দুয়ারে পাষাণ তালা (নবম কিস্তি)

আরমান

রেনোর বউ আগেই মারা গেছে। ছেলেমেয়ে কেউ নাই তার। বাচ্চাদের খেলকুদ, তাদের খুশি, হাসি-আনন্দ আর মাসুমিয়ত তার হামেশা ভালো লাগে।

‘লে আমার পুতলি, খা এইটা,’ রেনো একটুকরা বাতাশা দেয় শাদানের হাতে। বাতাশা দেইখা লাফ দিয়া আসে বান্দর। পরক্ষণেই রেনোর দাবড়ানি খাইয়া দূরে গুটিশুটি মাইরা বসে। শাদান বাতাশা কখনো চোষে, কখনো দুধের দাঁতে কুট কুট কইরা কামড়ায়।

অন্য কোনো দিন হইলে নুরা বেটির হাত থেকে বাতাশা কাইড়া নিয়া ঘিন্নায় দূরে ছুইড়া মারত। রেনো হাত লাগাইছে এমন খাবার খাওয়ার কথা সে স্বপ্নেও ভাবে নাই। রেনো আর তার বেরাদরির লোকেরা মরা জানোয়ারের গোশত খায়, আজিব কিসিমের সব মূর্তির সনে পূজাপেন্নাম করে। কিন্তু আজকে নিচা জাতের রেনো আপন তবকা আর এতেকাদ ছাড়াইয়া রহমতের ফেরেশতা হইয়া উঠছে। নুরারে আখ আইনা দেওয়া, শাদানরে হামদর্দি দেখানো—এরকম সিফত রেনোর মতন লোকের ভিতরেও যে থাকতে পারে, নুরা কস্মিনকালেও তা ভাবে নাই। অচিরেই তার পায়ের কাছের খরখরা জমিনে আখের ছোবার ঢের জইমা ওঠে। কিন্তু নুরার তিশনা মিটে নাই। জিহ্বা এখনও শুষ্ক ঠেকে তার। একচোখে সে তাকাইয়া থাকে আখের খেতের দিকে। মালিক জহিরের ভয় না থাকলে আরেক টুকরা আখ ভাইঙ্গা আনত সে। কিন্তু এক্ষণে হিম্মত হয় না তার। 

রেনো বুঝতে পারে কেন তার সামনে বসা নারীটা বারবার জিহ্বা দিয়া শুকনা ঠোঁট ভিজাইতেছে আর উদাস চোখে তাকাইতেছে খেতের দিকে, যেখানে ডাসা ডাসা সবুজ-লাল আখগুলা যেন রসে ফাইটা পড়বে দশা। সে খেতে গিয়া আরেকটা আখ ভাইঙ্গা আইনা নুরার সামনে রাখে। শাদিদ ভুখপিয়াসা সত্ত্বেও নুরা ভড়কায়, আখ হাতে নিতে ইতস্তত করে।

‘চিন্তা করিস না। খেত হইতে আমি আখ চুরাইছি। লোকে ধরলে আমারে ধরবে। মারলে আমারে মারবে। আমি ফকির মানুষ। সংসারে একজীবন কাটাইয়া গেছি। বুড়া মরলেও এমন কিছু যাবে-আসবে না।’

শোকরের চোখে রেনোর দিকে তাকায় নুরা—তার চেহারায় স্বস্তির ছায়া দেখা যায়। ফের আখ চাবাইতে শুরু করে সে। ভুখপিয়াসা খানিকটা লাঘব হইলে অতঃপর খানিক বাদে যখন কিছুটা ধাতস্থ হয়, চোখের সামনে ভাইসা ওঠে ওয়াজেদের করুণ দশা : তার দরদভরা মিনতি, গিড়গিড়াইয়া মারনেওয়ালাদের পায়ের ‘পরে দয়া ভিখ মাগা, কাপড়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ আর মুখে কাতর আহাজারি—সবটা পুনরায় ঘটে নুরার কল্পনায়। 

‘সে মইরাই গেছে শায়েদ,’ ধইরা আসা গলায় বিড়বিড় করে নুরা; দূরের পায়ে হাঁটা মাটিপথটার দিকে তাকাইয়া থাকে, যেখানটায় বাতাসের দমকে দেখা যায় ধুলার কুণ্ডলী উড়তেছে।

‘ওই পথটায় ইমাম ওয়াজেদরে ভাগতে দেখছিলাম। তার চেহারা জখমি আর কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল। বুঝলাম না তার এই দশা কেমনে হইল,’ হয়রান হইয়া বলে রেনো।

‘সে বাঁইচা আছে?’ অজান্তেই জিগেশ করে নুরা। অধীর চোখে তাকাইয়া থাকে রেনোর দিকে। জিন্দা থাকলে ওয়াজেদ তার কাছে আসতে পারে, ভাবে সে।

‘হাঁ হাঁ, বাঁইচা আছে। আমি নিজের চোখে দেখছি। জখমি দেহটা বহু কষ্টে টাইনা নিয়া যাইতেছিল রেলস্টেশনের দিকে। কিন্তু তুই..’ রেনো সওয়ালভরা নেগাহে নুরার দিকে তাকায়। 

‘ও খোদা, আমারে নিয়া যাও কিন্তু তারে বাঁচাইয়া রাখো,’ অন্তরের অন্তস্তল হইতে ফরিয়াদ আসে নুরার জবানে। তার অশ্রুভিজা আধবোজা নয়ন দেইখা রেনো বুইঝা ফেলে, মালিক জহিরের দাসী, যে ভুখপিয়াসায় কাতর হইয়া গাঁয়ের বাইরে বাইরে ঘুরতেছে আর ইমাম ওয়াজেদ, যে খুন লতপত দেহে রেলস্টেশনের দিকে ছুটতেছে, দোনোজনে আসলে এক কাহিনির দুই কিরদার, দোনোজনের ভিতরে জরুর কোনো রিশতা আছে যার দরুন তাদের কঠিন সাজা ভুগতে হইতেছে। 

কিন্তু আমার বেটি যদি এমন কিছু করত আমি তারে সাজা দিতাম? 

নুরার উদাস খুবসুরতি দেইখা রেনোর মনে হয় শায়েদ সে এমনটা করত না। নুরার জন্য মায়া লাগে তার। আগে জানত তো ইমাম ওয়াজেদরে থামাইত সে। বলত, ‘আসো আমার সাথে, আমি তোমারে লুকানোর জায়গা দেখাইতেছি। আন্ধেরা হইলে নুরার কাছে নিয়া যাব তোমারে।’ 

কিন্তু এখন এইসব ভাইবা কী ফায়দা? গুজরাইয়া যাওয়া পল ওয়াপেস আসে না। দুঃখের পলগুলি শুধু চোরাকাঁটা বিন্ধাইয়া যায় মনে, যার ছোবল হামেশা ফিরা ফিরা আসে।

অনেকটা সময় এমনেই চইলা যায়—শান্ত, নিস্তরঙ্গ, যেন কোথাও কিছু ঘটে না, যেন সময়ের পর্দা দূর দূর তক সবকিছুরে আচ্ছাদিত কইরা রাখে, আরও নিঝুম কইরা রাখে। রেনো চুপচাপ বইসা থাকে। নুরা থাইকা থাইকা চাপা আহশ্বাস ফেলে, ফের খামোশ হইয়া যায়। আখের খেতজুড়ে হুহু বাতাস বইতে থাকে। আর যে গাছের ছায়ায় তারা বইসা আছে তার ছায়া ঘনাইয়া আসে আরও। 

‘চল আমার সাথে। আন্ধেরা হইলে গাঁও চইলা যাইস।’ 

রেনোর দরদভরা কথায় ভরসা পায় নুরা। গাঁয়ের কারও সাথে নজর মিলানোর হিম্মত নাই তার। যেকোনো সময় যে-কেউ এদিকে আসতে পারে, এই ভাইবাও মনে আশঙ্কা জাগে।

ইঙ্গিত পাইয়া দূরে বইসা থাকা বান্দর দুইটা আবারও তাদের মালিকের দিকে আগাইয়া আসে ভয়ে ভয়ে, কিন্তু নুরা নিজের জায়গা থেকে নড়ে না। ঢিলা হইয়া আসা হাতে শাদানরে কোলে সামলাইয়া ভাবে এখন সে কী করবে।

‘চল পুত্তর, সন্ধ্যা হইল, এখন ঘরে চল,’ মাটি হইতে পাগড়ি আর ঝুলিটা তুলতে তুলতে রেনো তার বান্দরদের ডাক দেয়। লাফ দিয়া মালিকের কান্ধে চইড়া বসে ওরা। রেনো একপলক নুরার দিকে তাকায়। মাটির দিকে তাকাইয়া আছে সে, ভুরুজোড়া কুঞ্চিত, দ্বিধার দ্বন্দ্বে ভুগতেছে। রেনো বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

‘শোনো,’ পিছন থেকে ডাকে নুরা।

রেনো দাঁড়াইয়া যায়। কিন্তু নুরার কী বলবে বুইঝা পায় না। একজন আজনবিরে সে কেমনে বলে তার সাথে কী কী ঘটছে আর এখন সে কারও সাথে নজর মিলানোর কাবেলও থাকে নাই?

‘আমি.. আসলে.. বলতেছি যে.. আমি এখন গাঁয়ে যাইতে পারব না..’ আমতা আমতা করে নুরা।

একজন পূর্ণবয়সি নারী, খানিক আগে খাওয়া আখের রসে যার গাল আর ঠোঁট এখনো ভিজা, চুলগুলা এলোমেলোভাবে বিখড়াইয়া আছে ক্লান্ত চেহারার ‘পরে আর কোলে একটা দুধের কন্যাশিশু, তারে দেখায় অপ্রস্তুত কিশোরীর মতন অবুঝ।

‘ঘটনা কী, বেটি?’ রেনো জিগায়।

‘আর কী বলি? এ যদি ননির জান না হইত, কখন কুয়ায় ঝাঁপ দিতাম।’

‘বেটি.. আমার কথা শোন.. আয় আমার সাথে। আন্ধেরা হইলে গাঁও চইলা যাইস।’ রেনো স্নেহভরে বলে।

মধ্যবয়সি প্রৌঢ় লোকটার নরম স্বর আর খানিক আগে তার ও শাদানের জন্য যে হামদর্দি সে দেখাইছে তাতে নুরার মনে হয় এই লোকটারে ভরসা করা যায়। 

খারাপ হওয়ার আর কী বাকি আছে আমার সাথে? গাঁয়ের লোকেরা আমারে দেখলে থুথু দিবে। আর মালিক জহির ও তার বউ তো আমার মাথায় না জানি কোন কেয়ামত ভাইঙ্গা ফেলে। রাতটা কোনোভাবে কাইটা গেলে কোনো একটা উপায় বাহির হবে হয়তো। 

নুরা উইঠা দাঁড়ায়। শাদানের কোল বদল কইরা রেনোর পিছে পিছে হাঁটতে লাগে।

গ্রামের দূর দিয়া ঘুইরা একটা রাস্তা চইলা গেছে, দোনোজন সেই রাস্তা ধইরা হাঁটে একটানা অনেকটা পথ, তারপর একটা শুকনা নালা ধইরা আবারও একটানা অনেকটা পথ। আঁকাবাঁকা রাস্তাটা রেনো ভালো কইরাই চেনে। তার আশা, এই পথে কেউ তাদের দেখতেছে না। তবু মাঝেমধ্যে পিছন ফিরা সে নুরারে দেইখা নেয়, বারবার নিশ্চিত হইয়া নেয় সে ঠিকঠাক আসতেছে কি না।

সন্ধ্যার অন্ধকার ছাইয়া যায় যতক্ষণে তারা পৌঁছায়: একটা শুষ্ক অনাবাদী জায়গার ওপর কয়েকটা মাটির ঘর, সামনে তুলসীর চারার পাশে একটা চবুতরা, পাশেই বটগাছের কাণ্ডে লটকানো আজব কতক সফেদ নিশানি, যার কাছেই আছে লাকড়ির তৈরি মূর্তিগুলি। কয়েকটা ছোটো বাচ্চা খেলতেছে মাটিতে। একটা মাজাপড়া শীর্ণদেহের বুড়া বইসা আছে চবুতরায়, সাথে দুই বুড়ি। নুরারে দেইখা তারা চমকায় না, অবাক চোখে আপাদমস্তক দেখে শুধু। তারপর আপসে বিড়বিড় করতে লাগে। অচেনা নারীদের মাঝেমধ্যেই এরা এইখানে আশ্রয় পাইতে দেখে। পরে ভাগ্য তাদের কোনখানে নিয়া ফেলে তা নিয়া খুব একটা মাথা ঘামায় না তারা। 

‘এইখানে তোর একটা চুলও কেউ বাঁকা করতে পারবে না,’ রেনো নুরারে একিন দিলায়। সাথেই চবুতরায় বইসা থাকা এক নারীরে হুকুম দিয়া বলে, ‘গুমনিয়া, যা তো, বেটির জন্য দুধ নিয়া আয়।’

চলবে…

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷