সারাদিন যেমন তেমন করে কেটে যায়, রাত এলেই যেন নেমে আসে মৃত্যুর শীতলতা। একটু দূরের বন থেকে ভেসে আসে শেয়ালের চিৎকার, রাস্তায় কুকুরের কান্না। একটা অশুভ ছায়ায় যেন ঢাকা পড়ে সব। বারবার শিউরে ওঠে শরীর, বাতাসের শব্দেও কেঁপে ওঠে মন। হারিকেনের টিমটিমে আলোটাও কাগজ দিয়ে একদিক ঢেকে রাখা, যেন উজ্জ্বলতা না ছড়ায়। অন্ধকার করে রাখা সব, যেন এতটুকু আলো না ছড়ায় কোনোদিকে।
কিতাবের পৃষ্ঠায় চোখ রাখা, মন যে কোথায় তা জানে না খুশবু। কুকুরের কান্নার সাথে সাথে আয়াতুল কুরসি আর তিনকুল জপতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। ভয়ংকর ইচ্ছে জাগে একটু পর পর। ইচ্ছে করে হারিকেনের তেলটুকু নিজের শরীরে ঢেলে সলতেটা ওড়নার কোনায় লাগিয়ে দিতে। উফ! শব্দ বের হয়ে আসে অস্ফুটে। টেবিলের ওপরে ফল কাটার ছুরি। একবার মনে চায় সেটা নিজের কণ্ঠনালী বরাবর বসিয়ে দেয়। পরক্ষণে নিবৃত করে নিজেকে। অনিচ্ছায় নেমে আসা চোখের জলকে মুছে ঢোক গেলে। পানির গ্লাসটা মুখ পর্যন্ত এনে ধরতেই গ্লাসের ভেতর যেন ভাসে শাহীদার মুখ। ‘‘জানিস খুশবু! ওরা আমাকে নির্যাতন করে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, সে কী পিপাসা! একটু পানিও দেয়নি। পানি চাইতে ওরা.. না না, তোকে বলব না।” শাহীদার প্রতিচ্ছবি যেন আর্তনাদ করে ওঠে, পৃথিবী জুড়ে ওই একটাই চিৎকার… আস্তে করে পানির গ্লাস নামিয়ে রাখে খুশবু। চোখদুটো জবা ফুলের মত টকটক করছে ওর। ছুরি নিয়ে টেবিলের ওপর দাগ কাটে, অজস্র দাগে ভরে ওঠে ওর প্রিয় পড়ার টেবিল। ওর ইচ্ছে করে এমন করে কাটতে পারত মগ সেনাদের, যদি পারত! আবার দু চোখে বন্যা নামে খুশবুর। আজ মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা হয়েছে। সহপাঠীদের গুমরে ওঠা কান্নার আওয়াজ ওর মাথার ভেতর বাজে অবিরাম ঘণ্টাধ্বনির মতো। বড় আপার অসহায় কণ্ঠস্বর ভুলে যেতে চায়, ভুলে যেতে চায় সব কিছু। গতকাল মাদরাসা থেকে ফেরার পথে শাহীদাকে নিয়ে যায় ওরা। তারপর, তারপর পাওয়া গিয়েছিল শাহীদার পোড়াদেহ। কেউ কেউ দেখেছে দূর হতে, শাহীদা পড়ে ছিল রাস্তার ঢালে, পোড়া গলিত একটি মাংসপিণ্ড হয়ে। সবগুলি কুকুরের আচমকা চিৎকারে খানখান হয়ে যায় নীরবতা, স্তব্ধ হয়ে যায় খুশবু। ওর হাত থেমে যায়… চোখ জুড়ে অন্ধকার শূন্যতা।
দরজায় মৃদু করাঘাতে ওর শরীর ঢিলে হয়ে আসে। শুনতে পায় মা দরজা খুলছেন। বাবার দোকানের কর্মচারী আলী। বাবা পাঠিয়েছেন আজ রাতে বাসায় আসবেন না বলে। আলী রাতে থাকবে বাড়িতে। হাজী ইসমাঈলের বড় খান্দান, নিজের ঘরে প্রায় পনের বিশজন নারীসহ বাড়ি জুড়ে সাতঘর মিলিয়ে শ খানেক মানুষের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। মংডু বাজারের সবচে বড় ব্যবসায়ী হাজী ঈসমাঈলের কাঁধে বাড়ির লোকজনের বাইরে অন্যদের প্রতি সামাজিক দায়িত্বও আছে। হাজী ঈসমাইল হাটহাজারী মাদরাসায় কাফিয়া পর্যন্ত পড়ে রাখাইনে চলে আসেন। জড়িয়ে পড়েন ব্যাবসায়। তিন ছেলে এক মেয়ের বাবা। ছেলেদের একজন ইতিমধ্যে বৌদ্ধদের হাতে শহিদ, একজন নিখোঁজ। একজন বাংলাদেশে। আজ রাতে তিনি বাড়িতে আসেননি, ছেলের খোঁজ নিতে কয়েক জায়গায় যাবেন গোপনে, যদিও এরকম হাজার জনের খোঁজ আজও মিলেনি, না মেলাই নিয়ম, তবুও পিতৃপ্রাণ মানে না সে কথা।
মায়ের ডাকে ঘোর ভাঙ্গে খুশবুর । সালেহা বেগম জানেন—খুশবুর মনের অবস্থা। তবু সারাদিনে দানাপানি মুখে না দেয়া মেয়েটাকে কিছু খাওয়ানো তো দরকার। মরার আগেই মরে গিয়ে লাভ কী। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সালেহা ভাবেন, ওর যদি জন্মই না হতো, ভালো হতো! হাতের রুটি সবজির থালাটা টেবিলের ওপর রেখে পাশে বসেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। মেয়েকে বলার মতো কোনো কথা তার মুখে আসে না। শুধু চোখের জলের ভাষা ছাড়া তার কিছু নেই আর। খুশবুও চুপ। হারিকেনের আলোয় দুটি অসহায় দুঃখী মানুষের অশ্রুজলের উপাখ্যান কেউ কোনোদিন জানবে না। কোনো চিত্রকর আঁকবে না এই বেদনার ছবি। সময় চুপ করে দাঁড়ায়, রাত দীর্ঘতর হয়। হারিকেন মিটমিট করে একসময় দপ করে নিভে যায়। মায়ের কোলে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ে খুশবু, আপাত পৃথিবীর বুকে এই ওর একমাত্র নির্ভরতা, নিরাপদ আশ্রয়। সালেহা বেগম উপরে তাকিয়ে দেখেন, কড়িকাঠ ভেদ করে তার দৃষ্টি চলে যায় আসমানের পর আসমান পেরিয়ে; আছড়ে পড়ে আরশের দরজায়।
চলবে…
এতো ছোট কেন 🙄
মাশাআল্লাহ! লেখিকার লেখার ধরন এত সুন্দর! কি এক অজানা শক্তি যেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ টেনে ধরে রেখেছিল। আল্লাহ আপনার লেখায় বারাকাহ দিন
আকর্ষণ আছে লেখায়।কিস্তি টা আরো বড়ো হলে ভালো হতো।
ইয়াসমিন বইটা পাবো কোথায়??
অনন্য উপাখ্যান, এই ধারায় লেখার শক্তি আপনার কলমে মজুদ থাকুক সর্বদা।
পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার মতো শক্তি যে লেখিকার আছে তাঁর কাছে পাঠকের আবদারের আধিক্য থাকা অবশ্যই অস্বাভাবিক কিছু না। নিয়মিত লেখা চাই। আল্লাহ আপনার লেখায় বারাকাহ দিক।
একটানে পড়েছি। এক নিঃশ্বাসে না। অনেকগুলো নিঃশ্বাসে। শেষপ্রান্তে এসেও মনে হলো শেষ হয়নি। বাকি পর্বের অপেক্ষায়…
বাকি পর্বের অপেক্ষায়, সম্মোহনী যাদুর মতো টেনে রাখে।
মৃত্যুর শীতলতা কেমনে হয়? শব্দগুলো যেন ছন্নছাড়া। পড়া আগাতে পারি নি
মা শা আল্লাহ।
দারুণ লেগেছে।
চালিয়ে যান অবিরাম।
খুশবু’র প্রথম পর্ব বের হয়েছে এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল। পরবর্তী পর্ব আর কবে পাব!