চোখ বন্ধ করলেই একটা উঠোন নেমে আসে স্মৃতির দহলিজে। দুপুরের কড়া রোদে হলুদ হয়ে আছে। চত্বরজুড়ে মিশে আছে কাদা-জল-গোবরের মাথা ঝিম ধরানো গন্ধ। ছোট মামা আমনের আঁটি মাথায় করে এনে ঝুপঝাপ ফেলছেন সদ্য লেপা তকতকে উঠোনটার মধ্যিখানে। উঠোনের এক পাশে চুপচাপ খেলায় মেতে আছে আমারই কাছাকাছি বয়সের এক শিশু। চোখ বন্ধ করলেই স্মৃতির দহলিজজুড়ে শিশুটির মুখের আদল ভেসে ওঠে।
আমি দেখি, ছোট মামা প্রতিবার এসে শিশুটির দিকে তাকিয়ে প্রাণখুলে হেসে ওঠেন। কাছে গিয়ে আদর করে কোলে তুলে নেন। গাল টিপে দেন। দু গালে চুমু দিয়ে ফের ফসলের মাঠে ছুটে যান ঘর্মাক্ত শরীরে। শিশুটির দিকে আমি অপলক তাকিয়ে থাকি ঈর্ষান্বিত নয়নে।
বড় মামা আর নানা ধান মাড়াইয়ের কল সারাচ্ছেন। মেশিন পত্রের খুটিনাটি নিরীক্ষা করছেন অতি মনোযোগে। একসময় কল সারানো হয়ে গেলে তারা সেটাকে নিয়ে যান উঠোনের মধ্যিখানে। মেশিনের দু পাশ বোঝাই করে ফেলেন আমনের আটির স্তুপে। স্তুপ গড়া হয়ে গেলে বড় মামা আর নানা মেশিনে পা ঠেলতে থাকেন। ধীরে ধীরে গতি বাড়ে। ধানের শিষ মেশিনের দাঁতে ছোঁয়াতেই রাশি রাশি ধান ছিটকে পড়তে থাকে সামনের শূন্য উঠোনটায়। চোখের পলকেই ভরে উঠতে থাকে সোনালী উঠোন।
শিশুটির চোখে বিস্ময়। সে অবাক হয়ে দেখে চলেছে নানা-মামার এই কর্মযজ্ঞ। তার মুখ হেসে ওঠে। তার চোখ হেসে ওঠে। সমস্ত শরীর নাচিয়ে সে আনন্দ-বিহ্বলতায় নিজের ভেতর দুলে ওঠে।
টের পাই, শিশুটির আনন্দ আমাকেও স্পর্শ করে। আমি তার উচ্ছ্বসিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার পলক পড়ে না। ভেবে কুল পাই না, আমার অনুজ এই শিশু, যে কিনা আমার সহোদর, এত আনন্দ কীভাবে ধরে! সারাক্ষণ সে তার চারপাশ মাতিয়ে রাখে। তার জন্য কারো একটু মন খারাপ করবার জো নেই। এই তো সেদিন, আব্বুর কি এক কথায় আম্মুর মন খারাপের দিন। আম্মু কথা বলেন না কারো সাথে। কাজকর্মেও মন নেই। আমার জেদি আম্মুর কাছেও কেউ ভিড়ছে না তেমন একটা। আম্মু একলা একা আনমনে বসে থাকছেন আর গোপনে চোখের জল মুছছেন। আমি ভেবে পাই না, আব্বু কী এমন বলল যার কারণে বসে বসে গোপনে অমন চোখের জল মুছতে হবে! আম্মু দিনভর কিছু মুখে দেন না। কেউ তাকে গিয়ে খাওয়ার কথা বলবে—সে সাহসও কারো হয় না। বাড়ির ছোট মেয়েকে তারা বেশ জানে। দুপুর পেরোলে শুনতে পাই, আমার অনুজ, এই চির উচ্ছ্বসিত প্রাণ শিশুটি, আম্মুর কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে, আমাল পেতে ব্যাতা কলচে। আমি কাবো না।
সহোদরের ব্যাথার কথা শুনে উদ্বেগ ফুটে ওঠে আম্মুর কণ্ঠে। সে কি বাবা, তোমার পেটে ব্যাথা করছে কেন? আম্মু বাড়িজুড়ে হাঁকডাক শুরু করে দেন, কে কী খাইয়েছো আমার ছেলেটাকে? তার পেটে ব্যাথা করছে কেন? বাড়ির একটা মানুষের কোনো গ্রাহ্যি নেই আমাদের নিয়ে। আমার ছেলের যদি কিছু হয়…
আম্মু লেজকাটা পড়া সাপের মতো ফোঁসফাঁস করতে থাকেন। এমন সময় আমার অনুজ ফোঁপানো কান্নার সুরে বলে ওঠে, সবাইকে বকচো কেন? আমার পেত কারাপ তো তোমার জন্য। তুমি কাচ্চো না। তাই আমার পেতে ব্যাতা।
এ কথা শুনে আম্মু আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না। তার সব রাগ বুঝি জল হয়ে গড়িয়ে যায়। ওলে আমার জাদুরে—বলে আম্মু ঠোঁটে মুখে বুকে চেপে ধরেন আমার অনুজকে।
বড় মামা আর নানা ব্যতিব্যস্ত ধান মাড়াইয়ে। কখন মেঘ করে গিয়ে বৃষ্টি নেমে আসে সেই শঙ্কা তাদেরকে চালিত করে। এই সিজনটার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এই রৌদ্র তো এই মেঘ বৃষ্টি। আমার অনুজ খেলা রেখে ধান মাড়াইয়ের কলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। নানার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে দেখতে থাকে ঘূর্ণায়মান কল। তার চোখে কী বিস্ময় তখন! সে কি তখন তুমুল কৌতূহলী! আমি জানি না। ঠিক ওই মুহূর্তটাতে আমার চোখ আমার সহোদরের দিকে ছিল না। কৌতূহলই ছিল হয়তোবা। তাই তো নানা-মামার উপস্থিতিতেও তাদের সম্পূর্ণ অগোচরে অনুজ তার নরম কোমল তর্জনি ছোঁয়ায় ধান মাড়াইয়ের কলের দাঁতের সাথে। তুমুল কৌতূহলই বোধহয় তাকে আকর্ষিত করে থাকবে। সে হয়তোবা ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল কেন অমন করে ঘুরছে অবাককরা ওই মেশিনখানা। কিন্তু ঘূর্ণায়মান কল তো কৌতূহল বোঝে না, সে তো আর সরলতা মানে না। ফলে চোখের পলকেই অনুজের কোমল আঙুলের অগ্রভাগ ছিটকে গিয়ে পড়ে সোনালী ধানের স্তুপের ওপর।
নানা-মামার আকস্মিক চিৎকার শুনে চোখ ফেরাই অনুজের দিকে। দেখি, রক্তিম অবয়ব নিয়ে কান্নার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে আমার অনুজ। আমার প্রিয়তম সহোদর।
চোখ বুজলেই স্মৃতির উঠোনজুড়ে তার রক্তিম অবয়ব ফুটে ওঠে।
২,
সন্ধ্যা নামতেই লক্ষ্মী ছেলের মতোন পড়তে বসে যাই আমরা; আমি আর আমার অনুজ, দু’জনে পিঠাপিঠি। ফলে আমাদের স্কুল এক, আমাদের শ্রেণি এক এবং আমাদের বইপত্রও অভিন্ন। মাগরিবের আজান শেষে রাতের অন্ধকার গাঢ় হওয়ার সমান্তরালে বাড়তে থাকে আমাদের হরফের গুঞ্জন। ছোটো ফুফুর কঠিন তদারকিতে দুই ভাই তারস্বরে চেঁচাতে থাকি, ‘ওই ফুল ফোটে বনে, যায় মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই।’ একই সুরে দুজনে তাল মেলালেও অনুজ আমাকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। ‘মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি’ সমস্তটা মুখস্থ করে তার শোনানো সারা। আমি তখনও ‘ওই ফুল ফোটে বনে’র ভেতরেই আটকে আছি।
অনুজ ছোট ফুফুর চোখ রাঙানি থেকে আমার আগেই নিস্তার পেয়ে যায়। কিন্তু সে অন্যদিনের মতো সরে গিয়ে চোখের আড়াল হয় না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে আমাকে। এদিকে আমি ছড়াটা ঠিকঠাক মুখস্থ শোনাতে পারছি না। ছোট ফুফু কটমট করে ধমকে যাচ্ছেন। ক্রমাগত মুখ কিড়বিড় করছেন। তাতে আমার আরও গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি অসহায় ও সহমর্মী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমার চোখের তারায় আজও সেই শিশুটির কোমল চাহনি নক্ষত্রের মতোন ফুটে আছে।
এর মাত্র দিন কয়েক পরের কথা।
সেদিনও যথারীতি সন্ধ্যা নেমেছে। যথারীতি পাখিরা ফিরে গেছে প্রত্যেকের ঠিকানায়। সন্ধ্যার আজান হতেই পুকুরের জলে হাত মুখ চোখ ভিজিয়ে আমিও ফিরে এসেছি ঘরে। আজকের সন্ধ্যাটা বেশ প্রসন্ন। বিকেলটা দারুণ কেটেছে। ফুরফুরে মেজাজে দ্রুতই বই নিয়ে বসে যাই। আমার একলা একার কণ্ঠ শুনে পাশের ঘর থেকে আম্মু ছুটে আসেন। ‘কীরে, নীরব কোথায়?’ নীরব। আমার অনুজের একমাত্র ডাকনাম।
আম্মুর কথায় আমার চৈতন্য ফেরে। তাই তো, এতক্ষণ তো ওর দেরি করবার কথা নয়। আমি তবু আলগোছে বলি, কী জানি! আজ বিকালে তো আমার সাথে ছিল না। আছে কোথাও। আসবে এখনই।
কিন্তু আমার কথা সত্য হয় না। নীরব তখনই আসে না। সময় গড়াতে থাকে। সন্ধ্যার অন্ধকার আরও গভীর হয়ে রাত্রির কোলে ঢলে পড়তে থাকে। আব্বু ততক্ষণে বাসায় ফিরেছেন। ছোট চাচাও এসে গেছেন তার আড্ডা ছেড়ে। আরও অবাক হয়ে দেখি, সমস্ত মহল্লা যেন সেই মুহূর্তে ভেঙে পড়েছে আমাদের উঠোনে। সবার মুখে একই কোরাস, নীরব হারালো কোথায়?
নজু ভাই তড়িৎকর্মা লোক। মুহূর্তেই রিকসা আর মাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। “হারানো বিজ্ঞপ্তি, হারানো বিজ্ঞপ্তি, পুঁলিশফাঁড়ী নিবাসী নাসিরুল ইসলামের ছোট ছেলে নীরবকে আজ সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। উজ্জ্বল ফর্সা সাত বছর বয়সের ছেলে। হারানোর সময় তার পরনে ছিল নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর খয়েরি রঙের গেঞ্জি। যদি কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি তার সন্ধান পেয়ে থাকেন…”
কোনো সন্ধান আসে না। নজু ভাই সারা মহল্লা, মহল্লা পেরিয়ে পাশের এলাকা—সব চষে ফিরে আসেন। কোনো খবর জানা যায় না। নীরব কোত্থাও নেই। যেন সে ধোঁয়া হয়ে বাতাসের কণায় মিশে গেছে।
আম্মু বারবার মূর্ছা যান। আব্বুর চোখ ভিজে আছে জলে। দাদি, ছোট ফুফু, ছোট চাচা, আম্মা—নির্বাক যেন।
রাত গভীরতর হতে থাকে। অন্ধকার ঘন কালো হয়ে নেমে আসতে থাকে আমাদের মনের আসমানজুড়ে। কোথাও কোনো আলোর দেখা আমরা পাই না।
নীরবের কোনো সন্ধান আসে না। তবে তার গোলাপি নতুন স্যান্ডেলটার সংবাদ আমাদের কানে আসে। নয়ন এসে সংবাদ দেয়, নীরবের স্যান্ডেল পাওয়া গেছে। সে-ই প্রথম আমাদের বাড়ির সংলগ্ন পুকুরটায় নীরবের স্যান্ডেল ভেসে থাকতে দেখেছে। স্যান্ডেলটা দেখতেই আম্মুর কান্না বাঁধ ভেঙে নেমে আসে যেন। ছোট চাচা সেদিনই কিনে দিলেন স্যান্ডেলটা। নীরবের খুবই প্রিয়। আমাকে ছুঁতেও দিত না। প্রিয় স্যান্ডেলটা রেখে কোথায় হারাল নীরব!
স্যান্ডেলের সূত্র ধরে পুকুরে নামেন নজু ভাই। সাথে তার আরও ক’জন বন্ধুও। তাদের কিছু সময়ের ডুবোডুবির পরিণতিতে পুকুরের এক কোণায় নীরবকে ভুস করে ভেসে উঠতে দেখা যায়। শান বাঁধানো বিরাট পুকুরটার চারপাড়জুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। আমি সে মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে যেতে পারি না। অবশেষে কে যেন একজন আমাকে যায়গা করে দিলে দেখি, কোমল চাহনির অনুজ আমার, রক্তিম অবয়বের সহোদর আমার কেমন ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি আর সেদিকে চেয়ে থাকতে পারি না। মানুষের ভীড় ছেড়ে বেরিয়ে আসি। তখন আমার কেন যেন শুধুই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
৩,
মানুষ অন্য প্রাণীর মতো নয়; সে পাখির মতো নয়, মাছের মতো নয়, নয় পিঁপড়ে কিংবা গাছের মতো। মানুষ স্মৃতিতাড়িত জীব। অতীত তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। জীবনের ফেলে আসা দিন তাকে স্থির হতে দেয় না। তাকে কেবলই ভাবালুতার ঘোরে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাকে কেবলই তন্ময়তার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়। মানুষ একেবারেই আলাদা। সে কেবল পেছন ফিরে তাকাতে চায়। আর এই তাকাতে চাওয়াটাই তার জন্য ডেকে আনে ঘোর আপদ। সে স্মৃতির দেয়াল টপকে বেরোতে পারে না। সেই স্মৃতি যা তাকে কেবলই পোড়ায়। সেই স্মৃতি যা তাকে কেবলই বিমর্ষ করে দেয়।
আমার অনুজের মুকখানা তেমনই। কেবলই পিছু ডাকে। কেবলই পোড়ায়।
পুকুরের গভীর জলের অন্ধকারে দীর্ঘক্ষণ ডুবে থেকে ভুস করে ভেসে ওঠা সেই শিশু প্রায় রাতেই আমার ঘুমের ভেতর ফিরে ফিরে আসে। আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে। কি যে হয়, আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে চাই তাকে। কিন্তু নাগাল পাই না। কোথাও দেখি না কোমল হাসিমুখের সেই শিশুটিকে। চারপাশজুড়ে শুধুই কুঁয়াশা।
বুকের ভেতর অসীম শুন্যতা নেমে আসে, কেমন আছো সহোদর, প্রিয় অনুজ আমার!