আর্ট অ্যান্ড সিভিলাইজেশন বইতে ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে বলা আছে—কলম বা তুলির সাহায্যে কাগজ বা এই জাতীয় উপাদানের উপর হস্তাক্ষর যা একই সাথে শৈল্পিক ডিজাইন এবং ফর্ম তুলে ধরে। সাধারণত ক্যালিগ্রাফি বলতে বোঝায় এক ধরনের লিপিচিত্র যা চীনা এবং জাপানিদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল আজ থেকে দু হাজার বছর আগে। কিন্তু ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি বলতে আজ যা বোঝায় তার উৎপত্তি ও প্রসার ঘটেছিল তারও অনেক পরে। ক্যালিগ্রাফি, চীনা ধরনে—যা প্রাচীন হায়রোগ্লিফিক চিত্রবিদ্যার চেয়েও বর্ণিল। অন্যদিকে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি শুরুই হয়েছিল বর্ণকে প্রধান করে। তাই ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিতে বর্ণ নিজেই একটি চিত্র হয়ে ওঠেছে।
চৌদ্দশো বছর আগে, কুরানের বাণী সংরক্ষণ এবং জনগণের নিকট তা পৌঁছাত প্রধানত তিনটি উপায়ে— হাফেজ, যারা গোটা কুরআন শরিফ হুবহু মুখস্থ করত; কারি, যারা কুরআন শরিফ বিশুদ্ধ উচ্চারণে আবৃত্তি করে অবিশ্বাসীদের আকৃষ্ট করত এবং পূর্ণ ইমানের সাথে তাকে একজন মুসলমানে রূপান্তর করত; শেষে কাতিব, যারা পবিত্র কুরান নকল করত তাদের সুন্দর ও শৈল্পিক হস্তাক্ষরের মাধ্যমে। শুরুতে এ ধরনের হস্তাক্ষরকে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি বলা হলেও পরবর্তিতে ইসলামিক দর্শন ও চিন্তাধারায় চিত্রণে রক্ষণশীলতার কারণে এর বিকাশ একটি সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত হয়। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ একজন শিল্পী, তাই ইসলামিক নীতিবোধসম্পন্ন একজন মুসলিমকে বিশেষ করে একজন কাতিবকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। চিত্রকলা বা সঙ্গীতের মতো করে তারা তাদের শৈল্পিক তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি।
কুরআনের বাণীর সাথে প্রথম দিকে ড্রইংয়ের পরিবর্তে কাতিবগণ লতাপাতা ও আলপনার ব্যবহার করতেন। পরিবর্তীতে কাতিবগণ বাণীকে এমনভাবে লিখতে শুরু করেন যাতে করে অক্ষর বা অক্ষরসমষ্টি নিজেই লতাপাতা বা আলপনার রূপ নিতে থাকে। পবিত্র কুরানের বাণীর প্রচার ও প্রসার লাভের সাথে সাথে ক্যালিগ্রাফি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হয়ে ওঠে, কেননা এতে করে কুরআনের বাণীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় আরবঅঞ্চলই ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির সূতিকাগার। ধর্ম হিসেবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভের পর মুসলমানরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে এবং জনগণকে ইসলামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে থাকে সেই সাথে সাথে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিরও বিস্তার ঘটতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর ওফাতের পর ৬৩০ খ্রি. থেকে ১৭০৭ খ্রি. পর্যন্ত মুসলমানরা বীরত্বের সাথে ছড়িয়ে পরে স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে ভারতবর্ষের পশ্চিম ও বুলগেরিয়ার পূর্বাঞ্চল থেকে ইয়েমেনের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত অবধি।
পবিত্র কুরআনের বাণী নকল করার মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু হলেও প্রথমদিকে এর ব্যবহার হতো মুদ্রায়, মসজিদসহ অন্যান্য ইসলামিক স্থাপত্যে, মাদরাসায় এবং দরগায়। উঁচুদরের সাহিত্যের পাণ্ডুলিপিতে, কাঠের কাজে, কাপড়ে, এবং বিভিন্ন হস্তশিল্পে ক্যালিগ্রাফি লক্ষণীয় হতো।
চীনারা ক্যালিগ্রাফিতে প্রধানত তুলি ব্যবহার করত। কিন্তু ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিতে লেখাটা যখন ড্রইং থেকে মুখ্য তখন পাখির পালক ব্যবহারটাই মুসলিমদের কাছে বেশি গুরুত্ব পেতে থাকল। পরে পাখির পালকের পরিবর্তে ‘বিগপেন’ বা পার্সিয়ান ভাষায় ‘কালামে দুরস্ত’-এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেল। আজকাল অবশ্য অনেক রকম আধুনিক কলম পাওয়া যাচ্ছে। যেগুলো ‘ক্যালিগ্রাফি পেন’ হিসেবে অধিক পরিচিত ও স্বতন্ত্র। আগে বিভিন্ন পাথর কয়লা গুঁড়ো করে ও নানান উপাদান সংমিশ্রণ করে কালি তৈরি হতো৷ এখন তো সৰ্বত্ৰ আধুনিক কালিই ব্যবহার হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে ক্যালিগ্রাফিতে শুধু আরবি বা ফারসি বা উর্দু লিপিরই ব্যবহার কেন? এটা প্রধানত একারণে যে, এই তিনটি ভাষার বর্ণমালার গঠন আকৃতি ও চরিত্রগত নৈকট্যই এর কারণ। এই তিনটি ভাষার বর্ণমালা স্থান ও স্থানান্তরভেদে গঠন ও আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে; যা ক্যালিগ্রাফিতে ভিন্নমাত্রা আনতে শিল্পিকে সুযোগ দেয় এবং সহজ করে তোলে—এতে করে একজন ক্যালিগাফি-শিল্পী নিজের মতো করে লিখতে বা আঁকতে পারেন।
ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিতে কুফি শৈলীই সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। যা ব্যবহার হতো সপ্তম হিজরিতে। ইরাকের কুফা নগরীতে এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল বলে এর নাম হয়েছে কুফি শৈলী। অন্যান্য প্রধান শৈলীগুলোর মধ্যে সুল্স, নাখ, মুহাক্কাক, রায়হানি, তাওকি ও রুকআ শৈলী মূলত কুফি শৈলীরই বিবর্তন; যা চর্চিত হয়েছিল এগারো হিজরিতে। এই শৈলীগুলোকে একত্রে বলা হয় ‘আকলামুস সিত্তা’ বা ‘ছয়মাত্রা’। আরবদের মধ্যেই অন্য ঘরানার চিঠিপত্রে ডাকবিভাগে বা এজাতীয় কাজে তুগরা ব্যবহার করত। একে দিওয়ানি শৈলীও বলা হয়ে থাকে ৷
বিভিন্ন কারণে কুফি পাণ্ডুলিপি বিভিন্নভাবে পড়তে হতে পারে। নাস্থ শৈলী ছিল কুফি থেকে উন্নত৷ যে কারণে কুফি থেকে নাসখি লিপি অতি দ্রুত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আরব অঞ্চলের বাইরে ইসলাম যখন দ্রুত বিকাশ হতে থাকল অন্যান্য দেশসমূহেও তখন ক্যালিগ্রাফির চর্চারও উন্নয়ন ও বিবর্তন হতে শুরু করল৷ বিশেষ করে অনারব দুটি দেশে—তুর্কি ও ইরানে।
ইসলামের প্রারম্ভিক শতাব্দিগুলোতে পার্শিরা ‘পহলভি’র প্রতিনিধিত্ব করে যা আরবি বর্ণমালারই বিচ্যুতাংশ। ইরানিরা তখন অধিকতর শৈল্পিক লিখনপ্রণালীর ওপর জোর দেয় এবং তা উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে এবং ক্রমে তা জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইসলাম-পূর্ব ইরানে জরথুস্ত্র এবং মনিবাদ পাণ্ডুলিপিতে ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলেখা পাওয়া যায়। চৌদ্দ হিজরিতে ইরানে ক্যালিগ্রাফির দুটো নতুন শৈলী যুক্ত হয় যার একটি তা’লিক এবং অপরটি নাস্তা’লিক।
রাজা প্রথম সুলায়মানের আমলে (পনেরো হিজরিতে) তুর্কিতে ক্যালিগ্রাফির খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘরানা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার জনক ছিলেন শেখ হামদুল্লাহ—যা ‘শেখ-শৈলী’ নামে সমাধিক পরিচিত; এটি দিওয়ানি স্টাইলকে অনুসরণ করত। সম্রাট অটোমানের আমলে রাষ্ট্রীয় নথিপত্রে, অর্থনৈতিক কার্যাদিতে সিয়াকাত নামের হস্তলেখার প্রচলন ছিল। এটিও দেখা যায় পনেরো হিজরিতে। পরেরো শতাব্দীতে এসে সিয়াকাতলিপি একটি ধ্রুপদী ঘরানায় রূপ লাভ করে। তুর্কিতে কাতিব হাফিজ ওসমান ক্যালিগ্রাফিতে এক নাটকীয় পরিবর্তন আনেন। তিনি দেখান যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি কী করে একটি চিত্র তুলে ধরে; যা একই সাথে তাৎপর্যময় ও ইঙ্গিতবহ। এই স্টাইলকে বলা হতো হিলাইয়া। ক্যালিগ্রাফিকে শুধুমাত্র বর্ণবিন্যাস থেকে অধিকতর চিত্রময় করে তোলার ক্ষেত্রে সম্ভবত এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ।
বর্তমানে ক্যালিগ্রাফিতে কুফি, নাখ, দিওয়ানি, মুহাক্কাক, রায়হানি, তা’লিক, নাস্তা’লিক, শেকাস্তে, জানজিরি শৈলী কমবেশি প্রচলিত।
আরববিশ্বে ক্যালিগ্রাফির ইতিহাসে ইবনুল বাওয়াব (মৃত্যু ১০২২ খ্রি.) একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব; যিনি নাস্তা’লিক স্টাইলের আধুনিকায়ন করেছেন। তুর্কিতে আহমেদ কারাহিসারি (১৪৯৬-১৫৫৬ খ্রি.) জিলাইলিপি এবং তার স্বকীয়শৈলীর জন্যে খ্যাতিমান। রায়হানি, মুহাক্কাকলিপিও তার হাতে যথেষ্ট বেগবান হয়েছে। ক্যালিগ্রাফি জগতের অন্যতম মহান শিল্পী তিনি। শুরুটা যদিও আরবে এবং তা ফারসি-উর্দু বা এ জাতীয় ভাষায় হলেও বর্তমানে অসেমেটিক ভাষাতেও ক্যালিগ্রাফির চর্চা হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আরববিশ্ব এর চর্চা শুরু করলেও এটি সংরক্ষণ ও জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। স্বীকার করে নিতে হয় যে, দুটি অনারবীয় দেশ—তুর্কি এবং ইরানই ক্যালিগ্রাফিকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে নিষ্ঠার সাথে এর চর্চা করে আসছে এবং ক্যালিগ্রাফি যে আজ বিশ্বব্যাপী একটি শিল্প হিশেবে পরিচিতি ও স্বীকৃতি পাচ্ছে মূলত এই দুটি দেশের শিল্পীদের বদৌলতেই।
আরজু আমি রতন,.. কেমন আছ ?