“আপনার পদবি কী?” এত জোরে প্রশ্ন করি যে কেনান লাফ দিয়ে ওঠে।
হোমসে সবাই সাধারণত পদবি ধরেই একে অন্যকে চিনতে পারে। কেউ তার বংশ পদবি বললেই আমার দাদি সেই লোকের পুরো পারিবারিক ইতিহাস বলে দিতে পারতেন। কে তার দাদা, তার ফুফু কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে, অন্য কোন কোন পরিবার তাদের আত্মীয়—সবকিছু তার ঠোঁটস্থ ছিল।
এই বিশেষ গুণ পুরো সিরিয়ার সব মানুষের আছে।
কেনান স্মিত হেসে বলে, “আলজেন্দি।”
সিরিয়ার সুপরিচিত একটা বংশ, নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা। মগজে জোর দিয়ে আমি মনে করার চেষ্টা করি আম্মা কখনো আলজেন্দি নামে কারো কথা বলেছিলেন কি না। মনে পড়ে না এমন কিছুই।
ওদিকে খাওফের চোখ সরু হয়ে আসে। গায়ের জামাটা ঝেড়ে নিয়ে একটা সিগারেট ধরায় ও। আমরা কই আছি, কী করছি তাতে ওর থোড়াই পরোয়া। ওকে এড়িয়ে চলাই এখন আমার জন্য সহজকাজ। কেনান আর লামার দিকে মনোযোগ দিয়ে আমি মনে মনে দুআ করতে থাকি, খওফ যেন আমাকে জ্বালিয়ে না মারে। আজকে অন্তত আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাই না।
“আপনার বোনের সাহস দুর্দান্ত।” আমার কথা শুনে খওফ ভ্রু তোলে। “এরকম নয় বছর বয়সি বাচ্চা আমি খুব কমই দেখছি যে এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও ভাইদের সাথে হাসতে পারে।”
“হুম, ওর তেজ আছে ভালো।” কেনান খুব আলতো হাতে লামার চুলে সিঁথি করে দেয়। “ও সবসময়ই এমন। আমার তো মনে হয়, তখন এরকম চিল্লানোর জন্য ওর নিজের উপরই রাগ লাগতেছে। এটা দেখলেই বোঝা যায়, ও কত কষ্ট পাইতেছিল।”
আমার অনুশোচনা জেগে ওঠে। “আ’ম স্যরি।”
“আরেহ আমি আপনাকে দোষ দিতেছি না। আপনার কি কষ্ট কোনো অংশে কম হইছে নাকি?।”
“ওকে আবার জিজ্ঞেস করো। তুমি ওকে কীভাবে চেনো?” খওফ আবার বাগড়া দেয় রূপালি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে।
আমি বরাবরের মতোই না দেখার ভান করি।
“জিজ্ঞেস করো ওকে, তাহলে আজকে তোমাকে আর জ্বালাব না।”
প্লিজ, যাও এখান থেকে। মনে মনে অনুনয় করি।
“ওর ওই হা হু জবাবে তুমি নিজে কি সন্তুষ্ট? একটা গাধাও বুঝবে ও কিছু একটা লুকাচ্ছে। আচ্ছা, যদি খারাপ কিছু হয়? যদি তোমার ক্ষতি হবে এরকম কিছু লুকিয়ে থাকে ও?”
প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ করে খওফের দিকে তাকাই আমি । তাতে ওর কিছুই যায় আসে না।
“সারাটা রাত এখানে তুমি একদম একা। আর ধরো, লায়লাও জানে তুমি কই আছো—তারপরেও একটা প্রেগন্যান্ট মহিলা তোমার জন্য কতটুকু করতে পারবে? থাকার মধ্যে তোমার আছে কেবল স্কালপেল।” কেনানকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে খওফ সোজা হয়। “তাছাড়া ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তোমরা দুইজনেই আধপেটা হলেও তোমাকে কাবু করতে ওর বড়জোর ৫ সেকেন্ড লাগবে। আর তুমি প্রতিরোধ করতে না পারলে ৩ সেকেন্ড।”
দুশ্চিন্তায় আমার ঘাড় ঘেমে ওঠে। কেন খওফ এমন করে? আমার মস্তিষ্কে এমনভাবে সন্দেহ আর ভয় গুঁজে দেয় যে ওর কথা ছাড়া আমার ভাবনার জগতে আর কিছুই থাকে না।
কেনান আলজেন্দি। নামটা এত বেশি পরিচিত। কোথায় শুনেছি আগে?
“ও তোমাকে চেনে।” খওফ বলেই যায়, “ও তোমাকে চিনে ফেলেছে বলেই এখন বল ওর কোর্টে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি ও তোমার নামও জানে। ও তো তোমাকে তোমার বংশ পদবি জিজ্ঞেস করে নাই।”
শিট, ওর কথায় যুক্তি আছে।
আমার মন একবার বলছে কেনান আমার কোন ক্ষতি করবে না কিন্তু আবার এই ভেবে বিরক্তও লাগছে, ও কিছু একটা লুকাচ্ছে।
“কেনান, আমি জানি না আপনি কী ভাবতেছেন, কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের আসলেই আগে কখনো পরিচয় হয়েছিলো।” গলার স্বরে সমঝোতার কোনো অবকাশ না রেখে বললাম।
কেনানের চোখের তারায় মোমের শিখা নড়তে থাকে।
“আমি আগেও বলছি আপনাকে, আমাদের কখনো দেখা হয় নাই।” জোর দিয়ে বলে ও।
ওর দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রতি সেকেন্ডে আমার দৃষ্টি শীতলতর হয়ে আসে। “আমি শিওর, দেখা তো হইছেই!”
কেনান শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথে আমার হাত-পা প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে স্কালপেলটা নিতেই পারব না, সার্জিকাল ব্যাগটা আমার থেকে যথেষ্ট দূরে। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে, আমি যদি উঠেও দাড়াই কেনানেরই সুবিধা কারণ ও আমার চেয়ে অনেক লম্বা। আমার উচিত ছিল নিজের মনের কথা শুনে সব বিপদ তুচ্ছ করে বাড়ি ফেরা।
শান্ত হও!
“সালামা, আমি মিথ্যে বলছি না, আমাদের কখনও দেখা হয়নি।” কেনান ঘুরে আমার দিকে তাকায়। খওফ এই দৃশ্য খুব উপভোগ করছে, একবার আমার দিকে তো আরেকবার কেনানের দিকে তাকাচ্ছে ঘুরেঘুরে।
“তাহলে?” নিজের জায়গায় নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় আমার।
“আমাদের দেখা হয়নি কারণ সেই সুযোগটা আমরা পাইনি। “
“সাংকেতিক ভাষায় কথা বলা বন্ধ করবেন?”
এবার কেনান সরাসরি আমার দিকে তাকায়। “গত বছর আমাদের দেখা করার কথা ছিল, একটা কফির দাওয়াতে।”
দাওয়াত!
শুক্রবার।
লায়লার নীল কাফতান।
“ওহ মাই গড,” দম ফেলতে গিয়ে এক বছর আগের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছি। “আপনিই…”
“আমিই, কিন্তু এরপর সব পালটে গেছে।”
“ওই বিয়ের প্রস্তাবটা নিয়ে আপনার আসার কথা ছিল আমাদের বাসায়!” অবশেষে পুরো কথাটা বলতে সক্ষম হই আমি।
খাওফ খাবি খেয়ে হাততালি দেয়।
কেনান যেমন আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গাল আর কান ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে, তেমনি আমিও ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছি। একে একে মনে পড়ে যাচ্ছে আম্মা আর সবকিছু শেষের শুরুর কথা।
মনে পড়ে যাচ্ছে—আমার তাবৎ দুনিয়া ভেঙে চুরমার হয়ে আমারই চারপাশে আছড়ে পড়ার একদিন আগের কথা। মোবাইল হাতে ফেসবুকের নিউজফিডে ঘুরছিলাম। ল্যাপটপে প্রিন্সেস মনোনোকের সিনেমাটা থামিয়ে রেখে দেখতে নিয়েছিলাম লায়লার ট্যাগ করা মেকআপ টিউটোরিয়ালটা—ঠিক তখনই আম্মা ঘরে ঢুকলেন।
“সালামা,” বলে ডাক দিলে চোখের উপর এসে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে আমি চোখ তুলে তাকালাম।
হাসিতে কী যেন এক দ্বিধা মেখে আম্মা আমার বইয়ের তাক থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে আসা ডেভিলস আইভির পাতাগুলোর ওপর আঙুল বোলাচ্ছিলেন।
ফার্মাসিতে যখন টিকে গেলাম তখন লায়লাই দিয়েছিল গাছটা, যার নাম রেখেছিলাম উরজুয়ান। খুবই আয়রনিক একটা নাম কারণ উরজুয়ান মানে বেগুনি, অথচ আমার ডেভিলস আইভির পাতাগুলো ছিল গাঢ় সবুজ রঙের। তবুও, নামটা আমার খুব প্রিয়। উ, র, জ, আর ওয়াও মিলেমিশে যে সুরময় শব্দটা তৈরি করে, সেটা শুনতে খাঁটি আরবি শব্দের মতো লাগে।
ঔষধি গাছপালা, ফুলদানি আর দুটো স্ক্র্যাপবুকের পাশে উরজুয়ান গাছটাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। আমি অনেক বছর ধরে ভেষজ ফুল আর লতাপাতা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এই স্ক্র্যাপবুক দুটো বানিয়েছিলাম, ওটাতে শুকনো ফুলের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগানো ছিল আর পাশে ক্যাপশন লেখা ছিলো। যখন আমার সাহায্যের দরকার হতো, লায়লা ছবি এঁকে দিত। এই স্ক্র্যাপবুকগুলো নিয়ে এত গর্ব হতো আমার যে আমার প্রফেসরকেও সেগুলো দেখিয়েছিলাম, তিনি পুরো ক্লাসের সামনে আমার প্রশংসা করেছিলেন। সেই দিনই আমি ফার্মাকোলজিতেই স্পেশালাইজড ডিগ্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আম্মা বিছানায় আমার পাশে বসলেন। “ওরা কাল আসছে।”
আমি নিশ্চিত জানতাম, আম্মা কখনো ভাবেননি এই দিনটা এত দ্রুত, বিশেষত হামজা আর লায়লার বিয়ের বছর না ঘুরতেই, এসে হাজির হবে।
“শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর তিনটায়,” কংক্রিটের ইতিহাস পাঠ করে যাওয়া স্বরে মাকে বলেছিলাম। “জানি আমি।”
আম্মা গাল কামড়ালো নিজের। সূর্যের আলো এসে গালে পড়াতে মায়ের বয়স কমে গেছে মনে হচ্ছিল। এত তরুণ লাগছিলো যে আমার যমজ বোন বলে কেউ ভুল করতে পারতো।
আমি হেসে বললাম, “তুমি এত টেনশন নিতেছ কেন? আমি তো ভাবছি দিন-তারিখ মনে রাখা আমারই কাজ ছিল।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আম্মার বুক চিরে। আমাদের মুখের গড়ন, লালচে-বাদামী চুলের রঙ ও কোমলতা একই ছিল, কিন্তু আমাদের চোখের রঙে এসে সমস্ত সাদৃশ্য মুছে গেছে। আমার চোখের রঙ বাদামি ও হ্যাজেলের মিশ্রণ—ঠিক আমাদের লেবু গাছের ছালের রঙ, আর আম্মার চোখ ছিল গভীর নীল, গোধূলির আকাশের মতো। আর ওই মুহূর্তে আম্মার আসমানী চোখজোড়া আমার প্রতি উষ্ণ মমতায় ভরে উঠছিল।
“আচ্ছা, তোমার তো কোনো চিন্তা নাই,” রাগত স্বর আম্মার, “তাই তোমার ভাগের টেনশনও আমারই করা লাগতেছে।” একটু থেমে আবার বলল, “আচ্ছা, আপাতত ওদেরকে মানা করা যায় না?”
“কেন?” ফেসবুকে ওর ছবি দেখে ভালোই লেগেছিলো আমার। তার সুদর্শন চেহারার সাথে ব্যক্তিত্বের কতটুকু মিল—তা আমি দেখতে চেয়েছিলাম।
“এতকিছুর পর—” আম্মা থেমে শ্বাস নিল, তারপর নিচু স্বরে বলে চলল, “দারায় যে ঝামেলা হইতেছে, আমাদের এখানে, হোমসেও যদি একই ঝামেলা হয়?”
যে ঝামেলার কথা আম্মা বলছিল, তা মূলত চৌদ্দজন কিশোরকে সরকারের অপহরণ করার ঘটনা। ওদের নখ উপড়ে ফেলে নির্মমভাবে অত্যাচার করেছিলো, তারপর ফিরিয়ে দেয় পরিবারের কাছে—কারণ তারা মিশর, তিউনিসিয়া এবং লিবিয়ার বিপ্লবের সাফল্যের পর দেওয়ালে লিখেছিল, “ডাক্তার, এবার তোমার পালা।”। “ডাক্তার” বলতে তারা রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদকে বুঝিয়েছিল, যিনি ছিলেন একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। নিরীহ মানুষদের রক্তে আকণ্ঠ ডুবে থাকা লোকের মুখ থেকে ‘কোনো ক্ষতি না করার’ শপথের বিদ্রূপ আমার চোখ এড়ায়নি।
আমি ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকালাম। বিশ্ববিদ্যালয়েও কেউ এ নিয়ে কথা বলেনি, কিন্তু বাতাসে ভেসে বেড়ানো চাপা উত্তেজনা পথেঘাটেও অনুভব করতে পারছিলাম। কিছু একটা বদলে গেছে। বাবা আর হামজা রাতের খাবারের টেবিলে যেভাবে কথা বলছিল, তাতেই আমি টের পাচ্ছিলাম।
“দারাআ এখান থেকে বহুদূর,” নিচু স্বরে বলি মাকে। “আর… অতকিছু আমি জানি না।”
“দূরত্ব কোনো বিষয় না,” নিজের মুঠোয় আমার হাতগুলো চেপে ধরে মা। “ওদেরকে আমি আমার বাচ্চাদেরকে নিয়ে যাইতে দিতে পারব না।”
“আম্মা, রিল্যাক্স!” বলতে বলতে আম্মার মুঠো আরো দৃঢ় হওয়াতে আমি খানিক হকচকিত হই। “আমি কোথাও চলে যাচ্ছি না।”
“অবশ্যই যাচ্ছ,” দুঃখী হাসি মেখে আম্মা বলে। “কাল যদি কেনানের সাথে কথা পাকা হয়ে যায়, আমার বাচ্চাটার বিয়ে হয়ে যাবে।”
ডেভিলস আইভির লতাগুলোর সূক্ষ্ণ সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো দায় হলো আমার। “দারাআয় হওয়া আন্দোলনগুলো কি মন্দ কিছু? এমন সরকারের অধীনে কি কেউ থাকতে চায়? নানুভাই আর উনার ভাইকে যে নিয়ে গেলো, আর কোনোদিন ওদের দেখতে পাইলা না—এসব তো তোমার কাছেই শুনলাম সবসময়।”
এবার আম্মা হকচকিত হয়, পরক্ষণেই তার চেহারায় শুধু ভেসে থাকতে দেখা যায় স্নিগ্ধতা।
“হুম, ওরা আমার বাপ-চাচাদের নিয়ে গেছিলো।” আম্মার আসমানী চোখজোড়া ভিজে যায়। “আম্মা, তোমার খালা আর আমার চোখের সামনে দিয়ে বাবাকে ওরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। মাত্র দশ বছর বয়স ছিল আমার, তবু ওই স্মৃতি কোনোদিন ভুলিনি আমি। আমার মনে আছে, আমি চাইতাম বাবা যেন মারা যায়। বিশ্বাস হয়?” আম্মা থামে কিন্তু আমার ভেতর কোনো বিস্ময় জাগে না।
আমি তো জানতামই পঞ্চাশটা বছর সিরিয়ানরা কেমন করে টিকে আছে, বুকে ভয়-সংশয় আর মগজে বিদ্রোহ পুষে। সরকার আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীনতা হরণ করেছে আর গণহত্যা চালিয়েছে হামায়। ওরা আমাদের আত্মাকে পিষে ফেলতে চেয়েছে, ভেতরের ভয়কে নির্যাতনের চেষ্টা করেছে অথচ আমরা টিকে গেছি। এই সরকার আমাদের সেই উন্মুক্ত ক্ষত—টানা রক্তক্ষরণে নিঃশেষিত হচ্ছিল আমাদের প্রাচুর্য—তাদের লোভ আর দুর্নীতির থাবায়। তবু আমরা হার মানিনি। উঁচু শিরে আমরা প্রতিরোধ করে গেছি লেবু গাছের চারা রোপণ করে আর করেছি এই দুআ—আমাদের নিতে এলে যেন ওদের বুলেট এসে সোজা কপালে বিঁধে। কারণ ওদের কারাগারের যিল্লতির আগে মৃত্যুই শ্রেয়।
আম্মা একটা লম্বা দম নিয়ে বললো, “আমার পরিবারের উপর হওয়া জুলুমের বিচার আমি অবশ্যই চাই, সালামা। কিন্তু এরজন্য তো আমি তোমাদেরকে হারাইতে পারব না। তুমি, তোমার ভাই, লায়লা আর তোমার বাবা—তোমরা চারজনই তো আমার সব।”
শূন্যে ভেসে রইলো আম্মার দৃষ্টি।
“আচ্ছা, তাহলে কুনাফা বানাইলে কেমন হয়?” আমার দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনার জন্য ক্ষীণস্বরে বললাম।
চোখের পাতা নড়লো তার, “ও হ্যাঁ, কুনাফা। বানাইতে কী কী লাগবে, আমি সব এনে রাখসি।”
“আমি হাতের কাজটা শেষ করেই বানাইতে যাব,” হেসে বললাম। “কথা হচ্ছে, কুনাফাই কেন?”
আম্মার ঠোঁটজোড়া কী যেন এক গোপনীয়তা লুকালো। “কারণ তুমি এটা অনেক ভাল বানাও আর আমি তাকদীরে বিশ্বাস করি।”
“মানেহ?”
বসা থেকে উঠে তিনি আমার কপালে চুমু খেলেন। “কিছু না, হায়াতি। আই লাভ ইউ।”
“লাভ ইয়ু টুউ!”
স্মৃতির দুনিয়া থেকে ফিরে আসতেই কেনানের উপর চোখ পড়ে আবার, কেনান নিজের চুলে আঙুল চালিয়ে নিচ্ছে আর আমার বুকের খাঁচার ভেতর হৃৎপিন্ডটা লাফিয়েই যাচ্ছে ভয়াবহভাবে।
“আমি ঠি—ঠিক বলেছি না?” কথা জড়িয়ে আসে আমার, পাতলা সোয়েটার আর ল্যাব কোটের ভেতরেও গা ঘেমে উঠছে। কেনান অন্যদিকে ফিরে আঙুল ফোটায়। “ঐ বিয়ের প্রস্তাবটা, আম্মারা মিলে ঠিক করসিলো যে!”
ভেংচি কেটে ও আমার দিকে তাকায়, “এইভাবে বললে যে খুব রোমান্টিক কিছু শোনাচ্ছে, তা কিন্তু না।”
আমার মনে হয় যেন চারপাশের বাতাস থেমে গেছে আমাকে ফরাশের উপর স্থির রেখে। লায়লা তো ঈদের চাঁদ হাতে পাবে এই খবর শুনলে, আমি ‘না-হওয়া এক বাগদত্তা’র সাথে একই ঘরে লুকিয়ে আছি।
না-হওয়া।
কী এক শব্দ! হলেও হতে পারত এমন একটা জীবনের অসীম সম্ভাবনা ধরে রেখেছে এই শব্দ। কত কত বিকল্প একটা আরেকটার উপর স্তুপ করে রাখা, যেন খেলার কার্ড অপেক্ষা করছে কখন খেলোয়াড়েরা তুলে নেবে। খেলার ভাগ্য যাচাই করবে। জীবনের একটা ছেঁড়া টূকরো চোখের সামনে ভেসে উঠলো, যেখানে এই না-হওয়াটা সত্য হতে পারত। প্রথম আলাপেই আমাদের আত্মারা একে অপরকে চিনে নেয়। তারপরের সবগুলো দিন ভরে ওঠে বাসন্তী সাজে। আমি দিন গুণতে থাকি ‘কবুল’ বলা পর্যন্ত। মফস্বলে আমরা একটা বাড়ি কিনি, গোধূলির আলোয় দোল খাই, দুনিয়া ঘুরে দেখি, পরিবার বাড়ে আর প্রতিটা দিন আরো একটু করে প্রেমে পড়ার পথ আবিষ্কার করি। আমি সুপরিচিত ফার্মাসিস্ট আর কেনান বিখ্যাত এনিমেটর। দীর্ঘ একটা জীবন একসাথে কেটে যায় আমাদের, রবের সাথে মিলিত হওয়ার দিনটার আগপর্যন্ত।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
আমাদের ভবিষ্যৎ বর্ণহীন আঁধারে ঢাকা। জীবনের সাথে লড়ে যাওয়া ওর ছোটবোনকে নিয়ে এই ভাঙাচোরা এ্যাপার্টমেন্ট। ক্ষুধার নগ্ন থাবা, অবশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, এতিম ভাইবোন, রক্তমাখা হাত, পুরনো শ্রাপনেল, আগামির ভয়, নিরব চোখের পানি আর তাজা তাজা ক্ষতগুলোই আমাদের জীবন। আমাদের ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে আমাদের হাত থেকে।
কোথায় যেন, কোন বহুদূর থেকে ভেসে আসা স্বাধীনতার সুর আমি শুনতে পাই। হতে পারে, খাওফ নিজের মনে গুনগুন করছে।
কেনান আঙুল মোড়ায়। “আমাকে আপনার মনে আছে কি নেই তা জানতাম না বলে আমি কিছু বলতে চাইনি। আমি যদি বলতাম, ‘আমাদের মায়েরা চেয়েছিলো আমরা যেন বিয়ের আগে টুকটাক সৌজন্যমূলক আলাপ করি, ওই সূত্রে আমাকে চেনেন’ তাহলে কেমন ক্রিপি লাগত না শুনতে?”
চোখ ডলতে ডলতে নিজ মনে হেসে ফেলি। ওর নিশ্চয়ই এখন খুব বিব্রত আর জড়োসড়ো লাগছে।
“ব্যাপার না। আমি বুঝতে পারছি।” দাঁত বের করে বলি।
কেনান সরু চোখে তাকায়, “আপনি হাসছেন কেন?”
“কারণ এরকম কিছুর কথা আমার কল্পনায়ও আসেনি।” বলতে বলতে আমি শব্দ করে হাসতে শুরু করি। কেনানের হাসিও ধীরে ধীরে চওড়া হয়ে আমার অট্টহাসিতে যোগ দেয়। যতবার আমাদের চোখে চোখ পড়ে, ততবার হাসির দমক বাড়ে। আরবি প্রবাদটার এমন বাস্তব প্রয়োগ আর হতেই পারেনা : হাসিও পায়, দুঃখও ধরে।
খাওফকে দেখে মনে হয় ঘটনার পরিণতিতে ও যথেষ্ট সন্তুষ্ট।
“ওয়েল, সেই একটা আইসব্রেকার হইলো,” আমি বলি।
“এরকম কিছু হবে জানলে আমি আরো আগেই সব খোলাখুলি বলতাম।“
হুট করে লামা জেগে উঠে পানি চাইলো, আর মুহূর্তেই পরিস্থিতি বদলে গেলো। কেনান একলাফে জগ নিয়ে আসে। লামার কপাল মুছে দিতে গিয়ে যখন দেখি ও এখনো ঘামাচ্ছে, স্বস্তিবোধ করি।
“ঘেমে ওর পুরো জামা ভিজে গেছে,” হেসে বলি।
“এটা কি ভালো?” পানি খাওয়ানোর সময় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে কেনান।
“খুবই ভালো। লামা, আরেকটু পানি খাও।” ও সায় দেয়। “ভালো লক্ষ্মণ, এর মানে ও সেরে উঠছে। তাকিয়ে দেখেন, ওর শ্বাস-প্রশ্বাস এখন স্বাভাবিক, ক্ষতগুলোতেও কোনো পুঁজ নেই আর, আলহামদুলিল্লাহ। ওর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এখন শুধু ওকে গরমের মধ্যে রাখতে হবে আর বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে।“
কেনানের চোখজোড়া ভিজে উঠে আবার। বোঝাই যাচ্ছে, ও ধরে নিয়েছিলো এই যাত্রায় লামাকেও হারিয়ে ফেলবে। নিজেকে সেই কঠিন বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করেই রেখেছিল।
লামা ঘুমিয়ে পড়লে আমি আরেকটা কম্বল মেলে দিই ওর গায়ে।
কেনান চুপচাপ ওর বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোট্ট হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে ফেলে। ওর কথাগুলো স্বপ্নালু ঘোরের মত মনে হয়, “আমাদের সবার ছোট ও। ওর যেদিন জন্ম হলো, আমরা যে কত খুশি ছিলাম! দুই ঝামেলাবাজ ছেলের পর এই ছোট্ট ফেরেশতার আগমন। নার্স যখন বাবাকে এসে বললো, মেয়ে হয়েছে, বাবা তো শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। কত আদরের ছিলো আমাদের। ফুলের ঘায়েও মূর্ছা যেত। কোনোদিন একটা আঁচড়ও পড়তে দিইনি ওর গায়ে। ওর ভাই হয়ে, ওর মুহাফেজ হয়ে আমরা তা কি করে হতে দিই? আর এখন… ওর শরীর বিদ্বেষের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত।” রাগে-ক্ষোভে কেনানের গলা ধরে আসে। “আমি ব্যর্থ এক ভাই। বাবা-মা চলে যাওয়ার পর থেকে ইউসুফের মুখে আর একটা শব্দও শোনা যায়নি। সামান্য শব্দেও ও কেঁপে ওঠে। লামা আর আমিই ভাঙাচোরা হাল চেপে রেখে মনের জোর ধরে রাখছিলাম। শেষমেশ ওরা আমার বোনটাকে কষ্ট দিয়েই ছাড়লো। বাবাকে আমি কথা দিছিলাম, নিজের সবটুকু দিয়ে আমি ওর ঢাল হবো…অথচ…”
কাঁপা হাতে কেনান লামার চারপাশে কম্বলটা আরো ভালো করে গুঁজে দেয়। দেখে বাবার হামযা আর লাইলাকে মনে পড়ে আমার।
মনে মনে দুয়া করতে থাকি লায়লার যেন কিছু না হয়।
অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটা বদলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, “সারাদিন কী করেন আপনি?”
“রুজি রোজগার? আমার পরিবার জার্মানি থেকে যখন যা পারে পাঠায়।”
অকারণ হাতের আঙুল নেড়ে যাচ্ছিলাম আমি। “হাসপাতাল থেকে আমি কিছু পাই না, যা করি মানুষকে সাহায্য করার জন্য করি। তবে জানিনা কতদিন এখানে…”
বলতে গিয়ে আমাকে থেমে যেতে দেখে কেনান ভ্রু কুঁচকে মাথা তুলে তাকায়। আমার চেহারায় ফুটে থাকা বিব্রত বোধ থেকে ও সহজেই অনুমান করে ফেলে। এই কাজ আমি কীভাবে করলাম! ঠিকমত ঘুম না হওয়ার কারণে হতে পারে তারপর আজ সারাদিন যা গেল।
“আপনি চলে যাবেন?” ও জিজ্ঞেস করে।
আমি ভাবি, কী বলবো। “জানি না আসলে।”
“আপনি জানেন না?” ওকে বিভ্রান্ত দেখায়।
“সুযোগ পেলে কি আপনি কখনো যাবেন না?”
ওর ছোট ছোট দুটো পুষ্টিহীনতায় ভোগা ভাইবোন থাকার পরেও ও কেন যাচ্ছে না? কিসে বাধা দিচ্ছে ওকে? আমি তো কেবল হাসপাতালের কথা ভেবে যাচ্ছি না।
“না” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাহীন কন্ঠে ওর জবাব।
“ইউসুফ আর লামার কী হবে?
লম্বা দম নিয়ে লামার দিকে একবার তাকায়। ব্যাথায় লামার চেহারা কুকড়ে আছে। ওর কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কাঁপা হাতে সরায়। “চলে যাওয়াই যদি নিরাপদ হইতো, তাহলে আমি ইউসুফ আর লামাকে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু সেরকম তো না। ইউসুফের কেবল তের বছর আর ওর নয়। ওরা পারবে না একা গিয়ে পৌঁছাতে।”
আমি তাকিয়েই থাকি। “তাহলে আপনি কেন ওদের নিয়ে যাচ্ছেন না?”
ওর চোখ থেকে বিষণ্ণতার রেশ মিলিয়ে যায়, সেখানে ভর করে তীব্র এক কাঠিন্য। “এই দেশ তো আমারই। আমি যদি প্রতিরোধ না করি, কে করবে?”
নিজের কানকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
“কেনান,” আমি খুব ধীর স্বরে বলতে শুরু করি। “আপনার ভাইবোনদের বাঁচামরা নিয়ে কথা বলতেছি আমরা।”
ঢোক গেলে কেনান। “কিন্তু আমি আমার দেশের কথা বলতেছি, স্বাধীনতার কথা বলতেছি যেটা আমার প্রাপ্য অধিকার। আব্বু-আম্মুকে কবর দিয়ে এসে লামাকে যে বুঝাইতে হইছে তারা আর কোনোদিন বাড়ি ফিরবে না, আমি সেসবের কথা বলতেছি। আমি কীভাবে–” ওর গলা ভিজে যায়, “কীভাবে এই দেশ ছেড়ে যাব আমি? সারাজীবনে এই-ই তো প্রথম আমি সিরিয়ার মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারতেছি।”
একটা মানুষ এত অনড় কী করে হয়?
“বুঝলাম না, এখানে থেকে আপনি যুদ্ধের কী উপকার করতেছেন? সিরিয়ার মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে?”
আমার শব্দচয়নে কেনান ভ্রুকুটি করলেও এ নিয়ে কিছু বলে না। বরং গভীর শ্বাস টেনে বলে, “আমি আন্দোলন রেকর্ড করি।”
আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসে, ভেতরটা কেমন করে ওঠে। “আপনি… কী?” অস্ফুটে বলি।
লামার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে ও। “এজন্যই আমি যাইতে পারব না এখান থেকে। আমি মানুষকে—সারা দুনিয়াকে—দেখাচ্ছি এখানে কী ঘটতেছে।” ল্যাপটপ দেখিয়ে বলে, “কারেন্ট আসলে আমি ভিডিওগুলো ইউটিউবে আপলোড করি।”
আতঙ্কে আমার নখ মেঝেতে দেবে যাচ্ছে। “আপনি এসব আমাকে কেন বলতেছেন? কেউ যদি সামান্যও টের পায়, মরার চেয়েও খারাপ অবস্থা হবে আপনার, জানেন সেটা? ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ যদি মিলিটারিদের প্রতিরোধ করতে না পারে, আপনাকেও ধরে নিয়ে যাবে।”
কেনান হাসে, আদতে তা ফাঁকা আওয়াজ। “সালামা, ওরা কারণ ছাড়াই মানুষ ধরে নিয়ে যাইতেছে। যেসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই তারাও ভালো করে জানে, সেগুলার জন্য আমারে নির্যাতন করবে। আর আমি একাই যে শুধু রেকর্ড করতেছি, তা কিন্তু না। কতজন কতভাবে লড়াই করে যাচ্ছে! দারাআয় গিয়াস মাতার নামে একজন সেনাবাহিনির হাতে গোলাপ তুলে দেয় গুলির বিপরীতে। আমার কী মনে হয় জানো? ওরা এটাকে মারাত্মক ভয় পায়। প্রতিবাদের প্রতিটা রূপই স্বৈরাচারকে ভীত করে। সেজন্য আমার রেকর্ড করা না করা কোনো বিষয় না। ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র এলাকাতেই তো আছি। পুরান হোমসে আমরা যারা আছি, সবার মাথার ওপর তো একই বিপদ ঝুলে আছে। আমার এখানে থাকাটাই অংশগ্রহণ করা। আমি কিছু করি বা না করি, ওদের কাছে তো আমি অপরাধীই। তাই প্রতিরোধ করেই মরা ভাল।” বলতে বলতে আমার হাতের দিকে তাকানো মাত্র আমি হাতা টেনে ঢেকে দিই। বসার দূরত্বের কারণে ওর চোখে উছলে ওঠা অনুভূতিদের ঝলক আমি পড়তে পারছি না, নীল বেদনা ছাড়া সেখানে আর কী থাকবে!
(চলবে…)