একজন বশির মেসবাহ

কাজী যুবাইর মাহমুদ

বশির মেসবাহ মৌলিকভাবে আরবি-উর্দু ব‌ইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী। আরবি-উর্দু প্রচ্ছদের একটা মেজাজ আছে, চরিত্র আছে, সেটা যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলাই তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রচ্ছদের লেখা কম্পিউটার টাইপ হলে বাংলায় সেটা চলে, কিন্তু আরবি উর্দু প্রচ্ছদে সেটা চলে না। আরবি-উর্দু প্রচ্ছদ মানোত্তীর্ণ হ‌ওয়ার প্রধান শর্তই হচ্ছে হস্তলিপি, এই শর্ত পূরণের একক কিং বাংলাদেশে বশির মেসবাহ‌ই। যিনি আরবি-উর্দু প্রচ্ছদ করেন, তিনি যদি লেটারিং না পারেন, তার আরবি-উর্দু প্রচ্ছদ করা মানে ঠেকার কাজ চালানো অথবা প্রতারণা করা। পৃথিবীতে কম্পিউটার টাইপ ব্যবহার করে আজও কোনো উৎকৃষ্ট আরবি-উর্দু প্রচ্ছদ হয়নি। এই হিশেবে আরবি-উর্দু প্রচ্ছদের সবচেয়ে প্রভাবশালী বশির মেসবাহকেই মনে করি। তার সাম্প্রতিককালের বাংলা প্রচ্ছদ প্রচ্ছদ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আমি তার এক দশক আগ পর্যন্ত করা প্রচ্ছদ নিয়ে বলতে পারি যে, তিনি জীবনে এমন কিছু বাংলা প্রচ্ছদ করেছেন, সেসব পুরো বাংলাভাষার প্রচ্ছদশিল্পকে মহিমান্বিত করেছে।

প্রথমত বশির মেসবাহকে প্রচ্ছদশিল্পী বলার চাইতে ক্যালিগ্রাফার হিসেবে আমি আগে চিনে নিব। পরিচ্ছন্ন আর সুরুচিপূর্ণ হাতের লেখাকেই ইংরেজিতে বলা হয় ‘ক্যালিগ্রাফি’, যেখানে রয়েছে দু’টি গ্রিক শব্দ–Kallos (সুন্দর), আর Graphein (লেখা)। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি যাদের মাধ্যমে এখন এ পর্যায়ে এসেছে, এর মূলে বশির মেসবহার অবদান অনন্য।

বইয়ের প্রচ্ছদের মধ্যেও তিনি নানা বৈচিত্রে ক্যালিগ্রাফি এবং টাইপোগ্রাফির কারিশমা দেখিয়ে যাচ্ছেন কয়েকযুগ ধরে। তাঁর ডিজাইনে যে বিষয়টি আমার কাছে সবচে গুরত্বপূর্ণ মনে হয় তা হলো, বইয়ের কাভার কিংবা ক্যালিগ্রাফিতে নকশা এবং কম্পোজশিনের স্থায়িত্ব। আরও বিশ বছর আগের বশির মেসবাহ’র কাজ এই সময়ে সামনে আনলে সহজে অনুমেয়; বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে তাঁর প্রচ্ছদ কতটা রিলেটেড। বর্তমান সময়ে বিশেষ করে ইসলামী অঙ্গনে যারা প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন, দেখা যায় মক্কা-মদীনা কিংবা মুহাম্মাদ সা. কিংবা সাহাবায়ে কেরাম যদি বইয়ের বিষয়বস্তু হয়, প্রচ্ছদে বিষয়ের সঙ্গে নকশা বা ডিজাইনের এখনকার শিল্পীগণ আমার মনে হয় এখনও ততটা সমৃদ্ধ হতে পারেননি, বশির মেসবাহ এবং তাঁর সময়কালের শিল্পীরা যতটা সমৃদ্ধ ছিলেন মক্কা-মদীনার ছবি দিয়ে শৈল্পিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে। লক্ষ করি, তুলির আঁচড়ে মূর্ত-বিমূর্তভাবে তিনি ফুটিয়ে তোলেন সৌন্দর্য। বিশ-পঁচিশ বছরেও যে কাজ এখনও আমাদের কাছে কম্যুনিকেটিভ।

২,

কোনো শিল্পী তখনই ভালো কাজগুলি প্রকাশ করতে পারেন যখন কাজের বিষয়ে তার থাকে সময়ের এবং রুচির সর্বোচ্চ স্বাধীনতা। আমরা বশির মেসবাহ’র কাজগুলি সূক্ষ্মভাবে ঘাটলে দেখব প্রতিটা কোণ এবং রাউন্ড শেইপগুলিতে তাঁর সিগনেচার। সময়ের যে অভিযোগটি আসে, তা বেশিরভাগ পরিশ্রমী আর সৃষ্টিশীল শিল্পীর ক্ষেত্রেই ঘটে। কেননা সৃষ্টির সঙ্গে শিল্পীর যে সংযোজন তা দ্বিতীয় আর কেউ অনুধাবন করতে পারে না। আর বশির মেসবাহর ক্ষেত্রে ‘সময়’র বিষয়টিতে বর্তমান ক্লায়েন্টদের বোঝাবুঝির যে গ্যাপ, তা ধরতে না পারাটা আমি মনে করি ক্লায়েন্টেরই অপারগতা। তিনি এখনও ক্যালিগ্রাফি, টাইপোগ্রাফি, লোগো এইরকম ক্রিয়েটিভ কাজগুলি করেন ম্যানুয়ালি। পেন্সিল, মার্কার, রং-তুলিতে। এরপরই ডিরেকশন দিয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে আউটপুটের উপযোগী করে তুলেন। একটা আর্টওয়ার্কে ভিজ্যুলাইজ করতে পারাটাই বড় বিষয়, আর তা ক্রিয়েট করার যে সময় স্বাধীনতা—তা কি ক্লায়েন্ট বুঝতে পারে? আমার মনে হয় এখানেই ক্রিয়েশন, ক্লায়েন্ট আর আর্টিস্টের গ্যাপটা তৈরি হয়। যা শুধু বশির মেসবাহ নন, সৃষ্টিশীল প্রায় শিল্পীর ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

বশির মেসবাহ শিল্পী। গ্রামীণফোন বা রবির কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ নয় যে, গ্রাহককে সন্তুষ্ট করতে বাধ্য। তবে, গ্রাহকের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রসঙ্গ আপনি তখনই আনতে পারবেন, যখন আপনি তাকে পল্টনের ডিজাইন ও প্রিন্টিং ব্যবসায়ী হিসেবে বিবেচনা করবেন। শিল্পীর বেলায় গ্রাহকসন্তুষ্টি খুঁজতে যাওয়া স্রেফ বোকামি ও মূর্খতা। পৃথিবীর কোনো মহৎ শিল্পী গ্রাহকের দাসত্ব করেছেন বলে আমি শুনি নাই।

৩,

প্রসিদ্ধ মানে তো জনপ্রিয়। আর জনপ্রিয়তা চলে সময়ের স্রোতে স্রোতে। বিগত এবং বর্তমান সময়ে বিশেষ করে ইসলামী ধারার (ইসলামী ধারা বিশেষ বলা হয়েছে এই কারণে, যেহেতু বশির মেসবাহ বেশিরভাগ কাজ করে গেছেন এ অঙ্গনে) প্রকৃত অর্থে কার জনপ্রিয়তা কতটুকু দাঁড়ায়; তা হিসাব করতে আমাদের কমপক্ষে অপেক্ষা করতে হবে পঞ্চাশ বছর। তাঁর কাজের মধ্যে শক্তিশালী যে ভাব বা মানুষের রুচির সঙ্গে তার কাজের যে রিলেশন, তা শুধু চলমান জনপ্রিয়তার বা কেবল সাময়িক মুগ্ধতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। কাজের ম্যাচিউরিটি যার মধ্যে যতটুকু থাকে, তার স্থায়িত্ব ততদিনের। তো এই সময়ে এসে বশির মেসবাহর সঙ্গে তরুণদের তুলনা করতে গিয়ে যখন তাঁর অস্তিত্ব আবছা মনে হয়; তখন আমাদের দুঃখবোধ হওয়া উচিৎ ছিল, কারণ বশির মেসবাহর মতো একজন প্রকৃত শিল্পীকে আমার আজও চিনে উঠতে পারি নাই। এই অপারগতা তাদেরই; যারা বশির মেসবাহকে চিনেন এবং তাঁর কাজের ক্লায়েন্ট। বর্তমান তরুণদের জনপ্রিয়তার কারণ আবিষ্কার করলে বের হবে ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলানোর কারণ। আর বশির মেসবাহ যিনি একজন প্রকৃত আর্টিস্ট, তিনি ট্রেন্ড অনুসরণ করেন না, প্রকৃত শৈল্পিক রূপ প্রকাশের চর্চা করেন। ক্যালিগ্রাফি, বুক কাভার কিংবা লোগো, মনোগ্রাম এই কাজগুলি নিশ্চয়ই স্থায়ী ওয়ার্ক। এই শিল্পে ট্রেন্ডের চাইতে বড় বিষয়টি ধরা হয় স্থায়িত্বে।

সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয়টি হলো, বশির মেসবাহকে বাংলাদেশ আজও খুঁজে পায়নি, যেহেতু তাঁর কাজ একটা গণ্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ ছিল; তাই তাঁর কাজের মূল্যায়ন করার অতটুকু সক্ষমতা এই গণ্ডির কেউ অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশে টাইপোগ্রাফির পথিকৃৎ বলতে আমরা কাইয়ুম চৌধুরী ভেবে থাকি, আমাদের এই ভাবনা তো প্রথম আলোর সৃষ্টি, কারণ প্রথম আলো কাইয়ুম চৌধুরীকে চিনতে পেরেছিল। অথচ বশির মেসবাহকে চিনতে পারার মতো ছিল না কোনো প্রতিষ্ঠান, কিংবা তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড তাঁকে গণ্ডি পেরিয়ে নিতে পারেনি।

অন্তত ইসলামী ধারায় তাঁর প্রকৃত মূল্যায়নটুকু বুঝতে না পারা এটা বাংলাদেশের ব্যর্থতা তো বটেই, এর আগে ইসলামী ধারার মানুষেরই বড় ব্যর্থতা।

৪,

বশির মেসবাহর লেটারিংয়ে নিখুঁত এলাইনমেন্ট আর অক্ষরের সিমিলারিটি থেকে খুঁটে খুঁটে আমি প্রতিনিয়ত শিখি। উনি এই লাইনে একজন আইকনিক বস ও মহা সম্মানের শায়েখ। তিনি এ পর্যন্ত যে পরিমাণ টাইপফেস ক্রিয়েট করেছেন, এবং খুব নগন্য মূল্যে যে সব মাস্টারপিস লেটারিংগুলি ক্লায়েন্টদের দিয়েছেন, সেইসব টাইপফেস ও লেটারিংগুলি যদি বাংলা টাইপ অর্থাৎ বাংলা ফন্ট হিসেবে প্রকাশ করা হয়; তাহলে বাংলাদেশে বিশাল এক ফন্ট ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে তোলা সম্ভব শুধু তাঁর লেটারিংগুলি দিয়েই।

লেটারিং ও টাইপোগ্রাফি করার ক্ষেত্রে আমি তাঁর দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। এই বিষয়ে কোথাও আটকে গেলে আমি বশির মেসবাহর লেটারিং স্টাডি করি, সমাধান পেয়ে যাই। তার একেকটা লেটারিং আমার কাছে লেটারিংয়ের ক্লাসের মতো। সবমিলিয়ে বলা যায়, বশির মেসবাহরা বাজারে আছেন বলেই তো কাজী যুবাইর মাহমুদ ঢাকা শহরে শিল্প করে ভাত খাওয়ার সাহস করেছে।

বশির মেসবাহর সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়েছিল মাত্র দু’বার। ‘কেমন আছেন’টুকু পর্যন্তই। অতএব তাঁর কাজ আমার কাছে যতটা পরিচিত, তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ততটা পরিচিত নই। আমার কর্মক্ষেত্রের এরিয়া যেখানে, পুরানা পল্টন, একই এরিয়ায় একেবারেই লাগোয়া, পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে দুইজন কিংবদন্তি শিল্পীর ওয়ার্কহাউজ। শিল্পের বিচারে দু’জনই দু’জনের কাজের জায়গায় কিংবদন্তিতুল্য। চা খেতে খেতে প্রায় দুজনের পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া দেখি, আর ভাবি তাঁদের বিশালতা। একজন বশির মেসবাহ, অন্যজন ধ্রুব এষ। আমি যেহেতু প্রচ্ছদ এবং অক্ষরশিল্প নিয়ে কাজ করি, এই দুইজন ব্যক্তি আমার কাছে সবসময় অনুপ্রেরণার।


বশির মেসবাহ’র কিছু কাজ


বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Asim billah
Asim billah
1 year ago

খুব সুন্দর লিখেছেন। আমাদের নতুন প্রজন্মের অগ্রপথিক। ধন্যবাদ।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷