একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত প্রমাণিত সত্য হিসেবে মনে করা হতো—ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিতা ও কাব্যচর্চা অপছন্দ করেন। এ বিষয়টা বিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে; কিছুটা আরব ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের হাত ধরে আর অনেকটা ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের প্রোপাগান্ডায়।
ইবনে আবদুল বার নিজের ‘আল-ইসতিয়াব ফি মারিফাতিল আসহাব’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, ‘আব্বাসী খেলাফতের বিখ্যাত আলেম, কবিতার কথক ও সমালোচক আসমায়ী একবার বলেন, কবিতা খুবই মন্দ জিনিস, মন্দত্ব ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু ভালো কাজে খুব দুর্বল।’ অতঃপর তিনি তার কথার সমর্থনে তুলে ধরেন হযরত হাসসান বিন সাবিতের (রা.) দৃষ্টান্ত। বলেন, ‘হাসসান বিন সাবিতকে দেখুন, তিনি ছিলেন জাহিলী কবিদের মধ্যে প্রথম সারির একজন। কিন্তু ইসলাম এলে তার কবিতা হয়ে পড়ে দুর্বল।’ (আল-ইসতিয়াব)
আসমায়ীর এই মতামত কতটুকু সঠিক তা নির্ণিত হওয়ার পূর্বেই মুহাম্মদ বিন সাল্লাম জুমাহি তার ‘তাবাকাতু ফুহুলিশ শুয়ারা’ গ্রন্থে আসমায়ীর বক্তব্যের সমর্থনে লেখেন, ‘কিন্তু ইসলাম আসার পর কবিতা থেকে আরবদের মনোযোগ সরে যায়। তারা লিপ্ত হয়ে পড়ে জিহাদ এবং রোম-পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। ফলে তারা ভুলে বসে কবিতা ও তার আবৃত্তি।’ (তাবাকাতু ফুহুলিশ শুয়ারা : ২২)
ইবনে সাল্লামের পর ইবনে খালদুনও এমন একটি মত পেশ করেন, যা আসমায়ীর বক্তব্যকে করে তোলে আরও শক্তিশালী। তিনি লেখেন, ‘জেনে রাখুন, কবিতা ছিল আরবদের পুস্তক, যাতে সংরক্ষিত থাকত তাদের জ্ঞান, তাদের কথা, তাদের প্রজ্ঞা ও দর্শন। অতঃপর আরবরা ইসলামের সূচনালগ্নে এটা (কবিতা) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেননা দ্বীনি আলোচনা, নবুওয়াত ও ওহীর বাণী এ থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছিল। পবিত্র কুরআনের বাকশৈলী ও ছন্দময়তা তাদেরকে এতটাই বিস্মিত ও ব্যাকুল করে তুলেছিল যে, কবিতা থেকে তারা নিজেদের মুখ বন্ধ করে নেয় এবং একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থাকে নিশ্চুপ।’ (মুকাদ্দিমাতু ইবনে খালদুন : ১ : ১২২)
ইবনে খালদুনের পর যত জীবনীকার, ঐতিহাসিক ও সমালোচক এসেছেন, সকলেই গবেষণা-অনুসন্ধান ছাড়াই কথা বলেছেন আসমায়ীর বক্তব্যের সমর্থনে। এমনকি বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদদের মধ্যে জুরজি জাইদানের মতো একজন বিজ্ঞ খ্রিস্টান ঐতিহাসিক এবং এই সময়ের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও লেখক, এবং মধ্যপন্থি ও ভারসাম্যপূর্ণ সমালোচক ডক্টর শুকরি আল-ফয়সালও পূর্ণ যৌক্তিক ও বর্ণনাগত দলিল দিয়ে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ইসলামে কবিতা ও কাব্যচর্চা দুর্বল হয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন, ‘অতএব, আমরা এই সময়ে (ইসলামের সূচনালগ্নে) এমন কোনো কবি পাই না, যার মধ্যে রয়েছে কবিতায় শিক্ষকসুলভ মাহাত্ম্য ও উচ্চতা, ইমরুল কায়সের মতো উদ্ভাবন, ‘আনতারা’র সঙ্গীত বা ‘নাবেগা’র জ্ঞান ও প্রজ্ঞা।’ (তাতাওয়ারুল গাযাল বাইনাল জাহিলিয়্যাতি ওয়াল ইসলাম)
এভাবে বেশিরভাগ সমালোচক না-বুঝেশুনে এবং কথার প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির আলোতে না দেখে ব্যাপকভাবে বর্ণনা করায় এক সময় এই ধারণা প্রচলিত হয়ে গেল—ইসলাম ও নবিজি ﷺ বাস্তবেই অপছন্দ করতেন কবিতাকে। এই পালে হাওয়া দেন প্রাচ্যবিদ ব্রোকেলম্যান। তিনি নিজের ‘তারিখে আদাবে আরবি’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবি ও কবিতা—উভয়টাকেই অপছন্দ করতেন।’ যখন মুসলিম ও অমুসলিম উভয় পক্ষই একই কথা বলতে থাকে—তখন আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়! ফলে মানুষের মনে স্থির হয়ে যায় যে, ইসলাম ও নবিজির ﷺ কাছে কবিতা একটি অবাঞ্ছিত কাজ এবং যে ব্যক্তি এ কাজ করে সে অপছন্দনীয়।
কিন্তু বর্তমান সময়ে আরবি সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে এবং পরিস্থিতি ও তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধানের পর যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে, বাস্তবতার আলোকে তা এর সম্পূর্ণ ভিন্ন। অর্থাৎ না কুরআন, না নবিজি ﷺ কবিতা অপছন্দ করতেন এবং না ইসলামী যুগে কবি ও কবিতা দুর্বল হয়ে পড়েছিল, না হয়েছিল বিলুপ্ত। বরং তৎকালীন যুগের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নবিজিও ﷺ এটাকে ব্যবহার করেছিলেন রক্ষণাত্মক অস্ত্র হিসেবে। তিনি নিজের কবি সাহাবীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কবিতার মাধ্যমে বিরোধীদের জবাব দিতে। এই ধরনের কবিতা তিনি নিজে শুনেছেন। এমনকি কবিকে নিজের মিম্বরে বসিয়ে বলেছেন কবিতা আবৃত্তি করতে! তিনি তাদের জন্য দুআ করেছেন আল্লাহর সাহায্য ও ফেরেশতাদের সহযোগিতা লাভের। শুধু তাই নয়, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী একজন কবির, যাকে তিনি হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, তার কাব্যিক ক্ষমা প্রার্থনায় এত খুশি হন যে, তিনি শুধু তার ভুল ও বেয়াদবি ক্ষমাই করেননি শুধু, বরং তার গায়ে চড়িয়ে দেন নিজের চাদর, যা ছিল সেই সময়ের এক মহান সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। (এটা ছিল হযরত কাব বিন জুহাইরের ঘটনা।)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে খোলাফায়ে রাশেদার যুগে বিজয়ের সময়গুলোতে সামরিক ও গর্বসূচক কবিতার এত বেশি প্রাচুর্য ছিল এবং এমন মানসম্পন্ন ও জনপ্রিয় কবিতা রচিত হয়েছিল, যা কোনো কোনো দিক থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল জাহিলী যুগের কবিতাকেও। এই কাব্যিক যুদ্ধে মুসলিম কবিরা নিজেদের কবিতার মাধ্যমে শত্রু-কবিদের দাঁতভাঙা জবাব দিতেন।
বর্তমান সময়ে এই বিষয়ের উপর খুব ভালো কাজ করেছেন ড. শাওকি জাইফ, ড. ইয়াহইয়া জাবুরী ও ড. আবদুল্লাহ হামিদ। বিষয়বস্তুর প্রতিটি দিক নিয়ে গভীর অধ্যয়নের পর তারা প্রমাণ করেছেন—প্রচলিত ধারণাটি শুধু ভুলই নয়, বরং একটি বিভ্রান্তিকর ও জ্ঞান-গবেষণার বাস্তবতা পরিপন্থি বিষয়ও বটে।
নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে গবেষণা ও বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি তুলে ধরা হলো─
এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম মনে রাখতে হবে, ইসলাম সাধারণভাবে তার মূলনীতি ও শরীয়তের পরিধি বজায় রেখে মানুষকে এমন সমস্ত বিনোদন, এমন সমস্ত নিয়ামত উপভোগ করতে এবং মানসিক আনন্দে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি দেয়, যাতে ব্যক্তি নিজে বা অন্যরাও আনন্দ লাভ করতে পারে। তবে শর্ত হলো, এটা যেন ব্যক্তির নিজের বা সামগ্রিকভাবে সমাজের কোনো ক্ষতি না করে বা এই ধরনের কোনো কাজ ইসলামের প্রতিষ্ঠিত সীমা লঙ্ঘন না করে কিংবা এর কারণে নির্ধারিত ইবাদতে সৃষ্টি না হয় কোনো অবহেলা বা বিঘ্নতা।
যখন সাধারণ বিনোদনের ক্ষেত্রে ইসলামের এই নীতি, তখন কবিতা সম্পর্কে─যা কবি ও শ্রোতা উভয়ের জন্য বিনোদনের মাধ্যমের পাশাপাশি একটি অত্যন্ত কার্যকর কর্ম এবং একই সাথে যোগাযোগ ও শিক্ষার একটি সুন্দর মাধ্যম। উপরন্তু এটি এমন একটি শাস্ত্র, যা ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। একদিকে এটি মানুষের মন, মগজ, ভাবনার ক্ষমতা এবং বোধ শক্তিকে আবাদ ও প্রজ্বলিত করে, অন্যদিকে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের অবস্থা ও পরিস্থিতির এমন এক কার্যকর চিত্র নির্মাণ করে যে─কখনও কখনও তাতে হৃদয় স্পন্দিত হয়, আবেগগুলো হয় উদ্দীপ্ত আর কখনও কখনও মন ও মগজে এমন শান্তি ও তৃপ্তি সৃষ্টি করে এবং আবেগ ও অনুভূতিতে এমন সংযম ও মধ্যপন্থা প্রদান করে, যা অন্য কোনো মাধ্যমের দ্বারা সম্ভব নয়। স্পষ্টতই, কোন কাজ বা কোন শাস্ত্র যখন ব্যক্তি বা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করে বা তার থেকে ক্ষতির আশংকা থাকে তখন কোনো সরকার বা কোনো সমাজ সেটা করতে দেয় না এবং মানুষকে তার প্রতি উৎসাহিতও করে না। ইসলামও কবিতার ব্যাপারে এই পন্থাই অবলম্বন করেছে।
কবিতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম ব্যাখ্যা আমরা এই আয়াতগুলো থেকে পাই─
وَٱلشُّعَرَآءُ يَتَّبِعُهُمُ ٱلْغَاوُۥنَ ٢٢٤ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِى كُلِّ وَادٍۢ يَهِيمُونَ ٢٢٥ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ ٢٢٦ إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَذَكَرُوا۟ ٱللَّهَ كَثِيرًۭا وَٱنتَصَرُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا۟ ۗ
অর্থাৎ, (হযরত থানভী রহ. এর তরজমা) ‘আর কবিদের পথ তো পথভ্রষ্ট মানুষেরা অবলম্বন করে। (হে সম্বোধিত ব্যক্তি) তুমি কি জানো না যে, সেই (কবি) লোকেরা (কাল্পনিক বিষয়ের) সর্বক্ষেত্রে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘোরে এবং তারা এমন সব কথা বলে, যা নিজেরা করে না। কিন্তু হ্যাঁ, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তারা (নিজেদের কবিতায়) অধিকহারে আল্লাহর জিকির করে। তারা জুলুমের শিকার হওয়ার পর গ্রহণ করে তার প্রতিশোধ।’ (সূরা শুআরা: ২২৪-২৭)
এই আয়াতগুলোতে কবিতা নয়, প্রকৃতপক্ষে কবির স্বভাব, তার কথা ও কাজের প্রকৃতি ও গুণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এজন্য বলা হয়েছে, কবিদের কথা ও কাজের ধরন এমন যে, তাদের অনুসরণ করে প্রবৃত্তির দাসত্বকারী মানুষেরা।
দ্বিতীয় কথা হলো, সাধারণ কবিদের মেজাজ এমন যে, তারা বাগানে বাগানে ভোমরার মতো গুঞ্জন করে এবং বাজারে বাজারে ঘোরাফেরা করে, অর্থাৎ তাদের চিন্তা-চেতনা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-মন্দের নির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। এজন্য তারা বলে এক, আর করে আরেক। যার ফলাফল হলো, তাদের অধিকাংশ কথা ও কাজে কোন সামঞ্জস্য থাকে না। আমরা দেখি, অহংকারে বা প্রশংসায় তারা আসমান ও জমিনকে এমনভাবে মিশিয়ে দেয়─যে পর্যন্ত পৌঁছতে পারে শুধু মন ও মগজ; বাস্তবে যার বিদ্যমানতা অসম্ভব। কিংবা তারা নিজেদের বা নিজেদের উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সাহস ও বীরত্বগাঁথা এমনভাবে আঁকে, যেন তা এক আসমান সমপরিমাণ! অথচ কার্যত এক শত্রুকে দেখলেও তার কলিজা শুকিয়ে যায়! যেমনটি জানা যায় কিছু বিখ্যাত কবিদের সম্পর্কে। কিন্তু এ ধরনের অপ্রীতিকর কথাবার্তা বা হাস্যকর প্রশংসা ও গুণগান গাওয়া সাধারণ কবিদের থেকে ব্যতিক্রম হলেন ঈমানদার কবিগণ─যারা নেক আমল করেছেন এবং নিপীড়ন সহ্য করে অর্জন করেছেন সফলতা। এভাবে ইসলাম যেন এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে কবিদের স্বভাব ও মেজাজের প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত পেশ করেছে এবং ভালো ও মন্দ কবিদের মধ্যে ঈমান ও নেক আমলের পার্থক্যরেখা টেনে দিয়ে সুস্পষ্ট করেছে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি। একইসাথে এই আয়াতগুলো থেকে কবিতা ও কাব্যচর্চা হারাম বা অপছন্দনীয় হওয়ার কোন দিক পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে হাদীসের ভাষ্যও কমবেশি এমনই। এই বিষয়বস্তুর উপর বর্ণিত প্রথম হাদিসটি হলো,
عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لأن يمتلئ جوف أحدكم قيحا يريه خير له من أن يمتلئ شعرا
অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কারো পেট পুঁজ দিয়ে পূর্ণ করা উত্তম হবে, কবিতা দিয়ে পূর্ণ করার চেয়ে।’ (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিসের পেছনে একটি ঘটনা রয়েছে, যে ঘটনাটি ছাড়া বক্তব্যের অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ঘটনাটি হজরত আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, ‘একবার আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এমন সময় এক কবি কিছু গান গাইতে গাইতে আবির্ভূত হলো। তখন তিনি বললেন, ‘ধরতে চাইলে এই শয়তানকে ধরো। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি পুঁজ দিয়ে পেট ভরে, তাহলে তা কবিতা দিয়ে পেট ভরার চেয়ে উত্তম।’
এই ঘটনা থেকে এতটুকু অবশ্যই বোঝা যায়, এই কবিতাগুলো অবশ্যই মানুষের মধ্যে একটি অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিলো, যা নবিজি ﷺ অনুভব করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই কবির কথা বা আবৃত্তিতে অবশ্যই এমন কিছু ছিলো, যা ইসলাম ও নবিজির ﷺ দৃষ্টিতে আপত্তিকর। হয় সে মুশরিক কবি ছিলো, যে তার কবিতায় প্রতিমা ও মূর্তি ইত্যাদির প্রশংসা করছিলো কিংবা এটা ছিলো অনৈতিক ও অশ্লীল কোন কবিতা, যা জাহিলি যুগের মতো আবৃত্তি করা হয়েছিলো। ফলে তার কোনোটিই সেই নতুন ইসলামি আরব সমাজের জন্য উপযুক্ত ছিল না এবং ইসলামের দৃষ্টিতেও ছিল অবৈধ। কেননা এগুলো একজন মানুষের হৃদয়কে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয়। এজন্য ইমাম বুখারী এই হাদীসটিকে এনেছেন ‘মানুষের উপর কবিতা এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করা যে, কবিতা তাকে আল্লাহর স্মরণ এবং কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জনে বাধা দেয়–এটা অপছন্দনীয় হওয়া বিষয়ক’ অধ্যায়ের অধীনে।
স্পষ্টতই, মদিনার মানুষ সেসময়ে নতুন মুসলিম হচ্ছিলেন। গোড়াপত্তন হচ্ছিলো ইসলামি সমাজের। এমন অবস্থায় কোন সংস্কারক কীভাবে প্রকাশ্যে এমন কিছু করার অনুমতি দিতে পারেন, যার কারণে সমগ্র মিশনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এমনই একটি উদাহরণ হলো─দাবা ও অন্যান্য খেলা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু কেউ যদি এগুলোর প্রতি এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে, নামাজ ইত্যাদি সম্পর্কে অবহেলা করে, তাহলে এই অনুমতি পরিণত হয় নিষেধাজ্ঞায়। এ ধরনের সমস্ত কাজই জঘন্য ও অপছন্দনীয় বিষয় হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে, হারাম হিসেবে নয়। এভাবে কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা। এটা যদি চিত্তবিনোদন, ভালো সময় কাটানো, আনন্দ ও খুশি উদযাপনের জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে কোন দোষ নেই। কেননা ইসলাম এটা চায় না যে, কবি নিজের কবিতায় শুধু ধর্মীয় কথা বলবে বা কেবল উপদেশ ও নসিহতের ধরন অবলম্বন করবে। তবে এটা অবশ্যই চায়, কবি যেন তার কবিতাকে সমাজে মন্দ ও অশ্লীলতা ছড়ানো বা কাউকে অসম্মান করার মাধ্যম আর গুনাহ, অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতাকে প্রশংসনীয় করে তুলে ধরার হাতিয়ার না বানায়। এটাকে শুধু ইসলামই নয়, অন্য কোন ধর্ম ও যৌক্তিক সমাজব্যবস্থাও অনুমতি দিতে পারে না। এজন্য ব্যঙ্গাত্মক কথা সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামে অনর্থক ও ব্যঙ্গাত্মক কথা বলবে, তার জিহ্বা কেটে দেওয়া হবে।’ এই আদেশের ভিত্তিতে হজরত উমর রা. তাঁর খেলাফতকালে তৎকালীন বিখ্যাত ব্যঙ্গ-কাব্য রচয়িতা হুতাইবাকে একটি অযৌক্তিক ব্যঙ্গত্মক কথা বলার পর বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যদি এমন কথা বলো, তাহলে আমি তোমার জিভ কেটে দেবো।’ একবার তো এই অপরাধের জন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়।
যেহেতু কবিতা ব্যক্তির হৃদয় ও মনকে সরাসরি আকৃষ্ট করে, সেজন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব মুরসিয়া গাইতেও নিষেধ করে দেন, যেগুলো রচিত হয়েছিলো মুসলমানদের ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যকার সংঘটিত যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারীদের নিয়ে, যাতে এগুলো শুনে পুরোনো শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এবং হৃদয় পরিচ্ছন্ন হওয়ার পরিবর্তে নোংরা না হয়ে উঠে। কেননা ইসলাম কবিতাকে শুধু ভাষা ও সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না, বরং মনে করে চিত্তবিনোদনের উপকরণও। এখন যদি আনন্দের পরিবর্তে এর মাধ্যমে অনৈতিকতা, নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা বৃদ্ধি পায় বা রাগ, সীমালঙ্ঘন ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় অথবা জাহিলী যুগের কিছু অনাকাঙ্খিত আচার-অনুষ্ঠানের দিকে মন চলে যায় কিংবা এ ধরনের অন্য কোনো প্রভাব দেখা দেয়, তাহলে এ ধরনের কবিতাকে ভালো চোখে দেখা যেতে পারে না।
এ কারণেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে কবিতা আবৃত্তি, তা শুনতে বা উপভোগ করতে কখনোই নিষেধ করেননি। বরং উল্টো তিনি এ কথা বলে কবিতার মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন যে, ‘অনেক বক্তব্যে রয়েছে জাদু আর অনেক কবিতায় রয়েছে হিকমত।’ এই প্রজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যখন নিজের ও ইসলাম সম্পর্কে কুরাইশদের ব্যঙ্গ-কবিতা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন তিনি হাসসান ইবনে সাবেত, কাব ইবনে মালিক ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করতে নিজেই নির্দেশ দেন। এমনকি নবিজি ﷺ হযরত হাসসান রা.কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘যতক্ষণ তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রক্ষা করতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পবিত্র আত্মা (হযরত জিব্রাইল আ.) তোমাকে সাহায্য করতে থাকবেন।’ হযরত হাসসান রা. যখন তাদের ব্যঙ্গ করে কবিতা আবৃত্তি করেন, তখন নবিজি ﷺ খুশি হয়ে বললেন, هجاهم حسان فشفى واستشفي অর্থাৎ ‘হাসসান তাদের ব্যঙ্গ করে তার নিজের ও আমার হৃদয় শীতল করেছে।’ (সহিহ মুসলিম)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, إنما الشعر كلام ، فحسنه حسن و قبيحه قبيح অর্থাৎ, কবিতা একধরনের বাচনভঙ্গি, তাই এর ভালো অংশ ভালো বলে বিবেচিত হবে আর খারাপ অংশ বিবেচিত হবে খারাপ হিসেবে।’ (প্রাগুক্ত)
কবিতা নবিজির ﷺ পছন্দনীয় হওয়া এবং এটাকে কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এর চেয়ে বড় কারণ আর কী হতে পারে? যেমনটি উপরে বলা হয়েছে যে, নবিজি ﷺ তিন কবিকে কুরাইশদের জবাব দিতে বলেন। হযরত হাসসান রা. তাঁর মসজিদের মিম্বরে বসে কুরাইশদের জবাবে কবিতা আবৃত্তি করতেন। নবিজির ﷺ ওফাতের পর একবার হজরত হাসসান রা. মসজিদে নববিতে বসে এই ধরনের কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। এমন সময় হযরত উমর রা. পাশ দিয়ে অতিক্রম করতে করতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। হজরত হাসসান রা.ও তার সুর পাল্টে বললেন, ‘যাও, যাও, আমি এ জায়গায় বসে সেই ব্যক্তিকে কবিতা শোনাতাম, যিনি তোমার চেয়ে উত্তম ছিলো, অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর তিনি বিখ্যাত সাহাবী ও হাদিস বর্ণনাকারী হজরত আবু হুরায়রার দিকে ফিরে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আপনি কি মহানবীকে এ কথা বলতে শুনেননি, ‘তুমি আমার পক্ষ থেকে এই কুরাইশী কবিদের উত্তর দাও! হে আল্লাহ! আপনি তাকে জিবরাঈল আ.এর মাধ্যমে শক্তিশালী করুন। তখন হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, হ্যাঁ, আমি তা শুনেছি।’ (বিস্তারিত জানতে দেখুন, সহিহ বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসায়ি)
আরবি সাহিত্যের একজন সাধারণ ছাত্রেরও এই ঘটনাটি জানার কথা─কাব বিন জুহাইরের মতো একজন কবি─যিনি ছিলেন ইসলাম ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদ্বেষী ও ঘোরতর বিরোধী এবং যার রক্ত নবিজি ﷺ হালাল করে দিয়েছিলেন─তার শুধু একটি প্রশংসা-কবিতার জন্য নবিজি ﷺশুধু তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে জীবন দানই করেননি, বরং নিজের চাদর খুলে তার গায়ে চড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই কারণেই এই ক্বাসিদার নাম হয়, ‘ক্বাসিদাতুল বুরদাহ, যার অর্থ ‘চাদরওয়ালা ক্বাসিদা’। পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে নবিজির ﷺ প্রশংসায় বহু কবিতা রচিত হয় যেগুলোকে ‘ক্বাসিদা-ই-বুরদা’ নামে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। যেমন, বুসিরী ও শওকীর কবিতা।
কমবেশি এমনই অবস্থা ছিলো খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও। হযরত উমর রা.এর মতো কঠোর মানসিকতার খলিফা সম্পর্কিত এই রেওয়ায়েতটি খুবই বিখ্যাত যে, তিনি হজরত আবু মুসা আশআরীকে লিখেছিলেন, ‘লোকদের কবিতা শেখার নির্দেশ দিন। কেননা এতে উচ্চ নৈতিকতা, সঠিক মতামত গঠনের ক্ষমতা এবং বংশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়।’
ইসলাম কবিতা ও কাব্যচর্চা সম্পর্কে নতুন ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট দাবি ও চাহিদা, একটি নির্দিষ্ট ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী এবং উন্নয়নশীল জাতির আশা, আকাঙ্খা ও মনোবলের পরিপ্রেক্ষিতে এমন সুস্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী পন্থা অবলম্বন করেছে, যা কবি ও কবিতার বিকাশের পথে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং বিপরীতে এই নীতি কেবল কবিতার বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করেনি, এটাও চিহ্নিত করেছে যে, একটি উন্নত সমাজে কবিতা ও কাব্যচর্চার ভিত্তি এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত!
এ বিষয়টি যাচাই করার জন্য জাহিলি যুগের কবিতা ও ইসলামী কবিতাকে শুধু ‘কম-বেশি’র মাপকাঠিতে তুলনা করা উচিত নয়। বরং ভাষা ও বক্তব্যের অলৌকিকতা, অর্থ ও উদ্দেশ্যের বৈচিত্র্য, গভীরতা ও কার্যকারিতা, কবিদের সংখ্যাধিক্য ও তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসমূহ─এসবের দিক থেকেও তুলনা করা উচিত। এতে বোঝা যাবে, জাহিলী যুগের কবিতা─যা ইসলামী যুগের তুলনায় একটি বৃহৎ সময় জুড়ে চর্চিত হয়েছে─শুধু কয়েকটি বিক্ষিপ্ত বিষয়, সীমিত চিন্তা ও কিছু যৌন অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে।
এ প্রসঙ্গে চিন্তা করার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইসলাম যদি কবিতা ও কাব্যচর্চার বিরোধী হতো, তাহলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে আজ অবধি সেই লাখ লাখ মুসলিম কবি─যারা শুধু আরবি ভাষাতেই নয় বরং বিভিন্ন ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন─তারা কি আবির্ভূত হতে পারতেন? তারা কি এভাবে প্রকাশ্যে কবিতা লিখতে পারতেন, যেভাবে করে আসছেন এবং যার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে আজ পর্যন্ত? কোনোভাবেই না। যদি ইসলাম ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরোধিতার সামান্যতম ইঙ্গিতও থাকতো, তাহলে কবেই মৃত্যু ঘটতো কবিতার। যেমন মুসলমানদের মধ্যে মৃত্যু ঘটেছিলো মূর্তিপূজা ও কুসংস্কারের। যেভাবে নাচগান, ভাস্কর্য, চিত্রকলা ইত্যাদি আজ পর্যন্ত মুসলমানদের প্রিয় শিল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, একইভাবে কবিতাও পারতো না মুসলমানদের মধ্যে বিকাশ লাভ করতে।
একইসাথে এটাও মনে রাখতে হবে, আরবী ভাষায় কাব বিন জুহাইরের কাব্যশৈলীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান ও প্রশংসায় কবিতা রচনা পরবর্তীকালে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে গুরুত্ব বেড়ে যায় এ ধরনের কবিতার। এটাকে স্মরণ করা হতে থাকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর নামে। যেমন বুসিরী’র ক্বাসিদা-ই-বুরদা, শাওকি’র নাহজুল-বুরদা, যা আজও ইসলামি দেশগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠান ও উপলক্ষ্যে অত্যন্ত ভক্তি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে পড়া ও শোনা হয়।
অনারব মুসলমানরা তো নবিজির ﷺ প্রতি প্রচণ্ড মুহাব্বত, সীমাহীন বিশ্বাস এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করার চেতনায় তাদের কবিতা ও কাব্যচর্চায় এক নতুন ও বিশেষ ধরনের বয়ান সৃষ্টি করে নিয়েছে, যাকে বলা হয় ‘নাত’। এমনকি ফারসি ও উর্দু সাহিত্যে নবিজির ﷺ প্রশংসা, গুণগান ও বৈশিষ্টের বর্ণনার জন্য যেসব বিষয়বস্তুর উপর ‘নাত’ তৈরি করা হয়, তা অন্য কোন ব্যক্তির প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণনার জন্য বলা যায় না। বরং সেগুলো শুধু নবিজির ﷺ বিষয়াবলী বর্ণনার জন্য সংরক্ষিত। যেমন ‘হামদ’ আরবী ও অন্যান্য ভাষায় শুধু আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণনার জন্য সংরক্ষিত।
এখন প্রশ্ন হলো, যদি ইসলাম ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিতা ও কাব্যচর্চা পছন্দ না করতেন, তাহলে কি আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূলের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি নতুন ও বিশেষ ধরনের বয়ানকে শুধু প্রণয়ন করা নয়, এতো সহজে চর্চা ও অনুশীলন করতে দেওয়া হতো, যা আজ অবধি প্রচলিত ও জনপ্রিয়? মুসলমানদের ১৪ শত বছরের ইতিহাসে কোনো না কোনো সময় এর বিরুদ্ধে আওয়াজ কি উঠতো না? যেখানে মুসলমানরা নিজেদের ধর্মের ছোট্ট থেকে ছোট্ট বিষয়ে শুধু তর্ক-বিতর্কই করেনি, বরং যুগ যুগান্তরের জন্য ঝগড়া-বিবাদের বিষয় বানিয়ে নিয়েছে! আর যখনই বিষয়টির মীমাংসা হয়নি, তখনই তাদের মতানুযায়ী একটি ভিন্ন সম্প্রদায় অস্তিত্ব এসেছে; যার মধ্যে কিছু আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। সুতরাং, এই ধরনের মেজাজের মুসলমানরা যদি কবিতা অপছন্দ করতো, তাহলে কি তারা সহজেই তা গ্রহণ করতো? এটাকে ভাষা ও সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন্ত রূপ হিসেবে গ্রহণ করে এর বিকাশ ও উত্থানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতো? প্রতিটি ভাষায়, প্রতিটি যুগে এমন প্রখ্যাত কবি জন্মলাভ করতো, যারা নিজেদের নাম লিখিয়েছে ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণাক্ষরে; যার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে আজও!
বস্তুত বাস্তবতা সেটাই, যার প্রতি শুরুতেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের বুযুর্গরা বিশ্বাস ও আস্থার কারণে একজন বর্ণনাকারী ও একজন ঐতিহাসিকের কথাকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে নেন। অতঃপর এর উপর ভিত্তি করে ইসলাম ও নবিজির ﷺ শত্রুরা গড়ে তোলে মিথ্যার প্রাসাদ। তারা ফতোয়া জারি করে, ইসলাম ও নবিজির ﷺ অবস্থান কবিতার বিরুদ্ধে, অথচ সত্য সম্পূর্ণরূপে এর বিপরীত।
কবিতা ও কাব্যচর্চার প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লিখিত আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনাও উপযুক্ত স্থানে হয়েছে; যার সারকথা উঠে এসেছে হাতিম রাযী রহ.এর এই বক্তব্যে─’মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিতা শুধু পছন্দই করতেন না, বরং নিজে থেকে কবিতা আবৃত্তি করতে বলতেন এবং শুনতেন। তিনি তাঁর বিরোধীদের কবিতার উত্তর দিতেন তাঁর নিজের কবিদের কবিতার মাধ্যমে। কবিতা শুনে অন্যায়কারীদের ক্ষমা করতেন এবং গ্রহণ করতেন তাওবা ও ক্ষমাপ্রার্থনা। এমনকি উত্তম কবিতা আবৃত্তির জন্য ভূষিত করতেন সম্মান ও পুরস্কারেও। উত্তম কবিতা শুনে তিনি আনন্দের আতিশয্যে কেঁপে উঠতেন!’
জাবির ইবনু সামুরা রা. থেকে বর্ণিত, ‘আমি একশত বারের বেশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে বসেছি। আমি দেখেছি, নবিজির ﷺ সাহাবীগণ মসজিদে নববিতে বসে কবিতা আবৃত্তি করছেন এবং আলোচনা করছেন জাহিলিয়াতের অনেক বিষয় নিয়ে; নবিজি ﷺ এসব দেখে অধিকাংশ সময় হাসতেন।’ এই হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট, তিনি কবিতাকে এতোটাই ভালোবাসতেন যে, তাঁর মসজিদে কবিতা আবৃত্তি হতো। তিনি তা নিষেধ করেননি, বরং পছন্দের প্রকাশ হিসাবে হেসেছেন।
তথ্যসূত্র :
১. আল-আদাবু ফি মাওকিবিল হাযারতিল ইসলামিয়া, ড. মোস্তফা আশশুকআ, মিশর
২. আল-আদাবু ফি খিদমাতিল হায়াতি ওয়াল আকিদাহ, আবদুল্লাহ হামাদ আল-উওয়াইশিক, দারুল আরাবিয়া, বৈরুত।
৩. উসদুল গাবাহ ফি মারিফাতিস সাহাবাহ, ইজ্জুদ্দীন ইবনে আছির
৪. আল-ইসলাম ওয়াশ শের, ড. ইয়াহইয়া জাবুরী, বাগদাদ
৫. আল-আমালিল মুরতাদা, আলী বিন হুসাইন