‘দুনিয়ার সব দুর্ঘটনাই ফিলিস্তিনি ট্রাজেডির প্রতিনিধিত্ব করে’ (শেষ পর্ব)

গাসসান কানাফানি

কাউসার মাহমুদ

: কখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অধ্যয়ন শুরু করেন? মনে আছে কি?

গাসসান : মনে হয় না এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা গতানুগতিক। প্রথমত, আমি সোভিয়েত লেখকদের একজন ভক্ত ছিলাম এবং এখনও আছি। তাদের প্রতি আমার প্রশংসা ছিল পরম, যা আমার এবং মার্কসবাদের মধ্যে বরফ ভাঙতে সাহায্য করেছিল। কাজেই সোভিয়েত লেখকদের পাঠ এবং প্রশংসার মাধ্যমেই প্রাথমিক পর্যায়ে মার্কসবাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। দ্বিতীয়ত, আমার বোনের স্বামী একজন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন। ১৯৫২ সালে আমার বোনের বিয়ে হয়েছিল এবং তার স্বামী সেই প্রাথমিক পর্যায়ে আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়াও, যখন কুয়েতে গিয়েছিলাম তখন একটি বাড়িতে আরও ছয়জন যুবকের সাথে ছিলাম এবং সেখানে আসার কয়েক সপ্তাহ পরই জানতে পারি যে তারা একটি কমিউনিস্ট সেল গঠন করছে। তাই বলতে গেলে একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই আমি মার্কসবাদ সম্পর্কে পড়তে শুরু করি। ফলে আরব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের সাথে সে আবেগের প্রভাবে ওই সময় এবং ওই পর্যায়ে আমি কতটা নিমগ্ন ছিলাম, তা জানি না। সুতরাং সেসময় যা-কিছু বা যে উপাদানটি পড়ছিলাম সে বিষয়ে আমার বোঝা বা উপলব্ধিকে পরিমাপ করতে পারি না। যদিও সেসব বিষয়বস্তু আমার কাছে এলিয়েন বা অস্বাভাবিক জাতীয় ছিল না।

: হতে পারে এই প্রভাবগুলো আপনার [প্রাথমিক] গল্পগুলোকে [তৎকালীন আপনার রাজনৈতিক ধারণার সাথে সম্পর্কিত] এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমি মনে করি আপনার সোভিয়েত সাহিত্যের পাঠ এবং মার্কসবাদীদের সাথে যোগাযোগ আপনার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছিল।

গাসসান : মনে হয় না এই কারণগুলো অগ্রাধিকার নেয়। বরং আমি মনে করি আমার লেখার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাস্তবতার কারণেই। অর্থাৎ, আমি যা দেখছি তথা আমার বন্ধুদের অভিজ্ঞতা, আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন এবং ছাত্রদের অভিজ্ঞতা, যেখানে দারিদ্র্য ও দুর্দশা নিয়েই ক্যাম্পে আমার জীবনযাপন—সে বিষয়গুলোই আমাকে প্রভাবিত করেছে। সম্ভবত সোভিয়েত সাহিত্যের প্রতি এ কারণে অনুরাগ ছিল যে, আসলে আমি যা দেখছিলাম, এটি তা প্রকাশ করে, বিশ্লেষণ করে, মোকাবেলা করে এবং বর্ণনা করে। ফলে অবশ্যই তাদের প্রতি আমার প্রশংসা অব্যাহত। তবে আমার লেখায় সোভিয়েত সাহিত্যের প্রভাব ছিল কিনা জানি না। এই প্রভাবের আকার প্রকারও জানি না। পরিবর্তে এ কথা বলতে পছন্দ করি যে, এই প্রভাব বাস্তবতার কারণে। মোটকথা, আমার উপন্যাসের সব চরিত্রই বাস্তবতা থেকে অনুপ্রাণিত, যা আমাকে শক্তি দিয়েছে এবং যা কল্পনাপ্রসূত নয়। আর না আমি শৈল্পিক [সাহিত্যিক] কারণে আমার নায়কদের বেছে নিয়েছি। বরং তারা সবাই ক্যাম্প থেকে এসেছে, বাইরে থেকে নয়। আমার প্রথম গল্পের শৈল্পিক চরিত্রগুলোর জন্য সবসময়ই তারা মন্দ ছিল। তাই জীবনেরই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল আমার লেখায়।

: আপনি ছিলেন মধ্যবিত্ত, কিন্তু ছোটবেলায় শ্রমজীবী শ্রেণির সাথে যোগ দিয়েছিলেন।

গাসসান : হ্যাঁ, অবশ্যই আমার পরিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট মধ্যবিত্তের সাথে সম্পর্কিত; কারণ আমার বাবা শরণার্থী হিসেবে সিরিয়া যাওয়ার আগে মধ্যবিত্ত ছিলেন। এবং এর [শ্রেণিগত] শেকড়ের সাথে আমার পরিবারের সংযুক্তি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে ছিল। আমার মতো শিশুদের যে দ্বন্দ্বের মূল্য দিতে হয়েছিল [অতীত এবং বাস্তবতার মধ্যে]। তাই, আমার সম্পর্ক [আমার সমশ্রেণির সদস্যদের সাথে] বন্ধুত্বপূর্ণ না হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। আমি শ্রমজীবী শ্রেণিদের দলে যোগ দেওয়ার ভান করিনি। কারণ যদিও আমি প্রকৃত সর্বহারা বা শ্রমজীবী ছিলাম না, কিন্তু ঠিকই যোগ দিয়েছিলাম। যাকে আমরা আমাদের ভাষায় বলি ‘অজ্ঞ শ্রমজীবী’। যার সদস্যরা উৎপাদন যন্ত্রের অংশ নয় ঠিক, তবে তারা শ্রমজীবীদের প্রান্তে বেঁচে থাকে। কিন্তু তারপর এটি আমাকে অবশ্যই শ্রমজীবী শ্রেণির মতাদর্শ বুঝতে সাহায্য করেছিল, তবে এ কথা ঠিক বলতে পারি না যে, আমি তখন শ্রমজীবী শ্রেণির অংশ ছিলাম।

: যাহোক, তা শুরু থেকেই আপনি নির্যাতিতদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতা দেখতে পেরেছিলেন।

গাসসান : হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। যদিও আমার ধারণাটি বৈজ্ঞানিক ও বিশ্লেষণাত্মক উপায়ে স্বচ্ছ করা হয়নি, তবে তা একটি সংবেদনশীল অবস্থা ঠিকই ছিল।

: চলুন আবার একটু ১৯৬৭-তে ফিরে যাই। যখন ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের’ জন্ম হয়েছিল, সংগঠনটির বিশ্বাস কী ছিল এবং একটি নতুন সংগঠন তৈরির কারণ কী ছিল?

গাসসান : যেমনটা জানেন যে, ‘পপুলার ফ্রন্ট’ নতুন কোনও সংগঠন ছিল না। এটি মূলত আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফিলিস্তিনি শাখা, আমি যার সদস্য ছিলাম। এটি প্রথমে ১৯৬৭ সালে আন্দোলনের সদস্যদের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করে। আমরা ‘পপুলার ফ্রন্ট’ তৈরি করেছি কারণ আরব বিশ্ব [রাজনৈতিক জায়গায়] নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রের মঞ্চ। তেমনি আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফিলিস্তিনি শাখার আকারও অনেক বিস্তৃত হয়েছে এবং এর নেতৃত্ব ও সদস্যদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন এসেছে। তাই আমরা পপুলার ফ্রন্টে যোগ দিয়েছি। অবশ্যই, ব্যক্তিগতভাবে ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলাম কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, একটি দল হিসেবে ফ্রন্ট ফিলিস্তিনি কাজের ক্ষেত্রে অন্যান্য [রাজনৈতিক] সংগঠনের চেয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নত পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশ্বাস করি এই সংস্থার মাধ্যমে আমার ভবিষ্যত দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করতে পারব। পপুলার ফ্রন্টে যোগ দেওয়ার মূল কারণ এটাই।

: এই সংগঠনে ‘আল-হাদাফ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে আপনার ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন এবং এর গণসংহতি পদ্ধতি সম্পর্কে কি কিছু বলতে পারেন?

গাসসান : আমি এই সংগঠনের একজন সদস্য। যেটি আসলে একটি দল গঠন করে এবং যার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে। মূল গণতান্ত্রিক নীতির উপর ভিত্তি করে একটি সাংগঠনিক এবং নেতৃত্বের কৌশলও রয়েছে। অতএব, যখন নেতৃত্ব আমাকে এই বিশেষ পদটি অর্পণ করে, তখন অবশ্যই আমাকে একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি সম্পন্ন করতে হবে। পপুলার ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিটির সদস্য আমি। যা কেবলই প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ের বাইরেও যায় এমন বিবিধ কর্মকাণ্ডে মিডিয়া সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি অনুসারে, আল হাদাফ ‘ফ্রন্ট’র মিডিয়া কাঠামোর একটি অংশ। তবে অবশ্যই আল হাদাফের জন্য আমি দায়বদ্ধ নই। কাজটি কেন্দ্রীয় মিডিয়া কমিটির উপর অর্পিত এবং আমি সংবাদপত্রে এই কমিটির প্রতিনিধিত্ব করি। প্রায়োগিক দিক থেকে আমাকে এই প্রতিষ্ঠানের (আল হাদাফ) সাংগঠনিক দিকটি ডিল করতে হবে। তবে আমাদের একটি কমিটি আছে যারা আল হাদাফ পড়ে এবং মূল্যায়ন করে। নিবন্ধ লেখে এবং সম্পাদকীয় নিয়ে আলোচনা করে। ফ্রন্টের মধ্যে এমন দশটি অনুরূপ প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান বাকিগুলোর চেয়ে ছোট হতে পারে। তেমনি পপুলার ফ্রন্টের মধ্যে এমন কিছু সার্কেল আছে যারা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। আবার যারা সামরিক সংগ্রাম এবং অন্যান্য ক্যাম্পে কাজ করে তারাও আছে। আমরা প্রত্যেকেই অন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে যারা সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কাজ করেন, যেমন সম্মেলন আয়োজন, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, সভা এবং জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ—অবশ্যই তারা পপুলার ফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে আমাদের সংবাদপত্র থেকে উপকৃত হন। এছাড়াও জনসাধারণের বিষয়ে আমাদের সাথে পরামর্শ করে তারা। তাই তাদের মধ্যে এই গতিশীল সম্পর্কের ফলে সব ক’টি সার্কেল একত্রে গণসংহতি অভিযান চালায়।

: সংবাদপত্র সম্পর্কে কি কিছু বলতে পারেন আমায়?

গাসসান : সংবাদপত্রে কাজ করা খুবই চাপের। এই এখন এ সপ্তাহের ইস্যুটি শেষ করেছি বলে মনে হচ্ছে। সত্যিই আমি ক্লান্ত বোধ করি এবং কারও পক্ষে এই জাতীয় কাগজের জন্য কাজ করা ভয়ংকর। কখনও আপনি একটি সমস্যার শেষ বাক্যটি শেষ করবেন, তখন দেখবেন হঠাৎই আবার নতুন করে ফাঁকা বিশটি পৃষ্ঠা পূরণ করার মুখোমুখি হয়ে আছেন। এছাড়াও, কাগজের প্রতিটি লাইন, শিরোনাম এবং ছবি ফ্রন্টের সদস্যদের দ্বারা আলোচনা করা হয় এবং সামান্যতম ত্রুটিও পর্যবেক্ষণ ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। পত্রিকাটি তখনও সমালোচনার মুখে পড়ে এবং এতে কাজ করা বাস্তবেই সাধারণ কোনও পত্রিকায় কাজ করার মতো নয়। সাধারণ সংবাদপত্রে আপনাকে কেবল আপনার কাজ করতে হবে। কিন্তু আমাদের সংবাদপত্রে ক্ষুদ্রতম বিবরণটিও ফ্রন্টের বিভিন্ন সার্কেল দ্বারা আলোচনা করা হয়। যারা সেসব মনোযোগ সহকারে পড়েন। সুতরাং ফ্রন্টের [অন্যান্য] সদস্যদের নিয়ে গঠিত এই বৃহৎ আদালতের সামনে একটি সমন্বিত কাজ করা একজন ব্যক্তির পক্ষে খুবই কঠিন। ফলে এর সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিটি অনায়াসেই অনুভব করে যে, তাকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

তদুপরি এখন আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশে বাস করি। প্রতিরোধ আন্দোলনে এবং আমাদের মতো একটি সংগঠনে, প্রতিটি বিভাগই মেধা ও দক্ষতার সাথে ‘মানুষ’কে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। ফলে সংখ্যায় তারা যতই স্বল্প হোক না কেন, তা মুখ্য নয়। যেহেতু কাজ শেষ করা এবং একজনের ওপর অর্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য বিষয়। আল হাদাফে আমাদের অল্প সংখ্যক কর্মী রয়েছে। তাই আমরা যখন ফ্রন্টকে আমাদের আরও কর্মী নিয়োগ করতে বলি, তখন আমরা যে উত্তরটি শুনি তা হলো, ‘আপনার দুই-তিনজন কর্মচারীকে তৃণমূলে শিক্ষা দিতে দিন, কারণ তৃণমূলে কাজ করা সংবাদপত্রে কাজ করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ অগত্যা আমরা নীরবই থাকি। কেননা পাছে না আবার আমাদের থেকে কর্মচারীদের নিয়ে যায় তারা। সুতরাং অন্যদের পক্ষে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিনই যে, শুধুমাত্র তিনজন আল হাদাফ সম্পাদনা করেন। তিন বছর ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে। কখনও কখনও আমরা চতুর্থ ব্যক্তির কাছ থেকে [অতিরিক্ত] সাহায্য পাই ঠিক, কিন্তু কিছুদিন পর এই ব্যক্তি আমাদের ছেড়ে চলে যায়। তারপর আবার একজনকে পাই, সে-ও চলে যায় এবং গল্পটি এভাবেই পুনরাবৃত্ত হতে থাকে।

: তারপরও আপনার দিনরাত কাজ করতে হবে?

গাসসান : হ্যাঁ, মনে হয় না আমাদের সহকর্মীদের কেউ দিনে ১৩/১৪ ঘন্টার কম কাজ করে। আর তা কোনোপ্রকার ছুটি ছাড়াই বিরতিহীন এবং সমালোচনা থেকে অনুকম্পা ব্যতিরেকেই। আমাদের সংগঠন, সরকার ও অন্যান্য পত্রিকায় লোকজন আমাদের সমালোচনা করেছেই।

: আল-হাদাফকে কি একটি প্রগতিশীল সংবাদপত্র বলে মনে করেন এবং তাত্ত্বিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি প্রগতিশীল সংবাদপত্রের মতো পড়া হয় বলে বিশ্বাস করেন?

গাসসান : হ্যাঁ, এবং এটি একটি সমস্যা সৃষ্টি করে বলেও মনে করি। দেখুন আমি কিন্তু কাগজের প্রশংসা করার চেষ্টা করছি না, বরং গভীর রাজনৈতিক এবং পলিটিক্যাল আইডিয়াগুলো সহজ উপায়ে প্রকাশ করা খুব কঠিন। এই ক্ষমতা খুব কম লোকেরই আছে। পপুলার ফ্রন্টে আমাদের দুজন মানুষ আছে যারা গভীর ভাবনাকে সহজে প্রকাশ করতে পারেন এবং যে কেউ সেগুলো পড়ে বুঝতে পারে। তাদের একজন জর্জ হাবাশ। অন্যজন সামরিক নেতাদের একজন যিনি চমৎকার সব লেখা লিখেছেন। বাকিদের জন্য এটা কঠিন। বিশেষ করে যদি তারা আগে অনুশীলন না করে থাকে। আদতে এ নিয়ে সবসময়ই আমরা তৃণমূলের সমালোচনার মুখোমুখি হই যে, আমাদের সংবাদপত্র কী লিখে তা বোঝা খুব কঠিন। কাজেই আমাদের বিষয়গুলো আরও সরল করতে হবে এবং সহজভাবে লিখতে হবে। মূলত এ কারণেই পত্রিকাটি প্রস্তুত করতে অনেক সময় লাগে। কারণ নিয়মিতই আমাকে পত্রিকাটি পুনঃপরীক্ষা করতে হবে এবং লেখার পরে উত্থাপিত কিছু পয়েন্টকে সরলীকরণ করতে হবে। আমি মনে করি ফ্রন্টে অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সংবাদপত্র তৈরি করা আমাদের কাজকে সহজতর করবে এবং এই লাইনে আমাদের কাজ অব্যাহত রাখবে। অভ্যন্তরীণ সংবাদপত্র সহজ বিষয় এবং সহজ আইডিয়া প্রকাশ করতে পারে। আমাদের মতো একটি কেন্দ্রীয় পাবলিক সংবাদপত্রের জন্য, অভ্যন্তরীণ সংবাদপত্রগুলো অনুকরণ করা খুবই কঠিন। কারণ অবশ্যই আমাদের একটি গুরুতর গতিপথ বা সীমা নিতে হবে। এটি করার জন্য আমরা [এখন] জটিল পলিটিক্যাল আইডিয়াগুলোর সাথে সম্পর্কিত নিবন্ধের পরিমাণ সীমিত করার চেষ্টা করছি। যেন এই নিবন্ধগুলো পরিমাণে অল্প পৃষ্ঠা নেয় এবং সরাসরি রাজনৈতিক প্রচারে ফোকাস করে।

: আপনার পত্রিকায় কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্যকর্মের মতো শিল্পকর্ম প্রকাশ করেন?

গাসসান : সাহিত্য, চলচ্চিত্র সমালোচনা, থিয়েটার, শিল্প, চিত্রকলা এবং শিল্পসমৃদ্ধ এজাতীয় আরও বিবিধ কিছুর জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুটো পৃষ্ঠা নির্ধারণ করেছি। আমি মনে করি পূর্বে উল্লেখিত সাংবাদিকরা সবচেয়ে জনপ্রিয়; কারণ, ফ্রন্টের অনেক সদস্য এই পৃষ্ঠাগুলোর মাধ্যমে বামপন্থি চিন্তাধারা বোঝেন।

: ব্যক্তিগতভাবে ছোটোগল্প প্রকাশ করেছেন?

গাসসান : আল-হাদাফে কাজ শুরু করার পর থেকে লেখার সময় পাইনি। প্রকৃতপক্ষে, [সম্প্রতি] কেবলই একজন বৃদ্ধ মহিলা সম্বন্ধে দুটি গল্প প্রকাশ করেছি, সবসময়ই যা আমি [উম্মে সাদ] বিষয়ে লিখি। মোটকথা এখন আমার লিটারারি লেখাপত্রের একদমই সময় নেই এবং তা খুবই বিরক্তিকর।

: আরো লিখতে চান?

গাসসান : সাধারণত অফিস থেকে বেরিয়ে যখন বাড়িতে যাই, তখন এতটাই ক্লান্ত বোধ করি যে লিখতে পারি না। তাই লেখার পরিবর্তে পড়ি। আর অবশ্যই প্রতিদিন দুই ঘণ্টা পড়তে হবে আমার। কারণ এটি ছাড়া কোনোভাবেই চলতে পারি না। কিন্তু পড়া শেষ করার পর ঘুমাতে যাওয়া বা একটি (অর্থহীন) সিনেমা দেখতে ভালো বোধ করি। কারণ কাজ শেষ করার পর আর লিখতে পারি না আমি।

: আপনি কি মনে করেন ফ্রন্টের সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে এ বিষয়টি প্রতিফলিত হয় যে, সামরিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত একটি সমষ্টির পরিবর্তে এটি যৌথ হয়ে উঠেছে, যেখানে বিতর্ক প্রচুর?

গাসসান : না, আমি আপনার সাথে একমত নই। আসলে, ফ্রন্টে সবসময়ই আমরা একটি নির্দিষ্ট কৌশলগত সীমার উপর জোর দিয়েছি। যার মূলমন্ত্র হলো : প্রতিটি রাজনীতিবিদই একজন যোদ্ধা এবং প্রতিটি যোদ্ধাই একজন রাজনীতিবিদ। আপনি এখন যে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করছেন, তা কেবল আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় [ফ্রন্টে]। এ ঘটনাটি এই কারণে যে, নৈর্বক্তিক পরিস্থিতির ফলে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন (Palestinian resistance movement) এখন অবক্ষয়ের অবস্থায় রয়েছে, যা এই সময়ের মধ্যে আমাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আমরা এই অধঃপতনের অবস্থায় বাস করছি, যা আমাদের সামরিক তৎপরতা বাড়াতে বাধা দেয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা সামরিক অভিযান বন্ধ করতে যাচ্ছি। এটা সাধারণভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য। বিশেষ করে পপুলার ফ্রন্টের জন্য, গাজা, পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলে আমাদের সামরিক অভিযান গত দুই বছরে তীব্র হয়েছে। কিন্তু ইসরাইল এসব অভিযানকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। তবে আমরা সক্রিয় আছি। দক্ষিণ লেবাননেও আমাদের ঘাঁটি রয়েছে এবং জর্ডানে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে একটি গোপন জনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। যাহোক, আমরা যে ক্ষয়ক্ষতিতে বাস করি এবং আরব সরকার কর্তৃক আরোপিত সাধারণ দমনমূলক পরিবেশ জনমতকে প্রভাবিত করে, তাতে লোকেরা মনে করে যে আমরা সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু এই অনুমান বা সিদ্ধান্তটি ভুল।

: আপনার মতে, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গতিপথ উল্লেখ না করেই কীভাবে অধঃপতিত অবস্থা একজন ফিলিস্তিনি ব্যক্তিকে প্রভাবিত করেছিল?

গাসসান : রাজনৈতিক আন্দোলন মানুষের মতো। যখন একজন ব্যক্তি সুস্থ, বিখ্যাত এবং ধনী হয়, তখন তার চারপাশে বন্ধুরা জড়ো হয় এবং সবাই তাকে সমর্থন করে। কিন্তু যখন সে বৃদ্ধ হয়ে যায়, অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার টাকা হারায়, তখন তার চারপাশের বন্ধুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এখন আমরা [প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে] এই পর্যায় দিয়ে যাচ্ছি। মানে উদাসীনতার পর্যায় দিয়ে। একজন ফিলিস্তিনি ব্যক্তি মনে করছে যে, গত কয়েক বছরে তিনি যে স্বপ্নগুলো গড়েছিলেন তা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এটি একটি বেদনাদায়ক অনুভূতি আপনি জানেন এবং আমি মনে করি অনেক কমরেডই আমার মতামতকে শেয়ার করে যে, এই পর্যায়টি অস্থায়ী। যখন ফিলিস্তিনি ব্যক্তি আবিষ্কার করবে যে, আমরা একটি বিরাট শত্রুর সাথে যুদ্ধ করছি, যাকে আমরা কয়েক বছরের মধ্যে পরাজিত করতে পারব না, যাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি এবং আমরা বারবার পরাজিত হব, তখন ফিলিস্তিনি বিপ্লবের প্রতি ফিলিস্তিনি ব্যক্তির আনুগত্য এখনকার মতো ভঙ্গুর ও আবেগপূর্ণ হবে না। বিশ্বাস করি, যখন আমরা আমাদের প্রথম নতুন জয় জিতব তখন আমরা আবার জনতাকে একত্রিত করতে পারব। আর আমি আত্মবিশ্বাসী এই জয় আসবেই। আমরা এই ‘ডাউন টাইম’ থেকে ভয় পাই না, যেমনটা একে বলতে চাই। এটি স্বাভাবিক যেহেতু আরব নেতারা এবং আরব মিডিয়ার মুখপাত্ররা জনসাধারণের কাছে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সহজে অর্জনযোগ্য বিজয়ের প্রশংসা করেছিলেন। এখন অনেক আরবই আবিষ্কার করেছে যে এই প্রতিশ্রুতিগুলো বিভ্রান্তিকর ছিল। অতএব, আমি বিশ্বাস করি না যে এই ঘটনাটি [ফিলিস্তিনি ব্যক্তির উদাসীনতা] একটি সহজাত এবং ধারাবাহিক ঘটনা। আমরা জানি ভবিষ্যতে আমরা এই পর্যায়টি অতিক্রম করব এবং বিপ্লবের প্রতি জনগণের আনুগত্য আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হবে।

: ১৯৬৭, ১৯৬৮ বা ১৯৬৯ সালে আপনি বা ফ্রন্টের নেতৃত্ব কি খুব বেশি আশাবাদী ছিলেন? আপনি কি অনেকগুলো প্রতিশ্রুতি করেছিলেন? এই সংঘাতকে কি একটি সহজ সংগ্রাম হিসেবে দেখেছেন?

গাসসান : না। আসলে পপুলার ফ্রন্ট তার লিখিত নথির মাধ্যমে জনসাধারণকে সতর্ক করেছিল যে, সমস্যাটি সহজ নয়। এটি তাদের সতর্ক করেছিল যে, তারা বারবার পরাজিত হবে, রক্তপাত, অনেক ট্র্যাজেডি এবং গণহত্যার মুখোমুখি হবে। আমরা এটি বহুবার উল্লেখ করেছি। কিন্তু সাধারণভাবে ফিলিস্তিনি বিপ্লবের নেতৃত্ব জনগণের সামনে একটি সহজ বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আশাবাদের ক্ষেত্রে, আমরা খুব আশাবাদী এবং আমি বলতে পারি যে, আমাদের কঠিন সংগ্রামের সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও আমাদের পরিস্থিতি ১৯৬৭, ১৯৬৮ বা ১৯৬৯-এর চেয়ে ভালো, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং একটি প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে। যার মাধ্যমে এটি তার ঐতিহাসিক আন্দোলনের মূল্যায়ন করে, অবশ্যই উপরিগত উপস্থিতির দ্বারা নয়।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷