[তামিম আল-বারঘৌথি হাল জমানার অন্যতম জনপ্রিয় আরবি কবি। বাবা মুরিদ আল-বারঘৌথি ফিলিস্তিনি কবি এবং মা রাদওয়া আশুর মিসরি ঔপন্যাসিক। জন্ম কায়রোয়, ১৯৭৭ সালের ১৩ জুন। পড়াশোনা মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রে। বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব কায়রো, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি ওয়াশিংটন এবং ফ্রি ইউনিভার্সিটি বার্লিনে। কাজ করেন জাতিসংঘের পরামর্শক হিসেবেও। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে, প্যালেস্টাইনিয়ান হাউজ অব পোয়েট্রি থেকে। ফিলিস্তিনি ও মিসরি কথ্য ভাষায় কবিতা রচনা করে সুনাম কুড়ান। এ পর্যন্ত তাঁর ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৭ সালে আবুধাবির আমিরাতি টেলিভিশন আয়োজিত কবিতা প্রতিযোগিতায় ‘প্রিন্স অব পোয়েট’ পুরস্কার লাভ করেন। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করায় ২০০৩ সালে তাঁকে মিসর ত্যাগ করতে হয়। পরে অবশ্য সেই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয় সরকার। আরব বসন্তে তাঁর দুর্দান্ত সব জাগরণী কবিতা বিপ্লবীদের পথ দেখায়। পিতৃভূমি ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর সব নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কথা বলেন শব্দের জাদুকরি বুননে। দরাজ কণ্ঠে নিজের কবিতা আবৃত্তিতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ২০২২ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠানে আরবিতে বক্তব্য দেন। অনূদিত কবিতাটি তাঁর ‘ফিল কুদস’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া; কবিতার মূল নামও ‘ফিল-কুদস’।—অনুবাদক]
প্রিয়তমার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাই
শত্রুর আইন ও প্রাচীর আমাকে ফিরিয়ে দেয়
নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলি—হয়তো এ আশীর্বাদই
জেরুজালেম ভ্রমণে গেলে তুমি কী দেখবে?
চারদিক থেকে বাড়িগুলো যখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে
যা দেখবে তা তোমার সহ্য ক্ষমতার বাইরে;
তবে প্রিয়তমার সাক্ষাৎ পেলেই সবাই আনন্দে
মাতে না এবং সব অনুপস্থিতি ক্ষতিকরও নয়
বিচ্ছেদের আগের সাক্ষাতে আনন্দ পেলেও
সেই আনন্দ আদতে নিরাপদ কিছু নয়;
একবার যখন দেখবে জেরুজালেমের মুখ
যেদিকেই তাকাবে, তাকেই দেখবে।
জেরুজালেমে—স্ত্রীর প্রতি বিরক্ত জর্জিয়ার এক সবজিবিক্রেতা
ছুটি কাটানো ও বাড়ি রং করানোর কথা ভাবেন
জেরুজালেমে—আপার ম্যানহাটন থেকে আসা এক প্রৌঢ় লোক
পোলিশ তরুণদের তৌরাতের পাঠ শেখান
জেরুজালেমে—এক ইথিওপিয়ান পুলিশ বাজারের পথ আটকে দেন;
কুড়ি স্পর্শ না করা হানাদারের কাঁধে মেশিনগান—
একটি টুপি সালাম ঠোকে ওয়েলিং ওয়ালে
স্বর্ণকেশী ইউরোপীয় পর্যটকেরা মোটেও দেখে না জেরুজালেম
সারাদিন খোলা জায়গায় মুলা বিক্রি করা এক নারীর সঙ্গে
পরস্পরের ছবি তুলতেই দেখবে তাদের;
জেরুজালেমে—তুলসীর প্রাচীর আছে
জেরুজালেমে—কংক্রিটের ব্যারিকেড আছে
জেরুজালেমে—জুতো পরে সৈন্যরা মেঘের ওপর দাপিয়ে বেড়ায়
জেরুজালেমে—পাকা পিচের ওপর আমরা নামাজ আদায় করি
জেরুজালেমে, জেরুজালেমে—তুমি ছাড়া আর কে আছে?
ইতিহাস মৃদু হেসে আমার দিকে তাকায়—
‘তুমি কি সত্যিই ভেবেছ, নিজেদের বাদ দিয়ে তারা অন্যদের দিকে নজর দেবে?
এই তো তারা তোমার সামনে, বইয়ের মূলপাঠ তারাই, তুমি পাদটীকা ও মার্জিনে মন্তব্য
ছেলে আমার, ভেবেছ কি তোমার ভ্রমণ শহরের মুখ থেকে সরিয়ে দেবে
বাস্তবতার ভারি পর্দা—তুমি দেখতে পারবে তোমার আকাঙ্ক্ষা সব?
জেরুজালেমে—তুমি ছাড়া সব তরুণই আছে;
জেরুজালেম বেষ্টনীর হরিণ—সময়ের এই তো বিচার
বিদায় দেওয়ার পরও তুমি তার পেছনে দৌঁড়াচ্ছ
একটু শান্ত হও, আমি দেখছি—তুমি ক্লান্ত
জেরুজালেমে, জেরুজালেমে—তুমি ছাড়া আর কে আছে?’
হে ইতিহাসলেখক, থামুন
এই শহরের দুটি সময়রেখা
প্রথম রেখাটি অপরিচিত, শান্ত, দৃঢ় পদক্ষেপের—যেন তা ঘুমেই হাঁটে
দ্বিতীয় রেখাটি মুখোশপরা নীরবে অতিসন্তর্পণে পা ফেলে।
জেরুজালেম নিজেকে জানে
এখানে যে কাউকেই জিজ্ঞেস করো—পথ দেখাবে
এই নগরের সবকিছুই
কথা বলে, জানতে চাইলেই বিশদ বিবরণ দেয়।
জেরুজালেমে—নতুন চাঁদ আরও বেঁকে যায় ভ্রুণের মতো
বাঁকিয়ে বসে গম্বুজের মাথার চাঁদের ওপর
এ যেন যুগ-যুগান্তরে গড়ে ওঠা পিতাপুত্রের রসায়ন।
জেরুজালেমে—কিছু পাথুরে দালানে বাইবেল ও কোরআনের উদ্ধৃতি আছে
জেরুজালেমে—সৌন্দর্য অষ্টভুজাকার ও নীল
তার মাথার ওপর আছে সোনালি গম্বুজ
আমার মনে হয়, এটি বাঁকা আয়নার মতো—তুমি দেখবে ছোট পরিসরে আকাশের মুখ
তা নিয়ে যেন তুমি খেলছ এবং কাছে টানছ
যদি কোনো জাতি জুমার খুতবার পর হাত তোলে
অবরোধে অভাবীদের মাঝে বিতরণ করা ত্রাণের মতো তা বন্টিত হয়
জেরুজালেমের আকাশ সব মানুষের, এ আমাদের রক্ষা করে এবং আমরা একে;
আমরা তাকে আমাদের কাঁধে চড়াই
সময় যদি তার তারকাদের প্রতি জুলুম করে।
জেরুজালেমে আছে গাঢ় মার্বেল পাথরের খুঁটি
মার্বেলের শিরায় যেন ধোঁয়ার আবহ
মসজিদ ও গির্জার উঁচু জানালা
ভোরের হাত ধরে দেখাচ্ছিলো কীভাবে আলপনা আঁকতে হয়
ভোর বলে, ‘ওভাবে না, এভাবে।’
জানালা বলে, ‘না, এভাবেই।’
অনেক তর্কাতর্কির পর তারা আপস করে
প্রান্তিকতার বাইরে এসে মুক্ত হয় ভোর, তবে
সে যদি করুণাময়ের জানালা দিয়ে প্রবেশ করতে চায়
অবশ্যই তাঁর বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট হতে হবে।
জেরুজালেমে একটি স্কুল ছিল, মাওয়ারাউন্নাহার থেকে আসা এক মামলুকের
তারা তাঁকে ইসফাহানের এক দাসবাজারে বেঁচে দিয়েছিল বাগদাদ থেকে আলেপ্পো আসা এক বণিকের কাছে
আলেপ্পোর আমির তাঁর বাঁ চোখে নীলমণি দেখে ভয় পান
এবং মিসরে আসা এক কাফেলার কাছে তাঁকে সোপর্দ করে দেন
কয়েক বছর পর মঙ্গোলদের পরাজিত করে তিনি চরম প্রতাপশালী হয়ে উঠেন।
জেরুজালেমে—খান এল জেইতের আতরের দোকানে ব্যাবিলন ও ভারতের মিশেল এক সুগন্ধি আছে
খোদার কসম, সেই সুগন্ধির ভাষা আছে, তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনলেই বুঝবে
যখন তারা আমার দিকে টিয়ারশেল ছোঁড়ে, তখন সুগন্ধি আমাকে বলে, ‘চিন্তা করো না।’
গ্যাসের তীব্রতা কমে গেলে ফের ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধি এবং আমাকে বলে, ‘দেখলে তো।’
জেরুজালেমে বিরোধ আছে, এর অলৌকিকত্বও কেউ অস্বীকার করে না
এ যেন কাপড়ের কিছু টুকরো, নতুন-পুরোনো সবই টেনে নেয় কাছে
অলৌকিক বিষয়াবলি হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় এখানে।
জেরুজালেমে—তুমি যদি কোনো বৃদ্ধের সঙ্গে করমর্দন করো কিংবা কোনো ঘর স্পর্শ করো
হে অভিজাত ঘরের সন্তান, তুমি তোমার হাতের তালুতে একটি বা দুটি
খোদাই করা কবিতার পঙক্তি খুঁজে পাবে।
জেরুজালেমে—ধারাবাহিক বিপর্যয় সত্ত্বেও বাতাসে নিষ্পাপ সুরভি, শিশুতোষ খুশবু
তুমি দেখবে, বাতাসে দুটি বুলেটের মাঝে স্বাধীনতা বলে বলে উড়ছে কবুতর।
জেরুজালেমে—কবরগুলি থরে থরে সাজানো, যেন তা নগরের ইতিহাসরেখা আর মাটি যেন বই
এ পথেই গেছে সবাই
সব আগন্তুককেই গ্রহণ করে জেরুজালেম, বিশ্বাসী হোক বা অবিশ্বাসী
এর মধ্য দিয়ে হাঁটো আর পৃথিবীর সবকটি ভাষার ফলকগুলো পড়ো
এতে রয়েছে আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান, ইউরেশিয়ান, রাশিয়ান ও বসনিয়ান
রয়েছে তাতার ও তুর্কি, বুজুর্গ ও অভিশপ্ত, ধনী ও দরিদ্র, ধার্মিক ও পাপাচারী
রয়েছে মাটিতে পা ফেলা সব মানুষই
বইয়ের পাদটীকা ছিল তারা, আমাদের আগেই নগরের মূলপাঠ হয়ে উঠেছে
এই নগর কি কেবল আমাদের জন্যই সংকীর্ণ?
হে ইতিহাসলেখক, কী এমন হলো যে আমাদের কথা বাদ দিয়েছেন?
হে গুরুজন, আবার পড়ুন, আবার লিখুন—আমি দেখছি আপনি গুরুতর ভুল করছেন
চোখ বুজে আসে, আবার চোখ খুলি, হলদে গাড়ির ড্রাইভার আমাদের নিয়ে
জেরুজালেমের গেইট দিয়ে বেরিয়ে উত্তর দিকে রওনা করে
জেরুজালেম আমাদের পেছনে
ডানপাশের লুকিং গ্লাসে দেখা যাচ্ছিল তা
অস্ত যাওয়ার আগে বদলে যায় সূর্যের রঙ
তখন কীভাবে যেন হুট করে একটি হাসির রেখা মুখের ওপর এসে পড়ে
আমি ঘনিষ্টভাবে তাকাতে চেষ্টা করি, সে আমাকে বলে,
‘হে প্রাচীরের আড়ালে রোদনকারী, তুমি কি বোকা?
পাগল হয়েছ নাকি?
বইয়ের মূলপাঠ থেকে হারিয়ে যাওয়া ওহে মানুষ, কেঁদো না
কেঁদো না হে আরব, জেনে রেখো
জেরুজালেমে, জেরুজালেমে যারাই থাকুক
কাউকেই দেখি না আমি তোমাকে ছাড়া।’