শত শত অবসন্ন চেহারার ভিড়ে খওফ আবার হাজির হয়, জ্বলজ্বলে চোখ আর সেই পরিচিত হাসি নিয়ে।
এই যে ও আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে, এর কারণকে হয়তো বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখা দেয়া যায়। খওফ আমার মস্তিষ্কের বানানো সেই ডিফেন্স মেকানিজম, যা যে কোনো মূল্যে আমার টিকে থাকা নিশ্চিত করতে চায়। তবু ও আমার কী হাল করতে পারে সেটা ভাবলেই আমার যন্ত্রণা হয়।
দশ মিনিটের মধ্যে আ’ম হলওয়েতে আমাকে খুঁজে বের করে। মেঝেতে পড়ে থাকা শতশত মানুষের শরীর ডিঙিয়ে আমি যে ভাঙা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে এসে পৌঁছায়।
আমার নার্ভাস সিস্টেম আবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সারা শরীরে এমনভাবে বিদ্যুৎ স্পন্দিত হচ্ছে, কোনোভাবেই নিজেকে আর শান্ত করতে পারছি না। হুট করে ডাক্তার যিয়াদ চলে আসতে পারে এই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। হাতের কাঁপুনি আড়াল করতে হাত পকেটে ঢুকিয়ে ফেলি। উনি যদি আমাকে এখানে দেখে, আমি নিজমুখে উনাকে কখনো বলতে পারব না যে আমি দেশের মানুষদের রেখে পালিয়ে যাচ্ছি। এই আলাপ তোলা আমার পক্ষে অসম্ভব।
“তো, কয়জন তোমরা?” আ’মের প্রশ্ন শুনে সম্বিৎ ফিরে পাই।
“দুইজন,” আমার কণ্ঠ যেন দূর থেকে ভেসে আসছে।
এক মুহূর্তের জন্য সে আমাকে দেখে। “এই-ই তোমার পুরা পরিবার?”
সংজ্ঞাতীত যন্ত্রণায় আমার বুক ভেঙে আসে। “হ্যাঁ।”
ও মাথা নাড়ে, কিন্তু চেহারার অভিব্যক্তি নিরাবেগ। পরিবারে শুধু একজন থাকাও এখন আর অবাক করার মতো কিছু না।
“আমি তোমাদেরকে তারতুস পর্যন্ত নিয়ে যাব,” আবহাওয়া নিয়ে আলাপ করার মতো স্বাভাবিক স্বরে ও বলে।
“ওখান থেকেই সাধারণত বোটগুলো ছাড়ে। ভূমধ্য সাগর হয়ে দেড়দিন লাগবে ইতালি পৌঁছাতে। সেখান থেকে বাসে করে জার্মানিতে নিয়ে যাবে তোমাদেরকে। ইতালিতে পৌঁছানোটাই সবচেয়ে জরুরি।
আ’মের প্রতিটা শব্দ আমার মনকে আরো বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। ওর বর্ণনা যদিও নিরস, তবুও চোখের সামনে আমার আসন্ন যাত্রার দৃশ্য ভেসে ওঠে। নীল সমুদ্রের বুক চিরে বোট ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেই তীরে যে দিয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতিজ্ঞা। আমার দিকে ফিরে লায়লা হাসছে, যে হাসিতে মিশে আছে এই কথা—আমরা এখন নিরাপদ। ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষায় আমার ভেতরটা আকুলিবিকুলি করছে।
এক শিশুর কান্নার আওয়াজে দিবাস্বপ্ন ভেঙে বাস্তবে ফিরে আসি। হঠাৎ আবিষ্কার করি, রোগীদের আর্তনাদ যেন আমার কান বধির করে দিচ্ছে। না, না। পীড়িতের সেবা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে কী করে আমি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে পারি?
কিন্তু লায়লা অন্তঃসত্ত্বা আর আমি হামযাকে কথা দিয়েছি। একে তো লায়লা আমাকে রেখে কখনোই যাবে না, তার উপর আমিও তো ওকে ইউরোপের একটা দেশে এভাবে একা ছেড়ে দিতে পারি না। কারণ জার্মান বা ইতালিয়ান ভাষা তো দূরে থাক, ও ইংরেজিতেও ভালো করে কথা বলতে পারে না। অসুস্থতা আর নিঃসঙ্গতা ওকে আরো সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে। কারণ অমানুষ তো সিরিয়ার বাইরেও আছে।
সিদ্ধান্তহীনতা আমাকে প্রচণ্ড বিষিয়ে তুলছে।
গলা ঝেড়ে নিয়ে প্রশ্ন করি, “খরচ কেমন পড়বে?”
কিছুটা ভেবে নিয়ে ও বলে, “চার হাজার ডলার লাগবে, আর এখানে লাইন আছে।”
“কীইইহ!?”
“আমি ডলারে কাজ করি। লিরার কোনো ভরসা নাই। একজনের দুই হাজার করে মোট চারহাজার লাগবে।”
আমার চেহারা থেকে রক্ত সরে যায়, মুখ শুকিয়ে আসে। এত বেশি তো আমাদের কাছে নেই। শুরুর দিকে বাবা ছয় হাজার ডলার তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগই খরচ হয়ে গেছে। আমাদের কাছে এখন মোটে তিন হাজার ডলার আছে।
আমার চেহারার রঙ বদলে যাওয়া ওর চোখ এড়ায় না। কিছুটা রুঢ় স্বরেই সে বলে, “তোমার কি মনে হয় ইউরোপ যাওয়া খুব সোজা? গোটা গোটা দুইটা মানুষকে এক ভিন্ন উপমহাদেশে পাচার করার কথা হইতেছে এখানে। পুরা রাস্তায় যে সৈন্যদের ঘুষ দিতে হবে, সে কথা তো বাদই দিলাম।”
আমার পায়ের বোধশক্তি শূন্য হয়ে গেছে। “তুমি বুঝতেছো না। আমার সাথে আমার ভাবী যাবে। ও সাতমাসের প্রেগন্যান্ট। ও যদি…ওর জন্যেও আমাদের টাকা দরকার। এত টাকা আমার কাছে নাই। প্লিজ, একটু ভাবো।”
আ’ম এক মিনিট ভাবে। “চার হাজার ডলার দিবা, আমি তোমাদেরকে ওয়েইটিং লাইন ছাড়াই ব্যবস্থা করে দিব। এইটুকুই করতে পারি আপাতত। চিন্তা করতে বেশি সময় লাগায়ো না। বোট কিন্তু কারও জন্য অপেক্ষা করে না।
এই বলে ও চলে যায়। আমার মনে হচ্ছে মাটিতে দেবে গেছি আমি। খওফ চোখ সরু করে আ’মের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। জানি না, এই সমস্যার কী সমাধান দিবে আমার মস্তিষ্ক!
***
ডাক্তার যিয়াদ আমাকে খুঁজে পেলেন রিকোভারি রুমে। আমি তখন মাটিতে বসে দু’হাতে হাঁটু চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় সামনে পেছনে দুলছি, কাঁপছি আর কাঁদছি। ছোট ছোট দুইটা মেয়ে নিথর পড়ে আছে আমার পাশে, তাদের গলায় বুলেটের গর্ত। বয়স বড়জোর সাত হবে, গায়ের কাপড় ছেঁড়া আর হাঁটুতে ক্ষতচিহ্ন।
স্নাইপারের লক্ষ্যবস্তু সবসময় নিরপরাধ মানুষই হয়, যারা লড়াই করতে পারে না। শিশু, বৃদ্ধ আর হবু মায়েরা। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ডাক্তার যিয়াদকে জানিয়েছিল মিলিটারিরা তাদের আঘাত করতে পারে। এই তো, অক্টোবরেই লায়লা খুব সামান্যর জন্য বেঁচে ফিরেছিল; তাই এখন আর আমি ওকে কোথাও যেতে দিই না।
ডাক্তার যিয়াদ আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেন। তার চেহারায় যন্ত্রণার গভীর ছাপ।
“সালামা, আমার দিকে তাকাও।”
ক্ষত-বিক্ষত বেগুনি ছোপে ভরা ছোট ছোট মুখগুলো থেকে চোখ সরিয়ে আমি তার দিকে তাকাই। আমার ঠোঁট এমনভাবে কাঁপছে, থামানোর জন্য দুহাতে চেপে ধরি।
“সালামা, এই বিষয়ে তোমার সাথে কথা হইছে না? এই অবস্থায় তুমি কাজ করতে পারবা না। তোমার পক্ষে সম্ভব না, মা। নিজের দিকেও তো একবার দেখতে হবে তোমার। তুমি যদি নিজেই ভুক্তভোগী হও, তুমি অন্যদের সাহায্য করতে পারবা না তো। এই ভয়ংকর পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব তোমার বয়সি কারও না।” তার দৃষ্টি আরো কোমল হয়ে আসে। “তুমি অনেক কিছু হারাইছো। নিজেকে আর হাসপাতালের দেয়ালের ভেতরে আটকে রেখো না। বাড়ি যাও।”
ডাক্তার যিয়াদের কথা আমার বুঝে আসে না। গত সাত মাস ধরে এই মানুষটার মধ্যে আমি বাবার ছায়া খুঁজে বেড়াই। আমার বয়সি তার একটা মেয়ে আছে, আমার মধ্যে হয়তো তিনিও নিজের মেয়েকে দেখেন। হাসপাতালে প্রতিদিন যেসব ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, নিজের মেয়ের জন্য উনি কখনোই এমনটা চাইবেন না। এই যে নিরীহ মানুষদের রক্তে আমার দুহাত ভরে যায়, প্রতিদিন ভয়ংকর সব দৃশ্যের সাক্ষী হয়েও পরদিন আবার ফিরে আসি—এই জিনিসগুলো উনি নিজের মেয়ে হিসেবে আমার কাছে আশা করেন না। আমার মনের খুব ছোট্ট একটা অংশ তাই মাঝেমধ্যে ডাক্তার যিয়াদের প্রতি রুষ্ট হয়। অথচ উনি আমার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কখনো আমাকে সাধ্যের বাইরে কাজ করতে দেন না।
“কিন্তু এখানে রোগী আরো বাকি আছে…”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বাধা দিয়ে বলেন, “তোমার জীবনও ওদের জীবনের সমানই গুরুত্বপূর্ণ!” তার কণ্ঠ অনমনীয়, আমাকে আপত্তি করার সুযোগ দিচ্ছেন না।
চোখ বন্ধ করে আমি কথাগুলো মেনে নেয়ার চেষ্টা করি, বিশ্বাস করার চেষ্টা করি। কিন্তু যতবারই দুহাতে শব্দগুলো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি, ততই সব মুঠো থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
তবু, কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াই। ডাক্তার যিয়াদ লাশগুলোর উপর একটা সাদা চাদর ছুঁড়ে মেলে দেন।
***
বাসায় ফিরে কাউচে গা এলিয়ে পড়ে থাকি দীর্ঘক্ষণ। এই পুরো সময়ে লায়লা কিছুই বলে না।
চোখ বন্ধ রেখে আমি আ’মের কথাগুলো লায়লাকে শোনাই। খরচের কথা বলার সময় গলা কাঁপে আমার। লোকটার প্রতি ঘৃণা হয়। আমাদের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সে নিজের পকেট ভরছে, তার কাছে নিরীহ প্রাণগুলোর কোনো মূল্যই নেই। চুড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ পরিস্থিতি না হলে কেউ এভাবে আরেক দেশে পালিয়ে বাঁচতে চায় না। তারা তো শুধু বেঁচে থাকার জন্য কোনো রকম একটা আশ্রয় চাইছে, তা খড়কুটোর মতো হলেও হোক।
“কিছু তো বলো,” আমি অনুরোধ করি। ওর নীরবতায় চোখ খুলি। ও কফি টেবিলটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা পরিকল্পনা করছে। হুট করে ভেংচি কেটে বলে,
“আমার কিছু বলার নাই”, ভ্রু তুলে আবার বলে, “তবে যদি…”
“যদি কী?”
“আমাদের স্বর্ণের গয়না বিক্রি করি?” আঙুলে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে ও। শেষ বিকেলের সূর্যটা দাগপড়া জানালার কাঁচ বেয়ে লিভিংরুমের মাঝখানে এসে আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোয় এরাবিয়ান কার্পেটটাকে আধিভৌতিক কিছু মনে হচ্ছে।
গয়না বিক্রির কথা বলছে ও।
আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য এইসব গয়না। চকচকে রূপের আড়ালে ঘন বুনটে এগুলো যুগ যুগ ধরে বহন করছে আমাদের ইতিহাস, আমাদের গল্প।
বোমা হামলার পর যখন আমি আমাদের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া বিল্ডিংয়ে আবার গিয়েছিলাম, আমার নিজের কিছুই সেখানে আর খুঁজে পাইনি। গ্রানাইট সব ধ্বসিয়ে দিয়েছে। আমার গয়নাগাটি সব ওখানেই, মাটির নিচে পড়ে আছে। কিন্তু লায়লারগুলো এখানে। মোহরানার অংশ হিসেবে হামযার দেয়া গয়নাগুলো।
“কে কিনবে ওগুলা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
লায়লা হাত নেড়ে বলে, “আ’ম হয়ত ডলারের জায়গায় স্বর্ণ দিলে নিবে।”
স্বর্ণ দিয়ে কেউ দেশ ছেড়ে যাওয়ার উপায় পেয়েছে এরকমটা আমি শুনিনি। কিন্তু এমনও না যে আমাদের আগে কেউ এরকম চিন্তা করেনি। আর তাছাড়া আমি লায়লার—আমাদের পরিবারের—স্বর্ণ এভাবে ছেড়ে দিতে চাচ্ছি না। আ’মের মতো খারাপ লোকের কাছে তো কখনোই না।
“ও তো বলে নাই ডলার না হইলে স্বর্ণ দিতে। স্বর্ণ চাইলে ও বলতই।”
“তাহলে তুমি ওকে জিজ্ঞেস করতেও চাচ্ছো না?” লায়লা প্রশ্ন করে।
“আচ্ছা, আমি দামাদামি করে দেখব ওর সাথে।”
প্রথমে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে লায়লা, তারপর হাসিতে ফেটে পড়ে৷ “ওর সাথে দামাদামি? তোমার কী মনে হয়? এটা কি আল হামিদিয়া বাজার?”
লায়লার আঁকা একটা ক্যানভাস আটকানো মেহগনি ফ্রেমের দিকে আঙুল তুলি আমি। এই ছবিটা আমার খুব পছন্দের—গাঢ় নীল আকাশ এসে ধূসর সমুদ্রে মিশে গেছে। লায়লা যে কীভাবে এমন সুন্দর ছবি হুবহু এঁকে ফেলেছে, আমার মাথায়ই ঢোকে না। সমুদ্রের পানিগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় এখনি ফ্রেম ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসবে, কার্পেটটাকে ভিজিয়ে দেবে। মেঘগুলো সব দলবদ্ধ হয়ে জমাট বেঁধে আছে, যেন এখনই তুফান শুরু হবে।
“ওই ফ্রেমটা অর্ধেক দামে তোমার কাছে বেচার জন্য লোকটারে কে পটাইছে? এত সুন্দর ফ্রেম! তুমি পটাইছিলা?”
লায়লা হাসে। “না, তুমি।”
“জি হ্যাঁ, আমি। তো… আ’মের সাথেও আমিই দেখব ব্যাপারটা।”
কিন্তু বাকি চিন্তাগুলো আমি ওকে আর বলি না। আমি যে কথাগুলো ওকে শুধু হাসানোর জন্য বলছি, আমি যে ভাইকে দেয়া প্রতিজ্ঞা আর হাসপাতালের প্রতি কর্তব্যের উভয় সংকটে পড়ে অন্তর্দ্বন্দ্বের করাতে চিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি—এসবের কিছুই আমি ওকে বলি না।
তবু, ওর চোখের দৃষ্টিতে কী যেন আছে। যা দেখে আমার মনে হচ্ছে ও সবকিছুই বুঝতে পারছে।।
“তুমি জার্মানির কথা এমনভাবে বলো, মনে হয় যেন এটা এমন একটা জায়গা যেখানে আমাদের সব স্বপ্ন পূরণ হবে।” আমার চোখ আবার ওই ছবিটার দিকে চলে যায়। এত বাস্তব মনে হয় ছবিটা! “আমরা তো জার্মান ভাষা পারি না। কোনোমতে শুধু ইংরেজিটা বলি আর ওইখানে আমাদের পরিবারেরও কেউ নাই। একটা অপরিচিত জায়গায় থাকব যেখানে আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে এমন মানুষের অভাব হবে না। রিফিউজিদেরকে নিজেদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করা হইতেছে, সে তো তুমি জানোই। আর কিডন্যাপিংয়ের কথা তো বাদই দিলাম।”
এক সময়, সেই কতকাল আগে, আমার ইউরোপে এক বছর কাটানোর ইচ্ছা ছিলো। আরেক বছর আমেরিকায়, কানাডায়, জাপানে। সবগুলো মহাদেশ ঘুরে বীজ রোপণের ইচ্ছা ছিল। আমি হার্বোলোজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে চেয়েছিলাম, সারা পৃথিবী চষে ঔষধি ফুল-পাতা সংগ্রহ করতে চেয়েছিলাম। আমি চাইতাম, যতগুলো জায়গায় আমি যাব সবগুলো জায়গা মনে রাখবে সালামা কাসসাব এখানে পা রেখেছিল। এই সমস্ত অভিজ্ঞতা জড়ো করে আমি শিশুদের জন্য এমন বই লিখতে চেয়েছিলাম যার প্রতিটা পাতায় এমন জাদু আর শব্দের বন্ধন থাকবে যা শিশুপাঠকদের নিয়ে যাবে অন্য কোনো জগতে।
“তুমি কী করবা?” একবার লায়লাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। “তুমি কোথায় যেতে চাও?”
আমরা তখন সবে হাইস্কুলের গণ্ডি পার করেছি। গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছি তখন গ্রামে আমার দাদুদের বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তখন মাত্র দু মাস দূরে। গাছে গাছে পাকা এপ্রিকট ঝুলছিল। সারা সকাল আমরা সেগুলো ডজনখানেক ঝুড়িতে ভরেছি খাওয়ার জন্য আর প্রতিবেশীদের দেয়ার জন্য। এরপর খোলা জায়গায় চাদর পেতে শুয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে নিতে মেঘের লুকোচুরি দেখছিলাম দুজন মিলে। কী নিরিবিলি একটা দিন ছিল! এত ভালো একটা দিন ছিল যেখানে আমাদের বুকে ছিল আশা আর চোখভরা স্বপ্ন। যেখানে মিষ্টি শৈশবের স্মৃতিরা ফিরে ফিরে আসত।
এপ্রিকটের ঘ্রাণ শুঁকে লায়লা গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে বলেছিল, “আমি নরওয়ের ছবি আঁকতে চাই।”
“মানে পুরা দেশটাই আঁকবা?” আমি হেসেছিলাম খুব।
আমার দিকে ফিরে ও আমার নাক টেনে দেয়ার জন্য হাত তুলেছিল কিন্তু তার আগেই আমি নাক ঢেকে ফেলেছিলাম।
“এখানে মজা করার কিছু নাই।” ও চোখ পাকায় কিন্তু ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা ফুটে আছে ওর।
“অবশ্যই আছে।” বলে আমি অন্যদিকে ফিরি। আমার হিজাব পেছনে চলে গিয়ে কপালের উপর চুল বের হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এমন জায়গায় ছিলাম যেখানে হুট করে দেখে ফেলবে এমন কেউ ছিল না। হিজাব সামান্য টেনে দেয়ার চেষ্টা করতেই চুলের ঝুটি একপাশে চলে আসে।
লায়লা তখন উঠে বসে চারপাশে তাকায়। কাউকে না দেখে ও টুপ করে আমার ঝুটি ধরে চুল বাঁধার ফিতা ধরে টান দেয়।
“নীল রঙের সব শেড আমি দেখছি শুধু নরওয়েরটা দেখি নাই সরাসরি। গুগলে দেখছি শুধু, দম আটকে আসার মতো সুন্দর! এই জিনিস আমি বাস্তবে দেখতে চাই। নীলের প্রত্যেকটা শেড আমি আঁকতে চাই। তারপর সেগুলো দিয়ে প্রদর্শনী করতে চাই। ওই প্রদর্শনীর নাম দিব ‘ব্লু ফ্রম এভ্রি এ্যাঙ্গেল’ বা এরকম কিছু।
আমি পাশ ফিরে তাকাই। “আমার তো শুনেই এত ভালো লাগতেছে, লায়লা! মনে হইতেছে ঘিবলি স্টুডিওর মতো কিছু।”
লায়লা হেসে আমার চুল বাঁধতে শুরু করে। যখনই আমি স্ট্রেসড থাকি, ও আমার চুল বেঁধে দেয়। তখনও স্ট্রেসড ছিলাম। “আমার স্বপ্ন আমাকে এখান থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।”
ওর চোখের তারায় আমি ওর প্রশ্নটা দেখতে পাচ্ছিলাম—সালামা চলে গেলে আমি ভালো থাকব তো?
জন্মের পর থেকে আমরা একসাথে। বোনের মতো নৈকট্য আমাদের। ও বাবা-মার একমাত্র সন্তান আর আমি একমাত্র মেয়ে হওয়াতে আমাদের এই বন্ধন আমরাই বানিয়ে নিয়েছিলাম।
‘সালামা!’ দূর থেকে হামযার ডাক শুনতে পাই আমরা। “লায়লা! ইয়াল্লা, খাবার রেডি।”
হামযার কণ্ঠ শুনে লায়লার চোখ ঝিলমিল করে ওঠে। লাফ দিয়ে উঠে ও দৌড়ে যায়। হামযা ওকে কোমর জড়িয়ে ধরতে গেলে দুজনই প্রায় পড়ে যাচ্ছিল।
আমি উঠে দাঁড়াই। ওদেরকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমি এমন একটা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম যে দরজা পার করে ঢোকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
লায়লা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞে করে, “কী হইছে?”
আমার অভিব্যক্তি যে ভালো হয়নি বুঝতে পেরে আমি হাসি দেই। “কিছু না।”
সে সময়ের দুশ্চিন্তাগুলো কী শিশুসুলভ ছিল! আমাদের স্বপ্নগুলোও তখন কী নিষ্পাপ ছিল!
অথচ এখন আমার সামনে বসে আছে এক ভুখা অন্ত্বসত্ত্বা মেয়ে, যার মুখের তুলনায় চোখগুলো আকারে অনেক বড়। আর এদিকে আমারও পেট ফাঁকা ড্রামের মতো খনখন করছে।
“সালামা” লায়লার ডাকে আমি দিবাস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে ওর দিকে তাকাই। “আজকের দিনটা খুব বিষণ্ণ কেটেছে, না?”
“প্রতিটা দিনই এমন।”
মাথা নেড়ে ও কোলের দিকে ইশারা করে বলে, “এখানে শোও।”
আমি তাই করি।
লায়লার আঙ্গুল আমার চুলের ভেতরে ডুবে যায়, ছোট ছোট বেণী করে দেয়। আমার হিজাব প্রত্যাখ্যাত হয়ে সোফার পাশে কোথাও পড়ে থাকে। ওর কোমল পরশে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। ওর স্ফীত উদর আমার মাথাকে বালিশ হিসেবে ঠেক দেয়, পেটের ভেতরে অনাগত শিশুর পায়ের আঘাত টের পাই আমি। শুধু গায়ের কাপড় আর চামড়ার কয়েকটা স্তর ওকে এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা থেকে আলাদা করে রেখেছে।
কী হৃদয় বিদারক!