উদিত দুঃখের দেশ (ষষ্ঠ কিস্তি)

মূল : জুলফা কাতু’

আবিদা সুলতানা উমামা

উদিত দুঃখের দেশ (পঞ্চম পর্ব)

শিরশির করে কাঁপতে থাকা আমার সারা গায়ে ভোরের রক্তিম রোদ এসে লুটিয়ে পড়ে। খাওফকে বয়ে বেড়ানোর ভার এড়িয়ে চলতে হবে আমার। তাই তৈরি হয়ে নিই। খিদের চোটে পেট গুড়গুড় করছে, হাতে পায়ে প্রচন্ড ব্যথা। কিন্তু মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজ করতে পারলে, আগের ব্যর্থতাগুলো পুষিয়ে নিতে পারলে, নিজের এইসব ব্যথা আমার কাছে অগুরুত্বপূর্ণ।

ফার্মাসিতে পড়ার সময় এসব কোনো কিছুর পাঠ আমাকে দেয়া হয়নি। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেও এসব শিখতে পারতাম কি না সন্দেহ। কারণ ফার্মাসিস্ট হিসেবে আমার আসলে এই কাজগুলো করার কথা ছিলো না। প্রথম বর্ষে বেশিরভাগই আমরা তাত্ত্বিক বিষয়াদি শিখেছি, ল্যাবে করেছি সাধারণ ফরমুলা মিক্স করার কাজ। আসলে আমরা তখন কেবল সামনের বছরগুলোর জন্য একটু একটু করে ভীত গড়ে রাখছিলাম।

সাঁতারের ‘স’ও না জেনে গভীর জলে নেমে পড়লে যা হয়, হাসপাতালে প্রথমদিন আমার সে দশাই ছিলো। পা ছুঁড়ে সাঁতারটা আমার নিজেকেই শিখতে হয়েছে, যাতে ঢেউয়ের বিশালতা আমাকে ডুবিয়ে না দেয়।

দুপুরে, হাসপাতালের পাশেই একটা এলিমেন্টারি স্কুলের শিশুদের উপর এক মহাদূর্যোগ নেমে আসে শ্রাপনেল বর্ষণের রূপ ধরে।

হাসপাতালে শিশুদের ভীড় দেখে আমার পৃথিবীটা ধীর হয়ে আসে, জুতার ভেতরের আঠালো রক্তের মধ্যে ডুবে যেতে থাকে আমার পা জোড়া। এই সংহারের মাঝখানে অসাড় দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ ভাঁজ খুলছে এক এক করে। প্রতিটা অশ্রুফোঁটা, রবের সাক্ষাতে ছুটে যাওয়া প্রতিটা রূহ ধরা পড়ছে আমার চোখের আয়নায়।

একটা শিশুকে দেখি মায়ের জন্য কাঁদছে, যে মায়ের দেখা আশপাশে কোথাও নেই।

দশ বছরের একটা ছেলেকে দেখি, কাগজের মত সাদা হয়ে আছে চেহারা আর বাহুতে বিঁধে আছে বড় একটুকরো মেটাল। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কিন্তু এমনভাবে দাঁত-মুখ চেপে রেখেছে যাতে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ না বেরোয়। কারণ ওর আরেকটা হাত যে কান্নারত ছোট বোনটা ধরে আছে, তাকে ও ভয় পাইয়ে দিতে চায় না।

দেখি হোমসের সর্বশেষ কয়েকজন ডাক্তারকে, যারা মাথা দুলিয়ে ছোট ছোট, ক্ষত-বিক্ষত শরীরগুলো একের পর এক দেখে যাচ্ছেন।

ছোট ছোট মেয়ে শিশুদের দেখি যাদের পাগুলো সব মুচড়ে আছে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তাদের চোখে ভেসে আছে আপতিত ভবিষ্যতের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ—ব্যবচ্ছেদ।

হায়! আমাদের অবস্থা যদি সারা দুনিয়ার প্রতিটা চ্যানেলে আর প্রতিটা মোবাইলে সরাসরি সম্প্রচার হতো! তাহলে হয়ত মানুষ জানতে পারতো, এই জালিমেরা আমাদের শিশুদের কী করছে! 

একটা ছেলে উজ্জ্বল চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে গান গাইতে শুরু করে। গায়ে কোনো জামা নেই, মাথার কালো চুলগুলো পাতলা। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে ওর বুকে খাদ পড়ছে, ফুসফুসে বাতাস ভরে নিতে কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার। পাঁজরের হাড়গুলো এত স্পষ্ট, মনে হচ্ছে গুণতে পারব। বিদ্রোহীদের লেখা বিখ্যাত গানগুলোর একটা গাইছে সে, কচি কণ্ঠে ভীষণ জোর! হাসপাতালের শোরগোল আর ভারী দেয়াল ছাপিয়ে ভেসে যাচ্ছে সুর। মোহগ্রস্তের মত সুরকে অনুসরণ করে আমি তার কাছে যাই। আশপাশে কেউ নেই। ছেলেটার হাতে পায়েও কিছু হয়নি, মুখ-মাথা কোথাও রক্তের স্রোত নেই—তাই অগ্রাধিকার পায়নি। তবু… আমি ওর হাতগুলো মুঠোয় ভরে নিয়ে টের পাই সেগুলো বরফ শীতল। ছোট্ট কোটটা বোধহয় স্কুলেই ফেলে এসেছে, ধ্বংসস্তুপের নিচে।

“তুমি ব্যথা পেয়েছো?” নীরব অশ্রু ভেদ করে আমি জিজ্ঞেস করি।

তার গান থামে না, কিন্তু কণ্ঠ নেমে আসে। আমি পালস চেক করি; ধীর আর অস্বাভাবিক। কিন্তু কোথাও ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাই না। 

“তুমি ব্যথা পেয়েছো?” আমি আবার প্রশ্ন করি। এরকম চলতে থাকলে ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে।

সে আমার দিকে ফেরে। “আমার নাম আহমাদ। আমার বয়স ছয় বছর। আপনি কি আমার আম্মুকে খুঁজে দিবেন?” খুব নিচুস্বরে সে বলে। ওর গাঢ় নীল চোখজোড়া মাথার খুলিতে ডুবে আছে অনেকখানি। সেই নীলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় আমাকে জেঁকে ধরে।

প্রচন্ড মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। আমার ল্যাবকোটটা খুলে ওর গায়ে জড়িয়ে দিই। নিজের হাতের ভেতর রেখে ওর হাতগুলোকে দিই উষ্ণতা, আর চুমু খাই।

“হ্যাঁ, বাবা। আমি তোমার আম্মুকে খুঁজে দিব। তোমার ব্যথা হচ্ছে কি না বলতে পারবা?”

“আমার অদ্ভুত লাগছে।”

“কোথায়?”

“মাথা। আমার… ঘুম আসছে”—জোরে জোরে কাশে—“আর আমার বুক… আমি জানিনা।”

অভ্যন্তরীণ রক্তপাত!

আমি ডাক্তার যিয়াদকে চিৎকার করে ডাক দিই। তিনি দ্রুত আমার কাছে এসে আহমাদের পালস চেক করেন। ডাক্তার যিয়াদ যখন ওর মাথা নীরিক্ষা করছে, আহমাদ পানি খেতে চায়। প্রচন্ড পানির পিপাসার একটাই অর্থ। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি মাথা নাড়ান।

“এর মানে কী? আপনি কি ওর আশা ছেড়ে দিচ্ছেন?” আমি জানতে চাই।

“সালামা, আমাদের কোনো নিউরোসার্জন নেই। মস্তিষ্কের রক্তপাত বন্ধ করা এখানে কারও পক্ষে সম্ভব না।” তার বিষাদমাখা কণ্ঠে তীব্র অনুশোচনা।

“তাহলে? আমরা ওকে এভাবে…” আমি বিড়বিড় করি কিন্তু উচ্চারণ করতে পারি না ভয়ংকর শব্দটা। আহমাদকে শোনাতে চাই না আমি।

ডাক্তার যিয়াদ আহমাদের কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেন, সেখানে বিন্দু বিন্দু ঘামের আস্তরণ পড়ে আছে। গলার কাছে দলাপাকানো তিক্ততা টুপ করে গিলে ফেলি।

“তোমার কষ্ট হচ্ছে, বাবা?” তিনি জিজ্ঞেস করেন।

আহমাদ মাথা নাড়ে।

“এ্যাড্রেনালিন আর মানসিক আঘাত। ওর মোরফিন প্রয়োজন নেই। শেষ মুহূর্তগুলো তুলনামূলক ভালো কাটানোর চেষ্টা করা ছাড়া ওর জন্য আমাদের কিছু করার নাই।”

“আমি ওর ব্লাড ট্রান্সফিউশন করব।” বলে আমি সাজসরঞ্জাম রাখার স্থানের দিকে ছুটি। ও নেগেটিভ রক্ত হওয়াতে আমি সর্বজনীন রক্তদাতা। রোগীদের রক্ত দেয়ার জন্য ডাক্তার যিয়াদের বানানো একটা ম্যানুয়াল মেশিন আছে আমাদের, কারণ ট্রান্সফিউশন মেশিনটা সবসময় কাজ করে না; যেহেতু এখানে বিদ্যুৎ অপ্রতুল। “আমি ওকে রক্ত দিতে পারব এবং দিব—”

“তাতে কোনো ফায়দা হবে না।” তার স্বর এখন আরো বেশি দুঃখভারাক্রান্ত।

“ডাক্তার যিয়াদ—” আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তিনি এক হাত তোলেন।

“সালামা, কোনো লাভ হবে না। এই বাচ্চাটাকে যদি আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও সুস্থ্য করতে পারতাম, তাহলে সেটাই করতাম। কিন্তু আমি পারছিনা। ওকে কোনোভাবে বাঁচিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু আমি ঐ ছোট্ট মেয়েটাকে সারিয়ে তুলতে পারব যার নাড়িভুড়ি মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। সবাইকে বাঁচানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না।”

আমি চেঁচামেচি শুরু করার আগেই তিনি চলে যান।

“আন্টি—” আহমাদ কোমল স্বরে ডাক দিয়ে শ্বাস নেয়ার জন্য থামে।

“হ্যাঁ, বাবা?” আমি ওর দিকে ফিরে আবার হাতগুলো নিজের মুঠোর ভেতর পুরে নিই। তুমি বেঁচে থাকলে, আমি তোমাকে দেখে রাখব, কসম খাচ্ছি। শুধু বেঁচে যাও, প্লিজ, তুমি বেঁচে থাকো। 

“আমি কি মারা যাব?” বাচ্চাটার প্রশ্নে ভয়ের লেশমাত্রও পাই না আমি। ছয় বছরের সব শিশু কি মৃত্যু বোঝে? নাকি শুধু যুদ্ধ দেখা শিশুরা বোঝে? আমার হাতগুলো কাঁপতে শুরু করে।

“মরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছো, বাবা?”

“আমি—” ও আবার কেশে ওঠে, আর ওর ঠোঁটে দেখা দেয় লালচে ক্ষরণ। ইয়া আল্লাহ! “আমি জানি না। আমার বাবা মারা গেছে। আম্মু বলছে উনি জান্নাতে আছে। আমিও কি জান্নাতে যাব?”

“হ্যাঁ, তুমিও যাবা। ওখানে তোমার বাবার সাথে দেখা হবে।”

কোমল হাসি হাসে ও। 

“আলহামদুলিল্লাহ,” এইটুকু ফিসফিস করে বলে। “জান্নাতে আমি কী করতে পারব, আন্টি?”

মৃত্যুর মুখেও এইটুকুন একটা শিশু কী করে এমন স্থির থাকতে পারে?

কান্নার দমক গিলে নিয়ে উত্তর দিই, “ওখানে তুমি সারাদিন খেলতে পারবা। তুমি যতরকমের খেলা, খাবার, ক্যান্ডি আর খেলনা চাও সব পাবা ওখানে।”

“আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারব?”

ওর এমন প্রশ্নে বিস্ময়বোধ আমাকে ঘিরে ধরে। “অব… অবশ্যই পারবা, সোনা।”

“ভালো হবে।”

বেশ কয়েক মিনিট কেটে যায় আমাদের নীরবতায়, শুধু শোনা যায় ওর ফুসফুসে বাতাস ভরে নেয়ার লড়াই। ওর চোখের তারা ঘোলাটে হয়ে আসছে, প্রতি সেকেন্ডে কমে যাচ্ছে শ্বাসের গতি।

কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে দুআ করতে থাকি ওর রূহের জন্য।

“আন্টি—তুমি কেঁদো না—জান্নাতে গেলে—আমি আল্লাহকে—সব বলে দিব,” ও ঢোক গেলে। আমি তাকিয়ে দেখি মুখখানা স্থির হয়ে আছে। চোখগুলো স্বচ্ছ কাঁচের মত, যেন চোখের নীল মণিতে আটকে গেছে ছোট ছোট ঝিলিমিলি তারা। 

 

***

 

দীর্ঘকাল আমি আহমাদের শরীরের পাশে বসে থাকি। দু ঠোঁটে ঠেস দিয়ে রাখি ওর হাতজোড়া। পেছনের কোনো শব্দই আর পৌঁছাতে পারছে না আমার কানে। ভাঙা ক্যাসেটের বাজনার মত আমার কানে কেবল বেজেই যাচ্ছে, আমি আল্লাহকে সব বলে দিব।

সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে আছে আমার। হাড়তক জমে গেছে সব। মনে হচ্ছে, আল্লাহর গজব যদি নেমে আসতো!

কাঁধে কারও হাতের টোকা অনুভব করেও এড়িয়ে যাই অবচেতন মনে। কে কী বলছে, তাও শুনতে ইছা করছে না আর।

“এই যে!” হাতটা না থেমে বিরক্ত করতেই থাকে। একটা বাচ্চা, যাকে আমি চিনতামও না, তার দুঃখ আমাকে কাবু করে রেখেছে।

“কী চাই?” ঝট করে ঘুরে তাকাই আমি।

আমার বয়সী বা তারচেয়ে একটু বড় একটা ছেলে। গায়ে কাঁপুনি নিয়ে হাঁপাচ্ছে। সে হাতগুলো স্থির রাখতে পারছেনা, কেবলই মুখে হাত বুলাচ্ছে, তার সবুজ চোখজোড়া উন্মত্ত। তাকে পরিচিত মনে হয় তবু কয়েক সেকেন্ড লাগে বুঝতে, এ তো সেই ছেলেই যে গতকাল ছোট একটা মেয়েকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলো।

“প্লিজ… প্লিজ! আপনার আমাকে সাহায্য করতেই হবে।”

তার স্বরভঙ্গি আমাকে নিজের দুঃখের বলয় থেকে বাস্তবতায় নিয়ে আসে। আহমাদ মারা গেছে, কিন্তু জীবিতদের এখন সাহায্য প্রয়োজন। নিজের মর্মবেদনাকে ভেতরে ঠেলে দিই, শোকতাপের বোঝা পরেও বইতে পারব।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াই, “জ্বী, বলেন, কী হয়েছে?”

“আমার বোন, কালকে বোমা হামলার পর আমার বোনকে এখানে নিয়ে আসি—ওর পেটের ভেতর শার্পনেল ঢুকে গেছিলো—পরে বের করা হইছে—ওকে বাসায় নিয়ে গেছিলাম—হাসপাতালে জায়গা ছিলো না কোনো—ওরা বলছে ও ঠিক হয়ে যাবে—কিন্তু—আপনি প্লিজ—একটু” অনেক কষ্টে সে কথাগুলো বলে। যে ভয়ার্ত পরিস্থিতির ভেতর সে ছিলো, তা বোধহয় শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছিলো না।

“দ্যাখেন, আপনার আগে শান্ত হওয়া প্রয়োজন। বড় করে শ্বাস নেন, এখনই!”

সে নিজেকে থামায়, চেষ্টা করে শ্বাস নেয়ার। কিন্তু খুবই করুণ অবস্থা তার। 

“আমার বোন,” জোর করে শান্ত স্বরে সে বলতে শুরু করে। “কাল রাত থেকে ওর জ্বর। সারাদিনেও কমেনি। প্যানাডল দিছি, তাও কাজ হয়নি। ওর অবস্থা অনেক খারাপ। তিনবার বমি করছে। আবার এখানে আনতেও পারতেছি না। নাড়ানোর চেষ্টা করলেই ব্যথায় কান্না শুরু করে। প্লিজ, আপনি আমাকে সাহায্য করেন।”

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও আহমাদের শরীর থেকে ল্যাবকোটটা খুলে নিতে হয়। ওকে বিদায় জানানোর সুযোগটুকুও পাইনি।

চারদিকে তাকিয়ে একবার দেখার চেষ্টা করি অন্য ডাক্তারেরা আর কেউ করতে পারবে কি না। কিন্তু প্রত্যককেই রোগী নিয়ে ব্যস্ত দেখা যায়। এই কাজ আমার নিজেরই করতে হবে। কয়েক মাস আগে যখন এখানে কাজ করতে শুরু করেছি, তখন থেকে দেখে আসছি ডাক্তার যিয়াদ তার রোগীদের জন্য কত কিই না করেছেন। তাকে দেখে আমারও ইচ্ছে হতো। তার অমত সত্ত্বেও আমি শার্পনেল বের করা, ক্ষতস্থান সেলাই করা এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও চেষ্টা করতে শিখেছি, কারণ এই কাজ না করলে আমার কী দশা হবে তা ভালো করেই জানি। জোর করে আমি সার্জনের কাজ হাতে নিয়েছি। এত এত বুলেট বের করেছি, যেগুলো গলিয়ে অনায়াসে একটা গাড়ি বানানো যাবে। ইমারজেন্সি সার্জিকাল ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমি ছেলেটার পিছু নিই।

“কোথায় থাকেন আপনি?” বিকেলের শীতল হাওয়া চিরে দ্রুত পায়ে যেতে যেতে আমি প্রশ্ন করি।

তার চোখজোড়া আকাশে আর উঁচু ভবনগুলোতে ঘুরপাক খাচ্ছে, স্নাইপার আর প্লেনের খোঁজে। “এই তো কয়েক গলি পরেই। ডাক্তার, ওর ব্যথা কেন হচ্ছে বলতে পারেন?”

জবাব দেয়ার আগে আমার ভেতর একটু দ্বিধা কাজ করে। “আমার মনে হয়, ওর ক্ষতস্থানে হয়ত এখনও শার্পনেলের অংশ রয়ে গেছে।”

অস্ফুটস্বরে গালমন্দ করে বসে সে।

“আমরা দুঃখিত।”

সে মাথা দোলায়। “না, হাসপাতালের যে অবস্থা এখন, আমি বুঝতে পারছি এরকম হইতেই পারে। মন্দের ভালো এই, যে একটুখানি মাত্র।”

যেন একটাই হয়। 

“ওর বয়স কত?”

“নয় বছর।”

ইশ!  স্বাভাবিকভাবেই খালি পেটে পড়ে আছে আর সহজেই সংক্রমিত হয়েছে।

“আমাদের দ্রুত যেতে হবে।”

ছেলেটা হাঁটারগতি বাড়িয়ে দেয়, আমিও তার পিছুপিছু ছুটে চলি আমাদের টুটা-ফাটা শহরটার পুরনো গলি ধরে। রাস্তায় কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে, কেউ আলাপে মশগুল আর কেউ বেকারিতে লাইন ধরে অপেক্ষা করছে।

“আমি কেনান,” সে হঠাৎ বলে ওঠে, আমি বিভ্রান্ত হয়ে তাকাই।

“জ্বী?”

“কেনান,” সে আবার বলে কোনোমতে একটুখানি হাসে।

“সালামা,” আমিও বলি। ওর নামটা পরিচিত শোনাচ্ছে, যেন কবে কোন স্বপ্নে শুনেছি একবার।

কিন্তু সেই চেনা-অচেনার মিহি পর্দাটা আমি ওঠানোর আগেই সে থেমে যায়। সামনে একটা দালান। অথবা একটা দালানের অবশিষ্টাংশ।

চলবে…

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷