চিত্রকরের ছাপ

মূল : মধুলিকা লিডল

ইমরান রাইহান

১. 

ত্রিশ বছর বয়সি মির্জা বশিরের লাশ দেখে রিজোয়ানের মাথায় প্রথম যে চিন্তা এলো তা হলো, মৃত ব্যক্তিটির প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। 

দিল্লিতে আরো একটি কর্মব্যস্ত দিনের সূচনা শুরু হয়েছে। সড়ক থেকে ভেসে আসছে ঘোড়ার গাড়ির শব্দ, ফেরিওয়ালাদের চিৎকার, বাদামের শরবত, বিক্রেতার টুংটাং। ভারী পর্দার ফাঁক গলে ভেতরে প্রবেশ করছে সূর্যের আলো। শুভ্র মার্বেল পাথরের মেঝে সেই আলোয় ঝলমল করছে। ‘সম্ভবত, রক্তপাত বেশি হয়নি। শুভ্রতার বিপরীতে লাল রং ফুটে উঠেছে’ মনে মনে ভাবল রিজোয়ান। পুরো কক্ষের দিকে আরেকবার তাকাল সে। 

বেশ বড়সড় কক্ষ। অন্তত পনেরোজন লোক আরামে বসা যাবে এখানে। এক কোণে দুটি নরম গদি রাখা, বসার জন্য। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি বড় জানালা, সেখানে পর্দা ঝুলছে। কক্ষের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে রং, তুলি, ব্রাশ, কাগজের তোড়া। তাকের উপর ঝাঁঝালো গন্ধের বেশ কিছু মিশ্রণ রাখা আছে তামার পাত্রে। কয়েকটি ঝিনুক রাখা আছে তুলির পাশে। রিজোয়ান জানে ছবিতে সর্বশেষ আঁচড় দেয়ার সময় ঝিনুক ব্যবহার করে চিত্রশিল্পীরা। বেশ কিছু পেইন্টিং সারিবদ্ধ রাখা একপাশে। রিজোয়ান জানে কক্ষটি একজন মুঘল চিত্রশিল্পীর কর্মক্ষেত্র ছিল। এখানে বসেই দরবারি চিত্রগুলো আঁকতেন তিনি। দূর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি এখন বেঁচে নেই। নিজের চিত্রকর্মের পাশেই পড়ে আছে তার রক্তরঞ্জিত দেহ। 

দিল্লির কোতোয়াল শাফিন শেখ দাঁড়িয়ে আছেন লাশের পাশে। সহকারী হিসেবে রিজোয়ান ধরতে পারছে তার মনে কী খেলা করছে। একজন হাকিম ঝুঁকে আছেন লাশের উপর। লাশ পরীক্ষা করছেন তিনি। উত্তরমুখী জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল রিজোয়ান। সামনে একটি উদ্যান দেখা যাচ্ছে। আয়তনে খুব বড় না হলেও দেখতে চমৎকার। 

‘তাকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে’ হাকিম সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন। তার কণ্ঠ গমগম করে উঠল পুরো কক্ষে। ‘আঘাত করা হয়েছে পিঠে। অন্তত ছয় ইঞ্চি ভেতরে ঢুকে গেছে ছুরি।’

‘খুনি কি শক্তিশালী কেউ?’ প্রশ্ন করল রিজোয়ান। ইতিমধ্যে টানটান হয়ে গেছে স্নায়ু। সে জানে প্রতিটি বিষয় সতর্কতার সাথে লক্ষ করতে হবে। সামান্য কোনো ক্লু থেকেও হতে পারে রহস্যের সমাধান। 

‘মনে হয় না। মজবুত ছুরি হাতে থাকলে যে কেউ এই কাজ করতে পারে।’ হাতে লেগে থাকা রক্ত মুছতে মুছতে বললেন হাকিম। 

আবার মেঝের দিকে তাকাল রিজোয়ান। লাশের পায়ের কাছ থেকে শুকনো রক্তের কয়েকটি রেখা চলে গেছে ৬/৭ ফুট সামনে। 

‘বশির কি আঘাতের সাথে সাথে মারা গেছেন?’ প্রশ্ন করল রিজোয়ান। ইতিমধ্যে সরে এসেছে লাশের মাথার দিকে। 

‘সাথে সাথে মারা না গেলেও কয়েক মুহূর্তের বেশি বেঁচে ছিলেন না এটি নিশ্চিত। কারণ আঘাত খুবই ভয়াবহ ছিল।’

‘আপনি কি লাশ সরিয়েছেন?’

‘না। আমি এসে এভাবেই পেয়েছি।’

‘প্রহরীরা সরিয়েছে?’

‘না। তারা এসে মৃত পেয়েছে। ফলে যেভাবে ছিল সেভাবেই রেখেছে।’ 

‘আপনার কি মনে হয় আঘাতের পর সে নিজের শরীর টেনে সামনে এনেছে? নাকি খুনির কাজ এটা?’

‘বলা কঠিন। যেকোনো কিছুই সম্ভব।’

‘সে মারা গেছে কতক্ষণ হয়েছে?’

‘চার ঘণ্টার মতো।’ এই প্রথম মুখ খুললেন শাফিন শেখ। ‘অন্যদিনের মতোই রাতের বেলা নিজের কক্ষে কাজে ব্যস্ত ছিল সে। বাইরে দুজন প্রহরী থাকে। এখানে দরবারের অনেক মূল্যবান চিত্র আঁকা হয়, ফলে পাহারার ব্যবস্থাও বেশ মজবুত। রাত তিনটার দিকে আচমকা মির্জা বশিরের চিৎকার শুনে ছুটে আসে দুই প্রহরী। ঘরে প্রবেশ করে তারা দেখে বশিরের লাশ এভাবেই পড়ে আছে। তারা কক্ষে কাউকে দেখেনি। দ্রুত তারা বাইরে ছুটে যায়। বাগান তল্লাশি করে, এমনকি প্রাচীরের উপর উঠে আশপাশে তাকায় কিন্তু কাউকে দেখা যায়নি। খুনিকে চিহ্নিত করার মতো কোনো তথ্যই আমাদের কাছে নেই।

‘কক্ষ থেকে কিছু হারিয়েছে কি?’ 

‘প্রহরীদের জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু তারা বলল কক্ষ থেকে কিছুই খোয়া যায়নি। তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য। কারণ প্রায় রাতে তারা এখানে এসে বশিরের সাথে গল্প করত। ফলে প্রতিটি বস্তু তাদের চেনা ।’

‘বাহির থেকে কাউকে প্রবেশ করতে দেখেছে তারা?’

‘না। এমন কাউকেও দেখা যায়নি।’

রিজোয়ান লাশটির ক্ষত পরীক্ষা করছে। হাকিম বলেছে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, কিন্তু এটি গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য নয়। দিল্লিতে মানুষ খুন করার মতো হাজার হাজার ছুরি আছে এবং এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি সম্ভবত ইতিমধ্যে যমুনার তলদেশে আশ্রয় নিয়েছে। 

রিজোয়ান লক্ষ করল লাশের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে জমাট বাঁধা রক্ত। যদিও হাতের আঙ্গুলে বা তালুতে কোনো আঘাত কিংবা রক্ত নেই। 

‘তার হাতের কাছে একটি পেইন্টিং পাওয়া গেছে। এটি পরে সরিয়ে রেখেছি।’ রিজোয়ানকে বললেন হাকিম। ইশারায় গদিতে রাখা একটি ছবি দেখিয়ে দিলেন তিনি। 

চৌকোনো কাঠের ফ্রেমে আটকানো উজ্জ্বল রংয়ের একটি ছবি। ধনাঢ্য কারো বিয়ের শোভাযাত্রা আঁকা হয়েছে। ছবির সামনের দিকে কনের সাথে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে বর। তার পরনে জরির কাজ করা শেরওয়ানি। মাথায় উঁচু হয়ে আছে পাগড়ি। কনের চেহারায় নেকাব দেয়া, শুধু চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে। ডান হাত কিছুটা উপরে ওঠানো। কবজিতে অ্যানিমেলড ব্রেসলেট ঝুলে আছে। বর কনের পেছনে পাইপার ও ড্রাম বাদকদের দেখা যাচ্ছে। বহু মানুষের সারি, শেষদিকের মানুষগুলো খুবই অস্পষ্ট। ছবির ডান দিকের কোনে পথচারীদের দেখা যাচ্ছে। তারা তাকিয়ে আছে শোভাযাত্রার দিকে। 

পেইন্টিংটা নিয়ে জানালার কাছে চলে এলো রিজোয়ান। রোদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ছবিটি। তখনই প্রথমবারের মতো খেয়াল করল বিষয়টি। ছবির নিচের দিকে কোনায় সামান্য রক্ত লেগে আছে। দ্রুত হেকিমের পাশে চলে এলো সে। 

‘আপনার কি মনে হয় এখানে রক্ত কীভাবে লেগেছে, এটা কি তার হাতের ছাপ?’ প্রশ্ন করলো রিজোয়ান। 

‘আমার ধারণা এটা তার হাত থেকেই লেগেছে। ছবিটা সরানোর সময়ই লক্ষ করেছিলাম। সম্ভবত খুনের সময় ছবিটা হাতে নিয়েই কাজ করছিল সে।’ 

‘এমনকি হতে পারে ছবিটা ধরার জন্য এগিয়ে এসেছিল সে?’

‘হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। যদি ছবির জন্য খুন হো তাহলে খুনি এটি সাথে করেই নিয়ে যেত’ বললেন শাফিন শেখ। রিজোয়ান কিছু না বলে ছবিটা তাকে রাখার জন্য এগুলো। ছবিটি তাকে রাখতে গিয়ে চমকে গেল সে। হাত থেকে সশব্দে পড়ে গেল ছবিটি। তাজা রং লেগে রিজোয়ানের কাপড় ময়লা হয়ে গেল। কিন্তু এসব কিছুতে তার আগ্রহ নেই। সে তাকিয়ে আছে তাকের দিকে। 

তার চোখ আটকে গেল সেখানে রাখা ছোট্ট একটা ছুরিতে।

 

২.

আধা ঘণ্টা পর। 

প্রশস্ত একটি হলরুমে বসে আছে শাফিন শেখ ও রিজোয়ান। এটি চিত্রশালার প্রধান পরিচারকের কক্ষ। রিজোয়ান ইতিমধ্যে জেনেছে বিচিত্র খুবই দক্ষ একজন শিল্পী। মুঘল সম্রাটের সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। 

‘বিচিত্র এখন শহরে নেই। তিনি জাহাঁপনা বাদশাহ সালামতের ডাকে আগ্রা গেছেন। আজ রাতের মধ্যে হয়তো ফিরবেন। তার দুজন সহকারী অবস্থান করছে কাশ্মীরে। প্রিন্স দারা শিকোহ বর্তমানে সপরিবারে সেখানে প্রমোদ ভ্রমণে আছেন।’ বললেন শাফিন শেখ। বিশ্বস্ত সহকারীর উপর পরিপূর্ণ আস্থা। তার কাঁধেই তদন্তের ভার দিয়ে নিজে ভারমুক্ত হতে চাচ্ছেন। মনে মনে চাচ্ছেন তদন্ত দ্রুত সমাপ্ত হোক। পরিবারের সাথে বাংলায় সফর করার কথা তার। তদন্ত যত বিলম্বিত হবে, সফরও তত পিছিয়ে যাবে। 

‘এই হত্যার কোনো কারণ এখনো জানতে পারিনি আমরা। সম্ভাব্য কারণ হতে পারে পেশাগত প্রতিহিংসা, ডাকাতি কিংবা অন্যকিছু। ডাকাতির সুযোগ নেই, কারণ কক্ষ থেকে কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হয়নি। পেশাগত প্রতিহিংসার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। আপনি জানেন, বর্তমান সম্রাটের দাদা আকবরের সময় প্রাসাদ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে এ ধরণের খুনোখুনি লেগেই থাকত। তবে এই ঘটনায় বিচিত্র ও তার দুই সহকারীকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায়, কারণ তারা এখন শহরেই নেই। চিত্রশিল্পীদের আর কেউ কি এখন আছে?’

‘হ্যা একজন আছে। মুখতার। সে বেশ অভিজ্ঞ শিল্পী।’

কোতোয়ালের ডাকে মুখতার এসে উপস্থিত হলো। মধ্যবয়সি একজন ব্যক্তি। চেহারায় সতর্কতার ছাপ। তার কাছ থেকে বিশেষ কিছু জানা গেল না। বশিরের পাশের কক্ষেই থাকত সে। হত্যাকাণ্ডের সময় নিজের কক্ষেই ঘুমিয়ে ছিল। ঘটনার পর প্রহরীরা এসে জাগিয়ে তোলে তাকে। বশিরের কক্ষে এসে লাশ দেখে চমকে যায় সে। তবে মাথা ঠান্ডা রেখে দুই প্রহরীর একজনকে পাঠায় কোতোয়ালের দফতরে, অন্যজনকে সাথে আলো দিয়ে বাগানে পাঠায় সেখানে কেউ লুকিয়ে আছে কি না তা দেখে আসতে। 

‘বাগানে তল্লাশির কথা ভাবলেন কেন?’

‘আমার মনে হয়েছিল খুনি হয়তো বাগানেই লুকিয়ে আছে। কারণ প্রহরীরা বলেছিল চিৎকার শুনেই তারা বশিরের কক্ষে প্রবেশ করে। বশিরের কক্ষে যেহেতু একটি দরজাই ছিল ফলে খুনি পালানোর জন্য জানালাই ব্যবহার করেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে তার পক্ষে খুব বেশি দুরে পালানো সম্ভব ছিল না। এজন্য ধারণা করেছি সে বাগানেই লুকিয়ে ছিল।’—বললো মুখতার। 

প্রহরী শামসুদ্দিনকেও ডেকে আনা হলো। তার কাছ থেকে নতুন কিছুই জানা গেল না। মুখতারের কথাই বলল সে। শামসুদ্দিন বাগানে তল্লাশি করেছিল। সে কসম করে বলল বাগানে কিছুই দেখা যায়নি। রিজোয়ান নিজে আবার বাগানে তল্লাশি চালাল। কিন্তু কোনো আলামত পাওয়া গেল না। 

‘আরেকজন প্রহরী ছিল রাতে। সে কোথায়?’

‘রফিকের কথা বলছেন। সে একটু আগেই বাসায় গিয়েছে। আপনি বললে রেহানাকে বলব তাকে ডাকতে।’ 

‘রেহানা কে?’

‘তার বোন। সে এখানে দাসির কাজ করে।’ 

‘তাকে ডাকার দরকার নেই। এখানে কোনো সুন্দর দৃশ্য নেই তার জন্য। তাকে দুরে রাখতে পারলে সেটিই ভালো হবে।’ 

শেষবারের মতো লাশের দিকে তাকাল রিজোয়ান। বশিরের মৃত লাশ কি তাকে কোনো ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছে? রিজোয়ান অনেকবার ভেবেছে একজন মানুষ নিহত হওয়ার সময় তার অনুভূতি কেমন থাকে। নিজের খুনিকে নিয়ে সে কী চিন্তা করে। জীবিতদের জন্য সে কোনো বার্তা রেখে যেতে চায় কি না। ‘মৃত্যুর আগে বশির কী ভেবেছিল তা হয়তো আর জানা হবে না’ মনে মনে ভাবল রিজোয়ান। 

লাশ সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন শাফিন শেখ। আনমনে বললেন, বশিরের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর জন্য বিষয়টি সহ্য করা কঠিন হবে। 

 

*

 

এক ঘণ্টা পর। 

শাফিন শেখের দফতরে বসে আছে রিজোয়ান। পাশের কক্ষে এক হিন্দু যোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সন্দেহ করা হচ্ছে এই যোগী যুবরাজ আলমগিরের চর। তথ্য নেয়ার জন্য দিল্লি এসেছে। সাম্প্রতিক দিনগুলিতে সম্রাট শাহজাহানের সাথে আলমগিরের সম্পর্ক বেশ তিক্ত হয়ে উঠেছে। দুপক্ষের মাঝেই জমাট বেধেছে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। শহরের প্রশাসক ও প্রহরীদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন শাহজাহান, কাউকে সন্দেহ হলেই যেন ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিজোয়ান জানালার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়। একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে চাঁদনি চক। কিছুদিন আগে সম্রাট শাহজাহান এই বাজারটি নির্মাণ করেছেন। এর নকশা করেছেন তার আদরের কন্যা জাহানারা। অন্তত দেড় হাজার দোকান নিয়ে গঠিত এই বাজারটি। মাঝ বরাবর চলে গেছে কৃত্রিম একটি খাল। যমুনা থেকে কেটে আনা হয়েছে এটি। দিল্লির সবাই জানে খাল খননের পেছনে আছে সুলতানের অন্য উদ্দেশ্য। তিনি চাঁদনি রাতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত দেখতে চান খালের জলে। খালের উপর নির্মাণ করা হয়েছে পুল। সেই হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে চাঁদনি চক। রিজোয়ান জানে চাঁদনি চক মূলত তিনটি বাজারের সমষ্টি। উর্দু বাজার, জোহরি বাজার, ফতেহপুরি বাজার। ফতেহপুরি বাজারের কাছেই পড়েছে কোতোয়ালের দফতর। ভবনটি স্থানীয়দের কাছে কাটারা নামেই প্রসিদ্ধ। বাজার থেকে লোকজনের কোলাহল ভেসে আসছে। উচ্চকণ্ঠে একজন রুপাব্যবসায়ী দরদাম করছে কারো সাথে। 

রিজোয়ানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা চিন্তা। একটু আগে হেকিম সাহেব জানিয়েছেন তাকে পাওয়া ছুরিটি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়নি। এমন ছোট ছুরি দিয়ে ভারী আঘাত করাও সম্ভব নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠে ছুরিটি এখানে কে রাখল। তার উদ্দেশ্য কী? 

‘তুমি চাইলে এক পেয়ালা বাদামের শরবত খাওয়াতে পারি।’ বললেন শাফিন শেখ। 

‘খাওয়া যায়। আমি ভাবছি খুনিকে নিয়ে। ঘটনা ঘটেছে মধ্যরাতে। খুনের কোনো সাক্ষী নেই। খুনি পালিয়ে গেছে। হয়তো সে শহর ছেড়ে চলে গেছে ইতিমধ্যে। অথবা এখন মিশে আছে চাঁদনি চকের ভীড়ের মাঝে। অপেক্ষা করছে পরবর্তী শিকারের।’

‘তোমার কী মনে হয় খুনি কেমন হতে পারে?’

‘সে খুব সতর্ক। আঘাত করেছে পেছন দিক থেকে, বাড়তি ঝুঁকি নেয়নি। সে অবশ্যই আগে আরো কিছু খুন করেছে নাহলে নিজের উপর এতটা নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা নয়। খুন করে ছুরি নিয়ে পালিয়ে গেছে ঠান্ডা মাথায়।’

‘তুমি কি আসলেই বিশ্বাস কর, খুনি ছুরি নিয়ে গেছে? ভেবে দেখ কাজটা সহজ নয়। যখন দরজার বাইরে প্রহরীদের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে এবং যে কোনো মুহূর্তে তাদের ভেতরে প্রবেশের সম্ভাবনা থাকছে তখন খুনি ছুরি বের করার ঝুঁকি কেন নিবে?’

রিজোয়ান আচমকা চোখ তুলে তাকাল শাফিন শেখের দিকে। এই বিষয়টি আগে তার মাথাতেই আসেনি। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করেছেন। 

‘আপনি কি প্রহরীদেরকে ছুরির কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন?’

‘তারা বিষয়টি ভালো করে লক্ষ করেনি। অবশ্য মধ্যরাতে এমন আকস্মিক ঘটনায় যে কারো হকচকিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তাদের একজন বলল ছুরি দেখেনি। আরেকজন বলল, মনে হয়েছে দেখেছে কিন্তু সে নিশ্চিত না। আমরা সেখানে পৌঁছার আগে হেকিম সাহেব এসেছেন। তিনিও ছুরি দেখেননি। বুঝতেই পারছ আমাদের হাতে নিরেট কিছু নেই। সবটাই অনুমান। তবে আমার মনে হচ্ছে খুনির জন্য ছুরি নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়।’

বাদামের শরবত নিয়ে এসেছে পরিচারক। কিন্তু রিজোয়ানের কাছে সবকিছু বিস্বাদ মনে হচ্ছে। সে টেবিলের সামনে চলে এলো। বশিরের লাশের সাথে পাওয়া পেইন্টিংটি সামনেই রয়েছে। সেখানে আবার সতর্ক নজর বুলাল রিজোয়ান। 

‘আমি ভাবছি বশিরকে কি খুনি টেনে নিয়ে এসেছিল নাকি সে নিজেই হেঁচড়ে সামনে আসে।’

‘খুনি তার লাশ নিয়ে টানাটানির বিশেষ কোনো কারণ দেখছি না। আঘাতের পর পালিয়ে যাওয়াই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক।’

‘আমি একটু বের হব। তুমি চাইলে এখন বাসায় যেতে পার। আগামীকাল সকালে বিচিত্রের সাথে দেখা হবে আমাদের। তাকে কিছু প্রশ্ন করতে হবে। আমি চাই তুমি আমার সাথে চলো।’

‘জি অবশ্যই।’ উঠে দাঁড়াল রিজোয়ান।

 

৩. 

বিচিত্রের বয়স সত্তরের কোঠায়। তার চেহারায় ফুটে উঠেছে বলিরেখা। দৃষ্টি ধূসর। তিনি বসে আছেন একটি নরম গদিতে। পাশে আছে হেলান দেয়ার জন্য কোলবালিশ। তার থেকে একটু দুরে বসা মুখতার। বিচিত্রের হাতে একটি তুলি। সেটি উল্টো দিকে অনবরত ঘুরাচ্ছেন তিনি। চেহারায় অন্যমনস্কতার ছাপ। 

‘একটা সময় আমাদের পেশার বেশ মর্যাদা ছিল। বাদশাহর বাপদাদারা আমাদের পুর্বপুরুষকে বেশ সম্মান করেছিলেন। বাদশাহ নিজে এখনো সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু সামনে আর কদিন থাকবে কে জানে। গত দুবছরে আমাদের ভাতা কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। শুনেছি যুবরাজ আলমগির এসব চিত্রকলা তেমন পছন্দ করেন না। আমাদের ভবিষ্যৎ রুটিরুজি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকেই। এর মধ্যে যদি এসব খুনোখুনির কথা সম্রাটের কানে যায় তাহলে কী হবে ভাবুন।’ কাঁপা কণ্ঠে বললেন বিচিত্র। 

কক্ষে একজন তরুণী প্রবেশ করল। রিজোয়ান প্রথমে ভাবল চিত্রশিল্পীদের কেউ হবে। কিন্তু সাধারণ পোশাক-আশাক দেখে ভুল ভাঙ্গল। চিত্রকররা মুঘল দরবারে এখনো বেশ দাপটের সাথেই টিকে আছে। তাদের বেতন ভাতাও বেশ ভালো। তরুণীর গায়ে সস্তা জামা, হাতে কমদামি ব্রেসলেট। বিচিত্র তাকে ইশারা করলে সে একদিকে গিয়ে ঝাড়ু দেয়া শুরু করল। রিজোয়ান বুঝল এই তরুণীই প্রহরীর বোন রেহানা। 

‘আপনি কি বশিরের কক্ষে যেতেন?’ শাফিন শেখ প্রশ্ন করলেন। খুব চিন্তা করে প্রশ্ন করেননি। স্রেফ আলাপ শুরু করতে চাচ্ছেন। 

‘আমি আমার কক্ষ থেকে খুব কমই বের হই। সম্রাট না ডাকলে আগ্রাও যেতাম না। বশিরের কক্ষে যাইনি কখনো। সে নিজেই এখানে আসত।’ বিচিত্র হাত থেকে তুলিটি রেখে দিল। রিজোয়ান লক্ষ করল তুলির পেছনের অংশে কাঠের শক্ত বাট লাগানো। এর শেষমাথা একেবারে সুচালো। কাউকে আঘাত করার জন্য এটি বেশ কার্যকরী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। তুলিটি ভালো করে লক্ষ করল রিজোয়ান। 

‘চলুন বাগানে যাওয়া যাক। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।’ বললেন শাফিন শেখ। বিচিত্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। 

বাগান থেকে বশিরের কক্ষের জানালা দেখা যাচ্ছে। রিজোয়ান কল্পনা করলো সেই জানালা থেকে লাফিয়ে পড়ছে কেউ। বাগানটি চমৎকার। বেশ কিছু ফুলের গাছ আছে। বাতাসে একটা সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছে পানি দেয়ার জন্য ছোট ছোট কিছু নালা খনন করা হয়েছে। তাতে ভাসছে গুলমোহর গাছের শুকনো পাতা। সাবধানে একটি কাঁটাযুক্ত গোলাপের ডাল সরিয়ে সামনে এগুলো রিজোয়ান। 

‘বশির কেমন লোক ছিল। তার পরিবার সম্পর্কে কী জানেন বলুন।’ 

‘বশিরের পরিবার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। সে ছিল অনাথ। পনেরো বছর বয়সে তাকে এখানে আনা হয়েছিল। গত পনেরো বছর ধরে সে এখানেই আছে। আমার কাছেই কাজ শিখেছে। বেশিরভাগ সময় সে একাই থাকত। অবশ্য দুই প্রহরীর সাথে তার বেশ খাতির ছিল। আমার সাথে কাজের বাইরে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা হয়নি কখনো।’ 

‘শিল্পী হিসেবে সে কেমন ছিল?’ 

‘শিল্পী হিসেবে সে বিশেষ কেউ ছিল না। সে ছিল খুবই সাধারণ একজন শিল্পী। আরো ভালো করে বললে সে ছিলো মূলত কপিকার। তার আঁকা মৌলিক ছবি খুব কমই। সে অন্যের ছবিই কপি করত বেশি। আমরাও তাকে দিয়ে অনুলিপির কাজই করাতাম। আমাদের এখানে সবচেয়ে ভালো শিল্পী মুখতার। তার হাতে জাদু আছে। বাদশাহ সালামত যদি চিত্রকরদের জন্য নতুন ভাতা মঞ্জুর করতেন তাহলে সে অবশ্যই এটি লাভ করত।’

‘বশিরকে তার অদক্ষতার জন্য কেউ কি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত?’

‘আমার মনে হয় না এমনটি হয়েছে কখনো। সে নিজের কাজেই ডুবে থাকত বেশিরভাগ সময়। তাছাড়া নিজের অদক্ষতার বিষয়টি সে নিজেও জানত।’

‘মানুষ হিসেবে বশির কেমন ছিলেন?’

‘কোনো মানুষই সাদা বা কালো নয়। তারা মূলত ধূসর। বশিরও এমন। আমার সাথে তার কোনো সমস্যা হয়নি কখনো। কিন্তু তাই বলে তার প্রতি সবার মনোভাব এমন হবে তা নয়।’

বিচিত্রকে নিয়ে বশিরের কক্ষে এলো রিজোয়ান ও  শাফিন শেখ। লাশের সাথে পাওয়া পেইন্টিংটা বিচিত্রের সামনে তুলে ধরল রিজোয়ান। 

‘ছবিটা দেখুন ভালো করে। নিচের দিকে কোনায় একটু রক্ত লেগে আছে। ছবিটা দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে?’ 

বিচিত্রের চেহারায় সতর্কতার রেখা ফুটে উঠল। একবার আড় চোখে শাফিন শেখের দিকে তাকাল সে। শাফিন শেখ কথা চালিয়ে যাওয়ার ইশারা দিল। 

‘এটা খুবই সাধারণ একটা ছবি, বশিরের আঁকা অন্য ছবিগুলোর মতোই। এই ছবিতে বিশেষ কিছুই নেই। তবে মজার ব্যাপার হলো তাঁর রক্তটা লেগেছে ছবির সেই জায়গায়, সাধারণত যেখানে শিল্পী নিজের নাম লেখেন।’ 

বিচিত্রকে আরো দুয়েকটি প্রশ্ন করে বিদায় জানানো হলো। শাফিন শেখ দফতরে ফিরে গেলেন। রিজোয়ান থেকে গেল বশিরের কক্ষে। পুরো কক্ষ তল্লাশি চালাল ভালো করে। সবগুলো ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। চেক করল প্রতিটা তুলি ও ব্রাশ। বসার গদি উল্টে সরিয়ে রাখল। নিচ থেকে বের হলো কয়েকটা শুকনো ফুল। সম্ভবত বাগান থেকে তুলে এনেছিল বশির। প্রায় দু ঘণ্টা পর কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে গেল বশির। 

শক্ত কাঠের বড় সাইজের একটি তুলি। পেছন দিকটা খুবই সুচালো। বিচিত্রের হাতে এমন তুলিই দেখেছিল রিজোয়ান। আলগোছে তুলিটি পকেটে ভরে বের হয়ে এলো কক্ষ থেকে। 

 

*

 

দুদিন ধরে রিজোয়ানের দেখা নেই। শাফিন শেখ অবশ্য চিন্তিত নন। রিজোয়ানের খামখেয়ালির কথা জানা আছে তার। সে প্রায়ই এমন করে। কয়েকদিনের জন্য গায়েব হয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। শাফিন শেখ ধারণা করছেন হয়তো সে আগ্রা চলে গেছে। নিজের দফতরে বসে এসব ভাবছেন শাফিন শেখ, আচমকা হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো রিজোয়ান। 

‘দ্রুত আসুন। দশ বারোজন সেপাই লাগবে আমাদের। খুনিকে ধরতে হবে।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে। 

‘ব্যবস্থা করছি। আগে বলো কে খুনি? সে এখন কোথায় আছে?’ শাফিন শেখ ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছেন। 

‘চলুন। নিজের চোখেই দেখবেন।’

দশজন সেপাইসহ শাফিন মির্জা ও রিজোয়ান পৌঁছলেন প্রধান চিত্রকরের কক্ষের সামনে। 

‘সেপাইরা বাইরে থাক। আমরা আগে ভেতরে ঢুকি। খুনি এখন ভেতরেই আছে।’ ফিসফিস করে বলল রিজোয়ান। ইশারায় সেপাইদের ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন শাফিন শেখ। 

‘কী করতে যাচ্ছ, আমাকে একটু খুলে বলো। আমাকে অন্ধকারে রেখো না।’ রিজোয়ানের হাত ধরে বললেন শাফিন শেখ। 

‘এখন বিস্তারিত বলার সময় নেই। আগে খুনিকে ধরতে হবে।’ হাত ছাড়িয়ে নিল রিজোয়ান। 

কক্ষের ভেতর বিচিত্র বসে আছে। তার হাতে সেই বিশেষ আকৃতির তুলিটি। তার সামনে বসে আছে মুখতার। একটু দূরে কক্ষ ঝাড়ু দিচ্ছে দাসি রেহানা। একপাশে ছোট একটি বালক একমনে ছবি আকার চেষ্টা করছে। শাফিন শেখের মনে হলো পরের কয়েক মুহূর্তে দ্রুত অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল। রিজোয়ান চিৎকার করে বলল, রেহানাই খুনটা করেছে। মুখতারের চেহারা পাণ্ডুবর্ন ধারণ করলো। বিচিত্র চিৎকার করে উঠলেন। বালকটির হাত থেকে রং তুলি পড়ে গেল। রেহানা ছুটল দরজার দিকে, মুখতার ছুটল জানালার দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর বাহির থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ ভেসে এলো। 

৪.

দুই ঘণ্টা পর। 

কোতোয়ালের দফতরে বসে আছেন শাফিন শেখ ও রিজোয়ান। বাইরে মানুষের ব্যস্ত কোলাহল। পাশে একটা দোকান থেকে কাবাব পোড়ানোর ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রেহানা ও মুখতারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশের একটি ভবনে তাদের আটকে রাখা হয়েছে এখন। 

‘এবার বলো। খুনিকে শানাক্ত করলে কীভাবে?’ শাফিন শেখ প্রশ্ন করলেন। 

রিজোয়ান কোনো কথা না বলে টেবিলের পাশে চলে এলো। তুলে নিল সেই বিশেষ পেইন্টিং যা বশিরের লাশের সাথে পাওয়া গেছে। 

‘ছবিটি দেখে আপনার কী মনে হয়েছিল?’ 

‘বিশেষ কিছু মনে হয়নি। সাধারণ একটি ছবিই মনে হয়েছে।’

‘ছবিতে থাকা কনের হাতের দিকে লক্ষ করুন। একটা ব্রেসলেট দেখা যাচ্ছে। এমন ব্রেসলেট আর কোথায় দেখেছেন?’ 

‘মনে পড়েছে। রেহানার হাতে এমন ব্রেসলেট ছিল।’ 

‘হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। রেহানাকে দেখার পরেই আমার মনে পড়ে এমন ব্রেসলেট ছবিতেও ছিল। তখন বুঝতে পারি ছবিতে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। বশির অবশ্যই আমাদের জন্য কোনো বার্তা রাখতে চেয়েছিল ছবিতে। তার রক্তের ছাপ তাই প্রমাণ করে। আমার জন্য কাজটি সহজ হয় আরেকটি কারণে। বশিরের কক্ষে ছুরি দেখে চমকানোর কারণে আমার হাত থেকে ছবিটি পড়ে যায়। তখন গায়ের সাথে লেগে কিছু অংশের রং উঠে যায়। ব্যাপারটি ছিল আশ্চর্যজনক। কারণ ছবিটি দেখে মনে হচ্ছিল এটি আঁকা হয়েছে কয়েকদিন আগে। তাহলে রং উঠবে কেন? ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি ছবিতে থাকা বর ও কনের চেহারা থেকেই রং উঠে আসছে। এইজন্য বিচিত্রকে যখন ছবিটি দেখাই তার চেহারায় চমকে ওঠার ভাব দেখেছিলাম। সে-ও বুঝতে পেরেছিল ছবিতে থাকা বর কনের চেহারা মূলত দ্বিতীয়য়বার আঁকা হয়েছে। কিন্তু সে আমাদের কাছে বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিল। আমার এক বন্ধু থাকে গিয়াসপুরে। ধনী বাবার সন্তান। শৌখিন চিত্রকর। আমি তার কাছে যাই। তাকে বলি সাবধানে উপরের রং সরিয়ে ভেতরের মূল ছবিটি উদ্ধার করতে। সে টানা একদিন পরিশ্রম শেষে ছবিটি উদ্ধার করেছে। এই দেখুন মূল ছবি।’ 

রিজোয়ানের হাত থেকে ছবিটি নিলেন শাফিন শেখ। লক্ষ করলেন ছবির চিত্র বদলে গেছে। বর ও কনের চেহারা আগের চেয়ে পরিবর্তিত। ফুটে উঠেছে মুখতার ও রেহানার ছবি। 

‘মূল ছবি উদ্ধার হতেই বুঝতে পারলাম এই ঘটনার সাথে মুখতার ও রেহানার সম্পর্ক আছে। মনে করে দেখুন, বিচিত্র বলেছে বশির রক্তের ছাপ সেখানে দিয়েছে যেখানে শিল্পীরা নিজের নাম লেখে। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বহীন নয়। বশির আমাদের একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। প্রথমত সে নিশ্চিত করেছে ছাপটি সেই দিচ্ছে। আমরা না বুঝলেও যে কোনো শিল্পী সহজেই তা ধরতে পারত। অথবা হতে পারে বশির রেহানার চেহারায় ছাপ দিতে চাচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে তার শক্তি ফুরিয়ে এসেছে তাই নাম লেখার জায়গাতেই ছাপ দিয়েছে।’

‘তাহলে এই দুজনের চেহারা বদলানো হলো কখন! নতুন করে চেহারা কে আকল?’

‘আমিও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। যেহেতু চেহারার অংশের রং ছিল কাঁচা, তাই অনুমান করা যায় বশিরের মৃত্যুর পরই কাজটি সারা হয়েছে। চিন্তা করে দেখলাম কাজটি কে করতে পারে। প্রহরীদের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ তারা বাইরে তল্লাশিতে ব্যস্ত ছিল। এই সময়টা মুখতার কোথায় ছিল? তা আমরা জানি না। তাহলে ধরে নেয়া যায় সে তখন বশিরের কক্ষেই অবস্থান করছিল এবং ছবিতে তুলির আঁচড় দিচ্ছিল। আপনার একটি কথা আমাকে সমাধানে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। আপনি বলেছিলেন, খুনির ছুরি সাথে নেয়ার কথা না। আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকি। প্রহরীদের একজন বলেছে, সে ছুরিটি দেখেছে, আরেকজন বলেছে দেখেনি। তাহলে ধরা যায় হত্যার পর ছুরিটি ছিল কিন্তু পরে সরানো হয়েছে। এই কাজটিও করা সম্ভব মুখতারের পক্ষেই। কারণ দুই প্রহরীকে দুদিকে সরিয়ে সে নিজের কাজ সারার জন্য বেশ সময় পেয়েছিল।’

‘কিন্তু রেহানাই কেন? ছবিতে তো দুজন আছে। মুখতারও করতে পারে খুনটি।’ 

‘তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সে রাতে সে আসলেই ঘুমে ছিল এবং খুনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানত না। আঘাতের ধরন দেখুন, আঘাত করা হয়েছে পেছন থেকে। একজন মহিলা যত শক্তিশালীই হোক সে সাধারণত সামনে থেকে আঘাত করার সাহস করবে না। তাই সন্দেহের তির গেল রেহানার দিকেই।’

‘কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। রেহানা ঘরে প্রবেশ করল কীভাবে?’

‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন প্রহরী রফিক তার আপন ভাই। সে তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়েছে। হত্যার পর রফিক প্রথমে কক্ষে প্রবেশ করে। সম্ভবত রেহানা তখনো সেখানে অবস্থান করছিল। বোন নিরাপদে জানালা টপকানোর পর সে শামসুদ্দিনকে ভেতরে ডেকে নেয়। এরপর যখন তারা বাগান তল্লাশি করতে যায় রেহানা ততক্ষণে অনেকদূর চলে গেছে।’ 

‘আচ্ছা এবার বলো এই হত্যার মোটিভ কি?’

‘এটা গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন। শুরু থেকেই আমার মনে হচ্ছিল বিচিত্র অনেক কিছু জানেন কিন্তু বলতে চাচ্ছেন না। গতকাল সারাদিন আমি তার সাথে ছিলাম। খাতির করে অনেক কথা আদায় করেছি। মূলত মুখতারের সাথে রেহানার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। বিচিত্র বিষয়টি অনুমান করেছিলেন। এছাড়া কেউ এ সম্পর্কে জানত না। জাহাঁপনার মহলে এ ধরণের কাজ গর্হিত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। একজন সামান্য দাসির সাথে রাজকীয় চিত্রকরের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে দেখার সুযোগ ছিল না। যাই হোক, মুখতার ও রেহানা তাদের একটি ছবি আঁকতে বলে বশিরকে। বশির এ সময় তাদের সম্পর্কের কথা জেনে যান। সম্ভবত তিনি তাদেরকে চাপ দিয়ে টাকা পয়সা উদ্ধার করতে চাচ্ছিলেন। এই কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে রেহানা তাকে হত্যা করে। মুখতার বিষয়টি জানত না। কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করে সে বুঝতে পারে এটি রেহানার কাজ। তাই সে দ্রুত আলামত সরিয়ে ফেলে।’

‘চমৎকার কাজ দেখিয়েছ। আমি জাহাঁপনাকে বলব তোমার কথা। হয়তো তিনি তোমাকে আগ্রায় নিয়ে যাবেন।’ 

‘আপাতত দিল্লি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার আগ্রহ নেই আমার। আপনি হয়তো জানেন না, চাঁদনি চকের কাবাবের দোকান আমার কাছে ফতেহপুর সিক্রির চেয়েও প্রিয়।’

‘হবে নাকি এক প্লেট গরম গরম কাবাব?’ 

‘আপনি বললে না করব না।’ উচ্চস্বরে হেসে উঠে রিজোয়ান।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Abrar Khan
Abrar Khan
9 months ago

আদ্যোপান্ত এক চুমুকে পড়ে ফেললাম৷ অনুসন্ধিৎসা শেষ অবধি টেনে নিয়ে গিয়েছে৷ লেখকের চিরচেনা ধাঁচ, গুছিয়ে বর্ণনার অভ্যেসে গল্পটি দারুণ হয়েছে৷ ইতিহাসের কিছু বাঁক উঠে এসেছে৷

জুনাইদ বিন আজিজ
জুনাইদ বিন আজিজ
7 months ago

মুঘল আমলে বিচরণ করতে করতে পড়ে ফেললাম সেই আমলের একটি হত্যাকাণ্ড ও সূক্ষ্ম তদন্তের একটি অতুলনীয় গল্প। ধন্যবাদ।

তা মি ম
তা মি ম
28 days ago

পরবর্তী কিস্তি না থাকলে লিখে ফেলেন।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷