এইসব সন্ধ্যা

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ

অন্যসব দিনের মতো গলির মোড়টা আজকেও অন্ধকার। সন্ধ্যার পরপর দুই ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে এখন অন্ধকারটাকে আরও গাঢ় মনে হচ্ছে। তালতলা সুপার মার্কেটের রাবেয়া ফার্মেসির ডাক্তার ফয়েজ উদ্দিন ডি এইচ এম এস রাতের ফার্মেসি বন্ধ করে বাড়ি ফিরেছেন। আসার সময় দেখা হয়ে গেল রমিজ মিয়ার সাথে, গঞ্জের কাঠের ব্যাপারি, বাজারে ফার্নিচারের দোকান আছে। একথা সেকথায় মিনিট দশেক দেরি হয়ে গেল। বিবিসির খবরের গোড়াটা ছুটে গেল বোধহয়। রমিজ মিয়া মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়, প্রতিদিনই দেখা হলে আমতা আমতা করে। ভালোমন্দ দু-চার কথা জিজ্ঞেস করে। একদিন সময় করে ধরতে হবে আসল মতলবটা কী। কথাবার্তা গোপন রাখা অবশ্য এন্টিমক্রুডের লক্ষণ, রমিজ মিয়ার কোনো অসুখ হলে তার জন্য ওষুধ নির্ণয় করা সহজ হয়ে যাবে অনেকটা। বাড়িটা বড় রাস্তা থেকে লিকলিকে গলিটা ধরে মিনিট দুয়েক সামনে, এদিকের ছাপোষা বাড়িওয়ালাদের জন্য রাস্তার উপরে একটা লাইট দেয়াও অনেক খরচান্ত ব্যাপার। তার নিজের বাড়ির দরজাতে অবশ্য লাইট আছে একটা, বাড়ি আসা অবদি জ্বলে, তারপরে বন্ধ। বৃষ্টি হয়ে গেলে পরে আশেপাশের ডোবা নর্দমায় দুই ফোঁটা পানি জমেছে, ইতিউতি লুকিয়ে থাকা খানকয়েক ব্যাঙ তারস্বরে গলা ফুলাতে শুরু করেছে। বাড়িতে পা দিতে দিতে ফয়েজ সাহেবের মন থেকে এই শহরতলির এঁদো গলির বাসাটা হারিয়ে গেল, সেখানে ভেসে উঠল টলটলে নীল পানির জাদুকাটা নদী, একটা ছোট গরু, তার রশি হাতে নিয়ে গাছতলায় বসে থাকা একটা বছর দশেকের কিশোর। এলোমেলো হাওয়ায় ভেসে যাওয়া ব্যাপারি নৌকাগুলোর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সন্ধার আলো নিবে আসে। দুটি ছাগল আর এক হালি হাঁস তই তই করে তাড়িয়ে নিতে সেসময় মাঠে আসে মোল্লা আব্দুস সবুরের সবচেয়ে ছোট কন্যা শরমিন। গরুর পেছনে দুটা ঘা বাড়িয়ে দিতে দিতে ফয়েজুদ্দি টের পায় এই সন্ধ্যা হওয়ার মুখে কোথাও একটা কোকিল ডাকছে কুহু কুহু। সে তাকে ভেংচে ডাকে কুহু, কোকিলটা প্রাণপনে তার জবাব দিতে দিতে একসময় টের পায় এ তার প্রেয়সী নয়, অন্য কেউ।

‘মুবিন, এই মুবিন, দরজাটা খোল। মুবিন! মাত্র সাড়ে দশটা বাজে, এর মধ্যেই সব ঘুমায় গেল নাকি।’

ফয়েজ উদ্দিন ডি এইচ এম এসের বয়স বাড়ছে, সেই সঙ্গে চড়ছে মেজাজ। সামান্য একটু অপেক্ষাতেই আজকাল মুখ দিয়ে যা তা আসতে থাকে। এইটা কোনো ভালো লক্ষণ না। বদমুখো বুড়ার কপালে শেষ বয়সে ছেলের বউয়ের গঞ্জনা জোটে। এই অভ্যাসটা যেভাবেই হোক কন্ট্রোল করতে হবে। পালসেটিলা ওয়ান এম বায়ুচড়ায় ভালো কাজ করে, কাল দুপুরে বাড়ি আসার আগে মনে করে দুটো পিল মুখে ফেলে দিতে হবে।

‘আস্তে ডাকো, রাত হইছে।’ দরজা খুলে দিতে দিতে রাবেয়ার বিরক্ত মুখের আভাস দেখা যায়। ‘এই রাত বিরাতে দরজায় দাঁড়ায় গরু ছাগল বইলা চিল্লাইলে লোকে কী বলবে’

‘চিল্লাবে না তো কী করবে, এই অন্ধকারে কখন থেকে ডাকতেছি তার খবর আছে?’

‘চোখ লেগে গেছিল একটু, সবাইরে খাওয়ায় একটু কাত হইছিলাম।’ বলতে বলতে রাবেয়া হাতের ব্যাগটা তুলে রাখে আলমিরার ওপরে। ছাতিটা দরজায় ঝুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

‘হাত মুখ ধুয়ে আসো, ভাত দেয়া হইছে।’ ফয়েজ উদ্দিন বাড়ির পুরানো রেডিওটার নব ঘুরিয়ে এফ এম ১০০ মেগাহার্টজ ধরার চেষ্টা করছেন। দুবারের চেষ্টায় অবশেষে মানসী বড়ুয়ার গলা পাওয়া গেল,

‘দেশটির প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন তার দেশ কখনোই তার সীমান্তে ন্যাটোর সৈন্য বরদাশত করবে না…’

‘ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধটা বোধহয় লেগেই গেল’ বলতে বলতে বাথরুমে ঢোকেন ফয়েজ সাহেব। বিবিসি বাংলার আন্তর্জাতিক খবর শেষ হয়ে এবার শুরু হয়েছে চিঠিপত্রের আসর। বাম হাতে রেডিওর সুইচটা অফ করে দিয়ে প্লেটে আরেক টুকরা মুরগি নেন ফয়েজ সাহেব। রাবেয়ার দিকে তকিয়ে বলেন,

‘ওরা সব ঘুমায় পড়ছে?’

‘শুইছে তো, ঘুমাইছে কিনা কে জানে। একটু আগেই হাসাহাসির শব্দ শুনলাম।’

‘আজকে দোকানে ইমাম সাহেব হুজুর আসছিলেন। বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। ছেলে হাইস্কুলে পড়ায়, এই বছরই নিয়োগ হইছে। পাকা সরকারি চাকরি। এখন মেয়ে খুঁজতেছে। একটাই সমস্যা, পোস্টিং সেই খুলনায়।’

‘মেয়ে বড় হইছে, এখন তো আর বুকে আগলায় রাখা যাবে না। কোথাও না কোথাও তুলে দিতেই হবে।’

এইসব মুহূর্তগুলোতে ফয়েজ উদ্দিন সাহেবের মন তরল হয়ে আসে। অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে হয়। জীবনের শুরুর দিনগুলোর সেই অনিশ্চয়তার কথা মনে হলে এখন কেমন ভয় লাগে। বিদেশি এনজিওর ভালো চাকরি, ঢাকা শহরে পোস্টিং, মাসশেষে নিশ্চিত বেতন, অনায়াসের চাকরি, এমন একটা নির্ভার মুহূর্তে এসে সংসার শুরু করেছিলেন ফয়েজ উদ্দিন সাহেব। তখনও নামের পেছনে ডি এইচ এম এস উপাধিটা জোটেনি। একদিন হঠাৎ শোনা গেল এনজিও ডোনেশন সোর্স সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। ভাগ্যিস তখন হোমিওপ্যাথি কলেজের শেষ বর্ষ। ইন্টার্নির এপ্রোন খুলে রেখেই ফয়েজ উদ্দিন বাজারে ফার্মেসি খুলে বসলেন। সার্ভাইবল অব দ্যা ফিটেস্ট।

‘ছেলের ছবি দেখছ তুমি, দেখতে কেমন, লম্বা?’

‘পাসপোর্ট সাইজের ছবিতে লম্বা খাটো কেমনে বুঝব?’

একটু হাসি চেপে রাবেয়া জানতে চান, ‘মাথার চুল কেমন? আজকাল তো শুনি চাকরির পড়া পড়তে পড়তে মাথার চুল নাকি সব পড়ে যায়।’

‘চুলটা তো খেয়াল করলাম না, তবে আছে নিশ্চয়ই, টাক থাকলে চোখে পড়ত।’

‘রীনার বিয়েটা ভালোয় ভালোয় দিয়ে নিই, তারপর মুবিনের বিয়েটা দেখেশুনে দেব। তোমার এই ছেলেটা আসলে একটা বলদ। এত করে বললাম ডাক্তারিটা পড়, এইচ এসসিতে ভালো রেজাল্ট হয় নাই তো কী হইছে। না, উনি প্রোগ্রামার হবেন। সময় নষ্ট ছাড়া কিছু না। সারা দিনমান পড়ে আছে ঐ বাক্সের সামনে, কী পায়, কয় টাকা ইনকাম করে তোমাকে বলে কিছু? আমি তো কিছু বুঝি না’

‘মুবিনের চেহারাটা কেমন শুকায় যাচ্ছে, সারাটা দিন বসে থাকে কম্পিউটারের সামনে। আজকে তো দুপুরে গোসলও করার সময় পায় নাই। খুব নাকি চাপ।’

‘আমি বাপু বুঝি না এইসব কারিকুরি। আমার সহজ হিসাব, সারাদিন পড়াশোনা করব। রোগি আসলে রোগি দেখব, নগদ টাকা পাব, এত পেরেশানি নেওয়ার সময় কই?’

‘থাক, বাদ দাও। যে যেইটা করে সেইটা বোঝে। তুমি তোমার হোমিওপ্যাথি বোঝো, সবাই কি আর সেইটা বুঝবে।’

‘রাতে খাইছে? না খাইলে ডাক একটু, কথাবার্তা বলি।’

‘তোমার যা কথাবার্তা সব ওই খাওয়ার সময়, অন্য সময় বলতে পার না। ছেলেটার খাওয়াটা প্রতিদিন নষ্ট কর।’

‘তোমার এই বি গ্রেডের আমড়া কাঠের ঢেঁকির জন্য আমারে কনফারেন্স ডাইকা কথা বলতে হবে?’


***


‘আপা আপা, তোমার বিয়ের আলাপ চলতেছে, শুনবা?’ পলা চোখ গোল গোল করে ডাকল।

‘ঘোড়ার ডিম তুই শোন’

‘ঘোড়ার ডিম না আপা, মনে হচ্ছে সোনার হরিণ। সরকারি চাকুরিজীবি, হাইস্কুলের মাস্টার।’

‘পলা তুই থামবি!’ কপট রাগ দেখায় রীনা। মুখটা বালিশের আড়াল করে প্রাণপণে মুখটা পলার চোখ থেকে আড়াল করে রাখে। যদি কোনোভাবে একটু হাসির আমেজ দেখে, সারাদিন খেপিয়ে মারবে। আজকাল যা দুষ্টু হয়েছে।

‘তোমার বিয়ে হলে এই খাটটা আমার একার হয়ে যাবে, না আপা?’

‘তা হবে কীভাবে, ভাইয়ার বিয়ে হলে ভাইয়া এই ঘরে উঠে পড়বে। তখন মেহমানের ঘরে তোকে বিছানা করে দেয়া হবে। যদ্দিন আমি আছি, এই ঘরের আশ মিটিয়ে নে।’

‘ইস, জীবনেও আমি এই ঘর ছাড়ব না। বললেই হইলো, না? আচ্ছা আপা তোমার কেমন বর পছন্দ, লম্বা, ফর্সা, না কালো হলেও চলবে?’

‘উফ ঘুমা তো!’ পলার বকবকানি একবার শুরু হলে আর থামার জো নেই।

বিয়ের আলাপটা চলছে বছর খানেক ধরে। মাঝেমধ্যেই দেখা যায় রাতের খাবারের পর বাবা লম্বা সময় মার সঙ্গে কী সব আলাপসালাপ করেন। রান্নাঘরে যাওয়ার মুখে দরজার আড়ালে দাঁড়ালে সব কথাই স্পষ্ট শোনা যায়। বাবা গম্ভীর গলায় মার সঙ্গে সাংসারিক নানান কথাবার্তা বলেন, হঠাৎই মনে হয় গলাটা একটু নেমে আসছে। মাঝেমধ্যে একটা-দুটা শব্দ, দু-চারটা টুকরা কথা, এই পর্যন্তই সারা। এরপর একদিন দেখা যাবে নানান বাজার সদাইয়ের তোড়জোর। মা দুপুর বেলা একটু হলুদ বেটে দেবেন, ঈদের সময় কেনা তোলা জামাটা বের করবেন। বিকালে নানাপদের নাশতা বানানো হবে। এই দিনটা রীনাকে মা রান্নাঘরের কাছে ঘেঁষতে দেন না। পাশের বাড়ির বউ ঝি দুয়েকজন এসে মাকে সাহায্য করে। সে আপনমনে একা একা বসে চিন্তা করে। এর মধ্যেই শুরু হয় ইন্টারভিউয়ের পালা। কাছাকাছি বয়সের কেউ থাকলে অবশ্য টুকটাক গল্পসল্প হয়, কিন্তু শুধু মুরুব্বিরা আসলে বিব্রতবোধের একশেষ। তারপর আসল মানুষের সঙ্গে একান্তে আলাপ। এর মধ্যে দেখা যাবে বাবা ছেলেপক্ষের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছেন। পুরোনো দিনের গল্প, নানান হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করবেন। যদিও আমরা জানি এসব মুখের কথা মাত্র। দুপুরে এমন কিছু আহামরি রান্না হয়নি, ফ্রিজেও বাজার বলতে কিছু নেই। তারা যদি রাজি হয়ে যান তবে বাজারে ছুটতে হবে।

তারপরের কয়েকটি দিন স্বপ্নরঙিন। স্কুল থেকে ফিরে পলার অনবরত বকবকানি, ডিগ্রির বই খুলে আনমনে অজানা অচেনা একটা মানুষের দিকে চেয়ে হারিয়ে যাওয়া। আজ বিকেলে দারুণ একটা ব্যাপার ঘটল। বন্ধু সুমনার সঙ্গে ক্লাস থেকে ফেরার পথে রিকশা থেকে রীনা নামতে যাবে, সুমনা বলল,

‘এই শোন’

‘কী?’

‘এই ব্যাগে একটা জিনিস আছে, তোর কাছে একটু রাখ। কাল পরশু এসে নিয়ে যাব।’ সেই থেকে জিনিসটা ব্যাগের ভেতরে গুটিসুটি মেরে আছে, খোলার আর সু্যোগ হয়নি। ও ঘরে বাবা মায়ের মধ্যে কী নিয়ে যেন কিঞ্চিত উত্তেজিত কথাবার্তা হচ্ছে। মা এসে ভাইয়ার দরজায় নক করছেন। পলার চোখ বন্ধ, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। চুপি চুপি উঠে ব্যাগটা নামিয়ে আনল রীনা। ভেতরে খুব দামি একটা মোবাইল। কলেজে ওঠার পরে বাবা একটা ফোন কিনে দিয়েছিলেন, কেবল কল করা যায়। সেই তুলনায় এই ফোনটা কী সুন্দর। কদিন আগে ক্লাসে রেশমা একটা এমন দামি ফোন নিয়ে এসেছিল, সবার ছবি তুলে দিল, ওর বর নাকি দিয়েছে। সুমনার এই ফোনটার পেছনে নিশ্চয়ই একটা গল্প আছে, নয়তো ওর কাছে কেন রেখে গেল এটা।

মাত্র পৌনে এগারোটা বাজে, সুমনা কি ঘুমিয়ে পড়েছে! একটা ফোন করাই যায়, এগারটা আজকাল খুব একটা রাত নয়।

‘সুমনা ঘুমিয়ে পড়েছিস?’

‘না, এই খাওয়া দাওয়া চলছে। তোর কী খবর?’

‘এই তো, ফোনটা কোথায় পেলি বলতো?’

‘তুই ব্যাগটা খুলে ফেলছিস, না?’

‘আহা, ভেতরে কী এমন মানিক রতন দেখব না! পরে দেখলাম রাতে বাসায় পুলিশ এসে বলছে, এই বাসায় সন্দেহজনক জিনিস আছে, আমাদের কাছে চেকিং পারমিট আছে। তখন কী করব।’

‘ধুর কী সব আজগুবি কথা। একটা ফোনের জন্য পুলিশ আসবে কেন?’

‘আসতে পারে না! কদিন আগে ভাইয়ার এক বন্ধুর ফোন নিতে পুলিশ এসেছিল, চোরাই ফোন বোধহয়।’

‘এইটা সেইসব কিছু না। তোমার হবু দুলাভাই দিয়েছে।’

‘ও, তাই বলি, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ!’ রীনা ওপরে ওপরে সুমনাকে ক্ষেপাতে কসুর না করলেও ভেতরে ভেতরে মনটা কেমন মিইয়ে গেল। এইরকম একটা মানুষ তার থাকলে কী হতো! এমন দামি গিফট তার লাগবে না, একটু পাশে থেকে গল্প করত যদি। আচমকা কোনো কোনো দিন যার পকেট থেকে বেরিয়ে পড়ত একটা আইসক্রিম। কী এমন ক্ষতি হতো। রাতের বেলা পাশে বসে চুলে বিলি কাটতে কাটতে গল্প করা যেত। ভাবতে ভাবতে রীনার গলার কাছটাতে কী যেন আটকে আসতে লাগল। এই এক বিচ্ছিরি সমস্যা, নিজের ওপর নিজেই যেন একটু বিরক্ত হলো।

***

 ‘মুবিন, এই মুবিন, দরজাটা খোল, তোর আব্বা ডাকতেছে’

‘আসতেছি আম্মা’

রাতের এই সময়টা আসলে খুব বিজি থাকতে হয়। ফাইভারে বেশিরভাগ অর্ডার পড়ে রাত এগারোটা থেকে তিনটার মধ্যে। মাসে দশ ডলারের চার পাঁচটা কাজ ধরতে পারলেও হাত খরচটা আসে। মুবিন প্রাণপনে একটার পরে একটা অফারে রেসপন্স করছে। ফাইভারে তার গিগ আছে সব মিলিয়ে চারটা, এর মধ্যে পাঁচ থেকে দশ ডলারের গিগটার পারফর্ম্যান্স ভালো, সেকেন্ড পেজে আছে এখন। গত সপ্তাহে একটা অর্ডার কমপ্লিট করায় ফাইভস্টার রেটিং পাওয়া গেছে, সেই আমেরিকান ভদ্রমহিলা মমতাময়ী আছেন, শেষদিন কাজ করার পরে মেসেজে থ্যাঙ্কস লিখে নিজেই রেটিং দিলেন, একটা রিভিউ দিয়েছেন পরদিন সন্ধ্যায়। এতটা আশা করেনি মুবিন। আজকের কপালটা অবশ্য খারাপ, এক নিগা নাইজেরিয়ান আমেরিকান আইডি থেকে অর্ডার করেছে। এইসব অর্ডার ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটিতে অভিশাপের মতো। বাঘের চোখ এনে দিলেও এদের কাছ থেকে পজিটিভ রিভিউ পাওয়া যায় না। বেশির ভাগের ধান্দা থাকে কাজ নেয়ার পর রিফান্ড চাওয়া। এইসব ক্ষেত্রে ফাইভার নির্দয়ের মতো সেলারকে বাঁশ দেয়। মুবিন যদি এই বেচারাকে সন্তুষ্ট করতে না পারে তবে কী হবে ভেবে পায় না।

তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল এইচএসসির রেজাল্টের দিন। সে ভাবতেও পারেনি, তার পদার্থবিজ্ঞান আর কেমিস্ট্রিতে সি আসবে। খারাপ রেজাল্ট মানুষের হতেই পারে, তাই বলে এতটা খারাপ! তিনদিন মুখে কিছু রুচল না। পরদিন বিকেলে বাইরে হাঁটতে গিয়ে মনে হলো হাইওয়েতে গিয়ে একটা ট্রাকের সামনে শুয়ে পড়া যাক। তার এতদিনের প্রোগ্রামার হওয়ার স্বপ্ন এইভাবে ধুয়ে মুছে যাবে তা সে ছয় মাস আগেও বুঝতে পারেনি। বাবা অবশ্য মনে মনে খুশি হয়েছেন। ছেলে যদি পড়াশোনা করে বিদেশ চলে যায় তবে সংসার চালাবে কে। তার শরীরটা আজকাল তত একটা ভালো যায় না, সন্ধ্যার পর আরাম কেদারায় বসে গল্প করতে করতে চা খেতে মনে চায়। কিন্তু সেই জীবন কি আর আছে। এইবার যদি মুবিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্নে একট ভাটা পড়ে, আর সে সংসারের হালটা ধরে, তবে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন। আরে, গরিবের এত বড় স্বপ্ন দেখার কী আছে!

সপ্তাহখানেক পর রাতের খাবার খেতে খেতে বাবা শান্ত স্বরে মুবিনকে এইসব কথা যখন বুঝিয়ে বলছেন, এক পর্যায়ে সে চেঁচিয়ে উঠেছিল,

‘তোমরা আমাকে ভাবোটা কী, কলুর বলদ? আমার কোনো স্বপ্ন, সাধ-আল্লাদ নেই। ওই এক হোমিওপ্যাথির শিশিতে পানি ঢেলে আমার জীবন চলবে? উপজেলা শহরের একটা হোমিওপ্যাথ, যার জীবনের চূড়ান্ত সফলতা একজন মানুষের জ্বরজারি কমানো আর দুরারোগ্য টিউমার সারানোতে। একটাই জীবন আমার এইসব রোগেশোকে নষ্ট করতে চাই না।’

‘যা করতে চাস সেই মুরোদ তো তোর নাই। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতি, তাহলেও ভেবে দেখা যাইত।’

‘আমি পরীক্ষায় খারাপ করছি, তাই বলে তো আমার যোগ্যতা, পটেনশিয়াল নষ্ট হয়ে যায় নাই। আমি দেখব এর শেষ কোথায়। তোমরা আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও।’

‘আমার বাবা তোমাকে বছর বছর বসিয়েখাওয়ানোর সাধ্য নাই। তোমার রাস্তা তুমিই দেখ।’

সেই দিনের উত্তপ্ত কথা কাটাকাটির পর আট মাস পেরিয়ে গেছে। টিউশনির জমানো টাকা আর মায়ের কাছ থেকে ধার করে কেনা ল্যাপটপ তার স্বপ্নের সারথি। ইউটিউব আর প্রোগ্রামার বড় ভাইয়ের সান্নিধ্যে যা এলেম হাসিল হয়েছে তার সবটা বিনিয়োগ করে একটু একটু করে তার ফ্রিল্যান্সার পরিচয় দাঁড়িয়েছে, তিনটা ফাইভস্টার, দুটা ফোর স্টার রিভিউ, একটা কন্টেস্টে উইন, এই তার মোট সম্বল। এই সময়ে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসে দাঁড়িয়েছে এই নিগা নাইজেরিয়ান, আল্লাহ তুমিই সহায়।

রাতের বেলা বাবার ডাক মানে সিরিয়াস কিছু, কিংবা খুবই বিরক্তিকর সিলি ব্যাপারে হম্বিতম্বি, দেখা যাক।

‘তোমার মায়ের কাছে শুনলাম আজকাল নাকি কাজের চাপে নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যাইতেছে, তা খাটাখাটনি কি বিনিমাগনা, নাকি পয়সাকড়ি কিছু পাও?’

‘আব্বা আমার বিজনেস মাত্র শুরু, লাভ-লস নিয়া এখন হিসাব করার সময় হয় নাই।’

‘বিজনেস কর নাকি, আমি তো জানতাম ফ্রিল্যান্সিং না কি সব কর। সেইদিন আবুল সাহেব বলল ছেলেপেলেরা নাকি আজকাল অনলাইনে কী সব করে, খুব সুবিধার কিছু না। তালাশে রিপোর্ট হইছে দেখলাম। তুমি আবার সেইসব কিছুতে জড়ায় পইরো না।’

‘কার কাছ থেকে কী শুনে আসেন, নিজে তো এইসব কিছু বোঝেন না, খালি আজেবাজে কথা বলেন। আপনার হোমিওপ্যাথি নিয়ে আজাইরা কথার অভাব আছে?’

‘আমি বুঝি না, বুঝতেও চাই না। যেই কাজ করলে মানুষের সামনে মুখ দেখানো যায় না, সেইরকম কাজে আমার কোন আগ্রহ নাই।’

‘আমার কাজে আপনি মুখ দেখাইতে পারেন না? আপনার দরকার মানুষের সামনে বুক ফুলায় বলা, আমার ছেলে অমুক ভার্সিটিতে পড়ে, বুয়েটে পড়ে। আপনার দরকার নাম, খ্যাতি। আপনার লাভ-ক্ষতি আমার থেকে কেন উসুল করতেছেন আব্বা?’

‘এই তোরা থামবি, রাত হইছে, মানুষ ঘুমাইছে সব।’ রাবেয়া খাতুন উত্তপ্ত স্বরে পিতা-পুত্রের চাপান উতোর ভেস্তে দেয়ার কোশেশ করেন। ‘ছেলে পেলে কাজ কাম করতেছে, এই তো বেশি। পাশের বাসার রায়হানটা দেখো না, সারাদিন ঘুরে ফিরে বেড়ায়, আর মায়ের ওপর চোটপাট করে, ওরকম হইলে ভালো হইত, না?’

‘দাও দাও, লাই দিয়ে মাথায় তুলে রাখ। ওই ফ্রিল্যান্সিং না প্রোগ্রামিং, সেইসব নিয়ে পড়ে থাকলে লোকে মেয়ে দিবে না, আমি বলে রাখলাম।’

‘না দিলে নাই, দেশে মেয়ের অভাব আছে নাকি!’

মুবিন বেচারা হাফ ছেড়ে বাঁচল। তর্কটা উত্তপ্ত হতে হতে একটা মধুর দিকে মোড় নিয়েছে। কেটে পড়ার এখনই সময়। এদিকে ক্লায়েন্টকে ছয়ঘণ্টার মধ্যে একটা আপডেট দিতে হবে। কি প্রবলেম ফিক্স করতে হবে কে জানে, আজ রাতে বোধহয় আর ঘুম হচ্ছে না।

***

ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়। বাসন কোসন ধোয়া মোছা শেষে রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে শোবার ঘরে আসেন রাবেয়া খাতুন। ফয়েজ সাহেব বারান্দার ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছেন। চৈত্রের পূর্ণিমা গেছে দুদিন আগে, আকাশের কৃষ্ণপক্ষের ভরপুর জোছনা। সন্ধ্যা থেকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত ব্যাঙগুলো এখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। বারান্দার সামনে রাজশাহী থেকে আনা আম্রপালির গাছগুলো চাঁদের আলো খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলছে। সারা উঠানে খেলা করছে ছেড়া ছেড়া জোছনা।

‘মুবিনটা মন খারাপ করছে, না?’

‘ছেলেটা নিজে নিজে কত কিছু করতেছে, তুমি শুধু শুধু ওর মনটা খারাপ করে দাও কেন।’

‘আসলে আমরা ভুলে যাই, সন্তান জন্ম দিলেই সে আমার হয়ে যায় না। তার নিজের একটা ইচ্ছা আছে, চরিত্র আছে। তবু মানুষ তো, মানুষ মাত্রই ভুল করে।’

রীনা-পলার ঘর থেকে হাসির আওয়াজ পাওয়া যায়। এত রাতে মেয়েগুলো কি নিয়ে গুজুরগুজুর করছে কে জানে। দেখতে দেখতে জোছনাটা ঢেকে যায় মেঘে। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। একটা বাদুড় দূরে কোথাও উড়ে যায় অলস ভঙ্গিমায়। মুবিনের ঘর থেকে ভেসে আসে করুন সুরের আর্তনাদ—হায়, জীবন এত ছোট কেনে? বাইরে তখন উথাল পাথাল বাতাস। কয়েকটি নানাবয়সী প্রাণের নানাবর্ণের আনন্দ-বেদনা সেই আর্তনাদে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Tarif
Tarif
1 year ago

অনবদ্য

মাহফুজ তাসনিম
মাহফুজ তাসনিম
1 year ago

চিত্তাকর্ষক।
বেশ ভালো লেগেছে।
গদ্যকারের জন্য শুভকামনা।

আহমেদ রাইয়্যান
আহমেদ রাইয়্যান
10 months ago

মনে হলো ভাই তার দিন যাপন লিখলো 😅

তা মি ম
তা মি ম
29 days ago

একই ছাদের নিচে, অথচ অনুভূতিগুলো একেকরকম!
দারুণ ফেদেছেন। ভালো লাগলো।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷