২
গত জুলাই আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে।
মাত্র সাত দিনের মধ্যে।
আমি তখন হাসপাতালের বিছানায়। আমার শব্দহীন কান্নার নোনা পানিতে ভিজে মুখের ক্ষত জ্বালাপোড়া করছিলষ। উপর থেকে পড়ার কারণে বাম উরুতে তখনো ব্যথা। আর প্রতিবার শ্বাস নিতে গেলে তারস্বরে প্রতিবাদ করছিল ভাঙা পাঁজর। গজের এত মোটা আস্তর দিয়ে হাত মোড়ানো ছিল, দেখতে মনে হচ্ছিল মোটা দস্তানা পরেছি। হাতের জায়গায় জায়গায় শ্রাপনেল এমনভাবে গর্ত করে দিয়েছিল যে রক্তের ফোয়ারা বইছিল। কিন্তু এই সবকিছুই কষ্ট হলেও সহ্য করে থাকা যায়।
একমাত্র গুরুতর আঘাত পেয়েছিলাম মাথার পেছনে। বিস্ফোরণের বেগ আমাকে এমনভাবে আছড়ে ফেলে যে কংক্রিটের সাথে বাড়ি খেয়ে আমার করোটিতে আঘাত লাগে। ডাক্তার যিয়াদ আমার চিকিৎসা করেন। তখনই তার সাথে আমার প্রথম দেখা। তিনি আমাকে বলেন, আমার ভাগ্য ভালো যে আমি কেবল একটা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে গেছি। আমার মায়ের ভাগ্য যে আমার মত ভালো ছিল না সেটাই হয়তো তিনি আমাকে ভুলিয়ে রাখতে চাচ্ছিলেন। বোমার আঘাত কেড়ে নিয়েছে আমার প্রিয় মাকে। দুহাতে কোনোদিন আর তাকে জড়িয়ে ধরতে পারবো না।
সেদিনই খওফ প্রথম হাজির হয়, নিজের পরিচয় দেয়। বেশ খানিক সময় পর আমি টের পাই, খওফকে শুধু আমিই দেখতে পাচ্ছি। প্রথমে ভেবেছি ওষুধের প্রভাবে বোধহয় উলটাপালটা দেখছি। ভেবেছি ওষুধ বন্ধ হয়ে গেলে খওফও চলে যাবে। কিন্তু না। ও থেকে গেল। মায়ের জন্য যখন কান্না পেত, পাশে বসে ভয়ংকর সব কথা সে ফিসফিস করে বলত। ব্যথা কমে গেল, পাঁজর ঠিক হয়ে গেল এমনকি হাতে বিশ্রী ক্ষতচিহ্ন দেখা দিল কিন্তু খওফ গেল না। আর যখন ওর থেকে যাওয়াটা নিশ্চিত ব্যাপার হয়ে গেল, আতঙ্ক আমাকে জাপটে ধরল ক্রমেই।
খওফ আসলে আমার এমন এক হ্যালুসিনেশন যে কখনো আমার পিছু ছাড়বে না। যে গত সাতটা মাস ধরে প্রতি রাতে আমার ভয়গুলোর ভেতরে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
এছাড়া আর কোনো ব্যাখা দাঁড় করানো যাচ্ছে না। বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দিয়েই কেবল আমি খওফের অস্তিত্ব স্বীকার করতে পারি।
‘যা ভাল্লাগে তাই ভাবতে পারো তুমি’, শয়তানি হাসি দিয়ে ও বলে।
মাথার ক্ষতগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে আমি ফিসফিস করে আওড়াতে থাকি, “ডেইজি, ডেইজি, ডেইজি।”
খওফ নিজের চোখের উপর এসে থাকা চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে বুকপকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে। লালরঙা একটা বাকশো, হুবহু ওর কাঁধে লেগে থাকা লাল দাগটার রঙ। একটা লম্বা শলাকা টেনে বের করে দুই ঠোঁটের মাঝে রাখে। আগুন জ্বালতেই ধকধক করে জ্বলে উঠে পুড়তে থাকে আর খওফ লম্বা এক টান দেয়।
“তুমি আ’মের সাথে কেন কথা বলো নাই, সেটা বুঝাও আমাকে,” ও বলে। “কালকে না তুমি ওয়াদা করলা যে কথা বলবা? অবশ্য এই ওয়াদা তো তুমি প্রতি রাতেই করো।” নিচুস্বরে বললেও ওর প্রতিটা শব্দে যেন বিষমাখানো।
এভাবেই ওর সাথে আমার আলাপ শুরু। প্রথম প্রথম ও আমাকে নানা বিষয়ে গালমন্দ করত। সিরিয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিত। এরপর একদিন শুরু করল, আমি যেন আ’মের কাছে নৌকা চাই। সেই থেকে ওর আর কোনো জিরানো নেই। মাঝেমাঝে আমার অবাক লাগে, আমার এই ব্রেইন কীভাবে ওর মতো একটা চরিত্র সৃষ্টি করলো!
ঘাড় বেয়ে ঘামের ফোঁটা ঝরে পড়ছে আমার। “হ্যাঁ,” কোনোমতে জবাব দিই আমি।
খওফ সিগারেটে আঙুলের টোকা দিলে মেঝেতে ছাঁই ঝরে পড়ে। “তারপর কী হলো?”
একদিকে পাঁচ বছর বয়সি একটা মেয়ে, মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া বাদামি চুল—বুকে স্নাইপারের গুলিতে সে মরে গেল। অন্যদিকে ওর ভাইকে ক্ষতস্থান পঁচে যাওয়ার পরেও আমি বাঁচিয়ে তুলেছি। এখানে তো আমাকে ওদের প্রয়োজন। “আ-আ-আমি কথা বলতে পারি নাই।”
ওর চোখ সরু হয়ে যায়। “তুমি পারো নাই,” শুকনো গলায় সে আমার কথাই আবার বলে। “তাহলে আমি ধরে নিতেসি, তুমি এই বাসার নিচে চাপা পড়তে চাও। হাত-পা ভেঙে, রক্তারক্তি অবস্থায়। তোমাকে উদ্ধার করার জন্য কেউ আসবে না। কীভাবেই বা আসবে বলো? সবারই তো তোমার মতো অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে এমন অবস্থা হইসে যে ভাঙা ইট-সিমেন্টের দেয়াল তো দূরে থাক, কেউ আরেকজনের ভারই তুলতে পারে না। অথবা হইতে পারে, তুমি গ্রেফতার হইতে চাও। তোমার বাবা আর হামযাকে যেখানে নিয়ে গেসে, সেখানে যাইতে চাও। নির্যাতনের শিকার হইতে চাও এমন সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য, যেগুলা তুমি জানোই না। মিলিটারিদের দেয়া শাস্তি না, বরং পুরস্কার হিসেবেই তুমি মরতে চাও, না? এগুলাই কি চাও তুমি, সালামা?
আমার সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। “না।”
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সে ধোঁয়া ছাড়ে। পায়ের অক্সফোর্ড জুতার গোড়ালি দিয়ে অবশিষ্ট অংশটুকু মাড়িয়ে ফেলে। তারপর চৌকাঠ পার হয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়। ওকে দেখার জন্য আমি মাথা তুলি। তার দৃষ্টির শীতলতা যেন ডিসেম্বরের অরোন্টেস নদী।
“তাহলে পারি নাই আবার কোনো কথা? তুমি কথা দিসিলা আ’মের কাছে নৌকা চাবা আজকে। সারাদিনে তিনবার সে তোমার পাশ দিয়ে গেসে কিন্তু তুমি কিছু বলো নাই। নাকি তুমি চাইতেসো আমি আগের চুক্তিতে ফিরে যাই?”
“না!” আমি চিৎকার করে বলি, “না।”
এক চুটকিতে খওফ আমার চোখের সামনে বাস্তবতাকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। হ্যালুসিনেশনের ভেতর হ্যালুসিনেশন তৈরি করে মুহূর্তেই সে সবার কাছে উন্মোচিত করে দিতে পারে আমার এই শক্তপোক্ত খোলসের আড়ালে আমি আসলে কী ভঙ্গুর ডালে আশ্রয় নিয়েছি তীব্র ঝড়ো হাওয়ায়। এমন হলে ডাক্তার যিয়াদ আমাকে আর হাসপাতালে কাজ করতে দিবে না। আমার কারণে রোগীদের কোনো ক্ষতি হওয়ার সুযোগ তো উনি কখনো দিবে না। কিন্তু আমার জন্য হাসপাতালে কাজ করাটা খুবই জরুরি। নিজের কষ্ট ভুলে থাকার জন্য, নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য যাতে আমার মন চিৎকার করে কাঁদতে না পারে। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য।
আরো খারাপ কিছুও হতে পারে। আমার কারণে লায়লার দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে, যা ওর নিজের আর অনাগত সন্তানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
না। যত কষ্টই হোক, ওর জন্য হলেও আমাকে সব সহ্য করে নিতে হবে। আমার ভালো থাকা যদি লায়লাকে ভালো রাখে, তার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি।
এ জন্য, খওফ আমাকে কথা দিয়েছে, দিনের বেলা সে আমাকে দেখা দিবে না। ওর যত ভয় দেখানো দরকার সেটা শুধু ও রাতের আঁধারেই সীমাবদ্ধ রাখবে। যাতে অন্য কেউ আমার মানসিক অবস্থা টের না পায়।
একটা নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে ওঠে খওফের ঠোঁটে। “এটাই তোমার শেষ সুযোগ, সালামা। খোদার কসম, কালকে যদি তুমি কথা না বলো, আমি তোমার দুনিয়া তামা তামা করে দিব।”
ভয়ে দুরু দুরু বুকের মধ্য প্রচণ্ড রাগ জেগে ওঠে। আমার অবচেতন মন হয়তো আমাকে পুরোপুরি কব্জা করে নিয়েছে কিন্তু অবচেতন মনটা তো আমারই।
“এত সোজা না, খওফ!” আমি হিসহিস করে বলি। আমার তখন চোখে ভাসছে সে ছেলেটার চোখের চাহনি যখন সে তার ছোট বোনকে কোলে তুলে নিয়েছে। ছোট্ট তুলতুলে শরীরটা আলতো করে ধরে রেখেছে। সেই দৃশ্য চোখের সামনে থেকে তাড়িয়ে আমি বলি, “আ’মের কাছে নৌকা না-ও থাকতে পারে। আর যদি থাকেও, সে এমন দাম চাইতে পারে যেটা দেয়ার সাধ্য আমাদের নাই। তখন আমাদের হাতে একমাত্র উপায় থাকবে, তুরস্কের পথে পায়ে হেঁটে মিলিটারিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া। তা-ও যদি অতদূর পায়ে হাঁটার পর লায়লা বেঁচে থাকে, তো!
খওফ ভ্রু নাচিয়ে বিদ্রূপের স্বরে বলে, “আমি বুঝতেসি না, কেন তুমি লায়লাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হামযাকে দেয়া ওয়াদা এড়ায়ে যাইতেসো? হাসপাতালের জীবনটা নিয়ে তোমার ভিতর যে যুদ্ধ চলতেসে, সেটা তোমার মনেও ভেজাল লাগাইতেসে। এখন মূল বিষয় হইলো, তুমি ওয়াদা দিয়ে সেটা এখন ভাঙতেসো। এইসব হাবিজাবি বলে অনুশোচনারে এড়ানোর বাহানা করা চলবে না। আমাকে বলো, লায়লার নিরাপত্তার জন্য তুমি কি যে কোনো কিছু করতে রাজি না?
হাত দুটোকে পকেটে ঢুকিয়ে আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিই।
“এই স্মৃতিটা-” ও সোজা হয়ে বাঁকা হাসি হেসে বলে, “-তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।”
আমি চিৎকার দেয়ার আগেই ও তুড়ি বাজায়।
দইমাখা গোশতের ঝোলে পুদিনা আর দারুচিনির উবলানো ঘ্রাণ নাকে এসে লাগতেই নস্টালজিয়ার হাওয়া এসে গায়ে লাগে। চোখ মেলে তাকাতে আমার দ্বিধা হয়। তবু চোখ মেলি। তাকিয়ে দেখি সেই গুমোট ঘরটার পরিবর্তে আমি আমার বাসায় বসে আছি। আমার বাসা!
রান্নাঘরটা হুবহু আগের মতোই আছে। হালকা হলদে-বাদামি রঙের মার্বেল পাথরের দেয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে বাঁধা আরবি ক্যালিগ্রাফি আর সোনালি রঙের লেবুর ছবি আঁকা ক্যানভাস। ক্যাবিনেটগুলোর নিচের তাকে কড়াইসহ আর সব বাটি-ঘটি সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। কিচেন টেবিলটার ওপর পদ্মফুল আঁকা সাদা সাটিন কাপড় বিছানো। সেই টেবিলের চারপাশে চারটা চেয়ার আর উপরে স্বচ্ছ কাঁচের ফুলদানিতে ফুটে আছে ব্লু অর্কিড। আজ সেই দিন, যেদিন মেহমান আসার কথা ছিল বলে অর্কিডগুলো এনেছিলাম। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি ব্লু অর্কিড কিনে আনতাম।
বামে ঘুরে তাকাতেই দেখি মা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি শিশ বারাকের দিকে নিবদ্ধ রেখে কাঠের চামচ দিয়ে কড়াইয়ের ভেতরে নাড়াচাড়া করছেন। পুরোটা সময় ঠোঁট নেড়ে দুআ করছেন মা।
“ওদেরকে নিরাপদে রাখো, খোদা!”, ফিসফিস করে বলছেন, “আমার ছেলে আর তার বাবাকে নিরাপদে রাখো। সহি-সালামতে আজকে আমার কাছে ফিরায়ে দিও ওদেরকে। যারা ওদের ক্ষতি করতে চায় তাদের থেকে নিরাপত্তা দাও ওদের।”
আমার বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে, এই এক জায়গায় আমার সবকিছু থমকে গেছে।
মা আমার পাশে!
চোখের পানি নীরবে নেমে এসে গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে প্রাণপনে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। আমার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাই আমি। মা যখন আমাকে চুমু খেয়ে ‘ইয়া উমরি, তাকবুরনি’[1]তাকবুরনি আরবি শব্দ। মূলত আঞ্চলিক উচ্চারণে ইয়াবুরনি বা তাবুরনি (Ya’aburnee/te’eburnee)। … Continue reading বলে আমার সমস্ত যাতনা মুছে দিতেন, সেই মুহূর্তটায় ফিরে যেতে চাই আমি।
কিন্তু সেসবের কিছুই হয় না। আমি আলতো করে তার বাহুতে হাত রাখি। রক্তিম চোখে অন্যমনস্কতা নিয়ে মা তাকায়। তার মুখে ক্লান্ত হাসির রেখা ফুটে আছে। এই যুদ্ধটা মাকে কী পরিমাণ বদলে দিয়েছে, তার দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। তার কখনো-পঁয়ত্রিশ-না-পেরোনো-চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ, গাঢ় বাদামি চুলের গোড়াগুলো ধূসর হয়ে গেছে। অথচ আগে কখনো তার পাকধরা চুল দেখা যেত না। একটা নিখুঁত ছবির মতো ছিল মা। শরীরের হাড়গুলো এখন স্পষ্ট বোঝা যায়, চোখের নিচে জমেছে গাঢ় অন্ধকার ছায়া। এসবের কিছুই তো আগে ছিল না।
“তাকবুরনি, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ,” এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে মা বলেন। আমার হায়াত তোমার হোক।
তা-ই হয়েছে।
“হ্যাঁ, মা,” কোনোমতে বলি আমি। তার পরশে আমি যেন মোমের মত গলে যাচ্ছি।
“আরে, সালুমিইই,” হামযা বাবাকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ডাক দেয়। আমি আর একটু হলে কেঁদে ফেলছিলাম। ওরা এসে গেছে! হামযার বাদামি চোখজোড়া প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ঠিক বাবার চোখের প্রতিচ্ছবি! ওরা দুজনই গায়ের কোটের উপর সিরিয়ার পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছে কাঁধ থেকে। একটা প্যাঁচ দিলেই ফাঁস পড়ে যাবে এমন।
“কীরে? তুই কি সিরিয়াসলি কাঁদবি এখন?”
আমি হামযাকে লায়লার কথা কিছু জিজ্ঞেস করছি না। কারণ জানি, লায়লা এখন ওদের বাসায় ফিরে হামযার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু হামযা আজ ওখানে যাবে না।
“হামযা, ছোটবোনকে বিরক্ত করো না তো,” মায়ের কাছে যেতে যেতে বাবা বলেন। মা সাথে সাথে বাবাকে জাপটে ধরেন। বাবা ফিসফিস করে মায়ের কানে কিছু একটা বলেন।
“তুমি কি এখন চলে যাচ্ছো?” হামযাকে প্রশ্ন করতে গিয়ে আমার গলা ধরে আসছে, মাথা তুলে ওর দিকে তাকাতে হচ্ছে। গত সাতটা মাস আমি ওকে দেখতে পাইনি।
ও কোমল হাসি দেয়। “নামাজের পরেই আন্দোলন শুরু হবে, সেজন্য আগেভাগে যেতে হবে।”
বুকের ভেতর কান্না জোর করে আটকে রেখেছি আমি। হামযার বয়স সবে বাইশ। মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে বের হয়েছে কিছুদিন আগে। যাইতুনা হাসপাতালে আবাসিক ডাক্তার হিসেবে এপ্লাইও করেছে। তখনও হামযা জানত না ও বাবা হতে যাচ্ছে। যদি জানতো, তাহলে কি সেদিন ও আন্দোলনে যেত?
“যা-যায়ো না,” আমার কথা আটকে যায়। কে জানে, হয়তো এই হ্যালুসিনেশনের শেষটুকু সুন্দর হবে। হয়তো আমি কিছু ব্যাপার পাল্টে দিতে পারব। “প্লিজ, তুমি আর বাবা যায়ো না আজকে।“
“তুই প্রতিবারই এই কথা বলোস।”
আমি ওর হাত শক্ত করে ধরি। আমার চোখ তখন মুখস্থ করে নিচ্ছে ওর বিবর্ণ কোট, ও হাসলে সেই টোলপড়া গাল। আমার ভাইয়ের শেষ এই স্মৃতিটুকুই আছে আমার কাছে। সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিও প্রতারণা করে। একদিন হামযার বৈশিষ্ট্যগুলোও হুবহু মনে থাকবে না, জানি। ভুলে যাব বাবার চুলের বাদামি রঙের ভাঁজের ধূসরতা, চোখের মৃদু চমক। ভুলে যাব হামযা আমার থেকে কতোটুকু লম্বা, আমাদের দুজনের একই রকম বাদামি চুলের রঙ। ভুলে যাব মায়ের টোলপড়া গাল আর ভূবন আলোকিত করা হাসি। আমাদের পারিবারিক ছবিগুলো সব বাড়ির ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছে। কোনোদিন আর সেগুলো ফেরত পাব না।
“এহহে, সালামা, এমন করতেছিস কেন?” এ কথা বলে ও আমার চোখে পানি দেখে মাথা নাড়ায়। কিছুটা নরম হয়ে বলে, “আমি কথা দিচ্ছি, আমরা ফিরে আসবো।”
আমার ফুসফুস সংকুচিত হয়ে আসে। আমি জানি এরপর ও কী বলবে। প্রত্যেকটা শব্দ এলোমেলো হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এই আলাপ আমার মাথায় ক্রমাগত বেজেই চলেছে বহুকাল।
“কিন্তু আমি যদি না…” ও একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে গম্ভীর হয়ে বলে, “সালামা, আমি যদি না… তুই লায়লার পাশে থাকবি। ওর আর আম্মুর যেন কিছু না হয় সেটা খেয়াল রাখবি। তোদের তিনজনের যেন কিছু না হয় সে খেয়াল রাখবি।”
আমি ঢোক গিলি। “আমি তোমাকে আগেই কথা দিসি।”
প্রথম যখন আন্দোলন শুরু হয়, রাস্তায় যখন মানুষের ঢল নামে, হামযা তখনও আমাকে ঠিক এরকম করে ওয়াদা করিয়েছিল। ও সবসময়ই আগে থেকে বুঝতে পারত। বয়সের তুলনায় ভীষণ বুদ্ধিমান ছিল ও। আমার খারাপ সময় গেলে সেটাও বুঝতে পারত, আমি কিছু না বললেও। ওর মেঘের মতো কোমল হৃদয় চারপাশের সবাইকে ছুঁয়ে দিতে পারত। ও জানত মা এত ভয়ের মধ্যে থাকার পরেও উনাকে সিরিয়া থেকে জোর করে বের করে নিয়ে যাওয়াও ভীষণ কঠিন হতো, এটাও জানত লায়লাকে পালিয়ে যাওয়ার কথা বললে ও হেসেই উড়িয়ে দিত। কিন্তু আমি যে তাদেরকে যে কোনো মূল্যে আগলে রাখব এটাও সে জানত। আমার কাছে পরিবারের মানুষদের নিরাপত্তাই সবকিছু।
“আরেকবার কথা দে আমাকে।” ও জোর দিয়ে বলে। “আমার বিবেক থাকতে এই ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে আমি যেতে পারব না। তোর ওয়াদা চাই আমি।” ওর বাদামি চোখজোড়ায় যেন আগুন জ্বলছে।
কোনোমতে আমি ফিসফিস করে বলি, “ওয়াদা করলাম।” এই দুটো শব্দ আগে তো কখনো এত ভারী ছিল না।
এখন ও আমার মাথায় হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করে দিয়ে বাবার সাথে বের হয়ে যাওয়ার কথা, আর কখনো ফিরে না আসার পথে সে যাত্রা।
কিন্তু এবার আর ও তা করে না।
ওর হাত খপ করে আমার কাঁধে আঁকড়ে ধরে। “করসিলি?”
আমি হোঁচট খাই। “কী?”
ওর দৃষ্টিতে তখন আগুন লকলকায়। “মিলিটারিরা আমাকে আর বাবাকে নিয়ে যাওয়ার পরে মাকে বের করসিলি? লায়লাকে বাঁচাইসিলি? নাকি ওদের জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দিছিস?”
আমার হাড় ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে যায়।
“সালামা, তুই আমাকে মিথ্যা বলসিলি?” যন্ত্রণায় কাতরায় ও।
দুই হাতে বুক চেপে ধরে আমি পিছিয়ে আসি।
“তুই মাকে মরে যেতে দিলি?” আরো উঁচু গলায় ও জিজ্ঞেস করে।
মা-বাবা ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের চেহারার ডান পাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মেঝেতে গিয়ে পড়ছে প্রতি ফোঁটা রক্ত, যে মেঝে মা প্রতিদিন মুছে পরিষ্কার রাখত। প্রতিটা ফোঁটা যেন আমার হৃৎপিণ্ডে ছুরি হয়ে আঘাত হানছে।
“আ’ম স্যরি, আমারে মাফ করে দাও, প্লিজ!”
“স্যরি?” ভ্রু কুঁচকে বাবা বলেন। “তুমি তোমার মাকে মরে যেতে দিলে, এখন লায়লাকে মরে যেতে দিচ্ছো। কীসের জন্য?”
“মা হয়তো তোকে মাফ করে দিবে,” হামযা বলে, “কিন্তু আমি কখনো করব না। তোর নেয়া সিদ্ধান্তের কারণে যদি লায়লাকে ভুগতে হয়, সালামা, আমি তোকে কখনো মাফ করব না।”
আমি কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে পড়ে যাই। “আ’ম স্যরি। আ’ম স্যরি।”
“স্যরিতে হবে না।” ওরা সবাই একসাথে বলে।
হঠাৎ মেঝে কেঁপে ওঠে। আমার পা জড়িয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যায় টাইলসের নিচে। আমাদের রান্নাঘর, বাড়ি ভেঙে পড়তেই আমি কোনো এক অন্ধকার অতল গহ্বরে আছড়ে পড়ি, চিৎকার করি। পিঠে পাথরের ফলকের বাড়ি লাগে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ভীষণ। যখন চোখ খুলি, মাথার ওপরের আকাশ তখন ভরে গেছে কোনো এক বাড়ির আগুনের ধোঁয়ায়।
ফুসফুসে অক্সিজেনের অভাবে আমি কেশে উঠি। পায়ের কাঁপুনি নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়াই। আমার সামনে সেই সাত তলা ভবনটা, যেখানে আমার ঘর ছিল। ছয় তলার বারান্দায় ভেজা কাপড় মেলে দেয়া আর তার নিচের তলার বারান্দার রেলিঙের সাথে সিরিয়া বিপ্লবের পতাকা ঝুলছে গর্বিত ভঙ্গিতে। বাতাসের সাথে এটা এমনভাবে দোল খাচ্ছে যেন এখনই উড়ে যাবে। কিন্তু হামযা পতাকার চারপাশ এমন শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিল যে এটা কখনোই উড়ে যাবে না। ও আর বাবা গ্রেফতার হওয়ার পর মায়ের কখনো এটা নামিয়ে নেয়ার মতো শক্তি হয়নি।
আমার চারপাশে বাতাস বইছে ভীষণ। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই আমি জানি, এখন কোথায় আছি। খওফ আমাকে সেদিনের এক সপ্তাহ পরে আসা আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য দিনগুলোর কাছে নিয়ে এসেছে।
মা।
“না।” আমি আর্তনাদ করে উঠি, “না!”
“তুমি উনাকে বাঁচাতে পারবা না।” খওফ আমার কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। “উনি আরো আগেই মরে গেসে।”
আমার বাড়ি মাত্র পনেরো কদম দূরে। আমি পারব। মাকে বাঁচাতে পারব আমি।
“মা!” আমি চিৎকার দিয়ে তার দিকে দৌড়ে যাই। “বের হয়ে আসো, বের হয়ে আসো। প্লেনগুলো আসতেসে!”
কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে; আমার কথার চেয়ে দ্রুতগতিতে প্লেন ধেয়ে আসছে। আর বোমা-বারুদ নিরীহ মানুষের থোড়াই পরোয়া করে! বাড়িঘর ভেঙে রক্তমাখা টুকরোয় পরিণত হওয়ার প্রকাণ্ড আওয়াজ আমার কানে এসে বাজে। পুরো ভবন মাটিতে ধ্বসে পড়ে। আমি নিজেকে আবিষ্কার করি মায়ের ক্ষত-বিক্ষত শরীরের সামনে। তার মাথার কাপড় নেই, বাদামি চুলগুলো সব ইট-সিমেন্টের ধুলায় ধূসরিত হয়ে আছে, মাথা মচকে আছে উল্টাদিকে। আমার জুতাহীন পায়ে যেন রক্তের পলিমাটি জমে আছে, তীব্র ধাতব গন্ধে পেট ফুলে যাচ্ছে।
কাঁদতে কাঁদতে আমি হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি। মায়ের নিথর শরীরটা আমি আঁকড়ে ধরে বুকে টেনে নিই। তার গালের উপর থেকে চুল সরাতে গিয়ে আমার হাঁত কাপতে থাকে ভীষণ, রক্তে আরো মাখামাখি হয়ে যায় মা। কিছু ফোঁটা আমার মুখে এসে পড়ে। “মা! ইয়া আল্লাহ, আর না! আর না!”
মায়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“তুমি আমাকে বাঁচাওনি কেন?” মা ফিসফিস করে। তার চোখে অসীম শূন্যতা। “কেন?”
“আ’ম স্যরি! প্লিজ, আমাকে ,মাফ করে দাও!”
আমার চোখের পানি গড়িয়ে মায়ের মুখের উপর পড়ছে, ঠোঁটে কেবলই মাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি নিয়ে আমি তার দেহটা আরেকবার জড়িয়ে ধরি। দুজনের গা দিয়ে বয়ে যাওয়া রক্তে বন্যার মধ্যেও আমি মায়ের শরীরে আগের সেই একই গন্ধটা পাচ্ছি।
“উনি চলে গেসেন, সালামা।” আমার পেছন থেকে খওফ বলে। “তাকায়ে দেখো, তুমি ঐ যে ওখানে আছো।”
ওর হাতের ইশারাকে অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি, ধ্বংসস্তুপ আর বারুদের ধোঁয়ার ভেতরে অতীতের আমাকে দেখা যাচ্ছে। ওর গালগুলো তখন মাংসল, চোখগুলো ধীরে ধীরে বুঝে নিচ্ছে অনাগত সমূহ যাতনার পরিভাষা, যেগুলো তাকে চিরকাল সঙ্গ দিবে। ওর বয়স তখন মাত্র সতেরো বছর, জীবন কতটা ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর হতে পারে, তার কিছু ও জানে না, দেখেনি কখনো। ছেঁড়া জামা আর হিজাব গায়ে ও কাশতে কাশতে হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের লাশের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারল না। মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারাল।
রাগ-দুঃখ আমার ভেতরে একসাথে জেগে উঠে ক্রমেই শরীরের হাড়ে হাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
“যথেষ্ট হয়েছে,” মাকে বুকের আরো কাছে জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, “আমাকে আমার জায়গায় নিয়ে চলো এখন।“
আমার পাশে খওফ উবু হয়ে বসে, আমার গালে লেগে থাকা রক্তের ফোঁটা আঙুল দিয়ে মুছে একটা হাসি দেয়। এই ধ্বংসযজ্ঞের একটা কণাও ওকে ছোঁয় না। জানি না আমার দেখার ভুল কি না, তবু আমার মনে হয় ওর কাঁধের ওপরের লাল দাগটা বড় দেখাচ্ছে, যেন কোটের ভেতর থেকে চুয়ে পড়ছে।
খওফ আঙুলে তুড়ি বাজাতেই আমি নিজের বিছানায় ফেরত আসি। গায়ের সব ঝুলকালি আর রক্তের দাগ নিমিষে উধাও। নিজের ক্ষতবিক্ষত আর দাগ পড়া হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কোলের উপর হুট করে মায়ের না থাকাটা আমাকে বিচলিত করছে। ভেজা গালে লেগে থাকা নোনা জলের ফোঁটাগুলোই আমার এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার একমাত্র প্রমাণ।
খওফ গভীর শ্বাস টেনে নেয়। তার চেহারার প্রতিটা রেখা জানান দিচ্ছে তার পরিতৃপ্তির কথা।
“তুমি যদি এখনও ঘাড়ত্যাড়ামি করো, তাইলে লায়লার এই অবস্থা হবে।” বলে ও আরেকটা সিগারেট ধরায়। “এর মধ্যেই তুমি ওয়াদা অর্ধেক ভেঙে ফেলসো। বাকিটা ভাঙার জন্য কি এখন লায়লাকে মারতে চাও?”
“প্রতিদিন তোমার আরো আরো রোগী মরে যাইতেসে। একেকটা লাশ তোমার আরো একটা করে অনুশোচনা তৈরি করে। এখানে থেকে লায়লা বেঁচে থাকলেও তুমি শেষ হয়ে যাবা।”
“চলে যাও এখান থেকে!” আমি ফুঁপিয়ে উঠি। আমার নিজের মস্তিষ্ক এভাবে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ভেবে রাগ হয়।
“আমাকে কেউ বোকা মনে করলে আমার বিরক্ত লাগে, সালামা,” ও বিড়বিড় করে, “যা চাই সেটা দিয়ে দিলে আমি চলে যেতে পারি।”
আমার গলা শুকিয়ে গেছে। হাতের তালুতে নিজের নখের আঁচড়গুলো জ্বালা করছে। ওকে কোনো জবাব না দিয়ে আমি অন্যদিকে ফিরি। করোটির ভেতরে মগজ দপদপ করছে। তখনই চোখ যায় খাটের পাশের নাইটস্ট্যান্ডের দিকে, যেখানে আমার প্যানাডল ট্যাবলেটের পাতা লুকিয়ে রেখেছি। গত জুলাই মাস থেকে এগুলো বাঁচিয়ে রেখেছি লায়লার প্রসবের সময়ের জন্য। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, একটা খেয়ে নিই। কিন্তু নিজেকে বিরত করি। কে জানে, তখন কোথায় থাকব, সেখানে আদৌ কোনো ওষুধ পাওয়া যাবে কি না।
“জেসমিন, জেসমিন, জেসমিন….” আমি বিড়বিড় করে আওড়াতেই থাকি যতক্ষণ না ফুলের ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে, ঠিক যেমনটা মা বুকে জড়িয়ে নিলে লাগত।
চলবে…
তথ্যসূত্র:
↑1 | তাকবুরনি আরবি শব্দ। মূলত আঞ্চলিক উচ্চারণে ইয়াবুরনি বা তাবুরনি (Ya’aburnee/te’eburnee)। শব্দটি মূলত স্নেহের আতিশয্যে বলা প্রবচন। সরল বাংলায় ‘আমাকে কবর দিও’। ব্যাখা, আমি তোমাকে কবর দেয়ার আগে তুমি আমাকে কবর দিও। অর্থাৎ আমার প্রিয় মানুষটা যেন আমার চেয়ে দীর্ঘ আয়ু পায়। |
---|