তাহাদের না-মানুষের জীবনে

সুবন্ত যায়েদ

বই : গোপন ও নির্জন কোনো ইশারা

লেখক : সুবন্ত যায়েদ

প্রকাশনী : চিলেকোঠা পাবলিকেশন

প্রচ্ছদ : হৃদিতা গুঞ্জন

পৃষ্ঠা : ৮০

গোধূলির মতো এক লগ্ন নেমে আসে তখন। আকাশ বেয়ে কিছু আলো এসে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, দুনিয়াটাকে অপার্থিব মায়ার মতো মনে হয়। কিন্তু কনে দেখা ক্ষণিক আলো সটকে পড়ে দ্রুতই। তখন জেল-পালানো যুবকের মুখ জেগে ওঠে উদ্‌ভ্রান্তের মতো। এই যে রাত নেমে আসে, প্রত্যেক দিন বেলা ফুরায়, চরাচরে অন্ধকার নামে, এখানেই কি শুধু ভয়?

এখন বরং ভয়াল রাত নয়, ভয়াল দিনের ব্যঞ্জনা অধিক হারে ছড়িয়ে পড়ে। তবু সে কিঞ্চিৎ ভয়ার্ত হয় রাতে, কিন্তু বেদনার্ত হয় ভীষণ। এমন বেদনার রাতে আকাশে সর্বদাই বিশাল এক চাঁদ ওঠে। কাছে-দূরে অচেনা অনেক পাখির কোলাহল শোনা যায়। মৃদু বাতাসে নারকেলের চেরা পাতা অনবরত দোলে। আর জেল-পালানো যুবক ক্ষুদ্র অনেক বেদনার ভেতরে একটিবার আত্মহনন বিষয়ক নস্টালজিয়া তৈরি করে। সে জানে যে, বিভিন্ন পথ উন্মুক্ত হয়ে আছে। তবু যাতায়াত সহজ নয়। শিরদাঁড়া যথাস্থানে রাখা কতটা কঠিন, সে নিজের দিকে এমন এক প্রশ্ন ছোড়ে।

নাকি বেঁচে থাকাটাই বড় এই প্রাচীন মৃতদের ভাগাড়ে?

সম্ভবত এই প্রশ্ন জেল-পালানো যুবককে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে কয়েকটি ধারায়। একটি ধারা এমন হতে পারে যে, যারা মানল পৃথিবীটা অপার খেলাধুলার জায়গা, তারা সমস্ত উত্তেজক খেলাধুলায় মগ্ন হলো। সময় ফুরাবার আগে আরো বিচিত্র সব খেলাধুলা বিষয়ক পাঠ নিল। নশ্বর এই জীবনে এত উপভোগের উপাদান ছড়িয়ে আছে যে, তাদের কাছে সেসব অপার বিস্ময়। তারা সম্ভবত অন্ধ হয় উপভোগের নেশায় এবং বিবিধ উপায়ে তারা আয়ু বৃদ্ধির কৌশল তালাশ করে। কিন্তু তারা ভীত স্বভাবের নয় বরং বাঘকে কীভাবে ঘোড়া বানিয়ে সওয়ার হওয়া যায়, সেসব কৌশল তারা রপ্ত করে ফেলে।

কোনো এক সভায় এই শ্রেণি মানুষের ভেতরে শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ঐশ্বরিক নাচের আসরে

জেল-পালানো যুবক জানতে পারে যে, এই শ্রেণি ঐশ্বরিক নাচের আসরে নিমন্ত্রণ পায়। যেখানে বাৎসরিক রমরমা এক আসর বসে ওপর-মহলে। সে মহল এতটাই ঊর্ধ্বে যে, সাধারণের দৃষ্টি সেখানে পৌঁছে না। সুতরাং বিশিষ্টরা দারুণ সুশৃঙ্খলভাবে ঐশ্বরিক নাচের আসরে আসন নেয় এক সন্ধ্যাকালে। উত্তুরে হাওয়ার মৌসুমে সেখানে শীত ছড়ানো দক্ষিণা বাতাসের মজমা বসে। সে বাতাসে মোহ ছড়ানো গন্ধ প্রতিটি কর্নারে পৌঁছে যায়। আর আসরজুড়ে ক্রমাগত নরম আলো প্রতিফলিত হয়।

নাচের আসরে বিদ্যুৎ চমকের মতো অনেক অপ্সরী এসে ঘুরে ঘুরে নৃত্য শুরু করে। নতুন যারা সুযোগ পেয়েছে তারা মূলত জানত না যে, ঐশ্বরিক নাচের আসরে অপ্সরীরা অনাবৃত হয়ে নাচে। ঈশ্বরপ্রদত্ত কিছু সরল মুদ্রা দেহ ঘুরিয়ে তারা প্রদর্শন করে সে মঞ্চে। নগ্ন নারীদেহের বাঁকে বাঁকে এমন মাদকতা তারা বোধ হয় আগে এতটা টের পায় নাই। তাই আসরের বিভিন্ন কর্নার থেকে ক্রমাগত হর্ষধ্বনি ভেসে আসে। সম্ভবত তারা নিজেরাও টের পায় না যে, সমস্ত শৃঙ্খলা কীভাবে টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। এভাবে তাদের অন্তর্গত অবশিষ্ট আব্রু খুলে পড়ে। তারপর কারো কারো গোপন কামরার দিকে সলজ্জ যাতায়াত শুরু হয়। আর বুড়িয়ে যাওয়া অতিথিরা তাদের বিগত যৌবনের কথা স্মরণ করে। এভাবে দারুণ উপভোগের ভেতরে তারা ভুলে যায় পৃথিবীর যাবতীয় দুর্ভোগ ও বঞ্চনার কথা। তারা মনে করতে পারে না যে, কীভাবে পৃথিবীতে ঘামের ইতিহাস লেখা হচ্ছে ক্রমাগত। তাই তারা যাবতীয় উপভোগ থেকে বিরতি নেয় বটে কিন্তু তাদের আচ্ছন্নতা কাটে না। তারপর যখন তারা অধীনস্থদের সামনে আসে, তারা দেখে কী দারুণ সুখী মুখ সকলের। তারপর তারা ইশতেহার অনুযায়ী ঘোষণা দেয় যে, কোথাও কোনো দুঃখ নাই, হতাশা নাই, ক্ষুধা নাই। সকলেই অপার শান্তির সহিত বসবাস করিতেছে।

তখন, জেল-পালানো যুবকের নরম বিছানায় ঘুম গাঢ় হচ্ছে না। শক্ত বিছানায় নিশিযাপন তার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। হঠাৎ এমন নরম বিছানা তার কাছে কৌতুকের মতো লাগে। তবু সে ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। বহুদিন হলো এমন নির্ঝঞ্ঝাট ঘুমানোর সুযোগ তার আসে নাই। জীবনের এমন অগাধ অপচয়ের কথা ভেবে তার দুঃখ হয়। আধো ঘুমেই সে চমকে ওঠে অপচয়ের কথা স্মরণে। মানুষের মুক্তির জন্য লড়াইটা কি তবে অপচয় বয়ে আনল অনেক জীবনের জন্য?

সে পাশ ফেরে এবং ছোটো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার আসলে ঘুম গাঢ় হচ্ছে না বলে চোখের সামনে আবোল-তাবোল অনেক দৃশ্যায়ন ঘটে। ঐশ্বরিক নাচের আসরে তার কতজন সহকর্মীর মুখ চিহ্নিত করা গেছে, এই রকম একটা হিসেব সে করে। উপভোগ ও ক্ষমতার মোহে শক্তিশালী আদর্শও মানুষের সমস্ত দেহ থেকে লুপ্ত হয়ে যায় কত সহজে। তার চোখের উপর অনেক মুখ এমন খেলা করে যে, যারা জীবন বাজি রেখেছিল এবং মৃত্যু ছুঁয়ে গিয়েছিল একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। আজকে তাঁদের জন্য আফসোস এবং শোক। এবং অনন্তকাল তার মনে শোকাবহ থেকে যাবে এ জন্য যে, যাদের আদর্শের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে জীবন উৎসর্গ করে দিল, তারা আজ মোহগ্রস্ত। তারা জীবনের শেষ অধ্যায়েও ফার্ম স্তনের খোঁজে বিভিন্ন বন্দরে পাড়ি জমায়। তারা এখন স্বৈরাচারের সহযোগীর প্রধান প্রধান নাম। এবং সর্বশেষ একজনের পতনের কথা জানা যায়, যে পুঁজিবাদের পাঠ নিতে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে। জেল-পালানো যুবক তার নাম মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু তার চোখে অগণিত মানুষের মুখ ভেসে ওঠে। যারা মাতৃভূমিকে ভাগাড় মনে করেছে কিন্তু লোপাট করেছে দেশের সম্পদ। এবং সমৃদ্ধ কোনো দেশে তারা পাড়ি জমিয়েছে। আর যারা এখানে পড়ে থাকল, তারা মূলত মানুষ নয় কিংবা মানুষ হয়ে উঠল না। তারা মূলত ভাগাড়ের কীট। যারা সংগ্রামে হেরে যায় অথবা জিতে যায়, যারা নিয়তির দোহায় দিয়ে একবার আকাশ পানে তাকিয়ে মৃত্যুকে স্মরণ করে এবং নির্ঝঞ্ঝাট একটি জীবন যাপন করে। একবার তারা কেন হুংকার দিয়ে ওঠে না!

তারা যেমন একবার হুংকার দিয়ে একটি শব্দ লিখেছিল নগরের সবচেয়ে ব্যস্ততম মোড়ে। সংকীর্ণ এক দেয়ালে। কিন্তু কী যে মাহাত্ম্য ছিল লাল হরফে লেখা সেই শব্দে, সংকীর্ণ দেয়াল ভেদিয়া অনেক মানুষের বুকে গিয়ে বিঁধল। গুরুত্বপূর্ণ আলাপে কত কথা চালাচালি হলো। অন্তর্জালে ছড়িয়ে গেল তার দুয়েকটি ভঙ্গিমার ছবি। দুদিন পর কালো রংয়ে ঢেকে গেল দেয়ালটি এবং ঠিক উপরে তার সিসি ক্যামেরা বসল। তারপর স্বৈরাচারীরা কালো ব্যাজ মাথায় বেঁধে লাল রংধারীদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল। তার মনে হয় যে, সেসব ছিল ছোটো ছোটো ঢেউ। তারা এমন কিছু মৃদু ঢেউ তৈরি করতে পেরেছিল। কিন্তু কালো ব্যাজধারীরা এতটাই তৎপর যে, তারা ঘন ঘন রক্তের পিপাসার কথা ঘোষণা করে। এত পিপাসা তাদের কোথা থেকে যে উৎপন্ন হয়, সেই ভয় ও বিস্ময়ে পথ থেকে সটকে পড়ে অনেকে।

কিংবা একদিন রাতে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুটি তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। সেদিনও কি ঘুম পালানো বেদনার রাত ছিল? অন্তত আকাশে কোনো চাঁদ ছিল না বলে তার মনে পড়ে। নক্ষত্র ছড়িয়ে ছিল আরো অনেক নক্ষত্রের ওপারে। ছাদে হাওয়া দিচ্ছিল। তখন বন্ধুটি সুখ প্রকল্প হাতে নিয়ে এলে সে তাহাদের পুরো জীবন পর্যালোচনা করে। আর তার সন্নিকটে সুখ প্রকল্পের আবৃত্তি চলে।

প্রতীকী জীবনের চিরায়ত মিথ

আসলেই কি কোনো হাহাকার আছে!

কী এমন দুঃখ নিয়ে চলাচল করে মানুষ? এই জনপদে রোজ কী সুন্দর এক ভোর নামে। লাল টুকটুক সূর্য ওঠে। কত যে পাখি এসে বসে উঠোনের ছায়াদাত্রী গাছটায়। আর শিশুটা শস্যদানা ছিটায় সে উঠোনজুড়ে। মা মুরগিটা বাচ্চাদের সাথে খুদ খুঁটে খায় সমস্ত সকালবেলা। মাঠজুড়ে যেন ফসলের উৎসবের হাঁকডাক। আর শহুরে মা রোজ ভোরে সন্তানকে নিয়ে ছোটে আলোর পাঠশালায়। মানুষ ক্রমশ আরো উদার হাসতে শিখেছে। মানুষ কি জানে না যে, তাদের জন্য সার্বক্ষণিক সেবা এখন হাতের নাগালে। সুতরাং মানুষের এখন ভরসা আছে, সুখের নিশানা আছে দৃষ্টির সীমানায়।

তখন পুলিশের গাড়ির সাইরেন কেন বাজে?

জেল-পালানো যুবক উতলা হয়। তখন বন্ধুটি ভীষণ সুখের এক হাসি মুখে ধরে রাখে। তার বোধ হয় পদোন্নতি আরো তরান্বিত হবে। আর তার হাত দুটো বান্ধা পড়ে। যখন সে জেলখানার অন্ধকার কুঠুরিতে ঠাঁই পায়, তখন কল্পনার ভূতের চোখের মতো অনেক চোখ সে জ্বলতে দেখে। তারা একে একে কাছে আসে। কী ভারী কণ্ঠ তাদের। এমন একেকটা কণ্ঠ তো মসনদ দুলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তারাও মূলত কিঞ্চিৎ ভীত। তারা বলে, আপনাকেও কি মোহগ্রস্ত করা হয়েছিল বিবিধ সুখের গল্পে? শুনুন সেসব হলো ফাঁদ। তাদের জন্য হুমকি সকলকে কারাবরণ করতে হবে ভীষণ সুখের গল্প শুনতে শুনতে। তারপর আর কি, শান্ত শিশুটির মতো ঘুমিয়ে পড়ুন। কোথাও আর নৈরাজ্য নাই।

তখন কি রাত? কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে। কিংবা আলোর কোনো উৎস আছে কিনা তীক্ষ্ণভাবে তালাশ করে কেউ। কিন্তু কিচ্ছু বোঝার উপায় নাই। তখন তারা যুগ ব্যাপিয়া দীর্ঘ এক রাত্রি যাপনের ভয়ে বলে যে, আমরা মূলত বেঁচে নাই। এই যে সুখ-দুঃখের খেলাধুলা, এসব দেখানো মূলত প্রতীকী। সুতরাং আমরা এক প্রতীকী জীবনের ভেতরে ঢুকে গেছি। এই যে অন্ধকার, সেসব সত্য না। মূলত আলোর ধারণাও সত্য না। অথবা আমাদের স্বপ্ন, আমাদের কান্না। কিন্তু তারা ঘন ঘন পিপাসার্ত হয়। ভ্যাপসা গরমে ঘাম ছোটে। আর অসহনীয় বোটকা এক গন্ধ লেগে থাকে দেয়ালে দেয়ালে। অন্ধকারে টের পাওয়া যায় তেলাপোকা আর ইঁদুরের দাপট। মানুষের কী বীভৎস ক্ষমাহীন এক জীবন এখানে। বাইরে থেকে এখানে শুধু পৌঁছায় কিছু খাদ্য আর কাল্পনিক কিছু জনশ্রুতি। জেল-পালানো যুবক তখনো জেল-পালানো বিষয়ক কোনো চিন্তা করে নাই। তখন একটি খবর রটে যায় হাজতখানায়। মাহাতেব তালুকদারের দুধের কন্যা নাকি বড় হয়েছে বেশ। সে এখন সংসারের হাল ধরতে সকাল-সন্ধ্যা চালের গুদামে ঝরে পড়া চাল টোকায়। এই সংবাদে মাহাতেব তালুকদার আম্মাজান বলে হাউমাউ করে কাঁদে গোটা দিন। বেদনায় বুকটা কীভাবে ভাগ হয়ে চিরে যেতে পারে সেদিন হাজতখানার মানুষজন জেনেছিল। এবং হাজতখানায় সেদিন সবাই একটি কন্যার জন্য নীরবে কেঁদেছিল।

তার পরের দিন পুরো হাজতখানায় তোলপাড় হয়ে গেল। মাহাতেব তালুকদার নাই। যেন ইহলোকেই আর নাই। কথিত আছে সেদিন থেকে তার পরিবারও নিখোঁজ। এবং এসব গল্প নিয়ে আরো যে কত ডালপালা ছড়ায়। নতুন নতুন মিথ তৈরি হয় সে নিরেট অন্ধকার কক্ষে। জনাব মাহাতেব তালুকদার হয়তো গোপনে কোথাও সংসার করে আর সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শুধু কন্যার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে। সে কি আর ভাবে যে, সে একজন বঞ্চিত নাগরিক এবং অনেক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। হয়তো এখনো ফুরসত পাচ্ছে কিছুটা ভাববার এবং তার কন্যাকে সে লাল রং চিনিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবু ভয়ে সে কুঁকড়ে যাচ্ছে রোজ সেই ইঁদুর ও তেলাপোকাময় অতিষ্ট জীবনে, অথবা ধূসর ক্ষমাহীন মৃতদের ভাগাড়ে ফিরতে হবে কিনা সে আশঙ্কায়। অথবা তার চেয়েও বেশি আশঙ্কা তার কন্যার চাল কুড়ানো সে গল্পে। জনাব মাহাতেব তালুকদারের জীবনের গল্প অন্তত আরো বর্ণিল কিছু ভাবে না কেউ। কিন্তু বর্ণিল কিছু গল্পের আসরে জেল-পালানো যুবক প্রথম শোনে ঐশ্বরিক নাচ বিষয়ক কিছু উপকথা। পৃথিবীতে এমন এক নাচ নাকি আছে যেখানে শুধু নিরাভরণ নগ্ন যুবতীরা নাচে। যে নাচের মুদ্রা স্বয়ং ঈশ্বর শিখিয়েছেন এবং আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে সে মুদ্রা রপ্ত করা লাগে।

কী অবান্তর কথা, বলে কেউ কেউ সটকে পড়ে বটে কিন্তু অধিকাংশই আরো গোল হয়ে বসে। সেখানে যাবার যোগ্যতা কী?

তারা একে অপরের মুখের দিকে তাকায় কিন্তু প্রত্যুত্তর আসে না। তখন একজন ভীষণ ক্রোধে তেলাপোকা ছুড়ে মারে দেয়ালে। তারপর তাহাদের জীবনের প্রতীক হয়ে পোকাটা শুঁড় তুলে চিত হয়ে পড়ে থাকে ফ্লোরে। সবাই কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকায়। এসব তেলাপোকাই রাতে আরো নিরেট অন্ধকারে তাদের খাদ্য লেগে থাকা হাত কামড়ে খায়। এভাবে প্রতিনিয়ত কে কাহার খাদ্যে পরিণত হচ্ছে তার কিছু কিছু সকলেই বোঝে। তখন যুবকটি একবার মাত্র ভাবে যে, যেভাবেই হোক একদিন খাদকের উদর থেকে বের হব। অন্তত একদিন দেখব যে, আকাশ চিরকালই উন্মুক্ত। হাওয়া সকলের জন্যই প্রবাহিত।

মাত্র একটিবারের ভাবনা তার দেহ ও মনে অন্যরকমের জোয়ার এনে দেয়। সে অকস্মাৎ বলে যে, আমরা একদিন বাহির হব। আমরা প্রমাণ করে দেবো যে, আকাশ চিরকালই উন্মুক্ত। শুধু আমাদের মনে রাখা চাই যে, নিঠুর শাসকের ছলাকলা ভয়ংকর সুন্দর। তাতে আমাদের ভুলে গেলে কি চলবে নাকি! যারা রোজ আমাদের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে, আমরা কেন তাদের জীবনদানের পোস্টারে লোভাতুর হব?

এভাবে, হাজতখানার একটি অন্ধকার কক্ষে সকলেই নীরব ঐকমত্যে পৌঁছে। এবং সকলের ভেতরে এক ধরনের শান্তি বিরাজ করে।

কিন্তু এখানে শান্তিটাই ক্ষণস্থায়ী। বিষাদের সমস্ত উপাদান যেন ভরপুর, আর এ সমস্ত কিছুই যেন চিরস্থায়ী। তাই একটি বিষয় সকলেই খেয়াল করে যে, এখন নিয়ম করে বুকের বাম পাশে ব্যথা ওঠে। সকলেই আলতো করে বুকের উপরে হাত বোলায়। হার্টবিট যেন ক্ষণে ক্ষণে দরপতন ঘটায়।

আমাদের সুফলা পৃথিবীর জন্য কি খুব বেশি স্বপ্ন দেখা হয়েছিল?

তারা ভাবে। তারা আরো ভাববার ফুরসত পায় যখন দেখে জীবনের প্রতি নির্মোহ মানুষটিও পুঁজিবাদী পাঠ নেয়। এই ভূমি যেন তাদের চিরস্থায়ী সংসার। অথচ একটি অন্ধকার কক্ষে তাদের বয়সটা কীভাবে বেড়ে যাচ্ছে। যেন অযথাই বাড়ছে। সময় যে এক পাগলা ঘোড়া, সে তো ছুটছে। সুতরাং যাবতীয় কার্পণ্য মানুষের ইচ্ছের, সময়ের কোনো কার্পণ্য নাই। কিন্তু এই অন্ধকার কক্ষে পৃথিবীর সমস্ত কার্পণ্য এসে জমা হয়ে আছে। জেল পালাতে চাওয়া যুবক তাই একটি প্রজাপতির জীবনচক্রের জন্য হা-হুতাশ করে ওঠে এক সন্ধ্যায়। অনেক নিষ্ঠুরতা ও কুৎসিত ঘটনার পরেও জীবনের শেষ বেলায় একটি প্রজাপতি যাবতীয় সৌন্দর্য পেয়ে যায়। তবু পায় তো! ফুলে ফুলে অবাধ বিচরণের মহোৎসব।

তাহাদের না-মানুষের জীবনে

সে যখন জেল থেকে বাহির হয়, পৃথিবী তখন মহা ধুমধামের সহিত জীবন ও মৃত্যুর আয়োজন করছে।

মৃত্যুর মাধ্যমে যদি মানুষের মুক্তি ঘটে, তবে জীবনের মাধ্যমে মানুষ মূলত কী লাভ করে?

সে কি বৃহৎ এক জেলখানার নাগরিক হয়ে যায়! সে তখন আকাশপানে তাকায় আর অনুভব করে, মহাজীবনের একটি ঘুম বাকি পড়ে গেছে। ঘটনাক্রমে সে একটি বিলাসী বিছানায় ঘুমোবার সুযোগ পেয়ে যায়। কিন্তু কী নির্মমতা যে, নরম বিছানায় তার ঘুম গাঢ় হচ্ছে না। সে ঘন ঘন পাশ বদলাচ্ছে। তখন বিশাল এক টিভিস্ক্রিনে দেশ-বিদেশের হালচাল বিষয়ক বয়ান চলছে। আধো ঘুমে সে দেখে, কোথাও ভেসে যাচ্ছে বন্যার তোড়ে। আর একটি অবতার যেন নেমে এসেছে হঠাৎ। কী সাজ সাজ রব। এমন সাজানো নাওখানা অবতারের বৈকি, তারা যে কখনোই এমনটা দেখে নাই। নাকি এই দুর্যোগেও কারো বিবাহের হাউস উঠেছে! প্লাবিত জনপদে এমন কানাঘুষার ভেতরে নাওখানা কূলে ভেড়ে। মানুষজন দেখে যে, কারো বিবাহ নয় কিংবা অবতার নয়, হয়তো অবতারের মতো জনপ্রতিনিধি, নেমে এসেছে জনগণের দুর্দশা দেখতে।

কিংবা দেখা যায় মানুষের হেথায়-সেথায় দৌড়াদৌড়ি। কী বিশৃঙ্খল বর্বরের মতো। আর সামনে দিয়ে ছুটে যায় টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাকটা। কিংবা দেখা যায় একটি কুকুরজীবন। জীবনের সমস্ত সম্পদ ব্যয় করে সে কুকুরের জীবন ধারণ করেছে। মানুষের জীবন আর আনন্দ এনে দেয় না। কোনো আশা দেখায় না। কী নিখুঁতভাবেই না সে কুকুরজীবন গ্রহণ করেছে। কুকুরদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অনায়াসে।

এই সংবাদে কি যুবকের প্রশান্তি আসে কিঞ্চিৎ?

হয়তো আসে। হয়তো আসে বলেই তখন তার ঘুম গাঢ় হয় ক্রমশ। সে তখন জেগে ওঠে বিশাল এক আসরে। কী আলো ঝলমলে চারিদিক! এই-ই কি তবে সেই ঐশ্বরিক নাচের আসর হবে! তখন সে চেনা মুখ খুঁজতে গিয়ে দেখে জনাব মাহাতেব তালুকদার আসরের প্রথম সারিতে। সে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়। সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখে আরো অনেক চেনা মুখ আসর ঘিরে বসে আছে। সংখ্যায় অনেক কিন্তু কত সুশৃঙ্খল তারা। হয়তো তখন তার মনে পড়ে একবার, টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাকটার পেছনে বিশৃঙ্খল বর্বরদের দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু এই আনন্দ উৎসবের ভেতর সেসব দৃশ্য মুহূর্তেই গলে যায়। ততক্ষণে আসরে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে আগুন। আর তার চারপাশে ঘিরে থাকা কতিপয় নগ্ন নিরাভরণ যুবতী। যখন বিশেষ মুদ্রায় তারা দুলে ওঠে তখন দুলে ওঠে যেন সমস্ত আসর। উন্মাদের মতো লাগাতার হর্ষধ্বনি চলে। যেন উল্লাসে ফেটে পড়ে সকলে।

আর যুবক ভীষণ উত্তেজনা বোধ করে। সে কি তবে সত্যিই বিশেষ এক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হলো, যারা ঐশ্বরিক নাচের আসরে যথাযথ মর্যাদার সাথে নিমন্ত্রণ পায়!

তখন তার বুক বরাবর একফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়লে সে ভাবে যে, একটি হেলদি জীবনের স্বপ্ন বুঝি এমনই। এমন নেশাতুর জীবনের স্বাদ তার সত্যিই জানা ছিল না।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷