উদিত দুঃখের দেশ (তৃতীয় পর্ব)

মূল : জুলফা কাতু'

আবিদা সুলতানা উমামা

উদিত দুঃখের দেশ (দ্বিতীয় পর্ব)

পরদিন সকাল। লায়লার গালে চুমু এঁকে বিদায় জানিয়ে আমি হাসপাতালের দিকে রওনা হই। জীবন এতোটাই অনিশ্চিত, আমরা জানিনা আবার দেখা হবে কি না। তাই, প্রতিটা মুহূর্তই আমাদের জন্য বিদায়ী মুহূর্ত।

“আমের সাথে কথা বইলো।” ওর উষ্ণ হাসির রেখা আমাকে হামযার কথা মনে করিয়ে দেয়।

কিছুই বলতে না পেরে আমি শুধু মাথা নাড়ি। বের হয়ে দরজায় তালা দিই।

লায়লার বাসা থেকে হাসপাতালে পায়ে হেঁটে যেতে পনের মিনিট লাগে। হামযা এরকম একটা সুযোগের খোঁজেই ছিলো। কারণ তরুণ একজন ডাক্তারের যদি বাসার কাছাকাছি কোনো হাসপাতালে চাকরি হয়, যেখানে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া লাগবে না তাহলে তার জন্য খুবই সুবিধা হয়। তিন বছর বয়সে হামযা যখন অক্ষর চিনতে শুরু করেছে, তখনই বাবা-মা বুঝে গিয়েছিলো তাদের ছেলে জিনিয়াস। অল্প বয়সেই ও স্কুলে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেয়। হোমসেরই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ভর্তি হয় যাতে পরিবারের কাছাকাছি থাকতে পারে। কিন্তু আমি জানতাম, ও আসলে লায়লার কাছাকাছি থেকে দুজনে নতুন জীবন শুরু করতে চাইছিলো।

যে চাকরিটা ওর করার কথা ছিলো সেটা এখন আমি করছি। অথচ এটা আমার কাজের ফিল্ডই না। ফার্মাসিস্টরা শুধু ওষুধ লিখতে পারে-সার্জারি করা তাদের কাজ না। আমার তো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তবেই কাজ করার অথবা গবেষণা করার কথা ছিলো। আমি তো সার্জন না। কাটাছেঁড়া অথবা ক্ষত সেলাই করার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না কখনো। কিন্তু নিজেকে আমার এমন মানুষে পরিণত করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে।

আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা এই হোমসকে দেখে আমার মনে হয় ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে তুলে আনা কোনো কিছু। এই বিগত বছরগুলোয়, আমার চোখের সামনে ঘটা মৃত্যুর জোয়ার বয়ে গেছে বহু শহরে। গল্পটা একই, শুধু জায়গাগুলো ভিন্ন। আমার মনে হয়, শহীদদের আত্মা এইসব পরিত্যক্ত ঘর-বাড়ি আর রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। আর দেয়ালে দেয়ালে আঁকা বিপ্লবের পতাকায় তারা হাত বুলিয়ে যায়। আর যারা বেঁচে আছে, গায়ে কোট-চাদর জড়িয়ে তারা বাইরে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে থাকে। আজ শিশুরা ভগ্নস্তপ থেকে যা পাচ্ছে তাই দিয়ে খেলছে। এদিকে এক বৃদ্ধা সমানে চেঁচিয়ে ওদের সতর্ক করছে রাস্তায় বিছানো গুঁড়া কাঁচের গালিচার ব্যাপারে। আমার গায়ে ল্যাব-কোট দেখে তিনি ফোকলা দাঁতে হাসলেন।

“আল্লাহ মা’য়েক!” আল্লাহ তোমার সাথে আছেন।

কাঁপা হাসি দিয়ে আমি ঘাড় নাড়ি।

স্বৈরতন্ত্রের অসুস্থ চর্চা হাসপাতালকেও ছাড় দেয়নি। রঙ ধুয়ে যাওয়া দেয়ালের হলদে-লাল আভাসই তা বলে দেয়। আর আমি পুরান জুতাজোড়ায় লেগে থাকা মাটিতে করে দিনের পর দিন বয়ে বেড়াই ক্ষত-বিক্ষত মানুষদের রক্ত।

হাসপাতালের দরজাগুলো সবসময় খোলাই থাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সবসময়ের মত ভিড় লেগেই আছে। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আহতদের আর্তচিৎকার।

সার্জারির যন্ত্রপাতি আর ওষুধপত্রের সংকট এখানে চিরন্তন। আর এই সংকটের ছাপ আমার চারপাশের বিছানায় শুয়ে থাকা প্রতিটা আনত চেহারায় স্পষ্ট। আজকাল আমি স্যালাইন দিয়ে রোগীদের বলি এ্যানেস্থেশিয়া দিচ্ছি এই ভরসায় যে অন্তত তাদের বিশ্বাসের কারণে এটা প্ল্যাসিবো[1]রোগীকে মানসিকভাবে আশ্বস্ত করার জন্য যে চিকিৎসা দেয়া হয়। অর্থাৎ, কোনো  … Continue reading হিসেবে কাজ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে থাকতে একটা আর্টিকেলে এই প্যাসিবোর সফলতা সম্পর্কে পড়েছিলাম। তখনকার দিনগুলোতে আমি লেকচার ভবনের সিঁড়ির কোণায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকতাম ক্লাসনোটস আর ফ্লাস্কভর্তি যুরাত চা হাতে। পড়াশোনার জগতে এতই ডুবে থাকতাম, কোন ফাঁকে যে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যেতো টেরই পেতাম না। সন্ধ্যা হয়ে এলে লায়লা এসে আমার নাকে টোকা মেরে ধ্যান ভাঙতো।

এতসব সংকট আর টানাপোড়েনের মধ্যেও আমাদের এই ফ্রি সিরিয়ান আর্মির আওতায় থাকা হাসপাতালটা ঐ মিলিটারিদের এলাকার হাসপাতালগুলোর চেয়ে হাজারগুণে ভালো চলছে।

মিলিটারিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হাসপাতালগুলোর গল্প আমাদের কানে আসে। সেখানকার রোগীরা আন্দোলনে পাওয়া আঘাতে ঠিক বেঁচে গেলেও চিকিৎসার জন্য গিয়ে মরতে বসছে। এখানে আমাদের ভোগান্তি অবরোধ আর হামলার ক্ষয়ক্ষতির কারণে, আর ওখানে চলছে রোগীদের পা শেকল দিয়ে বিছানায় বেঁধে নির্মম নির্যাতন। এমনকি ডাক্তার আর নার্সেরাও কখনো কখনো এই নির্যাতনে শামিল হয়।

আমাদের হাসপাতালে বিছানাগুলো গাদাগাদি করে রাখা, রোগীদের আত্মীয়-স্বজনের এত ভিড় যে তাদের হালপুরসির জন্য গেলে আমাকে তাদের মাঝখানে রীতিমত চ্যাপ্টা হয়ে যেতে হয়। ডাক্তার যিয়াদ দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন, মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য রোগী পার করে, সতর্ক পায়ে। এই মানুষগুলোর কোনো পরিবার-পরিজন নেই। এমনকি একটা বিছানা ব্যবস্থা করার মতোও কেউ নেই। ডাক্তার যিয়াদের ধূসর চুলগুলো এলোমেলো। বাদামি চোখজোড়ার চারপাশে চামড়ার ভাঁজ এখন আরো স্পষ্ট। এক মিলিটারি অভিযানে এই হাসপাতালের হেড সার্জন মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। তার আগে তিনি একজন এন্ডোক্রাইনোলোজিস্ট হিসেবে নিজের বাঁধা সময়ে কাজ করতে এবং ধীরে ধীরে অবসরে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছিলেন। যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলো, তিনি সাথে সাথে পরিবারকে লেবাননে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন থেকে এই হাসপাতালই তার বাড়ি-ঘর।

“আসছে। আল-ঘৌতায় বোমা হামলার খবর পাওয়া গেছে। বিশজন আহত হয়েছে। ১৭ জনকে এখানে আনা হচ্ছে,” তিনি বলেন। হেড সার্জন হিসেবে তিনি ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সাথে যুক্ত আছেন, তারা তাঁকে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য দেয় যার ফলে আরো কিছু মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয় ।

এক মুহূর্তের জন্য আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। জায়গাটা আমার এলাকার উল্টাপাশে। গাড়িতে করে যেতে আধাঘন্টা লাগে। তার মানে, লায়লা নিরাপদ আছে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই আমার চেতনা কাজ করে। বোমা হামলা মানেই হাসপাতালের দরজাগুলোয় যে কোনো দৃশ্যের অবতারণা। মানুষের নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসা অথবা ভেতরে পেঁচিয়ে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, ছিন্নবিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ…

ডাক্তার যিয়াদের সাথে সদর দরজায় অপেক্ষা করছি। তিনি নিচুস্বরে আল্লাহর রহমত ও দয়া সম্পর্কিত আয়াত তিলাওয়াত করছেন। আমার ঘাড় বেয়ে নেমে আসা ঘামের প্রবাহ শান্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন যে কোনো মুহূর্তে দরজাগুলো ধড়াম করে খুলে যাবে।

যে কোনো মুহূর্তে।

আমার সামনের জানালায় খওফ হাজির হয়। হাসপাতালের ভাঙা বাতির আলোতেও ওর গায়ের কাপড় ঝলমল করছে। মাথার চুলগুলো পেছনে টেনে আঁচড়ানো। আমার দিকে তাকিয়ে ও দাঁত বের করে হাসছে। হাসপাতাল খওফের প্রিয় জায়গা। ও জানে, লায়লার কিছু হয়ে যাওয়ার ভয় আমার সিরিয়ায় থাকার সিদ্ধান্ত পালটে দিতে পারে। এই ভয়েই আমি একসময় সিরিয়া ছেড়ে চলে যেতে পারি, সেটা ও জানে।

দরজা খোলার আগেই আমরা চিৎকার শুনতে পাই, আধা সেকেন্ড সময় পাই নিজেদের প্রস্তুত করে নেয়ার জন্য। কিন্তু এই দৃশ্য আমি হাজারবার দেখলেও কোনো সতর্কবার্তাই আমাকে এভাবে মানুষের মরে যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত করতে পারবে না। এটা সাধারণ কিছু না। কখনো হতেই পারে না!

“সালামা, বাচ্চাদেরকে আগে ধরো,” ডাক্তার যিয়াদ রোগীদের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে বলেন। “নূর, কারো যেন রক্ত বের না হয় সেটা দেখো। মাহমুদ, ব্যান্ডেজ শেষ হয়ে গেছে এমন যেন না হয়। দরকার হলে বিছানার চাদর দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিবা। যাও!”

পাঁচজনকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকিদের স্বেচ্ছাসেবীরা ধরে ধরে নিয়ে যায়। তাদের চারপাশে প্রচুর ভিড় জমে যায়। সবাই চিৎকার করছে, চেঁচাচ্ছে। ডাক্তার যিয়াদ উঁচু গলায় বাকি স্টাফদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এই নৃশংস দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি আরো একবার কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে আমার মন। তিনিই আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, মানুষের জীবন বাঁচাতে পারার উসিলা।

চেহারায় তৃপ্তির হাসি নিয়ে খওফ সটান দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। এরপর সে গুনগুনিয়ে সুর তোলে বিপ্লবীদের সঙ্গীত, ‘স্বাধীনতার সুখে’র। কিন্তু ওকে কিছু বলার সময় আমার নেই। মৃত্যু কারও অপেক্ষা করে না।

রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে তাদের ব্যান্ডেজ করা, সারিয়ে তোলার চেষ্টা করাই আমার জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং। কখনো কখনো আমাকে দেখার পর তারা আরো বয়স্ক, আর অভিজ্ঞ ডাক্তার চায়। প্রথম প্রথম আমি দমে যেতাম। শরীর কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা করতাম আর তোতলাতে তোতলাতে বোঝানোর চেষ্টা করতাম যে, অন্য ডাক্তাররা কত ব্যস্ত, আর আমিও তাদের সমানই অভিজ্ঞ। কিন্তু এখন যদি কেউ আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা সেকেন্ডও নষ্ট করতে চায়, সাফ জানিয়ে দিই চিকিৎসা নিলে নেন, নয়ত মৃত্যুর দরজা খোলা। এখন তারা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোন দিকে যাবে।

এখানে কাজ করার কারণে আমার মন এতোটা কঠিন আর এতোটা নরম হয়েছে যা আমি কখনো ভাবতেও পারতাম না।

পঞ্চম রোগীকে ব্যান্ডেজ করার সময় হঠাৎ চোখ পড়ে একজনের উপর, দিশেহারা হয়ে ছোট্ট একটা মেয়েকে কোলে করে আনছে সে। দেখতে মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বেশি বয়স হবে না। সদ্য কৈশোর পেরোনো। মেয়েটার মাথা একদিকে কাত হয়ে ঝুলে আছে, গায়ের জামা থেকে রক্তের ফোঁটা গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে। ছেলেটা অনুসরণ করে আমার চোখ। হাসপাতালের টিমটিমে আলোয় অগোছালো কোঁকড়া চুলের ছেলেটাকে পরিচিত মনে হয়। কিন্তু ওকে জায়গা দেয়ার আগেই ডাক্তার যিয়াদ অন্য একজন রোগীকে সাহায্য করার জন্য আমাকে ডাকেন। রোগীর গলার হাঁড় ভেঙে বাহু দিয়ে ঢুকে গেছে। চামড়া ফুঁড়ে বের হওয়া হাড় দেখে আমার পেট গুলিয়ে বমি আসে, গলা অব্দি উঠে যায়, জ্বালাপোড়া করে। কিন্তু জোর করে অনুভূতিটাকে গিলে নিয়ে আমি হাড়টাকে নিজের জায়গায় বসানোর কাজে নেমে পড়ি।

পরপর তিনটা সার্জারির পর আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে যাই। তখনই আ’মকে পাশ দিয়ে যেতে দেখি। ওর সাথে কথা বলতে হবে। আজকেই। আমার মনে হচ্ছে, খওফের দৃষ্টি আমার মাথার চামড়া ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, ওর হুমকি মাথার ভেতর বেজেই চলেছে।

তোমার দুনিয়া আমি তামা তামা করে দিবো।

খওফ যে কোনো মূল্যে আমাকে সিরিয়া ছাড়তে বাধ্য করবেই। এই যে এত মাস ধরে ওকে চিনি, ওর এই ব্যাকুলতার কারণ আমি কখনও বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ, মাথার ভেতরে কেউ একজন ফিসফিস করে সবটা বুঝিয়ে দিচ্ছে।

“জিজ্ঞেস করতে ক্ষতি কী? তুমি তো শুধু তথ্য নিবে। শুধু এইটুকু জানার জন্য যে খরচ কেমন আসবে। ওর জন্য এইটুকু করো।”

“আ’ম,” আমি ধুপ করে বলে বসি। ও থেমে আমার দিকে ফেরে।

“জ্বি?” অবাক হয়ে ও জবাব দেয়। বয়সের তুলনায় ওকে আরো বয়স্ক মনে হচ্ছে। অবশ্য চলমান ঘটনাগুলোর সাপেক্ষে ত্রিশের কোটায় পা দেয়া কারো চুল ধূসর হয়ে গেলে এখন আর অবাক লাগে না।

“আমি-ইয়ে…মানে, আমি ভাবছিলাম-“আমি তোতলাতে থাকি। কী বলবো সেটা আমার আগে থেকেই ভেবে রাখা উচিত ছিলো।

“তোমার নৌকা লাগবে, সালামা?” ওর কথা শুনে আমার চেহারা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

গায়ের ল্যাবকোটটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরি যে মোটা কাপড় হওয়ার পরেও ভাঁজ পড়ে যায়। আমার মনে হচ্ছে, আমাকে ও ভীরু ভাবছে। যত মানুষ ওর কাছে সাহায্য চেয়েছে আমিও এখন তাদের একজন, আশপাশের তিন এলাকা মিলে যে একটা ফার্মাসিস্টকে পাওয়া যায়, সেই জন।

“তাই না?” ভ্রু কপালে তুলে সে আবার বলে।

হামযার চিন্তিত চেহারাটা মনে পড়ে। “হ্যাঁ।”

আ’ম একপাশে সরে এসে একবার চারপাশে দেখে নেয় কেউ শুনছে কি না, “আচ্ছা ঠিক আছে। মেইন হলওয়েতে দেখা করো দশ মিনিট পর।”

ডাক্তার যিয়াদ বা নূর আমাকে খুজতে আসার আগে কিছু মিনিট আমার হাতে আছে। যদিও ডাক্তার যিয়াদ সবসময়ই আমাকে বিশ্রাম নিতে জোর দেন। তবু আমার হাতের তালু ঘামছে। দশ মিনিটে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। কারও শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে, হৃৎযন্ত্র অচল হয়ে যেতে পারে অথবা কারও রক্তবমি হতে পারে। যে কোনো কিছু! কিন্তু আমি হামযাকে কথা দিয়েছি। লায়লা আমার বোন, আমার একমাত্র পরিজন। ওর গর্ভে আমার ভাইয়ের সন্তান, যার কথা হামযা জানার সুযোগ পায়নি এবং কোনোদিন চোখের দেখাও দেখতে পাবে না। আমার এখন জানতে হবে সিরিয়া ছেড়ে যাওয়ার খরচ আমাদের জোগাড় করা সম্ভব কি না। খওফের ক্ষমতার বিস্তৃতি আমার পরীক্ষা করে দেখতে হবে না। ও চাইলে, আজকের দিনকেই হাসপাতালে আমার কাজ করার শেষ দিনে পরিণত করতে পারে।

“ডে-লিলি” মেইন হলের দিকে যেতে যেতে আওড়াতে থাকি, চোখজোড়া নিবদ্ধ রাখি কাদামাখা মেঝেতে। “পেশীর খিঁচুনি আর ব্যথা উপশম করে। আর্সেনিকের বিষ্ক্রিয়া কাটাতে পারে। ডে-লিলি। ডে-লিলি…”

মেইন হলে রোগীর ভিড় অনেক বেশি। এখন বুঝতে পারছি আ’ম কেন এখানেই ডেকেছে। এখানে কথা বললে আশাপাশের মানুষের কাছে বিনা পয়সায় আ’মের পাবলিসিটি হয়ে যাবে। তারা তখন জানবে আ’ম কে, কী করে আর কিভাবে সে নতুন জীবনের সম্ভাবনার কথা দিচ্ছে।

আ’ম প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে খদ্দের খুঁজতে আসে। মানুষ তার সারাজীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে নৌকায় করে অন্য মহাদেশের দিকে যাত্রা করে, যেসবের কথা আমাদের অনেকে কেবল বইয়ের পাতাতেই পড়েছে। হাসপাতালের সবাই আ’মকে চেনে। এমনকি ডাক্তার যিয়াদও, যিনি মনে করেন বেশিরভাগ মানুষের সিরিয়াতেই থাকা উচিত। তবে, যারা চলে যেতে চায় তাদের তিনি কখনো মানা করেন না, কারণ তার নিজের পরিবারকেই তো তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আ’ম যতক্ষণ না রোগীদের জীবন বাঁচানোর কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ সে তার নিজের ধান্ধা চালিয়ে যেতেও কোনো বাধা নেই। ডাক্তারদের থেকে ও দূরেই থাকে। ওর সব মনোযোগ রোগীদের প্রতি। যে সকল পরিবার ইউরোপীয় উপকূলে পৌঁছে গেছে তাদের ছবি দেখিয়ে আ’ম বাকিদের সে সফলতা জানানোর কোনো চেষ্টা সে ছাড়ে না। কারণ, প্রমাণ ছাড়া পানিতে ডুবে মরার ঝুঁকি কেউই নিতে রাজি হবে না। এটা অবশ্য প্রাথমিক ধাপ। কিন্তু তারপরে কেউ কেউ প্রমাণ ছাড়াই মেনে নেয় যে, এই গণহত্যার জোয়ারে বসে থাকার চেয়ে অন্য কোথাও বেঁচে থাকার আশা করাই ভালো।

অন্য কোনো উপায় থাকলে কেউই নড়বড়ে নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ী দিতে যেতো না।

চলবে…

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 রোগীকে মানসিকভাবে আশ্বস্ত করার জন্য যে চিকিৎসা দেয়া হয়। অর্থাৎ, কোনো ঔষধি গুণ ছাড়া যে কোনো কিছু দেয়া যার ফলে রোগী বিশ্বাস করবে যে তাকে ওষুধ দেয়া হচ্ছে এবং সে নিজের বিশ্বাসের কারণে কিছুটা সুস্থবোধ করবে।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Chemist
Chemist
1 year ago

Can’t wait to read the next episode

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷