বই : বিপ্লবী নবী
লেখক : মওলানা আজাদ সুবহানি
প্রচ্ছদ : রাজ্জাক রুবেল
প্রকাশনী : গ্রন্থিক প্রকাশন
পৃষ্ঠা : ২২৪
হজরত মুহাম্মদ (স) কে ছিলেন? তাঁকে নিয়ে দুনিয়াজুড়ে এমন আলোড়ন সৃষ্টিরই-বা কারণ কী? চিন্তাশীল যেকোনো মানুষের মনেই প্রথমে এই দুইটি প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক—বিশেষত যখন তিনি দেখতে পান সবখানেই হজরত মুহাম্মদের (স) নাম ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।
তো আমার মনে হয় প্রথম প্রশ্নের জওয়াবটিই প্রথমে জানা দরকার। কারণ এই জওয়াবটিকে সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে তবেই দ্বিতীয় প্রশ্নের জওয়াব উপলব্ধির জন্য প্রস্তুত হওয়া সম্ভব হবে।
সাকিন
হজরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন একাধারে আরাবি, মক্কি ও মাদানি। তার জন্মস্থান ছিল আরব উপদ্বীপে, তাই তিনি আরাবি। মক্কা ও মদিনায় তিনি জীবন অতিবাহিত করেন। প্রথমে তিনি মক্কারই বাসিন্দা ছিলেন, পরে মদিনায় হিজরত করে বসতি স্থাপন করেন।
বংশসূত্রের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একাধারে কুরায়শি হাশেমি ও মুত্তালিবি—কেননা তিনি কুরায়শ বংশের বনি হাশিম গোত্রে মুত্তালিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশপরম্পরায় নিকটতম সূত্র ছাড়া দূরসম্পর্কের আরও একটি সূত্র আছে। সেই সূত্র অনুসারে তিনি আদনানি, ইসমাইলি ও ইবরাহিমি। তার বংশপরম্পরায় ঊর্ধ্বতন পুরুষ হজরত ইবরাহিম (আ), তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ) এবং তারই বংশের এক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন আদনান। এই আদনানের বংশধরগণ পরবর্তীকালে বিভিন্ন গোত্র ও শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। কুরায়শ তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই শাখারই বনি হাশিম গোত্রের মুত্তালিব পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এখান থেকে স্পষ্ট হলো তিনি হজরত ইবরাহিমের (আ) অধস্তন পুরুষ।
মধুময় নাম
তার নাম দুটো—মুহাম্মদ ও আহমদ। ইসলাম ধর্ম ও কোরআনের মনোনীত নাম মুহাম্মদ; এইজন্য এই নামটিই সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেছে। ইসলামপূর্ব যুগে ও আহলে কিতাবিদের গ্রন্থে তাকে ‘আহমদ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মুহাম্মদি যুগের ইতিহাসে বর্তমান যেন অতীত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেজন্যে উম্মতে মুহাম্মদি দুই নামই একসাথে গ্রহণ করে। তাই, যখন কোনো মুসলমান তার নাম উচ্চারণ করেন, তিনি বলেন,—‘আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা’।
‘মুজতবা’ এবং ‘মুস্তফা’—এই দুইটি শব্দ নামের অংশ নয়, সম্মানসূচক পদবি। উভয় শব্দের অর্থ একই—মনোনীত। মূল নামের সাথে এই শব্দ জুড়ে দেওয়া এ কথাই ঘোষণা করে যে তিনি আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি; তাকে সেই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে এবং তার সঙ্গে সেরকম সম্পর্কই রক্ষা করে চলতে হবে।
‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বাক্যটিও তার নাম থেকে আলাদা। এটি প্রার্থনামূলক বাক্য। এর অর্থ—‘মুহাম্মদের (স) ওপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।’ ‘মুজতবা’ ও ‘মুস্তফা’ এই দুই সম্মানসূচক পদবি অপেক্ষা ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বাক্যটিকেই তার নামের সাথে উচ্চারণ করা ওয়াজিব বা অধিকতর জরুরি গণ্য করা হয়। এমনকি এই বাক্যটি শেষে যুক্ত না করে আল্লাহর রসুলের নাম উচ্চারণকে বেয়াদবি এবং খানিকটা গুনাহর কাজ গণ্য করা হয়। এইজন্য তার নাম উল্লেখের সঙ্গে এই বাক্যটির উল্লেখও অপরিহার্য কর্তব্য হিশাবে পরিগণিত হয়ে আসছে সব সময়। ন্যূনতম ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন কোনো মুসলমানের মুখ হতে তাই কখনও ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ ছাড়া আল্লাহর রসুলের নাম উচ্চারিত হতে দেখা যায় না।
‘মুজতবা’ ও ‘মুস্তফা’ ছাড়াও তার আরও অনেক সম্মানসূচক পদবি আছে এবং এর সংখ্যা এত বেশি যে, সবগুলোকে একত্র করতে গিয়ে আলাদা গ্রন্থ প্রণয়ন করতে হয়েছে। এই সব সম্মানসূচক নাম ও পদবি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হাসিলের জন্য গ্রন্থগুলো পাঠ জরুরি। উল্লিখিত বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে দুইটির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য—দরুদে তাজ ও হিজবুল বাহার। অবশ্য এত অধিক সংখ্যক সম্মানসূচক নামের মধ্যে পাঁচটিই প্রধান। হজরত মুহাম্মদকে (স) জানতে হলে পাঁচটি সম্মানসূচক নামের সাথে পরিচিত হওয়া অবশ্য কর্তব্য এবং তার সামান্যতমও বরকত হাসিলের জন্য সেই পরিচয়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াও কর্তব্য।
এই প্রধান পাঁচটি সম্মানসূচক নাম হলো :
- শাফিউল মুজনাবিন বা পাপীদের জান্নাত প্রবেশে সুপারিশকারী।
- রহমাতুল্লিল আলামিন বা সমগ্র জগতের রহমত।
- সাইয়িদুল মুরসালিন বা সকল নবী-রসুলের নেতা।
- খাতামুন্নাবিইয়িন বা নবীগণের সিলমোহর।
- ইমামুর রব্বানিইয়িন বা রব্বানিদের পথিকৃৎ।
এর মধ্যে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ ও ‘খাতামুন্নাবিইয়িন’ এই দুইটি সম্মানসূচক নাম স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত এবং আল্লাহর কিতাবে এর উল্লেখ আছে। অবশিষ্ট তিনটি সম্মানসূচক নাম তার উম্মতগণ প্রদান করেছেন। এর মধ্যে দুইটি পুরাতন, একটি নতুন। এই নতুন সম্মানসূচক নামটি হলো ‘ইমামুর রব্বানিইয়িন’। রব্বানিগণ এই সম্মানসূচক নামটি উদ্ভাবন করে দো-জাহানের নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শেষোক্ত সম্মানসূচক নামটি নতুন হলেও এর গুরুত্ব ও মূল্য অপরিসীম।
হজরত মুহাম্মদের (স) পিতার নাম আবদুল্লাহ আর মাতার নাম আমেনা; দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব। তার চাচাদের মধ্যে হামজা, আব্বাস, আবু তালেব ও আবু লাহাবের নাম উল্লেখযোগ্য। অনেকেই আবু জাহলকেও তার চাচাদের মধ্যে শামিল করে থাকেন; কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভুল। তার চাচাতো ভাইদের মধ্যে হজরত আলী, হজরত আবদুল্লাহ ও হজরত ফজল (রা) প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
তার আগমন কেন মক্কায় হলো
মক্কা নগরীর আবদুল মুত্তালিবের গৃহে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পূর্বেও মক্কা নগরীর প্রসিদ্ধি ছিল সারা আরবজুড়ে, কেননা মক্কাই ছিল আরবের শ্রেষ্ঠতম উপাসনাকেন্দ্র। এখানেই অবস্থিত সেই কাবাঘর, যার খ্যাতি ও মর্যাদা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নির্ণয় করা মুশকিল। এ কথা সত্য যে কাবার খ্যাতি ও মর্যাদা আল্লাহর নবীর (স) হাতেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। তারপরও স্বীকার করতে হয় যে, কাবার খ্যাতি ও মর্যাদা বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যদি বলা হয় সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা অনুসারে শুদ্ধতম ও খ্যাতিমান হজরত মুহাম্মদ (স) পূতঃপবিত্র ও প্রশংসিত অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন, কিংবা তার আলোকময় ও ঐতিহাসিক প্রকাশের জন্য পবিত্র ও প্রসিদ্ধ স্থানকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল, তা ভুল হবে না।
মর্যাদার দিক থেকে অবশ্য কাবার সাথে মুত্তালিব পরিবারের তুলনা হতে পারে না। কেননা কাবার মর্যাদা কাবার জন্যই নির্দিষ্ট। তারপরেও মুত্তালিব পরিবারের একটি নিজস্ব মর্যাদা ছিল। সে মর্যাদা এই যে, এই পরিবার ছিল গোটা আরব অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম ধর্মীয় নেতার পরিবার। সুতরাং আল্লাহর নবীর (স) জন্মস্থান হিসেবে শহর নির্বাচনের ব্যাপারে যেমন একটি পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয় পরিবার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তেমনই একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যায়। এই পরিকল্পনা কী এখন তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বিষয়টির গভীরে প্রবেশের আগে মক্কা এবং মুত্তালিবগৃহের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করা কর্তব্য; কেননা শুধু তখনই এই দুইটি স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে যে মহান নীতিগত ও শিক্ষণীয় ইশারা বিদ্যমান রয়েছে, তা হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে।
কাবার গুরুত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে আপাতদৃষ্টিতে মক্কা কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা তেমন ছিল না। বরং তা বৈষয়িক দিক দিয়েও উন্নত একটি শহর ছিল। মূলত মক্কা ছিল তখনকার আরব অঞ্চলের লন্ডন বা নিউইয়র্ক—ব্যাবসা-বাণিজ্য ও তহজিব-তমদ্দুন (সভ্যতা-সংস্কৃতি) দুটোরই প্রধান কেন্দ্র। আরবের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী, আশরাফ ও কুলীন নাগরিকগণ এখানে বাস করতেন; ফলে তা ব্যবসায়ী, নেতা ও সমাজপতিদেরই বিশিষ্ট শহর হিসেবে গণ্য হতো। মোদ্দাকথা, মক্কা তখন সারা আরবের পুরোদস্তুর ‘দারুল হুকুমত’—রাজনীতি, শিল্পকলা ও তমদ্দুনিক (সাংস্কৃতিক) প্রাণকেন্দ্র।
আবার কাবার মতোই মুত্তালিব পরিবারটিও ছিল সকল দিক থেকে মক্কার প্রাণকেন্দ্র। তখনকার মক্কাকে যদি আরবের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় এবং সেজন্য যদি লন্ডন-নিউইয়র্কের সাথে তার তুলনা চলে, তাহলে সেই বিচারে মুত্তালিবগৃহকেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল অথবা হেনরিফোর্ড ভবন, রকফেলার ভবন বলে অভিহিত করা যায়। তেমনই মক্কাকে সারা আরবের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল বা দারুল হুকুমত রূপে গণ্য করা হলে মুত্তালিব পরিবারকে রাজনীতির কেন্দ্রস্থল রাজভবন বা আরবের হোয়াইট হাউস বা বাকিংহাম প্যালেস বলতে হয়। আর মক্কাকে আরবের তহজিব-তমদ্দুনের (সভ্যতা-সংস্কৃতির) প্রাণকেন্দ্র বলে স্বীকার করলে মুত্তালিব পরিবারকে তহজিব-তমদ্দুনের কেন্দ্রস্থল বলে অভিহিত করা যায়।
মক্কা নগরী ও মুত্তালিবগৃহকে আল্লাহর নবির (স) জন্মস্থান নির্বাচন করার পেছনে যে পরিকল্পনাটি লুকায়িত ছিল, তা এই যে, তিনি কেবল আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন দরবেশ, যোগী, সন্ন্যাসী—অর্থাৎ সংসারবিরাগীদের নেতা হওয়ার জন্যই প্রেরিতপুরুষ হননি, বরং বণিক-ব্যবসায়ী, সমাজপতি, বিদগ্ধ, কুলীন ও অভিজাতদের নেতৃত্ব দানও তার প্রেরিত হওয়ার উদ্দেশ্য। মানে আল্লাহর নবি (স) তার অনুসারীদের জন্য কেবল আধ্যাত্মিক সাধনার চরম সিদ্ধি ও এবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে নজির স্থাপনই নয়, বরং একই সাথে তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও শাসনকার্যেও পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করতে ও তাতে চূড়ান্ত নজির স্থাপন করতে শিক্ষকরূপে প্রেরিত হন। আমাদের কর্তব্য হলো তার নির্দেশনা অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে তার অনুসারীদেরকে আল্লাহর খেলাফতের চরম সৌভাগ্য ও গৌরবের মোকাম হাসিল করতে হবে।
এই ব্যাপারে আরও একটি সূক্ষ্ম বিষয় নিয়েও গভীর বিচার-বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে—শহর হিসেবে মক্কাকে যেমন জন্মস্থান নির্দিষ্ট করা হলো, গৃহ হিশাবে তেমনই কাবাকে নির্দিষ্ট করা হলো না কেন? অথচ তা-ই হওয়া তার সম্মান অনুপাতে যুক্তিযুক্ত হতো; হজরত আলীর জন্মস্থান যেভাবে কাবাঘর, তার জন্মস্থানও সেভাবে কাবাঘর হতে পারত না?
না, কারণ আল্লাহ তাআলার তার নবীকে (স) প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো তাকে সামগ্রিক নেতৃত্বের উপযোগী করে তোলা ও তার দ্বারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পন্থা নির্দেশ করা। যদি তার জন্ম কাবাঘরে হতো, এই উদ্দেশ্যের ইশারা আধাআধি হতো, কেননা কাবাঘর তো কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল, পার্থিব রাজনীতি-অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল না। অন্যদিকে মুত্তালিব পরিবার ছিল পার্থিব বিষয়ের কেন্দ্রস্থল। সুতরাং মক্কাকে জন্মস্থান নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা বিধান এবং মুত্তালিব পরিবারে প্রেরণ করে তার জাগতিক জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন করা হয়। এমনিভাবে হজরত মুহাম্মদের (স) ফিতরতে (স্বভাবে) আধ্যাত্মিক ও জাগতিক—উভয় দিককার গুণের সমন্বয় সাধন করে তাকে মানবজীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের যোগ্য করে তোলা হয়।
হজরত আলীকে (রা) যেহেতু আধ্যাত্মিক জগতের নেতা বানানোই উদ্দেশ্য ছিল, তাই তার জন্মের জন্য কাবাকে নির্দিষ্ট করা হয়। তাই দেখা যায় হজরত আলী (রা) আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উচ্চতম অংশ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু পার্থিব জগতের ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু অর্জন করতে পারেননি। তিনি যে অনুপযুক্ত ছিলেন তা নয় বরং তার মধ্যে পার্থিব জগতে উন্নয়নের আগ্রহই ছিল না। এই কারণেই আল্লাহর নবী (স) হজরত আলীকে (রা) হজরত হারুনের (আ) মতো বলে আখ্যায়িত করেছেন, হজরত ইউশার (আ) মতো বলে আখ্যায়িত করেননি। আবার ঘোষণা করেছেন, ‘আলী (রা) আমার অনুসারীদের মধ্যে ঈসা ইবনে মরিয়মের (আ) মতো।’
তার ইন্তেকাল কেন মদিনায় হয়েছিল
মক্কাকে যেমন জন্মস্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তেমনই অন্য একটি জায়গাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল চিরনিদ্রার স্থানরূপে। কবরস্থান নির্বাচনের ব্যাপারে পৃথক একটি পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়। জন্মস্থানের জন্য তো এমন একটি জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল যা ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ শহর—ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র, রাজনীতির প্রাণভূমি, শাসন-পরিকল্পনাকেন্দ্র এবং সেইসঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু চিরনিদ্রার জন্য এমন একটি জায়গাকে নির্বাচন করা হলো যার এইসকল মর্যাদা বা খ্যাতির কোনোটাই ছিল না। তবে মদিনা কী ছিল? ছিল কিষানদের একটি বসতি মাত্র—পশুপালন ক্ষেত্র, চাষীদের একটি সাধারণ পল্লি, বড়জোর একটি বৃহৎ কৃষক এলাকা। এখানে আধ্যাত্মিকতার কোনো ছাপ ছিল না, ছিল না পার্থিব জগতের কোনো বিষয়ে সামান্যতম খ্যাতি।
এরপরেও মুসলমানদের মতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আর অমুসলমানদের মতে শ্রেষ্ঠ মানবদের একজন, যার জন্মস্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল সভ্যতার লীলাকেন্দ্র, অথচ তারই চিরনিদ্রার স্থান হিসেবে এমন অখ্যাত, শ্রমজীবী-অধ্যুষিত ও সভ্যতা-সংস্কৃতির আলো থেকে বিচ্ছিন্ন একটি জায়গাকে কেন নির্বাচন করা হলো? এটি এইজন্য যে, পূর্ণতাপ্রাপ্তির পূর্বক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্য জ্ঞান-আহরণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয়। তাই পূর্ণতাপ্রাপ্তির আগে এমন একটি বড় জায়গায় অবস্থান প্রয়োজন যে-স্থান থেকে জ্ঞান-আহরণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সম্ভব। আরবে মক্কা নগরীই সেই দিক দিয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল। এ কথাও স্পষ্ট যে, জন্ম ও সত্যের প্রতি আহ্বান করার যোগ্যতা অর্জনের সময়টি অপরিপক্বতার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সমীচীন। সুতরাং জন্ম থেকে সত্যের প্রতি দাওয়াতের জন্য যোগ্যতা অর্জন পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করার জন্য পবিত্র মক্কা নগরীই সঠিক স্থান বলে মনোনীত করা হয়—কারণ, মক্কা যেমন আধ্যাত্মিকতার শ্রেষ্ঠতম কেন্দ্র ছিল তেমনই জাগতিক উন্নতির সকল সুযোগ-সুবিধাও মক্কায় বিদ্যমান ছিল। সেখানে আল্লাহর নবী (স) আর্থিক ও জাগতিক বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করে উভয় ক্ষেত্রেই কামালিয়াত হাসিল করেন এবং নিজের চরম উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হন। সেখানেই তিনি প্রাপ্ত হন আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে নবীত্ব ও সত্যের পথে মানুষকে ডাকার পূর্ণ যোগ্যতা। এবং অর্জন করেন জাগতিক ব্যাপার-স্যাপার—ব্যবসা-বানিজ্য, রাজনীতি ও রণকৌশলে অপূর্ব দক্ষতা।
কামালিয়াত হাসিলের পর কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনের সময় আসে। এই সময় প্রয়োজন হয় এমন একটি ক্ষুদ্র জায়গা যেখানে উভয় ক্ষেত্রের সঞ্চয়ই ব্যবহার করা যায়, যেখানে মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়, যেখানে শক্তির পরিবর্তে নম্রতাতেই কাজ চলে, এবং যেখানকার অধিবাসীদের গ্রহণক্ষমতা থাকে অত্যধিক। এমন জায়গার জন্য মদিনার মতো স্থানই ছিল সবদিক দিয়ে উপযুক্ত। অবশ্য এই প্রশ্ন উঠতে পারে হিজাজ বা আরব উপদ্বীপে এমন বহু অখ্যাত স্থান ছিল, তা সত্ত্বেও মদিনাকেই নির্দিষ্ট করা হলো কেন? এর জওয়াব কল্যাণ ও মঙ্গলে অখ্যাতের অগ্রাধিকার আছে, কিন্তু কৃত্রিমের নাই। মদিনা অখ্যাতদের জায়গা ছিল ঠিক, কৃত্রিমদের জায়গা ছিল না। অখ্যাত অথচ কৃত্রিম নয় এমন জায়গা আরবে কয়টিই-বা ছিল? অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে এই বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে মদিনা ছিল অদ্বিতীয়।
এ ছাড়াও কল্যাণমূলক কাজের জন্য ক্ষুদ্র জায়গা ও পতিত জনতার প্রয়োজন আছে বলে যে কথা রয়েছে, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায় মক্কার আমজনতায় দাওয়াতের নিস্ফলতা ও মদিনায় আমজনতায় দাওয়াতের সাফল্যের মধ্যে। নিশ্চয় এ কথা সবারই জানা আছে যে, মক্কায় তেরো বছরের দাওয়াতে দাওয়াত-কবুলকারীর সংখ্যা বেশি বৃদ্ধি পায়নি। অথচ মদিনায় দশ বছরের দাওয়াতে রাজ্যের পর রাজ্য সাড়া দিয়েছে এবং কবুলকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে লাখের অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ কথা সত্য—মক্কায় যারা তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন এক একটি হীরার সমতুল্য। কিন্তু হীরা দিয়ে তো আর বাজার ধরা করা যায় না, বাজার ধরার জন্য প্রয়োজন প্রচুর টাকা-পয়সার।
এতে কোনো সন্দেহ নাই মদিনাকে নির্বাচন করার এছাড়াও আরও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল—যেমন অবস্থানের গুরুত্ব, অধিবাসীদের যুদ্ধ করবার যোগ্যতা, এবং এর রাজনৈতিক ও গঠনমূলক ব্যবস্থাপনার অনুকূল পরিবেশ। মদিনার পরিবেশ এমন ছিল :
এক. মদিনা হেজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এখানে বসে আরব ও সিরিয়া উভয় এলাকাকেই দাওয়াতের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করা সম্ভব ছিল।
দুই. মদিনা থেকে কিছু দূরে এমন একটি সংযোগস্থল অবস্থিত ছিল, যে-স্থান দিয়ে একটি পথ সিরিয়ার দিকে চলে গেছে। সিরিয়া থেকে মক্কার সওদাগরদের এই পথ দিয়ে ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না।
তিন. মদিনার অধিবাসীদের বেশির ভাগই ছিল কিষান-মজদুর। কিষান-মজদুররা স্বাভাবিকভাবেই সংযমী, পরিশ্রমী ও সাহসী হয়ে থাকে। এই কারণে মদিনা ছিল প্রকৃতিগতভাবে সৈনিকদের ভূমি, এখানকার অধিবাসীদের সহযোগিতায় একটি সুদক্ষ সেনাবাহিনী গঠন করা অতি সহজ ছিল।
মদিনার চারপাশে ইহুদিদের বসতি ছিল। কর্তৃত্বও ছিল তাদের হাতে। এই ইহুদিদের অধীনে ছিল গোটা কয়েকটি দুর্গ—এইগুলো জালের মতো বিস্তৃত ছিল সারা মদিনায়। দুর্গগুলো করতলগত করতে সক্ষম হলে সারা আরবের মোকাবেলায় একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল লাভ করার সম্ভাবনা ছিল। তা ছাড়া যেহেতু ইহুদিদের হাতেই ধর্ম, অর্থনৈতিক শক্তি ও কর্তৃত্ব ছিল, তাই পুরো আরব অঞ্চলই তাদের ভয়ে ভীত থাকত। তাদের পরাস্ত করতে পারলে সারা আরবে কর্তৃত্ব বিস্তার করা অতি সহজ ছিল। আর মদিনার একেবারে আশেপাশে ছিল খ্রিস্টান গোত্রসমূহের শাসনকর্তৃত্ব। তারাও দুর্গাধিপতি ছিল। তাদের পরাজিত করতে পারলে শাসনক্ষমতা লাভ করার পথে আর কোনো বাধা ছিল না এবং বৈপ্লবিক দাওয়াতের পেছনেও তা পূর্ণ শক্তি জোগাতে সক্ষম ছিল। এছাড়া, মদিনা সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত। সুতরাং মদিনায় প্রতিষ্ঠা লাভের পর সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাও সহজ ছিল।
মদিনা আল্লাহর নবীর (স) চিরনিদ্রার স্থান হওয়ার জন্য আরও একটি কারণ বেশি উপযুক্ত, তা এই যে—মক্কায় নতুন ‘হারাম শরিফ’ স্থাপন করা সম্ভব হতো না, সেখানে হজরত মুহাম্মদের (স) হারাম শরিফ বা পূণ্যধাম প্রতিষ্ঠা করা হলেও আদিপিতা হজরত ইবরাহিমের (আ) সাথে তার মর্যাদা মিশে যেত। মদিনায় এতে কোনো বাধা ছিল না; এখানে তার নতুন ‘হারাম শরিফ’ হওয়া সম্ভব। আর এ কথা সত্য আল্লাহর নবী (স) যে ইনকিলাবি দাওয়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন তার জন্য একটি খালেস ‘হারামে মুহাম্মদি’-এর প্রয়োজন ছিল। ‘তৌহিদ’ এমন একটি মিশ্র ও বিমূর্ত ধারণা যে এর সঠিক ব্যাখ্যা ও পূর্ণতা বিধানের জন্য হজরত মুহাম্মদের (স) প্রয়োজন ছিল। সুতরাং তৌহিদের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই তার ব্যক্তিত্বের আভায় মণ্ডিত হওয়া উচিত। কিন্তু খালেস ‘হারামে মুহাম্মদি’ ছাড়া কীভাবে তা সম্ভব হতো? সিরাত ও চরিত্র-আদর্শের কেতাবি বর্ণনা ও ব্যাখ্যার অবশ্যই একটি মূল্য রয়েছে, কিন্তু তা যে শুষ্ক! জীবনক্ষমতা যে এতে বিদ্যমান থাকে না! হৃদয় ও মনকে উজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজন একটি চাক্ষুষ প্রেরণা-উৎসের। যতদিন মৃত্যুর কালো পর্দা তার জীবনে নেমে না আসে ততদিন জাতির প্রতিষ্ঠাতা এই উৎস হতে পারেন; আর হতে পারে তার পবিত্র মাজার ফরিয়াদির জন্য ‘হারাম শরিফে’। জিয়ারতকারীদের অন্তরে এই ‘হারাম শরিফ’ চিরবসন্তময় ও সুবাসিত কাননের মতো। এ-স্থান সব সময় মহব্বত ও ঈমান-একিনের সুগন্ধ বিতরণ করে এবং তাদের মন ও মস্তিষ্ককে আমৃত্যু তারই নেশায় মাতোয়ারা রাখে। যারা মসজিদুল হারামের (কাবা শরিফ) সাথে মদিনাও জিয়ারত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের নিকট জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারা যাবে যে মদিনায় চিরবসন্তময় ‘বাগে জান্নাত’ প্রেম ও প্রত্যয়ের কী মধুর সুবাসই না তাদের মাঝে বিলিয়েছে।
এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, নতুন হারাম শরিফ প্রতিষ্ঠা একদিক থেকে তৌহিদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু শুধু এই ক্ষতিই তৌহিদের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটাতে পারে না, তৌহিদের অনুপস্থিতি তা পারে। তৌহিদকে আকৃতিমুক্ত রাখুন এবং কেবলমাত্র তা মনে ধারণের বিষয় বলে মনে করতে থাকুন—দেখবেন তৌহিদ গায়েব হয়ে গেছে। সুতরাং তৌহিদকে মনে ধারণের পরিবর্তে বাস্তবে আনার জন্যে ‘হারাম শরিফ’ প্রতিষ্ঠা জরুরি। অবশ্য এতে যতটুকু ক্ষতির আশঙ্কা বিদ্যমান তা প্রতিরোধের ব্যবস্থাও অবশ্যই থাকা দরকার। আর এটাই তৌহিদের খেদমতের বাস্তবপন্থা। সুখের বিষয়, হজরত মুহাম্মদ (স) সেই ক্ষতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছেন, এবং চূড়ান্ত ব্যবস্থাই করে গেছেন।
মনে হচ্ছিল, লেখাটা শেষ না হোক। লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক সবাইকে আল্লাহ উত্তম জাযায়ে খায়ের দান করুন