খ্রিস্টীয় জায়নবাদ বা ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানিটি ও ইহুদি রাষ্ট্র

জগলুল আসাদ

ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের জন্মের এক সুবিশাল ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। উচ্ছেদ ও দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইউরোপীয় উপনিবেশিক লিগ্যাসি। আবার, ইউরোপে জাতি ও জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ না ঘটলে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। বিশেষ কিছু অভিন্নসূত্র ধরে নিজেদেরকে জাতি মনে করা এবং সেই জাতির সমস্যা দূর করতে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের চেতনা ও সেই জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র গড়বার ইচ্ছে একটা আধুনিক প্রবণতা, যা মূলত ইউরোপীয় ।  ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে যা ইহুদি সমস্যা নামে পরিচিত ছিল, তা-ও  রাজনৈতিক জায়নবাদের উত্থানের অন্যতম কারণ। থিয়োডোর হার্জল ইহুদিদেরকে একটি জাতি বলে গণ্য করে ১৮৯৬ সালে ইউরোপীয় ইহুদিদের সমস্যা দূরীকরণের একমাত্র টেকসই উপায় হিসেবে ইহুদি-রাষ্ট্র গঠনের বিশদ প্রস্তাব করেন তার দ্য জুইশ স্টেইট (Der Judenstaat) বইটিতে।

মনে রাখতে হবে, ‘ইহুদি সমস্যা’ ইউরোপীয় খ্রিস্টান-প্রধান দেশগুলোর ফেনোমেনন, যার সাথে প্রাচ্যে, বিশেষত মুসলিম অঞ্চলসমূহে বসবাসরত ইহুদিদের সম্পর্ক নাই বললেই চলে। মুসলিম শাসনে ইহুদিরা ‘আহলে কিতাব’ বা ‘পিপল অব দ্য বুক’ হিসেবে বিবেচিত হতো। এবং অনেক ইহুদিই ইউরোপীয় মধ্যযুগে মুসলিম ভূমিতে আবাস ও আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল বলে সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণাদি আছে। বিশেষত মুসলিম শাসনামলে ‘আন্দালুসিয়া’তে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক সহাবস্থান স্মরণযোগ্য। ইরাকি বংশোদ্ভূত ইসরাইলি-ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আভি শ্লাইম, যিনি রিভিশনিস্ট ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান, তিনি তাঁর Three Worlds : Memoirs of an Arab-Jew বইতে লেখেন : “ইরাকে কোনো ‘ইহুদি সমস্যা’ (Jewish problem) ছিল না। ইহুদি সমস্যা ছিল ইউরোপের। আমি ১৯৪৫ সালে বাগদাদের এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আমরা ছিলাম আরব ইহুদি। আমাদের সংস্কৃতি ছিল আরব সংস্কৃতি। আমরা বাড়িতে আরবিতে কথা বলতাম। আমাদের বন্ধুরা ছিল আরব। ইরাকের ইহুদিরা ‘ঘেটো’তে বসবাস করত না। তারা সর্বত্রই বসবাস করত। আধুনিক ইরাকের গঠনে ইহুদিদের ভূমিকা ছিল। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতা সর্বপর্যায়ে তাদের ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের গঠন সব পরিবর্তন করে দেয়।”

হার্জল ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের কারণ হিসেবে ইহুদিদের ডায়াস্পরিক অস্তিত্ব, ইউরোপে তাদের সংখ্যালঘুত্ব, ইহুদি-বিদ্বেষ ও ইউরোপীয় সমাজে তাদের এসিমিলেশন বা ইন্টিগ্রেশনের ব্যর্থতা বা অসম্ভাব্যতাকে উল্লেখ করেন, এবং  দাবি করেন, এই সব সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে ইহুদি-রাষ্ট্র গঠনে। রাষ্ট্রটি কোথায় হবে এই বিষয়টি তিনি উন্মুক্ত রাখেন, যদিও এই বইয়ের  “আর্জেটিনা নাকি ফিলিস্তিন” এই ছোট্ট অনুচ্ছেদে হয় আর্জেটিনা না হয় ফিলিস্তিনে এই রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে বলে প্রস্তাব করেন । তবে তিনি বলেন এই রাষ্ট্র হতে পারে “any corner of the globe”, ‘ইহুদি-সমস্যা’ সমাধানের সমস্ত বিকল্প তিনি আলোচনা করে ইহুদি-রাষ্ট্রই একমাত্র সমাধান এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তবে, ইহুদি রাষ্ট্র-গঠনে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কারণে প্যালেস্টাইনের ভূমিকেই তিনি অগ্রগণ্য মনে করেন। হার্জলকে রাজনৈতিক জায়নবাদের জনক মনে করা হয়। যদিও জায়নবাদ বা জায়োনিজম শব্দবন্ধটি প্রথম তৈরি করেন নাথান বার্নবম ১৮৯২ সালে, তখন তিনি ভিয়েনাতে ছাত্র ছিলেন। ১৮৯৩ সালে বার্নবম একটা পুস্তিকা রচনা করেন The National rebirth of Jewish people in its Homeland as a means of solving the Jewish problem নামে, যেখানে তিনি ইহুদিদের জাতিগত পরিচয়ের উপর গুরুত্ব দেন এবং ‘হোমল্যান্ড’ গঠনের অত্যাবশ্যকীয়তা বর্ণনা করেন। তারপর, রাষ্ট্রগঠনের ও গঠিতরাষ্ট্রের রূপরেখা বর্ণনা করে হার্জল তার বইটি লিখেন। ১৮৯৭ সালে হার্জল জার্মানির বাসলে প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেস আহ্বান করেন এবং বার্নবম ও তিনি মিলে ইহুদিদের নিজস্ব সার্বভৌম আবাস গঠনের গভীর আকুতি প্রকাশ করেন। এখানে, মনে রাখা দরকার, যারাই জায়নবাদের ইতিহাস লিখেছেন, প্রায় সবাই ব্যতিক্রমহীনভাবে জায়নবাদ ও ইহুদিবাদকে আলাদা রেখেছেন। যেমন, Allan Hart এর  Zionism : The Real Enemy of The Jews, David Engel  এর  Zionism : A Short History of a big Idea, Judith Butler রচিত Parting Ways : Jewishness and the critique of Zionism, Jacqueline Rose এর লেখা The Question of Zion ইত্যাদি বইতে জুডাইজম ও জায়োনিজমকে আলদা করা হয়েছে। জুডাইজম ও জায়নবাদের মধ্যকার অসামঞ্জস্য নিয়ে সবচেয়ে বিশদ ঐতিহাসিক-মতাদর্শিক পর্যালোচনা হাজির করেছেন ইসরাইলের সুপ্রসিদ্ধ রাবাই Yaakov Shapiro তাঁর ১৪০০ পাতার বই The Empty Wagon : Zionism’s Journey from Identity Crisis to Identity Theft-এ।

ইহুদিবাদ হচ্ছে ধর্মবিশ্বাস, যেখানে দখল ও উচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠনের বাসনা নাই, যেটা কিছু বিশ্বাসগত, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও কিছু আচরণিক দিক নিয়ে গঠিত । এখানে বলা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ইহুদিবাদের ইতিহাসে ইহুদি আকিদাসমূহকে সুসংবদ্ধভাবে কোডিফাই করেন মুসা মাইমুন বা মাইমোনাইডিস (১১৩৮-১২০৪)। ১৩টি বিশ্বাসকে তিনি ইহুদি-বিশ্বাস হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে জায়নবাদ  হচ্ছে   ইহুদিদের জন্যে  ‘ইসরাইল’ (ফিলিস্তিন)-এ সার্বভৌম জাতীয় আবাস গঠনের আন্দোলন ও মতাদর্শ। আধুনিক জায়নবাদ ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম সময়ের একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ঘটনা। এই রাজনৈতিক জায়নবাদকে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যাবে। আভি শ্লাইম তাঁর The Iron Wall : Israel and the Arab World বইতে জায়নবাদের দুটি মূলগত ও প্রায় স্থায়ী বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। এক. এটি সবসময় প্যালেস্টাইনের জাতীয় পরিচয়কে অস্বীকার করেছে (Non-recognition of Palestinian national identity) । দুই.  মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে এটি সবসময় বৃহৎ শক্তির সাথে মৈত্রী খুঁজেছে। জায়নবাদ যেহেতু সেটেলার কলোনিয়াল প্রজেক্ট, তাই উচ্ছেদ, নির্মূল ও দখলদারিত্ব অর্থাৎ   Dispossession, Elimination, Occupation-এর প্রবণতা জায়নবাদের একেবারেই ভেতরের জিনিস। জায়নবাদের অনেকগুলো ধারা আছে। যেমন, পলিটিকাল জায়োনিজম, প্র্যাক্টিকাল জায়োনিজম, প্র্যাগমেটিক জায়োনিজম, সিন্থেটিক জায়োনিজম, রিভিশনিস্ট জায়োনিজম ইত্যাদি। ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রিভিশনিস্ট জায়োনিজম ঘরানার। এই ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা জেভ জাবোটিনিস্কি। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত তার “The  Iron Wall”   ও  “On the morality of  the Iron Wall” প্রবন্ধদ্বয়ে একধরনের মাস্কুলার বা ফাইটিং জায়োনিজমের পরিচয় পাওয়া যাবে। বেন গুরিয়ান প্র্যাগমেটিক জায়োনিজমের প্রতিভূ। তার আগের চাইম ওয়াইজম্যানকে বলা হয় সিন্থেটিক জায়োনিজমের স্থপতি। জায়নবাদের এইসব প্রকার, ইতিহাস, রাজনীতি ও রণকৌশল নিয়ে  “জায়নবাদের ভাবকল্প ও রাজনীতি” এবং “জায়নবাদের দুই পা : এক পা ইতিহাসে, আরেক পা বিশ্বাসে”, এই দুটো অংশে আলোচনা করেছি।  

এখানে মূলত আমরা আলোচনা করব খ্রিস্টান জায়োনিজম বা খ্রিস্টীয় জায়নবাদ নিয়ে, যার জন্ম ইহুদি জায়নবাদেরও পঞ্চাশ বছর আগে। দাবি করা হয়, ইউরোপ-আমেরিকার কয়েক মিলিয়ন মানুষ এই জায়নবাদের সমর্থক। এই খ্রিস্টীয় জায়নবাদ ইহুদি-রাষ্ট্র ইসরায়েলের শর্তহীন সমর্থক, বন্ধু ও ইহুদি-রাষ্ট্রের পক্ষের অন্যতম লবিস্ট গ্রুপ। খ্রিস্টান জায়োনিজমের উদ্ভব ব্রিটেনে বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে আয়ারল্যান্ডে এবং বিকাশ-বিস্তৃতি আমেরিকায়। এই জায়োনিজমের জন্ম প্রোটেস্টান্ট, ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানিটির ঐতিহ্যের ভেতরকার বাইবেল ব্যখ্যার একটি ধারার ভেতরে। খ্রিস্টান জায়নবাদের ধর্মতাত্ত্বিক বিবেচনা ইহুদি জায়নবাদের জাতিবাদী রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। খ্রিস্টান জায়নবাদী প্রতিষ্ঠান ও ইহুদি জায়নবাদী লবি মিলে সারা পৃথিবী থেকে ইসরাইলে ইহুদিদের মাইগ্রেশনে ব্যাপক সাহায্য করে। খ্রিস্টান জায়নবাদের ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাস হচ্ছে, ইসরাইল রাষ্ট্রের সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ পৃথিবীতে জেসাস ক্রাইস্টের দ্বিতীয় আগমনের শর্ত । তারা মনে করে, আখেরি জামানাতে (End Times) ইহুদি রাষ্ট্র যিশুখ্রিস্টের আগমনের পটভূমি রচনা করবে এবং ইহুদিরা এক সময় খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হবে। খ্রিস্টান জায়োনিজম নামক প্রোটেস্টান্ট–পিউরিটান খ্রিস্টানিটির এই ধারা মনে করে ইসরায়েল রাষ্ট্র বাইবেলের ভবিষ্যদ্‌বাণীর বাস্তবায়ন, তাই এই রাষ্ট্র আমাদের নিঃশর্ত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক সমর্থন পাবার যোগ্য।

দুই.

খ্রিস্টান জায়োনিস্ট (Christian Zionist) পদটি সর্বপ্রথম হার্জলই ব্যবহার করেন । সুইশ ফিলানথ্রপিস্ট ও রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ডুনান্টকে বোঝাতে তিনি এই পদটি ব্যবহার করেন । হার্জলের নেতৃত্বে ১৮৯৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব জায়নবাদী সম্মেলনে যে অল্প কয়েকজন খ্রিস্টান নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন হেনরি ডুনান্ট তাদের একজন। উক্ত সম্মেলনে  আরেকজন নিমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন উইলিয়াম হেশলার (William Herchler), যিনি ভিয়েনাতে এংলিকান এম্বাসির চ্যাপম্যান ছিলেন। হার্জল তার ডাইরিতে উইলিয়াম হাশলার সম্পর্কে লেখেন, “A sympathetic, gentle fellow, with the long grey beard of a prophet. He is enthusiastic about my solution of the jewish question.”  হার্জলের ডাইরি থেকে জানা যায় হেশলার বলেছিলেন, “We have prepared the ground for you.”   হাশলার (১৮৪৫-১৯৩১)  এবং হার্জল গভীর বন্ধু হয়ে ওঠেন। এবং নানা ডিপ্লোম্যাটিক কাজকর্মে তিনি হার্জলকে সহায়তা করেন। হার্জলকে যদি আধুনিক জায়নবাদের পিতা বলা হয় তাহলে উইলিয়াম হাশলারকে বলা যেতে পারে আধুনিক খ্রিস্টীয় জায়নবাদের স্থপতি। হাশলার শুধু হার্জলের প্রথমদিককার সমর্থকই ছিলেন না, হার্জলের মৃত্যুর পরও তার মতাদর্শের অটুট সমর্থক ছিলেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে, খ্রিস্টানিটির যে ধারা জায়নবাদ ও জায়নবাদী উদ্যোগকে সমর্থন করে তাকে খ্রিস্টীয় জায়নবাদ বলা হবে। খ্রিস্টান জায়োনিজমকে millenarian protestantism বা Evangelical protestantism বলেও আখ্যায়িত করা হয়।

খ্রিস্টীয় জায়নবাদের উদ্ভব জন নেলসন ডার্বির (১৮০০—১৮৮২) বাইবেল ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে । তিনি চার্চ অব আয়ারল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। অনেক ক্যাথলিককে তিনি  চার্চ অব আয়ারল্যান্ডের বিশ্বাসে ‘কনভার্ট’ করেন । পরবর্তীতে অবশ্য তিনি এই চার্চ ছেড়ে আসেন। ইতোমধ্যেই তিনি বেশ কিছু বিশ্বাসে উপনীত হন এবং সেগুলো প্রচার করতে থাকেন। তিনি বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্‌বাণীর গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্যকার হয়ে ওঠেন। তিনি ১৮৩১ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত  powerscourt conference-এ অংশগ্রহণ করেন । তিনি তার ধনাঢ্য বন্ধু লেডি পাওয়ারসকোর্টের সাথে মিলে অনেক মিটিং, সেমিনার ও কনফারেন্স করেন। পরবর্তীতে জন ডার্বি ইউরোপজুড়ে ব্যাপক ভ্রমণ শুরু করেন। জেনেভাতে তিনি ১১টি বক্তৃতা প্রদান করেন। কিছুদিনের মধ্যেই  ইংল্যান্ডে তিনি বেশ খ্যাতিমান হয়ে উঠেন তার “Dispensionalism” তত্ত্বের জন্যে। পরবর্তীতে, ইহুদিদের জাগতিক নিয়তি ও ইসরাইলি রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত এই তত্ত্ব আমেরিকাতেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং অনেকেই তা প্রচার করা শুরু করে। তার তত্ত্ব christen restorationism  বলেও পরিচিত। এটাকে রেস্টরেশনিজম বা প্রত্যাবর্তনবাদ বলা হয় এই জন্যে যে, এই তত্ত্ব বিশ্বাস করে ইহুদিরা তাদের পূণ্যভূমিতে আবার ফিরে আসবে । ইহুদিদের হোলি ল্যান্ড বা পবিত্র ভুমিতে আবার ফিরে আসাতে অনেক নন-ডিসপেনশনালিস্টরাও বিশ্বাস করেন।

ইহুদিদের প্যালেস্টাইন বা ল্যান্ড অব ইসরাইলে পুনরাগমনের এই চিন্তাগুলো ব্রিটিশ পাবলিক পরিসরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকজুড়ে। অর্থাৎ, এই ধর্মীয় আলোচনাগুলো ধর্মীয় সভা-সম্মিলনীর বাইরে জনপরিসরেও আলোচিত-বিবেচিত হতে থাকে, যদিও  ১৬ শতাব্দীর ব্রিটিশ সংস্কারবাদীরা এই নিয়ে লিখেছিলেন এবং পিউরিটানদের মধ্যে তো এই চিন্তাধারার পক্ষে জোর সমর্থন ছিল। ধর্ম বিষয়ক এই আইডিয়াগুলো ধর্মীয় ও পাবলিক পরিসর পার হয়ে রাজনীতির অঙ্গনেও প্রবেশ করে।

১৮৩৮ সালে লর্ড শ্যাফটসবেরি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন পামারসনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ  ‘কন্সুলেট’ প্রতিষ্ঠা করেন । ১৮৩৯ সালে স্কটল্যান্ডের চার্চ আলেক্সজান্ডার কেইথসহ কয়েকজনকে ফিলিস্তিনে পাঠান সেখানকার ইহুদিদের অবস্থা পরিদর্শন করতে। তারা ফ্রান্স, গ্রিস, মিশর ভ্রমন করে মিশর থেকে গাজাতেও যায়, ফেরার পথে তারা সিরিয়াতেও যায় । বিভিন্ন অঞ্চলের জুইশ কমিউনিটির সাথে তারা আলাপ করে যে তারা বাইবেল-কথিত ইসরায়েলে যেতে চায় কি না; জেসাসের আগমন ঘটলে তারা তাকে মেনে নিবে কিনা বা মানা উচিত কিনা ইত্যাদি বিষয়ক দাওয়াতি কার্যক্রমও তারা চালায় । ১৮৪৪ সালে আলেক্সান্ডার কেইথ বই লেখেন The Land of Israel according to the covenant with Abraham, with Isssac and with Jacob নামে। এই বইয়ের একটা স্লোগান খুব বিখ্যাত হয়ে উঠে “a land without a people for a people without a land” । শাফটসবারি ১৮৫৩ তে   লিখিত একটা চিঠিতে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে লেখেন : “গ্রেটার  সিরিয়া যদি a country without a nation in need of a nation without a country হয় তাহলে তো এই ভূমির প্রাচীন ও ন্যয্য মালিক ইহুদিরা আছেই ।” শাফটবারির এই উক্তি  পরবর্তীতে হার্জলকে অনুপ্রাণিত করে এই শব্দবন্ধ ব্যবহারে “a land of no people for a people with no land” । ফিলিস্তিনি কখনোই জনমানবশূন্য ছিল না। ফিলিস্তিন “A land of no people” এটা ঘোরতর মিথ্যা ও প্রাচ্যবাদী মনের নির্মিত বয়ান। থিয়োডর হার্জল ও আহাদ হাম—এদের সবারই জানা ছিল যে, ফিলিস্তিন জনবসতিপূর্ণ। হার্জলের সহকর্মী Max Nordau দুইজন রাবাইকে প্যালেস্টাইন পরিদর্শনে পাঠায়, সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র বা আবাস গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে। তারা ফিরে এসে প্রতিবেদন দাখিল করে বলে : “The bride is beautiful but she is married to another man.।” অর্থাৎ, ফিলিস্তিন জনবিরল অঞ্চল কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল ধারণা ছিল, আর অনেকক্ষেত্রেই এটা নির্মিত মিথ্যা বই অন্য কিছু নয়! অবশ্য, প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিতে, ফিলিস্তিনে বসবাসকারী কেউ মানুষ পদবাচ্য নয়।

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের মধ্যে লর্ড শ্যাফটসবেরি ছিলেন প্রধান খ্রিস্টান জায়োনিস্ট । ১৮০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত লন্ডন জুইশ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ১৮৪৮ সালে এবং ১৮৮৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সোসাইটির সভাপতি ছিলেন তিনি। বাইবেলের বুক অব ক্রনিকল ছিল তার প্রিয়। কারন এটি ইসরায়েলের পুনরুদ্ধারের আশায় ভরপুর । ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ “Quarterly Review” পত্রিকায় ব্রিটিশ কনসুলের অধীনে সরাসরি ইহুদিদেরকে তিনি প্যালেস্টাইনে পুনর্বাসনের কথা বলেন। ব্রিটেনের একজন মেজর পলিটিশিয়ান হিসেবে এমন প্রস্তাব তিনিই প্রথম দেন। ১৮৬৫ সালে Palestine Exploration Fund (PEF) প্রতিষ্ঠায় তিনিও যুক্ত ছিলেন, যেটি প্যালেস্টাইনের ম্যাপিং বা মানচিত্রায়নের একটা গুরুত্বপূর্ন উদ্যোগ।

তুর্কি সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন যখন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীন আসে, তখন খ্রিস্টান জায়োনিস্টরা উচ্ছ্বসিত হয় এই ভেবে যে, ইতিহাসের এই ঘটনা ক্রমে ক্রমে বাইবেলের ভবিষ্যদ্‌বাণী বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে। ডিসপেনশনালিস্টদের কাছে বালফুর ডিক্লারেশনও বাইবেলের প্রফেসির সত্যতার ইঙ্গিতবাহী । বালফুর ঘোষণা জায়োনিস্ট আন্দোলনের চাপের ফসলও বটে। 

১৯১৬ সালের দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি এসে ব্রিটিশ সরকার মনে করল, জায়োনিস্টদের সহায়তা করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার বহন করতে ইহুদিরা সহায়তা করবে । ব্রিটিশ ফরেন অফিসের নীতিনির্ধারকরা এ-ও বিশ্বাস করত, ইহুদিরা  আমেরিকাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে আনতে পারবে । জার্মানি হয়তো প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের আবাসের ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি তাদের আগেই দিয়ে ফেলবে—এই ভয়ও ছিল ব্রিটিশদের। তাছাড়াও, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বালফুরের গভীর সহানুভূতি ছিল ইহুদি ও তাদের ইতিহাসের প্রতি। তারা ইসরাইলকে তাদের স্পিরিচুয়াল হোম বা আত্মিক আবাস মনে করত ।  বালফুর ও লয়েড জর্জ গভীরভাবে ক্রিস্টান জায়োনিজমে আস্থা রাখত; তারা বিশ্বাস করত যে, আধুনিক জায়নবাদ স্বর্গীয় প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের মাধ্যমে  ইহুদিদেরকে তাদের পূর্ব-পুরুষদের আবাসভূমিতে পুনরায় সংস্থিত (resettle) করবে। ব্রিটিশ ফরেন পলিসির সাথে খ্রিস্টান জায়োনিস্টদের মিশনারি বাসনা মিলে যায়। তাছাড়াও, মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের বিবাদমান সাম্রাজ্যিক স্বার্থের কারণে ফিলিস্তিন  কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, দুই হাজার বছরের মধ্যে নেপোলিয়ানই প্রথম ইহুদিদেরকে প্যালেস্টাইনে  স্বতন্ত্র আবাস ভূমির ঘোষণা  দেন, ১৭৯৯ সালে। মিশর থেকে ফিলিস্তিন অঞ্চলকে আক্রমণ করবার উদ্দেশ্যে তিনি বের হন, হাইফা অঞ্চল আয়ত্বে আনেন এবং ‘ওয়ালস অব একর’ পর্যন্ত পৌঁছে যান। কিন্তু আহমদ পাশা আল-জাজ্জারের নেতৃত্বে অটোম্যান আর্মির প্রবল প্রতিরোধের মুখে তিনি মিশরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। নেপোলিয়ানের বিশ্বনেতা হবার বাসনা ছিল। প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের ‘দেশ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে ফরাসি উপস্থিতিকে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি-রাষ্ট্র গঠনের এই ইচ্ছে নেপোলিয়ানের পূরণ হয়নি। কিন্তু সাইকস-পিকক নামক ব্রিটিশ-ফরাশি চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্য ভাগাভাগি ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উপস্থিতির প্রসঙ্গ পুনরুজ্জীবিত হয় ।  মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই চুক্তি কিন্তু বালফুর চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক।  

বালফুর ঘোষণা অনেকবার খসড়া করা হয়। ১৯ জুন, ১৯১৭ সালে ফরেন সেক্রেটারি আর্থার বালফুরের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা জায়োনিস্ট নেতৃবৃন্দকে—চাইম ওয়েইজম্যান ও ওয়াল্টার লর্ড রথসচাইল্ড—একটা ড্রাফট করতে বলেন যাতে প্যালেস্টাইনে ইহুদি আবাসের ব্যাপারে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারে। জায়োনিস্টদের ড্রাফটের ভেতরে এই বাক্যটা ছিল : “Palestine should be reconstituted as the national home for the jewish people.”   কিছু ভাষাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শেষমেষ বালফুর ঘোষণা তৈরি হয় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত জায়নবাদী আন্দোলন হাজার হাজার ইহুদি ইমিগ্র্যান্টদেরকে প্যালেস্টাইনে আনতে পেরেছিল। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ম্যান্ড্যাটের অধীন ছিল ফিলিস্তিন/ইসরাইল। ১৯৪৮ সালের সীমিত পরিসরে ইসরাইল রাষ্ট্রগঠনের মধ্যে খ্রিস্টান জায়োনিস্ট ও ডিসপেনশনালিস্টরা তাদের ঐতিহাসিক ধারাক্রমের যে ধর্মীয় বিশ্বাস, সেটার প্রমাণ যেন হাতেনাতে পেল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যখন পরাশক্তি হয়ে ওঠে তখন থেকে আমেরিকা প্রায় একটি বারের জন্যেও ইসরাইলি স্বার্থের বিপরীতে যায়নি। আমেরিকার প্রতিটি প্রেসিডেন্ট কোনো না কোনোভাবে হয় খ্রিস্টান জায়োনিস্ট সংগঠন অথবা ইহুদি লবি দ্বারা প্রভাবিত ছিল ।  

খ্রিস্টান ও ইহুদি জায়নবাদ উভয়েই বিশ্বাস করে যে, গড আব্রাহামের মাধ্যমে ইহুদিদেরকে ইসরাইলি ভূমি দিয়েছেন যার সীমানা ইউফ্রেতিস থেকে নীল নদ পর্যন্ত। তাই এই ভূমিগুলোকে কলোনাইজ করতে হবে। দরকার হলে বৈধ-অবৈধ যেকোনোভাবেই হোক ভূমিগুলোতে ইহুদি আবাস গড়তেই হবে । ফোরাত থেকে নীলনদ পর্যন্ত ইহুদি আবাস হলেই জেসাস ক্রাইস্টের আগমনের পথ সুগম হবে এবং বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্‌বাণী পূর্ণতা পাবে। তাই ১৯৬৭ সালে, ছয় দিনের যুদ্ধে, ইসরাইলি বাহিনি পশ্চিম তীর, গোলান মালভূমি, সিনাই ও গাজা দখল করে। এই এলাকাগুলোকে বাইবেলে গালিলি, জুডিয়া ও সামারিটা নামে ডাকা হয়। বাইবেল-কথিত এই ভূমিগুলো ইহুদি রাষ্ট্র দ্বারা দখল করাকে খ্রিস্টান জায়নবাদিরা ন্যায্য মনে করত। ইহুদি জায়নবাদীদের কাছে তো এটা ন্যায্য ছিলই। জে ডাব্লিউ কুক নামের এক রাবাই ৬ দিনের যুদ্ধে দখলকৃত ভূমিতে ইহুদি আবাস গড়বার প্রথম প্রচেষ্টা নেন। দখলকৃত ভূমি নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না, তিনি স্বপ্ন দেখেন ও দাবি করেন “True whole Land of Israel”.  ১৯৭৩ সালে ‘ইয়ম কিপুর’ যুদ্ধে ইসরায়েল কিছু ভূমি হারালে ধর্মীয় জায়নবাদীদের বিশ্বাসে হোঁচট লাগে। তারা এটাকে গডের পরীক্ষা হিসেবে নেন। ১৯৭৪ সালে ‘গুশ এমুনিম’  নামে একটা প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে, এটি শীঘ্রই একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয় এবং এটি নিজেদের মনোযোগ নিবন্ধ করে দখলকৃত ভূমিতে  আবাস স্থাপনে।

ইন্টারন্যাশনাল খ্রিস্টান এম্বাসি, খিস্টান ইউনাইটেড ফর ইসরায়েল, খ্রিস্টান ফ্রেন্ডস অব ইসরায়েল, জেরুসালেম প্রেয়ার টিম, ব্রিজেস ফর পিস ইত্যাদিসহ প্রায় ২০০ খ্রিস্টান জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন আছে। ইন্টারন্যাশনাল খ্রিস্টান এম্বাসি রাশিয়া থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদিকে ইসরায়েলে আনার খরচ বহন করেছিল। তারা রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেত, লোকেদেরকে ইসরাইলের সুন্দর সুন্দর ভূ-দৃশ্য দেখাত এবং ইসরাইলে বসতি গড়বার জন্যে অনুপ্রাণিত করত। তাদের যাতায়াত ও পোশাক-আশাকের খরচও  খ্রিস্টান এম্বাসি বহন করত। ১৩/১৪টি  দেশে তারা কাজ করে । ১৯৮০  সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। এটার একটা ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল, আমেরিকান এম্বাসিকে জেরুসালেমে স্থানান্তরিত করা। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকান এম্বাসি জেরুসালেমে নিয়ে আসেন। তেলাবিবে নয়, এখন আমেরিকান এম্বাসি জেরুজালেমে। অন্যান্য দেশের উপরেও খ্রিস্টান জায়োনিস্টদের চাপ আছে তাদের এম্বাসি জেরুজালেমে স্থাপন করবার।  খ্রিস্টান ফ্রেন্ডস ফর ইসরাইলি কমিউনিটিজ ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা ইসরাইলে সেটেলমেন্টে আগ্রহীদের সাহায্য করে, তাদের জন্যে ফান্ড সংগ্রহ করে, বৃক্ষ রোপন করে ইত্যাদি। অনেক খ্রিস্টান জায়োনিস্ট ডোম অব রকের (কুব্বাত আস-সাখরা) এর স্থানে জুইশ টেম্পল মাউন্ট পুননির্মাণে ইহুদিদের টেম্পল মুভমেন্টকে সহায়তা করতে ইচ্ছুক। বর্তমান খ্রিস্টান জায়োনিস্টদের কতগুলো পলিটিকাল এজেন্ডাকে স্টিফেন সাইজার এভাবে উল্লেখ করেছেন : ১. হোয়াইট হাউজ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও কংগ্রেসের সাথে লবি করা। ২. প্যালেস্টাইনে অবৈধ স্থাপনাগুলোকে সমর্থন করা। ৩. আমেরিকান এম্বাসিকে জেরুজালেমে স্থানান্তর (যেটি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত)। ৪. টেম্পল মুভমেন্টকে সহায়তা করা। ৫. ইহুদিদের জন্যে ফান্ড  সংগ্রহ ও ফান্ড স্থানান্তর। ৬. ইসলামের অবমাননা করা ও শান্তি প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়া।

খ্রিস্টান জায়োনিস্ট একটা এন্টি-ক্রাইস্ট ফিগার অন্বেষণ করে, যেটি ইহুদি জায়নবাদেরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়ক হয়। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেন, তারপর লাদেন ও আহমেদানিজাদকে দানব-রূপে চিহ্নিত করে খ্রিস্টীয় ঘরানায় বহু  বইপুস্তক লেখা হয়েছে। যেমন, Mark Hitchcock এর The Apocalypse of Ahmadinejad. এগুলোর চিল্ড্রেন’স ভার্শনও করা হয়েছে । প্রায় সব উপায়ে সমাজের নানা স্তরে এসব চিন্তা ছড়িয়ে দেবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ।

জেরি ফালওয়েল সিনিয়র (১৯৩৩-২০০৭) (তিনি ব্যাপ্টিস্ট প্যাস্টর ও টেলিভাঞ্জেলিস্ট) ১৯৬৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর ইহুদি জায়োনিস্ট মুভমেন্টের সাথে খ্রিস্টানদের মধ্যস্থতা করেছেন। খ্রিস্টান কমিউনিটির ভেতরে ইসরায়েলের পক্ষের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেন তিনি। অসংখ্য কন্সারভেটিভ খ্রিস্টান ও চার্চ লিডারদেরকে তিনি ইসরাইলের পক্ষে মোবিলাইজ করেন।

জন হ্যাগি খ্রিস্টান জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন “Christians united for Israel” এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। খ্রিস্টান ও ইহুদি কমিউনিটির ৪০০ নেতা  ও জন হেগি মিলে এ সংস্থাটি তারা গড়ে তুলেন। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইসরায়েলি জায়োনবাদী সংগঠন “Im Tirtzu” এর প্রধান অর্থ যোগানদাতা। তিনি ট্রাম্পেরও সমর্থক ছিলেন। তিনি টেক্সাসের কর্নারস্টোন ইভানজেলিকাল চার্চের প্যাস্টরও। এই চার্চের ২২ হাজার সক্রিয় সদস্য আছে, আর সমর্থক আছে কয়েক মিলিয়ন। প্রতি সপ্তাহে লক্ষাধিক লোকের কাছে তারা খ্রিস্টীয় জায়োনবাদী দাওয়াত পোঁছায় ।

আমেরিকার প্রায় প্রতিটা প্রেসিডেন্ট ইসরাইল ও ইহুদিদের প্রতি খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গিই পোষণ করত। জিমি কার্টার ১৯৭৬ সালে বলেন : “The establishment of the nation of Israel is the fulfillment of biblical prophecy and the very essence of its fulfillment.” 

জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭৭ সালে। তার Palestine : peace, not apartheid বইটা প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। এই বইয়ে তিনি ইসরায়েলের দখলদারিত্বের সমালোচনা করেছেন কিন্তু ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ‘গণতন্ত্র’ আছে বলে প্রশংসাও করেছেন। তার আরেকটা বই ২০০৯ সালে বের হয়েছে We Can Have Peace In The Holy Land : A Plan That Will Work. সেখানেও ইসরায়েলের সমালোচনা আছে অবশ্য। তবে, এটাও তিনি নিশ্চিত করে বলেছেন,  আমেরিকার অনেক অফিসারের কাছেই ইসরায়েলের সমালোচনা অগ্রহণযোগ্য। এক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকলেও  ইহুদি লবির সামর্থ্য সম্পর্কে তিনি ভেতর থেকেই অবহিত।

রোনাল্ড রিগানও বাইবেলের পুরাতন নিয়মের বিশ্বাস অনুযায়ী ঘোষণা দেন : “I turn back to the ancient prophets in the Old Testament….signs foretelling Armageddon and I find myself wondering if—if we are the the generation that is going to see that come about.” রোনাল্ড রিগান তার নির্বাচনী প্রচারণায় অজস্রবার ‘আর্মাগেডন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর শেষ সময় এসে গেছে, যা ঘটছে তা বাইবেলের প্রফেসিরই বাস্তবায়ন ।  জায়োনিস্ট লবির সামনে অনেক প্রেসিডেন্টকেই অসহায় হয়ে যেতে হয় । জর্জ বুশ সিনিয়র বলেন, “There are 1000 lobbyists upon the HiLL today  lobbying Congress for loan guarantees for Israel and I’am one lonely little guy down here asking Congress to delay its consideration of loan guarantees for 120 days.” কিন্তু জর্জ বুশ সিনিয়র ইসরাইলের জন্যে লোন গ্যারান্টিকে ৩ মাসের জন্যে  বিলম্বের আবেদন করেও ব্যর্থ হন লবির কাছে ।

জর্জ বুশ জুনিয়র সরাসরি বলেন :  “I am driven with a mission from God. God would tell me “George, go and fight these terrorists in Afghanistan”. And I did. And then, God would tell me “George, go and end the tyranny in Iraq.” বারাক ওবামা নির্বাচিত হবার পরপরই AIPAC (American Israel Public Affairs Committee) এর সভায় যোগ দিয়ে তাদেরকে নিশ্চিত করতে হয়  “let me be clear that Israel’s security is sacrosanct. It is non-negotiable.”  প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পর্কে জেরি ফালওয়েল জুনিওর বলেন, ইভানজেলিকালরা তাদের স্বপ্নের প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন, যিনি আমেরিকা ও ইসরায়েলকে একীভূত রাখবেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৯৮৬ সালেই আমেরিকান সিনেটে ঘোষণা করেছিলেন, ইসরাইলকে আমরা সমর্থন করি কেন—এই কৈফিয়ত দেওয়া আমাদের বন্ধ করতে হবে। আমরা তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছি এখানে। যদি ইসরাইলের অস্তিত্ব না-ও থাকত, আমেরিকাকে এই অঞ্চলে নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যে ইসরাইল আবিস্কার করতে হতো—(If there were not an Israel, The United States of America have to invent an Israel to protect her interests in the region.)

তারা সবাই এই ব্যাপারে একাট্টা যে তাদেরকে জায়োনিস্ট লাইনেই হাঁটতে হবে। তাই কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলতে চান, জায়োনিজম একটা খ্রিস্টান পলিটিকাল মুভমেন্ট।

খ্রিস্টান জায়োনিস্টরা বাইবেলকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে। প্রত্যকেটা ঘটনাই ঘটবে বলে বিশ্বাস করে । প্রায়শই যা কিছু ডেস্ক্রিপ্টিভ, তা-কে প্রেস্ক্রিপ্টিভ ভাবে। খ্রিস্টান জায়োনিজমের তিনটা ধারা আছে : মেসিয়ানিক জায়োনিজম, যারা ইহুদিদের জন্যে খ্রিস্টীয় সুসংবাদ শোনায়; এপোক্যালিপ্টিক জায়োনিজম, যারা ধ্বংস ও যুদ্ধের কথা বলে, আরেকটি হচ্ছে, প্রাগমেটিক খ্রিস্টিয়ান জায়োনিজম, এরা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে ইসরাইলের পক্ষে থাকে। 

সম্প্রতি, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ এ মাইক জনসন স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন আমেরিকান সংসদে বা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস-এ। তিন সপ্তাহ আমেরিকার সংসদ স্পিকারবিহীন ছিল। মাইক জনসন ইভানজেলিকাল খ্রিস্টান। খ্রিস্টান জায়োনিস্ট। পার্লামেন্টে তার প্রথম কাজ হলো ইজরায়েলের সমর্থনে বিল আনা। তিনি বললেন : “The first bill I’m going to bring to this floor in a little while will be in support of our dear friend Israel and we are overdue in getting that done.” এ থেকেও বোঝা যায়, খ্রিস্টান জায়নবাদ ইহুদি জায়নবাদকে টিকিয়ে রাখে। এক লেখক তো লিখলেনই, ইহুদি জায়নবাদ বলে কিছু নাই, যা আছে সেটা খ্রিস্টান জায়নবাদ।

খ্রিস্টান জায়োনিজম জুইশ জায়োনিজমের চেয়ে অন্তত দশ গুণ বৃহৎ। এর প্রায় ৬০/৭০ মিলিয়ন সমর্থক আছে বলে দাবি করা হয়। খ্রিস্টান জায়োনিজমকে খ্রিস্টানধর্মের জায়গা থেকে সমালোচনাও করা হয়। যেমন, এরা খ্রিস্ট ধর্মকে বিকৃত করেছে। পবিত্র কেতাবে মানুষের প্রতি ন্যায়ানুগ আচরণ করা, দুর্দশা দূরীকরণ ও মজলুমের প্রতি সহমর্মিতার  ব্যাপারে যে জোর দেওয়া হয়েছে খ্রিস্টান জায়োনিস্টরা তা বেমালুম ভুলে থাকে। তাছাড়াও,  ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতি ও জুলুমকে সমর্থন করতে গিয়ে জায়োনিস্ট খ্রিস্টানরা ফিলিস্তিনে তাদের মজলুম খ্রিস্টান ভাইদের ভুলে গেছে। “মিডল ইস্ট কাউন্সিল অব চার্চেস” খ্রিস্টান জায়নবাদকে ‘হেরেসি’  হিসেবে ঘোষণা করেছে।

২০১২ সালের ১৮ আগস্ট নেতানিয়াহু বলেছিলেন : “আমি বিশ্বাস করি না, ইহুদি-রাষ্ট্র ও আধুনিক জায়নবাদ খ্রিস্টান জায়নবাদ ছাড়া সম্ভব হতো। আমরা আমাদের বন্ধুদের মূল্যায়ন করি, আমরা তাদের ভুলব না।” ২০১৭ তে Christians United for Israel নামক খ্রিস্টান জায়নবাদি সংগঠনের বার্ষিক সভায় নেতানিয়াহু বলেন : “ইসরাইলের চেয়ে বড় বন্ধু আমেরিকার নাই। আমেরিকার চেয়ে বড় বন্ধু ইসরায়েলের অন্য কেউ নেই;  আর, আমেরিকার মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু আপনারা, খ্রিস্টান জায়নবাদী বন্ধুরা।”

নেতানিয়াহুর উক্তিতেই বোঝা যায় খ্রিস্টীয় জায়োনবাদের শক্তি ও ভূমিকা ।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
একরামূল হক শেখ
একরামূল হক শেখ
1 year ago

ইহুদি জায়নবাদ একটু আধটু জানি, কিন্তু খ্রিস্টান জায়নবাদ বিষয়ে ছিলাম নিরক্ষর। জগলুল আসাদ সাবলীলভাবে সেটিকে তুলে এনেছেন। এবং এটিই বাস্তব যে দুটো জায়নবাদই একে অপরের পরিপূরক। ফলে তাঁদের সঙ্গে এঁটে ওঠা সত্যিই বেশ কঠিন।

Happy
Happy
1 year ago

আপনার এবারের লেখাটাও চমৎকার হয়েছে।
বাকি অংশটুকু পরবর্তীতে আসবে আশা করি।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷