ইসলামী জ্ঞানচর্চার সাথে অন্য দশটি জ্ঞানচর্চার মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্যসব জ্ঞানচর্চা নিছকই শাস্ত্রীয় বিষয়াদি হলেও ইসলামী জ্ঞানচর্চার সাথে স্পিরিচুয়ালিটির প্রত্যক্ষ ও শক্ত সংযোগ আছে। ইনফরমেশনের পাশাপাশি এখানে আধ্যাত্মিকতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ইসলামী জ্ঞানশাস্ত্রের নিছক তথ্যভান্ডার জানলেই তাকে আলিম বা জ্ঞানী বলা হয় না; বরং এর জন্য প্রয়োজন নূর ও আধ্যাত্মিক তাওয়াজ্জুহ। ফলে, ইসলামী জ্ঞানচর্চায় এমন কিছু আবশ্যকীয় বিষয়াদি থাকে, যা অন্যক্ষেত্রে শতভাগ আবশ্যকীয় না। আদব, এটিকেট বা শিষ্টাচার—ইসলামী জ্ঞানচর্চায় তেমনই একটি অপরিহার্য প্রসঙ্গ। আদবকেতা কাকে বলে, ইসলামী জ্ঞানচর্চায় আদব কেন প্রয়োজন এবং কোথায়-কোথায় প্রয়োজন—এই প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে বরেণ্য দুজন ইমামের আদবের গল্প দিয়ে শুরু করি।
সালাফে সালিহিনের মধ্যে প্রশ্নাতীত যোগ্যতা ও খেদমত আঞ্জাম দেওয়া দুজন ইমাম হলেন ইমাম আযম আবু হানিফা নু’মান ইবনে সাবিত রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদ্রিস শাফেয়ী রহ.। একজনের ইন্তেকাল ১৫০ হিজরিতে, অপরজনের জন্ম একই বছর, ইন্তেকাল ২০৪ হিজরিতে। দুজনেই ইতিহাসখ্যাত গ্রহণযোগ্য দুটি মাযহাব বা স্কুল অফ থটের প্রতিষ্ঠাতা।
ইমাম আযমের গল্পটা প্রথমে বলি।
ইমাম আবু হানিফা রহ. যে-ক’জন উস্তাদের সোহবত (সান্নিধ্য) ও মুলাযামাতের (সার্বক্ষণিক সঙ্গ) মাধ্যমে ইমাম আযম হতে পেরেছেন, হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমান রহ.-এর নাম তাদের প্রথম সারিতে থাকবে। বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাত ধরে ফিকহের যে সিলসিলা তৈরি হয়েছে, আলকামা, ইবরাহিম নাখঈ হয়ে তা পৌঁছেছে হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমানের কাছে। হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমানের কাছ থেকে ফিকহের সিলসিলা গ্রহণ করেছেন আবু হানিফা রহ.। আঠারো বছর হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমানের মুলাযামাত গ্রহণ করেছেন।
হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমান রহ.-এর প্রতি ইমাম আবু হানিফার এতটাই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আদব ছিল, সারা জীবনে কখনো হাম্মাদের বাড়ির দিকে পা মেলে বসেননি। আবু হানিফার মুখ থেকেই শোনা যাক।
ইমাম আযম বলেন, “আমি কখনো আমার উস্তাদ হাম্মাদের বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি; তার প্রতি সম্মানবশত। অথচ আমার ও তার বাড়ির মাঝে সাতটি রাস্তার দূরত্ব ছিল।” [1]আত-তাবাকাতুস সানিয়্যা ফি তারাজিমিল হানাফিয়্যা ১/১১৪, তাকিউদ্দিন আল-গাযযি, … Continue reading
উস্তাদকে দেখেই ছাত্র শেখে। ইমাম আবু হানিফাকে দেখে শিখেছিলেন ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ রহ.। ইমাম আবু হানিফা প্রতি নামাজের পর দোয়া করতেন হাম্মাদের জন্য। তা দেখে আবু হানিফার জন্য দোয়া করতেন ছাত্র আবু ইউসুফ।
এবার বলি ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর গল্প। ইমাম শাফেয়ী ছিলেন ইমাম মালিক ইবনে আনাসের ছাত্র। উস্তাদকে এতটাই সম্মান করতেন, কিতাবের পাতা উল্টাতেন নিঃশব্দে; উস্তাদের প্রতি আদবে যেন কোনোক্রমেই ঘাটতি না হয়। শাফেয়ীর মুখেই শুনি।
ইমাম শাফেয়ী বলেন, “আমার অভ্যাস ছিল, আমি যখন মদিনায় আসতাম, তখন ইলমের প্রতি ইমাম মালিকের ভক্তি, সম্মান ও আদব দেখতাম। তা দেখে আমার মধ্যে আদবকেতা বৃদ্ধি পেত। এমনকি, মাঝেমধ্যে যখন ইমাম মালিকের দরসে বসতাম, তখন কিতাবের পাতা উল্টাতে চাইলে উস্তাদের প্রতি সম্মানবশত একদম হালকাভাবে উল্টাতাম। যেন তিনি পৃষ্ঠা উল্টানোর শব্দ শুনতে না পান।” [2]তারিখু দিমাশক ১৪/২৯৩, ইবনে আসাকির
এখানেও একই কথা। ছাত্র শেখে উস্তাদের কাছ থেকে। ইমাম শাফেয়ী শিখেছেন ইমাম মালিকের কাছে। শাফেয়ীর ছাত্র শিখেছেন তার কাছ থেকে।
বলছি, রবি ইবনে সুলাইমানের কথা। উস্তাদ শাফেয়ী যখন তাকিয়ে থাকতেন, সমীহের কারণে তিনি পানি পান করতে পারতেন না। রবি ইবনে সুলাইমান নিজেই বলছেন, “আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, ইমাম শাফেয়ী তাকিয়ে থাকলে সমীহের কারণে আমি পানি পান করার সাহসও করতাম না।” [3]আল-মাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা পৃ. ৩৯০, ইমাম বাইহাকি, দারুল খুলাফা লিল-কিতাবিল … Continue reading
আদব কাকে বলে?
আদব শেখার ব্যাপারে ইমাম মালিকের বক্তব্য তো ইতিহাসখ্যাত। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্যও আছে এই প্রসঙ্গে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক আদবকেতা বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছি আমরা।
আল্লামা ইবনে মানযুর (৭১১ হি.) লিখেছেন, আদব হলো ভদ্র ও সুন্দর আচরণের নাম। [4]লিসানুল আরব ১/২০৬
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. (ওফাত : ৮৫২ হি.) বলেন, আদব হলো ব্যবহারের মধ্যে প্রশংসনীয় আচরণ ও উচ্চারণ নিয়ে আসা। [5]ফাতহুল বারি ১০/৪০০, দারুল মা’রিফাহ
আল্লামা মুরতাযা যাবিদি (১২০৫ হি.) লেখেন, আদবের শাব্দিক অর্থ হলো, উত্তম চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার। তবে, আদবের মূল অর্থ হলো—দোয়া। এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, আদবের মাধ্যমে মানুষ অন্যের দোয়া অর্জন করে নিতে পারে। আদব হলো এমন এক যোগ্যতা, যা ব্যক্তিকে দোষত্রুটি থেকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রশংসনীয় আচরণ-উচ্চারণ, সবসময় সুন্দরের সাথে থাকা, বড়কে সম্মান ও ছোটকে স্নেহ করা—সবকিছুই আদবের অন্তর্ভুক্ত। মোটকথা, উত্তম আখলাক ও সুন্দর আচরণ-উচ্চারণের সকল চর্চাই আদব। [6]তাজুল আরুস ২/১২, মুরতাযা যাবিদি
ইবনুল কায়্যিম জাওযি রহ. আবু ইসমাইল হারাবির (৪৮১ হি.) সূত্রে আরও সুন্দর পরিচয় দিয়েছেন। আদব হলো সীমালঙ্ঘনের ক্ষতি জেনে বাড়াবাড়ি ও রূঢ়তার মাঝে সীমা রক্ষা করা। [7]মাদারিজুস সালিকিন ২/৩৭০, দারুল কিতাবিল আরাবি
প্রথম তিনজন পূর্বসূরির বক্তব্যের সারাংশ যা দাঁড়াচ্ছে, তা-ই আদব; আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়। ইবনুল কায়্যিমের বক্তব্যে যা আরও স্বচ্ছ, আরও পরিষ্কার।
আদব, অ্যাটিকেট কিংবা ভদ্রতা—যেকোনো ক্ষেত্রে অগ্রগামিতার ক্ষেত্রে অতি জরুরি এক প্রসঙ্গ। দ্বীন কিংবা দুনিয়া—যেকোনো ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে গেলে লোকে দেখবে, আপনার আদবকেতা কদ্দূর আছে। এই আদবকেতার প্রয়োজনটা ইলমের ক্ষেত্রে একটু বেশিই প্রয়োজন।
সালাফের বক্তব্যে আদবের প্রয়োজনীয়তা
আদবের প্রয়োজনীয়তা সকল যুগে সমান ছিল। কোনো যুগে এর প্রয়োজনীয়তা কমেছে—তা তো নয়ই; ক্ষেত্রবিশেষে এই প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। মানুষের কর্মের সার্বজনীনতা নিছক ইলম দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং এর সাথে আদবের প্রয়োজন হয়। আদববিহীন ইলম পরিণত হয় তাকাব্বুর ও রিয়ার বস্তুতে। ইলমকে যদি বলা হয় হাতিয়ার, এর চালনাকারী তবে আখলাক ও আদব।
মানুষের সৌন্দর্যের দুটি দিক; খালকি ও আখলাকি—বাহ্যিক সৌন্দর্য ও চারিত্রিক সৌন্দর্য। প্রথমটি আল্লাহপ্রদত্ত হলেও দ্বিতীয়টি অর্জনের বিষয়। বলাবাহুল্য, বাহ্যিক সৌন্দর্য আপেক্ষিক হলেও চারিত্রিক সৌন্দর্য সর্বজনীন এবং সর্বকালীন। আদব ও চারিত্রিক সৌন্দর্য মানুষকে সম্মানিত ও বড় করে তোলে।
ইবনুল কায়্যিম জাওযি রহ. (৭৫১ হি.) বলেন, “আদব একজন মানুষের সৌভাগ্য ও সফলতার চাবিকাঠি। আদব-স্বল্পতা দুর্ভাগ্য ও সর্বনাশের কারণ। আদবের মাধ্যমে দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ যেমন অর্জিত হয়, তদ্রূপ আদব-স্বল্পতার কারণে দুনিয়া-আখেরাতে বঞ্চনারও শিকার হতে হয়।” [8]মাদারিজুস সালিকিন ২/৩৬৮, দারুল কিতাবিল আরাবি
এবার আদব সম্পর্কে সাহাবা ও সালাফদের কিছু বক্তব্য জেনে নিই।
শুরু করি ইমাম ইবনে শিহাব যুহরি রহ. (১২৪ হি.)-এর বক্তব্য দিয়ে। আদবের গুরুত্ব ও অবস্থান বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, “নিশ্চয় এই ইলম হলো আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত আদব; যা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিক্ষা দিয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাহকে শিখিয়েছেন। আদব হলো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবীজির কাছে নাযিল করা আমানত। যেন তিনি যথাযথভাবে উম্মাহকে তা পৌঁছে দেন। সুতরাং কেউ কোনো ইলম যখন জানবে, সে যেন তা আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত হুজ্জত (অকাট্য প্রমাণ) হিসেবে সামনে রাখে।” [9]মা’রিফাতু উলুমিল হাদিস, পৃ. ৬৩, হাকিম নাইসাবুরি, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ
ইমাম যুহরি প্রথম যুগের আলিম। প্রথম শতকের শেষ ও দ্বিতীয় শতকের শুরুতে তার ইলমি গ্রহণযোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল প্রশ্নাতীত ও সর্বজনমান্য। অগণিত হাদিস নির্ভর করে আছে তাঁর বর্ণনার ওপর। ইমাম যুহরি তাঁর দীর্ঘ ইলমচর্চা ও অভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধি করেছেন—আদব নিছক আচার-আচরণের সমষ্টি নয়; খোদ এই ইলমই হলো আদব। সুতরাং আদববিহীন যে-তথ্য ও ইনফরমেশন জানা, শোনা, পড়া ও চর্চা করা হয়, তার নাম ইলম নয়; কিছু তথ্য মাত্র। ইলম শিখতে হলে তার জন্য আদব শেখা অতীব জরুরি বিষয়।
ইমাম যুহরি যখন ইন্তেকাল করেন, তার চার বছর আগে খোরাসানে জন্মগ্রহণ করেন একটি শিশু; পিতামাতা নাম রাখেন—আব্দুল্লাহ। পিতার নাম মুবারক হওয়ায় পরবর্তীকালে যিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক নামে। যুহরির পরবর্তীকালে যারা ইলমচর্চায় আলো ছড়িয়েছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. (১৮১ হি.) তাঁদের অন্যতম। হানাফি এই আলিম ইলমে হাদিসের ময়দানে যেমন আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি জিহাদের ময়দানে বীরত্বের সাথে তরবারি চালনা করেছেন। ব্যবসার ময়দানেও ছিলেন সমকালীন শিল্পপতিদের একজন।
ইবনে মুবারক রহ. বলেন, “কেউ যদি আদব অর্জনকে তুচ্ছজ্ঞান করে, সে শাস্তিস্বরূপ সুন্নাহ থেকে বঞ্চিত হয়। আর যে সুন্নাহকে অবহেলা করে, শাস্তিস্বরূপ সে ফরজ আমলের তাওফিক থেকে বঞ্চিত হয়। আর, যে ফরজ পালনে অবহেলা করে সে আল্লাহর পরিচয় লাভের তাওফিক থেকে বঞ্চিত হয়।” [10]শুআবুল ঈমান ৪/৫৫৯, বর্ণনা নং-৩০১৭, ইমাম বাইহাকি, মাকতাবাতুর রুশদ
তরুণদের মধ্যে ইলমের প্রতি তাড়া ও তাড়না যেমন থাকে, আদবের প্রতি অনীহাও থাকে। কিন্তু, ইলমের জন্য আগে আদব শিখতে হয়। নমনীয় হতে হয় ইলমদাতা আল্লাহ তাআলার দরবারে। ভক্তি-শ্রদ্ধা রাখতে হয় ইলম লাভের মাধ্যম উস্তাদের প্রতি। এজন্য ‘মুফতিল মাদিনাহ’ ইমাম মালিক ইবনে আনাস (১৯১ হি.) এক কুরাইশ তরুণকে নাসিহা করে বলেছিলেন, “ভাতিজা, ইলম শেখার আগে আদব শেখো।” [11]হিলইয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৩০, আবু নুআইম আসবাহানি, দারুস সাআদাহ
সাহাবা এবং সালাফে সালিহিনদের আমলও ছিল ইলমের আগে আদব শেখা। এক্ষেত্রে বারবার তারা গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ইলম যেমন শিখেছেন, তেমনি নিয়ম করে আদব শিখেছেন। বিশিষ্ট তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন রহ. সেই বিবরণও দিয়েছেন। তিনি বলেন, “পূর্বসূরিরা যেমন ইলম শিখতেন, তেমনি আদবও শিখতেন।” [12]আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামি, ১/৭৯, খতিব বাগদাদি, মাকতাবাতুল … Continue reading
তৃতীয়-চতুর্থ শতকের মুফাসসির ইমাম আবু যাকারিয়া আল-আম্বারি রহ. (৩৪৪ হি.) বলেন, “আদববিহীন ইলম হলো জ্বালানিবিহীন আগুনের মতো। এবং ইলম ছাড়া আদব হলো দেহবিহীন আত্মার মতো।” [13]আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামি, ১/৮০, খতিব বাগদাদি, মাকতাবাতুল … Continue reading
ইলমকে কেন আগুনের সাথে তুলনা দিলেন? কী এর অর্থ? এর কারণ এবং ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন আবু যাকারিয়া আম্বারি। বলেন, ইলমকে আগুনের সাথে তুলনা দেওয়ার কারণ হলো—সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাকে এই তুলনা দিতে দেখেছি। ইবনে উয়াইনা বলেন, ইলমের প্রতিতুলনা একমাত্র পেয়েছি আমি আগুনকে। এক মশাল থেকে আরেক মশালে আগুন আমরা নিতে পারি সত্য; কিন্তু তা কমাতে পারি না। [14]প্রাগুক্ত
আবু যাকারিয়ার কথাটি বেশ গভীর ও অর্থবহ। ইবনে উয়াইনার ব্যাখ্যার পাশাপাশি যদি বক্তব্যটি নিয়ে আরও ভাবি, দেখা যায়—জ্বালানিবিহীন আগুনের কোনো মূল্য নেই। এই আগুন যথাক্ষেত্রে জ্বলবেও না, মানুষকে উপকৃতও করতে পারবে না। আগুনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ জ্বালানি। অপরদিকে যথাযথ জ্বালানিবিহীন আগুনের প্রকৃতি হলো—কোথাও সামান্য ইন্ধন পেলে ফোঁস করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু সেই আগুন উপকারের চেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে বেশি।
সন্তানের ইলম শেখার ব্যবস্থা করা যেমন পিতামাতার দায়িত্ব, তাদের আদব শেখার ব্যবস্থা করাও তাদের দায়িত্ব। সন্তানকে ইলম না শেখানোর জবাবদিহিতা যেমন তাদের করতে হবে, আদব না শেখানোর জবাবদিহিতাও সমানভাবে করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু স্পষ্ট করেই একথা বলে গেছেন। এজন্য নবীজির সাথে সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা সর্বোচ্চ আদব প্রদর্শন করার পাশাপাশি সন্তানকে আদব শেখানোর কথাও গুরুত্ব দিয়ে বলে গেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এক লোককে দেখে বলেন, “তোমার ছেলেকে আদব শেখাও। কারণ, তোমাকে আখেরাতে জিজ্ঞাসা করা হবে—ছেলেকে কী আদব শিখিয়েছ আর কী ইলম শিখিয়েছে? আর ছেলেকে জিজ্ঞাসা করা হবে তোমার প্রতি সদাচার ও আনুগত্যের কথা।” [15]আস-সুনানুল কুবরা, আসার নং-৫০৯৮, ইমাম বাইহাকি
এজন্য ইমাম মালিকের মা তাঁকে আগে আদব শিখতে পাঠিয়েছিলেন। খাইরুল কুরুনের সেই সোনালি সময়ে একজন জননী জানতেন, তার সন্তানের জন্য ইলমের আগে আদব শেখা প্রয়োজন। তিনি নিজে সেই বিবরণ দিচ্ছেন।
ইমাম মালিক বলেন, “আমি তখন ছোট। আম্মা আমাকে সুন্দর করে কাপড় পরিয়ে মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিতেন। তারপর রবিয়ার দরসে পাঠিয়ে দিতেন। যাওয়ার সময় বলে দিতেন, বাবা, রবিয়ার দরসে গিয়ে বসো। তবে, হাদিস ও ফিকহ শেখার আগে রবিয়ার আদব ও ভদ্রতা শেখো।” [16]আত-তামহিদ লিমা ফিল মুওয়াত্তা মিনাল মাআনি ওয়াল আসানিদ ৩/৪, ইবনে আব্দুল বার, … Continue reading
একই ধরনের কথা দ্বিতীয় শতকের মুহাদ্দিস আবু ইসহাক ইবরাহিম ইবনে হাবিব আল-আযদিকে (২০৩ হি.) বলেছিলেন তার পিতা হাবিব ইবনুশ শাহিদ। ইবরাহিম বলেন, “আব্বা একদিন আমাকে বললেন, বাবা, তুমি আলিম ও ফকিহদের মজলিসে যাও। তাদের কাছ থেকে ইলম শেখো। এবং তাদের আদব, আখলাক ও জীবনচরিত গ্রহণ করো। কারণ, অনেক-অনেক হাদিস জানার চেয়ে আদব-আখলাক সহ কিছু ইলম জানা আমার কাছে অধিক প্রিয়।” [17]আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামি, ১/৮০, খতিব বাগদাদি, মাকতাবাতুল … Continue reading
হাবিব ইবনুশ শাহিদের কথাটি অনেক গভীর। আদববিহীন অঢেল ইলমের চেয়ে আদব-আখলাকসহ অল্প ইলম বেশি পছন্দনীয়; সালাফদের নিকট যেমন, আল্লাহ তাআলার নিকটেও। এজন্য তাবিয়ী হাজ্জাজ ইবনে আরতাত (১৫০ হি.) রহ. বলেন, “পঞ্চাশটা হাদিস শেখার চেয়ে একজন মানুষের জন্য সুন্দর আদব-আখলাক শেখা বেশি জরুরি।” [18]আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামি, ১/২০১, খতিব বাগদাদি, মাকতাবাতুল … Continue reading
দ্বিতীয় শতকের মুহাদ্দিস মাখলাদ ইবনুল হুসাইন আল-মুহাল্লাবিও (১৯৬ হি.) প্রায় কাছাকাছি কথা বলেছেন—“অনেক বেশি-বেশি হাদিস জানার চেয়ে আমাদের জন্য আদব শেখা বেশি জরুরি।” [19]মু’জামু ইবনিল আ’রাবি ৩/১১৩৫, ইবনুল আ’রাবি (৩৪০ হি.), দার ইবনুল জাওযি
আদববিহীন ইলমের ঝুঁকিটা কোথায়? এটা বুঝতে হলে তৃতীয় শতকের মালিকি ইমাম শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আল-বুশানজির (২৯১ হি.) বক্তব্যটির প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দিতে হবে। আদববিহীন ইলমের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে তিনি বলেন, “যে আদববিহীন ইলম ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন করতে চায়, তার পক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যাচার করাও খুব সামান্য বিষয় মনে হবে।” [20]সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৩/৫৮৬, হাফেজ যাহাবি
বুশানজির বক্তব্যটি বাহ্যত একটু কঠোর ও অস্বাভাবিক মনে হলেও, আদতে বাস্তবতা এমনই। আদববিহীন ইলম অন্বেষণকারী কেউ যখন ইলমি আলাপে মত্ত হয়, ইচ্ছেকৃত না হলেও, লাগামহীনতার কারণে এমন সব অসংলগ্ন কথা ও আচরণ প্রকাশিত হয়, যা ক্ষেত্রবিশেষে আল্লাহ ও তার রাসূলের নামে মিথ্যাচারের নামান্তর।
ধরুন, একজন আলিম ও আরেকজন আদবহীন মানুষের মাঝে ইলমি কোনো বিষয়ে পর্যালোচনা ও বিতর্ক চলছে। স্বভাবতই, আদাবুল ইলম ও আদাবুল ইখতিলাফের দাবি হলো—বিতর্কে যেন এমন কোনো কথা উচ্চারিত না হয়, যা আল্লাহ ও তার রাসূল বলেননি। এক্ষেত্রে বা-আদব আলিমের পক্ষে তা রক্ষা করা সম্ভব হলেও, আদবশূন্য মানুষটির পক্ষে এই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বিতর্কে জেতার নেশা তাকে এমন কথা বলতেও প্রবৃত্ত করতে পারে, যা প্রকারান্তরে আল্লাহ ও রাসূলের নামে মিথ্যাচারের নামান্তর। জেনেবুঝে মিথ্যাচার না করলেও জেদ ও ঝোঁকের বসে করে ফেলা খুব স্বাভাবিক। শাইখুল ইসলাম বুশানজি রহ.-এর বক্তব্যটি এর প্রতিই ইঙ্গিত করে।
নিছক ইলম অর্জনই নয়; মানবজীবনে আদব শেখা কেন গুরুত্বপূর্ণ—এই প্রসঙ্গে আয়াত-হাদিস-আসার ও সালাফের বক্তব্যের আলোকে চাইলে আরও ফিরিস্তি টানা যাবে। আপাতত দীর্ঘায়নের ভয়ে আলাপ এখানে সংক্ষেপণ করি। প্রসঙ্গ শেষ করার আগে সাহাবা ও সালাফদের জীবনে আদবের কিছু নমুনা ও ঘটনা তুলে ধরা যাক।
সাহাবা ও সালাফদের আদব
বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু। নবীজি যার ইলমের জন্য দোয়া করে গেছেন। ইতিহাস যাকে চিনেছে ‘রঈসুল মুফাসসিরিন’ উপাধিতে। বয়সে অপরাপর সাহাবিদের থেকে তিনি ছিলেন বেশ ছোট। যে-কারণে ইসলামের শুরুযুগ সহ অনেক ঘটনার তিনি সরাসরি সাক্ষী হতে পারেননি। এই বিষয়ক হাদিস ও ইলম অর্জনের জন্য তাঁকে আকাবির সাহাবিদের কাছে যেতে হতো। এই প্রচেষ্টা তিনি করতেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আদবের সাথে। আমাদের এই আলোচনায় তিনি হতে পারেন উত্তম আদর্শ।
ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর যখন কোনো সাহাবির কাছ থেকে হাদিস বা মাসয়ালা জানার প্রয়োজন হতো, তখন তিনি সেই সাহাবির দরজায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন। বাইরে থেকে খোঁজ পাঠিয়ে বিরক্ত করতেন না। দরজায়ও কড়া নাড়তেন না। বরং অপেক্ষা করতেন। সাহাবি যখন বের হতেন, তখন তাঁর সোহবত (সান্নিধ্য) গ্রহণ করতেন এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে প্রশ্ন করতেন।
আরও নির্দিষ্ট করে তাঁর আদবের ঘটনা শোনাই।
যায়দ ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু। ওহি-লেখক সাহাবি। কুরআন সংকলনের ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্বশীল যে-ক’জন সাহাবি ছিলেন, যায়দ ইবনে সাবিত তাঁদের একজন। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু নানা বিষয়ে যায়দ ইবনে সাবিতের কাছ থেকে ইলম হাসিল করতেন।
যায়দ ইবনে সাবিত একদিন বাহনে চড়েছেন। কোথাও যাবেন। এমন সময় ইবনে আব্বাস এসে উপস্থিত হলেন। হযরত যায়দকে আরোণহরত দেখামাত্র তিনি বাহনের লাগাম হাতে তুলে নিলেন। গোলামের মতো বাহনের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যাবেন। আহলে বাইতের একজন সদস্যের এমন বিনীত আচরণে যায়দ ইবনে সাবিত বিব্রতবোধ করতে লাগলেন।
—‘ইবনে আব্বাস, সরে যাও।’ বিব্রতি কাটাতে হযরত যায়দ বললেন।
—‘আমাদের আলিমদেরকে এমন সম্মান করতেই আমরা নবীজি কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি।’ বিব্রতি দূর করতে ইবনে আব্বাস মুখ খুললেন।
যায়দ ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু বাহন থেকে নেমে এলেন। ‘তোমার হাতটা দেখি ইবনে আব্বাস!’ ইবনে আব্বাস হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর হাতে চুম্বন করে যায়দ বললেন, ‘আমরাও আহলে বাইতের সাথে এমন সম্মান প্রদর্শন করতে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি।’ [21]আল-মুজালাসাতু ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম ৪/১৪৭, আবু বকর দিনাওয়ারি (৩৩৩ হি.), দার ইবনে … Continue reading
এবার সালাফের ঘটনা বলি।
দ্বিতীয় শতকের মুহাদ্দিস ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের কথা ইতিহাসস্বীকৃত। তার একেক দরসে লোকসংখ্যা হতো পাঁচ হাজার করে। কখনো আরও বেশি হতো। দরসে হাদিস কিংবা ফিকহি বিষয়াদি লিখত যারা, তাদের সংখ্যা হতো পাঁচশোরও কম। বাকিরা তার কাছ থেকে উত্তম আদব ও সুন্দর গুণাবলি শিখত। [22]মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃ. ২৮৮, ইবনুল জাওযি, দার হিজর
বলাবাহুল্য, আমরা যে-সময়টার কথা বলছি, সেটা খাইরুল কুরুনের একদম নিকটবর্তী। তখন ইলম অর্জনকারী ও আদব অর্জনকারীর সংখ্যার মাঝে ছিল আকাশপাতাল তফাত।
বিখ্যাত দুই হাদিসগ্রন্থের রচয়িতা ইমাম বুখারি (২৫৬ হি.) ও মুসলিম (২৬১ হি.) রহ.। ইমাম মুসলিম ছিলেন ইমাম বুখারির ছাত্র। নানা কারণে উস্তাদের প্রতি মুসলিমের ছিল অসামান্য ভক্তি। একদিন তো উস্তাদকে বলেই ফেললেন, “সায়্যিদুল মুহাদ্দিসিন, ইমামুল ইলাল, আপনার পা দুটি দিন; চুম্বন করে ধন্য হই।” [23]সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১২/৪৩২
ইমাম বুখারি তাঁর প্রিয় ছাত্র মুসলিমকে পা চুম্বন করতে দিয়েছিলেন কি না—একথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। শরয়ি দৃষ্টিকোণ ও বুখারির দৃষ্টিভঙ্গির দিকে তাকালে স্পষ্টতই বোঝা যায়—দেননি। দিয়েছেন কি দেননি, ইতিহাস তা মনে রাখেনি। কিন্তু উস্তাদের প্রতি তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আদবকে স্মরণ রেখেছে। আমাদের আলোচ্য বস্তু এই জায়গাটুকুই।
তথ্যসূত্র:
↑1 | আত-তাবাকাতুস সানিয়্যা ফি তারাজিমিল হানাফিয়্যা ১/১১৪, তাকিউদ্দিন আল-গাযযি, দারুর রিফায়ি; আল-জাওয়াহিরুল মুযিয়্যা ফি তাবাকাতিল হানাফিয়্যা ২/৪৯৬, আব্দুল কাদের আল-কুরাশি |
---|---|
↑2 | তারিখু দিমাশক ১৪/২৯৩, ইবনে আসাকির |
↑3 | আল-মাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা পৃ. ৩৯০, ইমাম বাইহাকি, দারুল খুলাফা লিল-কিতাবিল ইসলামি |
↑4 | লিসানুল আরব ১/২০৬ |
↑5 | ফাতহুল বারি ১০/৪০০, দারুল মা’রিফাহ |
↑6 | তাজুল আরুস ২/১২, মুরতাযা যাবিদি |
↑7 | মাদারিজুস সালিকিন ২/৩৭০, দারুল কিতাবিল আরাবি |
↑8 | মাদারিজুস সালিকিন ২/৩৬৮, দারুল কিতাবিল আরাবি |
↑9 | মা’রিফাতু উলুমিল হাদিস, পৃ. ৬৩, হাকিম নাইসাবুরি, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ |
↑10 | শুআবুল ঈমান ৪/৫৫৯, বর্ণনা নং-৩০১৭, ইমাম বাইহাকি, মাকতাবাতুর রুশদ |
↑11 | হিলইয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৩০, আবু নুআইম আসবাহানি, দারুস সাআদাহ |
↑12 | আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামি, ১/৭৯, খতিব বাগদাদি, মাকতাবাতুল মাআরিফ |
↑13, ↑17 | আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামি, ১/৮০, খতিব বাগদাদি, মাকতাবাতুল মাআরিফ |
↑14 | প্রাগুক্ত |
↑15 | আস-সুনানুল কুবরা, আসার নং-৫০৯৮, ইমাম বাইহাকি |
↑16 | আত-তামহিদ লিমা ফিল মুওয়াত্তা মিনাল মাআনি ওয়াল আসানিদ ৩/৪, ইবনে আব্দুল বার, ওয়াযারাতু উমুমিল আওকাফ, মরক্কো |
↑18 | আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামি, ১/২০১, খতিব বাগদাদি, মাকতাবাতুল মাআরিফ |
↑19 | মু’জামু ইবনিল আ’রাবি ৩/১১৩৫, ইবনুল আ’রাবি (৩৪০ হি.), দার ইবনুল জাওযি |
↑20 | সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৩/৫৮৬, হাফেজ যাহাবি |
↑21 | আল-মুজালাসাতু ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম ৪/১৪৭, আবু বকর দিনাওয়ারি (৩৩৩ হি.), দার ইবনে হাযম |
↑22 | মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃ. ২৮৮, ইবনুল জাওযি, দার হিজর |
↑23 | সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১২/৪৩২ |