দুয়ারে পাষাণ তালা (প্রথম কিস্তি)

মূল : মুস্তফা করিম

আরমান

সৈয়দ মুস্তফা করিম। পয়দায়েশ ১৯৩২ ইসায়ি। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে বি.এস.সি. ডিগ্রি হাসিল করেন। এম.বি.বি.এস. করেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। ১৯৮৩ সালে করাচি থেকে পাবলিশড হয় উনার নভেল ‘গর্ম দিন’। ২০০৮ সালে দিল্লি থেকে পাবলিশড হয় উনার অন্যতম সেরা নভেল ‘রাস্তা বান্দ হ্যয়’। ২০১১ সালে করাচি থেকে পাবলিশড হয় আরেকটা নভেল—‘কুরতাবা’। এ ছাড়াও প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সফরনামা, তারিখি নভেল ও আদবি তানকিদের ওপর উনার একাধিক বই প্রকাশিত ও সমাদৃত। মুসান্নিফ বর্তমানে ব্রিটেনে বসবাস করতেছেন।—অনুবাদক।


১.

মসজিদে আজকে সব বয়সের নামাজি আসছে। ফরাশের ওপর বিছানো চাটাইয়ে বইসা আছে সবাই। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়জন ছাড়া কেউই মসজিদে নিয়মিত আসে না। জুমার দিনেও না। কিন্তু আজকের রাত গুরুত্ববহ। বরকতময় আর পবিত্র। আজকে শবে বরাত। খোদার হুকুমে এই রাতে ফেরেশতারা রিজিক বাঁটেন। এই রাতের কদর করছেন স্বয়ং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

এবাদতগুজারদের সামনে রেহেলের ওপরে কোরআন খুইলা রাখা; জাফরানরঙা পৃষ্ঠাগুলা লন্ঠনের ঝলমলে আলোয় উজ্জ্বল হইয়া ওঠে। তেলাওয়াতকারীদের আঙুল কালো হরফের নিচ দিয়া চইলা যায় ধীরে ধীরে। তাদের মাথা মৃদু তালে দুলতে থাকে। যেন এক ঝুমের মধ্যে, এক দোলকের মধ্যে বাস করতেছে ওরা; যেন কোনো অতীন্দ্রিয় রহস্য জাইনা ফেলছে, যেখানে আছে আত্মমগ্নতা, আছে নেশাজাগানিয়া ঘোর।

গম্বুজগুলা গুঞ্জরিত হইয়া ওঠে তেলাওয়াতের সুরে। অনেকগুলা ফানুস নাইমা আসছে গম্বুজের গা থেকে, ধুলামলিন, হলুদ ফ্যাকাশে চেহারার মতন, ধূসর। তাকের ওপরে জ্বলতেছে আগরবাতি। ধোঁয়ার সর্পিল রেখা ঘুরতেছে তাকের কালো অন্ধকারে, ধীরে ধীরে, লাগে বিষণ্ন। এক নেশাধরা সুবাস ছড়ায়ে পড়ছে চারদিকে।

মিম্বারে বইসা আছে যুবক বয়সী ইমাম ওয়াজেদ শাহ, এত মুসল্লির সমাগম দেইখা খুশি, এবাদতে ওদের মগ্নতা দেইখা উচ্ছ্বসিত। তার আবরু সামান্য কুঁচকানো, চোখে আত্মগর্বের উঁকি।

ওয়াজেদ শাহ কোট ফাতাহ খানের মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হইছে এক মাস আগে। সেদিন থেকে মুসল্লির সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই আছে। আর আজকে তো মুসল্লিরা শুধু মসজিদের ভিতরেই না, বাইরের চত্বরেও বইসা আছে কাতারের পর কাতার।

তীব্র গরমের সময়। রাতেও প্রচুর গরম। কিন্তু আজ থাইকা থাইকা এক দমকা হাওয়া আইসা সবাইরে শীতল পরশ দিয়া যায়। দূরে কোথাও বৃষ্টি হইতেছে, অনেকেই তা খেয়াল করে; কিন্তু এশার নামাজ শেষ হইছে সেই কখন তারপরেও কেউ উইঠা যায় না, বরং শবে বরাত উপলক্ষ্যে যে বিশেষ দোয়া হবে, বইসা বইসা তার অপেক্ষা করে।

‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’, ওয়াজেদ শাহ বলে।

এবাদতগুজাররা থাইমা যায়। তেলাওয়াতকারীরাও চুপ। ওয়াজেদ শাহ আবেগভরা গলায় উঁচা আওয়াজে একটা সূরা থেকে কেরাত পড়তে শুরু করে; তার সুন্দর লাহান শ্রোতাদের মন ছুঁইয়া যায়। যখনই ওয়াজেদ শাহ পড়া থামায়, মুসল্লিরা একযোগে আমিন বইলা ওঠে। তারা আয়াতের অর্থ বোঝে না ঠিক, কিন্তু বরকতময় কিতাবের পবিত্র আয়াতগুলি তাদের চিন্তা, তাদের অনুভবের সবটুকু দখল কইরা নেয়। আল্লাহ-রাসুলের স্মরণে তাদের ইমানে জোশ আসে। কয়েকজন অনুভব করতে পারে এই জীবন কত ক্ষণস্থায়ী আর তুচ্ছ; তাদের মনে পইড়া যায় অতীত জীবনের পাপের কথা, ক্ষমার অযোগ্য সেসব পাপ। তাদের মুখে অনুশোচনার শব্দ শোনা যায়। চোখ ভিজা ওঠে অনুতাপের অশ্রুতে।

ওয়াজেদ শাহ চোখ বন্ধ কইরা খোদাতালার গভীরে ধ্যানে ডুব দিতে চায়। পারে না। তার বারবার মনে আসে খালি নিজের কথা, নিজের খুবি, গুণগরিমা আর রুহানি শক্তির কথা, যার প্রভাবে মুসল্লিরা আচ্ছন্ন। ওরা এক দৃষ্টিতে তাকায়ে আছে ওয়াজেদের দিকে;—সুন্দর শ্যামলাবরণ চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ, কালো একগাছা দাড়ি, সরু গোঁফ; খাড়া নাকের ওপর একটা লাল আঁচিল; পরনে সাদা কুর্তা আর লাল সালোয়ার, মাথায় সামান্য তেরছামতো পাগড়ি।

সূরা শেষ কইরা ওয়াজেদ শাহ প্রথমে রাসুলে পাকের নামে, তারপর মরহুম বুজুর্গদের নামে ফাতেহা পাঠ করে। বুজুর্গদের ইয়াদে তার মনে কেমন উদাসভাব ছাইয়া যায়। খানিকটা বিষণ্ন হইয়া পড়ে সে। যথাসম্ভব নিজেরে সংযত রাখার চেষ্টা করে। ফাতেহা শেষে সে আলতো কইরা চেহারায় হাত মোছে। মুসল্লিরা সবাই ওয়াজেদের সাথে ফাতেহা পড়তেছিল কেমন অস্থিরভাব নিয়া, অধৈর্য। ফাতেহাপাঠ শেষ হইতেই তারা দ্রুত দাঁড়ায়ে পড়ে। হুলুস্থুল বাইধা যায় তাদের পোশাকের খসখস আর পায়ের ধপধপ শব্দে। সবাই যার যার কোরআন শরিফ নির্দিষ্ট তাকে রাইখা একে একে মসজিদ ছাইড়া যায়। কেউ কেউ যাওয়ার আগে ওয়াজেদের সাথে মুসাফাহা করে আর সেই হাত ভক্তিভইরা বুকে লাগায়; যেন ওয়াজেদের হৃদয়ের পবিত্র উষ্ণতা শুইষা নিবে।

দ্রুতই মসজিদ খালি হইয়া যায়। দাঁড়ায়ে থাকে কেবল কোট ফাতাহ খানের মালিক—মালিক জহির। তার ছাইরঙা মোচ-দাড়ি কানের দিকে বাঁকায়ে তোলা। জামায় লাগানো সোনার বোতাম। নিজের বিনয় আর তুচ্ছতা জাহির করতে সে ইবাদত করতেছিল মসজিদের ভিতরের একদম শেষ কাতারে বইসা। ইমাম ওয়াজেদের মায়াবী সুরে তার হৃদয়ে ইশকের জোয়ার আসছিল। আবেগের বিহ্বলতায় ভিজা উঠছিল দুই চোখ। সেই ঘোর কাইটা যাইতেই সে দেখে, যেখানে সে বইসা আছে তার অদূরে, এক কোনায় কিছু কবুতরের পালক আর শুকনা পাতার ছোটোখাটো স্তূপ জইমা আছে।

মসজিদ সাফাইয়ের দায়িত্ব ওয়াজেদের কাঁধে। এ কেমন দ্বীনদার, যে আল্লাহর ঘর সাফসুতরা রাখার প্রয়োজন বোধ করে না? এই মসজিদ তো তেমন বড়োও না যে ওয়াজেদের মতন তাগড়া যুবক সেটা পরিষ্কার রাখতে পারবে না, মালিক জহির ভাবে।

রাগে তার চোখ বিবর্ণ আর চোয়াল শক্ত হইয়া আসে। বইসা বইসা সে মুসল্লিদের ইবাদত শেষ হওয়ার এন্তেজার করে। এরপর সব মুসল্লি বের হইয়া গেলে সে হাতের ইশারায় ওয়াজেদরে ডাকে। হাসিমুখে আগায়ে আসে ওয়াজেদ, মালিক জহিরের রাগের ব্যাপারে বেখবর সে, উলটা আশা করতেছে, বখশিশ মিলবে হয়তো।

‘তুমি মসজিদ সাফাই করো না?’ গর্জে ওঠে মালিক জহির, গজবের মতন শোনায় তার আওয়াজ। হাত দিয়া ইশারা কইরা সে ময়লার দিকে দেখায়—‘কী নোংরা ওইখানে।’

ওয়াজেদের পা জইমা যায়। মনে হয় কেউ যেন তার পায়ের নিচ থেকে চাটাই সরায়ে নিয়ে নিচে বিছায়ে দিছে ধারালো কঙ্কর। ধড়ফড় শুরু হয় তার বুকে। কপালে দেখা দেয় বিন্দু বিন্দু ঘাম। মালিক জহিরই তারে ইমাম নিযুক্ত করছে। বেতনও সে দেয় আর তার খাবারও মালিক জহিরের ঘর থেকেই আসে।

মালিক জহির কোট ফাতাহ খানের হুকুমরান, কর্তাব্যক্তি। চারদিকে দূর দূর পর্যন্ত ছড়ায়ে আছে তার জায়গাজমিন। সে যখন মসজিদে আসে কিংবা গ্রামের পাশ দিয়া যায়, পথেঘাটে লোকেরা তারে মাথা ঝুঁকায়ে সালাম করে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে ভক্তিবশত।

ওয়াজেদ মালিক জহিরের কাছের কেউ না। একটা মামুলি প্রজার চাইতে বেশি না তার অওকাত। এমন কারও সাথে মাঝেমধ্যে যেমন হালপুরসি[1]ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা। করা যায়, আবার চাইলে এক সেকেন্ডের সিদ্ধান্তে তারে ছুইড়াও ফেলা যায়। ওয়াজেদরে ছুইড়া ফেলতে মালিক জহিরের দুইবার ভাবতে হবে না।

ওয়াজেদ চুপসায়ে যায়। বহু কষ্টে আমতা আমতা কইরা বলে—

‘আমি.. সাফাই করি.. রোজানাই করি.. আজ একটু দেরি হয়ে গেছিল.. অন্ধকারের কারণে ফরাশের ওই দিকটা বাকি থাইকা গেছে।’

সত্যি বলে ওয়াজেদ। গাঁয়ের যেসব ছেলে তার কাছে তালিমের জন্য আসে, তাদের সাথে নিয়া রোজানাই সে মসজিদ সাফাই করে।

‘সামনে থেকে খেয়াল রাখবা। এটা খোদাতালার ঘর। সবসময় যেন সাফসুতরা থাকে।’ হুকুমের স্বরে বলে মালিক জহির। বলতে বলতে কড়া চোখে তাকায় ওয়াজেদের দিকে। নিজের ক্ষমতা কখন ও কোথায় জাহির করা লাগবে খুব ভালো কইরাই জানে সে।

ওয়াজেদ মাথা নাড়ে। মাটির দিকে তাকায়ে থাকে অনুতাপে। এতটা খারাপভাবে বকায় কষ্ট লাগে তার। মন ভাইঙা যায়।

লন্ঠনের আলোয় দুজনের ছায়া দীর্ঘ হইয়া কাঁপতে থাকে দেয়ালের গায়ে। কোত্থেকে এক উদাস হাওয়া ওঠে বাইরে, অশ্বত্থের পাতাগুলারে তিরতির কইরা কাঁপায়। এরপর আর কোনো শব্দ নাই। একটা অবশ নীরবতা ছড়ায়ে পড়ে চারপাশে।

রাগ পইড়া যাওয়ার পর মালিক জহির বুঝতে পারে, ওয়াজেদের সাথে সে বাড়াবাড়ি কইরা ফেলছে। এভাবে না বকলেও চলত। খানিকটা নরম হইয়া আসে তার মন।

ওয়াজেদ মাথা উঠায় না। মাটির দিকে তাকায়ে তাকায়ে ভাবে, সামান্য একটা ভুলের জন্য কীভাবে তারে বকা হইল, যেন সে কোনো মামুলি খাদেম, একটা লাচার ইনসান, যারে ছোটোখাটো ভুলচুকের জন্য যখন-তখন অপমান করা যায়। ইমামের এই পদরে বেহুদা মনে হইতে থাকে তার।

মালিক জহির বুঝতে পারে ওয়াজেদের মনের অবস্থা। কিন্তু ওয়াজেদের কাছে মাফ চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওয়াজেদরে খাওয়ায় সে, পরায় সে, দুই-চারটা কথা শোনানোর অধিকার তার আছে। ওয়াজেদ ভুল করছে বলেই তারে ধমকাইছে সে। জহিরের ওপর ফরজ ছিল এইটা। ওয়াজেদের জায়গায় অন্য কেউ হইলে তারে পিটানো হইত।

‘তুমি কি এইখানে খুশি?’

‘জি, আল্লাহর দয়ায়।’ ওয়াজেদ উদাস গলায় জবাব দেয়।

‘ভালো। এখন আমি যাইতেছি।’ থমথমে গলায় বলে মালিক জহির। পা বাড়ায় দরজার দিকে। ওয়াজেদও মাথা ঝুঁকায়ে দুর্বল পায়ে তার পিছু নেয়।

এক বুড়া চাকর লন্ঠন হাতে দাঁড়ায়ে থাকে উঠানে, মালিক জহিরের অপেক্ষা করে। তার চেহারায় বিদ্রূপের হাসি—ওয়াজেদের দিকে ফিরাও তাকায় না সে। মালিক জহির জুতা পরে। ছড়ি হাতে নিয়া খাড়া হয়। এরপর ওয়াজেদের বিদায়ি সালামের জবাব দিয়া চাকরটারে সাথে নিয়া পথ চলতে শুরু করে। কিছু সময় যাবৎ বাতাসে তাদের পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। এরপর আবার সুনসান নীরবতা।

একা হইয়া পড়ে ওয়াজেদ। একটা গুমোট নিঃসঙ্গতা জাঁইকা বসে তার সর্বসত্তায়। এই বোবা পাথরসময় কীভাবে কাটবে তার জানা নাই। গ্রামে এখনও পর্যন্ত তার কোনো বন্ধু হইয়া ওঠে নাই যার কাছে গিয়া সময় কাটানো যায়। একটা দুঃখভরা লাঞ্ছনার অতীত তার সত্তার অনিবার্য অংশ হইয়া অবিরাম তারে তাড়া কইরা ফিরে। অনেক ভাবনার পরেও সেই ধূসর অতীতের মাঝে একখণ্ড সুখের স্মৃতি খুঁইজা পায় না সে, যারে আঁকড়ায়ে ধইরা একটু শান্তি মিলতে পারে।

শবে বরাতে ওয়াজেদের মনে গোপন আশা ছিল মালিক জহির হয়তো তারে রাতের খানার দাওয়াত দিবে। কিন্তু বেজার হইয়া বাড়ি ফিরছে মালিক জহির। মসজিদের উঠানে উদাস পায়চারি শুরু করে ওয়াজেদ।

এখনই হয়তো কোনো চাকর আমার জন্য খাবার নিয়া আসবে। খানা খাইয়া আমি দোয়া-অজিফায় মশগুল হইয়া যাব, তারপর গভীর ধ্যান, খোদার তাসাব্বুরে বিলীন হওয়ার চেষ্টা, তারপর তাহাজ্জুদ আর সকালের ইবাদত শেষে আবার রোজকার মতন গ্রামের বাচ্চাদের কোরআন শিখানো, হস্তলিপির পাঠ দেওয়া। প্রত্যেকটা দিন একইরকম কাজ। একইরকম ব্যস্ততা। এইসব ছাড়া আর কিছুই নাই আমার জীবনে?

নিজেরে প্রশ্ন করে ওয়াজেদ। একটা গুমোট ব্যথামোড়া অস্থিরতা তার সর্বসত্তা তোলপাড় কইরা তোলে। ফের মনে পড়ে অতীতের কথা: বাপের মৃত্যু। খুব ছোটো যখন ছিল, তখন একদিন, তার মনে আছে, বাপের খুন-লতপত লাশ আনা হইল হাবেলিতে, যেখানে তার মা চাকরানির কাজ করতেন। সেদিনের পর থেকে মায়ের দিনরাত কাটত বিলাপে আর আহাজারিতে। কয়দিন পর যখন দুঃখের তাপ কইমা আসলো, রাতবিরাতে তারে শোয়াইয়া রাইখা ঘর ছাইড়া কোথায় জানি বাহির হইয়া পড়তেন উনি। শেষমেশ চাকরানির কাজটা গেল। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারাইল তারা। রাত নামলে এই বাড়ি-ওই বাড়ির বারান্দায়, ভাঙা কুড়েঘর আর বিরান ঝুপড়ির তলে দিন কাটতে লাগল তাদের। যখন তার বয়স চার বছর হইল, কোনো এক ঈদে তার মা তারে ঈদগাহে রাইখা নিরুদ্দেশ হইলেন জনমের তরে। তার পরওয়ারিশ হইল এতিমখানায়, যেখানে তার চেয়ে বয়সে বড়ো ছেলেরা তারে দুর্ব্যবহার দিয়া মানুষ করছে। হাফেজ না হইলে আর কেরাত সুরেলা না হইলে না-জানি তার কী হাশর হইত।

একটা মাদরাসায় উস্তাদির কাজ পাইল সে। যে বেতন মিলত, তা দিয়া কোনোমতে দিন কাটানো যায়। কেউ কোনোদিন তার বন্ধু হইয়া ওঠে নাই। তারও সবাইরে পর-পর লাগে। একটা দুঃখজর্জর অন্তর তার, যেখানে না আছে মহব্বত, না আছে আপনতা। মায়ের কথা মনে পড়লে ঘিন্না আসে। উনি যদি তারে ছাইড়া নিরুদ্দেশ না হইতেন, তাহলে আজকে তার একটা ঠাঁই থাকত। মনের কথা শোনার মতো কেউ তো থাকত!

উঠানের এক পাশে আইসা বসে ওয়াজেদ। চোখ বন্ধ কইরা হাতের তালুতে মুখ ঢাকে। পায়ের নিচের মাটির ঠান্ডা পরশ অনুভব করার চেষ্টা করে। একটা শীতলভাব ছড়ায়ে পড়ে তার সর্বশরীরে। নিরুত্তাপ নিঃসঙ্গ একটা রাত দীর্ঘ হইয়া ঝুইলা আছে। আসমানে বিছায়ে আছে তারার দল, জায়গায় জায়গায় সাদা ধুলার মতন দেখায়। মাঝখানে সাপের মতন কুণ্ডলী পাকায়ে আছে চাঁদ, বিষের নীল আলো ফেলতেছে তার গায়ে। মসজিদ সুনসান। উঠানের অন্যপাশে বটের ঘন ডালপালা দেইখা মনে হয় জটাধারী পাগলের দেহ।

ওয়াজেদ কুর্তার বোতাম খোলে। মাথা থেকে পাগড়ি নামায়ে রাখে পাশে। ঘামে ভেজা মাথা ও বুকে ঠান্ডা হাওয়া তার ভালো লাগে। মন খানিকটা ফুরফুরা হয়। চারদিকে নজর বুলায় সে।

মসজিদের সামনের জায়গাটা প্রশস্ত। চারপাশে ঘন ঝোপঝাড়। মাঝখানে পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে সরু ঝরনাধারা। অদূরে দাঁড়ায়ে আছে এক জরাজীর্ণ বিরান হাবেলি, যার ধইসা পড়া ছাদ রাতের অন্ধকারেও চোখে পড়ে। দিনের বেলায় সে গিয়া বইসা থাকে হাবেলিতে, ধ্বংসস্তূপের পাশে, তখন সে ছাড়া আর কেউ থাকে না ওইখানে। সুনসান হাবেলিতে সময় কাটাইতে তার ভালো লাগে। বেশিরভাগ সময় হাতে থাকে কোনো বুজুর্গের লেখা কিতাব, যেটা পড়ার সুযোগ তার কমই হয়। হাবেলিতে তার সময় কাটে ভাবনায়, নানান অবাস্তব স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে।

ওয়াজেদ শুনছে, সে যেই মসজিদের ইমাম, সেই মসজিদটা বানাইছিলেন এই ধ্বংসপ্রায় হাবেলির মালকিন। পেশায় উনি ছিলেন নর্তকী। পরে তার শাদি হয় কোট ফাতাহ খানের এক বড়ো জায়গিরদারের সাথে। নিঃসন্তান ছিলেন। মসজিদ বানাইছিলেন যাতে খোদা খুশি হইয়া তার কোল ভইরা দেন। কিন্তু কাজ হয় নাই। দুঃখ সইতে না পাইরা উনি খুদকুশি[2]সুইসাইড করেন। বউমরার দুঃখে পাগল হইয়া মারা যান তার স্বামী।

হাবেলিতে পায়চারি করার সময় ওয়াজেদ সেই নর্তকীর কথা ভাবে, তার খুবসুরতির তাসাব্বুর করে। কল্পনায় দেখে তার নাচের ভঙ্গি, তার দিনরাতের আয়োজন আর ব্যস্ততা। এইসব কল্পনার ভিতরে এক ধরনের নেশা আছে, ঘোর আছে, একটা না-বলা আনন্দ আছে।

আচ্ছা, সব নারীই কি নাচে? ওই নারীরাও কি নাচে যারা মসজিদের ঝরনা থিকা পানি লইতে আসে, যাদের জোয়ান বাহুর অবিরাম নড়াচড়া, মাংসবহুল রানের হরকত আর যৌবনভরা দেহের আন্দোলন আমার চোখরে গুনাহগার বানাইয়া দেয়? বেশিরভাগ সময় ওয়াজেদ এইসব ভাবনার মধ্যে গুম হইয়া যায়।

আসমানে আচানক আতশবাজি ফুটতে শুরু করে। লাল-নীল-সোনালি-সবুজ রঙের ঝলকানিতে আলো হইয়া ওঠে আসমান। গাঁয়ের দিক থেকে ভাইসা আসে উৎসবে মত্ত মানুষের হাসির আওয়াজ। ওয়াজেদেরও মন চায়, ওইখানে যাবে; লোকজনের খুশিতে শরিক হবে; হাসিমজাক করবে, কৌতুক বলবে আর শুনবে, ভাগদৌড় খেলবে। কিন্তু সেইটা কেমনেই বা সম্ভব। তার প্রতিদিনকার এবাদত আর ইমামতির মতন ইজ্জতদার পদ লোকসমাজে তারে যেভাবে পরিচয় করাইছে, যেভাবে তার সত্তারে একটা লোহার পিঞ্জিয়ার আটকায়ে দিছে, সেইটা ভাঙা বহুত মুশকিল তার জন্য, হয়তো অসম্ভবই।

ও খোদা, এ কেমন তনহায়ি.. কেমন বন্দিদশা.. যেটা থেকে আমি বেরোইতে পারতেছি না। তুমি একটা উপায় বের করো মাবুদ।

নিজের মনে বলে ওয়াজেদ। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নাই। রাতের থমধরা খামোশি তারে নিয়া উপহাস করে।

মসজিদের দরজা এখনও খোলা। ওখান থেকে লন্ঠনের কম্পমান মরা আলো উঁকি দিতেছে উঠানে। ওয়াজেদ মসজিদের ভিতরে যায়। চাটাইয়ের বাঁকাত্যাড়া কাতারগুলা সোজা করে। লন্ঠন নিভায়। এরপর বাইরে আইসা দরজা বন্ধ করতে লাগে। কোত্থেকে এক দমকা হাওয়া তখন উড়ায়ে নিয়া আসে একরাশ তাজা ফুলের সুবাস। হাবেলির ভিতরকার ফুলগুলাই হয়তো। বাতাসের ঝাপটা তার ভালো লাগে। মন খানিকটা হালকা হয়। বুক ভইরা লম্বা লম্বা শ্বাস নেয় ওয়াজেদ। ফুরফুরা মন নিয়া রাতের নেশাধরা আকাশের দিকে তাকায় খোদার তালাশে। আসমানে দূর দূর পর্যন্ত ছড়ায়ে আছে তারার গরদিশ[3]পরিভ্রমণ। নির্লিপ্ত এক মহাশূন্য।

জোর কদমে ওয়াজেদ তার কুঠুরির দিকে যায়। মসজিদের দেওয়ালের সাথেই লাগানো সেটা। ভিতরে ঢুইকা মাটিতে রাখা লন্ঠনটা দেওয়ালে গাঁথা একটা পেরেকের সঙ্গে টাঙায়। আগুন খানিকটা তেজ করে। এরপর তাকের ওপরে রাখা পুরাতন কিতাবাদির স্তূপ থেকে একটা কিতাব হাতে নিয়া পালঙ্কের ওপর আইসা বসে। পৃষ্ঠা উলটাইয়া পড়তে শুরু করে :

এলেম দুই প্রকার : অভৌতবিদ্যা, আর মানুষের ভৌতজগতের বিদ্যা। লাস্টেরটার আলাপ বেকার, হুদাই সময় নষ্ট। কারণ মানুষ মরণশীল। অন্যদিকে অভৌত বিদ্যাগুলার মাধ্যমে মানুষের সামনে ওইসব রহস্যের জট খোলে, যেগুলার ব্যাপারে সে হামেশা বেখবর থাইকা আসছে।

পড়তে পড়তে ওয়াজেদ থমকাইয়া যায়। মালিক জহিরের সেই দম্ভভরা বাক্যগুলা তার কানে বাজতে থাকে, যেগুলা তারে মসজিদে শুনতে হইছিল। মন উইঠা যায় কিতাবের পাতা থেকে। তার মনে হয়, আসল বাস্তবতা হইল এই দুনিয়া, যেখানে রাতদিন তার নানারকম মানুষের মোকাবেলা করা লাগে।

কেমন একটা অস্থিরভাব ভর করে মনে। কিতাব রাইখা চারপায়ার ওপর শুইয়া পড়ে সে। বাতাস থাইমা গেছে। ভ্যাপসা গরম হয়ে উঠতেছে কুঠুরির ভিতরটা। গোসল করা দরকার। চারপায়ার নিচ থেকে টিনের বাক্স বের করে ওয়াজেদ, ওইখানে তার কাপড়চোপড় থাকে। লুঙ্গি আর কুর্তার ভাঁজে কিছু শুকনা ফুলের পরশ পাওয়া যায়, গন্ধহীন, বিবর্ণ। এগুলা সে বুজুর্গদের মাজারে পইড়া থাকা ফুলের স্তূপ থেকে কুড়ায়ে আনছিল।

ফুলগুলা নাড়াচাড়া করতে করতে ওয়াজেদ ওই বুজুর্গদের মতন মহান হওনের খোয়াব দেখে। কল্পনায় বুজুর্গরা কথা বলেন। তারে আরও বেশি মুত্তাকি আর পরহেজগার হওয়ার তালকিন দেন। গোপন গুনাহ থেকে বাঁচার নসিহত করেন, যা তারে দিনরাত পেরেশান কইরা রাখে।

গায়েবি নসিহতে ওয়াজেদের অন্তরে খানিকটা জোর পয়দা হয়। ফুলগুলা বাক্সে রাইখা সে কাপড় বাহির করে। কুঠুরি ছাইড়া ঝরনার পানিতে গোসল করতে যায়। অন্ধকারে জোনাকিরা জগমগায়। ঝিঁঝিপোকার দল একটানা ঝিঁ ঝিঁ করে। ওইরকম একটা সময়ে সারা শরীরে একবার ঝরনার ঠান্ডা পানি বহাইয়া দিতেই এক আশ্চর্য শান্তিতে ভইরা ওঠে মন।

দুয়ারে পাষাণ তালা (দ্বিতীয় কিস্তি)

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা।
2 সুইসাইড
3 পরিভ্রমণ

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
আহসান
আহসান
1 year ago

রাস্তা বন্ধ দেইখা ভালোই লাগলো। দারুণ সুন্দর হইছে অনুবাদ। মাশাআল্লাহ বলা দরকার।

anish das apu
anish das apu
1 year ago

এটা কি অনুবাদ? আমি ভেবেছি মৌলিক গল্প! আরমান নামের এই নবীন অনুবাদকের লেখা এই প্রথম পড়লাম এবং আক্ষরিক অর্থেই মুগ্ধ হলাম। অনুবাদক এবং লেখক হিসেবে অত্যন্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি আরমানের যদি সে লেখালেখি চালিয়ে যায়। তার জন্য অজস্র শুভকামনা!

Mahmudul hasan Sunan
Mahmudul hasan Sunan
1 year ago

এইটা বই আকারে না বের হইলে, হার্ড কপি ছুঁয়ে না পড়তে পারলে আফসোস থাইকা যাইবো…

তালহা সাদিক
তালহা সাদিক
1 year ago

অসাধারণ লাগলো।বিশেষ কইরা কথ্য ভাষা দিয়া লেইখা মাঝখান দিয়া নানা উর্দু শব্দ ঢুকানোর এক্সপেরিমেন্টটা যথেষ্ট উপভোগ্য ছিলো।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷