এডওয়ার্ড সাঈদ : দ্য ভয়েস অফ প্যালেস্টাইন

মূল : ড. ইমতিয়াজ আব্দুল কাদির

কাজী একরাম

লোকটি তার বারো বছরের বাচ্চাকে নিয়ে প্রাচীরের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তার ডানদিকে ছিল ইসরায়েলি সৈন্য এবং তাদের বিপরীতে ছিল ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনী। তার ঠিক সামনেই ছিল ইসরায়েলি ঘাঁটি। আমি তখন কী করতে পারি। রাস্তা পার হওয়াও সম্ভব ছিল না। গুলির মতো বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছিল। আমার চারপাশের শিশুরা ভয় ও আতঙ্কে কাঁপছিল; চিৎকার করছিল। এদিকে, আমি আমার ক্যামেরা মারফত দেখলাম, যে শিশুটি তার বাবার সাথে গুলি থেকে পালাতে চেষ্টা করছিল, গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে। সাথে সাথে তার বাবাকেও গুলি করা হয়েছে, কিন্তু সে হাত নেড়ে সাহায্যের জন্য ডাকছিল, গুলি বন্ধ করতে অনুরোধ করছিল। এই মুহূর্তে আমাকে যা চিন্তা করতে হয়েছিল, তা হলো আমি যা কিছু শুট করেছি; আমাকে তা রক্ষা করতে হবে, কারণ এটি আমার জীবিকা। কিন্তু আমি নিজেকে নিয়েও চিন্তিত ছিলাম, আমি জানতাম এই ছবি মূল্যবান বটে, তবে মানুষের জীবনের (আমার নিজের জীবন) চেয়ে বেশি নয়। আমি যখন ভাবছিলাম, তখন একটা গগণবিদারী শব্দ আর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। ধোঁয়া পরিচ্ছন্ন হবার আগ পর্যন্ত বারো বছরের ছেলেটি বেঁচে ছিল। দেখলাম, ছেলেটি তার বাবার কোলে নিথরদেহে শায়িত। বাবা দেয়ালের সাথে লেপ্টে আছেন, নিশ্চল, নিষ্ক্রিয়। আমি যখন অফিসে ফিরে যেতে লাগলাম, একটি সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তাকে জিজ্ঞেস করলাম হতাহতের সংখ্যা কত? তিনি জানালেন, তিন। আমি বললাম আরও দুই যোগ করুন। এই বলে বাবা-ছেলের ভিডিওটি দেখালাম ভিডিও দেখে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার জবান থেকে বেরিয়ে আসল—‘হায় আল্লাহ, এই হলো জামাল আর এই হলো মুহাম্মদ, এরা উভয়ে বাজারে গিয়েছিল।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি তাদের চেনেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এরা আমার শ্যালক ও ভাতিজা।’

 

এটি ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০০০ সালের একটি ঘটনার বিবরণ, যা গাজায় বসবাসকারী সাংবাদিক তালাল আবু রাহমা বর্ণনা করেন। তিনি ফ্রান্স ২ (টিভি) এর জন্য কাজ করতেন। পিতার নাম জামাল আল-দুরা এবং পুত্রের নাম ছিল মুহাম্মদ আল-দুরা। সে সময়, ছবিটি সারা বিশ্বের সংবাদপত্রে ছাপা হয়। বড় বড় পত্রিকাও তাদের প্রথম পাতায় এটিকে স্থান দেয়। ফিলিস্তিনিরা এটিকে ‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদা’র সবচেয়ে আলোচিত ও ঐতিহাসিক চিত্র বলে মনে করেন। ভিডিও থেকে নেওয়া ছবিগুলির একটি সিরিজ স্পষ্টভাবে দেখায় যে, কীভাবে মুহাম্মদকে গুলি করা হয়েছিল আর সে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, এবং তার বাবার গায়ে গুলি বিদ্ধ হচ্ছিল।

মুহাম্মদের বাবা জামাল আল-দুরা আহত হলেও বেঁচে যান। এনডিটিভির সাম্প্রতিক এক খবরে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদের শাহাদাতের ৩২ বছর পর জামাল আল-দুরা এখন তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে কাঁদছেন আর এই বলে শোকের বর্ণনা দিচ্ছেন—‘গাজা উপত্যকায় আমার ছেলের রক্ত ​​এখনো বইছে। আজ থেকে ৩২ বছর আগে আমার ছেলে শহীদ হয়েছিল। আর আজ ইসরায়েলি সেনারা আমাদের বাড়ি টার্গেট করে, যার ফলে আমার দুই ভাই, ভাবী ও আমার ভাতিজি আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। আমার অনেক প্রতিবেশীও মারা গেছেন, যাদের অধিকাংশই শিশু। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বিশেষভাবে শিশুদের টার্গেট করে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সেনারা প্রতিদিন একটি করে শিশুকে হত্যা করে।’

এটাই ফিলিস্তিনের প্রাত্যহিক জীবন। চেকপোস্টে কখন কাকে থামানো হবে, কখন কাকে তল্লাশি করা হবে, কখন কোন বাড়ির ওপর দিয়ে বুলডোজার চলে যাবে, কখন কোন এলাকা গুলির শব্দে প্রতিধ্বনিত ও প্রকম্পিত হতে শুরু করবে, কেউ জানে না। আজ গাজায় বর্বরোচিত বোমাবর্ষণ চলছে, আমরা সেখানকার খবরা-খবর মনোযোগ সহকারে শুনছি ও দেখছি। কাল যুদ্ধ থেমে যাবে এবং সবকিছু ‘নরমাল’ হয়ে যাবে। তারপর আমরাও স্বাভাবিক হয়ে উঠব; কিন্তু ফিলিস্তিন নামের সেই অঞ্চলটি কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। যুদ্ধ সেখানে চলতেই থাকে, ছোট হোক বা বড়, সংবাদমাধ্যমে আসুক বা না আসুক, শরীরের রক্ত ​​ঝরুক বা জমে যাক! এ এক করুণ কাহিনি, মানুষ ও মানবতার ট্রাজেডি। হ্যাঁ, এটি ‘সভ্য’ পৃথিবীর একটি কুৎসিত চেহারা।

কেন তবে এ যুদ্ধবিগ্রহ? রক্তের এই হোলির হেতু কী? মুক্ত পৃথিবীতে কেন এই নির্দয় দাসত্বের শৃঙ্খল?

কেন? কখন? কী জন্য? 

এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব নিহিত ও বিবৃত আছে জনৈক নিরপেক্ষ ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান, আত্মবোধসম্পন্ন ফিলিস্তিনি নাগরিক এডওয়ার্ড সাঈদের লেখালেখি ও বক্তৃতামালায়।

এডওয়ার্ড সাঈদ জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ করেন। জেরুজালেম এবং মিশরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর আমেরিকায় চলে আসেন এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এখানে বাউডইন (Bowdoin) পুরস্কারেও ভূষিত হন সাঈদ। ১৯৭৪ সালে, এডওয়ার্ড সাঈদ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। ১৯৭৫-৭৬ সালে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান এবং আচরণ-বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষা বিভাগে ফেলো হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য-সমালোচনার উপর বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯৭৯ সালে আরেকটি বিখ্যাত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি, জন হপকিন্স-এর মানবিক বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। এর পরে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন।

এডওয়ার্ড সাঈদের গ্রন্থগুলো এ পর্যন্ত আটটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি তাকে তার ‘বিগিনিংস : ইনটেনশন অ্যান্ড মেথড’ (Beginnings: Intention & Method) গ্রন্থের জন্য প্রথম বার্ষিক ট্রিলিং (Trilling) পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে, তার Orientalism গ্রন্থটি আমেরিকার ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল পুরস্কারের সমালোচনা বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “Literature and Society” Ges “Conrad and the Fiction of Autobiography’। সাঈদ প্যালেস্টাইন জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ফিলিস্তিনিদের অবস্থান জোরালোভাবে উপস্থাপন করার দায়ে (!) জায়নবাদীরা শুধু মৌখিকভাবে নয়, শারীরিকভাবেও তাঁর উপর আক্রমণ করেছে। ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৩ এ নিউ ইয়র্ক সিটিতে তাঁর প্রয়াণ হয়।

লেখনী, বক্তৃতা ও তৎপরতা—তিন ক্ষেত্রেই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের এক অত্যন্ত দক্ষ ও সক্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত এডওয়ার্ড সাঈদ। উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়ন ও গবেষণায় তার রয়েছে অসাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রাচ্যতত্ত্বের ধারণায় এডওয়ার্ড সাঈদ সামগ্রিকভাবে অনেক বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক এবং সমালোচকদের প্রভাব স্বীকার করেন, যাঁদের মধ্যে জ্যঁ-পল সার্ত্র (১৯০৫-১৯৮০), মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪), আন্তোনিগ্রামসি (১৮৮৯-১৯৩৭) এবং জোসেফ কনরাড (১৮৫৭-১৯২৪) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাঈদের মতে, ঔপনিবেশিকতার সময় প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী সরকারের জন্য স্থায়ী ভূমিকা পালন করেছিল। তারা পরাধীন জনগণকে বুঝিয়েছিল ঔপনিবেশিকতাই তাদের সমৃদ্ধি, শান্তি ও অগ্রগতি এনে দেবে।

এডওয়ার্ড সাঈদ বিশিষ্ট ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের ধারণা ও রচনার বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, যারা প্রাচ্যবাদকে বিশেষ দিক-মাত্রা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ আর্থার জেমস বেলফোর (১৮৪৮-১৯৩০)। বেলফোর তার অসাধারণ একাডেমিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানের কারণে ব্রিটিশ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ঔপনিবেশিকতার পক্ষে যুক্তি দেন যে, ইউরোপ তার অধিকৃত অঞ্চলে তার সেরা সেরা মস্তিষ্ক অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী-বিশেষজ্ঞদের প্রেরণ করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করে। পরাধীন ভূখণ্ড শাসন করা পশ্চিমাদের অনুগ্রহ। সাঈদ ঔপনিবেশিকতা সম্পর্কে বেলফোরের এ তত্ত্বের সমালোচনা করেন। তার দৃষ্টিতে, মিশরে ব্রিটেনের উপস্থিতি ছিল সম্পূর্ণতই সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যের অধীন। প্রখ্যাত লেখক ও সমালোচক নাসির আব্বার নায়ার সাঈদ সম্পর্কে তার মতামত এভাবে প্রকাশ করেছেন :

Saids major contribution was to see colonialism as rooted in an epistemological inquiry and project: constructing the orient. Orientalism is this European construction of the east as primitive, savage, pagan, undeveloped and criminal. such a construction then enabled the European to justify his presence, the poor, weak native needed to be governed and developed, and it was the task of the European to do so. Oriental reality is interpreted in particular ways, Ways that are usable by the Europeans. Thus, Hindu and Islamic religious texts and beliefs are constructed with in this discourse as pagan, primitive and requiring reform. (Contemporary, literary and cultural Theory; P. 160.61)

সাঈদ ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত তার দুটি গ্রন্থ, ‘ওরিয়েন্টালিজম’ এবং ‘দ্য কোয়েশ্চেন অফ প্যালেস্টাইন’ দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। ফুকো, ফ্রাঞ্জ ফ্যানো, রাইমুন্ডোলেমস এবং ইব্রাহিম আবুলগুর দ্বারা অনুপ্রাণিত ৩২ বছরের সাহিত্যের শিক্ষকের এ গ্রন্থ দুটি পশ্চিমা জ্ঞানিক ঐতিহ্যকে জেরা করে দেখায়, কীভাবে পশ্চিমা পণ্ডিতদের মাধ্যমে (প্রাচ্যের মানুষ) বিশেষ করে আরব, তাদের সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে উৎপাদিত জ্ঞান প্রাচ্যের ওপর পশ্চিমের ঔপনিবেশিক দখলকে শক্তিশালী করতে কাজ করেছে। কীভাবে পশ্চিমের চিন্তাবিদ, শিল্পী ও লেখকদল জান্তে-অজান্তে প্রাচ্যের হীনমন্যতার মিথ তৈরিতে লিপ্ত হয়েছে, যা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ভিত তৈরি করে দেয়। এবং, তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূল্যবোধ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদকে প্রভাবিত করেছিল।

সাঈদের সকল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে Orientalism বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি মিশেল ফুকোর Truth, Knowledge, Power তত্ত্বের আলোকে প্রাচ্যের উপর পশ্চিমের নিয়ন্ত্রণবিধিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন এ গ্রন্থে। ইম্পেরিয়াল কালচার নিয়ে সাঈদের আগে, ফ্রাঞ্জ ফানোঁ তার বইয়ে (১৯৬১) ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন যে, ঔপনিবেশিকতা একটি জাতির অতীত এবং বর্তমানকে তার নিজস্ব এজেন্ডা অনুসারে পুনর্গঠন করতে কাজ করে। তাই উপনিবেশিতের (Colonized) প্রথম কাজ হওয়া উচিত তার আদি অতীত পুনরুদ্ধার করা। প্রাচ্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাঈদ আন্তোনিও গ্রামসির Hegemony ধারণারও ব্যবহার করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা সাঈদের এ গ্রন্থটির মাধ্যমে শুরু হয়েছে এবং আজ এটি একটি নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স হিসেবে বিবেচিত। সাঈদের এ গ্রন্থ ইউরোপ ও পাশ্চাত্য কেন্দ্রিকতাকে ইনকার করে। এমন নয় যে, এই বিষয়ে সাঈদ প্রথম বলেছেন। কিন্তু সাঈদই প্রথমবারের মতো শক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তিতে পাশ্চাত্যের ধারণায় প্রাচ্যের উপর ছেয়ে থাকা আস্তরণকে প্রামাণিক পদ্ধতিতে উন্মোচন করেছেন।

ফিলিস্তিন সমস্যা কয়েক দশক ধরে অমীমাংসিত। ১৮৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে, জায়নবাদী উপনিবেশবাদীদের প্রথম কাফেলা ফিলিস্তিনের উপকূলে এসে ভিড়তে থাকে এবং ১৯৬৭ সালের মধ্যে এই উর্বর অঞ্চলটি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত হওয়ায় এডওয়ার্ড সাঈদ পশ্চিমাদের আগ্রাসন এবং ইহুদিদের জোরপূর্বক দখলদারত্বের বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদ করেন। তিনি তার The Question Of Palestine (১৯৭৮) গ্রন্থে কলোনাইজারের কুৎসিৎ মুখোশ উন্মোচন করেন। ইউরোপ ও আমেরিকার দ্বৈত নীতি ও পক্ষপাতদুষ্টতাকে নগ্ন করেন নিদারুণভাবে।

এডওয়ার্ড সাঈদ উক্ত গ্রন্থে যেসব মৌলিক বাহাস, যেমন জায়নবাদ কী? কোথা থেকে এর উৎপত্তি? এর প্রচারের জন্য ইহুদিরা কী চাতুরি করেছে? পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা ফেরেব-প্রতারণার কী কী জাল বিস্তার করেছে? তথাকথিত উদারপন্থি বুদ্ধিজীবী, ঔপন্যাসিক, কবি, কলামিস্ট, ভ্রমণ-লেখক এবং জায়নবাদের অন্যান্য সহানুভূতিশীলরা কীভাবে পরিবেশকে মসৃণ করে তুলেছে? স্বয়ং জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনে বসতি গাড়তে কী কী তদবির কাজে লাগিয়েছে এবং নিজেদের দাবিকে সত্য প্রমাণ করার জন্য কীরূপ বয়ানের আশ্রয় নিয়েছে? এভাবে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের কিভাবে নির্বাসিত করা হয় এবং সকল দাবি-দাওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি কীভাবে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়েছে? ফিলিস্তিনিরা কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করেছে এবং কীভাবে ফিলিস্তিনি কবি, গল্পকার, অন্যান্য লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা এ আন্দোলনের জন্য জমিকে উর্বর ও মসৃণ করেছে? পিএলও এবং অন্যান্য আন্দোলন কিভাবে অস্তিত্বে এলো? ছিয়াত্তরের যুদ্ধের ফলাফল কী ছিল? ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির কী ফল হয়েছিল? ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান কী?… এবং বিবিধ প্রশ্ন ও প্রসঙ্গকে সাঈদ তাঁর গ্রন্থটির বিষয়বস্তু করেছেন এবং তিনি সে-সবের উপর যে বিস্তৃত আলাপ করেছেন, তা আমাদের এ বিষয়টিকে সঠিক পটভূমিতে দেখতে দারুণ সহায়তা করে। সাঈদ তার বইটি লিখেন ইহুদিবাদের মুখ ও মুখোশ এবং এ ব্যাপারে পাশ্চাত্যের তথাকথিত উদারপন্থি রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণ্য ভূমিকাকে নগ্ন করার উদ্দেশ্যে। তিনি তার লক্ষ্যে কতটা সফল হয়েছেন, তা এ থেকে অনুমান করা যায় যে, জায়নবাদীরা এ বইটিকেই বাজার থেকে গায়েব করে দিয়েছিল!

সাঈদ এই নীতির পোষক যে, কোনো মানুষ বা জাতিকে কোনো অবস্থাতেই তাদের স্বদেশ, জাতীয় পরিচয় বা সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। বেদনাভরা কণ্ঠে, লাখো ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর হয়ে তিনি ‘সভ্য’ বিশ্বের উদ্দেশ করে বলেছেন, “আমি একটি জিনিস উল্লেখ করছি, যদিও তা দিবালোকের চেয়ে স্পষ্ট, এজন্য যাতে এই মৌলিক অস্তিত্বগত নীতির গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যার উপর আমার ধারণায়, একটি জাতি হিসাবে আমাদের অভিজ্ঞতা নির্ভর করে। আমরা ফিলিস্তিন নামক এক দেশে বাস করতাম। যেভাবে আমাদেরকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে এবং যেভাবে আমাদের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে, এই সব কি কেবলমাত্র এজন্য বৈধ ছিল যে, যাতে সেই ইহুদিদেরকে, যারা নাৎসিবাদের গ্রাস থেকে বেঁচে গিয়েছিল; আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে? (ইহুদিদেরকে আশ্রয় দেওয়া প্রশংসনীয়, কিন্তু) এই প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রায় এক মিলিয়ন ফিলিস্তিনিকে আমাদের মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে এবং আমাদের সমাজকে অস্তিত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে। কোন সেই নৈতিক বা রাজনৈতিক মানদণ্ড, যার ভিত্তিতে আমাদের থেকে এমনটা আশা করা হয় যে, আমরা আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব; আপন মাতৃভূমি ও আপন মানবিক অধিকারের দাবি থেকে সরে আসব? যখন একটি গোটা জাতিকে এই সংবাদ দেওয়া হয় যে, সে আইনত গরহাজির, এমনকি তার নাম-চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীও ব্যবহার করা হয়, প্রোপাগান্ডা চালানো হয়, তার ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়া হয় বিশ্বকে এটা বোঝানোর জন্য যে, তার কোনো অস্তিত্বই নেই, আমাদেরকে তবে বলে দেওয়া হোক কোথায় এমন জগৎ রয়েছে, যেখানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড এবং অপকৌশলের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি কাজে লাগতে পারে না?” [1]The Question Of Palestine, পৃ. ১৭

সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার পথিকৃৎদের এহেন ধারণাকে, যে, তারা পৃথিবীতে সভ্যতা, মানবতা এবং উন্নয়নের বিস্তারের জন্যই ‘অনাবাদী’ বা ‘অসভ্য’ জাতিগুলির উপর চড়াও হয়, সমালোচনা করে সাঈদ প্যালেস্টাইনের প্রেক্ষিত থেকে বলেন, “বহু শতাব্দী ধরে এই ভূমিতে একটি বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের বসবাস ছিল, যা সিংহভাগ কৃষকদের নিয়ে গঠিত হলেও, এটিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি জাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এই জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল আরবি এবং ধর্ম ছিল ইসলাম। এই জাতি নিজেদের পরিচয় দিত এই ভূখণ্ডের সূত্রে; যার বুক চিরে তারা শস্য ও নানা ফসল চাষ করত এবং যাতে তারা নিজেদের পশুগুলি চরাত।” [2]প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২

প্যালেস্টাইন কোনো জনশূন্য, মানববসতিহীন বা অনুর্বর ভূমি ছিল না যে, যাকে দখল করে আবাদ করা এবং এর ‘অসভ্য’ জনগণকে সভ্য করার চেষ্টা করা হবে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতেই ফিলিস্তিন একটি আরব ও মুসলিম দেশে পরিণত হয়। গোটা ইসলামি দুনিয়ায় এর উর্বরতা ও সৌন্দর্যের কারণে; এর ধর্মীয় গুরুত্বের কারণেও, এর ভূগোল এবং বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল সুবিদিত। এডওয়ার্ড সাঈদ জ্যাক লে স্যাট্রাঞ্জের ’প্যালেস্টাইন আন্ডার দ্য মুসলিমস : এ ডিস্ক্রিপশন অব সিরিয়া অ্যান্ড হোলি ল্যান্ড ফ্রম এডি 650 থেকে 1500’ বইটির বরাত দিয়ে লিখেন, ‘‘ফিলিস্তিন সিরিয়ার প্রদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পশ্চিমের প্রদেশ। এর দীর্ঘতম প্রসারণটি রাফাহ থেকে শুরু হয়ে হাজ্জুনের সীমান্তে শেষ হয়েছে। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে একজন ঘোড়সওয়ারের দুই দিন সময় লাগবে। বৃষ্টি ও শিশির ফিলিস্তিনকে সেচ দেয়। এর গাছপালা এবং চাষের জমিতে কৃত্রিম সেচের প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র নাবলুসে আপনি এ উদ্দেশ্যে প্রবাহিত জল ব্যবহার করা দেখতে পাবেন। সিরিয়ার প্রদেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন সবচেয়ে উর্বর। এর রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর রামাল্লা। কিন্তু জনসংখ্যা ও আয়তনের দিক থেকে বায়তুল মাকদিস প্রায় এর সমান। ছোট আয়তন সত্ত্বেও, ফিলিস্তিনে প্রায় বিশটি মসজিদ এমন রয়েছে, যেখানে জুমার খুতবা দেওয়া হয় এবং নামাজ আদায় করা হয়।” [3]প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬

জ্যাক লে স্যাট্রাঞ্জের উল্লিখিত বইটি প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন মুসলিম ভূগোলবিদদের লেখাপত্রের প্রতিফলন। প্রাচীন ফিলিস্তিন কীরূপ জনবহুল ছিল এবং মুসলমানদের সমৃদ্ধির উদ্ধৃত মানচিত্রটি মুসলিম ভূগোলবিদ ইবনে হায়কলের লেখার রূপায়ন। এতে দেখা যাচ্ছে যে, শহরটি অর্থনৈতিকভাবেও স্থিতিশীল ছিল এবং বিশ্বাসের দিক থেকে এটি ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আবাসস্থল। ১৫১৬ সালে, ফিলিস্তিন উসমানী খিলাফতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এর একশ বছর পরে, জনৈক ইংরেজ কবি জর্জ স্যান্ডস নিম্নলিখিত শব্দযোগে প্যালেস্টাইনের এই মানচিত্র আঁকেন : “এই সেই দেশ যেখানে দুধ ও মধুর নদী প্রবাহিত হয়। এটি বাসযোগ্য বিশ্বের হৃদয়, এর জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। এটি সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর পর্বতমালা এবং উর্বর উপত্যকায় শোভা পায়। এর শিলাগুলি থেকে সতেজ জল উৎসারিত হয় এবং এর এমন কোনও অঞ্চল নেই, যা নান্দনিকতা বা সুবিধা বর্জিত।” [4]প্রাগুক্ত পৃ. ৩৭

পশ্চিমা এবং আমেরিকান লেখকরাও ইহুদিদের জোরপূর্বক দখলদারিকে ‘বৈধ’ হিসেবে দেখাতে তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আঠারো এবং উনিশ শতকে, মার্ক টোয়েন (আমেরিকান সাংবাদিক); ল্যামার্টিন (ফরাসি রাজা); নেভাল (ফরাসি লেখক); ডিসরাইলি (ব্রিটেনের ইহুদি প্রধাানমন্ত্রী ও লেখক) প্রাচ্য সম্পর্কে যেসব ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন, সেগুলোতে আরবদেরকে চিত্তাকর্ষণহীন এবং অনুন্নত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও ফিলিস্তিনে আরবদের বসবাসের বিষয়টিও প্রকাশ করেছেন তারা। স্বয়ং ইসরায়েলি সূত্রের বরাতে সাঈদ বর্ণনা করছেন, ইসরায়েলি সূত্র অনুসারে, ১৮২২ সালে ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদিদের সংখ্যা চব্বিশ হাজারের অধিক ছিল না এবং এ সংখ্যাটি দেশের মোট জনসংখ্যার, যার অধিকাংশই ছিল আরবদের, দশ শতাংশেরও কম ছিল। [5]প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪

সাঈদ বিংশ শতাব্দীর আদমশুমারিও উপস্থাপন করেন। আদমশুমারিটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Anglo Palestine Years Books 1947; (১৯৪৮ সালে প্রকাশিত) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সাঈদ লিখেছেন, যদিও ১৮৮২ সাল থেকে ইহুদি দখলদার ক্রমাগত ফিলিস্তিনে প্রবেশ করছিল, কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে ১৯৪৮ সালের বসন্তের কয়েক সপ্তাহ আগ পর্যন্তও, যখন ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে আরবদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল এক কোটি তেত্রিশ হাজার তিন হাজার চৌদ্দ। এতে ইহুদির সংখ্যা ছিল মাত্র এক লাখ চুয়াত্তর হাজার ছয়শ। ১৯৩৬ সালে, ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে তিন লাখ চুরাশি হাজার আটাত্তরে পৌঁছে যায়, যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল তেরো লাখ ছেষোট্টি হাজার ছিয়ান্নব্বই। ১৯৪৬ সালে, মোট জনসংখ্যা ছিল উনিশ লক্ষ বারো হাজার একশ বারো এবং ইহুদিদের সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ আট হাজার দুইশত পঁচিশ। [6]প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭

ইহুদি নেতাদের ধূর্ততার কথাও সাঈদ স্পষ্ট করেছেন। অস্ট্রিয়ান-হাঙ্গেরিয়ান নাগরিক থিওডর হার্জলকে (১৮৬০-১৯০৪) ‘জায়নবাদ’ এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক এবং জায়নবাদের মূল দস্তাবেজ তারই রচিত। তার উল্লেখ করে সাঈদ লিখেন, ১৮৯৫ সালে তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন যে, প্যালেস্টাইন সম্পর্কে কিছু একটা করতেই হবে। এই বিষয়ে হার্জল যে শব্দগুলি ব্যবহার করে, তা ছিল এরূপ : আমাদের নিজেদের দেশে নিঃস্ব ও দরিদ্র মানুষকে তাদের কর্মসংস্থানের সমস্ত উপায় থেকে বঞ্চিত করতে হবে এবং করিডোরের দেশগুলিতে তাদের জীবিকার উপায় খুঁজে বের করে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দিতে হবে। কিন্তু দরিদ্র ও নিঃস্ব জনগণের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাদের নির্বাসন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সতর্কতা, ভব্যতা, বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। [7]প্রাগুক্ত পৃ. ৩৯

ফিলিস্তিনের ভিতর ইসরায়েল গজিয়ে তোলার পরিকল্পনা এবং কৌশলগুলি যে কতটা নিষ্ঠুর এবং নৃশংস ছিল তার একটি আভাস দেখা যায় ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে একটি ইসরায়েলি জার্নালে হারে তাজ-এ মোশে দায়ানের বক্তব্য থেকে। সাঈদ সেই বক্তব্যও তার গ্রন্থভুক্ত করেছেন। মোশে দায়ান ছিলেন একজন বিখ্যাত ইসরায়েলি জেনারেল এবং রাজনীতিবিদ। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বেশ কয়েক বছর ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠন ‘হাগানাহ’-এর প্রধানও ছিলেন। তার সেই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এদেশে জুড়ে বসেছি; যেখানে পূর্বেই আরবরা আবাদ ছিল এবং আমরা এখানে একটি হিব্রু অর্থাৎ ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করছি। আমরা এদেশের অনেক এলাকায় আরবদের কাছ থেকে জমি কিনেছি। আমরা আরব গ্রামের পরিবর্তে ইহুদি গ্রাম তৈরি করেছি, আপনি এখন সেই আরব গ্রামের নামও জানেন না এবং এই অজ্ঞতার জন্য আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি না, কারণ এখন সেই ভূগোলের বইগুলিই অদৃশ্য হয়ে গেছে, যেখানে এই আরব গ্রামের নামগুলো উল্লেখ ছিল। শুধু এই বইগুলোই গায়েব হয়ে যায়নি, আরবের সেই গ্রামগুলোও গায়েব হয়ে গেছে। যেখানে আগে ‘মাহবা’; ছিল; সেখানে আবির্ভূত হয় ’নিহালাল’; (দয়ানের নিজের গ্রাম)। এভাবে ‘জবা’কে ‘জাবোট’, ‘হানিফিস’কে ’সারিদ’ এবং ’তাল শামান’কে ’কেকার কিহোশুয়া’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। এই দেশে এমন একটি জায়গা নেই, যেখানে আরব জনগণ আগে ছিল না। [8]প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১

একজন ইসরায়েলি অধ্যাপক; নাম শাহাক, ইসরায়েলি সন্ত্রাসীদের এই নৃশংস কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত মর্মাহত ছিলেন। তিনি এমন চারশোটি গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এই গ্রামগুলো, এর ঘর-বাড়ি; বাগানের দেয়াল, কবরস্থান এবং কবরের ফলকও নিস্তনাবুদ করে দেওয়া হয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের গল্প এখানেই শেষ নয়। একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৪৮ সালে, প্রায় সাত লাখ আশি হাজার আরব ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি থেকে বেদখল করা হয়েছে, যাতে করে ফিলিস্তিনের ‘পুনর্গঠন’ এর কাজকে সহজ করা যায়। [9]প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২

ইসরায়েল পুনর্গঠনের পর যে ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে আসে, সেখানে তাদের জাতীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতিকে উপহাস ও নিন্দার লক্ষবস্তু বানানো হয়। আধুনিক শিক্ষা বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক জীবনে তীব্র সংঘাতের সৃষ্টি করে এবং সমস্ত বস্তুগত সম্পদ কেড়ে নেওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের থেকে তাদের ধর্মকেও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। শিক্ষাব্যবস্থার উপর এই নেতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষণ করে সাঈদ লিখেন, পাঠ্যক্রমকে হঠাৎ বদলে দেওয়া হয়। এখানকার স্কুলগুলিতে উপলব্ধ সুযোগ-সুবিধা খুবই বাজে। তাদের প্রতিটি সম্ভাব্য উপায়ে শেখানো এবং বোঝানো হয় যে, তাদের এবং হীনমন্যতার জন্ম একইসাথে। তারা কখনই এর থেকে পরিত্রাণ পাবে না এবং সর্বদা ইজরাইল রাষ্ট্রের উপর অপমানজনকভাবে নির্ভর করতে হবে তাদের। [10]প্রাগুক্ত, পৃ. ২১১

উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনায় এডওয়ার্ড সাইদের প্রভাব মৌলিক। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সাহিত্য-তাত্ত্বিক সমালোচক ও চিন্তক নিছক একজন ব্যক্তি মানুষ ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন চিন্তা ও সক্রিয়তার একটি ধারা। তাঁর ব্যক্তিত্ব শুধু পাশ্চাত্যের নয়, প্রাচ্যের মানুষের জন্য ছিল সত্যের এক উচ্চকিত কণ্ঠস্বর, যার অনুরণন পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত ইতিহাসের ফাটল থেকে আলোর মতো ফুটতে থাকবে।

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 The Question Of Palestine, পৃ. ১৭
2 প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২
3 প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬
4 প্রাগুক্ত পৃ. ৩৭
5 প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪
6 প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭
7 প্রাগুক্ত পৃ. ৩৯
8 প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১
9 প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২
10 প্রাগুক্ত, পৃ. ২১১

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷