
ক্যাফে ইয়াফা একটি সম্প্রদায়ের মিলনস্থল, যেখানে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি বই ও সংস্কৃতিপ্রেমীরা একসঙ্গে সময় কাটাতে পারেন [ইয়ানিভ বারম্যান/আল জাজিরা]।
“এই ইয়াফা একদিন ইয়াহুদি শহর হবে… আরবদেরকে পুনরায় ইয়াফায় আসতে দেয়াটা উদারতা নয়, বরং হবে নির্বুদ্ধিতা।”
উপরের কথাগুলো লিখেছে ডেভিড বেন-গুরিয়ান। লেখার সময়কাল ১৯৪৮ সনের জুন মাস। ১৯৪৮ সন, যখন ফিলিস্তিনের স্বাধীন ভূখণ্ডে দখলদার ইয়াহুদিরা তাণ্ডব চালিয়েছিল। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা হরণ করে তারা নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছিল।
ডেভিড বেন গুরিয়ান ছিল ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯১০ সনে ফিলিস্তিনের ইয়াফা বিমানবন্দরেই তার বিমান অবতরণ করেছিল। ১৯৩৫ সন থেকে সে ছিল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসরত ইয়াহুদিদের নেতা। ১৯৪৬ সনে বিশ্ব ইয়াহুদি সংস্থার প্রধানও হয়েছিল সে। অতঃপর আসে ‘নাকাবা’র কাল। ১৯৪৮ সনের ১৪ই মে সে ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ঘোষণার পর থেকেই তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে ইয়াহুদিরা জয় লাভ করে। এই ডেভিড বেন গুরিয়ানই ছিল ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাই তাকে বলা হয় ইয়াহুদিদের জাতির পিতা।
ডেভিড ডাইরির কথাগুলো লিখেছিল জুন মাসে। ততদিনে ডানপন্থি ইরগান বাহিনি ইয়াফা শহরকে তছনছ করে ফেলেছে। প্রায় ৭০ হাজার ফিলিস্তিনিকে ওরা গৃহত্যাগী করেছিল।
ওই যুদ্ধটি ছিল সর্বাত্মক। ডেভিড প্রতিটি ইয়াহুদি নাগরিককেই লড়াইয়ে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আকাশ থেকে মুহুর্মুহু বোমা বর্ষিত হচ্ছিল। এক সময় বোমার বর্ষণ থামল। তখন শুরু হলো লুটপাট। ইয়াহুদিরা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বাড়িঘর লুট করতে শুরু করে। ডেভিড বেন গুরিয়ান, ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, এই লুটপাটকে সর্বোচ্চ সমর্থন জানিয়েছিল। এমনকি সে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও পক্ষে ছিল। হলোও তাই। মাস খানেক চলল ব্যাপক লুটপাট।
মাস খানেক পরের চিত্র। ফিলিস্তিনের বাড়িঘরগুলো সব বিধ্বস্ত। নাগরিকদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। “আর সারা রাস্তাজুড়ে পড়ে আছে হাজার হাজার আরবি বই-পুস্তক। যুদ্ধের প্রকোপে বইগুলো বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বৃষ্টি, রোদ ও ঝড়ো হাওয়ায় বইগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে।” ইতিহাসবিদ অ্যাডম রাজ তার বই The Looting of Arab property in the 1948 War তে এমনই লিখেছে।
বইগুলো এসেছে মানুষের বাসাবাড়ি, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, মসজিদ ও চার্চের সংগ্রহশালা, ইয়াফার স্যোশাল ক্লাবের রিডিং রুম এবং ইয়াফার শপিং মলের রাস্তায় থাকা সাতটি আধুনিক বুকশপ থেকে।
সেই ‘নাকাবা’র কাল থেকেই ইয়াফা শহর আরবি বই-পুস্তক শূন্য হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ৫৫ বছর ছিল এই দুরবস্থা। অথচ এই ইয়াফা ছিল ফিলিস্তিনের একটি উন্নত শহর। ইয়াহুদিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর আগে ইয়াফা ছিল বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানেই ফিলিস্তিনের কবি-সাহিত্যিকগণ বসবাস করতেন। আর সেই শহরই এখন আরবি বইপুস্তক শূন্য।
২০০৩ সনের কথা। রামাল্লার মিশেল রাহেব নামক এক যুবক। সে একটি আরবি বুকশপ খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর জন্য সে ইয়াফা শহরকেই বেছে নেয়। আর ওই বছরই সে খোলে ‘ইয়াফা ক্যাফে’।
রাহেব ব্যক্তিগতভাবে বইপ্রেমী। ১৯৯০ সনেও সে একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। রামাল্লা অঞ্চলেই একটি লাইব্রেরি খোলার চেষ্টা করেছিল। তার নিজস্ব সংগ্রহশালার হাজারো আরবি বই নিয়েই ছিল তার এই উদ্যোগ। রামাল্লার একটি স্থানীয় চার্চকে সে লাইব্রেরির জন্য নির্বাচন করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি।
ক্যাফে ইয়াফা কেবলই একটি ক্যাফে নয়। বরং সেটি একটি সামাজিক সমাবেশস্থল। এর আশপাশে রয়েছে বিভিন্ন শপিংমল। শপিং করতে আসা লোকেরা ক্যাফেতে যায়। বসে চা, কফি পান করে এবং হালকা নাস্তা সারে।
ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গা থেকেই মুসলিমরা ইয়াফাতে আসেন। তাদের কাছে ‘ক্যাফে ইয়াফা’ একটি আবেগের জায়গা। কেননা সেখানে কিছু আরবি বইপুস্তক পাওয়া যায়। যদিও আরও বিভিন্ন জায়গায় আরবি বুকশপ রয়েছে। তবে ক্যাফে ইয়াফা ইতোমধ্যেই একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।
দখলদারদের তাণ্ডবে ফিলিস্তিনের ‘লিখিত ঐতিহ্য’ বেহাত হয়ে গেছে। এই ক্ষতি অপূরণীয়। এখনো অনেকের বুকে ‘হারানোর ব্যাথা’ বেদনার সুর তুলে যায়। বিশেষ করে খালিল সাকাকিনির কথাগুলো এখনো ফিলিস্তিনের বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। তিনি একজন ফিলিস্তিনি কবি। জেরুজালেমে তার বাড়ি ছিল। তার ছিল ব্যক্তিগত পাঠাগার। তার বাড়িতেও দখলদার ইয়াহুদিরা লুটপাট চালিয়েছিল। বেহাত হয়েছিল তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার বইপুস্তক। তখন তিনি বেদনাহত কলমে লিখেছিলেন :
“বিদায়, আমার বইয়েরা। প্রজ্ঞার বাড়িকে বিদায়…কত রাত আমি তোমাদের পড়ে ও লিখে তেল ফুরিয়েছি—রাতের গভীর নিস্তব্ধতায়, যখন লোকজন সব ঘুমে বিভোর। হায়, তোমরা লুণ্ঠিত হলে! হায়, তোমাদের পোড়ানো হলো! তোমরা কি এখন মুদির দোকানে, তোমাদের দিয়ে কি পেঁয়াজ-রসুন মোড়ানো হচ্ছে? হায়!”

জাফার সৈকত, দূরে মসজিদ আল-বাহর এবং সেন্ট পিটার্স চার্চ দৃশ্যমান [ইয়ানিভ বারম্যান/আল জাজিরা]।
তারা প্রায় ৮০ হাজার বই সংগ্রহ করেছিল। সেগুলো রাখা হয়েছিল গুদামঘরে। যুদ্ধ শেষে সাড়ে চার হাজার বই নেয়া হয়েছিল ইয়াফার একটি তিন তলা বিশিষ্ট দালানে।
ওই সকল বই আর কখনোই ফিরে আসেনি। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে। তবে কিছু কিছু বই পশ্চিম জেরুজালেমের ইয়াহুদি জাদুঘরে পাওয়া যায়। ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তির’ তালিকায় সেগুলো রাখা হয়েছে।
ক্যাফে ইয়াফা : জেগে ওঠার প্রত্যয়
ক্যাফে ইয়াফার সারাটা দিনই থাকে ব্যস্তময়। লোকজন আসছে, বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। ক্যাফের স্টাফরা তাদের সামনে চা-কফি ও হালকা নাস্তার প্লেট দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই চিত্র পাল্টে যায়। ক্যাফে তখন পরিণত হয় একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। সেখানে আরবিভাষার ক্লাস হয়, লেকচার হয়, স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন ডকুমেন্টারি।
ক্যাফে ইয়াফার কিচেনের অপর পাশেই তাদের বুকশপ। আনন্দের বিষয় হলো, সেখানে কেবল আধুনিক আরবি বইপত্রই পাওয়া যায় না, এবং কেবল কায়রো ও বৈরুত থেকে আসা থ্রিলার ও রোমান্টিক উপন্যাস দিয়েই ওই বুকশেলফ ভরপুর নয়। বরং সেখান তালাল আবু শাউইশের ‘গাজার ছোট গল্প’ পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনের উল্লেখযোগ্য কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতা সমগ্র পাওয়া যায়। আরবি ভাষা-শিক্ষার বইপত্রও পাওয়া যায়।
যদিও দখলদার ইয়াহুদিরা আরবি বইপত্র পড়ে না। কখনোই তারা তা কিনবেও না। তবে ক্যাফের মালিক রাহেবের মতে : “ইয়াহুদিরা যে আরবি বইপত্র দেখছে এটাই আমার সার্থকতা।”

রাহেব ক্যাফে ইয়াফাকে একটি সম্প্রদায়ের মিলনস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছেন [ইয়ানিভ বারম্যান/আল জাজিরা]।
মাহমুদ মুনা মনে করেন : “দখলদার ইজরাইলে বাস করা ফিলিস্তিনিদের জন্য আরবি বই কেনা একটি বিলাসিতা–প্রয়োজন নয়।” মাহমুদ পাঠ্যপুস্তকের বুকশপ পরিচালনা করেন। তার সাথে রাহেবও একমত। তিনি বলেন : “আঞ্চলিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলে তাকেও ব্যাবসা নিয়ে ধুকতে হয়।”
অন্যদিকে ইজরাইলি নীতি আরবি বইপত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। ২০০৮ সনে সালেহ আব্বাস ইজরাইলি সরকার থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন। হাইফা অঞ্চলে ‘কুল শাই’ নামক একটি বুকশপ তিনি পরিচালনা করেন। তিনি দখলদার সরকারের অনুমতি নিয়েই সিরিয়া ও লেবানন থেকে বই সংগ্রহ করতেন। ২০০৮ সনে চিঠি দিয়ে তার সেই অনুমতি বাতিল করা হয়। ‘শত্রুদেশ’ থেকে ইজরাইলে বই আমদানি করা যাবে না মর্মে তাকে জানানো হয়।
একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ইজরাইলে বিক্রি হওয়া ৮০% আরবি বই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর মাঝে স্কুল ও ইউনিভার্সিটির পাঠ্যপুস্তকও রয়েছে। এর মাঝে আরও আছে দারবিশের ‘দারুল উইদা’ বইটি; যা বৈরুতে ছাপা হয়েছিল। আছে আরবিতে অনূদিত হ্যারি পটার সিরিজ ও সেক্সপিয়ার সমগ্রও। এমনকি ইয়াহুদি লেখকদের লেখা আরবি বই বা তার অনুবাদও ব্যান করা হয়েছিল। অর্থাৎ দখলদাররা আরবি ভাষাকেই গলা টিপে ধরতে চাচ্ছে।

রাহেব ফিলিস্তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি জীবিত রাখতে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে প্রস্তুত [আজুসেনা মেজোনা/আল জাজিরা]।
রাহেব গত বিশ বছর ধরে ক্যাফে ইয়াফা পরিচালনা করছেন। রামাল্লা থেকে ইয়াফা আসতে প্রতিদিনই তার ৪৫ মিনিট সময় লাগে। ব্যাবসাও লাভজনক নয়। তবু তিনি এটি পরিচালনা করতে চান। এবং ইয়াফাতেই তা করতে চান। তিনি বলেন :
“আমি ইয়াফা-হাইফা ও রামাল্লাকে ভালোবাসি। যদিও আমার জন্ম রামলায় এবং আমি সেখানেরই পরিচয় দেই। পৃথিবীতে আমাদের, ফিলিস্তিনিদের, শিকড় আছে। আমাদের জন্য অন্যত্র যাওয়া কঠিন। আমি যদি বিশ বছর পর জাফফায় স্থানান্তরিত হই আর আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেনে, আমার বাড়ি কোথায়? আমি সর্বদাই বলব রামাল্লা।”
ফিলিস্তিনি সাহিত্যের ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে রাহেব বদ্ধপরিকর। তার আশা ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি আরবি বইপত্রের বিকিকিনি আরও বাড়বে। এমনকি তিনি আশাবাদী যে, “আগামী বিশ বছরের মধ্যে আরও বেশ কিছু আরবি বুকশপ গড়ে উঠবে।”

রাহেব বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা শেয়ার করতে চান [ইয়ানিভ বারম্যান/আল জাজিরা]।
পড়া হলো