গ্রাফিতি ও গণঅভ্যুত্থান

অস্ট্রিক আর্যু

গ্রাফিতি শব্দটার মূল ইতালি। ইতালীয় শব্দ গ্রাফিয়ো বা ‘স্ক্রাচ’ থেকে উদ্ভূত গ্রাফিতি বা ‘ছেঁড়া শিলালিপি’। শব্দটা মূলে বহুবচন হলেও এখন একবচনেই ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন গ্রিক নগরী এফেসাসে আধুনিক গ্রাফিতির উদ্ভব এবং সেখানে গ্রাফিতি পতিতাবৃত্তির বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নভেলিয়া প্রিমিগেনিয়া নামের এক পরমা সুন্দরী পতিতার ব্যাপারে জানা যায় গ্রাফিতি থেকে। প্রাচীন গ্রাফিতিগুলো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটাত। ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের সময়কার গ্রাফিতিগুলো পম্পেই নগরীতে সংরক্ষিত ছিল।

দেয়ালে প্রথম অঙ্কন হাজার হাজার বছর আগে গুহায় আবির্ভূত হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রাচীন রোমান এবং গ্রিকরা তাদের নাম এবং প্রতিবাদী কবিতা লেখেন ভবনগুলিতে। রোম ও পম্পেই নগরীর সমাধিস্থলের দেয়াল ও ধ্বংসাবশেষে গ্রাফিতির অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণ সিরিয়া, পূর্ব জর্ডান, এবং উত্তর সৌদি আরবে শিলা ও পাথরের ওপরে কিছু লেখা পাওয়া গিয়েছে স্যাফাইটিক ভাষায় এবং ধারণা করা হয় এই স্যাফাইটিক ভাষার উৎপত্তি গ্রাফিতি থেকে।

গ্রাফিতির সংজ্ঞা নিয়ে আছে নানা মত। আছে ইতিহাস। আভিধানিক সংজ্ঞা বলে : গ্রাফিতি হলো বিনা অনুমতিতে শৈল্পিক উপায়ে দেয়ালের গায়ে জনসাধারণের অভিমত লেখনী কিংবা অঙ্কনের মাধ্যমে তুলে ধরা। আরেকটি সংজ্ঞা বলে : দেয়ালের যে ছবি বা লেখা আধিপত্যবাদী বা সুশীল মনে চাপ তৈরি করে সেটাই গ্রাফিতি।

গ্রাফিতি এক ধরনের অভিব্যক্তি। কখনো ব্যক্তিগত আবার কখনো বা সামষ্টিক। গ্রাফিতি হলো যোগাযোগের একটি মাধ্যম এবং মুহূর্তের মধ্যে যা অনুভব করে তা প্রকাশ করার একটি উপায়। এটি শিল্প এবং একটি কার্যকরী জিনিস যা মানুষকে কিছু সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে বা মানুষকে কিছু সম্পর্কে অবহিত করতে পারে। গ্রাফিতি কিছু লোকের কাছে একটা ভাষা, শিল্পের একটি রূপ, কারও কাছে নোংরামি।

অনেক গ্রাফিতিশিল্পীরা তাদের পরিচয় গোপন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এমনকি অনেক গ্রাফিতি শিল্পীকে ‘অন্তর্মুখী শিল্পীর’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি একটি সাধারণ ভুল ধারণা যে বেশিরভাগ গ্রাফিতি কোনো গোষ্ঠী দ্বারা করা হয়। ব্যাপারটা তা না। গ্রাফিতি সামাজিক, জাতিগত এবং অর্থনৈতিক পটভূমির প্রতিনিধিত্ব করে।

গ্রাফিতিশিল্পীকে অনেকে রাস্তার শিল্পী বলেন। রাস্তার শিল্পী কারা? অভিধানে পাই, রাস্তার শিল্পী হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি পাবলিক প্লেসে শিল্প তৈরি করেন। রাস্তার শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে প্রতিকৃতি শিল্পী, ক্যারিকেচারিস্ট, গ্রাফিতি শিল্পী, ম্যুরালিস্ট এবং কারুশিল্পের মানুষ। স্ট্রিট আর্টিস্টরা স্ট্রিট পারফর্মারদেরও উল্লেখ করতে পারে। যেমন মিউজিশিয়ান, অ্যাক্রোব্যাট, জাগলার, জীবন্ত মূর্তি এবং স্ট্রিট থিয়েটার পারফর্মার।

গ্রাফিতিকে অনেক দেশে বা অনেক স্থানে নিষিদ্ধ করা হয়। এটা গ্রাফিতির প্রতি মানুষের অবহেলা বা গ্রাফিতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে হতে পারে। গ্রাফিতি অপরাধমূলক কার্যকলাপকে আকর্ষণ করতে পারে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য একটি অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারে। গ্রাফিতি সরকারি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি করতে পারে; বা ঘৃণাত্মক বক্তৃতা ছড়াতে পারে; বা স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে পারে। গ্রাফিতি একটি বিতর্কিত বিষয়। অধিকাংশ দেশে গ্রাফিতিকে বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক শিল্প হিসেবে গণ্য করা হয় কারণ অনেক সময় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের সক্রিয়তা গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রচার করে।

গ্রাফিতিশিল্পীরা কখনও কখনও তাদের কাজের মাধ্যমে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বার্তা প্রকাশ করে কণ্ঠহীনের কণ্ঠস্বর হিসাবে। সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে শক্তিশালী মত ও মন্তব্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে গ্রাফিতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই সমাজে এটি বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। গ্রাফিতি জনগণের ইতিহাস, মূল্যবোধ, সমকালীন ভাষ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্যদের সাথে নিজেকে বা নিজেদেরকে সংযুক্ত করে। শুরু থেকেই গ্রাফিতি আলোচন, সমালোচনা, বাকস্বাধীনতা ও প্রতিবাদের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করার কারণে কয়েক দশকের মধ্যে গ্রাফিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে গ্রাফিতি এতটাই মূলধারায় পরিণত হয়েছে যে নিলাম ঘর, জাদুঘর এবং প্রদর্শনীগুলি সারা বিশ্বের স্ট্রিট আর্ট বিশেষজ্ঞ এবং সংগ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করছে।

আধুনিক গ্রাফিতি ফিলাডেলফিয়ায় ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে আবির্ভূত হয়েছিল বলে মনে করা হয় এবং ষাটের দশকের শেষের দিকে এটি নিউইয়র্কে পৌঁছেছিল। আমেরিকায় সমসাময়িক গ্রাফিতি মূলত হিপহপ দ্বারা প্রভাবিত এবং অসংখ্য গ্রাফিতির উদ্ভব ফিলাডেলফিয়া এবং নিউইয়র্ক শহরের সুড়ঙ্গের গ্রাফিতি থেকে। এ ছাড়াও শৌচাগার ও ব্রিজেও গ্রাফিতির কাজ দেখা যায়। সবচেয়ে পুরাতন আধুনিক গ্রাফিতি হলো ‘মনিকাস’ যা ভবঘুরে এবং রেলশ্রমিকদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল। মনিকাসের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাতা বিল ড্যানিয়েল ২০০৫ সালে ‘হু ইজ বোজো টেক্সিনো’ নামের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন।

গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপটনকে নিয়ে তৈরি ‘ক্ল্যাপটন ইজ গড’ হলো বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত গ্রাফিতি। ১৯৬৭ সালে ক্ল্যাপটনের একজন ভক্ত স্প্রে দিয়ে ইসলিংটন স্টেশনের দেয়ালে এই গ্রাফিতিটি তৈরি করেন। ১৯৭০ সালে পাংক রকের বিরুদ্ধে ব্ল্যাক ফ্লাগ ও র্ক্যাস ব্যান্ড তাদের নাম ও লোগো দিয়ে গ্রাফিতি করে।

১৯৮১ সালে ব্লেক লে রেট প্যারিসে প্রথম স্টেনসিল গ্রাফিতির প্রচলন করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে নিউইয়র্ক, মেলবোর্ন এবং সিডনিতে স্টেনসিল গ্রাফিতির কাজ দেখা যায়।

স্মারক হিসেবে গ্রাফিতির প্রচলন আছে। মানুষ প্রায়ই তাদের শেষচিহ্ন কংক্রিট দিয়ে বাঁধাই করে। এই ধরনের গ্রাফিতি সাধারণত কোনো একজন মানুষের বিশেষ সময়ের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে তৈরি করা হয়।

গ্রাফিতির বৈশ্বায়ন হয়েছে ধীরে ধীরে। মধ্যপ্রাচ্যে গ্রাফিতির উত্থান হয়েছে একটু শ্লথভাবে। ইরানের প্রধানতম পত্রিকা ‘হামশাহরি’ দুটি নিবন্ধ প্রকাশ করে তেহরানের দেয়ালের ওপর ‘এ-ওয়ান’-এর কাজের ওপর। ‘ইসরাইলি ওয়েস্ট ব্যাংক বেরিয়ার’ পরিণত হয়েছে গ্রাফিতি শিল্পচর্চার স্থান হিসেবে। একটি ধর্মীয় মত ‘না নাচ নাচমা নাচমান মিউমান’ সর্বদা দেখা যায় ইসরাইলি গ্রাফিতি শিল্পে। গ্রাফিতির প্রভাব দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে চোখে পড়ার মতো লক্ষণীয় যা মূলত পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারায় প্রভাবিত। ২০১০ সাল থেকে মালয়েশিয়া গ্রাফিতি চর্চার উৎসাহ বাড়ানোর জন্য ‘স্ট্রিট ফেস্ট’-এর আয়োজন করে আসছে।

আধুনিক দিনের গ্রাফিতি শিল্পীরা একটি সফল গ্রাফিতি তৈরি করার জন্য নানা উপায় এবং নানা উপকরণ ব্যবহার করে থাকেন। গ্রাফিতি তৈরির অন্যতম একটি মাধ্যম হলো স্প্রে পেইন্ট। স্প্রে পেইন্ট হার্ডওয়্যারের দোকানে পাওয়া যায়। শক্ত কোনো বস্তু যেমন কার্ডবোর্ড কেটে ডিজাইনের মাধ্যমে একটি আকৃতি প্রদান করে গ্রাফিতি তৈরি করাকে স্টেনসিল গ্রাফিতি বলে। আধুনিক গ্রাফিতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার যোগ হয়েছে। ইয়ার্নবোম্বিং হলো গ্রাফিতির সাম্প্রতিক আরেকটি রূপ। যেসব গ্রাফিতিগুলো গ্রাফিতিশিল্পীরা পরিহার করেছে ওইসব গ্রাফিতিতে পরিবর্তন আনাই হলো ইয়ার্নবোম্বারদের কাজ। স্প্রে পেইন্ট বা মার্কার পেন  সাধারণত গ্রাফিতি তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জেন মিচেল বাস্কুইট, যার গ্রাফিতি জনসাধারণের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, তার তৈরি একটি গ্রাফিতি ১০ কোটি মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল।

বাংসি হলো সর্বজনবিদিত এবং বিখ্যাত একজন পথ গ্রাফিতি শিল্পী যিনি আজও জনসাধারণের কাছে অজ্ঞাত। তিনি ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে রাজনৈতিক ও যুদ্ধবিরোধী গ্রাফিতির জন্য বিখ্যাত। কিন্তু তার গ্রাফিতি লন্ডন, লস অ্যাঞ্জেলস থেকে প্যালেস্টাইন সর্বত্র দেখা যায়। বাংসি শৈল্পিক আন্দোলনের জন্য সর্বজনস্বীকৃত এবং তিনি পরিচয় গোপন করেন মূলত গ্রেফতার এড়ানোর জন্য। ২০০০ সালে তার অনেকগুলো প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পিক্সনিট হলেন আরেকজন গ্রাফিতি শিল্পী; তিনিও তার পরিচয় জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখতেন। তার কাজ ছিল সৌন্দর্য ও নকশাকেন্দ্রিক। তার অধিকাংশ কাজই ছিল ম্যাসাচুসেটস আর ক্যামব্রিজের দোকানগুলোতে ফুলের নকশা করা।

‘সাবওয়ে আর্ট’ নামে একটি বই আছে। বইটি নিউইয়র্কের দুইজন ফটোগ্রাফার হেনরি চালফ্যান্ট এবং মার্থা কুপার তৈরি করেছেন। বইটিতে ট্রেনের ভেতর ও বাইরের গ্রাফিতিগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

আধুনিক দিনের গ্রাফিতির জনক হিসাবে অনেকেই ড্যারিল ম্যাকক্রে (‘কর্নব্রেড’)-কে বিবেচনা করেন। জনশ্রুতি আছে যে, কর্নব্রেড সিনথিয়া কাস্টাস নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে এবং তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যত্রতত্র ‘কর্নব্রেড লাভস সিনথিয়া’ লিখতে শুরু করে। এইরকম ‘গ্রাফিতি’ অবশ্য আমাদের দেশে টাকার গায়ে, গাছের গায়ে দেখা যায়।

কারো কাছে গ্রাফিতি হলো পাবলিক আর্টের একটি রূপ, যা ঐতিহ্যকে অব্যাহত রাখে, উদাহরণস্বরূপ, বৈশ্বিক মহামন্দার সময় মার্কিন ওয়ার্কস প্রোগ্রেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফেডারেল আর্ট প্রজেক্ট এবং মেক্সিকোতে ডিয়াগো রিভারার কাজের ম্যুরালগুলো। এই শিল্পীদের ম্যুরালগুলির মতো, গ্রাফিতির দুর্দান্ত কাজগুলি একটি প্রতিবেশীকে সুন্দর করতে পারে এবং একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের স্বার্থের কথা বলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক হিস্পানিক পাড়ায় গ্রাফিতি বেশ বিস্তৃত এবং অনেকে এটিকে শহুরে শিল্পের একটি রূপ হিসাবে বিবেচনা করে। এই ধরনের কাজ একটি উদ্ভাবনী শিল্প ফর্ম নাকি জনসাধারণের উপদ্রব এই প্রশ্নটি অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

গ্রাফিতি কুখ্যাতভাবে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে বিশ শতকের শেষের দিকে নিউইয়র্ক সিটিতে। ১৯৮০-এর দশকে নিউইয়র্কের শিল্পীরা যেমন কিথ হারিং এবং জিন-মিশেল বাস্কিয়েট তাদের গ্রাফিতির জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং শীর্ষ গ্যালারি দ্বারা প্রতিনিধিত্বকারী চিত্রশিল্পী হিসাবে এই স্বীকৃতিটিকে সফল ক্যারিয়ারে পরিণত করেছিলেন।

বেশিরভাগ বিচারব্যবস্থায় গ্রাফিতিকে ভাঙচুর হিসাবে নিষিদ্ধ করার আইন রয়েছে এবং কিছু দেশে শাস্তি বেশ কঠোর। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরে লঙ্ঘনকারীরা বেত্রাঘাতের সাপেক্ষে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে অনেক বিচারব্যবস্থা গ্রাফিতি নির্মূল এবং অপসারণের উপায় অনুসন্ধান করেছিল, এই ভয়ে যে এটি অন্য সম্প্রদায়ের অবজ্ঞার দিকে নিয়ে যাবে। প্রশমিতকরণ এবং অন্যান্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রচেষ্টার জন্য উল্লেখযোগ্য সংস্থান বরাদ্দ করা হয়েছিল, এবং কিছু শহর এমনকি শহুরে যুবকদের তাদের শৈল্পিক সৃজনশীলতা প্রকাশের জন্য আইনি সুযোগ প্রদানের জন্য ম্যুরাল প্রোগ্রাম বা ‘মুক্ত দেয়াল’ চালু করেছিল।

যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতি শিল্পী ব্যাঙ্কসি একদা বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে যদি লড়াইয়ের কোনো হাতিয়ারই না থাকে, তবে গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র অস্ত্র।’ বাংলাদেশে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলেনে শহরের দেয়ালগুলো বাঙ্কসির ভাষায় ‘সেই অস্ত্রে’ শাণিত এক বিপ্লবগাথাই হয়ে উঠেছিল। সাক্ষী হয়ে উঠেছিল উত্তাল গণআন্দোলনের এক উন্মুক্ত গ্যালারি হয়ে।

২.

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্টে ঘটে যাওয়া ছাত্রজনতার সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থান পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোড়ন তৈরি করেছে। এই গণঅভ্যুত্থানে গ্রাফিতি এত বেশি পরিমাণে ব্যবহার হয়েছে যে বলা যায় গ্রাফিতির বিপ্লব হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের এমন কোনো শহর-নগর পাওয়া যাবে না যেখানে গ্রাফিতি না করা হয়েছে। এইসব গ্রাফিতি জনমানসে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। আন্দোলনে একটা নতুন মাত্রা নিয়ে আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গ্রাফিতি নতুন ইতিহাস নির্মাণ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের পরেও গ্রাফিতি করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের আগে ও পরের গ্রাফিতি জনমানসের অভিব্যক্তিকে বিভিন্ন মাত্রায় হাজির করেছে। দেয়াললিখন বা চিকা থেকে বাংলাদেশের এই যে গ্রাফিতিতে উত্তরণ এটা মূলত ফ্যাসিস্ট সময়ের গর্ভজাত। জনগণের কথা বলার অধিকার বন্ধ না হয়ে গেলে এবং চিকা লেখার দেয়াল দখলে চলে না গেলে এই বিবর্তন হয়তো সহসা ঘটত না। ‘চিকা’ শব্দটা বাংলাদেশের দেয়ালচিত্রের রাজনৈতিক পরিভাষা। এখন যাদের জেন-জি বলা হচ্ছে, অনেকের কাছেই শব্দটা অপরিচিত। কারণ, তাদের বেড়ে ওঠার সময়ে তারা চিকা মারতে দেখেনি। ফ্যাসিস্ট আমলে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে লেখা দেয়াল তাদের সামনে কখনো পড়েনি।

এই গণআন্দোলনে গ্রাফিতির দুটি ধরন লক্ষ করা গেছে। একটি হলো, আন্দোলন চলাকালে একধরনের ইমার্জেন্সি অ্যাস্থেটিক বা আপৎকালীন নন্দন, যেটা অনেকটা যুদ্ধাবস্থায় খুব দ্রুত কিছু একটা এঁকে বা লিখে চলে যাওয়ার মতো ব্যাপার। এটাকে অনেকে হয়তো নন্দন বলতে চাইবে না, বা অ্যান্টিনন্দন বলবে; যাই বলা হোক এটা স্পষ্ট যে এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি হাজির করল। দ্বিতীয়টি হলো, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গ্রাফিতি। এই গ্রাফিতি হলো ভিন্ন ধাঁচের কারণ তখন তো ছাত্রজনতার জয় হয়েছে এবং স্বৈরাচার দেশ থেকে পালিয়েছে। যদিও এইসব গ্রাফিতিতে আগের কিছু ধরনধারণও উপস্থিত ছিল। ইতোমধ্যে যেহেতু বিজয় এসে গেছে এবং একটি নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে তাই এইসময়কার গ্রাফিতিকে ইমার্জেন্সি অ্যাস্থেটিকের মধ্যে ফেলা যাবে না। এবার তারা তাদের বক্তব্য পুরোপুরি তুলে ধরার সুযোগ পেল। তখন খুব স্পষ্টভাবে দেখা গেল ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতিনিরপেক্ষতা, সামাজিক ঐক্য ও রাষ্ট্রসংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্লোগান।

এই পর্বে এসে অবশ্য একটা বিতর্ক দেখা গেল। বিতর্কটা হলো আগের গ্রাফিতির ওপরে নতুন করে আরবি বা আরবি ক্যালিগ্রাফি লেখা নিয়ে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পমাধ্যমটি ইসলামি ভাবধারাসঞ্জাত। বরাবরের মতো ধর্মীয় কারণ বা ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানের আশঙ্কা থেকে ক্যালিগ্রাফি আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায় হয়ে রইল। বাংলাদেশের কথিত সুশীল সমাজের ভীড়ে এখানকার ক্যালিগ্রাফি চর্চা যা হয়েছে তা মূলত বইয়ের প্রচ্ছদে বা ক্যালেন্ডারে বা ক্যানভাসে বা ব্যক্তিগতভাবে। গণঅভ্যুত্থান যখন একটি নতুন স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে আসে তখন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ক্যালিগ্রাফির মধ্য দিয়ে দেয়ালে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। আর তখনই কথিত সুশীল সমাজের বুকে ধাক্কা এসে লাগে।

বাস্তবতা যে মানুষকে তার ভাষা ব্যবহারে পরিবর্তন এনে দেয় তার একটা বড় প্রমাণ হলো জুলাই ও জুলাই পরবর্তী ঢাকার দেয়াললিখন। আগে স্কুল বা কলেজের দেয়ালে নানা বাণী লেখা থাকত। এগুলো ছিলো চিরন্তন বাণী, যার বেশির ভাগ মূলত অরাজনৈতিক; কোনো সমকালীন ইস্যু সেখানে থাকত না। এখন সেখানে দেখা গেল নতুন স্লোগান যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক ও সমকালীন ইস্যুনির্ভর। এর মানে জুলাই একটা থ্রেসহোল্ড। এখন থেকে অনেক বিষয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ তৈরি হলো।

এই আন্দোলনের আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হলো গ্রাফিতিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ব্যাপক ও সরব উপস্থিতি।

ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাশের লম্বা দেয়ালে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে গ্রাফিতি করা হয়। এ বছরও হয়েছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারি পার হয়ে জুলাই আসতে না আসতেই কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। রংপুরে এক মিছিলে গুলি চালাল পুলিশ। শহিদ হলেন আবু সাঈদ। দুই হাত প্রসারিত করে যেভাবে সাঈদ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন তা জনতার কাছে একটা প্রতীক হয়ে উঠল।

সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনকে একটা নতুন মাত্রা এনে দিলো। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। বাড়তে লাগল শহিদের সংখ্যা। শহিদ মিনারে ডাকা হলো সমাবেশ। জনারণ্য হয়ে গেল পুরো শহিদ মিনার। আর শহিদ মিনারের আশপাশের দেয়ালগুলো, যেগুলো ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত নানা ছবি-লেখায় পূর্বেই ভর্তি ছিল, তা এবার ভরে উঠল ছাত্রজনতার সমস্ত রাগ-ক্ষোভ-যন্ত্রণার ভাষা হয়ে।

রক্তাক্ত সেই ভাষা, আপাত অশ্লীল বলে অভিহিত হতে পারে কিন্তু মনে রাখতে হবে যারা একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের বন্দুকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের স্বজনদের রক্তে লাল হয়ে উঠছে রাজপথ, তাদের কাছে তো নিরাপদে থাকা সুশীল সমাজের পলিটিকাল কারেক্টনেসের দাঁড়িপাল্লার কোনো মূল্যই নেই। নেই বলেই সে চারুকলা শিক্ষার্থীদের আঁকা ‘শৈল্পিক’ দেয়াললিখনের ওপর নির্দ্বিধায় লিখে দিতে পারছে—‘স্বৈরাচার ** না’। আর এর মধ্য দিয়েই ভেঙে যাচ্ছে হাই আর্ট-লো আর্টের মেকি দেয়াল। সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে ‘গ্রাফিতি’। নিরুপদ্রব-নিরীহ দেয়াললিখন নয়, যা মূলত ’৫২-এর একুশের সেই রক্তস্রোত, যা এই ২০২৪ পর্যন্ত প্রবাহিত; দেয়ালে দেয়ালে। তখন দেয়াল রাঙিয়ে ছিল তৎকালীন চারুকলা কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, তাঁদের ‘ভদ্র-মার্জিত-শিক্ষিত’ তুলিতে; এবার আপামর জনতা। তবে ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন ভাবে।

এই জেন-জি জেনারেশনের আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠল ‘গ্রাফিতি’। তাদের লেখার তুলি ও ‘স্প্রে ক্যান’, হ্যাশট্যাগ সহযোগে। বলাবাহুল্য, এ আন্দোলনের সঙ্গে ইন্টারনেটের লিংক আছে। এজন্যই হ্যাশট্যাগ। যাতে এটা বেয়ে এ আন্দোলনের আরও বিস্তৃত রূপ সকলের সামনে হাজির হয়। ইন্টারনেট জমানার আন্দোলনের এ এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

অনেকেই এই আন্দোলনের সাথে ২০১৩ সালে সংঘটিত শাহবাগের আন্দোলনের মিল খুঁজে পান। অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন। শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে এর বিস্তর ফারাক আছে। এ আন্দোলন নির্দিষ্ট কোনো স্থানকেন্দ্রিক বা নেতাকেন্দ্রিক ছিলো না। এই আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এর ভাষা। বাংলার পাশাপাশি ছিল ইংরেজি। ভদ্রকাব্যিক ভাষার জায়গায় ছিল রুক্ষতা ও কর্কশতা। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গালি হাজির হয়েছে সোজাসাপটা। এই গালিও ছিল বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে। তথাকথিত ভদ্র-মার্জিত হওয়ার দায় ছিল না। না থাকার কারণ, এই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত। রাজনৈতিক লিগ্যাসি থেকে নয় কিংবা বিপ্লব সংগঠিত করার কোনো স্বপ্ন থেকেও নয়।

৩.

এটা তো সর্বস্বীকৃত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হলেও তার ভ্রূণ তৈরি হয়েছিল ১৯৫২-তে। বাংলাদেশের দেয়াললিখনের ইতিহাসও ১৯৫২ থেকে শুরু। কিন্তু গ্রাফিতির ইতিহাস একটু আলাদা। এখানকার প্রথম আলোচিত গ্রাফিতি : ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’। জানা যায়, আশির দশকের এই আইজুদ্দিন ছিলেন একজন ‘অশিক্ষিত’ রিকশাচালক। রিকশার সিটের নিচের বক্সে থাকত লেখার সরঞ্জাম। সময়-সুযোগ আর খালি দেয়াল পেলে লিখে দিতেন তার কথাটি। তার এই কথা তখন অনেকের মনের কথা হয়ে উঠেছিল। ‘ফরমাল’ গ্রাফিতি হয়তো সেটা নয় কিন্তু গ্রাফিতিই। সেই মানুষটাই আরো পরে ‘শিক্ষিত’ হয়ে ‘সুবোধ’ হিসেবে ফিরে আসে। ফিরে আসে ‘ফরমাল’ গ্রাফিতি হয়ে। ফরমাল বলার কারণ এই যে, ‘গ্রাফিতি’ টার্ম দিয়ে আমরা যা বুঝি, বা যেরকম গ্রাফিতি আমরা দেখতে চাই, ‘সুবোধ’ ছিল তার একটা আদর্শ রূপ। এর ফলে সুবোধ খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এবং বলা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে পপুলার গ্রাফিতিও এই সুবোধ।

এই সুবোধ আইজুদ্দিনের মতো অতটা ‘অশিক্ষিত’ না। তাছাড়া ততদিনে দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। সুবোধ বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও বলেছে। আরো কাব্যিক, আরো মার্জিত ভাষাতে; ‘হবে কি’ ট্যাগলাইনে। সুবোধের যেই বেশ—পরনে প্যান্ট, ঝাকরা চুল, হাতে খাঁচা, খাঁচায় সূর্য—সবটাই বাঙালি মধ্যবিত্ত চিত্তে দোলা দিয়েছে। এইরকম ‘পাগল’ বা ‘বিবেক’ চরিত্র আমাদের নাটক বা যাত্রাপালায় বেশ পরিচিত আর এই ‘সুবোধ’ও তারই চিত্রায়িত রূপ।

এই অভ্যুত্থানে যে গ্রাফিতি হয়েছে তার অন্য আর একটা উজ্জ্বল দিক আছে। দিকটা হচ্ছে তার বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি। এই বৈচিত্র্য দাবির বৈচিত্র্য। আন্দোলন যতই অভ্যুত্থানের দিকে এগিয়েছে, ততই সে সমাজের সবার দাবিকে ধারণ করতে করতেই এগোনোর চেষ্টা করেছে। ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা যেমন উঠেছে, তেমনই জাতিগত নিপীড়নের কথাও তুলে ধরেছে। কথা উঠেছে পাহাড়ে আদিবাসী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও। এই অভ্যুত্থান ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক অপহৃত নারী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে ভোলেনি। একটা গ্রাফিতিতে বাংলায় লেখা হয়েছে ‘কল্পনা চাকমা কোথায়?’ নিচে চাকমা ভাষায় একই প্রশ্ন। সম্ভবত ঢাকা শহরে এই প্রথম চাকমা ভাষায় কোনো প্রশ্ন তোলা হলো।

ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর থেকে বাংলাদেশের দেয়ালগুলি হয়ে ওঠে একেকটা ক্যানভাস। যে যার মতো করে এঁকে যাচ্ছে, লিখে যাচ্ছে বিজয়ের আনন্দ। বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা হিপহপ কালচারের এক ভাষা হয়ে উঠছে গ্রাফিতি।

গ্রাফিতি যে সবসময় রাজনৈতিক ইস্যু বা বিপ্লবী ভাবনা নিয়ে আঁকা হয় তা না। তবে গ্রাফিতির মূল উপজীব্য সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়কে নিয়েই। একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অসাম্য আর অত্যাচারের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে যুক্ত হয়েছিল গ্রাফিতি এবং পোস্টার। সেই সময়ে শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা বেশকিছু পোস্টার জনমনে খুব প্রাণসঞ্চার করে। এমন একটি পোস্টারে আঁকা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়ার মুখের সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক ছবি এবং সঙ্গে লেখা ছিল : ‘এই রক্তখেকো জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ পোস্টারের পাশাপাশি তার আঁকা বেশকিছু দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতিও আলোড়ন তৈরি করেছিল। সবাইকে জানান দিচ্ছিল এ রক্তখেকোদের হটাতে হবে। স্বাধীন করতে হবে বাংলাকে।

’রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে অভ্যুত্থান এসে থেমেছে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে। মাঝে পেরিয়ে গেছে ৭০ বছরের বেশি সময়। বদলে গেছে বিপ্লবের বাণী, মিছিলের স্লোগান, আন্দোলনের দাবি আর অভ্যুত্থানের ভাষা। বাংলাদেশে যে কয়টি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে প্রায় সবকটিতেই ছাত্রসমাজের বিস্তার এবং প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বেশিরভাগ অভ্যুত্থানের শুরুতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ দাবিকে শাসকরা তোয়াক্কা না করে বরং ডেকে এনেছে তাদের পতন, অন্যদিকে জন্ম নিয়েছে ইতিহাসের একেকটি নতুন অধ্যায়।

এবারের গণঅভ্যুত্থানে নিজের আবেগকে প্রকাশ করতে এবং বিপ্লবের ভাষাকে বোঝাতে সামাজিক গণমাধ্যমে মিম এবং কার্টুন এবং শহরের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে নতুন এক হাতিয়ার। দিনকে দিন গ্রাফিতি সর্বজনীন হয়ে উঠছে। এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গ্রাফিতি দেশের বিপ্লবের সঙ্গে একই সুতায় গাঁথা হয়ে গেল। গ্রাফিতির স্লোগান,  ফেসবুকের মিম বা কার্টুন সবই একেকটি বিপ্লবের ভাষায় রূপ নিয়েছে। ভাষা যে কেবল বাকযন্ত্রনিঃসৃত ধ্বনি নয়, বরং চিত্রকলাও যে একরকমের ভাষা সেটির প্রমাণ এসব গ্রাফিতি।

শিক্ষার্থীদের আঁকা এসব গ্রাফিতি ছিল সার্কাজম এবং আয়রনিতে ভরপুর। রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘুণে খাওয়া জায়গাগুলো নিয়ে সোজাসাপটা বিদ্রুপ করেছে তারা।

কবিরাও এবার এগিয়ে এসেছে তাদের লেখনীর মধ্য দিয়ে; কবিদের মধ্যে হাসান রোবায়েতের কথা স্মরণ করতে হয়। রোবায়েতের অনেক কবিতা বা উক্তি দেয়ালে দেয়ালে শোভিত হয়েছে।

২০১০ সালে ফ্যাসিজমের ওপর মার্কিন লেখক জেসন স্ট্যানলির লেখা ‘হাউ ফ্যাসিজম ওয়ার্কস’ বইতে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট সরকার সবসময় পৌরাণিক অতীতকে নিজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণের আবেগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে নিজের মনোপলি ব্যবসায় পরিণত করে এবং অতীতের সেই ঘটনাকে পুঁজি করে চেতনার ব্যবসা শুরু করে। আওয়ামী লীগও সেই ‘চেতনাব্যবসা’ করেছিল। তাদের পুঁজি ছিল মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরোধিতা। শুধু আওয়ামী লীগ না, বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নিজেদের সোনালি অতীত নিয়ে এত বেশি স্মৃতিকাতর থাকে যে বর্তমানের যেকোনো সমস্যাকে সমাধান না করে অতীতের সুখস্মৃতিকে পুঁজি বানিয়ে সেটি কাটিয়ে যেতে চায়।

কোটা সংস্কার থেকে এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ পর্যন্ত কয়েক সপ্তাহের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ইতিহাস এই দেয়াল। হত্যা ও প্রতিরোধ, আশাবাদ ও সংকল্প—কী নেই সেখানে। যখন আক্ষরিক অর্থেই কেউ কথা বলতে পারছিল না, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লোকজনকে, ভয়ভীতির সেই সময় সাহস জুগিয়েছে এই দেয়াল।

এই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা পরিণত হয়েছিল গ্রাফিতি, দেয়াললিখন আর ক্যালিগ্রাফির নগরীতে। এর আগে কখনোই ঢাকার দেয়াল এত রঙিন রূপ ধারণ করেনি। শুধু নান্দনিকতার বিচারেই নয়, গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনের বক্তব্যে যে রাজনৈতিকতা ফুটে উঠেছে, তার তাৎপর্য অপরিসীম। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত হতে শুরু করেছে। তরুণ শিক্ষার্থীদের হাত দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই যেন দেয়ালে দেয়ালে ব্যক্ত হচ্ছে। সারা ঢাকা শহরের দেয়াল বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যে ছেয়ে গেছে।

গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন স্পষ্টতই প্রমাণ করছে, বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চৈতন্য, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর চৈতন্যের স্তরকে ছাপিয়ে বহুগুণ এগিয়ে গেছে। দেয়াললিখনগুলোর বক্তব্যে প্রধানত ধরা পড়েছে পরিবর্তনেরই আকাঙক্ষা। পাশাপাশি আছে তীব্র স্বৈরাচারবিরোধী সেন্টিমেন্ট। আছে স্বাধীনতার অনুভূতি। জনগণ, স্বাধীনতা, সংস্কার, পুনর্গঠন, অসাম্প্রদায়িকতা, বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি, বাকস্বাধীনতা, নির্বতনমূলক আইনের বিরোধিতা—ঘুরেফিরে এই বর্গগুলোই ছিল গ্রাফিতিগুলোর প্রধান বিষয়। এর মধ্যে ‘জনগণ’ বর্গটি ভালোভাবে নজরে পড়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জটিল বই পড়ে জনগণের এই চৈতন্য তৈরি হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব অভিঘাতে জনগণের রাজনৈতিক চৈতন্য রাতারাতি অনেক এগিয়ে গেছে।

‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনব’—ঢাকার বেশ কয়েকটি অঞ্চলের দেয়ালে এ বক্তব্য দেখা গেছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার প্রশ্ন আসছে কেন? বাংলাদেশ তো বহিঃশক্তির দ্বারা আক্রান্ত ছিল না। তবু হাসিনার আমলের শাসনের ধরনটাই এমন ছিল, জনগণের মধ্যে পরাধীনতার বোধ প্রবলভাবে দানা বেঁধেছিল। গুম, খুন, ক্রসফায়ার, বাকস্বাধীনতা হরণ, সংবাদপত্রের ওপর কড়া সেন্সরশিপ কায়েমের মাধ্যমে ত্রাসের এক রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। তাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনাশাহির পতন সংগত কারণেই স্বাধীন হওয়ার অনুভুতি তৈরি করেছে।

কোনো কোনো দেয়ালে ‘বাংলাদেশ ২.০’ লেখা রয়েছে, যেন একটা নতুন শুরু। এই মর্মেই ‘সংস্কার’ বর্গটি দেয়ালে দেয়ালে রাষ্ট্র হয়ে গেছে! স্বাধীনতা অর্জনই যে কর্তব্য শেষ নয়, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোরও যে সংস্কার ও পুনর্গঠন দরকার—এই ঐতিহাসিক চৈতন্য সমাজে হাজির রয়েছে। গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।

পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে বা দেশে দেশে গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে বা আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে গ্রাফিতি সবসময় একটি ভাষা হয়ে উঠেছে। আমাদের এইসব গ্রাফিতিতেও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি এসেছে। দেশে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জাতিসংঘের নীরবতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে তেমনই গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়েও কথা হয়েছে। মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের প্রতি আমাদের ঐক্য ও ভালোবাসার কথা উঠে এসেছে। ‘ফ্রম গাজা টু ঢাকা জাস্টিস মাস্ট বি সার্ভড’ বা ‘গাজা থেকে ঢাকায় ইনসাফ দিতে হবে’ কিংবা ‘ফ্রম ঢাকা টু গাজা, লং লিভ দ্য ইন্তিফাদা’ বা ‘ঢাকা থেকে গাজায় ইন্তিফাদা জারি থাক’ ইত্যাদি। এই গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসনের সঙ্গে আমাদের তারুণ্য যে নিজেদের সম্পর্কিত করছে বা বাংলাদেশের প্রতি ইন্ডিয়ার আধিপত্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে আমাদের তরুণদের যে সোচ্চার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে নিঃসন্দেহে তা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের রাজনীতিতে তা একটি ব্যাপক তাৎপর্য তৈরি করবে।

২০২৪ সালে সংঘটিত ছাত্রজনতার এই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে দেশের এমন কোনো শহর পাওয়া যাবে না যেখানে গ্রাফিতি করা হয়নি। তরুণরা দেয়ালে দেয়ালে নিজেদের আকুতি ব্যক্ত করেছে; স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা বলেছে। এইসব গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনে ফুটে উঠেছে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকল্পের পরিষ্কার রূপরেখা। সেই সাথে এটাও পরিষ্কার হয়ে উঠল যে, এখন থেকে আমাদের যেকোনো ন্যায্য অধিকার আদায়ে গ্রাফিতি হয়ে উঠবে একটি জনভাষা; হয়ে উঠবে সংগ্রামের একটি হাতিয়ার।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷