ইমাম শাফেয়ীর নির্বাচিত পদাবলী

আহমাদ হাবীব শাকির

ইসলামে প্রশান্ত যাপনদর্শন প্রসঙ্গে


 দিনগুলির গতিপথ ছেড়ে দিও প্রিয়,

প্রবাহিত হতে দিও স্বগতিতে

তকদির যে ফয়সলা দেয়,

মেনেই নিও

খারাপ সময়ের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ো না

জেনো, দুর্দিনের আয়ুও ক্ষয়শীল—

মুসিবতে লৌহ ধৈর্যশালী হয়ে যেয়ো

উদারতা ও বিশ্বস্ততাকে বানিয়ে নিও

—প্রিয়তম স্বভাব

যদি সৃষ্টির কাছে তোমার দোষত্রুটি 

জাহেরই হয়ে যায়

চাও তুমি তা গোপনই থাকুক—

দানের উন্মুখ হাত প্রসারিত করে ঢেকে দিও তাহলে

কারণ বড় বড় ত্রুটিও মোছে দেয় প্রসার হাত

প্রশস্ততা ও হৃদয়ের ধনাঢ্যতা বেছে নিও প্রিয়

মশহুর আছে ঘটিয়ে ফেলা দাগ ও

খুঁত

দানশীলতার ঢাকনায় আবৃত হয়ে যায়

শত্রুর সামনে কখনও লাঞ্চনাকর প্রকাশ থেকে বিরত থাকো

কারণ দুশমনের সমালোচনা স্বতন্ত্র আরেক আপদ

জেনো, কৃপণের কাছে কখনও কৃপার আশা করো না

জানোই তো, পিপাসার্তকে আগেই পান থেকে বঞ্চিত করা হয়

আর বিলম্বিত আগমন তোমার রিজিকের ভাগে কমতি আনবে না

প্রচেষ্টার বৃদ্ধি যেমন বণ্টিত অংশ বাড়াতে পারে না

হতাশা ও নৈরাশ্য, কিংবা উল্লাস ও আনন্দ

জেনে নিও, এ কেবলই মুহূর্তের ও সাময়িক

আয়েশি আর দুঃখ দুরবস্থাও তেমনি ক্ষণিকের

যদি তুমি সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ মন বানাতে পারো

তুমি আর জগৎরাজের

ফরক পাবে না

—প্রতিশ্রুতি নাও

ধ্বংস যদি তোমার বারান্দায় পা ফেলে একবার

মাটি ও ঊর্ধ্বলোকে কোনো আশ্রয় পাবে না অবশেষ

আল্লাহর ভূমির আয়তন প্রশস্ত ও তোমার বিচরণের জন্যে

সীমাহীন

আর যখনই তাঁর মসিবত ধাওয়া করবে

সংকীর্ণতার পরিশেষ আবদ্ধ মুঠ ছাড়া ঠিকানা কোনোই ঠিকানা পাবে না

দুর্যোগ ও দুঃসময়কে অভিযোগ করা ছেড়ে দিও প্রিয়তম

সে তো সর্বদাই ঘাতক ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে

আর মৃত্যু ছাড়া কোনো উপশমই বর্তমান নেই—

দুনিয়ার পরিসীমায়

 


প্রজ্ঞা ফিকহ ও বৌদ্ধিক ব্যুৎপত্তি এবং সুফিতত্ত্ব প্রসঙ্গে


প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের হে আগন্তুক অন্বেষী, তোমার সমীপে বৃদ্ধের পুঁজি থেকে এই-ই উপদেশ—

ফকিহ এবং সুফি, উভয়ই হতে চেয়ো

আল্লাহর কসম কেবল তার একটিমাত্র হতে যেয়ো না

আধ্যাত্মের শীতল উপত্যকা ছেড়ে কেবলমাত্র ফকিহ ও বোদ্ধা যদি হতে যাও—

তোমার হৃদয় হবে পাথরভূমি

তাকওয়া ও বিশ্বাসের প্রস্বাদ তুমি

কিছুতেই পাবে না

তদুপরি কেবলমাত্র সুফি ও দরবেশির পথে যদি যেতে চাও—

শুনো, জাহালত ও মূর্খতা নিয়ে

সুকুন ও বিশুদ্ধি হয় না

 


রাসূলপ্রেম ও নববিবংশের মহব্বত প্রসঙ্গে


লোকজন বলে, শিয়া হয়ে গেছো?

না, শিয়াতত্ত্ব আমার পথ ও প্ররোচনা এবং বিশ্বাসের দূরতম অঞ্চল

আর তাতেও কোনো শক্ ও সন্দেহ রেখো না—

আপনি মুহাম্মদই আমাদের সবচে’ প্রিয় হাবীব

সর্বোচ্চ নেতা ও জীবনাদর্শের রাহনুমা

যদি নবি রাসুল ও আল্লাহর কোনো ওলির ভালোবাসা শিয়াতত্ত্বই হয়

মানুষের মহত্তম দায়িত্ব তবে

—এমনতর সম্বোধনের

সুযোগ্যতম ভাগিদার হয়ে ওঠা

জলসা ও বৈঠকিতে যখনই

আলী ফাতেমা ও হুসাইনের প্রসঙ্গ আসে

বলা হয়—তাকে ত্যাগ করো

দেখানো হয়

এতো শিয়াতত্ত্বেরই মিরাস বাহক

মামলা ঠুকব তাদের নামে

আল্লাহর আদালতে—

আওলাদে ফাতেমার মহব্বত যাদেরই তত্ত্বে দাড়াক শিয়াদর্শন

 


ক্ষমতা প্রজ্ঞা কাব্যচর্চা ও জ্ঞানতন্ত্রে আত্মবিনির্মাণ প্রসঙ্গে


কাব্যচর্চার বেঘোর নিমগ্নতা ও বিভোরতা যদি দার্শনিক ও প্রজ্ঞাবানের শান হতো

তবে সেই প্রজ্ঞা ও নিমগ্নতায় মহাকবি লাবিদকেও আমি ছাড়িয়ে যেতাম

যুক্তিতর্ক ও লড়া’য়ে পশুরাজ সিংহ এবং বনি ইয়াযিদ সম্প্রদায়কেও হার মানাতাম

যদি মহাপ্রাজ্ঞ স্রষ্টার রহম আমার ওপর না হতো

সকল মানুষের ওপর আমারই রাজত্ব ঘোষণা করতাম

 


জীবিকা ও জীবননির্বাহ এবং মানবিক জীবনযাত্রার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে


যাপনের ক্লান্তি ও ঘর্মাক্ত ঘাম নিয়ে

মানুষ যখন জীবিকার তালাশে আপন নগরে পৌঁছে

সফররত মৃত্যু আপন তালাশেও ততক্ষণে পৌঁছে যায়

গন্তব্যগামী

অনেক কৌতুকবাজ ও রঙ্গিলার মাথার ওপর

ঝুলে গেছে মৃত্যু তাদেরই অজ্ঞাতসারে

যদি তারা জানত আগত যবনিকার সময় ও জ্ঞান

মৃত্যুচিন্তাই তাদের স্বয়ং মৃত্যু হয়ে উঠতো

 


বন্ধুবৃত্ত একাকিত্ব ও অপরের প্রতি ভরসা প্রসঙ্গে


যখন আমি পরিপাশে বন্ধু খুঁজতে গেলাম

যে আমার ক্ষয়কালে হয়ে উঠবে হৃদয়ের জ্বালানি 

যখনই দুশ্চিন্তার ওক্তে ভেঙে পড়ি

বন্ধুবৃত্তে তড়পাই কে আছো সাহায্যকামী

দেখি কেবল কষ্ট ও বিপদে উপহাসকারী

আর অর্জন ও আনন্দে হিংসুকের সারি

 


নিন্দুক ও সমালোচকের জবাব প্রসঙ্গে


বন্ধু-স্বজনদের আরজি—

নিন্দুক ও সমালোচকদের জবাব নেই কেন আপনার

বলি—

নিন্দার জবাব কখনও হয়ে যায় 

নিন্দার দরোজায় স্বতন্ত্র চাবিকাঠি

জাহেল ও আহাম্মকের জবাব থেকে বিরত থাকাই শরাফত—

নীরবতাই তখন উত্তমতম জবাব

সিংহ চুপ থাকলেও তার ভয়ে কাছ ঘেঁষে না লোকজন

কুত্তা অবিরত ঘেউঘেউ করলেও

ঢিল ছোঁড়ে ছেলেপুলে

 


ছিদ্রান্বেষণ ও নিন্দা এবং জবানের আত্মরক্ষা প্রসঙ্গে


চাও যদি প্রশান্ত জীবন

তোমার দীন কামিল হোক আর ইজ্জত অক্ষুণ্ণ থাকুক

তোমার জবান ও লিসানের

অশ্রাব্যতা পরিশেষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসো

কারণ তোমার ত্রুটির বিনিময়ে লোকজনের জিহবাও সমান পাল্লায়

তোমার চোখ পরের ত্রুটিই যদি তোমারে দেখায়—

তবে এতটুকু ভাবো আর বলো

হে চোখ, অন্যদের চোখও দেখবার সমান শক্তিগামী

আচরণে বলিষ্ঠ সুন্দরকামী হতে যেয়ো

লঙ্ঘনকারীর দিকে প্রসারিত করো সহৃদয়তার হাত—

আর যদি রক্ষাই করতে চাও

ভালভাবেই করো

 


জ্ঞানার্জনের তরিকা ও অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে


সমুদয় মারেফত ও ইলম

সহস্রাব্দিব্যাপী পরিশ্রমেও

তোমার একার করতলগত হবে না

—মারেফত ও হিকমাহ হয় অকুল সমন্দর

প্রজ্ঞার তালাশকারীর সহিতম পথ একখানিই—

আগ্রহী শাস্ত্র ও ফন্নের সর্বোচ্চ সুন্দরতমটি

—অগ্রাধিকারে লুফে নেয়া

 


ইলমে নাফে বা উপকারী ইলম ও জ্ঞানের ক্ষতিক্ষমতা প্রসঙ্গে


যার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা কলবের পথনির্দেশ না হয়

হায়াতের ভারসাম্যে ও চরিত্রে ব্যধি হয়ে দাঁড়ায়

তাকে আল্লাহর পক্ষে সুসংবাদ পাঠিয়ে দাও—

বিনিময়ে আল্লাহই তাকে প্রতিমাপূজারীর সমান শাস্তি

পাঠিয়েছেন

—তারই অর্জিত জ্ঞান

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷