আপনি কি সত্যিই সাপটা দেখেছেন?
– হ্যাঁ।
– দাড়িওয়ালা সাপ?
– সাপ তো দেখেছি, ওটা সাপই তো ছিল।
– কিন্তু দাড়ি যে! ওটা তো অসম্ভব কিংবা বিরল। তাহলে অসম্ভব এবং বিরল একসঙ্গে টেনে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে ভাবতে হচ্ছে । আরেকটা বার ভাবুন তো আসলে ও সাপের দাড়ি ছিল নাকি ভয়ে কিছু একটা ভেবেছেন। শুনেছি এই সাপের দাড়ি বিষয়ক গল্প আপনি শুনেছেন এই বাড়ির পুরাতন মানুষের কাছ থেকে। অবশ্য তারা শুনেছে কিন্তু কেউ দেখেছে বলে দাবি করছে না কিন্তু আপনি সেটা করছেন। জিনিসটা খোলাসা না করে পরবর্তীতে মনে মনে সেটাই কল্পনায় এঁকেছেন, তারপর একটা সাপ দেখামাত্রই মনে হলো এটাই এই বাড়ির ডিহি রক্ষাকারী প্রাচীন দাড়িওয়ালা সাপ। তাই নয় কি!
– আসলে কি তাই! প্রাচীন সাপ বলে দাড়ি গজিয়েছে হয়তো। আমার দাদির এক আত্মীয়া তার তো পুরুষদের মতো দাড়ি ছিল। মেয়ে মানুষ। দাড়ি কামাতো না কারণ তাতে পাপ হবে। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতেন। তিনি প্রায় বলতেন ও দাড়ি রসুলের সুন্নতের চিহ্ন। কাটা যায়!
আমি বুড়ি দাদির কথাটা মোটেও বিশ্বাস করলাম না। অবাক হয়েছি এই ভেবে যে তিনি এখনো কীভাবে গল্পগুলোকে জীবিত রেখেছেন। আরো কিছু কাহিনি যা বিল ভাতিয়ার তলায় পেঁচিয়ে থাকা জঙ্গল থেকে উঠে আসে। বুড়ি দাদির মা ওসব কাহিনি হামানদিস্তায় পান ছেচতে ছেচতে বলতেন, তিনি এখনো সহি সালামতে বেঁচে আছেন, ক্ষণিকের জন্য স্মৃতিভ্রষ্ট হলেও শতবছরের কাছাকাছি পৌঁছে পেছনের বছরগুলো গল্পের ভেতর দিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিলেন। পাড়ার পুরাতন কোনো অক্ষম ব্যক্তি কথায় ঢ্যাক মেরে বলে, কী গো বিশ্বাসের বেটি এখনো চশমা ছাড়া পঢ়িতে পারো গো, এঠে কবে আইলা গো, হামারঘে বাড়ির দিকে আসিও গো। কারণ তিনি এখনো চশমা ছাড়া চোখে পবিত্র কোরান আর মোকসেদুল মোমেনিন কিংবা পত্রিকাও পড়তে পারেন। দিনদিন তিনি যেন কিংবদন্তি হয়ে উঠছেন। অক্ষম ব্যক্তিটির কণ্ঠস্বর নুয়ে পড়ে, বিড়বিড় করতে থাকে চোখোরোচক দৃষ্টি নিয়ে। বুড়ি দাদির মা বিশ্বাস পরিবারের মেয়ে ও বউ, বংশের বিরাট দপদপা ছিল এখন তা আর নাই। এই কারেন্টের যুগে কারেন্টের মতো সব বদলে গেছে। অবস্থাপন্নরা নিজ চরিত্রগুণে বিপন্ন হয়েছে। বিপন্নরা আবার নদীর চরের মতো মোঁচে তাও দিতে দিতে জেগে উঠছে। বহুনামী গেরস্থের ‘গ’ খুঁজে পাওয়া এখন টাফ ব্যাপার। এক মাঘ মাসের শীতে বুড়ি দাদির মাকে দড়ির খাটলায় শুয়ে থেকে রোদ পোহাতে দেখেছিলাম, তার ফ্যাকাসে চাহনিতে ঝলমলে রোদ এসে পড়ছিল তিনি চোখ বন্ধ করে ছিলেন বলে তার প্রায় শতবর্ষী প্রাচীন চোখদুটো দেখা হয়নি।
বিশ্বাস না করার মতো কাহিনির শুরুটা বলার আগে বুড়ি দাদির সমন্ধে বলি, তিনি অত্যন্ত শুচিবাইগ্রস্ত মহিলা, কথাবার্তা বলার মধ্যে স্মার্টনেস আছে এবং এখনো ড্রেস দিয়ে কাপড় পড়েন। স্বামীর চাকরির সুবাদে উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় থেকেছেন। উঠাবসার টোনে লেগে থাকা আধুনিকতা নিয়ে স্বাধীনতার আগ দিয়ে থিতু হয়েছেন এই ডিহিতে।
তিনি যে হারে পান খান তাতে তার কাপড়ে এক ফোটাও পানের পিকের দাগ খুঁজে পাওয়া যাবে না, পিকদানিটা সবর্ক্ষণ বেড়াল ছানার মতো তার পায়ের কাছে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
আমি গল্পটা শুনেছি কখনো চা খেতে খেতে অথবা যখন তিনি একমনে পানের জন্য যাঁতি দিয়ে সুপুরি কেটে যাচ্ছেন তখন। বুড়ি দাদির গল্পের মতো, তার বলার ভঙ্গিও চমকপ্রদ, কিন্তু তা অন্ধকার শ্যাওলা নয় যে মাঝপথে পিছলে পড়ে যাব। এটাও শুনেছি তিনি বলছিলেন তার মায়ের শরীরে নাকি অক্তে অক্তে আতরের গন্ধ বের হত কেউ একজন অদৃশ্য ছায়া খুশবু ছিটিয়ে দিতেন। সেটা তিনি ছাড়া আর কেউ-ই অনুভব করতে পারতেন না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এসব বিশ্বাস করে এসেছেন, ভ্রম শব্দটি মুখে একবারের জন্যেও না এনে আমল করে গেছেন।
ইবাদত-বন্দেগীর সময় তিনি একা প্রকাণ্ড বিশাল এক শিমুল গাছে আলো দেখতে পান, সে আলো জোনাকিপোকার মতো জ্বলে, নেভে। সেজদার জন্য বাপের বাড়ি থেকে আসা বাবলা কাঠের জলচৌকি যেন তাকে নবি সোলেমান বাদশাহর মতো শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এসব কথা খুব গোপনে রাখতে হয়, যদি বাইরে প্রকাশ পেয়ে যায় তাহলে উক্ত ব্যক্তির আমলের শক্তির ছটা ম্লান হয়ে যায় তা আর থাকে না। অনেকেই বলে যারা কবিরাজি করে প্যাট পিন্ধন চালায় এ যে তাদের কথা—সাবধান যেন বাইরে না যায় এসব অলৌকিক উপহার, যাতে করে দেখা ও স্পর্শ করার শক্তি হারিয়ে না গিয়ে অটুট থাকে । ওসব উপহার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তখন বেঁচে থাকার আর কোন সম্বল থাকে না। লৌলিক অন্ধকারে আলোর খুশবু বড্ড মারাত্মক।
আপনি কি বিশ্বাস করেন যে সাপটি বেঁচে আছে?
– হয়তো আছে।
– আছে?
– নাই মনে হয়, নইলে বাড়ির পুব বারান্দার কাছে ইন্দারাটা আছে না—ওখানে শুয়ে থাকতো বেড়ি করে।
– ওখানেই আপনাদের প্রথম সাক্ষাৎ?
– না তো।
– তাহলে ইন্দারার কথাটা বললেন যে!
– আসলে সাপ ঠান্ডা জায়গা পছন্দ করে তো তাই বললাম।
– পরিবারের আর কেউ দেখেছে? এই ধরুন আপনার স্বামী, ছেলে কিংবা মেয়েদের মধ্যে কেউ?
– আসলে ওরা সাপকে পোকা বলতো। তাছাড়া সাপের প্রতি ভয় ছিল বেশি, আর আগ্রহ খুবই কম। তাই তো বাড়িতে গুচি বাইম মাছ উঠতো না। ওসব মাছ নাকি সাপের জাতভাই। ধরো বনমানুষ আর মানুষ যেমন।
– তাহলে সাপটা আপনাকেই পছন্দ করেছিল।
– কেন করবে পছন্দ?
– শুনেছি পছন্দের মানুষের কাছে ওসব ঘুরঘুর করে।
– কী ঘুরঘুর করে?
– দাড়িওয়ালা পোকাটা?
– কই, কখন? শোন রাতের বেলাতে সাপকে পোকা বলতে হয়।
– তাহলে বলছেন সাপটা দ্যাখেননি?
– দেখেছি তো। তখন আমার মেজো ছেলের বয়স দুই কি আড়াই—সঠিক খেয়াল নাই, বাড়ির কান্টায় (পেছনে) কী কাজে যেন গেছি। এরই মধ্যে পেঁপে গাছের গোড়া থেকে সড় সড় শব্দ আসছে, প্রথমে ভাবলাম মুরগি-টুরগি হয়তো, পরে দেখি সড় সড় শব্দের সাথে ফঁস ফঁস একটা খসখসে আওয়াজ। ওমা পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি তার জিব্বাহ নড়ছে। পরে বুঝতে পারি ওটা জিব্বাহ নয় দাড়ি, আমি হুতাশে যখন মাগগে বলে চিৎকার করে দৌঁড়ে বাড়ির মধ্যে, তখন হুশ হলো যে আমার ছেলে কই? আমি বুঝতে পারলাম যে তাকে আমি সেই দাড়িওয়ালা সাপের সামনে ফেলে এসেছি। ছেলের কান্না হঠাৎ শুনতে পাই এবং দৌঁড়ে গিয়ে দেখি ছেলে আমার কাঁদছে। তার সর্বশরীর দেখতে থাকি তাকে সাপে কামড়েছে কিনা। নাহ, কামড়ের কোন দাগ নাই। সেই প্রথম, সেই শেষ দেখা।
– দাদি আপনার ছেলেকে সেই সাপটা কামড়ালো না কেন?
– আরে ওটা তো বিশালদেহী ছিল। কামড়ে সুখ পেতনা নিশ্চয়, তাকে গিলে নিত।
– শুনেছি দোমুখো সাপের বিষ লাগলে নাকি সোনার থালিতে কিছু একটা খেতে হয়।
– এটাও শুনেছ যে ঢোঁড়া সাপ কীভাবে গাছের গুড়িতে বিষ রেখে আরও বিষ সঞ্চয়ের খোঁজে বেরিয়ে ছিল।
– ওসব তো বহু আগে থেকেই শোনা কিন্তু আপনার দেখার খবরটা অদ্ভুত এবং গা শিউরে ওঠার মতো।
আমার প্রশ্ন শুনে মুখভর্তি পিক নিয়ে টিপ টিপ করে হাসছেন, এটা কী আনন্দের লক্ষণ? বুঝতে পারছিনা। আনন্দে গদগদ হলে এতক্ষণে তিনি সবটাই উগলে দিতেন, কিন্তু না আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে যেতে হচ্ছে। ভাগ্য ভালো কারণ প্রশ্নগুলো লেবু পাতা নয় যে বারবার অসংযমী হয়ে জানার ধারালো ইচ্ছায় তেতো হয়ে উঠবে। এটাও সত্য যে বুড়ি দাদি বিরক্ত হচ্ছেন কিনা তাও বুঝতে পারছি না। বুড়ি দাদির পরিবার শিক্ষিত এবং সজ্জন। দশ গ্রামের মানুষ তাদের চেনে জানে, তাদের বাড়ির মূল ফটকের পশ্চিম পাশে সার সার করে লাগানো নারকেল গাছের মাথাগুলো শুকনো পাতা আর ঝুনা নারকেলে জঙ্গল বাঁধিয়ে ফেলেছে। এ বাড়ির প্রধান ফটক যা দুই দানবাকৃতি পিলারে আটকে আছে। পিলার দুটির মাথা চারকোনা গম্ভুজের মতো এবং তাতে খোদাই করা আছে চান্দ তারা চিহ্ন। ফটকের গ্রিলে মরচে পড়ে গেছে, তালাটার ও একই অবস্থা। দেখলাম তালাতে কয়েকবার কেরোসিন দেয়া হয়েছে খুলছেনা বলে।
দেখি পিলারের এক মাথার একটি চারকোনা গম্ভুজ ভাঙা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে। আর সেখানে কেঁচোর কেল্লা দেখে চোখ ছানাবড়া, ঘাসের দঙ্গল কাউকে পরোয়া না করেই বাড়িয়ে চলেছে তার উত্তরসূরি। ওসব মাড়িয়ে কাঁঠাল গাছটার কাছে টিনের একচালা বারান্দায় ইজি চেয়ারের নীল কাপড়ে বিষপিঁপড়ার আড্ডাটাও নিরুৎসাহে পেরিয়ে যেতে হবে।
আমি বুড়ি দাদিকে জিজ্ঞাস করলাম এ ডিহিতে উঠলেন কখন? আর সাথে পিলারের চান্দ তারা চিহ্ন সমন্ধে কিছু কথা।
তিনি বেড়ালের মতো ঘাপটি মেরে থাকা পিকদানিতে পিক ফেলে বললেন,
– এই ধরো আমার শ্বশুর, চাচা শ্বশুরেরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলন দেখেছেন, করেছেন, আমার স্বামী করেছেন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। দেশভাগের সময় কালিয়াচকে দুশো বিঘা জমি আমার বাপ-চাচারা পানির দরে দিয়ে এসেছে, না হলে হিন্দু জোতদারেরা লোক লাগিয়ে সবটাই দখল করে নিত, উৎপাত ও শুরু হয়েছিল। সেই আগুনলাগা সময়ে এই ডিহি অমূল্য মাঝি নামের এক হিন্দু ব্যক্তি, মুসলমান পার্টির কাছে বিক্রি করে ভারতে চলে যায়, তারপর সেই পার্টির কাছ থেকে কয়েক হাত বদল হয় এই ডিহি। অবশেষে আমার স্বামী এই ডিহি কিনে নেয়। আমরা ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি হিন্দুদের ডিহিতে নাকি নানারকম ফুলের গাছ এবং সাপ থাকে।
– তখন ও কি সেই ছিল?
– কে? ও – হ্যাঁ তার লড়াই আন্দোলন তো ফুরায়নি ভাই, ডিহি রক্ষার জন্য এখনো সে চড়ে বেরাচ্ছে হয়তো।
যুদ্ধের বছরের কথায় ধরো, তখন পাগলার উপচে পড়া বানে ডুবে গেছে গোটা গ্রাম। বানের জন্য এই গ্রামে মিলিটারি ঢুকেনি কিন্তু বহরমের তাঁতীপাড়ার হিন্দু তাঁতীরা পালিয়ে গেছিল।
– কোথায়?
– মালদার রেল বস্তিতে।
– কেন?
– গ্রামে মিলিটারি আসবে শুনে।
– কিন্তু মিলিটারি তো আসেনি।
– আসেনি তবে তাদের ধুকপুকে মনে ঢুকে গেছিল মিলিটারি, কারণ লালাপাড়ার রাস্তায় মাইন ফুটে দুটি বল (বলদ) গরু সহ গাড়িয়াল মারা যায়।
– মিলিটারির মাইন?
– না।
– তবে?
– মুক্তিযোদ্ধাদের পোঁতা মাইন।
তাঁতীরা পালিয়ে যাওয়ার আগে বহরম গ্রামের সবাই মরা বল গরু ও মরা মানুষ দেখতে ভিড় করে।
– মিলিটারি আসেনি?
– এসেছিল তো তাঁতীপাড়ার মানুষের ধুকপুকে হৃদয়ে। আর তারা প্রথমে মালদার রেল বস্তিতে এবং পরবর্তী সময়ে ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা বেছে নেয়। বাঁচতে। থাকতে। তবে তাঁত বুনতে নয়। সত্যি বলছি মিলিটারি বহরম গ্রামে আসেনি, এসেছিল শুধু তাদের মনে-হৃদয়ে।
আরেকটা কথা। বান আর ব্যারামের। বানের সময় যে রাস্তা দিয়ে মিলিটারি আসার কথা ছিল, সরকারের মোড়, সেই মোড়ে কলেরার বাহন যেন না ঢুকতে পারে সে জন্য বিশাল লগির মাথায় একটা ডালিতে মুঢ়া ঝাটা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে মিলিটারি না আসলেও কলেরা এসে সবকিছু তচনচ করে দিয়ে গেছে। মাছওলাদের গ্রামে ঢুকতে দেখলেই তাড়িয়ে দিত গ্রামবাসী, তবে কেউ বান তাড়াতে পারেনি, কলেরাকেও না। আর মিলিটারি বানের ভয়ে তো এলোই না।
– তাকে কী তাড়ানো হয়েছে?
– সেটা অসম্ভব। তাকে কেউ তাড়াতে পারবে না, সে আছে।
সবাই কি চলে গেছিল?
বেশিরভাগই চলে গেছিল রাতের অন্ধকারে ঘরে চেরাগ জ্বেলে। যারা ছিল তারা দেখল কয়েকদিনের মধ্যেই রাত করে এসে লুট করে নিচ্ছে, পালিয়ে যাওয়া তাঁতীদের ঘরের ছাদের টালি, বাঁশ-খুঁটি, তালের বর্গা, ঢুলি তবলা, হারমোনিয়াম সহ ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র। যখন প্রতিবেশীদের এমন কীর্তি গ্রামে থেকে যাওয়া তাঁতীরা দেখল তখন তারা ভয়ে এদেশ ছাড়ল। তারা এমনিতেই ছিল ভীতু পরবর্তীতে হতাশায় পালিয়ে গেল।
মালদার বস্তি আর ফ্লাইওভার সম্বন্ধে তাদের মুখেই শুনি, যারা অনেকেই পরে বহরমে ফিরে এসেছিল।
– কেন এসেছিল?
– বস্তি আর ফ্লাইওভার সম্বন্ধে জানাতে।
– হুদাই এসব জানাতে লুকিয়ে সীমান্ত পার হয়ে এদেশে এলো কেন?
– ঐ যে অনেকেই আছে তাদের জ্ঞাতি আর তাঁত বুনার খট খট শব্দ, শুনতে পাচ্ছ, সেটা শুনতে এসেছে।
– শুধু শুনতেই?
– না।
তবে –
টাকা তুলতে এসেছিল। বিয়ের জন্য। যখন মহাবীর তাঁতী আমাদের বাড়ি এলো। ইন্দারার দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। পায়ের উপর পা তুলে কঁচলালো। একা একা উদাস তাকিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বাড়িতে মাস্টার এলে তার সামনে বলল জানেন তো কাকা হামারঘে জাতের বিহার খরচাপাতির কথা। কালো মুখে নকশাকাটা শ্বেতপাথরি চোখদুটো লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ থেমে বলল বস্তি আর ফ্লাইওভারের নিচেই থাকছি। হারা ওখানে এখুন রিফুজি, বহরমপুর টাউনে পয়সাওয়ালারা গিয়ে উঠেছে, তাদের রিফুজি কলঙ্ক ঘুচেছে কিনা জানি না। সেখ্যানে সভাই অন্য চোখে তাকায়, এল্যাগ্যা বিহ্যা দিতে পারা যায় না খুব একটা সহজে। রাজমিস্ত্রীর কাম করছি। তাঁত বুনার হাতে বালু সিমেন্ট রড লিয়া চলছে দু বেলা লাঢ়াই। মাস্টার বলল সবাই যখন ফিরে এলো তোরা থাকলি কেন?
মহাবীর চুপ করে রইল। ম্যালা বড় ভুল কইর্যা দিয়াছি। কেনে যে আইনুনা অরঘে সোঁতে। তাদের ছেলেদের সেখানেই একটা শেকড় মালদার উদবাস্তু বস্তি আর ফ্লাইওভারের কাঁকরময় মাটির তল তল গজিয়ে চলে গেছে কলকাতা, বম্বে কিংবা কেরালার মতো শহরে আধুনিক সিটি গড়ার কাজে, তা আর মুখ ফুটে বলে না মহাবীর। সে চাপা দিয়ে দিল বস্তি আর ফ্লাইওভারের নিচে কীভাবে তারা সেই ভবিষ্যৎহীন গাছ হয়ে বেঁচে আছে, সেইসব গল্প। সে গাছে ফল ধরলেও তা যেন অপুষ্ট, তেতো, চোকা মোটা, আঁশময়। তাদের ডিহি নাই কিন্তু জীবন আছে যে যেখানে পারছে ঠাঁই নিচ্ছে।
বুড়ি দাদিকে জিজ্ঞাস করলাম, ওটা কি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বন্যায় ভেসে এসেছিল? কিছু আন্দাজ করতে পারেন। তিনি বললেন, বন্যার সময় আমাদের বাড়িটা ডুবেনি, ডিহি উঁচু থাকায় গ্রামের কয়েকঘর মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল।
– শুনেছি ওসব জিনিস বন্যায় ডিহি বদল করে।
না না। এ বাড়ি তারও পুরনো। এটা তো মুক্তিযুদ্ধ, কিন্তু আমি তো শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করা সেপাইয়ের মুখ থেকে।
– কী বলেন! সে এতো দিন হায়াত পেয়েছে এটা কীভাবে সম্ভব!
– না, সে তো এখন মৃত।
– কতদিন হলো?
– পয়ত্রিশ, চল্লিশবছর হবে।
– কিন্তু আপনি যে বললেন প্রায় তিরিশ বছর আগে দেখেছিলেন। তুমি সাপটির কথা বলছ তো? হ্যাঁ।
চল্লিশবছর হলো মারা গেছেন আমার মামা শ্বশুর। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মুখে প্রথম শুনি। খুবই কষ্টকর একটি মৃত্যু হয়েছিল তার, ধুঁকে ধুঁকে মরলেন। মনে হতো সবসময় তিনি আজরাইল দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু আজরাইল ফেরেস্তা তাকে গ্রহণ করছেন না। আফসোস। জীবনটা তার মস্করার মুখোমুখি কাটল।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনিতে লোক নিচ্ছে শুনে সেই যে তিনি গেলেন, অবশেষে যোগদান করেন বার্মা ফ্রন্টে। লম্বা চওড়া মানুষ, পড়াশুনাও জানতেন। তখনকার দিনে তো ওরকম মানুষের চাহিদা ছিল, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। তার অবস্থান সম্ভবত জাপানিরা যখন বার্মা আক্রমণ করেছিল সে সময়টার দিকে। মামা শ্বশুরের কুষ্ঠরোগ হয়েছিল, যোদ্ধাদের লিস্ট সংরক্ষণ ও অস্ত্র জমা দেওয়া না দেওয়ার সার্ভে করার পর। তাকে দেখেছি আমবাগানের ভেতরের একটা ঝুপড়িতে, আঁতুরঘরের মতো ঘরে বিষাক্ত জীবন।
তার কুষ্ঠরোগ হয়েছিল বলে নিজের হাতে তৈরি সুন্দর তীর বর্গার ঢালাইঅলা বাড়িতে থাকতে পাননি। কেন পাননি? কীসের ডরে? না কুষ্ঠরোগের যন্ত্রণায়। অন্য একটা কারণও ছিল বার্মায় ব্যাংকগুলো লুট হওয়ার সময় সে নাকি সোনার ঢিপি নিয়ে পালিয়ে এসেছিল।
– তো সার্ভের লোক তাকে তাড়া করতে করতে রামচন্দ্রপুরহাট পর্যন্ত এলো কেন?
– ঐ যে সোনার ঢিপি ডাকাতি কিংবা ছিনতাইয়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসে, জমা দেয়নি। পরে পুলিশ এলো, থানায় ডাক পড়ল, অস্ত্র জমা দেয়নি। তার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকল। দিয়াড়ে লুকালো, বরিন্দে পালালো, লুটের সোনায় কেনা কান্দরের খাসির কলিজা জমি বিক্রি করল কিছু। তবু পুলিশ লেগে থাকল পিছে। যখন অস্ত্র থানায় জমা পড়ল, টাকা ও বেশ কিছু খসল তারপর তো এলো কুষ্ঠরোগ।
– তা তার কুষ্ঠরোগ হওয়ার কারণ?
– বলা যাবে না তোমাকে, সে খারাপ কথা। এই ডিহি থেকে দ্যাখো তোমাকে কথায় কথায় বার্মা পর্যন্ত নিয়ে চলে গেছিলাম।
বুড়ি দাদি হাসতে হাসতে কথাটা বললেন।
(পরে আমি শুনেছি গ্রামের লোকের মুখে, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশ সেপাইরা অনেক সময় যৌন চাহিদা মেটাতে কুকুরের সাথে সঙ্গম করত ঐ ব্যাটা কুকুরের সাথে সঙ্গম করেছিল এই জন্য তার কুষ্ঠরোগ হয়েছিল। এরকম কথা এখনো প্রচলিত গ্রামের পুরাতন মানুষের মুখে। বিকৃত যৌনাচারের জন্য ব্যারাম তার দেহে ঢুকেছে, পাপের সাজা নাকি আল্লাহ এ দুনিয়াতেই চোখে চোখে দেখিয়ে দেন, এরচে এতো বড় উদাহরণ গ্রামের মানুষেরা দেখেনি। গ্রামের মানুষ তাই জেনেছে, তার কুষ্ঠরোগ না হলে রোগের কারণ তারা যেখানে সেখানে আলাপ করত না, ঘাটাতো না। বার্মা ফ্রন্টে আসলে কী হয়েছিল। যুদ্ধ? ব্যাংক লুট? নাকি কুকুর-মানুষের অবাধ সঙ্গম। অজোপাড়া পল্লির দিন-সবরে কিংবা মাঝরাত্তিরে সেসব ভাবনার বিস্ময়ের ধাক্কা এসে লাগে। কৌতূহলের ফাঁকা কলসগুলো চুপচাপ দখল হয়ে যায় বিদ্রুপে।
তার কাছে কেউ তেমন যেত না। খাবার একটা নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হতো, সে হামাগুড়ি দিয়ে খাবার নিয়ে খেত। পুকুরে সপ্তাহে একবার গোসল করত। তারপর…রাত্রির ভেতর সে গুনগুন করে অনুরোধের গান গেয়ে ডেকে নেয় মরণের দুখি ফেরেস্তাকে। গল্পের সরাইখানায় প্রবেশ করতে আবার আমাকে ডিহিতে ফিরতে হচ্ছে সেটার খোঁজে।)
এখন কি এই বিশাল বাড়িটাতে আপনি একাই থাকছেন? না। এক পাগলা ছাগলাকে নিয়ে থাকি। যদিও জানি তিনি তার অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে বাড়িটাতে থাকছেন। তারপর বুড়ি দাদি তার ছেলের নাম ধরে ডাকতেই হাতে গুলের কৌটা নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি এলেন। তারপর তার মায়ের আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলেন।
বুঝলে ছেলেটা আমার ভালোই ছিল, বিয়ে দিয়েছিলাম। বাচ্চাও আছে। কিন্তু হঠাৎ ছেলেটা ঘরে গুম মেরে বসে থাকত আর জানালা দিয়ে কান্টার পেছনটা দেখত। একা একা হাসে। কী যে দ্যাখে আল্লাই জানে।
এই পাগলামি বাড়তে থাকলে বউটি ছেলেটাকে সাথে নিয়ে চলে যায়। আর সে একা হয়ে পড়ে। সবটা শুনে বললাম, আপনার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, মনে হয় উনি সেটাকে দেখেছেন হয়তো তারই বদ দৃষ্টিতে পাগল হয়ে গেছেন। এটা হতে পারে ডিহির দোষ।
ছেলেকে ডেকে বললেন, এই ছোড়া তুই কি দাড়িওয়ালা কিছু জিনিস দেখেছিস?
হ্যাঁ, আম্মা।
সত্যি নাকি ভোগরা ভোগরি মিথ্যা বলছিস। হুম সজনে গাছের তলায় চান্নি রাইতে দেখেছি, মেলা বড়। ফের মিথ্যা। সত্য কথা বল। নাহ দেখিনি। তার ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে বললেন, তবে দেখেছি ফেস্যা ফেস্যা (পাতলা) দাড়ির একটা পোকা।
আসলে ও ভুল বকছে। কিছুই দেখেনি। শুনেছি ওদের কোনো ক্ষতি না করলে সহজে ওরা কারো ক্ষতি করেনা।
আপনি কী বিশ্বাস করেন যে ওদের অথবা ওটার যেটা আপনাদের ডিহিতে চলাফেরা করে, ওর কোনো শক্তি আছে।
শক্তি থাকবে না। ওটা তো বিশালদেহী ছিল। মানুষকে পেঁচিয়ে ফেলতে পারবে মনে হয়। ব্যাঙের মতো মানুষ আহার করা তার কোনো ব্যাপারই না। তার মানে আপনি দেখেছেন, বলছেন না।
হ্যাঁ দেখেছি তো, প্রায় দেখেছি, এখন আর দেখতে পাই না।
সত্যি সত্যি আপনি নিজের চোখে দাড়িওয়ালা সাপটাকে দেখেছেন?
তিনি হাসলেন।
এই যে এক্ষুণি বললেন, আপনি আহার করতে দেখেছেন।
হ্যাঁ। গহামা, দাঁড়াশ ওদের প্রায় ব্যাঙ কিংবা মুরগির ছা আহার করতে দেখেছি। এখন বাড়ির কান্টা সাফ করায় আর দেখতে পাই না।
সবকিছু এলোমেলো লাগল, একটার সাথে অন্যটা পেঁচিয়ে আকার নিল বিশাল ব্যঞ্জনার। তারপর বুড়ি দাদি আমার প্রশ্নের ব্যস্ততায় ডুবে যান, কখনো কখনো চোখ তুলে তাকান এই বাড়িটার দিকে। যার অবস্থা তার নিজের মতোই। বাড়িটা বাতাসে ঠনঠন শব্দে বেজে ওঠে, অপরিচিত কেউ আসে না। বছরে একবার শহর থেকে তার ছেলেরা মাইক্রো করে আসে এবং দিনে দিনে ফিরে যায়। তাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠলে বাতাসে কেঁপে ওঠা এই ডিহি ছাড়তে তিনি রাজি নন।
তিনি কী সবকিছু গুলিয়ে ফেলছেন নাকি আমি তার ভেতরের ক্ষতের খুব কাছাকাছি, বুঝতে পারি না।
এই বাড়িটাতে জুতা পড়ে হাঁটলে বুড়ি দাদি আঘাত পান, খালি পায়ে মিনিট পনেরোর মতো বাড়িটাকে স্পষ্ট বোঝার ভান শেষে তার কাছে ফিরে আসি। ঘুণে খাওয়া চেয়ার টেবিলের উপর বিছানো সুজনির ফোড়ে ফুল তোলা ক্লথের উপর পিতলের পিতরে যাওয়া শূন্য ফুলদানি দেখতে দেখতে ব্যবহারযোগ্য বেতের মোড়ায় গিয়ে বসি। আমার জন্য তখন কিছু চা নাস্তার আয়োজন চলছে, নিয়মিত পান না খেলেও কথাবার্তা শুরুর জন্য পান চেয়ে নিই, তিনি পানের বাটা কাছে টেনে পান সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ডিহির পশ্চিমমুখো হলে দেখি রান্নাঘর উপচে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
আমার দিকে তাকিয়ে, বুঝলে এখন সবাই চালাক হয়ে গেছে, ভাতকাপড়ের অভাব তেমন নাই। স্কুল থেকে উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে তাই কেউ আর বাড়িতে কাজ করতে আসে না। গরীব বাপ মায়েরা তাদের অসহায় মেয়েদের পাঠায় না, তাছাড়া আরেকটা কারণ আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা মেয়েদের বিয়েতে একটু বিঘ্ন ঘটে, গ্রামের কুটনি মহিলারা বিয়ে ভাঙিয়ে দেয়, এই বলে যে মেয়েটি কাজকরানি। ‘বিহ্যা দিছ! ওই ছুড়ি পরের বাড়িতে কাম ট্যান্যা ভাত কাপড় জুটালছে জি।’
বুড়ি দাদি এসব সেই অসহায় গরীব মেয়েদের মতো কাতর হয়েই বললেন। তার সাতখানা বিশাল ঘর পড়ে আছে, শূন্য, একা। এর আগে যে মেয়েটি ছিল তার কথায় বলি, প্যান্ট গেঞ্জি পড়া বয়সে তার মা হঠাৎ একদিন এসে মাস্টারকে বলল, দাদা বেটিট্যাকে রাইখা গেনু, জানেন তো হামারঘে সংসারের টানাটানি, আপনার ভাই ধোপাগিরি কইর্যা আর কয় টাকাই বা পায়, পহিল্যা ছ্যাল্যা এঠে আইনু, কিছু দ্যাওয়া থুয়া লাগবেনা, ভাত কাপড়খান দিয়েন, আর বিহ্যার সমাখানে হাতে তুল্যা কিছু…। সেই যে হালিমা এল এই বাড়িতে, থাকল টানা আঠারো বছর। গ্রামের মানুষের যা স্বভাব চরিত্র, কানাঘুঁষা বলাবলি করতে থাকল, ‘মাস্টারের বহুর আর কত টানা টানবে! কাম ট্যান্যা ট্যান্যা ছুড়িট্যার বিহ্যার বয়েস পার হইয়্যা য্যাছে যে, বুক ও গল্যা গেল লাগছে, কে লিবে অকে।’ তারপর অনেক খোঁজ লাগিয়ে হালিমার বিয়ে হয় এক লৈল্যা যুবকের সাথে যে কিনা হালিমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট ছিল। যুবকটির চোখে লেগে গেল দেখতে কালো হালিমাকে, কর্মীক খাটনাওলা ছেলে, শুনেছি লৈল্যা ছেলেগুলো অশিক্ষিত স্কুলে যায় না খুব একটা, অল্প বয়সে নেশা ধরে আর মারপিট করে বেড়ায়, সেটা থেকে তাদের ঘাড়ে বিশাল কুখ্যাতির জোয়াল চেপে বসে আছে। কিন্তু হালিমার স্বামী নাপিতের কাজ করত লৈল্যা পাড়ায়, শুনেছি সুসার বুঝে ঢাকায় চলে যাবে সে। অকস্মাৎ এই বিয়ের ঘটনায় কেউ কেউ বলেছিল লৈল্যা বলেই পুছল হালিমাকে। হালিমা ভালো আছে। স্মৃতির শবদেহ বহন করা খুব ভার। এখন বুড়ি দাদি অনেক কষ্টে সাত-আট বছরের একটি মেয়েকে যদি কোনোমতে জুটিয়েছেন তো সে মেয়েটি কাজের ধান্দার চেয়ে খেলার ধান্দা মাথায় নিয়ে ঘুরে। এ নিস্তব্ধ বাড়িতে পড়ে থাকার মানে কিছু খাবার, ঠনঠনে সতেরো ইঞ্চি রঙিন টিভিতে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখার লোভ, আর লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজ থেকে ডিপে রাখা ইটের মতো শক্ত হয়ে যাওয়া বাসি নবাবের মিষ্টি খাওয়া। কখনো মুড়িতে কুশরের গুড়ের উখড়া, আদা চা কিংবা দুধ ফেটে গেলে চিনি দিয়ে ছানা এসব বুড়ি দাদি তাকে কাচের পিরিচে তুলে দেন। বুড়ি দাদির অভিযোগ মেয়েটি কামচোর কিন্তু খাবার চুরি করে খায় সেটা এখনো বোধহয় তিনি ধরতে পারেননি। উনার মাঁজা পড়ে গেছে তবুও চকচক করে ঘরের বিছানার চাদর থেকে বাড়ির ভিতর বাহির বারান্দা। বাড়িতেই লাইনের পানি, কখনো থাকে কখনো নাই তাই তিনি বড় বড় ড্রামে পানি ধরে রাখেন। সাত আট বছরের সেই ছোট্ট মেয়েটি হলো এ বাড়ির নিঃসঙ্গতা কাটানো পারস্যের কথাবলা বন্দি তোতাপাখি।
শেষবারের মতো স্পর্শ করি তার অনেক অনেক দিন আগের কথা। তার বিশ্বাসের কাছে আমি অবিশ্বাসী। বলি তা হয় না, যেন তার কাছে আমার কোনো ঠাঁই নাই, ঘেঁষে বসার শক্তি নাই। কিন্তু তিনি এক ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর মতো বিশ্বাস আর গল্পগুলোকে জিইয়ে রেখেছেন, হারানো স্রোতের স্মৃতির মতো যা আগের মতো আর পাঁক দিয়ে বয়ে যায় না। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন বলে তার দেখা পেয়েছিলেন, আমার ভেতর সে বিশ্বাস জাগেনি। তবে অন্তরে যে অহেতুক অ-জ্ঞানের পাথর শব্দ করছে তাতে আমার লাভ নাই, কারণ সেই পাথর একে অপরে ঘর্ষণ করে আগুন ধরাতে পারেনি। শুধু কলহ করেই গেছে। বুড়ি দাদি যিনি সংকল্প করেছেন তার ডিহিতে বিশ্বাসের বীজ বপন করবেন, তার অসুস্থ ছেলের পুত্র অর্থাৎ নিজের ওয়ারিশ পোতাকে এই ডিহিতে আনবেন। তাই হবে। তিনি চান না তার ডিহিতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ফিরে আসুক, নাদান মানুষের ক্ষতি করুক। দাড়িওয়ালা সাপটি বরং অবাঞ্জিত হত্যার আগেই ছায়াময় হয়ে মিলিয়ে যাক। এই ডিহির শেকড় হয়ে তার বসত হোক পাতালে।
ঠান্ডা ঠার পাতালে।