চিন্তার যোগ্যতা বা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এমন বৈশিষ্ট্য, যা পুরো জগতের উপরে মানুষকে কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে। এটি আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ নেয়ামত, গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে অসংখ্যবার এ নেয়ামতের সঠিক ও সার্থক ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন, স্রষ্টার পরিচয় ও সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে বারবার বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের দিকে আহ্বান করেছেন তিনি :
‘নিশ্চয় আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য।’[1]সূরা আলে ইমরান : ১৯০আল্লাহ তায়ালা তাঁর একত্ববাদের প্রমাণেও যুক্তি দিয়েছেন,
‘যদি আসমান ও জমিনে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ থাকত, তাহলে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যেত।’[2]সূরা আল-আম্বিয়া : ২২
জাহান্নামীদের আর্তনাদ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,
‘আর তারা বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহলে জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হতাম না।’[3]সূরা মুলক : ১০
যারা চিন্তা-বুদ্ধির প্রয়োগ করে না, তাদের ব্যাপারে বলেছেন,
‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকটে নিকৃষ্ট প্রাণী হলো বধির, বোবা, যারা বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে না।’[4]সূরা আনফাল : ২২
বুদ্ধিমান লোকদের কদর করতেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। নামাজে তিনি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকদেরকে তাঁর নিকটে দাঁড়াতে বলতেন।[5]সহীহ মুসলিম, ৪৩২ একবার আবদে কায়স গোত্রের সর্দার আশাজ্জ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তিনি বলেছিলেন,
‘তোমার এমন দুটি গুণ রয়েছে, যাকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন : বিচক্ষণতা ও ধৈর্য।’[6]সহীহ মুসলিম, ১৭
কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকৃতিও এর অনুসারীর জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে অনিবার্য করেছে। এজন্য কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিধান নির্ণয়ের প্রক্রিয়াটি সরলরৈখিক হয়নি, বরং এতে মতানৈক্য হয়েছে। এসব মতানৈক্যের পক্ষে-বিপক্ষে আবার অসংখ্য উসুল-নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, যুক্তি-পাল্টাযুক্তি দেওয়া হয়েছে, গড়ে উঠেছে ফিকহশাস্ত্র, ফিকহি মাজহাব। এসকল প্রক্রিয়ার একটা বড় অংশ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উপরে নির্ভরশীল। ফিকহশাস্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশে বুদ্ধিবৃত্তি বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।
সালাফে সালেহিনও বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষ কদর করতেন। হাসান বসরি রহ. বলেন,
‘বুদ্ধি পরিপূর্ণ হওয়া ছাড়া মানুষের দ্বীন পরিপূর্ণ হয় না।’[7]ইবনু আবিদ দুনিয়া, আল-আকলু ওয়া ফাদলুহু
উরওয়া ইবনে জুবায়ের রহ. বলেন,
‘দুনিয়ায় বান্দাকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো বুদ্ধি, আর আখিরাতের সর্বোত্তম দান হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি।’[8]ইবনু আবিদ দুনিয়া, আল-আকলু ওয়া ফাদলুহু
দুই
বুদ্ধিবৃত্তি জ্ঞানের একটি মৌলিক উৎস এবং মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, এ ব্যাপারে সম্ভবত কোনো কালেই কোনো সন্দেহ ছিল না। সব সভ্যতায়, প্রায় সব দর্শনেই বুদ্ধিবৃত্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বুদ্ধির প্রশ্নে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক সৃষ্টি হয় অষ্টাদশ শতকের দিকে, ইউরোপে। তখন ‘বুদ্ধি’র সাথে একটা নতুন শব্দ যুক্ত হয়। ‘মুক্তবুদ্ধি’ বা ‘মুক্তচিন্তা’ নামে নতুন এক ধারণা সামনে আসে। এই ধারণার মূল কথা, বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগ হলেই হবে না, বরং বুদ্ধিকে মুক্ত করতে হবে, চিন্তা-চেতনাকে সকল প্রকার বিশ্বাস এবং প্রথাগত আচার-বিচার থেকে মুক্ত হতে হবে। এ ধারণার পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল খ্রিস্টান চার্চ ও বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
ইউরোপে তখন চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছিল। সামাজিক কর্তৃত্ব তো বটেই, শাসনকার্যও ছিল তাদের হাতে জিম্মি। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপরে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছিল। অপরদিকে বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা বাইবেলের ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছিল। চার্চকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল নতুন চিন্তা-দর্শনের সামনে। এ সকল প্রশ্ন ও আপত্তিকে তারা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে মোকাবেলা না করে বরং বিজ্ঞানী ও চিন্তকদের উপরে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। ‘কোর্ট অব ইনকুইজিশন’ গঠন করে ভিন্নমত পোষণকারীদের কঠোর সাজা দেওয়া হয়। কোনো কোনো বিজ্ঞানীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছেন,
‘শেয়ালকে দেখে শিকারীরা যেমন চিৎকার করে, ধর্মতত্ত্ববিদরা সেরকম চিৎকার শুরু করেছিল।’[9]বার্ট্রান্ড রাসেল রচনাসমগ্র : ১/৫২২
তারা এসব জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকেই নিরুৎসাহিত করতে থাকে। এক খ্রিস্টান পণ্ডিত তো ফতোয়া জারি করেছিলেন, ‘জ্যামিতি শয়তানের শাস্ত্র। গণিতজ্ঞদের ধর্মবিদ্বেষের প্রবক্তা হিসেবে নির্বাসনে পাঠানো উচিত।’
চার্চের সাথে বিজ্ঞানী ও চিন্তকদের দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া ছিল উভয়মুখী। তারাও ক্রমান্বয়ে চার্চবিদ্বেষী হয়ে ওঠে, যা ধীরে ধীরে ধর্মবিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ধর্মীয় ছত্রছায়ায় জ্ঞানচর্চা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তাধারাকে অবশ্যই চার্চ এবং ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত হতে হবে। এ থেকে শুরু হয় ‘মুক্তচিন্তা’র অভিযাত্রা। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ধর্মবিদ্বেষ; আর শ্লোগান ছিল, ‘চিন্তাকে মুক্ত করতে হবে, নির্মোহ করতে হবে’।
মানুষের চিন্তা যে পুরোপুরি নির্মোহ হতে পারে না, তা পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিতও স্বীকার করেছেন। বার্ট্রান্ড রাসেল তার The value of freethought এ বিস্তারিত বলেছেন যে, মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ নির্মোহ হওয়া, পারিপার্শ্বিকতা এবং ব্যক্তিগত ঝোঁক থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। রাসেল লিখেছেন,
‘কোনো ব্যক্তি যখন সব ধরনের পারিপার্শ্বিক বাধা থেকে মুক্ত হয়, তখনই কেবল তাকে মুক্ত বলা চলে। তাহলে মুক্তচিন্তক কী থেকে মুক্ত হবে? নামটির যোগ্য হওয়ার জন্য তাকে দুটি বিষয় থেকে মুক্ত হবে; আচারানুষ্ঠানের পিছুটান এবং নিজ আবেগের অত্যাচার। এ দুটি থেকে কেউই সম্পূর্ণ মুক্ত নয়, কিন্তু মানুষের আপাতদৃষ্টিতে সে মুক্তচিন্তক বলে অভিহিত হওয়ার যোগ্য।’
মুক্তচিন্তক বলে যারা নিজেকে তুলে ধরেছেন, মুক্তবুদ্ধির বুলি আওড়েছেন, তাদের কর্মপন্থা দেখলেও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়। জ্ঞানের উৎস হিসেবে ধর্মবিশ্বাসকে বাদ দিলেও পুরোপুরি নির্মোহ হতে পারেনি কেউই, ধর্মবিশ্বাসের মতোই অন্য কোনো মানদণ্ডে ইমান এনেছেন তারা। কেউ বুদ্ধি, কেউ অভিজ্ঞতা, কেউ বিজ্ঞানের সামনে মাথা নত করেছেন। বিশ্বাসীদের কাছে ধর্মগ্রন্থগুলো যেমন, তাদের কাছে ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এসব মানদণ্ড। ফলে মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধির ধারণাটা নিছক প্রতারণা হিসেবেই রয়ে গেছে, এর বাস্তব প্রয়োগ আর ঘটেনি।
বার্টান্ড রাসেল যেটিকে মুক্তচিন্তা বলে স্বীকৃতি দিতে বলেছেন, তাকে আমরা ‘আপেক্ষিক মুক্তচিন্তা’ বলতে পারি।[10]মুজাজ্জাজ নাঈম, মুক্তচিন্তা ও ইসলাম অর্থাৎ, চিন্তার ক্ষেত্রে কেউ পুরোপুরি নির্মোহ হতে না পারলেও তার প্রচেষ্টার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাকে ‘মুক্তচিন্তক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। বলাবাহুল্য, এ অর্থেই ‘মুক্তচিন্তা’ বা ‘মুক্তবুদ্ধি’ পরিভাষাদুটি ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে রাসেলের প্রস্তাবটি হলো, ধর্মবিশ্বাসীও মুক্তচিন্তক হতে পারে, ধর্মচিন্তাকেও মুক্তবুদ্ধি বলা যেতে পারে, যদি তা গ্রহণ বা বর্জনের পেছনে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও যাচাই-বাছাই থাকে। এ প্রস্তাবনায়, সচেতন ও সত্যানুসন্ধানী সকল ধর্মবিশ্বাসী মুক্তচিন্তক হতে পারেন। তাদের সচেতন ধর্মচিন্তাকে মুক্তবুদ্ধিও বলা যেতে পারে।
তিন
জ্ঞানের সাথে বুদ্ধির সম্পর্ক নিবিড়; তবে ‘মুক্তবুদ্ধি’র সম্পর্ক দূরতম। জ্ঞানের জন্য বুদ্ধির প্রয়োজন যতটা, ‘মুক্তবুদ্ধি’র প্রয়োজন ঠিক ততটা নয়। জ্ঞানার্জন করতে গেলে ঠিক ‘মুক্তচিন্তক’-ই হয়ে উঠতে হবে, প্রচলিত সব কিছুকে সন্দেহ করতে হবে, একথা সর্বাংশে সত্য নয়, বরং গোড়া বিশ্বাসী লোকেও জ্ঞানার্জন করতে পারে; আবার অনেক মুক্তচিন্তকও সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হতে পারে। বাস্তবতা হলো, সত্য চিরদিন সত্য, যদিও তা বিশ্বাসের মাধ্যমে অর্জিত হয়; মিথ্যা চিরদিন মিথ্যা, যদিও এর পেছনে গভীর পরীক্ষা-নীরিক্ষা আর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা থাকে। এজন্য ‘বিশ্বাস’ও জ্ঞানের উৎস হতে পারে, যদি এর পেছনে ‘মজবুত কারণ’ থাকে।
‘পেছনের মজবুত কারণ’ বলতে সেইসব কারণ, যা কোনো বিশ্বাসের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এই কারণগুলোর উপস্থিতি এবং এর যৌক্তিকতাই বিশ্বাসের বৈধতা দিতে যথেষ্ট। যেমন : কোনো ব্যক্তিকে কেউ কখনো মিথ্যা বলতে শুনেনি, তাহলে তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য। এই যে তাকে কেউ কখনো মিথ্যা বলতে শুনেনি, এটিই তাকে বিশ্বাস করার পেছনে মজবুত কারণ, অনুপ্রেরণা।
এ বিশ্বাস অযৌক্তিক নয়, অমূলক নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তির মতোই এটি জ্ঞানের একটি উৎস হতে পারে। কখনো কখনো এ ধরনের বিশ্বাস তো অনিবার্য হয়ে পড়ে, অন্যথায় জ্ঞানের পথই রুদ্ধ হয়ে যায়। ধর্মীয় জ্ঞানের একটি বড় অংশ এ শ্রেণীর। এতে বিশ্বাসই একমাত্র অবলম্বন, মানুষের চিন্তাবুদ্ধি এর নাগাল পেতে ব্যর্থ। এসকল ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার বুলি আওড়ানোর অর্থ হলো, এ জ্ঞানের গুরুত্বকেই অস্বীকার করা।
স্রষ্টা কে, কী তার পরিচয়, কী তার ইচ্ছা, বিশ্বজগৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী—এসকল প্রশ্নের নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত উত্তর কেবল ধর্মগ্রন্থগুলোই দিতে পারে। এক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার অর্থ হলো, প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া। কারণ এ বিষয়ে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক পথে অগ্রসর হয়েছেন, তাদের অর্জন প্রায় শূণ্য। দার্শনিকরা কয়েক হাজার বছরেও এসব প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারেননি, বরং প্রশ্নগুলোকেই আরও জটিল করে তুলেছেন। বিখ্যাত আইরিশ দার্শনিক জর্জ বার্কেলি দার্শনিকদের এই অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,
‘… বুদ্ধির সাহায্যে সেগুলোকে শোধরাতে গিয়ে অজান্তে আমরা অদ্ভুত কূটাভাস, সমস্যা ও অসংগতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ি। চিন্তা যত এগিয়ে যায়, সেগুলোর সংখ্যা ও আয়তন তত বেড়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দিশেহারার মতো অনেক জটিল গোলকধাধার মধ্যে ঘুরে ফিরে আমরা আগের জায়গাতেই ফিরে যাই, কিংবা তার চেয়েও খারাপ সংশয়বাদের মধ্যে গিয়ে নেমে পড়ি।’[11]George Berkeley, A treatise concerning the principles of Human Knowledge
দার্শনিকদের—যারা সাধারণত মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা—সক্ষমতার জায়গাটা কেবল প্রশ্ন করার ক্ষেত্রেই, এর উত্তর তাদের জানা নেই, উত্তর দেবার সক্ষমতাও নেই। দর্শন কেবল প্রশ্ন করতে পারে, প্রশ্নকে গুরত্ববহ করে তুলতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছেন,
‘দর্শন যদি এতসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারে, যা আমরা চাই; অন্তত প্রশ্ন করার সক্ষমতা রাখে, যা পৃথিবী সম্পর্কে কৌতূহল জাগায়।’ [12]Bertrand Russell, A History of Western Philosophy, Routledge : 1946, p. 14
দার্শনিক অনুসন্ধান বা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় যেসব প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর মেলে না, ধর্মগ্রন্থগুলো যে নিশ্চিতভাবে সেসব জবাব দিয়ে দেয়, একথা রাসেলও স্বীকার করেন,
‘বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে এ সকল প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। ধর্মতত্ত্বগুলো মুক্তকণ্ঠে প্রশ্নগুলোর অতি নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত উত্তর দিতে পারে। কিন্তু তাদের এই পরম নিশ্চয়তার জন্যই আধুনিক মানস সেগুলোকে সন্দেহ করে।’[13]Bertrand Russell, A History of Western Philosophy, Routledge : 1946, p. 14
মজার বিষয় হলো, রাসেল স্বীকার করছেন, দার্শনিক অনুসন্ধান কিংবা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে এ সকল প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব পাওয়া যায় না, অথচ ধর্মগ্রন্থগুলো নির্দিষ্ট জবাবকেও তিনি মানতে পারছেন না। তাহলে কী উত্তর অজানাই থাকা উচিত?
আল্লাহ তায়ালা তা চান না। মানুষ যদি তার সূচনা না জানে, গন্তব্য না জানে, তাহলে সে মহাবিশ্বের গোলকধাঁধাঁয় পড়ে যাবে। সে যদি নিজেকে না চিনে, সৃষ্টির উদ্দেশ্য না জানে, তাহলে সে সংশয়ে পড়ে যাবে। সব কিছুই অচেনা হয়ে উঠবে। কী তার খাদ্য, কী তার বস্ত্র, কী তার বাসস্থান, কী তার জীবনের নিয়ম-রীতি, আইন-কানুন—সব কিছু সাবজেক্টিভ হয়ে উঠবে। কুকুর-বিড়াল কিংবা হিংস্র বাঘ-সিংহের মতোই কি মানুষ? মানুষ কি তা-ই খেতে পারে, যা তারা খায়? এসকল প্রশ্নের নির্দিষ্ট জবাব হারিয়ে যেত, যদি ধর্মগ্রন্থগুলো মানুষকে তার সঠিক পরিচয় দিয়ে বাকি জগৎ থেকে তাকে পৃথক করে না দিত।
চার
ইসলাম মুসলিমের চিন্তাধারাকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে : নিরেট বিশ্বাসের স্থান, বিশ্বাস ও বুদ্ধির সমন্বয় এবং উন্মুক্ত চিন্তার ময়দান।[14]মুজাজ্জাজ নাঈম, মুক্তচিন্তা ও ইসলাম, পৃ. ১৭৮
নিরেট বিশ্বাসের স্থান হলো সে সকল বিষয়, যা মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও চিন্তাভাবনার দ্বারা কখনো জানা সম্ভব নয়। এটি কেবল ওহির মাধ্যমেই জানা সম্ভব। এজন্য ওহি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে নবিগণও এ ব্যপারে সম্যক অবগত ছিলেন না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও সিফাত, রিসালাত, আখিরাত এবং জান্নাত-জাহান্নামের মতো আকিদার মৌলিক বিষয়াবলি, মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অর্পিত বিধি-বিধান ও আদেশ-উপদেশ। এ সকল বিষয় সম্পর্কে নবিগণও ওহির মাধ্যমেই জেনেছেন, ব্যক্তিগত ইজতিহাদ ও চিন্তা-ভাবনা এর নাগাল পেতে সক্ষম নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘এবং আপনাকে পেয়েছিলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত; অতঃপর আপনাকে তিনি পথ দেখিয়েছেন।’[15]সূরা আদ-দুহা, ৭
আয়াতে ضال শব্দের অর্থ পথভ্রষ্টও হয়, এবং অনভিজ্ঞ, বেখবরও হয়। এখানে দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য। নবুয়ত লাভের পূর্বে তিনি আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে বেখবর ছিলেন। অতঃপর নবুয়তের পদ দান করে তাঁকে পথনির্দেশ দেওয়া হয়।[16]মুফতি শফি রহ., তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন
এ সব বিষয় বুদ্ধি-নির্ভর নয়, বরং ওহি-নির্ভর। এ জন্য ওহির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তাঁর সত্তা ও গুনাবলি, শরিয়ত, আখিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে। মানুষ এগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য, এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া মূল্যহীন।
মুসলিম চিন্তার দ্বিতীয় অংশ হলো, বিশ্বাস ও বুদ্ধির সমন্বয়। এর মৌলিক অংশটুকু, অর্থাৎ মূলনীতি ওহি-নির্ভর, তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি চিন্তা-বুদ্ধির উপরে নির্ভরশীল। পরিভাষায় একে ‘ইজতিহাদ’ বলা হয়। নবিগণও ইজতিহাদ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে শরিয়ার উদ্দেশ্য ও উসুল বুঝিয়ে দিয়েছেন, এরই ভিত্তিতে তাঁরা প্রয়োজনে ইজতিহাদ করেছেন। তবে তাঁদের ইজতিহাদে কোনো ত্রুটি হলে আল্লাহ তায়ালা সাথে সাথে শুধরে দিয়েছেন। এজন্য তাঁদের ইজতিহাদও ওহির অন্তর্ভুক্ত।[17]শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ., হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ : ১/২২৫
নবিগণের পরেও ইজতিহাদের প্রয়োজন পড়ে। নিত্য-নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সামনে শরিয়ার বিধানকে ব্যখ্যা করতে গিয়ে বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে ফকিহগণ কুরআন-সুন্নাহর গভীর অধ্যয়ন থেকে শরিয়ার মূলনীতি ও উদ্দেশ্য খুঁজে বের করেছেন এবং সেগুলোকে প্রয়োগ করেছেন নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ফিকহ, উসুলুল ফিকহ এবং মাকাসিদুশ শরিয়ার মতো শাস্ত্রগুলো। এ সকল শাস্ত্রে ব্যপকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়েছে। এ জন্য পরবর্তীতে মানতেক বা যুক্তিবিদ্যা ইসলামি পাঠ্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। আলেমগণ ফকিহ বা মুজতাহিদের যোগ্যতাকে তুলে ধরতে গিয়ে ‘মানতেক’কেও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে চিন্তার তৃতীয় ক্ষেত্র হলো সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। মানুষের নিছক দুনিয়াবি বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্রে ইসলাম তাকে অপার স্বাধীনতা দেয়, যতক্ষণ না আল্লাহ ও বান্দার অধিকারের গণ্ডিকে অতিক্রম করে। এই ক্ষেত্রটিই মানুষের চিন্তা-বুদ্ধির উৎকর্ষ ফলানোর স্থান, এখানে ইসলাম কোনো প্রকার সেন্সরশিপ আরোপ করে না।
একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনাবাসীদের খেজুর চাষের ক্ষেত্রে পরাগায়ণ পদ্ধতিটি অপছন্দ করলেন, তারা তা বন্ধ করে দিল। পরের বছর দেখা গেল ফলন কমে গেছে। এর প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
‘পার্থিব বিষয়ে তোমরাই বেশি জানো। আর যদি দ্বীনি কোনো বিষয় হয়, তাহলে আমিই (অধিক অবগত)।’[18]সহিহ মুসলিম, ২৩৬৩; ইবনে মাজাহ, ২৪৭১
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে,
‘যদি আমি তোমাদের দ্বীনি কোনো বিষয়ে কোন নির্দেশ প্রদান করি, তাহলে তা গ্রহণ করো। আর যদি আমার ব্যক্তিগত অভিমত থেকে কোন নির্দেশ প্রদান করি, তবে আমি তো একজন মানুষ।’[19]সহিহ মুসলিম, ১৪০
এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের নিছক দুনিয়াবি কর্মকাণ্ডগুলোকে শরিয়ার গণ্ডি থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন। সহিহ মুসলিমে যে শিরোনামের আওতায় হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে তা হলো,
‘শরিয়া হিসেবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা আদেশ করেছেন, তা পালন করা ওয়াজিব এবং পার্থিব বিষয়ে তিনি যে মতামত প্রদান করেছেন, তা ওয়াজিব না হওয়া প্রসঙ্গে।’
আল্লামা ইবনে খালদুন রহ. লিখেছেন,
‘চিকিৎসা অধ্যায়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদিসসমূহ ওহির অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং এগুলো আরবের প্রথাগত চিকিৎসা মাত্র। এগুলোর অবস্থান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যাস ও স্বভাবগত কর্মের ন্যায়, শরিয়া হিসেবে নয়।’ [20]ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমাহ : ১/৬৫১
মুফতি তাকি উসমানী হাফি. হাদিসে বর্ণিত কোনো কোনো চিকিৎসাকে ওহি বললেও, এর সর্বজনীন প্রযোজ্যতা নিয়ে তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন,
‘এখানে একথা বলার অবকাশ আছে, চিকিৎসা-বিষয়ক হাদিসগুলো তিনি রাসুল হিসেবে বা শরিয়ার অংশ হিসেবে বলেননি যে, সব যুগে সব অঞ্চলের সব মানুষের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে।’[21]মুফতি তাকি উসমানী, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৪/২৯৩-২৯৪
পার্থিব বিষয়ে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করবে, নিত্য-নতুন আবিষ্কারে মানবসমাজ ও সভ্যতার উৎকর্ষ আনবে, এ জন্যই মূলত চিন্তার এ অংশকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেওয়া হয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনে তাই ইসলামের পক্ষ থেকে কোনো বাঁধা নেই। চাঁদে পাহাড় আবিষ্কৃত হলে ইসলামের যেমন কোনো আপত্তি নেই, তেমনি পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে প্রমাণিত হলে ইসলাম অসন্তোষ প্রকাশ করে না। অথচ এ সকল বিষয় নিয়েই খ্রিস্টান চার্চের সাথে বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের বিরাট বিরাট সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়েছিল।
বস্তুত মুক্তবুদ্ধির ধারণাটা যারা ইসলামি সভ্যতায় বয়ে এনে এর সাথে ইসলামের দ্বান্দ্বিক অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করেছে, তারা ইসলাম ও খ্রিস্টবাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তুলনামূলক অধ্যায়ন করেনি। বাস্তবতা হলো, ইসলামের ইতিহাসে পার্থিব ও ধর্মীয় জ্ঞানের বিকাশ একই সাথে ঘটেছে। যখন ইসলামি জ্ঞানের উৎকর্ষ হয়েছে, তখন পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানও চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে, আর পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারা যখন নিম্নমুখী হয়েছে, তখন ধর্মীয় জ্ঞানও কমতে শুরু করছে। এটিই প্রমাণ করে যে, ইসলামি সভ্যতায় পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধর্মচর্চার অনুপ্রেরণা ঠিক একই। ইসলামের সাথে চিন্তা-বুদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো কালেই কোনো বিরোধ ছিল না, বরং এটি ইসলামি সভ্যতার মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য একটি উপাদান।
মুক্তবুদ্ধির প্রশ্নে এ বিষয়টিও মনে রাখা দরকার যে, মানুষের চিন্তা-বুদ্ধি ও ধ্যান-ধারণা মুক্ত হওয়ার প্রয়োজন যতটা, শুদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন তারচেয়ে অনেক বেশি। মানবজাতির সচেতন অভিভাবক হিসেবে ইসলাম মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাধারাকে শুদ্ধ করার যাবতীয় প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। এতে যদি চিন্তার স্বাধীনতা খর্বও হয়, সে পরোয়া করে না।
তথ্যসূত্র:
↑1 | সূরা আলে ইমরান : ১৯০ |
---|---|
↑2 | সূরা আল-আম্বিয়া : ২২ |
↑3 | সূরা মুলক : ১০ |
↑4 | সূরা আনফাল : ২২ |
↑5 | সহীহ মুসলিম, ৪৩২ |
↑6 | সহীহ মুসলিম, ১৭ |
↑7, ↑8 | ইবনু আবিদ দুনিয়া, আল-আকলু ওয়া ফাদলুহু |
↑9 | বার্ট্রান্ড রাসেল রচনাসমগ্র : ১/৫২২ |
↑10 | মুজাজ্জাজ নাঈম, মুক্তচিন্তা ও ইসলাম |
↑11 | George Berkeley, A treatise concerning the principles of Human Knowledge |
↑12, ↑13 | Bertrand Russell, A History of Western Philosophy, Routledge : 1946, p. 14 |
↑14 | মুজাজ্জাজ নাঈম, মুক্তচিন্তা ও ইসলাম, পৃ. ১৭৮ |
↑15 | সূরা আদ-দুহা, ৭ |
↑16 | মুফতি শফি রহ., তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন |
↑17 | শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ., হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ : ১/২২৫ |
↑18 | সহিহ মুসলিম, ২৩৬৩; ইবনে মাজাহ, ২৪৭১ |
↑19 | সহিহ মুসলিম, ১৪০ |
↑20 | ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমাহ : ১/৬৫১ |
↑21 | মুফতি তাকি উসমানী, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৪/২৯৩-২৯৪ |
আলহামদুলিল্লাহ
পড়ার পরেই… বলতে বাধ্য হলাম
মাশাআল্লাহ
লেখক ভাইকে শুকরিয়া
মাশাআল্লাহ