“সেটা ছিল এক তুমুল যুদ্ধ…”—সহপাঠীদের সাথে ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে এমন একটি বর্ণনা সে প্রায়ই পড়ত। কখনও ভাবে নি, একদিন নিজেকে দিয়েই সেই ‘বর্ণনা’ তৈরি হবে। একটি রাত্রির যুদ্ধের গল্প বন্ধুর সাথে ইতিহাসের মতো বলতে হবে। একটা সময় ‘তুমুল’ বলতে কী বোঝায় তা-ও সে জানত না। টের পায়, কণ্ঠে আজ তার কৈশোরের ইতিহাস শিক্ষক ভর করেছে।
“… স্থল অভিযান শুরু হয়েছিল তেল এল-হাওয়ার পশ্চিম দিক থেকে। তুমি তো জানো, ওই এলাকার দুইটা ভাগ—পূর্ব আর পশ্চিম। পশ্চিম দিকে উজ্জ্বল রঙের সারি সারি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক, প্রত্যেক ব্লকের আবার আলাদা নাম। লোকে বলে, ওগুলো সব বুর্জোয়াদের বসতি। বেশিরভাগ বাসিন্দার কাজ ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ’র আমলাগিরি করা। অসলো চুক্তির মধ্য দিয়ে এই বুর্জোয়া গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। যদিও দেশে কোনও সম্পদ সৃষ্টিতে তাদের অবদান নাই। আসলে বুর্জোয়া নামের একটা ভালো শব্দ এদের কারণে খারাপ হয়েছে। শব্দটা বললেই লোকে ওই দিকে আঙ্গুল তোলে। শব্দটার এমন অর্থের সমস্যাও আছে : অনেকে মনে করে, বুর্জোয়া মানে ধনবান; যারা নিজস্ব বাড়ির মালিক, ভালো খায়, ভালো পরে। সে-হিসেবে ওই এলাকার বাসিন্দাদের বুর্জোয়া বলাই যায়। যদিও আসল বুর্জোয়া হলেন ব্যবসায়ীরা, কারখানার মালিকরা; যারা সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন। তারা কঠোর পরিশ্রমও করেন এবং বিপ্লবের স্ফূলিঙ্গে অঙ্গারও হন।”
“আমি বুঝতে পারছি না, কেন তুমি এই সব বিবরণ আমাকে শোনাও, মনে হয় যেন আমি বিদেশ থেকে এসেছি। যুদ্ধের কথা বলার জন্য আমি যা জানি তা-ও আমাকে তোমার ব্যাখ্যা করতে হবে কেন? তুমি মনে হয় নিজেকে মাস্টার ভাবছ, আর আমাকে ছাত্র। এখন ‘কমিউনিস্ট মতাদর্শের উত্থান-পতন’ অধ্যায়ের ক্লাস করাতে চাও। শোনো, কমিউনিস্ট যুগের মৃত্যু হয়েছে বহু আগে, দাফনও হয়ে গেছে। আমাকে রেহাই দাও, ভাই, শুধু কাহিনিটা বলো। আমি তোমার মতো স্থানীয় ছেলে। আচ্ছা, যাও, আমি সত্যিকারের বুর্জোয়া আর তুমি শিল্পপ্রাণ মানুষ। এবার বলো।”
“হা, হা, হা! একদম! এটাই বলতে চাইছিলাম। যাই হোক, এলাকার বাকি অর্ধেক, মানে পূর্ব দিকটা সীমান্তের কাছাকাছি। কিন্তু আক্রমণের শুরু সেদিক দিয়ে হয় নাই। ওদিকের বেশিরভাগ কৃষি জমি। দখলদার বাহিনী অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিমুক্ত এলাকায় হানা দেয়। কোনও প্রতিরোধের আশা করে নাই। ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে এগুতে থাকে; যেদিকে প্রকৃত বুর্জোয়াদের বাস, খামার ও কারখানার মালিকরা থাকে যে-এলাকায়। তাদের বেশিরভাগ কারখানা অবশ্য অবরোধের কারণে বন্ধ। এরাই ছিলেন ইন্তিফাদার নেপথ্যে। অনেক প্রতিরোধ নেতাদের বাড়িও এখানে। ওই রাতেই ২০০৮-০৯’র যুদ্ধের শুরু।”
ইতিহাসে কি আর একটা যুদ্ধও আছে, যার কথা বলতে গেলে একত্রে দুই বছর বলতে হয়? লিখতে গেলে দুটি সংখ্যার মধ্যখানে হাইফেন দেওয়া লাগে, যেন একটা শিক্ষাবর্ষ। আর কোনও যুদ্ধ আছে, যার শুরু বছরের শেষে এবং পরের বছরের গোড়ায় শেষ? প্রশ্ন, সংখ্যা ও বছরের ধারাবাহিকতা তার চিন্তাভাবনা মূল ঘটনা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়; যেন যুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস দিতে গিয়ে সে একটা গাণিতিক জট খোলার চেষ্টা করছে। ভুলে গেছে যে, যুদ্ধ এখন তার সময়ের উত্তরাধিকার।
তৃতীয়বার চায়ের পানি গরম করতে চুল্লির শিকে আগুন জ্বালে, ঝাঁঝরির নীচে কয়লার স্তূপ ঠেলে দেয়। চিন্তার কুয়াশা গলিয়ে লক্ষ করে, বন্ধু আবু আহমেদ তাকিয়ে আছে, তার অপেক্ষা করছে—বুঝতে পারছে না, কাহিনির ভূমিকা এখনও বাকি, নাকি শেষ। আবু আহমেদের সাথে আলাপ করতে তার ভালোই লাগে। কথাবার্তা বক্তৃতা হয়ে গেলেও বা কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়লেও সে খুব একটা বাধা দেয় না।
সুতরাং পেয়ালায় চা ঢেলে আবার শুরু করে : “তো সৈন্যরা তেল এল-হাওয়ায় অনুপ্রবেশ করল এবং আমাদের ভাবাভাবির সুযোগ না দিয়ে আবাসিক টাওয়ারগুলো দখল করে নিল। তিউনিস ও লেবানন থেকে আসা ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ’র লোকেরা এই প্রথম অনুভব করল যে, তারা সরাসরি ইসরায়েলি সৈন্যদের সংঘর্ষের মুখে পড়েছে, যা ‘৮০-এর পরে আর ঘটে নাই। যদিও দখলদারদের টার্গেট ওই এলাকা ছিল না। ছিল তেল এল-হাওয়ার অপর প্রান্ত, যেখানে আমরা থাকি, মানে প্রতিরোধ বিপ্লবীদের দিক আর কি! সেদিন আমি এই জানালা, ঠিক এই জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে মিসাইল দেখেছি, সাথে গুলির আওয়াজ আর চিৎকার শুনেছি। অনেকেই দেখলাম, দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে আমাদের রাস্তা থেকে দূরে চলে গেলো, বিশেষ করে যারা পাড়ার শেষ মাথায় থাকত। আমরা মাঝামাঝি যারা, তারা আটকা পড়ে যাই। জানালার শার্সি এক সেন্টিমিটারও খুলতে পারি নাই আমি। ঘোর অন্ধকার। বিদ্যুৎ নাই। মাঝেমধ্যে হাঁপানোর শব্দ শুনছি, প্রতিরোধ যোদ্ধারা দৌড়ে যাচ্ছে। সত্যি কথা হলো, দৌড়াচ্ছে কি সৈন্যরা নাকি প্রতিরোধ যোদ্ধারা—নিশ্চিত জানি না। মানে প্রথম ইন্তিফাদার সময় সবকিছু যেভাবে ঘটেছিল, এবার ঠিক সেভাবে চলছিল না; আরও বেশি ক্রুদ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল। যেন একটা খেলা চলছে, যেখানে তুমি বাঁচবা, না হয় মরবা। এমন খেলা, যেখানে তুমি মৃত্যুর ছলনা উপভোগ করবা। তুমি তার মুখোমুখি দাঁড়াইছ, কিন্তু সে তোমার পাশ কেটে গেছে। রাশিয়ান রুলেট খেলার মতো—চেম্বারে একটা বুলেট, ব্যারেলটা কয়েকবার ঘোরাও, তারপর বুলেট তোমার মাথা ছিদ্র করবে কি করবে না না-ভেবেই ঘূর্ণন থামা-মাত্র ট্রিগার টেনে দাও। ধাওয়া-ধাওয়িটা এমন ছিল। লড়াইটা এমন ছিল।”
“আশ্চর্য, যুদ্ধের দশ বছর হয়ে গেছে, আর আজ তুমি এই কাহিনি বলছ!”
“দশ বছর! ঠিকই তো। দিন-তারিখের হিসেবেও প্রায় মিল। এমনই শীত তখন। তাপ নিতে আগুন জ্বালব যে, উপায় নাই। একটা মাছি সমান আলোর ঝলক মানে নিশ্চিত মৃত্যু। যাই হোক, শোন বন্ধু, যুদ্ধবিরতির এক সপ্তাহ আগেই বাচ্চাদের নিয়ে আমার মা আর বউ কোনওমতে মামার বাড়ি চলে গেলো। আমি ঘরেই থাকতাম, তেলে ও জাতারে রুটি ডুবিয়ে রাখতাম। জানতাম তারা পূর্ব দিকটাতে চাইছে প্রতিশোধ নিতে, তা-ই করবে। আমি তবু বাড়ি ছাড়লাম না, পাহারা দিতে থাকলাম। তুমি তো জানো, আমি ইতিহাস কতটা ভালোবাসি। সম্ভবত আমি যুদ্ধের অংশ হতে চাইছিলাম, তা-ই হয়েছে। শুরুতে, আমি শুনেছি একদল যুবক একে অপরকে ডাকাডাকি করছে। কারও গলা চিনতে পারি নাই। হঠাৎ দেখি, কালো কালো ছায়া ছুটে যাচ্ছে অন্ধকারে। স্থানীয় ছেলেদের যে একেবারে চিনতাম না, তা না। কিন্তু কণ্ঠ শুনে চিনতে পারার মতো সখ্যতা তাদের সঙ্গে ছিল না। বিড়ি খাই, জুমায় মসজিদে যাই না—আমাকে একরকম এড়িয়ে চলা স্বাভাবিক। কাজের জন্য বাইরে যেতাম, খেলা দেখতে বা বই পড়তে বাসায় আসতাম। ইচ্ছা ছিল ইতিহাসের শিক্ষক হব, দুর্ভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞানে বেশি নম্বর পেলাম—পরিবার চাপ দিল মেডিসিনের কিছুতে ঢুকতে। অগত্যা ফার্মেসি বিভাগে গেলাম।”
“মনে হচ্ছে, তুমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সামনে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছ। ইতিহাস, তোমার পরীক্ষা এবং ফার্মেসির গল্প তুমি হাজার বার আমাকে বলেছ। আমরা কি বুড়ো হয়ে গেছি? শোনো, ভাই, নিয়মিত জুমা পড়া ধরো, হয়ত আল্লাহ দয়া করবেন এবং তোমার স্মৃতিশক্তি হারানো বন্ধ হবে।”
“শোনো, আবু আহমেদ, কী হয়েছে আমি তোমাকে পুরোটা বলছি। হঠাৎ দেখলাম, কতগুলো জিনিস জ্বলন্ত লণ্ঠনের মতো জ্বলজ্বল করছে। না, লণ্ঠন না, কাচের মতো স্বচ্ছ আলো। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললাম, এরা দখলদার বাহিনীর বিশেষ ইউনিট। তবে তাদের অস্ত্রই জ্বলছিল নাকি তাদের হেলমেট ফ্ল্যাশ করছিল—বলতে পারব না। আমার হৃৎপিণ্ড এমনভাবে ধক ধক করছিল যে, ফেটে বেরিয়ে যাবে। এত ভয় পাইছি যে, আমার মাথায় গুলি করা হবে নাকি ঘাড়ে—বিমূঢ়। পেছন থেকে পা পর্যন্ত ঘাম ঝরছে। মৃত্যুর স্বাদ কী, তুমি তখন টের পেয়ে যাবা। শরীর জমে গেছে, নড়তেও ভয় করছে। নিশ্চিত তারা আমার শব্দ শুনবে। ডেভেলপমেন্ট না হওয়ায় আশেপাশে খুব বেশি বাড়ি ছিল না, খালিই বলা যায়। এটাই প্রতিরোধের জন্য নিরাপদ এবং দখলদারির জন্য মুসিবত সৃষ্টি করছিল। তাদের দুইটা হেলিকপ্টার ব্যাকআপ দিচ্ছিল। আমি কোনওদিন সিনেমায় যাই নাই, তবে সেদিন যা দেখলাম, তাতে এর চেয়ে ড্রামা আর হয় না। বাস্তব জীবনের সিনেমা।
“তারা নিশ্চয় জানত যে কোনদিকে আগাচ্ছে। একটা বাড়িতে হেলিকপ্টারের গোলা পড়ল। একই ভবনে দ্বিতীয়বার গোলাবর্ষণের আগে কয়েক মিনিট গুলি বিনিময় চলল। তারপর সব চুপ। যুদ্ধের আওয়াজ আর পেলাম না। চলে গেছে তারা নাকি হেলিকপ্টারে উঠেছে—কে জানে। আরও কয়েক মিনিট কেটে গেল। শুনলাম মৃদু স্বরে এক যোদ্ধা সাহায্যের জন্য ডাকছে। আহত তিনি। তার সকল কমরেডকে নিশ্চিত হত্যা করা হয়েছে। কেননা, আর কারও কণ্ঠস্বর নাই এবং প্রতিরোধ যোদ্ধারা সাধারণত বিচ্ছিন্ন ঘুরে বেড়ায় না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ এখনও তার কাছে যায় নাই। সবার মনে আতঙ্ক। অবশ্য আমিও যাই নাই। শুধু তাকে ডাকতে শুনেছি, ‘আমাকে সাহায্য করুন।’
“তুমি তো জানো যে, আমরাও সেদিন বাড়ি ছেড়ে উত্তরে মামার বাড়ি পালিয়ে গেছিলাম।”
“আমি তাকে ধুলায় দাপাদাপি করতে শুনলাম। গাড়ির ধাক্কা খেয়ে বিড়াল যেমন বালির উপর ছিটকে পড়ে তড়পায়, তেমন। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া কাউকে বেরিয়ে আসার সংগ্রাম করতে দেখেছ? চোখের পানি ধরে রাখতে পারবা না। আমার মাথা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল—কণ্ঠ শুনছি, কিন্তু লোকটাকে দেখতে পারছি না। তিনি আবার দুর্বল গলায় ডাকলেন, ‘আরব জাতি, কোথায় তোমরা?’
“আশ্চর্য, রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হচ্ছে, তখনও তিনি ভাবছেন অন্তিম সংগ্রামে আরবরা সাড়া দিতে আসবে। হতাশার কারণেই হবে হয়তো, শেষ নিঃশ্বাসের বেদনা তার মন ও কথাকে প্রভাবিত করে থাকবে। ফলে আগের স্লোগানগুলি আওড়াচ্ছিলেন বলা যায়। তবুও, কেউ কীভাবে নামহীন মানুষকে ডাকতে পারে, যাদের প্রতিক্রিয়া তিনি জানেন না? বিষয়টা কেমন, বুঝতে পারছ? একটি ধারণা দিচ্ছি— ধরো, সুইডেনের কোনও শীতের রাতে এক অপরাধী তোমাকে গুলি করল। তো তুমি নিঃসঙ্গ তুষারে মারা যাচ্ছ আর চিৎকার করছ, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আপনি কোথায়?’
“তাঁর এই ডাকের চেয়ে হাস্যকর কী হতে পারে? হ্যাঁ, একটা সস্তা কৌতুক বটে, কিন্তু আমার চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, এ-ই তার নিজের অনিবার্য মৃত্যুর অদম্য অনুভূতি। না, তার অভিব্যক্তি কোনও ইতিহাসের পাঠ নয়। বরং এটা হলো মানবিক দুর্বলতা এবং জীবনের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা। মানে আমার জীবনকে আমার এভাবে ভালোবাসতে হবে।
“পরের দিন সকাল। আমরা একবার নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে, এলাকায় আর শঙ্কা নাই। সাবধানে বাইরে পা রাখলাম। তার রক্ত বালি ভিজিয়ে দিয়েছে। তিনি সেখানে একটা কালো জ্যাকেটে মুখ ঢেকে শুয়ে আছেন।”
“উফ। তুমি আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছ। আর কী বলবে বলো তো? না, এখানে তোমার কোনও দোষ নাই, সালাম। এটা তার ভাগ্য, তার সময় এসে গেছিল।”
“ভাগ্য! তুমি কি পাগল? লোকটার বয়স তখন ত্রিশের কোঠায় হবে। যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, বিয়ে করতেন তবে কয়েক সন্তানের বাবা হতেন। এভাবে একটা অন্যায় মৃত্যুকে মেনে নেওয়া—আমাকে অসুস্থ করে তুলছে। আমি মনে করি না এটা ধর্মবিশ্বাসের বিষয়, এটা স্রেফ অসহায়ত্ব। প্রতিবেশী এবং স্থানীয় লোকজন কোথায় ছিল? মসজিদের শায়খ কোথায় ছিলেন?… ভাই, আরবরা কোথায় ছিল? গত দশ বছর ধরে প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তাকে সেখানে পড়ে থাকতে দেখি আমি। কল্পনা করো তো, কতবার দরজায় থমকে দাঁড়িয়েছি। কতবার তাকে হাত-পা প্রসারিত করতে দেখেছি। সেই রাত থেকে আমি মৃতদের সাথে বসবাস করছি। এই শহরের সবাই, পুরো শহরটাই মৃতদের সাথে বাস করে।”
“একে একে তিনটি যুদ্ধ হলো, এটা সামান্য বিষয় নয়।”
“যুদ্ধ কখন সামান্য হয়? বিশ্বের যে সমস্ত যুদ্ধের কথা আমি পড়েছি, বিশেষ করে যেগুলোতে কয়েক লক্ষ হতাহত হয়েছে, সেগুলি সবই ছিল মিথ্যা, কারণ বেঁচে গেলেই তুমি যুদ্ধ সম্পর্কে লিখতে পারবা, মরে গেলে নাই।”
“আল্লাহ তোমাকে পথ দেখাক। যাও, গিয়ে ফজরের নামাজ পড়। আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে বলা। ইমান না থাকলে আমাদের জনগণ কখনই এই সমস্ত দুর্ভোগ এবং এতসব অপরাধ সহ্য করতে পারত না।”
“আমাদের শক্তির রহস্য ইমান-আমল নয়, মৃতদের সাথে বেঁচে থাকা। শুভ রাত্রি, আমি সকালের নামাজ বাসায় পড়ি।”
“ওহ, আমি তো ভুলে গেছি, তুমি একটা নষ্ট বুর্জোয়া, মসজিদ তোমার বিছানায় আসে। মহান আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুক। কেউ কুফুরি-কথা বলতে চায় না। আল্লাহ আমাকে শক্তি, আশ্রয় দিন। তুমি যা বলছ, বুঝতে পারছি, যুদ্ধের উত্তাপ তোমার মাথা থেকে নামে নি এখনও।”
“আমাদের সাথে যা ঘটছে, তা-ই হলো আসল কুফুরি।”
আবু আহমেদ স্থানীয় মসজিদের দিকে রওনা হয়। সালাম কাপ-কেতলি গুছিয়ে আগুনে বালি ছড়িয়ে দেয়। যতক্ষণ তারা সেখানে বসে ছিল, সারাক্ষণ সে অনুভব করছিল কেউ তার পিছনে দাঁড়িয়ে। সে ঘটনাস্থলের দিকে আরেকবার তাকায়। মৃত মানুষটির পাশে যে শুকনো সিমেন্টের চৌবাচ্চা ছিল সেটা ছাড়া সব আগের মতোই আছে। “দশ বছর ধরে আমরা প্রতিবেশী, আমার বন্ধু,” সে ফিসফিস করে বলে, “অথচ একবারও আমি তোমাকে শুভ সকাল বলিনি।”
আসমা আল-গৌল : ফিলিস্তিনি নারীবাদী লেখক, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিক। দীর্ঘ সময় asmagaza.wordpress.com-এ ব্লগ লিখেছেন এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি ‘আলজাজিরা’র ডকুমেন্টারি বিভাগে কর্মরত। পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লেবাননের সামির কাসির ফাউন্ডেশনের পক্ষে কাজ করেন। ২০০৭ সালে হামাস সরকারের পাবলিক পলিসির বিরোধিতা করায় গ্রেপ্তার হন এবং মিডিয়ার ফোকাসে চলে আসেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালে ‘আ রেবেল ওম্যান ইন গাজা’ শিরোনামে বই লেখেন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাকে হেলম্যান/হ্যামেট সম্মাননা প্রদান করে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক নারী মিডিয়া ফাউন্ডেশন তাকে পুরস্কৃত করে সাংবাদিকতায় সাহসিকতার জন্য। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ফিলিস্তিনি যুব সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আল-গৌল ১৯৮২ সালে গাজার রাফাহতে জন্মগ্রহণ করেন, মিশর সীমান্তবর্তী এই ফিলিস্তিনি শহরের শরণার্থী শিবিরে বেড়ে ওঠেন তিনি। তিনি প্রধানত আরবিতে লেখেন। তবে তার লেখাজোকা ইংরেজি, ড্যানিশ ও কোরিয়ানসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
কিছুক্ষনের নিজেকে আবিষ্কার করলাম ফিলিস্তিনে হারিয়ে গেলাম। কি মর্মান্তিক তাদের জীবন!