দুয়ারে পাষাণ তালা (সপ্তম কিস্তি)
***
শহর থেকে হেকিম সাহেব আসছেন। হাবেলিতে উনার লগে বইসা শতরঞ্জ খেলতেছে মালিক জহির। সাদা চাদর বিছানো বিশাল পালঙ্কে দুজনে দুইটা বালিশে হেলান দিয়া আধশোয়া হইয়া বসা। পালঙ্কের মধ্যখানে তেপায়ার ওপর শতরঞ্জের বোর্ড বসানো। ছাদে লটকাইয়া রাখা একটা কাপড়ের পাখা টানতেছে এক জোয়ান নওকর। বারবার হাত বদলাইতেছে সে। শরীরের ভার একবার এই পায়ে দিতেছে তো আরেকবার ওই পায়ে। কিন্তু মালিক জহিরের হুকুমতে আরামের আশা মানে দুরাশা। হুকুম হইলে এক পায়ে খাড়াইয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাখা টানতে হয়। নওকর সেটাই করতেছে। সেই পাখারই মিহি বাতাস আর খানিক আগেই খাওয়া পরোটা, কাবাব আর ফিরনির স্বাদে মুখ চটকাইতেছে মালিক জহির আর হেকিম সাহেব। কয়দিন ধইরা মালিক জহিরের মনে সন্দেহ, তার পুরুষত্ব কমে যাইতেছে। শহর থেকে হেকিম সাহেব আসার এটাই কারণ।
হেকিম সাহেব মালিক জহিরের নাড়ি পরীক্ষা করেন, পেট টিপেটুপে দেখেন। জানান, সব ঠিকঠাকই আছে। টোটকা হিসাবে উনি আয়েন্দা রাতে গরুর অণ্ডকোষ খাওয়ার উপায় বাতলান : ‘এই জিনিস যদি ঘি, বাদাম, কিশমিশ আর গরম মশল্লায় পাকাইয়া খাইতে পারেন তাহলে আশা যে উহা আপনার জিনসি তাকতের লাই বহুত ফায়দামন্দ হবে। ইহা এমন টোটকা যা কোনোদিন বিফলে যায় নাই।’ হেকিমের টোটকায় মালিক জহির আশ্বস্ত হয়। শতরঞ্জের চালগুলার দিকে তার মনোযোগ আরও চতুর ও তীক্ষ্ণ হইয়া পড়ে।
কিন্তু খানিক বাদেই তার মনোযোগে ছেদ পড়ে। বাইরে হঠাৎ কীসের যেন শোরগোল শোনা যায়। হাবেলির দরজা খোলা হইতেছে। কে যেন আর্তনাদ করতেছে, দয়া ভিখ মাগতেছে। মালিক জহির চমকাইয়া ওঠে। এই ধরনের হইহাঙ্গামায় অভ্যস্ত না সে—খালি পায়েই ছোটে বাইরের দিকে। পিছে পিছে আসেন হেকিম সাহেব।
লোকটা ওয়াজেদ। কিষানদের ঘেরাওয়ের ভিতরে কাতরাইতেছে। মারের চোটে তার চেহারায় নীল দাগ জমে গেছে। মুখের একটা পাশ ফুলে আছে ভয়ানকভাবে। মাথার চুল আলুথালু, দাড়ি ধূলিধূসর আর কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। জহির নিজের চোখরে বিশ্বাস করতে পারে না।
‘কী হইতেছে এখানে?’ গজবনাক গলায় হুংকার দেয় জহির।
‘এই ছোকরা, এই ইমাম সাইজা বসা, মহা দ্বীনদার এলেমদার সাইজা বসা এই মহা হারামি ছোকরা, আমাদের নুরার লগে জেনা করতেছিল।’ উঁচা আওয়াজে ঘটনার জানান দেয় মজিদ। বলতে বলতে ঘিন্নায় থুতু মারে ওয়াজেদের গায়ে।
তব্দা খাইয়া যায় মালিক জহির। কপালে জাইগা ওঠে আক্রোশের বলিরেখা। ঘিন্নার আগুন ঠিকরাইয়া পড়ে চোখ থেকে। এমন একটা লোক যে কিনা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, যে কিনা তাহাজ্জুদগুজার, যার কেরাত এতটা শিরিন—লাগে যেন ফেরেশতার তেলাওয়াত, সেই লোকটা কেমনে জেনা করতে পারে? জেনা তো দূরের কথা, এরকম লোকের তো স্বপ্নদোষ হওয়াও উচিত না। কিন্তু ওয়াজেদের লুঙ্গিতে হলুদাভ দাগ সেটারই ইঙ্গিত দিতেছে। মজিদের সন্দেহই ঠিক তাহলে।
জহিরের লাগে, ওয়াজেদ তারে খুব বাজেভাবে ঠকাইছে। এরকম খচ্চর একটা লোকরে ইমামতির মতন ইজ্জতদার পদে বসাইয়া সে যে কত বড়ো ভুল করছে, তারও এহসাস হয়। তার ফয়সালাও যে ভুল হইতে পারে, এটা মানতে বেশি কষ্ট হয় তার।
ক্ষণকালের জন্য তার চোখ গিয়া পড়ে মজিদের ওপর। খাদেমের চোখে চমক। চেহারায় তৃপ্তির আভাস। মজিদ জানত ওয়াজেদ তাগড়া জোয়ান, মনোহরী নুরারে দেইখা তার জোয়ানি মোমের মতন গলতে পারে। এক ঘোর দুপুরে সে নুরারে মসজিদের দিকে যাইতে দেইখা ফেলে। এবং তার পরের দুপুরেও। সে বুঝতে পারে, শবে বরাতে নুরার হাতে খাবার পাঠাইয়া নিজের অজান্তেই সে যে তির ছুড়ছিল, তা জায়গামতো গিয়া লাগছে। তার জিত নসিব হইছে। বুড়ার ঝানু মগজের কাছে পরাস্ত হইছে দেওয়ানা মরদের জোয়ানি। সেই সাথে মজিদ সাবেত কইরা দিছে, তার মালিক এখনও তার কাছে সেই নাবালেগ জহির, তাই তার বুদ্ধিও নাবালেগ, এবং তার ফয়সালাও গলত হইতে পারে।
রাগে-গোস্সায় জহির তার মুঠি কষে। জেনা করছে তো করছে তাও আবার নুরার সাথে? তারই খায় তারই পরে যে নুরা? তার বেটা যার সাথে হামবিস্তরি করছে সেই নুরা? নুরার রগে-রেশায় তার বেটার খুন বইতেছিল, মানে তার আপনা খুন, এখন তাতে ওয়াজেদের খুনও গিয়া মিশল। নুরা তার খাদেমা ছিল, তার পাও দাবাইত। সুন্দরী বইলা তার পরশ জহিরের কাছে বিশেষ ছিল। কিন্তু আজকে এই ওয়াজেদ, এই হারামি, এই আত্মসাৎকারী, তার ইজ্জত, তার আবরু, তার মিলকিয়ত সব হাতাইয়া নিল।
‘ওরে এদিকে নিয়া আয়।’ হুকুম দেয় মালিক জহির।
এক তড়াক ঘাড়ধাক্কায় ওয়াজেদরে তার পায়ের কাছে আইনা ফেলে কিষানেরা।
‘রে নিমকহারাম! রে হারামজাদা!’ জহির গজরায়। পরক্ষণেই একটা দশাসই ঘুসি পড়ে ওয়াজেদের মুখে। তার ঠোঁট দিয়া রক্তের ফোয়ারা ছোটে। ফোলার ওপর ঘুসি পড়ায় জায়গাটা ডাইবা গিয়া আরেক দিকে ফুইলা ওঠে।
ওয়াজেদের করুণ দশা দেইখা হেকিম সাহেব দয়া খান। ‘যাইতে দেন মালিক সাহেব, খাওয়ার পরে ক্রুদ্ধভাব রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ হইতে পারে,’ সতর্ক করেন তিনি। তখন ওয়াজেদ ক্ষণকালের জন্য মাথা তুইলা তাকায় জহিরের দিকে। তার অশ্রুটলমল চোখে দয়াভিক্ষার ছাপ, আপন গুনাহের লাই শরমিন্দগি। তার ঠোঁট কাঁপে-কাঁপে। চেহারার রক্ত ময়লা আস্তিনে মুছতেই আবার গড়াইয়া আসে বাইরে।
হেকিম সাহেবের কথা কাজে আসে। জহির নিজেরে সংযত করে। কিষানদের হুকুম দেয়, ‘এই নির্লজ্জ হারামির মুখে চুনকালি মাখো। ওরে গাধার পিঠে তুইলা সারা গাঁও ঘুরাও। এরপর গেরামের বাইরে ঘাড়ধাক্কাইয়া বহিষ্কার করো।’
অচিরেই মালিকের হুকুম তামিল হয়। ওয়াজেদের মুখে চুনকালি দেওয়া হয়। গাধার পিঠে বসাইয়া সারা গাঁও ঘোরানো হয়। একজন ঢোল বাজাইয়া সামনে সামনে চলে। মধ্যখানে ওয়াজেদের গাধা হাঁটে। আর পিছে পিছে আসে কিষানের দল। ওয়াজেদের সনে তারা খিস্তি আওড়ায়।
যে-ই প্রথম এই তামাশা দেখে, হয়রান হয়। তবে বিস্তারিত শোনার পর তারাও ওয়াজেদের সনে গালি বকে। জিল্লতির মারে ওয়াজেদ মাথা ঝুঁকাইয়া থাকে। মইরা যাইতে মনে চায় তার। মনে চায় মাটির সাথে মিশা যাইতে।
‘বেইজ্জত ওয়াজেদ, তোর বাঁইচা থাকনের অধিকার নাই।’ বিড়বিড়াইয়া বলে ওয়াজেদ। তার চোখের পানি টপটপইয়া গড়াইয়া পড়ে গাধার পিঠে।
***
বিরান হাবেলি থেকে দিগ্বিদিক দৌড়াইতে দৌড়াইতে নুরা কবরস্তানে মায়ের কবরের শিথানের পাশে আইসা বসে। খানিক আগের ভীতিকর ঘটনায় কানতে কানতে ক্লান্ত শাদান, চুপচাপ মায়ের কোলে শুইয়া থাকে, থাইকা থাইকা তার হেঁচকির মতন ওঠে শুধু। নুরার চোখে আপন মাহবুবের লাই আঁসুর বহর, সেরেফ মহব্বতের খাতিরে যারে বাজেভাবে মার খাইতে হইছে। ওয়াজেদের সাথে তার জিসিমের রিশতা তার ওয়াফাদারির সবুত, তার ইশকের দায়, তার মজবুরি। ওয়াজেদের সাথে বাকি জীবন একসাথে থাকার ওয়াদা করছিল সে। কিন্তু যেই স্বপনের দুনিয়া নুরা এতটা যতনের সাথে এতটা আলগোছে গইড়া তুলছিল, মুহূর্তের ভিতর সব ভাইঙা চুরমার হইছে।
‘মা.. মা.. তুই কেন আমারে পেটে ধরলি.. কেন আমারে জনম দিলি.. খোদার দরবারে ক যেন আমারেও তোর কাছে নিয়া যায়। এখন তো আমার বাঁইচা থাকার কোনো উপায়ই থাকল না।’
বিরান কবরস্তানে কেউ নাই। শুধু নুরার করুণ বিলাপ বাতাসে বাতাসে বাড়ি খাইয়া ফেরে। নুরা মায়ের জীর্ণ কবরে মাথা কুইটা মরে। শবে বরাতের একদিন আগে কবরে যে গাঁদা ফুল দেওয়া হইছিল তা শুকাইয়া গেছে। নুরা সেই শুকনা ফুলের ওপর হাত বুলায়। একটা জামগাছের ছায়া আইসা পড়ছে মায়ের কবরের গায়ে। এমনই আরও কত কত গাছের ছায়ায় শুইয়া রইছে যুগ যুগ আগের কাঁচা-পাকা কবরগুলি সারি সারি, আর একটা অশ্বত্থের গাছে বইসা কা কা ধ্বনি তুলতেছে এক বিষণ্ণ দাঁড়কাক।
৩.
পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ঢইলা পড়ছে। ওদিকটায় দাঁড়াইয়া থাকা শিশমের গাছ আর ধূসর মাটির ঘরগুলিরে দেখাইতেছে ম্লান। কঠিন দাবদাহে লোকেরা ঘরের ভিতর ঘাপটি মাইরা আছে। বিপদে পড়া এক লোক উটে চইড়া যাইতেছে কোথাও। দূর থেকে ভাইসা আসতেছে একটা মহিষের ডাক। পশুটা ডাকা বন্ধ করতেই সান্নাটা ছাইয়া যায় আবার।
নুরারে না আকাশ নিয়া যায়, না তার মা কবরের মাটি ফাঁক কইরা তারে বুকে টাইনা লয়। লাগাতার কান্দার লাই তার চোখ জ্বলে। ব্যথায় টনটন করে যেখানটায় মজিদের লাঠির বাড়ি পড়ছিল। জালেমটার জন্য তার মুখ দিয়া গালি বাহির হয়। কাতরাইতে কাতরাইতে নুরা কবরস্তানের বাইরে আসে। হাঁটতে হাঁটতে সরু সেই পায়দল পথটার মুখে আইসা দাঁড়ায়। দুই পাশে আখের খেত। মাঝখান দিয়া রাস্তাটা গাঁয়ের দিকে চইলা গেছে। সেই পথ ধইরা নুরা কিছুদূর আসে। আবার দাঁড়াইয়া পড়ে। সামনে দূরে তার গাঁও দেখা যায়। সেই ঝিলের ধারে দাঁড়াইয়া রইছে বটগাছ, ঝুঁইকা পড়ছে পানির দিকে। সেই তার কুঠুরি, চালের ওপর লতাইয়া উঠছে শসার লতাপাতা। ওই যে মালিক জহিরের হাবেলি, পুরু কাঠের সদর দরজাটা বন্ধ, হয়তো জনমের তরেই তার জন্য বন্ধ।
পিপাসায় নুরার ঠোঁট আর জিহ্বা শুকাইয়া কাঠ। শাদানও অনেকক্ষণ ঘুমানোর পর জাইগা উঠছে। খিদার জ্বালায় ফুঁপাইতেছে এখন। কুঠুরিতে ফেরার জন্য নুরার দিল তড়পায়। কিন্তু এখন এই দিনের আলোয় সে কেমনে ঘরে ফেরে? লোকে দেখলে গালির তুবড়ি ছোটাবে। শক্ত সম্ভাবনা আছে মালিক জহির তারে কঠিন শাস্তি দিবে। নুরার পা জড়াইয়া আসে। খিদায় শাদানের কান্না বাড়ে। বেটির খিদা মিটাইতে নুরা স্তন তুইলা দেয় তার মুখে। শাদান মায়ের শুষ্ক স্তন জোরে জোরে চুষতে শুরু করে। বুকে চিনচিন কইরা ওঠে নুরার। বেটির মুখ থেকে স্তন ছাড়াইয়া নেয় সে। খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া ভাবে। কেন না সে মালিকের বাগান হইয়া শুকনা খালে নাইমা যায়? ওদিক দিয়া গেলে তার ঘরের দূরত্ব খানিকটা বেশি হয় ঠিক, কিন্তু ওদিকে লোকজনের আনাগোনা নাই। সম্ভাবনা বেশি যে কেউ তারে দেখবে না।
নুরা আবার চলতে শুরু করে। শিশমের গাছের কাছে আইসা দেখে, একটা লোক তার বান্দরদের সাথে নিয়া গাছে হেলান দিয়া আখ চাবাইতেছে। তার টাক মাথায় ঝালরের মতন পইড়া আছে একগাছি কাঁচাপাকা চুল। খাবলা খাবলা ভাবে বাইড়া উঠছে দাঁড়ি। চিনতে বেগ পাইতে হয় না নুরার। লোকটা রেনো, বান্দর সাথে নিয়া ডুগডুগি বাজাইতে বাজাইতে প্রায়ই গেরাম চক্কর দেয়। দুই মাইল পুবে যে কতগুলি ঝুপড়িঘর আছে, সেখানেই তার বসত।
আচমকা নুরারে দেইখা ঘাবড়াইয়া যায় রেনো। হাতের ইক্ষুটা ছুইড়া মারে দূরে। অবশ্য ভুইলা যায় যে তার মুখ আর দাঁড়ি আখের রসে ভিজা।
দূর-দূর তক যত খেত দেখা যায়, সবই মালিক জহিরের। তার এজাজত ছাড়া খেতের কিছু খাওয়া চুরির শামিল। ধরা পড়লে শক্ত সাজা মিলবে সন্দেহ নাই।
‘গেরামে গেরামে ঘুইরা ভুখ-পিয়াসায় মরণদশা আমার। এই নরকের আগুন না নিভাইয়া বাঁচি কেমনে?’ বলতে বলতে রেনো তার ছিঁড়াফাটা কোর্তা উঠাইয়া দেখায়। না খাইয়া থাকতে থাকতে তার পেট-পিঠ সমান হইয়া গেছে।
কালো শীর্ণ ক্ষীণ ক্ষয়িত একটা লোক, তার চ্যাপ্টা চেহারা আর গর্তের মতন ভিতরে ঢুকানো বুক-পেট ঘামে ভিজা, ময়লা পাগড়িটা মাটিতে ধ্যাধরাইতেছে, এই অবস্থাতেও লোকটার মুখে অপরাধের স্বীকারোক্তি। অন্য কোনোদিন হইলে নুরা ঘিন্নায় মুখ ফিরাইয়া নিত। গাঁয়ের লোকেরা রেনো ও তার মতন যারা আছে তাদের নীচ ভাবে। নুরাও তাই ভাবত। কিন্তু এখন রেনোরে কেমন যেন আপনা লাগে তার। দুজনাই এমন পথের পথিক, যার শেষ কোথায় জানা নাই। নুরা নরম চোখে রেনোর দিকে তাকাইয়া থাকে।
হঠাৎ থমকাইয়া দাঁড়ানো মহিলার চোখে দয়ার ছাপ দেইখা রেনোর হিম্মত হয় খানিকটা। মহিলার ঠোঁট শুকনা, চেহারা মলিন, মুষড়াইয়া পড়ছে দেহ, সে তাকাইয়া আছে ওই আখটার দিকে যেটারে খানিক আগে রেনো ছুইড়া মারছে দূরে।
রেনো আখটা পুনরায় কুড়াইয়া আনে এবং দুই ভাগ কইরা ভাঙে। কিছু বলার আগেই নুরার হাতে একটা ভাগ গুঁইজা দিয়া বলে, ‘নাও, খাও এইটা।’
ইক্ষু হাতে নুরা ধপাস কইরা মাটিতে বইসা পড়ে। অস্থিরভাবে দাঁতে ছিলতে থাকে আখের ছাল। মশমশ কইরা কামড় দিয়া চিবাইতে থাকে। আখের মিঠা রস তার জিহ্বায় লাগে আবেহায়াতের মতন। কিছুক্ষণের জন্য দুঃখ ভুইলা যায় নুরা। প্রাণের ক্ষীণ স্রোতধারা বইতে শুরু করে তার শিরায়-উপশিরায়। ঘোলাটে চোখে চমক আসে খানিকটা। রসের প্রতি ফোঁটা তার পিয়াসা আরও বাড়াইয়া দেয়, সেই সাথে খিদাও।
নুরারে দেইখা বান্দর ভয় পাইয়া রেনোর কান্ধে চইড়া বসছে। বান্দরের লাফঝাঁপ আর গায়ের লাল কাপড় দেইখা শাদান হাইসা ওঠে।
‘তোরে মেলা ক্লান্ত দেখাইতেছে। খেতে কাম করতেছিলি। তা আখ কাটা কি শুরু হয়ে গেছে?’ রেনো জিগেশ করে। নুরার বিধ্বস্ত দশা দেইখা এমনটাই আন্দাজ হয় তার।
নুরা কথা বাড়ায় না। সমর্থনে মাথা নাড়ায়। আখের যেই টুকরাটা ভালোভাবে চাবায় নাই, সেটা শাদানের মুখে পুইরা দেয়। ছোট্ট মানুষ, দুধও ছাড়ে নাই এখনও, কষ্টেমষ্টে দুইটা কি তিনটা দাঁত গজাইছে কি গজায় নাই, একটু চোষার পর মিষ্টি বুইঝা গিলতে গিয়া বিপদে পড়ে। আখের টুকরা তার গলায় ফাঁইসা যায়। ভয়ানকভাবে খকখক করতে লাগে শাদান। দম আটকাবে আটকাবে এমন সময় রেনো ছুইটা আসে, শাদানের মুখের ভিতর আঙুল ঢুকাইয়া বের কইরা আনে টুকরাটা। কষ্টে শাদান চিৎকার দিয়া ওঠে।
‘বেকুব মহিলা.. বেটিরে মারবি নাকি?’ নুরারে ধমক লাগায় রেনো।
‘না না না বেটি কান্দে না। এই দেখ বান্দরের নাচ দেখ।’ রেনো শাদানরে চমকায়। মাটিতে রাখা ডুগডুগিটা বাজাইতে শুরু করে।
শেষ বিকালের সান্নাটায় ডুগডুগির ডুগ ডুগ শব্দ বাতাসে মিলাইতে থাকে। ডুগডুগির শব্দে রেনোর দুই বান্দর ভাবে তাদের ডাক পড়ছে। মালিকের কাঁধ থেকে লাফাইয়া নামে ওরা। প্রশিক্ষণ মোতাবেক মাথায় হাত রাইখা নাচতে শুরু করে। দেইখা শাদান অবাক হইয়া কান্না বন্ধ করে। বান্দরদের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে তার মুখে আবার হাসি দেখা যায়।
‘বাদশা.. মহারানি.. এইবার থাম। সারাদিন নাইচা নাইচা তোরা ক্লান্ত। এইবার আরাম কর।’ রেনো পেয়ারের সাথে তার বান্দরদের ডাকে। বারবার হাত বুলাইয়া দেয় ওদের মাথায়।
চলবে…