ইসলামি শিল্পকলায় উদ্ভিজ্জ নিদর্শন

অস্ট্রিক আর্যু

ইসলামি শিল্পকলায় উদ্ভিজ্জ নিদর্শন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৃক্ষ, তরুলতা-গুল্মাদি-পাতা ইত্যাদির আকার ও ভঙ্গি এই শিল্পকলার মূল উৎস। এককভাবে বা অন্যান্য প্রধান ধরনের অলংকার যেমন—ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতিক প্যাটার্ন এবং ফিগারাল রিপ্রেজেন্টেশন-এর সাথে উদ্ভিজ্জ নিদর্শনগুলি ইসলামি বিশ্বজুড়েই দেখা যায়। স্থাপত্য, গ্রন্থ, বস্তু এবং কাপড় বা বয়নশিল্পে এর ব্যবহার হয়ে আসছে। ক্যালিগ্রাফির বিপরীতে উদ্ভিজ্জ নিদর্শনের এই শিল্প খুব দ্রুতই একটি ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় অলংকার হিসাবে প্রারম্ভিক ইসলামি আরবভূমিতে একটি নতুন বিকাশের প্রতিনিধিত্ব করে। শুরুর দিকে এই শিল্পে যে মোটিফগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তা মূলত পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এবং সাসানিয়ান ইরানের বাইজেন্টাইন সংস্কৃতির বিদ্যমান ঐতিহ্য থেকে নেওয়া হয়েছিল।

ইসলামি যুগের শুরুর দিকে সেমি-রিয়েলিস্টিক প্রাক-ইসলামিক মোটিফ এবং প্যাটার্নগুলির গ্রহণ দেখা যায়। এরপর নতুন নতুন মুসলিম পৃষ্ঠপোষকদের নান্দনিক আগ্রহ এবং রুচি অনুসারে এই ফর্মগুলিকে নানাভাবে বিন্যস্ত করা হয়। ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই অভিযোজন প্রক্রিয়া ঘটেছিল। এতে করে মধ্যযুগীয় সময়কাল অর্থাৎ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী অবধি অত্যন্ত বিমূর্ত এবং সম্পূর্ণরূপে বিকশিত ইসলামিক একটি শৈলীর উদ্ভব হয়েছিল। এই শৈলীর মূল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সর্বব্যাপী প্যাটার্নটি সাধারণত ‘আরবেস্ক’ নামে পরিচিত। মিশরে নেপোলিয়নের বিখ্যাত অভিযানের পর উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এই শব্দটি তৈরি করা হয়েছিল। ফরাসি ভাষায় আরবেস্ক শব্দের অর্থ ‘আরব ফ্যাশন’। এই ‘আরবেস্ক’ ইউরোপে এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাচ্যবাদের শিল্প হিসেবে অনেক বেশি অবদান রেখেছিল। ইসলামিক শিল্পের অনেক বোদ্ধাপণ্ডিত আজও এই টার্ম ব্যবহার করে থাকেন।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পশ্চিম এশিয়ায় মঙ্গোল আক্রমণ এবং ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে ইরানে একটি মঙ্গোল দরবার প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে, অনেক চীনা মোটিফ এবং নিদর্শন গৃহীত হয়েছিল, যদিও তা ঘটেছে কখনও কখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সংশোধিত আকারে। এই সময়কালে ইসলামি শিল্পকলার অলংকরণে অনেক রূপান্তর ঘটেছে এবং এই রূপান্তরের ঘটনা চলতে থাকে কয়েক শতাব্দী ধরে। ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে, প্রথমে ইতালিতে এবং পরে অন্যত্র, ইসলামিক-শৈলীর উদ্ভিজ্জ নিদর্শন তৈরি হয়েছিল। অটোমান, সাফাভিদ এবং মুঘলদের (বর্তমান তুরস্ক, ইরান এবং ভারত) ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যগুলিতে এর বহুল ব্যবহার হয়েছে। এসময়টাতে মূলত প্রতিষ্ঠিত নিদর্শনসমূহের জটিল সংস্করণগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল। কখনও কখনও কোনো প্রাকৃতিক-সৌন্দর্যমণ্ডিত ফুল বা পাতার বিন্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি নতুন সৃষ্টির জন্ম দিয়েছে। সাধারণ বাগান কিংবা বেহেস্তের বর্ণনায় উল্লেখিত ফুল বা উদ্ভিদের কথা বাদ দিলে, ইসলামি শিল্পে উদ্ভিজ্জ মোটিফ এবং নিদর্শনগুলি মূলত প্রতীকী অর্থে বর্জিত।

ইসলামি শিল্পকলায় ক্যালিগ্রাফি একই সাথে সবচেয়ে সম্মানিত এবং সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। এটা এই কারণে তাৎপর্যপূর্ণ যে নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে আল্লাহর ঐশীগ্রন্থ কোরআন নাজেল হয়েছিল আরবি ভাষায়। আর এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আরবি লিপির অন্তর্নিহিত বিভিন্ন অলংকৃত রূপের বিকাশের সম্ভাবনা প্রচুর। অলংকার হিসাবে ক্যালিগ্রাফির একটি নির্দিষ্ট নান্দনিক আবেদন আছে। বেশিরভাগ ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে সুস্পষ্ট লিপি থাকলেও সব মুসলিম সেগুলি পড়তে সক্ষম হতো না। এটা মনে রাখতে হবে যে ক্যালিগ্রাফি মূলত একটি পাঠ তবে তা আলংকারিক আকারে।

অঞ্চলভেদে বিভিন্ন সময়কালে সামগ্রিক নকশায় ক্যালিগ্রাফির ব্যবহারে পরিবর্তন আসে। অলংকার হিসাবে ক্যালিগ্রাফির সৃজনশীলতার নানারূপের দেখা মেলে। কিছু ক্ষেত্রে, অলংকরণে ক্যালিগ্রাফি প্রধান উপাদান। এইসব ক্ষেত্রে শিল্পী অলংকার হিসাবে লেখা তৈরি করতে আরবি লিপির অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলিকে কাজে লাগিয়ে থাকেন। একটি সম্পূর্ণ শব্দ বা বাক্য এলোমেলো ব্রাশস্ট্রোকের ছাপ দিতে পারে, অথবা একটি একক অক্ষর একটি আলংকারিক গিঁটে বিকশিত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ ক্যালিগ্রাফিক কাজগুলি কোনো আলংকারিক ফ্রেম বা ব্যাকগ্রাউন্ড দ্বারা অলংকৃত এবং উন্নত করা হয়। এটা ঠিক যে, ক্যালিগ্রাফি নিজেই একটি সামগ্রিক আলংকারিক প্রোগ্রামের অংশ হয়ে ওঠার সক্ষমতা রাখে, যা বাকি অলংকরণ থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা।

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্যালিগ্রাফি একই সঙ্গে উদ্ভিজ্জ বিন্যাসের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলে বা কখনো একটা জায়গায় এসে উভয়ে মিলিত হতে পারে; অর্থাৎ তখন প্রায়শই বিভিন্ন স্তরে ক্যালিগ্রাফি এবং উদ্ভিজ্জ নিদর্শনের আলংকারিক উপাদানগুলির একটি ইন্টারপ্লে বা পারস্পরিক ক্রিয়া হয়। আর এভাবেই জন্ম নেয় এক একটি নতুন নতুন শিল্পের।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শাহীনুর রহমান
শাহীনুর রহমান
1 year ago

আর্যু, মন ভরলো না। কিছু নমুনা ও বিস্তারিত ভেবেছিলাম।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷