কফিন

মূল : মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

আব্দুল্লাহ আফনান

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। ভারতবর্ষের টানা প্রায় দুইশ বছরের রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ঘটনাবহুল সর্বশেষ সাতটি বছরের প্রধান রাজনৈতিক চরিত্ররূপেই নয় আরো অনেক কারণেও উপমহাদেশের অনন্য চরিত্র মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৭৮-১৯৫৮)। তাঁর জন্ম পবিত্র মক্কায়। বেড়ে ওঠা ও লেখাপড়া কলকাতায় একান্তই ঘরোয়া পরিবেশে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনা না মাড়িয়েও তিনি আধুনিক ও প্রাচীন শিক্ষার শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতদের ওপর প্রাধান্য অর্জন করেছিলেন কেবল নিজের প্রখর প্রতিভাবলে। কি জ্ঞানবত্তায়, কি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়, কি রাজনীতি ও সংগঠনে সর্বত্রই তিনি একটি অদ্বিতীয় বিপ্লবী চরিত্র। মুসলিম সমাজের তিনি ‘ইমামুল হিন্দ’, হিন্দুপ্রধান ভারতীয় কংগ্রেসের তিনি বরেণ্য সভাপতি। ব্রিটিশ ভাইসরয় ও কূটনীতিকদের সাথে সংলাপে তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি। তাঁর সম্পাদিত উর্দু সাপ্তাহিক আল-হেলাল-এর জন্য তাঁকে বারবার কারাগারে যেতে হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও নীতিনিষ্ঠায় ভারতবর্ষের অন্য কোনো নেতাই তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না । মি. জিন্নাহর পাকিস্তান দাবির সম্মুখে একে একে গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল সকলেই নেতিয়ে পড়লেন, কিন্তু‘ তখনো তিনি তাঁর অবদানে অটল ছিলেন । অবশেষে স্বাধীন ভারতে যখন তিনি চরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির রূপায়ন দেখলেন, তখন তাঁর স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। এ পুস্তকটি তাঁর সে মর্মবেদনার মূর্তরূপ। এটাকে তাঁর দায়মোচনের প্রচেষ্টাও বলা চলে। রাজনীতিক মাওলানা আজাদের মৃত্যু হলেও যুগস্রষ্টা লেখক ও চিন্তাবিদ বিপ্লবী আজাদ যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকবেন।

এই গল্পের মাধ্যমে পাঠক এক অন্য আজাদের সাক্ষাৎ পাবেন বলেই আমাদের ধারণা। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল আবুল কালাম আজাদের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘আল-হেলাল’ ১৯২৭ ঈসায়ীর একটি সংখ্যায়।


ইভান ব্রডবাচ একবার বন্ধুদের নিজের একটি গল্প শোনায়। ভীতিপ্রদ সে গল্প শুনানোর সময় ইভান বড় বিচলিত বোধ করছিল। বারবার কেঁপে উঠছিল তার কণ্ঠস্বর। তবুও শেষাবধি ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত শুনাতে পেরেছিল সে। ইভান বলেন—

 ২৫ ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সাল। বড়দিন।

সে তারিখে বড়দিন উপলক্ষে এক বন্ধুর বাড়িতে একটি আধ্যাত্মিক মজলিসের আয়োজন করা হয়। সেখানে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত ছিলাম। সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল না, ছিল ঘোর অমানিশা। গভীর আঁধারে আচ্ছন্ন সেই রাতেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হলো।

সেসময় আমার বাসা ছিল মুসকোকা শহরের এমন এক গলিতে, যেটি ছিল শহরের সবচেয়ে ভয়ানক ও অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি গলি। দিনের বেলায়ও এই গলিপথে যেতে আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যেত। গলিটিতে ঢুকলেই বিচিত্র সব কল্পনা-জল্পনা ঘামিয়ে তুলত আমাকে।

আধ্যাত্মিক সেই আলোচনা সভায় শেষ যে বাক্যটি আমার কর্ণগোচর হয়েছিল, তা ছিল খোদ আমার নিজের ব্যাপারে। সেখানে প্রসিদ্ধ দার্শনিক স্পিনোজের রুহের সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ওই রুহ নাকি আজকে এই সভায় আগমন করেছে। অশুভ সেই রুহ আমাকে সম্বোধন করে বলল—

“তোমার মৃত্যু খুবই নিকটবর্তী। জলদি প্রভুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও।”

আমি প্রচণ্ড ভয় পেলাম । কাঁপা গলায় জানতে চাইলাম কথাটার ব্যাখ্যা।

“তোমার জীবন প্রদীপের আলো নিভে এসেছে। আজই তওবা করে নাও।” দ্বিতীয়বারও আমাকে একই জবাব দেওয়া হলো।

যদিও আমি রুহ-জগৎ বলতে কিছু বিশ্বাস করি না, তারপরও মৃত্যুর কল্পনা আমাকে কেমন শঙ্কিত করে তোলে। মৃত্যুর কথা মনে হলেই অভূতপূর্ব এক নির্লিপ্ততা অবসন্ন করে দেয় দেহ মন সব।

আমি এই অশুভ জলসা ছেড়ে দ্রুত বাড়ির পথ ধরলাম। উপরের তলায় পৌঁছে, দরজা খুলে দ্রুত ঢুকে পড়লাম ঘরে। ভয়ে আমার অবস্থা তখন সংকটাপন্ন, মনে হচ্ছিল যেন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ব এখনই। 

ঘর ছিল আলোকশূন্য। বাইরে বাতাস বইছিল প্রবল বেগে। জানালার পর্দাগুলোও কেমন অদ্ভুতভাবে দুলছিল। মনে হচ্ছিল, ঘরের খুঁটিগুলোও যেন ভয়ে বিচলিত হয়ে আছে।

ভাবছিলাম, হতভাগা ওই স্পিনোজের ভবিষ্যদ্‌বাণী সঠিক হয়ে থাকলে আজকের রাত্রটিই আমার জীবনের শেষ রাত্র। এই গভীর রজনীতে, ঘোর অমানিশায়, এই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বাতাসেই হয়তো আমার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে…

আমি দি‌য়াশলাই ধরালাম।

‘ও মাই গড’ অজান্তেই আমার গলা চিড়ে চিৎকার বেরিয়ে গেল। দ্রুত দরোজার দিকে দৌড়ে পালালাম। মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। খুব সম্ভবত করিডোরে পৌঁছে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম।

ঘরে আমি কী দেখেছি জানো? এই দেখো এখনো ভীতিতে আমার হাত-পায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেছে, বেড়ে গেছে হৃৎস্পন্দন—ইভান ব্রডবাচ নিমগ্ন শ্রোতাদের একজনের হাত নিজের বুকে এনে লাগায়।

‘আমি দেখলাম’ ইভান পুনরায় বলতে শুরু করে, ‘ঘরের ঠিক মাঝ-বরাবর একটা লাশের কফিন রাখা ছিল। এবং সেটি বেগুনি রঙের একটি চাদরে মোড়ানো। সোনালি একখানা ক্রুশও অসহায়ভাবে পড়ে আছে চাদরের উপর। 

কফিনটি আমি শুধু এক ঝলকই দেখেছিলাম, কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—সেই একদৃষ্টিতেই কফিনটির প্রতিটি ইঞ্চি-কণা আমার চোখে পড়েছিল। আজ পর্যন্ত সেটির সম্পূর্ণ নকশা আমার স্মৃতিতে ভাসমান।’

সম্ভবত সেটি ছিল কোনো বাচ্চা-মেয়ের কফিন। কারণ, একে তো সেটা আকারে ছিল অতি ছোট, তদুপরি সেটির উপরে রাখা বেগুনি চাদরের সাজসজ্জাও ছিল মেয়েদের কফিনে সাধারণত যেমন সজ্জা থাকে, তেমন।

আমি তীরের গতিতে সিঁড়িতে পৌঁছালাম এবং ঢলের বেগে নিচে নামতে; বরং বলা ভালো অধােগত হতে লাগলাম। যেন ক্ষুধার্ত-হিংস্র কোনো বাঘ আমাকে তাড়া করছিল।

সড়কে নেমে দ্রুত একটা ল্যাম্পপোস্ট জাপটে ধরলাম। বৃষ্টিতে ভিজে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে ছিল থামটি। ঠান্ডায় শরীরে কাঁপুনির মতো হলো। ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করল আমার অনুভবশক্তি। 

‘যদি আমার ঘরে আগুন লেগে যেত’—আমার বোধশক্তি কাজ করতে শুরু করেছে—‘কিংবা দরজা খুলে আমি দেখতে পেতাম,  অস্ত্রসজ্জিত কোনো চোর ঘরে দাঁড়িয়ে আছে অথবা বসে আছে শহরের কোনো পাগলা কুকুর; কিংবা যদি ঘরের ছাদও হঠাৎ করে ধ্বসে যেত তবুও আমি এতটা অবাক হতাম না। ভাবতাম, এটি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু লাশ রাখার কফিন! এর কী অর্থ হতে পারে? আমার ঘরে এটা কে নিয়ে আসল? আনলই বা কেন? আমির বা ধনবান ব্যক্তিদের মেয়েদের শবের মতো স্বর্ণ-রূপায় সজ্জিত একটি কফিন, আমার মতো অতি সাধারণ একজন চাকরিজীবীর ঘরে কে আনবে? কেন আনবে?

কফিনটা খালি নাকি তাতে লাশও রাখা আছে সেটাও তো জানা নেই….

হঠাৎ আমার মনে হলো, যদি এটা অলৌকিক কোনো কাজ না হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই কারও পরিকল্পিত কোনো ষড়যন্ত্র। কিন্তু কে আমার সাথে এমন করবে? বিভিন্নভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

‘দরজা তো তালাবদ্ধ ছিল’—আমি আবারও প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করলাম। ‘চাবি এমন গোপন স্থানে রাখা ছিল, যা আমার ঘনিষ্ঠ কজন বন্ধু ব্যতীত আর কেউ জানে না। আমার কোনো বন্ধু, এই মৃত্যুর উপঢৌকন প্রস্তুত করে আমার জন্য পাঠাবে—এটা কী করে সম্ভব!

তাহলে হতে পারে কোনো মজুর ভুলে নিয়ে এসেছে। পরক্ষণেই মনে হলো, মজুর যদি এনে থাকে, তাহলে ও ঘরে ঢুকল কীভাবে? মজুরি না নিয়েই চলে যাবে কেন? আর আমার এখানে কফিনই বা কেন আনবে?’

এভাবে একেকটা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছিলাম আবার পরমুহূর্তে নিজেই সেই যুক্তিকে খণ্ডন করে দিচ্ছিলাম। সবশেষে আমার বিধ্বস্ত মস্তিষ্কে এই খেয়াল চেপে বসল যে—

“এইসব কারসাজি ওই রুহেরই, যে আমাকে আজ রাতে মৃত্যুর পরোয়ানা দিয়েছে। আর এই কফিন মূলত আমারই শব-যাত্রার জন্য প্রেরিত।”

কিন্তু শেষমেষ এই যুক্তিটাও আমার মস্তিষ্কে ঠাঁই পেল না। কারণ, কফিনটি ছিল আমার দৈহিক গঠনের চেয়ে অনেক বেশি ছোট।

 

২.

পুনরায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার মনে হতে লাগল, এ যেন আসমানের পক্ষ থেকে আমার মৃত্যুর শোকমিছিল। বাতাস এত তীব্র গতিতে বইছিল যে, আমার বহির্বাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ততক্ষণে ভিজে একাকার হয়ে গেছি। 

‘আমার কোথাও আশ্রয় নেওয়া উচিত’ অস্ফুটস্বরে বললাম। কিন্তু… যাব কোথায়? কফিন রাখা সেই কামরায়? অসম্ভব! সেখানে গেলে আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যাব।

কিন্তু তীব্র ঠান্ডার প্রকোপে ও প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব হচ্ছিল না। আমি দ্রুত রোস্তভ নামক এক বন্ধুর বাসার পথ ধরলাম। সে-ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ও সংকীর্ণ গলির একটা বাসায় থাকত।

দরজায় করাঘাত করলাম। কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় খটখটালাম, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সারা শব্দ পাওয়া গেল না। পাশে রাখা একটি তাকে হাত দিতেই পেয়ে গেলাম চাবি। তালা খুলে দ্রুত ঢুকে পড়লাম ভেতরে।

শরীরের ভেজা কোটটা খুলে ফেলে দিলাম ফ্লোরে। একটা চেয়ারের সাথে পা ধাক্কা লাগল। বসে পড়লাম সেটাতেই। ঘন তমসার কারণে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না কিছুই। বিক্ষুব্ধ বাতাসে জানালাগুলো দুলছিল। গির্জা থেকে থেমে থেমে ভেসে আসছিল ঘণ্টার ধ্বনি। বড়দিনের উৎসব এখনও শেষ হয়নি।

আমি পকেট থেকে ম্যাচ বের করে আগুন জ্বালালাম।

‘ও মাই গড, এখানেও!’ অনিচ্ছাকৃত আমার মুখ দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে এলো। আমি পাগলের মতো ছুটে ঘর থেকে বেরোলাম। 

এই ঘরেও কফিন রাখা ছিল। তবে আমার কামরায় দেখা কফিনের চেয়ে এটি আকারে কিছুটা বড়। এই কফিনটি ছিল কালো গিলাফ দিয়ে ঢাকা। কালো গিলাফ মোড়ানোর ফলে সেটিকে আরও বেশি ভয়ানক দেখাচ্ছিল। 

‘এখানেও সেই কফিন!’—আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। এখন মনে হতে লাগল এটা স্রেফ আমার কল্পনা। হয়তো আমার চোখ আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে। অসম্ভব নয় যে, এখন আমি যেখানেই যাব আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য কোনো ভীতিকর কফিন আমার সামনে এসে উপস্থিত হবে। নিশ্চয়ই আজ আমার স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা হয়ে গেছে! যেখানেই যাচ্ছি শুধু কফিন আর কফিন। আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি!

পাগল হওয়ার কারণটাও সুস্পষ্ট। ওই অশুভ আধ্যাত্মিক জলসা এবং স্পিনোজের শয়তান রুহ আমার মাথাটা নষ্ট করেছে।

আমি ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে দু হাতে শক্তভাবে মাথাকে ঢেকে ফেললাম। 

“এখন আমি কী করব? কোথায় যাব? আমি পাগল হয়ে গেছি!”

এসব আবোলতাবোল বকতে বকতে অজান্তেই আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। 

মনে হচ্ছিল এখনই বুঝি আমি সংজ্ঞা হারাব। পাদুটোর চলার শক্তিও নিঃশেষ হয়ে এসেছে। তীব্র ঠান্ডায় পুরো দেহ-শরীর থর থর করে কাঁপছিল। মাথায় টুপিও ছিল না, পরনের কোটটাও ছিল না। এগুলো এমন জায়গায় পড়ে আছে যেখানে আমি যেতেও পারব না। কারণ সেখানে… আহ! সে কি ভয়াবহ অসহ্য বেদনার্ত এক দৃশ্য ছিল!

 

৩.

আমার মাথার চুলগুলো তীরের মতো সোজা দাঁড়িয়ে গেছে। কপাল থেকে বেয়ে পড়ছো হিম শীতল ঘাম। এতক্ষণে আমি বিশ্বাস করে নিয়েছি যে, এখন পর্যন্ত যা কিছু আমি দেখেছি এগুলো সব আমার মানসিক রোগের প্রভাব এবং আমার বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কের কল্পনা জল্পনা। বাস্তবে এসব কিছুই ঘটেনি।

এখন আমি কী করব? কোথায় যাব? বারবার এই প্রশ্ন আমার করোটিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সহসা আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ল। ওর নাম শাহরুফ। কিছুদিন হলো সে ডাক্তারি ডিগ্রি লাভ করেছে। খুব কাছেই ওর বাসা। ওই আধ্যাত্মিক বৈঠকে সেও আমার সঙ্গে ছিল।

নিজের অজান্তেই ওর বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেলাম। ও ভাড়া থাকত বিল্ডিংয়ের একেবারে উপরের তলায়। আমি সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলাম, অকস্মাৎ উপর থেকে বিকট শব্দে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো। মনে হচ্ছিল কেউ দৃঢ়-পদে ফ্লোরে পা ফেলছে এবং নিচে তার ধুপধুপ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

পরমুহূর্তেই একটি ভয়ার্ত কণ্ঠের আর্তনাদ আমার কানে পৌঁছাল—বাঁচাও! বাঁচাও!

আমি কিছু ঠাহর করার আগেই লোকটি এসে আমার সঙ্গে ধাক্কা খেল।

‘শাহরুফ? শাহরুফ! বন্ধু তুমি? কী হয়েছে তোমার?’ আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। কারণ, এই ব্যক্তি অন্য কেউ না, আমারই বন্ধু, যার ঘরে আমি রওনা হয়েছিলাম। 

উপরের তলায় সিঁড়ির ধারে একটি বাতি জ্বালানো ছিল। প্রদীপটির নিভু নিভু আলোয় ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছিল চারপাশ। গলার স্বর শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরল ও। ওর পুরো শরীর কম্পমান। চেহারা হলুদাভ। চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, কোনো কারণে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে।

‘শাহরুফ!’ আমি আবারও আওয়াজ করে ওকে ডাকলাম।

‘ইভাচ? ইভাচ!’ শাহরুফের গলার স্বর কিছুটা বুলন্দ হলো। ‘ইভাচ তুমি? সত্যি সত্যি তুমি তো?’

শাহরুফ আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। আমাকে চিনতে পেরে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। 

‘কি হয়েছে তোমার? তোমার পুরো শরীর দেখি মৃত মানুষের মতো হলুদ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তুমি….

‘চুপ করো’—শাহরুফ আমাকে থামিয়ে দিল, ‘আমাকে একটু দম ফেলতে দাও।’ একটু থেমে ও পুনরায় বলতে লাগল, ‘উফ তোমাকে এই সময়ে দেখে আমার কি যে আনন্দ লাগছে!’

‘মরতে মরতে বেঁচে গেলাম। আধ্যাত্মিক ওই সভার উপর কোটি-কোটি অভিশাপ। ঈশ্বরই ভালো জানে, না জানি ওই মজলিস আমার জন্য আরো কত ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিবে! তুমি কি বিশ্বাস করবে, এইমাত্র যখন আমি ঘরে ঢুকেছি… উফ, সে কি ভয়ানক দৃশ্য! দেখি, ঘরের ঠিক মাঝ-বরাবর একটি কফিন।’

প্রথমবার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। এ তো দেখি হুবহু আমারই গল্প। আমি সন্দিহান হয়ে পড়লাম, আমি কি ওর কথা শুনলাম, না নিজের মস্তিষ্কের কল্পনা?

পরমুহূ্র্তেই আমি চমকে উঠে অর্ধ হাত পিছিয়ে গেলাম। ‘কফিন! কী বলছো তুমি? তুমি কফিন দেখেছ?’

শাহরুফ সুস্পষ্ট ভাষায় বলল, ‘হ্যাঁ, কফিন, বাস্তবেই কফিন দেখেছি। তুমি তো জানো, আমি এতটা ভীতু নই। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে তো স্বয়ং ভূতও ভয় পেয়ে পালাবে।’

শাহরুফের সঙ্গে ব্যস্ত থাকার ফলে এতক্ষণে আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আতঙ্কে আমার বুক দুরদুর করতে লাগল আবারও।

এরপর আমার সঙ্গে ঘটিত কাহিনিদুটি ওকে শুনালাম। শেষে আর্তনাদ করে উঠলাম—‘হে ঈশ্বর এ কেমন ভীতিকর আপদে ফেললে আমাদের! নিজের ঘরে গিয়ে দেখি কফিন, পালিয়ে গিয়ে বন্ধুর ঘরে আশ্রয় নিলাম—সেখানেও কফিন, এখন আবার এই বন্ধু বলছে, তার ঘরেও…!’

 

৪.

আমরা দুজন সিঁড়ির ধারে প্রজ্জ্বলিত বাতির কাছে এসে দাঁড়ালাম। একজন অপরজনের প্রতি উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমাদের মনে সন্দেহ জাগল, আমরা কি স্বপ্ন দেখছি? এই সংশয় একই সাথে উদিত হলো দুজনের করোটিতে। ফলে একসঙ্গে পরস্পরকে দুজনে চিমটি কেটে দিলাম। সত্যিই কি আমরা জেগে আছি নাকি স্বপ্নে ভাসছি!

‘না আমরা স্বপ্ন দেখছি না’, মুখ খুলল শাহরুফই। সে বলে চলল, ‘আমরা চিমটির ব্যথা অনুভব করতে পারছি। তার মানে নিশ্চয়ই আমরা জাগ্রত। আমরা যে কফিন দেখেছি, বাস্তবেই সেগুলো কফিন। এগুলো কেবল আমাদের অলীক কল্পনা জল্পনা নয়। বলো এখন আমরা কী করব?’

এরপর ‘কী করণীয়’ তা নিয়ে আমরা দুজন কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করলাম। শেষে স্থির হলো, সাহস করে উপরে যাব এবং চাকরকে জাগিয়ে, ওকে সঙ্গে নিয়ে শাহরুফের কামরায় প্রবেশ করব। 

 

৫.

চাকর হাতে বাতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আমরা দুজন চলছি ওর পিছনে পিছনে। সত্যিই ঘরের মধ্যখানে একটি কফিন রাখা ছিল। এই কফিনটি ছিল সাদা রেশমে মোড়ানো। চতুর্কোণে সুতো দিয়ে বিভিন্ন কারুকাজ করা। এখানে সেখানে দুএকটা ফুলের নকশাও ছিল।

কফিন দেখে চাকর নিজের বুকে ক্রুশের চিহ্ন এঁকে নিল।

‘এখন আমরা প্রকৃত বাস্তবতা জানতে পারব’ থেমে থেমে বলল শাহরুফ। ওর দেহ এখনও কম্পমান। ‘কি জানি! ভিতরে কোনো লাশ রাখা আছে নাকি খালিই পড়ে আছে!’

কিছুক্ষণ দ্বিধার ভেতর পার করে সাহস নিয়ে সামনে এগলো শাহরুফ। এরপর কফিনের ঢাকনা উঠিয়ে পিছনে সরে গেল ও।

আমরা ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি, লাশের স্থানে ছোট্ট একটা খাম পড়ে আছে।

 

৬.

আমার বন্ধু স্পন্দিত হৃদয়ে খামটা উঠিয়ে ভাঁজ করা কাগজ বের করল। সেখানে লেখা ছিল—

“ আমার প্রিয় বন্ধু শাহরুফ!

ইদানিং আমাদের আর্থিক অনটন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আশা করি সে খবর তোমার অজানা নয়। তারপরও সংক্ষেপে বলি।

আমার বড় ভাই পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে গেছে। আগামীকাল তার সকল সামানাপত্র নিলামে উঠবে। তুমি তো জানোই, ওর দোকানে কয়েকটা কফিন বাদে আর কিছু নেই। (কারণ ও শহরে কফিনের ব্যাবসা করে।) 

এখন আমাদের জন্য দীনতা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শেষে পরিবারের লোকেরা পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, রাত্রি থাকতে থাকতে যতগুলো কফিন সরানো সম্ভব, সেগুলো সরিয়ে ফেলা হবে। যেন নিলামের হাত থেকে অল্পকিছু হলেও রক্ষা পায়।

সুতরাং নিজের পরিচিত বন্ধুদের কাছে একটা করেকফিন পাঠিয়ে দিয়েছি। একখানা কফিন তোমার এখানেও পাঠানো হয়েছে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের বেশি তোমাকে এই কফিনের বোঝা বহন করতে হবে না। আর এইটুকু উপকারের জন্য আমি তোমার এবং আমার সকল বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

ইতি :

তোমার বন্ধু—

ইভান গোভে

 

৭.

এই ঘটনার পর তিন মাস পর্যন্ত আমি মানসিক রোগের চিকিৎসা চালিয়ে গেছি। এখনো মাঝেমধ্যে আমি যখন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি তখন ভয়ে দরজার কাছে এসে থেমে যাই। অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির কামরায় দেখা, কফিনের সেই দৃশ্য—আজও মনে পড়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Junaid bin Aziz
Junaid bin Aziz
1 year ago

কী সুন্দর একটা গল্প! এটার প্রতি আগেই লোভ হয়েছিল সম্পাদক মুহতারামের একটা পোস্ট দেখে। পুরো গল্পটা পড়ে এখন তার সেই পোস্টের যথার্থতা টের পাচ্ছি। এক বসায় রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে পড়ে ফেললাম সম্পূর্ণ গল্পটা। গল্পকার মাওলানা আযাদের এমন গল্প আরও চাই। জয় হোক সম্পাদকের!

Last edited 1 year ago by Junaid bin Aziz
তা মি ম
তা মি ম
21 days ago

এখানে মূল দর্শন কোনটি, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার নাকি ভয়ের উৎস! নাকি দুটোই!

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷