সেদিন বাসায় ফিরতে প্রায় ন’টা বাজল। গেটের ভেতর ঢুকেই দেখি দীন ইসলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। তার হাসি দেখে আমার ছাতার কথা মনে পড়ল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় টেইলার্সের দোকানে ছাতা ফেলে আসার কথা বললাম। কেন আমি ছাতার কথা ভুলে গিয়েছিলাম তাও বললাম। বললাম যে বৃষ্টি থেমে গিয়েই ঝামেলা পাকিয়েছে। আরও বললাম, আগামীকালই তার ছাতা এনে দেব। দীন ইসলাম সমস্যা নেই টাইপ করে হাসল। আমি ওকে সামনের দোকানে চা খাওয়াতে চাইলাম। আবার হাসল। অনেকটা নো থ্যাংকস টাইপ হাসি। পরের দিন একাজ সেকাজ শেষ করে যখন বাসায় ঢুকছিলাম দেখি দীন ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে আর হাসছে। আমি খুব বিব্রত হলাম। বিব্রত হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে ছাতার কথা মনে পড়ল। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না বলে সোজা গিয়ে লিফটে উঠে পড়লাম।
ব্যাপার হচ্ছে, ছাতার সাথে আমার জনম জনমের শত্রুতা। বেশির ভাগ মানুষদের মতো আমারও এই ছাতা বস্তুর প্রতি ব্যপক বিতৃষ্ণা। যতক্ষণ পর্যন্ত বৃষ্টি আছে তো ঠিক আছে। কিন্তু এরপরে এই বস্তু হাতে রাখাও একটা বিব্রতকর ব্যাপার। যাই হোক, সেদিন বাসার গেটের কাছে আসতেই নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তখনই মনে হলো এইবার কোন ছাতা কেনা হয়নি। ওইদিকে মায়াবন টেইলার্সের কাছ থেকে লম্বায় কমাতে দেয়া প্যান্ট দুইটা না আনলেই নয়। রাত বাজে আটটা। আর আধা ঘণ্টা পরেই দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। গাড়িটাও দুইদিন ধরে গ্যারেজে। এই সময় ছাতা হাতে গেট দিয়ে দীন ইসলাম ঢুকলে। দীন ইসলাম হলো আমাদের বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি গার্ড। দেখতে অনেকটা পাকিস্তানিদের মতো। তার বিশেষত্ব হলো মুখের ট্রেডমার্ক হাসি। আমাকে দেখে হাসল আর জিজ্ঞেস করল ছাতা লাগবে কিনা। আমিও হাসলাম। বের হয়ে একটু সামনে যেতেই রিকশা নিলাম। সাথে সাথে বৃষ্টি থেমে গেল আর ছাতাটাকে বিরক্ত লাগতে শুরু হলো।
ছাতা আনতে দুই দিন পরে গেলাম। আমাকে দেখেই দর্জি বুঝলো যে ছাতার জন্য গিয়েছি। কিন্তু ছাতা ছিল সিকিউরিটি গার্ডের কাছে। সিকিউরিটি গার্ড দুই দিন ধরে আমাকে না দেখতে পেয়ে ছাতা দিয়েছিল রিচার্জের দোকানদারের কাছে, কারণ তার মেয়ের বিয়ে এবং সে এজন্য ছুটিতে থাকবে। আমি রিচার্জের দোকানে গেলাম। তারা বলল আজ সকালে মোবাইলে টাকা ঢুকাতে আসে এক আপা। আর তখনই ঝুম বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি কখন থামবে তার কোন ঠিক না থাকায় তারা ওই আপাকে ছাতাটা দিয়েছে। একটু হেল্প করা আর কি। অবশ্য আপা বলেছে ছাতা দিয়ে যাবে। আমি জানতে চাই কখন দিয়ে যাবে। তারা একে অপরের দিকে তাকায় আর বলে তারা জানে না। আমি তার পরের দিন গেলাম। আবার তার পরের দিন গেলাম। এভাবে কয়েকদিন গেলাম। প্রথমদিকে দীন ইসলামের সাথে দেখা হলে একটু হেসে লিফটে উঠে যেতাম। অবশ্য একদিন কারেন্ট না থাকায় সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলাম। পরে পরে দীন ইসলামের সাথে আর দেখা হয় না।
ফোন নম্বর খুঁজতে খুঁজতে রিচার্জের দোকানদারের অনেকটুকু সময় লাগল। নম্বর দিয়ে বলল সে নিশ্চিত যে এটা ওই আপার নম্বর কারণ আপা তিরাশি টাকা রিচার্জ করেছিল আর পুরো খাতার মধ্যে একটাই তিরাশি টাকার রিচার্জ আছে। কিন্তু এই নম্বর দিতে গিয়ে তাকে অনেক ব্যথিত মনে হলো। আমি অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম এই ব্যথার উৎস কোথায়। কিন্তু কী আর করা। আমাকে এই নম্বর চাইতেই হতো। কারণ দীন ইসলামের ছাতা ওই নম্বরের মালিকের কাছে। আর সে যেহেতু অনেক দরিদ্র, সেহেতু ছাতাটা তার খুবই দরকার।
একটা হারিয়ে যাওয়া ছাতার জন্য অপরিচিত কাউকে এর আগে কেউ কখনো ফোন করেছে বলে মনে হয় না। ও পাশ থেকে রিনিরিনি কণ্ঠের আর আঞ্চলিক টোনের একজন ফোন ধরল। আমি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে আমার সমস্যার কথা বললাম। বললাম দীন ইসলামের কথা। দীন ইসলামের ছাতা কেন তাকে ফেরত দেয়া গুরুত্বপূর্ণ তাও বললাম। ওই পাশের কণ্ঠ একই সাথে বিব্রত ও লজ্জিত হয়ে বলল যে সে অনেক আগে থেকেই ছাতাটা ফেরত দিতে চায় কিন্তু তার জীবনে কিছু একটা ঝামেলা যাচ্ছে বলে সময় পাচ্ছে না। সে এটাও বলল, ছাতা সে এখনই ফেরত দিত কিন্তু সেই সুযোগ নেই তার কাছে। আমি বিনীত হয়ে বললাম, তার যেদিন ইচ্ছে সেদিন ফেরত দিতে পারে এবং এই ব্যাপারে আমার কোনো তাড়া নেই। পরে আরো কিছু কথা বলে আমরা দুজনেই আগামী পরশু দিন ওভারব্রিজের নিচে ছাতা ফেরত দেয়া এবং ফেরত নেয়ার বিষয়ে একমত হলাম।
পরদিন সকালেই আমি দীন ইসলামের কাছে গেলাম। ওর রুম তালা বন্ধ দেখে বাড়িওয়ালার কাছে খবর নিতে গিয়ে শুনলাম দীন ইসলাম কাউকে কিছু না বলে বাড়ি চলে গিয়েছে। ফিরে আসবে কিনা এ ব্যাপারে উনি নিশ্চিত নয় এবং কেউই নিশ্চিত নয়। আমি তার কাছ থেকে দীন ইসলামের ফোন নম্বর নিয়ে কল দিই আর ওপাশ থেকে ট্যা টো টু, ট্যা টো টু এরকম শব্দ আসতে থাকে। এর অর্থ আমি কখনোই বুঝি না কারণ বন্ধ হলে বা ব্যস্ত থাকলে বা সংযোগ দেয়া সম্ভব না হলে তো বলে দেয়। আরো কয়েক বার কল দিই, কিন্ত ওই বিরক্তিকর আর একঘেঁয়ে শব্দ আসতে থাকে। বিকেলে গিয়ে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে তার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে আসি। এর মধ্যে ওই রিনি রিনি কণ্ঠের একটা মিসড কল দেখে কল ব্যাক করার পর বলল যে আমি যেন ঠিক দশটার দিকে ওভারব্রিজের নিচে থাকি। আমি কোনো চিন্তা করতে না বলে ফোন কেটে দিই।
পরশু যখন আসে আমার আর এসব কিছু মনে থাকে না। আমার শুধু মনে থাকে যে শুক্রবার হলো ঘুমের দিন। আমি ঘুমাই। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাই। যখন ঘুম থেকে উঠি তখন জানালার ফাঁক গলে কড়া রোদ এসে মুখের উপর পড়েছে। তখনও আমার ছাতার কথা মনে পড়ে না। ফোনে সময় দেখতে গিয়ে দেখি অনেক গুলো মিসড কল। কল ব্যাক করতেই বলে যে, সে প্রায় এক ঘণ্টার উপরে হচ্ছে ওভারব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোনোমতে দাঁত ব্রাশ করে পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়ি। শুক্রবার সাধারণত আমি গাড়ি নিয়ে বের হতে চাই না। সেদিন নিতে হলো। অল্প সময়ই লাগলো ওভারব্রিজের নিচে পৌঁছুতে। গিয়ে দেখি কালো বোরকা আর কচুপাতা কালারের হিজাব পরা বাইশ তেইশ বছর বয়েসি উজ্জ্বল শ্যামলা আর ভয় পাওয়া চেহারার এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে একটা পুরনো ডাফল ব্যাগ আরেক হাতে ছাতা। দেরি করায় অনেক করে দুঃখপ্রকাশ করে ছাতাটা নিলাম। চলে আসব এই মুহূর্তে বলে উঠল আমি তাকে বাসস্টপ পর্যন্ত দিয়ে আসতে পারব কিনা। এমনিতেই তার অনেক দেরি হয়ে গেছে বাস পাবে কিনা তার ঠিক নেই। যেহেতু আমার জন্যেই দেরি হয়েছে তাই রাজি না হয়ে উপায়ও ছিল না। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখলাম ইসমপুরের একমাত্র বাস অনেক আগেই ছেড়ে গিয়েছে। মেয়েটার দিকে চেয়ে দেখলাম তার মুখ কালো হয়ে কান্নার উপক্রম। আমি কী করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। মনে হলো যেন আমার হাতের ছাতাটাও কী করার বুঝতে পারছে না। মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম যে, তাকে বাসায় দিয়ে আসি আর সে আগামীকাল চাইলে যেতে পারবে। অসহায় হয়ে বলল যে, তাকে আজ যে করেই হোক যেতে হবে নইলে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। জিজ্ঞেস করলাম তার বাড়ি এখান থেকে কতদূর। সে বললো, মোটামুটি চার ঘণ্টার মত লাগে। দীন ইসলামের বাড়িও ওইদিকেই। আমার মাথায় এলো যে ছাতাটা দিয়ে আসি আর মেয়েটারও উপকার হোক। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু খাবে কিনা।
পাশে একটা হোটেলে আমরা পরটা আর ভাজি খেতে বসলাম। আমার জানতে ইচ্ছে হলো কী এমন কাজ যে তাকে আজই যেতে হবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে প্রায় দুই মাস হলো। এরপর থেকে সে এখানে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকে আর টুকিটাকি ঘরের কাজ করে। কিছুদিন হলো তারা ফোনে কথা বলছে। এখন তারা একসাথে থাকতে চায়। আজ বিকেলে চারটায় তার সালিশ। আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম সাড়ে বারোটা বাজে। মনে হলো এখনই ওঠা দরকার।
মেয়েটার নাম বললো রিমি। গাড়িতে উঠেই আমি তাকে ভরসা দিলাম যে আমরা চারটার আগেই পৌঁছে যাবো। এরপর আর কী কথা বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমি অল্প ভলিউমে গান ছেড়ে দিলাম। রিমি জিজ্ঞেস করল রাহাত ফতেহ আলী খানের গান আছে কিনা। আমি একটু অবাক হলাম। জানতে চাইলাম যে রাহাত ফতেহ আলী খানকে কী করে চেনে। সে বলে তার বাবা গান গাইত, সেও গাইত। অনার্সে ভর্তি হতেই বাবা মারা যায় আর তার মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তালাক দেয়ার পরে মায়ের কাছে অল্প কিছুদিন ছিল। কিন্তু আশেপাশের মানুষের কথা শুনতে হয় এই জন্য তার মা তাকে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি এবার ভালোভাবে তার দিকে তাকালাম। চেহারায় বেশ মায়া। হিজাব পরার ধরনে রুচির ছাপ। স্বামী কী করে জিজ্ঞেস করতে বললো, গ্রামে একটা মনিহারির দোকান চালায়। আয় রোজগার ভালোই। বললাম, তালাক কেন দিল। চুপ করে রইলো। ভাবলাম বলতে চাচ্ছে না। আমি আর কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পরে বললো, তার স্বামীর ধারণা তার সাথে জ্বিন আছে, সে নাকি অনেকবার দেখেছে। আমি বললাম, জ্বিন আছে মানে? মেয়েটা কিছু বলে না। এবার জানতে চাইলাম, তার কি মনে হয়, তার সাথে কি সত্যিই জ্বিন আছে? সে বলে, সে জানে না। তবে তার প্রায়ই মনে হয় একটা জলের শাড়ি তাকে পেঁচিয়ে আছে। তখন তার অনেক শান্তি লাগে। শুনে আমি হাসলাম। বললাম হ্যালুসিনেশন হতে পারে। কয়েক বার হ্যালুসিনেশন হওয়ার পরে সে ধরে নিয়েছে এটাই সত্যি। রিমি একটু অস্বস্তিবোধ করে। মনে হয় সে ভাবছে যে এমন অবিশ্বাস্য কথা বলে ঠিক করেনি।
অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্যি হতে পারে, রিমিকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম। এ-ও বললাম যে প্রকৃতিতে অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সে হাসে। কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে যে সে আগে কখনো এমন দামি গাড়িতে ওঠেনি। তার এমন সরলতায় আমার কেমন জানি মায়া লাগে। তারপর আমরা অনেক কথা বলি। আমি বানিয়ে বানিয়ে পৃথিবীর অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা বলি। সে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে বলে যে আমি যে এসব বানিয়ে বলছি তা বুঝতে পেরেছে। আমি লজ্জা পাই। আমার লজ্জা দেখে সে খিলখিল করে হাসে। তার হাসি দেখে মনে হয় এমন হাসি অনেক দিন হাসেনি। রিমিও আমাকে অনেক কথা বলে। তার ছোটবেলার কথা, তাদের বাড়ির পাশের নদীর কথা, সে নদীতে দল বেঁধে সাঁতার কাটা, তার বাবার কথা, বাবার সাথে দূরদূরান্তে গিয়ে গান গাওয়ার কথা, তার স্বামী জাফরের কথা, জাফর আর তার ভালোবাসার কথা। হঠাৎ তাকে আমার খুব আপন মনে হয়। আমার মনে হয় যে আমি যে এই একা একটা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি সে জীবন আসলে একা না। এই জীবনে আমার সাথে রিমি আছে যার মনে হয় যে তাকে জলের একটা শাড়ি মাঝে মাঝে পেঁচিয়ে থাকে। আমার রিমির স্বামীকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। একসময় আমি তাকে ঈর্ষা করতে থাকি। এ সময় রিমি আমার কাঁধে হাত রাখে আর মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয় একরাশি জল যেন আমায় ঘিরে ধরেছে। বামে যান বামে, রিমি বলে ওঠে।
আমরা যখন রিমিদের বাড়িতে পৌঁছি তখনও চারটা বাজেনি। রিমির মা আমাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত। রিমি সব খুলে বলল। শুনে একটু স্বাভাবিক হয়ে আমাকে ধন্যবাদ দিতে এলো। আমি জানতে চাইলাম, সেও মনে করে কিনা যে রিমির সাথে জ্বিন আছে। সে নিশ্চিত হয়ে বলল যে আছে। এ-ও বলল যে সে খুব ভালো এক হুজুরের সন্ধান পেয়েছে, এবার চিকিৎসা করালে ঠিক হয়ে যাবে। জাফরও চিকিৎসা করাতে রাজি হয়েছে। আমি অনেক বুঝাতে চাইলাম যে এসব জ্বিন-ফিন বলে কিছু নেই আসলে। এটা একরকম মানসিক সমস্যা যার জন্য আলাদা চিকিৎসা আছে। সে আমার কথা মানতে চায় না। সে বলে যে কুরআনে জ্বিনের কথা বলা আছে আর এতে বিশ্বাস না করলে তার ঈমান থাকবে না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম। এবার বললাম, মুখে যে তালাক দিয়েছে তা আসলে কোনো তালাক না আর এর জন্য সালিশ দরবারের দরকার নেই। তারা চাইলেই এখন একসাথে থাকতে পারে। সে এটাও মানল না। একটু পরেই সালিশ। ভাবলাম দেখে যাই কি হয়।
সালিশে সব একগাদা মুরুব্বিস্থানীয় লোক যার বেশিরভাগই হুজুর। আমি গিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সালিশ হলো খুবই সংক্ষিপ্ত। এলাকার ইমামসাহেব বিধান বলে দিলেন। একজনের সাথে হিল্লেবিয়ে দিতে হবে তারপর রিমি একরাত থাকবে তার সাথে। এরপরের দিন তালাক দিয়ে দিলেই আবার নতুন করে বিয়ে হবে রিমি আর ওর স্বামীর। হিল্লে বিয়ের লোকও ঠিক করা। গ্রামের প্রভাবশালী একজন। সমস্যা বাঁধালো রিমির মা। সে হিল্লে বিয়ে মানে না। চারিদিকে একটা চাপা ক্ষোভ দেখা গেলো। হিল্লে বিয়ে যে মানে না সে কাফের আর তার কী কী শাস্তি হবে এটা ইমামসাহেব বলে দিলেন। আরও বলে দিলেন ইসলামের বিধানের বাইরে এই গ্রামে কখনো কিছু হয়নি হবেও না। আমি কিছু একটা বলতে গিয়েও বললাম না। তাকিয়ে দেখলাম রিমি কাঁদছে। একহারা গড়নের সুদর্শন এক ছেলে এসে বললো সে হিল্লে বিয়ে ছাড়াই রিমিকে নিতে চায়। কয়েকজনের ধমকে চুপ করে গেলো। বুঝলাম এই লোকই জাফর। রিমি সামনে গিয়ে বলল, সে ওই লোককে হিল্লে বিয়ে করবে না। ইমাম বলল যে, এই লোক ছাড়া রিমিকে আর কেই বা হিল্লে বিয়ে করতে রাজি হবে। কেউ কিছু বলল না। রিমি অসহায়ভাবে এদিক ওদিক তাকাল। আমার কী যেন হলো। কিছু না ভেবেই বললাম যে আমি করব। সবার চোখ আমার দিকে ফিরল।
একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লোক আর তার স্পর্ধা দেখে সবার ক্ষোভ যেন অন্ধকার নেমে আসার মতো করে আমার উপর নেমে আসল। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। বুঝলাম অনেক বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। আমার সাথে কী হতে পারে তা যেন চোখের সামনে খুব হাই রেজুলেশনের ভিডিওর মত ভেসে উঠল। রিমির মা একেবারে অপ্রত্যাশিত একটা কাজ করে বসল। বলল যে আমি তার এক দূর সম্পর্কের বোনের ছেলে আর তারা আমার সাথে রিমির হিল্লে বিয়েতে রাজি। রিমিও বলল সে রাজি। জাফরও কী ভেবে রাজি হয়ে গেল। বেশ কয়েকজন রিমিদের পক্ষ নিল আর তখন বাকিদের কিছুই করার থাকল না। রাত আটটা বেজে সতের মিনিটে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। সবাই চলে যাওয়ার পর রিমির স্বামী আমাকে এসে বলল যে গ্রামের এসব প্রভাবশালী আমাদের কিছুতেই ছাড়বে না। এই গ্রামে এখনো তাদের বিরুদ্ধে কেউ যায়নি। এই প্রথম কেউ গেল। রিমি একপাশে চুপচাপ বসে ছিল। সে এসে বলল যে এখানে থাকা আমাদের ঠিক হবে না। আমাদের বরং নদীর ধারে চলে যাওয়া উচিত। কারণ সেখানে কেউই যায় না।
আকাশে একথালা চাঁদ আর সামনে নদী। আমার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। পাশে আমার একদিনের বউ আর তার প্রাক্তন স্বামী যে কিনা আবার ভবিষ্যৎ স্বামীও। মানুষের জীবনে কত কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমার জীবনেও ঘটল। একবার ভাবলাম আমি যদি আর রিমিকে তালাক না দেই। এমন যদি হয় যে আমি তার সাথেই থেকে গেলাম। কিন্তু তা কী করে হয়। এটা একরকম চুক্তির মতো। এক রাতের চুক্তি যার সাথে বিশ্বাস মিশে আছে। এই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমার মাথায় পেছন থেকে একটা আঘাত লাগল। পড়ে গিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকজন মুখোশপরা লোক দাঁড়িয়ে। আমাদের আশ্চর্য করে দিয়ে জাফর একদিকে দৌঁড় দিল। আমার নড়াচড়া করার শক্তি নেই। লোকগুলো রিমিকে টেনে একপাশে নিয়ে গেল আর মাটিতে চেপে ধরে কাপড় চোপড় খুলতে লাগল। আমি আর চোখ মেলে রাখতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করার আগ মুহূর্তে এক অসম্ভব ঘটনা ঘটলো। নদী থেকে বিশাল এক ঢেউ উঠে এলো আর রিমিসহ ওইখানের সবাইকে নিয়ে আবার নদীতে নেমে পড়ল। আর কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারলাম না।
চোখ যখন খুললাম তখন চারিদিক সুনসান। আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। একটু দূরেই গাড়িটা দাঁড় করানো। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এ সময় কেমন একটা শব্দ হলো। মনে হলো নদী থেকে আরেকটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো। আমি ভালো করে দেখলাম অদূরেই কী যেন একটা পড়ে আছে। কাছে গেলাম। রিমি দলা পাকিয়ে শুয়ে আছে। তার শরীরে একটুও কাপড় নেই। কেমন যেন পানির একটা আবরণ তাকে ঘিরে আছে। আমি নাকের কাছে আঙুল নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করার চেষ্টা করলাম। না, নেই। কেমন শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে রিমির প্রাণহীন দেহ। আমি গাড়ির ভেতর থেকে ছাতাটা বের করে আনলাম। মেলতে অনেকটুকু কষ্ট হলো। ছাতা দিয়ে রিমির শরীরটা ঢেকে দিলাম। আমার ভেতরে যতটা ভেতর আছে তারচেয়েও বেশি ভেতর থেকে একটা বিশুদ্ধ কান্না এলো। বসে বসে কাঁদলাম। আমার খুব ইচ্ছে হলো আমি এই জীবন এখানে বসেই কাটিয়ে দেই। একসময় ভোর হয়ে এলো। মনে হলো পাশের কোনো একটা থানায় যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু গেলাম না। রিমিকে ওইভাবে রেখে চলে এলাম।
এরপর বেশ কিছুদিন চলে গেল। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমাকে খুঁজতে পুলিশ আসবে। কারণ রিমি তো শেষ আমার সাথেই ছিল। কিন্তু কেউ এলো না। আমি নিজেই বেশ কয়েকবার থানার পাশে ঘুরঘুর করেছি গিয়ে সব বলে দেয়ার জন্য। সেদিনের ব্যাপারে বিভিন্নভাবে খবর নেয়ার চেষ্টা করেছি। কোনোকিছুতেই কিছু হলো না। এরমধ্যে একদিন শুক্রবার এলো। আমার ঘুমের দিন। অনেকক্ষণ কলিংবেল বাজার পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও গিয়ে দরজা খুললাম। দরজায় দীন ইসলাম দাঁড়িয়ে । আমার দিকে একটা ছাতা বাড়িয়ে দিল। বললো, এক মহিলা এটা দিয়ে গিয়েছে। হতবাক হয়ে দেখলাম যে এই সেই ছাতা। আমি যেন কথাই বলতে পারছিলাম না। ছাতা হাতে নিয়ে কোন রকমে বললাম, ও। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে মনে পড়ল এই ছাতা তো দীন ইসলামের। আমি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, নে, এটা তো তোর। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, কীরে একদিন না তোর কাছ থেকে নিলাম, মনে নেই? সে বলল, পড়ছে মনে, কিন্তু এই ছাতা তো আমার না স্যার, পার্কিংয়ে পইড়া আছিল, বাইরে বৃষ্টি দেইখা নিয়া নিছিলাম। এই বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আমি একহাতে ছাতা আরেক হাতে দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম আর নিজেকেই বললাম, ও।