মহাভারতের শুরুতেই অনার্য একলব্যের নিকট দ্রোণাচার্যের গুরুদক্ষিণা দাবির মুহূর্তকে উভয় সংকটের এক অনন্য মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা যায়। একলব্যের গুরুদক্ষিণা ছিল নিজ আঙুল কেটে, গুরু দ্রোণের হাতে তুলে দেওয়া; যাতে পাণ্ডু-পুত্র অর্জুনের চেয়ে জগতে আর কেউ অগ্রগামী না হতে পারে—তা নিশ্চিত করা যায়। মহাভারতের একলব্যের সঙ্গে গুরু দ্রোণাচার্যের এই ‘উভয় সংকট’ মুহূর্তের তুলনা হতে পারে উপনিবেশি জামানায় ভারতীয় মুসলিমদের গরু কোরবানি প্রসঙ্গে আন্তঃবাহাস। বাংলাদেশের বিদ্যায়তন বা বিদ্যায়তনের বাইরে ‘গরু কোরবানি’ সংক্রান্ত যে বয়ান নজরে আসে তা মোটাদাগে গুটিকয়েক শব্দে বাক্সবন্দি করা যায়। ভারতীয় রাষ্ট্রের চলমান দশাকে আমলে নিয়ে বিশেষত মার্ক্সীয়-উদারনীতিবাদী ইতিহাস ব্যবসায়ী মহাজনেরা ‘গো রক্ষা’ বা ‘গো-কুরবানি’ এই ফেনোমেনাকে একই মুদ্রার এপিট-ওপিট বলে বর্গায়ন করে। তাই উক্ত মার্ক্সীয়-উদারনীতিবাদী ইতিহাস ব্যবসায়ী মহাজনদের তহবিলে সাম্প্রদায়িকতা, মুসলিম জাতিবাদী, পরিচয়বাদি, শতাংশবাদী মাস্তানি, হিন্দু বা ইসলামো ফ্যাসিবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দ জমা থাকে; যা নিউ মিডিয়ার জনপরিসরে অবদমিত রুপের প্রকাশ হিসাবে হাজির হয়। মার্ক্সীয় ইতিহাসবীক্ষায় ধর্মের পর্যালোচনা বা আইডেন্টিটি সংক্রান্ত বোঝাপড়া যে খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ বা বিচ্ছিন্ন তা উপরিউক্ত প্রতিক্রিয়া হতে শনাক্ত করা যায় বৈকি। অপরদিকে, গরু খাওয়া আন্দোলনের নাম দিয়ে শুধুই ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি’ বা ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ করবার প্রস্তাবনা অপরিপক্বতা-প্রতিক্রিয়ার দলিল হিসাবে হাজিরা দেয়। সকলের গরুর অবয়বে (appearance) নজর। মর্ম (essence) তলবের সন্ধান করতে আগ্রহ শূন্যের কোটায়। এই নিবন্ধের মোড়কে নোকতায়, উপনিবেশি ভারতে বিশেষত খিলাফত আন্দোলনকালীন গরু কোরবানি প্রসঙ্গে আন্তঃমুসলিম বাহাসের মর্মের সন্ধান করা হবে। নিবন্ধরুপী নোকতাজুড়ে রাজনৈতিক ঐক্য, অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব, আইডেন্টিটি এন্ড ডিফারেন্স, রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্ন উঁকি দিবে। উপনিবেশি ভারতে গরু কোরবানির বাহাসের উছিলায় আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে বা সাম্য-মানবিক মর্যাদা ভিত্তিক আধুনিক রিপাবলিকের আইনি বর্গের সঙ্গে গরু কোরবানির প্রাসঙ্গিকতার দিকে নজর দেওয়া অন্যতম বাসনা।
খিলাফত আন্দোলনকালীন জমিয়ত-ই-উলামায়ে হিন্দের পক্ষ হতে প্রস্তাব করা হয় যে, খিলাফত রক্ষা করতে অমুসলিমের (হিন্দু) সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করতে হবে। এই রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতিজ্ঞা হচ্ছে গরু কোরবানি বাদ দেওয়া। যেহেতু রাজনৈতিক ঐক্য হচ্ছে হিন্দুদের (গান্ধী ও কংগ্রেস) সঙ্গে, তাই গরু কোরবানি হতে বিরত থাকলে ঐক্যের মধ্য দিয়ে খিলাফত ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যাবে। জমিয়ত-ই-উলামায়ে হিন্দ গান্ধী ও কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করতে গরু কোরবানি না করতে উৎসাহ দেয়। ফলে, হাজির হয় ফতোয়া। জমিয়ত-ই-উলামায়ে হিন্দের মতে, গরু কোরবানি ওয়াজিব নয়। মুবাহ। গরুর স্থলে বকরি বা উট কোরবানি করলেও একই কথা। খিলাফতের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইসলাম ও মুসলিমদের দিক হতে অগ্রাধিকার পায়, তাই গরু কোরবানি বাদ দিয়ে খিলাফত রক্ষা করা প্রধান এবং একমাত্র কাজ।
অন্য দিকে, ঐতিহ্যবাহী বেরেলভি আলেম আহমদ রেজা খান গরু কোরবানির এই অবস্থানের বিপক্ষে মত হাজির করেন তার “আনফুসুল ফিকর ফি কুরবানিল বকর” কিতাবে। বাহাসের গভীরে যাবার আগে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করছি যে, উক্ত বাহাসকে প্রো-কলোনিয়াল বনাম এন্টি-কলোনিয়াল বর্গে ফেলে বুঝা যাবে না। হারিয়ে যাবে মর্ম, রয়ে যাবে অবয়ব। যেহেতু আহমদ রেজা খানের চিন্তায় ব্রিটিশ শাসন, জমিয়ত-ই-উলামায়ে হিন্দের চেয়ে বেশ দূরের ছিল তাই পূর্বানুমানের ফাঁদ হতে বের হওয়া পাঠের জন্য সুখকর হবে। ঐতিহাসিক রোহিত দে দেখান ব্রিটিশ আর্মি ছিল গরুর মাংসের বাজারের প্রধান ভোক্তা। ব্রিটিশ শাসনে কলিকাতার হিন্দু এতিহ্যবিরোধী আধুনিক ইয়াং বেঙ্গলের গরু খাওয়াকেও আমলে নিতে পারি। এন্টি-কলোনিয়াল ছকে দেখলে মনে হবে, গরুর মাংস খাওয়া একটা প্রো-কলোনিয়াল ব্যাপার বা না খাওয়া এন্টি-কলোনিয়াল সিদ্ধান্ত। এই সরলীকরণ হতে মুক্ত হয়েই এগোতে হবে। মুরাদাবাদ হতে গরু কোরবানি প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে আহমদ রেজা খান বলেন, উপনিবেশি ভারতীয় বাস্তবতায় গরু কোরবানি মুবাহ নয়, বরং ওয়াজিব। খান বলেন একমাত্র গরু কোরবানিই অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের পার্থক্য (Shi ‘ar i Islam) করে। খান বলেন, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় নারীরা মসজিদে নামাজে যেতেন। কিন্তু তার ওফাতের পরে ফিতনার জন্য মসজিদে না যাবার তাগিদে ফিকহি শর্ত তৈরি হয়। তদ্রূপ একইভাবে উপনিবেশি ভারতের চাহিদার তাগিদে গরু কোরবানি ওয়াজিব হবে। খান, ওয়াজিবের পক্ষে কুরআন, সুন্নাহ, ফিকহ ইত্যাদির আশ্রয় নেয়। কুরআনের সুরা হাজ্জের ৩৬ নাম্বার আয়াত ও সিয়াহ সিত্তায় আয়েশা রা. হতে হাদিস সামনে এনে দেখান ইসলামের আইনি বর্গে গরু কোরবানি ওয়াজিব। এরপর আহমদ রেজা খান কামান দাগান জমিয়ত-ই-উলামায়ে হিন্দের গরু কোরবানি না দেওয়ার বিরুদ্ধে। খান বলেন, গান্ধী ও কংগ্রেসের চাপে রাজনৈতিক ঐক্যের বাহানায় গরু কোরবানি বন্ধ করা ইসলামের অসম্মান। খান আরও তীব্র ভাষায় বলেন, আমাদের শারিয়া আমাদের অসম্মান সহ্য করে না। খান জমিয়ত-ই-উলামায়ে হিন্দকে আক্রমণ করে বলেন, যারা ইসলামের শত্রুকে বন্ধু বানায় তারা নিজেরাও ইসলামের শত্রু এবং তারা আখিরাতে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে থাকবে।
খান ইসলামি আইন কাঠামো হতে বৈধতা হাজির করে ব্রিটিশ কলোনিয়াল আইন কাঠামোর ফায়দা নিলেন। খান প্রশ্ন করলেন, বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা কই? খানের এই আইনি পদক্ষেপকে মনে হতে পারে অনুগত নেক নাগরিক। কিন্তু খানের এই আইনি বোঝাপড়া লিবারেল গুড সিটিজেন দিয়ে বুঝা যায় না। কলোনিয়াল বাস্তবতায় সভ্রেনটির ক্রাইসিসকালীন খানের এই অবস্থান শের আলি তারিন “Imperial Muslim political Sovereignty” হিসাবে চিহ্নিত করেন। খানের এই অবস্থান মুলত ইসলামের ক্ষমতা ও জনপরিসরে ইসলামের সম্মানকে অগ্রাধিকার দেয়। খান কলোনিয়াল পাওয়ারের নেগোসিয়েশনে লিবারেল-সেক্যুলার রেটোরিক ব্যবহার করলেও, তা মর্মগতভাবে সেক্যুলারদের ধর্ম তৈরি প্রকল্প নয়। খান, পলিটিক্যাল রিয়ালিজম বা রাজনৈতিক বাস্তববাদ উপেক্ষা করে বলেন গরু কোরবানির বিকল্প নাই। বকরি বা উট কোরবানি দেওয়া ব্যয়সাপেক্ষ, তাছাড়া গরিব মুসলিমদের প্রোটিন সম্যসা, গরুর চামড়া হতে উৎপাদিত পণ্য, বাজার, ব্যবসা ইত্যাদি হাজির করেন। খান তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ নোকতা হাজির করেন। রামায়ণ, মহাভারতে কৃঞ্চ, রাম, লক্ষণ যে হরিণ বা বন গরু শিকার করত বা বেদসহ অন্যান্য পুরাণে ইন্দ্রের ২০-২১টি ষাড় ভক্ষণ তুলে ধরেন।
মাওলানা আহমদ রেজা খানের মোকাবিলায় জমিয়ত-ই-উলামায়ে ইসলামের পক্ষ হতে হাজির হোন মাওলানা আব্দুল বারী ফারিঙগী মহলি। মাওলানা আব্দুল বারী ফারিঙগী মহলির বিভিন্ন বক্তৃতায় তা ফুটে ওঠে। আব্দুল বারী শুরুতেই খানের সঙ্গে একমত হন যে, কোনো চাপে গরু কোরবানি হতে বিরত থাকলে তা ওয়াজিবই। আব্দুল বারী শুরুতেই বলে নেন, তিনি নতুন ফতোয়া দিবেন না বা কোন ফতোয়ার জবাব দিবেন না। বরং আব্দুল বারী প্রস্তাব দিতে আগ্রহী। সেই প্রস্তাবনার মাকসাদ হলো মানবকল্যাণ। আব্দুল বারী বলেন, মুসলিমদের সাথে অসমুসলিমদের ফারাক হলো খিলাফত, গরু নয়। হিন্দুদের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য হলে সেই খিলাফত রক্ষা হবে। এমত অবস্থায় গরু কোরবানি অগ্রাধিকার পাবে নাকি খিলাফত? আব্দুল বারি আহমেদ রেজা খানের ফতোয়ার বুনিয়াদি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাই তিনি বলেন, গান্ধী বা হিন্দুরা যদি আমাকে বা মুসলিমদের চাপ দেয় গরু কোরবানি বা গরু মাংস খেতে বিরত থাকতে, তাহলে আমি অবশ্যই গরু কোরবানি করব। আব্দুল বারী উম্মিদ রাখে, তার হিন্দু বন্ধুরা এ কাজ করবে না। আব্দুল বারী এরপরেই বলেন, আল্লাহর জন্য উৎসর্গ তো সেটাই যা সবচেয়ে দামি ও সুন্দর। আব্দুল বারী প্রস্তাব করে, একজন মুসলিম থেকেও হিন্দুর সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে। হিন্দুদের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য করবার মধ্যে দিয়ে খিলাফতের সভ্রেনটি রক্ষা তার মুল প্রস্তাব। গান্ধী যখন আব্দুল বারী ফারিঙগী মহলির লখনৌর বাড়িতে যায় তখন তার অবস্থানকালীন গরুর মাংস রান্না হয়নি৷ আব্দুল বারী গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকে শক্ত করতে পণ্য বয়কট করাকে জেহাদ বলে উল্লেখ করেন।
আহমদ রেজা খান বেরেলভি ও মাওলানা আব্দুল বারী ফারিঙগী মহলির এই বাহাসে খান গুরুত্ব দিচ্ছেন আইডেন্টিটি প্রশ্নে, অপরদিকে আব্দুল বারী গুরুত্ব দিচ্ছেন বন্ধুত্বের ধারণায়। ক্রাইসিস অফ সভ্রেনটিতে খান ইসলামের ক্ষমতার অনুসন্ধান করেন, যা রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের পাটাতনে ইম্পেরিয়াল মুসলিম সভ্রেনটি তৈরি করে। খানের গো কোরবানির পক্ষের অবস্থান মুসলিম আত্মচৈতন্য, তার রাজনৈতিকতা ও কর্তা আকারে হাজিরা দেয় পাকিস্তান আন্দোলনে। অপরদিকে, আব্দুল বারীর চিন্তায় যে বন্ধুত্ব তা আধুনিক ভারতীয় মুসলিম নাগরিক রুপে হাজির হয়। খানের এই আইডেন্টিটি এন্ড ডিফারেন্স বা রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী দোস্তি-দুশমনি ভেদ গুরুত্বপূর্ণ শনাক্তি। আব্দুল বারীর রাজনৈতিক ঐক্য বা বন্ধুত্ব–এর প্রস্তাবনা বির্মূত রয়ে গেল, যা ভারতীয় বাস্তবতায় আখলাককে গরুর মাংসের উছিলায় পিটিয়ে খুন করা হতে বুঝা যায়।
আব্দুল বারী বা জমিয়ত-ই-উলামায়ে হিন্দের বন্ধুত্বের রিপাবলিক কেন আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্র হলো না? এই উত্তর যথেষ্ট সচেতনভাবে দিয়েছেন পার্থ চ্যাটার্জি। পার্থ চ্যাটার্জি বলেন আধুনিক ভারত রাষ্ট্র হিন্দু জাতীয়বাদী বুনিয়াদেই দাঁড়িয়ে। জমিয়তের বন্ধুত্বের আধুনিক রিপাবলিক সেখানে সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হয়েও যায় তা হবে সেক্যুলার উসুলে৷ নৃতত্ত্ববিদ তানজিন দোহান দেখান, ভারত রাষ্ট্র হিসেবেই ফ্যাসিবাদী। বিজেপি বা মোদি শুধু ফ্যাসিবাদী রুপের কাপড় সড়িয়ে দিয়েছে৷ দোহা এটাকে বলছেন Revealing Signifier। ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ফ্যাসিবাদী মূলত ইন্ডিক থটের কারণে। দোহা বলেন, ইন্ডিক থট অন্তর্ভুক্তিমূলক, ইউনিভার্সল। দোহা বলেন, এই ইউনিভার্সলইজম মুলত ফ্যাসিস্ট। ইন্ডিক থট ইসলামকে সরাসরি নিতে পারে না। তাই সে প্রথমে ইসলামকে ডিজ-আর্টিকুলেট করে, তারপর ইনক্লুড করে। এই প্রক্রিয়াকে আমি বলি ইন্ডিক থটের খোজাকরণের রাজনীতি। আজকের বাস্তবতায় গরু কুরবানি বা গরুর গোশত খাওয়ার সঙ্গে যে আধুনিক রাষ্ট্র, আইন, ক্ষমতার শেকড় জড়িয়ে আছে তা এড়িয়ে গেলে ইতিহাসের খণ্ডিত পাঠ হবে। ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ নামক আজিব সেক্যুলার চিজে একিন রেখে সাম্য-মানবিক মর্যাদাভিত্তিক আধুনিক রিপাবলিকে মুসলিম সত্তার খোজাকরণ করে নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার রক্ষাকে প্রাধান্য দিবেন? নাকি এমন কোনো রাজনৈতিক গঠনে শ্রম নিয়োগ করবেন, যেখানে মুসলিম সত্তা ও আধুনিক নাগরিক সত্তা পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক! ইতিহাসের নিকট প্রশ্ন করলে জবাব দেয় “ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার?”