উদিত দুঃখের দেশ (সপ্তম পর্ব)

মূল : জুলফা কাতু’

আবিদা সুলতানা উমামা

আশপাশের বাকিগুলোর মতো এই দালানও দাঁড়িয়ে আছে অজস্র গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে। খাবলা খাবলা ছালের মতো খসে পড়ছে রঙের আস্তর। পাঁচতলা এই দালানের গায়ের রঙ কোনো এক কালে বাদামি ছিল।

কেনান সামনের দরজাটা আস্তে করে ঠেলে আমার দিকে তাকায়। ওর দৃষ্টি আমার বোধগম্য হয় না। কেমন যেন লজ্জিত মনে হয় ওকে। কোনাভাঙা কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে আমরা দোতলায় উঠি। কাঠের পুরোনো দরজা দিয়ে সরাসরি যে লিভিংরুম দেখা যায়, সেদিকে তাকালে মনে হয় একদম মাঝ বরাবর একটা ছোট বোমা পড়েছে। ভাঙা আসবাবপত্র, বিধ্বস্ত দেয়াল আর ধূলিমাখা ছেঁড়া ফরাশ। আরেকপাশে ব্যালকনির অবস্থা দেখে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। অর্ধেকের বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে, কিছুটা ভেঙে নিচে পড়ে গেছে। বিরাট একটা গর্ত জায়গা করে নিয়েছে শীতল বাতাসের ঝাপটা ভেতরে পাঠিয়ে রক্ত হিম করে দেওয়ার জন্য। ব্যালকনির কিনারে দাঁড়ানোরও অবস্থা নেই, যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

কেনানের ডাক শুনে ওর এক ভাই দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসে। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলে, গায়ের টিশার্টের একপাশে বড় একটা ছিদ্র, পরনের জিন্সটা বেশ ঢিলা।

লিভিংরুমের মেঝেতে পড়ে থাকা ওর বোনের আর্তনাদ আমার কান পর্যন্ত এগিয়ে আসে। আমার দ্রুত কাজ করতে হবে! কেনান হাঁটুগেড়ে বোনের পাশে বসে স্নেহের সাথে ওকে সান্ত্বনা দেয়। ছোট ছেলেটা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নার্ভাস চোখে ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাঁকিয়ে আছে, স্নায়বিক চাপে কাঁপছে ওর হাতগুলো।

“লামা, ইনি ডাক্তার। তোমাকে দেখতে এসেছে।”

মাথা নাড়ানোর আগে মেয়েটা খাবি খায়। অসম্ভব যন্ত্রণায় ওর সারা মুখ বিকৃত হয়ে আছে। আমি গিয়ে পাশে বসি।

“লামামণি, আমি তোমাকে ভালো করতে চাই, কিন্তু তার আগে তোমার আমাকে সাহায্য করতে হবে। পারবে না?”

ও আবার মাথা নাড়ায়।

“গতকাল কি ওকে হাসপাতালে রক্ত দেওয়া হয়েছে?” প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বের করতে করতে আমি কেনানকে জিজ্ঞেস করি।

“হ্যাঁ, ডাক্তারদের কেউ একজন দিয়েছিল। ও-নেগেটিভ, সম্ভবত।”

মাথা নেড়ে মেয়েটার জামার বোতাম খুলি। ওর ধবধবে ফর্সা চামড়া ভেদ করে পাজরের হাড়গুলো যেন বের হয়ে আসছিল, একদম আহমাদের মতো। চোখের পানিতে চোখ ঝাপসা করা যাবে না বলেই আমি নিজেকে কান্না করা থেকে বিরত রাখি। কেনান তখনও ওর হাত ধরে রেখে কথা বলে যাচ্ছে, যেন কষ্টটা কিছুক্ষণ ওকে ভুলিয়ে রাখতে পারে। ঘামে ভেজা জামাটা খুলতে নিলে ও চিৎকার করে ওঠে ব্যথায়। ওর উত্তপ্ত কপালে আমার হাতের তালু চেপে ধরি।

“লামা, কোথায় ব্যথা হচ্ছে?”

“পে.. পেটে,” ফুরানো দমে ও বলে। যতটা সতর্কতার সাথে সম্ভব, আমি ওর ব্যান্ডেজ কাটতে কাটতে বলি, “এখন আমি তোমার পেটে হাত দিয়ে চাপ দেবো, কোন জায়গায় ব্যথা সবচেয়ে বেশি সেটা আমাকে বোলো।”

মাথা নাড়ায় লামা। ছলছল টলমল নয়নে কেনান আমার গতিবিধি লক্ষ করে। নিজের স্থিরতা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। লামার পেটে হাত রাখা মাত্রই ও চিৎকার শুরু করে।

শিট!

আরেকটু চাপ দিতেই ওর চিৎকারের আওয়াজ বেড়ে যায় আরো।

ডেইজি। ডেইজি। ডেইজি—হাতগুলো স্থির করার জন্য জপতে শুরু করি।

কেনানের কণ্ঠ এবার কর্কশ হয়ে ওঠে, “আপনি কী করছেন?”

“শার্পনেলটা কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে।”

লামা চিৎকার করেই যায় কিন্তু আমি তো থামতে পারব না। ধাতব বস্তুটার কোনা আমার খুঁজে বের করতেই হবে। 

“আপনি ওকে ব্যথা দিচ্ছেন!” কেনান চেঁচিয়ে ওঠে।

মায়ের কাছ থেকে শেখা চাহনিতে আমি কেনানকে চুপ করিয়ে দিই। “আপনার কি মনে হয়, আমি শখ করে ব্যথা দিচ্ছি? জিনিসটা তো খুঁজে বের করতে হবে!”

ও চুপ হয়ে যায় তবে চোখের তারায় জ্বলজ্বলে ক্ষোভের আগুন আমার নজর এড়ায় না।

“ওর সারা গায়ে আঘাত আর সেলাইয়ের ছড়াছড়ি। কোন শার্পনেলটার কারণে এমন হচ্ছে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। সেজন্যই এভাবে দেখছি।”

কাগজের মতো বিবর্ণ চেহারা নিয়ে সে মাথা ঝাঁকায়।

“লামা, কখন ব্যথা সবচেয়ে বেশি পাচ্ছ সেটা আমাকে বলবা তুমি, ঠিকাছে? তুমি কত্ত সাহসী না? আমি জানি এখন তুমি অনেক স্ট্রংও থাকবা। তাই না?”

আরেকবার মাথা নাড়ানোর আগে ওর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।

“ভালো মেয়ে!”

লামার পেটে আলতো চাপে সোজা নিচের দিকে এগোই। দাঁতে দাঁত চেপে ও এবার বিনা শব্দে ব্যথা হজম করে। কিন্তু নাভি পর্যন্ত আসতেই ও আর সহ্য করতে না পেরে কুঁকড়ে ওঠে।

“এখানে!” ওর আর্তনাদ।

আমি থেমে যাই। ও বলার আগেই কোনাটা আমার হাতে লেগেছে।

কোমলভাবে ওকে বলি, “তুমি তো অনেক জোস, লামা! এখন কী বাকি, জানো? শুধু শার্পনেলটা বের করে আনা বাকি।”

“বের করেন।” কেনান বলে।

“আমি জাস্ট—” আমি তার দিকে তাকাই। “কাজটা জটিল।”

“কেন?”

কীভাবে বলব আমি!

“ওর—”

“আপনাকে ওর পেট কাটতে হবে, আর এদিকে কোনো এনেস্থেশিয়ার ব্যবস্থা নেই।”

“জি।”

হাতজোড়া চুলের ভেতর চালিয়ে নিয়ে মুখের ওপর নিয়ে আসে কেনান, বিপর্যস্ত সে। 

“আমার কাজটা এখনই করতে হবে। শার্পনেলটা অন্য কোথাও সরে যাওয়ার আগেই।”

“করে ফেলেন। আমাদের কাছে আর কোনো উপায় নাই। করতে হবেই।” তার কণ্ঠ বোনের মতোই বেদনার্ত শোনাল।

“এমন কিছু লাগবে যেটা ও কামড়ে ধরে রাখতে পারবে।”

কেনান নিজের কোমরের বেল্টটা খুলে নেয়। 

“লামা, আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পাচ্ছ, কিন্তু এইটুকু তুমি করতে পারবে। আমি আছি তোমার কাছে। তোমার ভাইয়েরাও আছে।”

ও কাঁদতে শুরু করে। 

“বেল্টটা কামড়ে ধরো,” আমি বলি ওকে। 

আমি তো কখনো নিজেকে কাছে দেখতে চাইনি। আমার একজন ফার্মাসিস্ট হওয়ার কথা ছিল। ঘরে গিয়ে বাচ্চাদের পেট কাটা তো আমার কাজ হওয়ার কথা ছিল না। 

স্কালপেল আর জীবাণুনাশক হাতে নিতে গিয়ে আমার হাত কাঁপে। আজ অব্দি যখনই আমি কোনো অপারেশন একা করেছি, ডাক্তার যিয়াদ সবসময় আশপাশে ছিলেন পাছে আমি কোনো গড়বড় করে ফেলি। তার থাকাটা আমাকে স্বস্তি দিত।

কিন্তু এখানে যদি আমার হাত পিছলে যায়, যদি একটি শিরা কেটে ফেলি অথবা যদি অভ্যন্তরীণ রক্তপাত আরো বাড়িয়ে ফেলি—লামা মরে যাবে। আমার হাতে খুন হয়ে যাবে। 

শক্ত করে চোখ বন্ধ করে আমি ডেইজি ফুলের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। 

“এই যে!” কেনানের কথা শুনতে পাই। “আপনি ঠিক আছেন?”

সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাই।

“জি,” গলা ধরে আসেনি বলে নিজের ওপর গর্ব হয়।

কেনানের চোখজোড়া নরম হয়ে আসতে দেখে আমার মনে হয় ও বুঝে ফেলেছে নিজের ভীতিটুকু লুকোতে আমি কতটা মরিয়া।

কিন্তু ওকে এড়িয়ে আমি তাকাই লামার দিকে। পানিতে টলোমলো চোখ নিয়ে ও তাকিয়ে আছে সিলিংয়ে। বেল্ট কামড়ে ধরে রাখা ঠোঁটজোড়া ঠক ঠক করে কাঁপছে। এইটুকুন বয়সে কত কঠিন দুনিয়া দেখতে হচ্ছে লামার!

ইয়া আল্লাহ, আমাকে দিশা দাও। এই বাচ্চা মেয়েটাকে বাঁচানোর উসিলা বানাও।

ওর পেটের চামড়া আর স্কালপেল জীবাণুমুক্ত করে কেনানের দিকে তাকাই। লামা যতটা ব্যথা পাবে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হবে কেনানের।

“ওকে ধরে রাখেন,” নির্দেশনা দিই।

বিবর্ণ চেহারা নিয়ে ও মাথা নাড়ে। শীতল ধাতব যন্ত্রটা লামার পেটে চেপে ধরতেই ও কাতরে ওঠে।

‘লামা, শুধু আমার দিকে তাকায়ে থাক।” ওর ভাই বলে।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আমি স্কালপেলটা নামিয়ে একটুখানি কাটি। লামার আর্তনাদ বেড়ে যায়। পুরোটা সময় পা ছুড়ে ও আমাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু কেনান ওকে ধরে রাখে। 

“প্লিজ, লামা! তোমাকে স্থির থাকতে হবে।” যত দ্রুত সম্ভব কাজ করতে করতে ওকে বলি। 

খলবলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে কাটা জায়গা থেকে। সেখানে দুই আঙুল ঢুকিয়ে আমি শার্পনেলটা খুঁজি। কাঁদতে কাঁদতে লামা আমাকে থামতে বলে। নিজেকে তখন আমার কোনো অসুর মনে হয়। কিন্তু কোমল হওয়ার সময় আমার হাতে নেই। আঙুলের মাথায় সুচালো কোনাটার আঁচড় পাই তখনই।

“পেয়েছি!” চিৎকার করে শক্ত হাতে চেপে ধরি। বৃহদান্ত্রের পাশে নাজুক একটা অংশে জিনিসটা আটকে ছিল। স্বস্তির শীতল পরশে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু দোয়া করতে থাকি, যেন আর কোনো ইন্টার্নাল ব্লিডিং না হয়। ধীরে ধীরে শার্পনেলটা বের করে আনি। এত কঠিন একটা মুহূর্ত ছিল! তাই সেলাই করার আগে গভীরভাবে খেয়াল করে দেখলাম কোনো কুচোকাচা যেন থেকে না যায়। চামড়ায় সেলাইয়ের প্রতিটি ফোঁড় যেন নতুন করে এক পশলা যন্ত্রণার হাওয়া বয়ে দিচ্ছে লামা, কেনান আর আমাকে। সেলাইটা দেখতে এত বাজে লাগছে, আর যে দাগ রেখে যাবে তার কথা আর নাইবা বললাম। তবু, লামা যে বেঁচে আছে এটাই এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সারা পেটে চাপ দিয়ে আরেকবার নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে আর কিছু নেই।

“হয়ে গেছে,” হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, যেন এই মাত্র কোনো ম্যারাথন দৌড়ে এসেছি। তারপর হালকা হাতে লামাকে নতুন ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলাম।

কেনানের মুখটা স্বস্তিতে ছেয়ে গেল। লামার ঘামে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে কপালে চুমু খায় ও।

“দারুণ দেখিয়েছিস, লামা। তোকে তো খুব বাহাদুর মেয়ে মনে হচ্ছে।” দুজনের চোখেই পানি। লামা ক্ষীণ একটা হাসি দেয়, দুচোখে তার অসীম ক্লান্তি।

কিন্তু আমার কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। হাত থেকে লামার রক্ত ধোয়ার জন্য আমি উঠে দাঁড়াই। তারপর মনে পড়ে পানির লাইন তো বন্ধ।

“এখানে,” পেছন থেকে কেনানকে বলতে শুনি। ওর হাতে এক বালতি পানি, যা তারা হয়তো খাওয়া আর রান্নার জন্য ব্যবহার করে থাকে।

মাথা নেড়ে আমি বলি, “না, এগুলো কী করে ব্যবহার করি! আপনাদেরও তো দরকার। থাক, হাসপাতালে গিয়ে হাত মুছে ফেলব আমি।”

“আরে, এটা কোনো ব্যাপার না। এদিকে আসেন, রক্ত ধুয়ে ফেলেন। আমাদের আরো কয়েক বালতি পানি আছে।”

এখানে কারো কাছেই কয়েক বালতি পানি নেই, থাকতেই পারে না।

তবু আমি তার কাছ থেকে পানি নিই।

“হাসপাতাল থেকে কি আপনাদেরকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে?” গায়ের হলুদাভ ল্যাবকোটে হাত মুছতে মুছতে বলি।

“জি,” পকেট থেকে ওষুধগুলো বের করে ও আমার হাতে দেয়। সেফালেক্সিন, ২৫০ মিলিগ্রাম।

“প্রতি ১২ ঘণ্টা পর পর দুটো করে ট্যাবলেট দেবেন সাতদিন।”

কেনান দ্রুতপায়ে লামার কাছে গিয়ে ওকে দুটো ওষুধ খাইয়ে দেয়। ওদের ভাই পেছন থেকে উদয় হয়ে লামার পাশে বসে। যতটুকু পারে চেষ্টা করে লামাকে আরাম দেওয়ার। লাল হয়ে যাওয়া চোখজোড়া ডলতে ডলতে ও নাক টানে আর লামা সামান্য হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ওর অবসাদ এত তীব্র, মনে হচ্ছে গায়ে এসে ফুটছে। 

হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ছয়টা প্রায় বেজে গেছে। আমাকে লায়লার কাছে ফিরতে হবে।

হেঁটে আমার কাছে ফিরে আসে কেনান। 

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডাক্তার। আমি জানি না আর কী বলব আপনাকে।”

ওর প্রশংসা এড়িয়ে বললাম, “এটা তেমন কোনো ব্যাপার না। আমি শুধু নিজের কাজ করছি। আর হ্যাঁ, আমি একজন ফার্মাসিস্ট।”

“আপনার কাজের তালিকায় এটা নাই বোধহয়।” আমার দিকে সমীহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ও। আমার শরীরে আবার অ্যাড্রিনালিন প্রবাহিত হয়। দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য হই। কেনানের অদ্ভুত এক প্রাণশক্তি আছে। লায়লা ছাড়া অন্য কারো চোখে আমি এমনটা দেখতে অভ্যস্ত না। “আর আপনার বয়সও কম।”

“আপনার চেয়ে বেশি কম না।”

মাথা দোলায় কেনান। “আমি কিন্তু অন্যকিছু মিন করিনি। আমার মনে হয় এই বয়সে আপনি এত কিছু করছেন, এটা খুবই দারুণ।”

“জীবন ঘটনাবহুল।” কাঁধ নেড়ে বলি।

“সেটাই।” এই বলে কয়েক সেকেন্ড ও আমার দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। 

গলাখাকারি দিয়ে আমি লামার দিকে দেখিয়ে বলি, “এখন কিছু সময়ের জন্য আপনার বোন কিছু খেতে পারবে না। শুধু তরল খাবার দিবেন, যত বেশি খেতে পারে। সুপ, পানি, জুস.. বা যেটাই হোক। ফল খেতে পারবে যদি থাকে আরকি।”

আমার প্রতিটা শব্দের সাথে কেনান মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ও এখন চিন্তায় মগ্ন যে এসব কোথা থেকে জোগাড় করবে। কিন্তু তারা কেউ শখ করে উপোস থাকছে না। আমি ওদের মা-বাবার কথা কিছু জিজ্ঞেস করি না। তাদের এখানে না থাকার পেছনে ভিন্ন কোনো রহস্য নেই।

“আপনার যদি কিছুর প্রয়োজন হয়, আমি হাসপাতালেই আছি। যখন দেখবেন লামা একটু নড়াচড়া করতে পারছে তখন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। আমরা দেখব আর কী কী করা যায়।”

“থ্যাংক ইউ।”

সার্জিক্যাল ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিই। 

কেনান আমার সাথে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসে। “আপনাকে আমি হাসপাতালে দিয়ে আসি।”

“না না, লাগবে না। আমি বাসায় যাচ্ছি। আপনার বোনের আপনাকে বেশি প্রয়োজন।”

ওকে বিভ্রান্ত দেখায়।

“সমস্যা নাই।” আরেকটু দৃঢ়তার সাথে বলি।

“আচ্ছা, তাহলে অন্তত বাইরে এগিয়ে দিই।” 

আমি সায় দিয়ে ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে নীরবে সিঁড়ি বেয়ে নামি। মূল দরজায় পৌঁছে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই ও হাসিমুখে ধন্যবাদ জানায়। আর আমি পা দিই চৌকাঠে।

“ভালো থা—” ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বাতাসের গা ছিঁড়ে গুলির শব্দ বেরিয়ে আসে। ভয় পেয়ে আমি যেই না ঘুরে দাঁড়িয়েছি অমনি কেনান আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে।

“হেই!” নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে প্রতিবাদ করি আমি, কিন্তু ওর সে খবরও নেই। ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। 

নিজের ঠোঁটের ওপর এক আঙুল রেখে দরজার ধাতব ফ্রেমে কান পাতে ও।

আমি অপেক্ষার সাথে দোয়াও করতে থাকি, যা ভাবছি তা যেন কিছুতেই না হয়।  আরো কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজ আমাদের সন্দেহকে সত্যায়িত করে দিয়ে সমস্ত আশা হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়।

“ভয়ংকর অবস্থা।” অবশেষে ওর মুখ থেকে শব্দ বের হয়।

“হ্যাঁ, আমার যেতে হবে।” আমি একপাশে সরে আসতেই কেনান পথ আগলে দাঁড়ায়।

“সম্ভবত মিলিটারিরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করছে। গোলাগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি বের হতে পারবেন না। ওদের সবার কাছে স্নাইপার আছে।”

এমন মুহূর্তগুলো আমাদের জীবনে এখন খুব সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে, তবু তীব্র আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে নেয়। লায়লা বাসায় একা। এভাবে সারা রাত ওকে একা থাকতে দিতে পারব না আমি।

“আমার যেতেই হবে। লায়লার আমাকে প্রয়োজন।”

“লায়লা কে?”

“আমার বন্ধু। ও আমার ভাবিও হয়। প্রেগন্যান্সির সাত মাস চলছে ওর। ওকে একা রাখতে পারব না আমি।”

“আপনি যাওয়ার পথে ধরা অথবা মারা পড়লে উনার কোন উপকারটা হবে?” কেনান দরজার সামনে শক্ত অবস্থান নিয়ে জোর দিয়ে বলে।

“উনাকে কল দিতে পারবেন না?”

“মোবাইল আছে কিন্তু ব্যবহার করতে ভয় লাগে। আমার মনে হয় যে মিলিটারিরা ট্র‍্যাক করে জেনে ফেলবে ও যে একা।”

কেনানকে খানিক দ্বিধান্বিত দেখায়। এরপরই সে একটা পুরানা নোকিয়া মোবাইল বের করে আনে। “এটা একধরনের বার্নার ফোনের মতো। শুধু কল দেওয়ার জন্য ব্যবহার করি। এটা দিয়ে খোঁজ নিতে পারেন।”

“এই জিনিস কোথায় পাইছেন?”

“আপনি কি প্রশ্নই করে যাবেন না উনাকে কলও দিবেন?” বলে আমাকে মোবাইলটা দিয়ে কেনান ওপরে উঠতে যায়।

মাঝপথে থেমে গিয়ে বলে, “মরার জন্য দৌড়ায়ে যায়েন না।”

আমি ঘাড় নাড়তেই ও চলে যায়।

 লায়লার নাম্বার ডায়াল করি। প্রতিটা বিপের সাথে হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।

কল ধরছে না। আতঙ্কে আমার জ্ঞান হারানোর দশা। আর তিনবার কল দেই। নো অ্যান্সার!

হঠাৎ খওফ এসে হাজির হয়। অস্বস্তির মহাশূন্যতা তৈরি হয় আমার বুকের ভেতর।

“কী হচ্ছে?”

“মনে করো, ওর এখন লেবার পেইন শুরু হয়েছে,” খওফের জবাব।

আমার পৃথিবী দুলে ওঠে।

“প্রত্যেকটা দিন তুমি এমনই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছ, সালামা। লায়লার জীবন নিয়ে খেলছ তুমি। আর ওর অনাগত সন্তানের জীবনের কথা তো বাদই দিলাম। তোমার ভাতিজি। কারা বেশি জরুরি তোমার জন্য? রোগী না ভাবি-ভাতিজি?”

খওফের ভারী ভারী শব্দের ওজনে আমার যেন হাড়েও চিড় ধরছে। হামযাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর লায়লার নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা মনে পড়ে যায় আমার। কীভাবে ও সপ্তাহের পর সপ্তাহ শুধু পেট আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে করে কেঁদেছে।  শুধু মৃত্যুকে ডেকেছে ও তখন, যন্ত্রণা ওকে এভাবে বন্যার স্রোতের মতো ডুবিয়ে, ভাসিয়ে আধমরা করে রেখেছিল।

আমার কার‍ণে যদি লায়লার কিছু হয় তাহলে হামযা আমাকে কী বলবে, ওকে আমি মুখ দেখাব কী করে।

যদি লায়লা আমার কারণে মরে যায়!

কেনানের বাসার মূল দরজা খুলে আমি ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো ভেতরে প্রবেশ করি। আমার কাছে এখানে থাকাটা ঠিক মনে হচ্ছে না। আমার লায়লার কাছে যেতে হবে। 

“আপনার ভাবির খোঁজ পেয়েছেন?” কেনান রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করে।

“কল ধরেনি ও।”

আমার উৎকণ্ঠা টের পেয়ে ও বলে, “মোবাইলটা রাখেন, আবার চেষ্টা করে দেখেন।”

“থ্যাংকিউ।” নিচু গলায় বলি। 

কেনান মাথা দুলিয়ে দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন ওর উপস্থিতি আমার অস্থিরতা কিছুটা উপশম করে। বিকেলের আধবুড়ো কমলা রোদ মরে আসে, সাথে করে টেনে নিয়ে আসে শীতল হাওয়া—কেনানের এই ধ্বংসপ্রায় বাসাটায়। ঠান্ডায় আমার গা কেঁপে ওঠে, ল্যাব কোটটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিই। আর তা কেনানের নজর এড়ায় না। ভাইকে সাথে নিয়ে একটা ছাইরঙা উলের কম্বল বড় গর্তটার একপাশে ঝুলিয়ে দিই, যা কেবলই হিমশীতল বাতাসের উপস্থিতি কিছুটা কমানোর চেষ্টা।

“থ্যাংকিউ,” বিড়বিড় করে বলি। জবাবে কেনান মাথা নেড়ে হাসি দেয়।

বাসার কোনো একটা ঘর থেকে কেনান পুরোনো একটা ম্যাট্রেস বের করে আনে। তারপর সেটা বিছিয়ে দেয় মেঝেতে। ওর ভাই লাজুক চোখে আমাকে দেখে আর আমি দেখি ওর দেবে যাওয়া চোয়াল ও হাড্ডিসার হাত। কেনানের সাথে ওর চেহারার মিল আছে। তবে ওর চোখের সবুজ কেনানের চেয়ে আরো হালকা, চুল আরেকটু গাঢ় বাদামি। এই দুটো বিষয় ওর বোনের সাথে মিলে গেছে।

“আচ্ছা, আপনার বিছানা লামার সাথে পেতে দিলাম। রাতে একা ঘুমাতে হয়তো অস্বস্তি লাগতে পারে।” তারপর কেনান খুব দ্রুত, যেন শব্দগুলো যত দ্রুত সম্ভব বলা যায়—সেভাবেই বলল, “আপনি চাইলে এখানকার যেকোনো রুমে থাকতে পারবেন। আমি আর ইউসুফ সারারাত জেগেই থাকব। তবে আপনার যদি কোনোকিছু দরকার হয় বা শুধু—”

“আপনার কথা ঠিক আছে। লামার গায়ে এখনো জ্বরজ্বর ভাব, আর আমি ওর সুস্থতা নিশ্চিত করতে চাই। তাছাড়া রাতে আমারও ঘুম হবে না। তবে আপনার ভাইয়ের ঘুমানো উচিত। এক ঘরে সবাই জেগে থাকার প্রয়োজন নাই।”

কেনান আমার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে ইউসুফকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। লম্বায় ইউসুফ কেনানের থুতনি সমান। নিজের রুমে যাওয়ার আগে সে মাথা তুলে বড় ভাইয়ের দিকে আদুরে চোখে তাকায়। 

কেউ একজন অন্তত ঘুমাতে পারবে ভেবে আমার আনন্দ হয়, কারণ লায়লার থেকে এত দূরে থেকে আমার তো এক ফোঁটা ঘুম হবে না। আমি এসে লামার পাশে বসে ওর গায়ের তাপমাত্রা মাপি। ওর গা মোটামুটি গরম এখনো। তবে আশা করছি, দ্রুতই কমে আসবে। ভেজা কাপড় দিয়ে কপালটা মুছে দিই। মনে পড়ে, আমি অসুস্থ হলে মা-ও এভাবেই পাশে বসে যত্ন করত। মনে পড়ে, মায়ের কোমল পরশ, লেবুজল খাওয়াতে বসে তার স্নেহভরা শব্দ।

“সাবাশ, মা।” শীতল হাতটা আমার ঘামে ভেজা কপালে রেখে মা বলতেন। “ইয়াল্লা, পুরোটা খেয়ে ফেল। সবগুলো জীবাণু মেরে ফেলতে হবে তো।”

জোর করে চোখ বন্ধ করে ফেলি। না। স্মৃতিতে ফেরা যাবে না।

“কী অবস্থা ওর এখন?” লামার আরেক পাশে বসতে বসতে কেনান জিজ্ঞেস করে। 

হাসিমুখ করার চেষ্টা করি, “জ্বর থাকলেও শ্বাস-প্রশ্বাস এখন স্বাভাবিক। আশা করছি, সুস্থ হয়ে যাবে দ্রুতই।”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

আমাকে অবাক করে দিয়ে কেনান একটা স্যান্ডউইচ হাতে দেয়। পাউরুটি, চিজ এসব এখন অমাবস্যার চাঁদ। খেয়াল করলাম, ওর হাতে নিজের জন্য খাওয়ার কিছু নেই।

“আপনি আমাদের মেহমান।” কেনান বলে। আর আমি ভাবি না জানি কত কী করে তারা এইটুকু জুগিয়েছে।

“আমি এটা খেতে পারব না। আপনার ছোটভাইকে দিতে পারেন।”

“না, ও খেয়েছে। আপনি না খেলে আমি এটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দেবো। কেউই খেতে পারবে না আর। এই বিষয়ে আর কথা বাড়াবেন না, প্লিজ!”

যে-কারো কাছে এই কথা শুনলে মনে হতো খেলো একটা হুমকি। কিন্তু কেনানকে দেখে মনে হচ্ছে না ও মজা করছে। চোখের তারায় একগুঁয়েমি ফুটিয়ে রেখে ও আমার দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ রাখছে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি স্যান্ডউইচটা দুইভাগ করি। বড় ভাগটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি, “এটা নেন।”

ও দু-পাশে মাথা নাড়ায়।

“আপনি না নিলে আমি এটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দেবো। কেউই খেতে পারবে না আর।”

কেনান হেসে ফেলে ওর ভাগটা হাতে নেয়।

“এত কঠিন কী ছিল, হ্যাঁ?”

“আমি নিশ্চিত, আমার আম্মা-আব্বার রুহ জান্নাত থেকে আমাকে দেখে অবাক হচ্ছে যে এই জিনিস আমি আপনার কাছ থেকে কীভাবে নিলাম।” বলে ও আবার হাসে। হুট করে ওর চোখ পড়ে আমার শত আঘাতের চিহ্নযুক্ত হাতে। আমার ভেতরটা হঠাৎ শূন্য হয়ে যায়। দ্রুত হাতা টেনে ঢেকে দিই হাতটা। কেনানের নজর না এড়ালেও কিছু বলে না ও। 

আকাশের বিস্তীর্ণ নীলের গায়ে গাঢ় গোলাপির ছোপ ছোপ দাগ এনে দিয়েছে সন্ধ্যা। খাওয়া শেষে কেনান ওর ভাইকে ডেকে আনে। আমরা নামাজ পড়ে নিই একসাথে। কেনান ভীষণ সুন্দর সুরে কেরাত শুরু করে। কুরআনের প্রতিটা শব্দ আমাকে দীর্ঘক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে যেন আমি শব্দের অর্থ কেবল গিলছি। আর প্রশান্তি ও স্নিগ্ধতা যেন আমার শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, ধুয়েমুছে দিচ্ছে সমস্ত যন্ত্রণা। আমার মনে পড়ছে না—শেষ কবে আমি এমন গভীর প্রশান্তির দেখা পেয়েছি যে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা প্রায় হারিয়েই গেছে।

নামাজের পর, লামাকে দেখে আসি। কোনো পরিবর্তন নেই। 

কেনান কিছু মোম এনে আলো জ্বালে। বারান্দার দেওয়ালের গর্তগুলো কম্বল দিয়ে ঢাকা বলেই প্রবল বাতাসের মুখেও মোম টিকে থাকে। আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য উঠে যাই। তখন একবার লায়লাকে আরেকবার কল দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। 

ও ভালো আছে, মুখের ওপর পানির ঝাঁপটা দিতে দিতে নিজেকে প্রবোধ দিই। 

লিভিংরুমে ফিরে এসে দেখি কেনান ওর বোনের পাশে বসে আছে। তাই আমি গিয়ে ফরাশের অপর প্রান্তে বসি। কেনানের পাশেই একটা ল্যাপটপ দেখতে পেলাম।

“ও পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে কি না কীভাবে বুঝব আমরা?” লামার কপালে জ্বরপট্টি দিতে দিতে কেনান প্রশ্ন করে।

“সেফালেক্সিন রক্তের সাথে মিশে গিয়ে কাজ করতে দশ থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। আগামীকালের মধ্যেই ইনশাআল্লাহ ও ঠিক হয়ে যাবে।”

“আপনি তো ওষুধের ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন!”

“আমার কাজই এটা।”

“কিন্তু আপনি একদম সময়টময় সবকিছু মুখস্থ বলে দিতে পারেন। এটা তো মোটামুটি অ্যাডভান্স লেভেলের কাজ।”

“তা বটে।” কিছুটা লজ্জা আমাকে ঘিরে ধরে। তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে জানালার দিকে তাকাই। আকাশের নীল ধীরে ধীরে কালো রঙ ধারণ করছে। একটা ছেলের বাসায় আমি রাতে থাকছি, এই বোধ আমাকে পীড়া দিচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কার‍ণে হলেও, ঘটনা তো সত্য। আমার হাতে যেন বরফ জমে গেছে। এই খবর পেলে লায়লার চোখ পাকিয়ে তাকানোর দৃশ্য এই মুহূর্তে আমি কল্পনা করতে চাচ্ছি না।

“গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে ফেললেও আপনি এতকিছু কীভাবে মুখস্থ রেখেছেন?” আচমকা কেনান প্রশ্ন করে। আমি তাকিয়ে ওর স্বরের সুর বোঝার চেষ্টা করি। কেনান এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে সহজ করতে চাইছে।

হালকা গলা ঝেড়ে আমি মাথার ভেতরের কথাগুলো আগে বন্ধ করি।

“আমার গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হয়নি। যখন এসব শুরু হয় আমি তখন মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।” আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর যখন মিলিটারি আমার ডজনখানেক ক্লাসমেটকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, এরপর থেকেই যে আমি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি—সেসব আর ওকে বলি না। কারণ ও আমার অত পরিচিত কেউ তো না।

“আর আমার সেকেন্ড ইয়ার শেষ হইছিল গত বছর। কম্পিউটার সাইন্সে। আমি একজন অ্যানিমেটর হতে চাইছিলাম। সবকিছু এত চমৎকার যাচ্ছিল। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, যত বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এখন, আমার যে কত গল্প জমে আছে ভেতরে। কত গল্প এখনো অ্যানিমেটেড মুভিতে রূপ দেওয়া বাকি!”

“হায়াকো মিয়াজাকির মতো?”

“হ্যাঁ, একদম ওইভাবে।” বলে ও অবাক চোখে তাকায়। “আপনি উনাকে চেনেন?”

“আমি উনার অ্যানিমেশনে অবজেজড!”

কেনান সোজা হয়ে বসে, ওর চোখ উত্তেজনায় চকচক করছে। “আমিও তো! স্টুডিয়ো জিবলি তো আমার গোল। চিন্তা আর কল্পনা ওখানে ঝড়ের মতো দৌড়ায়। ওদের গল্পের বুনট যেন জাদুকরি কিছু!”

কেনানের উচ্ছ্বাস আমার ভেতরেও আলোড়ন তোলে।

হাসিমুখে চোখ বন্ধ করে ও বলে, “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো!”

কী ভীষণ আনন্দ ওর স্বরে। যে ভাঙাচোরা মুখোশটা বারবার জোড়াতালি দিয়ে পরে থাকতে হয় তার পেছনের সত্যিকারের কেনানকে আজকে রাতের মধ্যে আমি এই প্রথম দেখতে পেলাম। ওর বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার কষ্ট হয়। আবার কেমন যেন পরিচিতও মনে হয়।

মাথা দুলিয়ে এবার আমি ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি, “আমাদের কি আগে কখনো দেখা হইছে?”

চোখ মেলে ও অবাক চোখে তাকায়। ধীর স্বরে জবাব দেয়, “এমন কেন মনে হলো?”

“আমি যা ভাবছি তা না-ও হতে পারে কিন্তু আমার মনে হয় আমি আপনাকে আগে কোথাও দেখছি। হাসপাতালের আশপাশে না। অন্য কোথাও বোধহয়।”

শেষের শব্দগুলোকে আমার কণ্ঠস্বর প্রশ্নের মতো করে উপস্থাপন করে। কেনান চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ায়, ওর চেহারা দেখে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। খানিক আগের উচ্ছ্বাসটা এখন অন্যকিছুতে রূপ নিয়েছে। দ্বিধা, সন্দেহ নাকি সমব্যথা? আমি জানি না।

হঠাৎ করে সামনের দরজা দিয়ে খওফ হাজির হয়। আমার ঘাড় বেয়ে ঘামের চিকন রেখা নামতে শুরু করে। 

“আমি… আ…” কেনান গলা ঝাড়ে একবার, হাতের নখে মেঝেতে আঁচড় কাটে। “আমাদের কখনো দেখা হয়নি।”

“আচ্ছা, আমারই ভুল হয়তো।” বলে আমি এমন ভান করি যেন এমন ভুল আমার প্রায়ই হয়। “আপনার চেহারার সাথে হয়তো আমার পরিচিত কারো নয়তো কোনো রোগীর চেহারায় মিল আছে।”

কেনান মাথা নাড়ে। কিন্তু আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার—ও অবশ্যই কিছু লুকাচ্ছে।

 

চলবে…

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷