চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, যা মোগল আমলে নির্মিত এবং চট্টগ্রামের মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের অমূল্য রত্ন হিসেবে স্বীকৃত। প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরানো এই মসজিদটির নির্মাণের পেছনে রয়েছে এক গভীর ইতিহাস।
আন্দরকিল্লা অঞ্চলের ইতিহাসের সূচনা হয় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা, যারা বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে নানাভাবে লুণ্ঠন ও আক্রমণ চালিয়ে বাংলার বাণিজ্যিক পরিবহন ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত করে রাখছিল। এই জলদস্যুদের আক্রমণ মোকাবেলায় বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এটি ছিল মূলত মোগলদের চট্টগ্রাম আক্রমণের প্রতক্ষ্য কারণ। এছাড়াও মোগল চট্টগ্রাম আক্রমণের আরেকটি কারণ ছিল মোগল যুবরাজ শাহ সুজার আরাকান পলায়ন। আর এই সময় চট্টগ্রাম আরাকানীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে মোগলরা চট্টগ্রাম আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। প্রস্তুতির যাত্রা শুরু হয় ১৬৬৫ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর। মোগল বাহিনীর সেনাপ্রধান হিসাবে নির্বাচিত করা হয় শায়েস্তা খাঁনের পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে। ইতিমধ্যে শায়েস্তা খাঁন পর্তুগীজদের নিজ দলে প্রলোভনের মাধ্যমে নিয়ে আসেন এবং সন্দীপ আক্রমণ করে আরাকানীদের সমুদ্রের শক্তিশালী আশ্রয়স্থল দখল করে নেন। স্থলপথে বুজুর্গ উমেদ খাঁন আরাকানীদের দেয়াঙ পাহাড় ঘাঁটি আক্রমণ করে ২৭ শে জানুয়ারি ১৬৬৬ সালে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসেন।
চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যে যুক্ত হওয়ার পর, বুজুর্গ উমেদ খাঁ, চট্টগ্রামের প্রথম শাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি দেখলেন দেয়াঙ পাহাড়স্থ দুর্গটি অনিরাপদ। যেকোনো মূহুর্তে আরাকানীরা আবার আক্রমণ করতে পারে। ফলে তিনি শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পাহাড়বেষ্টিত এলাকায় একটি সেনাদুর্গ নির্মাণ করেন। এর জন্য স্থান নির্ধারণ করেন বর্তমান কর্ণফুলি নদীর উত্তর তীরে। নদী থাকার ফলে এখানে শত্রুদের আক্রমণ করতে বেগ পেতে হবে। এই দুর্গে দশ হাজার সৈন্য ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম মোতায়েন করেন, এবং স্থানটির নামকরণ করেন ‘আন্দরকিল্লা’।
আন্দরকিল্লা শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। আন্দর (অন্দর) অর্থ ‘ভিতর’ বা ‘অভ্যন্তর’। কিল্লা অর্থ ‘দুর্গ’ বা ‘কেল্লা’। সুতরাং, আন্দরকিল্লা শব্দের অর্থ হলো ‘ভিতরের দুর্গ’ বা ‘অভ্যন্তরীণ কেল্লা’। কোনো শহর বা দুর্গের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি সুরক্ষিত স্থানকে বোঝায়। তাছাড়া বর্তমান আন্দরকিল্লা তৎকালীন ও বর্তমান সময়ে কর্ণফুলি নদী ও সমুদ্রের তট থেকে অনেক ভিতরে। সুতরাং ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে বুজুর্গ উমেদ খাঁ হয়তো এই স্থানের নাম ‘আন্দরকিল্লা’ রেখেছিলেন।
১৬৬৭ সালে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বুজুর্গ উমেদ খাঁ ‘চট্টগ্রাম বিজয়ের’ প্রতীক হিসাবে নির্মাণ করেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মোগল স্থাপত্যশৈলী অনুযায়ী তৈরি এই মসজিদটি ছিল তার সময়ের অন্যতম বৃহৎ ও সুন্দর ধর্মীয় নির্মাণ। তখন ইসলামাবাদে (চট্টগ্রাম) আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের মতো বিশাল কোনো স্থাপত্য ছিল না। ফলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে মসজিদটি।
তাছাড়া মুসলিম শাসনামলে জামে মসজিদগুলো শুধু উপাসনালয় হিসেবেই নয়, বরং সরকারি ভবন হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ, জুমার নামাযের খুতবা শাসকের স্বীকৃতির প্রতীক ছিল এবং তা সার্বভৌমত্বের ঘোষণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেই সঙ্গে, মসজিদ শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ ঘটাত না, বরং পৃষ্ঠপোষকের ক্ষমতা ও আদর্শেরও প্রতিফলন ঘটাত। তেমনি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ চট্টগ্রামে মোগল শক্তিমত্তা ও স্থাপত্যের এক অবিকল প্রতীক ছিল।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে স্থাপিত হওয়া ফারসী শিলালিপির বাংলা অনুবাদটি হলো, ‘হে জ্ঞানী, তুমি জগৎবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’। এই শিলালিপিটি ১০৭৮ হিজরি (১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে স্থাপন করা হয়েছিল। মসজিদটির ইতিহাসে এটি একটি অমূল্য অংশ হয়ে আছে। গবেষকদের মতে, মসজিদের শিলালিপি ও স্থাপত্যে সিরিয়ার ‘রাক্কা নগর’ এর স্থাপত্যকলার সঙ্গে মিল রয়েছে, যা এই অঞ্চলের স্থাপত্যের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে শিলালিপিটি মসজিদের এক প্রান্তে সংরক্ষিত রয়েছে।
মসজিদটি নির্মিত হয় একটি ছোট পাহাড়ের উপর, যা সমতল থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। এর আয়তন প্রায় ১৮ গজ দীর্ঘ ও ৭.৫ গজ প্রস্থ, এবং দেয়ালের পুরুত্ব ছিল প্রায় ২.৫ গজ। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি, বাকিগুলি পাথরের নির্মাণে। মসজিদটির ছাদের গম্বুজগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যার মধ্যে পেছন দিকে দুটি গম্বুজ এখনও অক্ষত রয়েছে।
মসজিদটির নির্মাণের পর থেকেই এটি চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজের একটি তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। প্রতি শুক্রবার, বিশেষ করে রমজান মাসে, চট্টগ্রাম ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মুসল্লী এখানে জুমার নামাজ আদায় করতে আসতেন। মসজিদের ইমাম বা খতিব হিসেবে নিযুক্ত হন পবিত্র মদিনা শরীফের আওলাদে রাসুল (রাঃ), যা মসজিদটির ধর্মীয় মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দেয়। এই মসজিদে প্রতি বছরের রোজা, ফিতরা এবং ঈদের চাঁদ দেখার বিষয়ে স্থানীয় জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো, যা চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজে একটি বিশেষ ঐতিহ্য হিসেবে চলছিল।
এরমধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসে। দীর্ঘকাল মোগলদের শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটিকে গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। কারণ তারা ভারতবর্ষে মুসলিম মোগলদের হঁটিয়ে ক্ষমতায় আসছিল। যার রেষারেষিতে তারা চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের মোগল আধিপত্য ও মুসলিম স্থাপত্যের প্রতীকী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটিকে অচল অবস্থায় রাখে। ফলে মসজিদটির অবকাঠামোগতভাবে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রায় এক শতাব্দী পর, ১৮৫৩-৫৪ সালে মসজিদটি পুনরুদ্ধারের জন্য চট্টগ্রামের সচেতন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন জানান। ১৮৮৫ সালে, চট্টগ্রামের জমিদার হামিদুল্লাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদটি মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য পুনরায় খুলে দেওয়া হয়। ১৯২০ সালে প্রকাশিত চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্মনের লেখা চট্টগ্রামের ইতিহাস বইয়ে এই ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। জমিদার হামিদুল্লাহ খাঁর এটি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার সফলতা ছিল। বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালনায় রয়েছে মসজিদটি।
আজকের দিনে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ চট্টগ্রামের মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর একটি। মসজিদে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মুসল্লি নামাজ পড়েন এবং শুক্রবারে এই সংখ্যা ৭ থেকে ৮ হাজারে পৌঁছায়। রমজানে এই সংখ্যা আরো বেড়ে যায়।
রমজান মাসে, হাজার হাজার রোজাদার একত্রিত হয়ে ইফতার করেন, যা ঐতিহাসিকভাবে একটি বিশেষ রেওয়াজ হিসেবে চালু রয়েছে। বিশেষ করে ঈদের দিন ২০ হাজারেরও বেশি মুসল্লি মসজিদে জমায়েত হন। যদিও মসজিদটির পুনঃনির্মাণের জন্য কুয়েত সরকারের অর্থায়নে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তবে বিভিন্ন জটিলতায় প্রকল্পটি থমকে আছে।
এছাড়া, মসজিদটি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের একটি অমূল্য নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। এর স্থাপত্যশৈলী এবং মোগল যুগের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চট্টগ্রাম বিজয়ের প্রতীক হিসাবে চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ শুধু চট্টগ্রামের একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি নয়, এটি মোগল শাসনের এক অমূল্য রত্ন। এর নির্মাণ ইতিহাস, ধর্মীয় গুরুত্ব এবং সমাজে এর প্রভাব চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজের জন্য আজও প্রাসঙ্গিক এবং তা চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে এক অমলিন চিহ্ন হিসেবে বিরাজমান।
তথ্যসূত্র :
১. ফার্সি ভাষার অভিধান: [Persian-English Dictionary by Francis Steingass] (https://dsal.uchicago.edu/dictionaries/steingass/)
২. Architecture of Mughal India, Catherine B. Asher.
৩. চট্টগ্রামের ইতিহাস – মাহবুবুল আলম।
৪. চট্টগ্রামের ইসলামি ঐতিহ্য – ড. আবদুল করিম।
৫. চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ – আবদুল হক চৌধুরী।
৬. শ্বাশত চট্টগ্রাম – জামাল উদ্দিন।
৭. মোগল বিজয়ের স্মারক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ,৩ জানুয়ারি ২০১৯, Covoice24।
৮. চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, রোববার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, জাগো নিউজ।
৯. মোঘল ঐতিহ্যের স্মারক চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, ১ জানুয়ারি, ২০১৮, ইনকিলাব।