সূর্যের লালিমা নিয়া রাশি রাশি ফেনা আছড়াইয়া পড়তেছে এখানকার রুপালি তীরে। বাঁকা বাঁকা খেজুরের গাছগুলা তখন মন্থর পাতাপল্লব থেকে গত রাইতের ঘুম ঘুম ঝাইড়া ফেলতেছে; কাঁটা কাঁটা ডালপালা তারা ছড়ায়ে দিতেছে দিগন্তে—যেখানে কালচে নীলের উপর দাঁড়াইয়া আছে আক্কার দেয়ালগুলা; ছড়াইয়া দিতেছে ডানে হাইফা থেকে আসা পথে; এবং ডালপালা উত্তরমুখা কইরা যেখানে পাহাড়ের পিছন থেকে দেখা যাইতেছে সূর্যের বড় একখানা থালা; ফলে তরুলতার চূড়াগুলা এবং পানি ও পথগুলা তখন সকালের লাল লজ্জায় রক্তবেগুনি হইয়া উঠছে।
আহমেদ টুকরি থিকা একখান বাঁশের বাঁশি বাইর করে, তারপর গাড়ির এক কোনায় হেলান দিয়া সে বাজাইতে থাকে কোনো অনন্ত প্রেমিকের সুরে জখমি জখমি তিরস্কার—জমিনের তারাগুলার মতো ছিটানো গালিল শহরের লম্বা–চওড়ায় গ্ৰাম থেকে গ্ৰাম যার বাসস্থান।
সূর্যোদয়ের ঝিরি ঝিরি বাতাসে বাস আগাইতেছিল। জখমি সুর এমনেই শেষ হয়, যাত্রীদের কারো মধ্যেই চমকিত দেখা যায় না। তারা ভাবতেছিল এই সুর ভিন্ন কোথাও থেকে আসতেছে। এর গায়ককে চোখে না পড়াই তাদের চমকাইছে আসলে।
মাঠগুলা তখন ডানমুখা হয়ে বইতেছে। সেগুলো রক্তমাখা সবুজে ঢেউ খেলতেছে। ঢেউসব নিজের অনন্ত প্রচেষ্টাগুলা চালায়ে যাইতেছে রুপালি বালিরে মাউন্ট করার জন্যে। আর গাড়িঘোড়ার সেই ক্ষুদ্র দুনিয়ায়, বিষণ্ণ সুরতালে, একটা অন্যরকম অব্যক্ত অদৃশ্য যোগাযোগ তাদের বিশজনের মধ্যে তৈরি হইছে—কেবল আজকের সকালের সালাম বিনিময় ছাড়া যাদের কোনো পরিচয় ছিল না, যারা সবাই হাইফার বাদশা ফয়সাল রোডে গাড়ির অপেক্ষা করতেছে।
সেই ক্ষুদ্র দুনিয়া কানায় কানায় ভরা কর্মজীবী মানুষ দিয়া, বন্দর যেন হিংস্র বাতশোষকের মতো শুইষা নিছে তাদের—গালিলের সব অলিগলি থেকে এবং হাইফার কত কত কিশান, যারা কোনো বিস্মৃত কাল থেকে বিয়ের সুতায় বান্ধা; সাফাদ থেকেও কত নারী–পুরুষ; উম্মে ফারাজের এক শিশু, যার মা তারে হাইফা পাঠাইছে তার বাপ বাঁইচা কি না খোঁজ নিতে—যে উত্তরসমেত ফিরে আইছে এখন। তারপর আল–কাবরির এক জমির মোকদ্দমায় উকিল ব্যস্ত সময় পার করে, কোর্টে বসার আগেই তার শেষ করা লাগবে সমস্ত ইনকুয়ারি; এক মহিলা তার একমাত্র মেয়ের জন্যে পাত্রের সন্ধান করে যায়; ঝুড়িভরা খাবার আর পাতলা রুটি, চুলাগুলায় তখন রান্না করা কবুতর; বাচ্চাদের খেলনা, হুইসেল, অজানা থেকে অজানায় যাওয়া কত চিঠিপত্র; একদিন আগে স্কুল ছুটি হওয়া মেয়েটির নলখাগড়ার বাঁশি, এবং নিজের স্ত্রীর মতো রাস্তাঘাট চেনা কত ড্রাইভার।
হাইফা থেকে, রাস্তার দিকে—আঁকাবাঁকা, যেন গাঙরে নেকলেসের মতো শক্ত করে পেঁচায়ে রাখছে; যেন তা উপরে উঠতেছে যেখানে খেজুর গাছ ডালপালা বারবার ঝাঁকায়ে জাইগা থাকে আর সমু্ন্দর থেকে আসা বাতাসের লগে নীরব অথচ কঠিন লড়াইয়ে দিশা হারায়—ওই নাআমান নদীর পরে, যে ক্লান্ত দুঃখগুলা ঢাইলা দেয় অথচ তা গর্জন ঢেউয়ে কী স্বচ্ছ আর পরিষ্কার, এবং তা আবার ফিরায়ে দেয় পিছনে পরম নীরবতায়। সেখান থেকে গাড়িগুলা চইলা যায় আক্কার দিকে, মানশিয়া, সুমাইরিয়া, মাযরাআ আর নাহারিয়ার দিকে—যাতে সেগুলা পুবে যায় এবং দশ গ্ৰামের মধ্যে ডুইবা যায় সারাটা পথ ভইরা; সেইখানে ঝুড়ি, কারুর চিঠি কিংবা সেইখানে ইনতেযার আর না সওয়া কারুর স্ত্রী।
একজন পাশের লোকরে বলে :
—এই ছেলে দেখো ভালো বাঁশি বাজায়।
সে জবাব দেয় না। জানালার বাইরে তাকায়। নিজেরে ডুবাইয়া দেয় যেন কোনো মাখন পেয়ালার মধ্যে সুরের তালে তালে।
ছেলেটা মাথা ছাইড়া দেয় পাশে থাকা বৃদ্ধের কোলে এবং ঘুমায়ে পড়ে সে। আরেক মহিলা হাজির হয়—তাকে সে চেনে না—সিদ্ধ ডিমের বানানো পাতলা রুটি নিয়া, এবং সে বাচ্চাটা জেগে উঠলে তাকে খাওয়াবার ইনতেযারে থাকে। ড্রাইভার গানমতো সুরে গুনগুন গেয়ে যায় এক তরুণের গান, যে এখন পাহাড় উঁচায়ে তা রাইখা আসতে ঠিক প্রেমিকার বাড়ির উঠানে—যখন প্রেমিকা ইতস্তত করে তার সাথে পালায়ে যাইতে, যেখানে শুধু চাটাই, রুটি, যয়তুন আর তার বুক ছাড়া কিছুই নাই।
আক্কা। ডানে বাঁক ঘুরলেই প্রথমে জানালার সামনে একটা গোরস্থান, বামে স্টেশন—যেখানে এখনও আছে কুদসি পাথরে বানানো রুটির মতো ফাঁপা কিছু বাড়িঘর; পিছনে পাবলিক পার্ক যেখানে বড় বড় হলুদ সিনকোনা গাছগুলা দেখা যায়; দূরে দেখা যায় প্রাচীরের চূড়াগুলা—বাদামি পাথরের টাওয়ারলা আর তার ফাটল ছিঁড়ে বেরোনো সবুজ ঘাসপাতা। তারপর ডানে নতুন ছোট ছোট বাড়ি যেগুলা সারি সারি মেরুল ফুলে সাজানো। আর দিগন্তে সমতল চূড়া আর প্রশান্ত ঢালু নিয়া দাঁড়ায়ে থাকা তাল্লে ফাখের (মৃৎশিল্পের পাহাড়)—যেখানে প্রতিরোধের ওয়ারিশিস্বরূপ মৃত্যু লাভ করা সৈন্যদের কবর, প্রাচীরগুলাও যেখান থেকে তেমন দূরত্বে নাই। তারপর বামে আছে পাথরি ‘স্বাস্থ্যকরি ভবন’; এবং সেখানে এখনও জাগন্ত গ্যারেজের একটা সারি, সেইখানে সাজানো টায়ারগুলা একটার পর একটা উঁচা হইতেছে যেন সেগুলার মবেলরঙি গেটের সামনে ব্যারেল রাইখা দিছে; সেইখানে কত ভাঙাচোরা গাড়ি যেগুলার গায়ে জমিনের ঘাসপাতা বয়ে গেছে এবং সেগুলা মেরামত, ওজন কিবা জং ধরার অপেক্ষায়।
একজন নিজের কোট খুইলা দেয় ছেলেটার গায়ে। সালাহ নামি আরেকজন টুকরি থেকে কমলালেবু বের করে—খসা ছাড়ায়ে যথারীতি সৌজন্যে সে তা প্রতিবেশীরেই অফার করে। আর দুইজন যয়তুনের মৌসুম নিয়া আলাপে মশগুল। আরেক মোটাসোটা মহিলা যে গতবার হজ করে এসেছে, সে বলতেছে কীভাবে ইয়াফাতে ইহুদিরা এতিমখানা উড়ায়ে দিছে এবং কীভাবে তারা বাচ্চাদের লাশগুলা ফাটা কমলালেবুর বীজগুলার সাথে ইস্কান্দার ইওয়াজ রোডের ড্রেনে ড্রেনে ছড়ায়ে দিছে। ওরা মাইনটা রাখছিল কমলালেবু ভরা একটা গাড়িতে যা ঠিক এতিমখানার সিঁড়িতে থামানো হয়। তখন পাগড়িপরা একজন বুড়া লোক বলে উঠছিলেন—যে এতিমরে খুন করবে আল্লাহ তার হাত কাইটা দেবেন; আর কোনো শুবা–সংশয় নাই আল্লার এই প্রতিশোধে।
সকাল হবার পাঁচ মিনিট আগে। বাচ্চাটা চিৎকার দিয়া উঠে। বিহানের সুরুজ চকচক করছে। আরেকজন গাড়িটা ছেড়ে দেবার জন্য প্রস্তুতি নিতেছে। দেখা যায় শাকসবজি নিয়া একটা ছোট সাদা গাধার গাড়ি রাস্তার কোনা দিয়ে আগাইতেছে। তখন বাঁশির সুর থাইমা গেছে।
ড্রাইভার উঁচা গলায় বইলা উঠল :
—ভালো কিছু হইব ইনশাআল্লাহ।
লোকেরা সিটব্যাকের উপর দিয়া রাস্তার উঁকি দিতে থাকে। আহমেদ বলে :
—টহল।
কিন্তু সালাহ শোধরায়ে দেয়।
—না, এটা টহল না। ইহুদি।
হাজ্জা ‘ইন্নালিল্লাহ’ বইলা ওঠে।
গাড়ি তখন থাইমা যায়, ইঞ্জিন অফ করে দেয়।
—নেমে পড়ো তোমরা। বললেন গাঢ় সবুজ ইউনিফর্ম পরা একজন সোলজার, যার কাছে একটা ছোট মেশিনগান, ভিতর থেকে সে মাথা বের করতেছিল। প্রথমে ড্রাইফার বাচ্চাদের হাত আঁকড়ায়ে নামায়। তারপর মহিলারা নামে। আর সবশেষে পুরুষেরা।
প্রথমে তাদের সবাইরে তল্লাশি করা হয়। তারপর ঝুড়িগুলা ভেঙে ফেলা হয়, এবং তারপর সাবধানে গিঁট দেওয়া সাদা বান্ডিলগুলা খোলা হয়। যে সৈন্যদুইটা এই কামে রত ছিল তাদের কমান্ডার—যে মোটা খাঁটো এবং মাজায় তার ছোট পিস্তল বান্ধা এবং যার কাছে একটা কালো লাঠি—তারে নিশ্চিত করে যে, এই ঝুড়ি আর বান্ডিলে কোনো ধরনের অস্ত্রপাতি নাই।
খাঁটো কমান্ডার পাশের সৈন্যটারে বলে :
—বাচ্চাটারে আনো এইখানে।
তারপর কমান্ডার নিজের লোকেদের দিকে আঙুল গোলাকার করে একরকম ইঙ্গিত দিতেই তারা রাস্তার পাশে পুরুষ–মহিলাদের কাতারবদ্ধ করতে লাইগা যায়—ঠিক তাদের পিছনে পানির স্রোত বইতেছে। তারপর গুণে শেষ করে হিব্রুতে ঘোষণা দেয় —‘পঁচিশ’।
কমান্ডার কালো লাঠি দিয়া রানে আস্তে নিজের পায়ে আঘাত করে। আর বাচ্চাটা তার পাশেই—তার সেদিক কোনো খেয়াল নাই। কমান্ডার স্থির ক্ষুদ্র পদক্ষেপে কাতারের সামনে যায়, এবং সে বলতে শুরু করে :
—মনে রাইখো হে আরব… এইটা যুদ্ধ। তোমরা নিজেদের বাহাদুর বলো, আর আমাদের সামান্য ইঁদুর ভাবো, তাহলে আইসো এদিক…
একটা ছোট গাড়ির পিছন থেকে ছোট প্যান্ট পরা একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখা গেল, তার কাঁধে মেশিনগান। সে রাস্তার অপর পাশে খালি পায়ে দাঁড়ায়ে।
—তোমার আজকের হিসসা এই নাও।
তারা সবাই গর্তে পইড়া গেল। তাদের মুখ কাঁধগুলো কাঁদায় ডুইবা গেল। রক্তে রঞ্জিত ঠাসা একটা স্তূপ হয়ে গেল ততক্ষণে। তখন তাদের শরীরের নিচ থেকে একটা রক্তাক্ত লাল সুতা বইতেছে। তারপর রক্তগুলা জমা হয়া দক্ষিণে নদীর পানিতে মিইশা গেল।
মোটা লোকটা তখন একটু নিচে ঝুঁইকা বাচ্চাটার কান ধইরা কয় :
—দেখছিস না? ভালো করে দেখ। ভালো করে মনে গাঁইথা রাখ। সবাইরে বলবি এই কাহিনি…
তারপর সোজা হয়া দাঁড়ায়। কালো লাঠিটা দিয়া বাচ্চাটার পিছনে চাপড় দিয়া সামনে যাইতে কয় সে :
—তাড়াতাড়ি দূর হ। এক্ষনি দূর হ। আমি দশ পর্যন্ত গুণব। যদি একদম দূর না হোস তাইলে আগুনে জ্বালায়ে দেবো তোরে।
কিছুক্ষণ পর্যন্ত বাচ্চাটি কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কতক্ষণ আশপাশের গাছগুলার মতো স্থির থাকল সে।
তার চোয়াল ভেঙে গেছে। গর্ত আর খালি পায়ের তরুণীর মাঝখানে সে নিজের ভাঙা দাঁতগুলা দেখতে পায়।
আবার সে কালো লাঠির আঘাত পাইল। বুঝতে পারল মাংস খসে পড়তেছে। পাদুটা ছড়ায়ে দেওয়া ছাড়া তার কাছে ভালো কোনো অপশন নাই তখন। পুরা রাস্তা তার চোখের সামনে একটা ঘূর্ণিচক্র, কুয়াশা আর কান্নায় নেয়ে গেছে।
কিন্তু তারপরও তার কানে অট্রহাসিগুলা ভাইসা আসে বারংবার। সে বুঝতে পারে না কী হইল, কেন হইল। সে উইঠা দাঁড়ায়, দুই হাত প্যান্টের পকেটে রাইখা সে নিশ্চিন্ত হাঁটতে থাকে, একবার পিছনেও তাকায় না। সে কেবল নীরবে নিজে নিজে গুণতে থাকে :
—এক… দুই… তিন…
বৈরুত, ১৯৬৯
গাসসান কানফারির ভাংচুর গদ্যের তরজমা আসলেই চ্যালেঞ্জের বিষয়। আর বিদেশি সাহিত্যের কাজ আরো বেশি বেশি হওয়া দরকার।
গল্পে শরিফ ভায়ের নতুন অভিজ্ঞতা—ভালোই হইছে।
এই অনুবাদ বুঝতে আমার ঘাম ঝরে গেছে। প্রথমত,অনুবাদে আঞ্চলিক টোনের এই ব্যবহার আমার একদমই পছন্দ না।দ্বিতীয়ত, বাক্যে প্রচুর জটিলতা।যে,যার ইত্যাদি অব্যয়ের ব্যবহার কমিয়ে জটিলতা কমানো যেত।
পুরোটা পড়া সম্ভব হলো না। গল্পের ভেতরেই ঢুুকতে পারলাম না। অনুবাদ সাবলীল লাগল না।
আঞ্চলিকতার কারণে দুর্বোধ্য লেগেছে।