ইয়াসিন আল–হুনাইদা। আরবি ভাষার একজন জনপ্রিয় লেখক। তার প্রধান ক্ষেত্র বিভিন্ন পুরোধা ও মান্যবর ব্যক্তির জীবন ও কর্ম। আরবি ভাষার বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রিকা ও ওয়েব জার্নালে তিনি নিয়মিত লিখছেন। আমাদের এই রচনাটি প্রসিদ্ধ আরবি ওয়েবজিন তিবইয়ান থেকে সংগৃহীত। যোগাযোগ-এর পাঠকদের জন্য রচনাটি অনুবাদ করছেন তরুণ লেখক ও অনুবাদক মুহাম্মাদ শরিফ। লেখক, অনুবাদক ও তিবইয়ানের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
—সম্পাদক
মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুদীর্ঘ এক ইতিহাস, যা সেই আদিমকালে শুরু হয়ে কাল-পরিক্রমায় সমৃদ্ধ হয়েছে চিন্তক আর দার্শনিক ঘরানার হাত ধরে। তবে এর ভিত্তিগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত হয় আঠারো শতকে ইউরোপীয় আলোকায়ন আন্দোলনের পরে এবং তখন বিজ্ঞানের শাখাসমূহ স্বতন্ত্রতা লাভ করে—আজকে যেসব মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব কিংবা ইতিহাস বলে পরিচিত। এই ব্যাপারগুলো যে কেবল বিদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং আরবেও কতক বড় বড় ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে, যারা এই মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধিতে বড় অবদান রেখেছেন। এঁদের মধ্যে সবার অগ্ৰপথিক হলেন ইবনে খালদুন, সমাজজীবনের বাহ্যিক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ-প্রণালী দাঁড় করিয়েছেন। তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন মূলত মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ করে ইতিহাসের প্রতি অত্যধিক আগ্ৰহ ও সুগভীর চর্চার ফলে।
কিন্তু কে এই ইবনে খালদুন? এই অঙ্গনে তাঁর রেখে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও প্রভাবগুলো কী কী? এবং বর্তমান দুনিয়ার অনুসৃত অ্যাকাডেমিয়ায় সেসবের প্রাসঙ্গিকতাই বা কতটুকু?
মহান এক সাহাবি থেকে বংশের পরম্পরা :
ইমাম ইবনে খালদুনের নসবনামা হলো : আবু জায়েদ ওলিউদ্দিন আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল-হাসান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাবের ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম ইবনে আবদুর রহমান ইবনে খালদুন আল-হাজরামি, যা শেষ হয়ে হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবি—ওয়ায়েল ইবনে হাজার পর্যন্ত গিয়ে। তিনি তিউনিসিয়ায় ৭৩২ হিজরিতে জন্মগ্ৰহণ করেন। পণ্ডিতদের মধ্যে তাঁর বংশমূল নিয়ে মতপার্থক্য আছে, কেউ বলেন আরব, আবার কেউ বলেন তাঁর বংশমূল বার্বার বা আমাজিগ জাতি। তবে তাঁর নিজের কেতাব আত-তা‘রিফ বিবনি খালদুন ওয়া রিহলাতুহি গারবা ও শারকা (ইবনে খালদুনের পরিচয় এবং তার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সফর) মোতাবেক অগ্রগণ্য মত হলো তিনি বংশগতভাবে ইয়েমেনি আরব ছিলেন। আর উত্তরাধিকারসূত্রে ইবনে খালদুন ছিলেন আন্দালুসি, কারণ তাঁর প্রপিতামহ খালদুন ইবনে উসমান হাজরামাউত থেকে আন্দালুস বা স্পেনে আসেন এবং কারমোনায় অবতরণ করেন, তারপর সেখান থেকে তিনি সেভিলে গমন করেন।
খালদুনি পরিবার রাষ্ট্রীয় জটিলতা এবং বিভিন্ন উত্থান-বিদ্রোহে যুগপৎ সক্রিয় ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো আবদুল্লাহ আল-মারওয়ানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এছাড়া খালদুনি বংশের বিদ্রোহ ইত্যাদিতে একটা ইতিহাসও রয়েছে, তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো কারিব ইবনে উসমান ও তাঁর ভাই খালেদ ইবনে উসমানের বিদ্রোহ। এভাবে খালদুনি পরিবার পরম্পরায় বড় বড় পদ ও উচ্চ মর্যাদা লাভ করে আসছিল। তবে এভাবে ইবনে খালদুনের পিতামহ ওলিউদ্দিন আবদুর সময় এলে তিনি রাজনীতি ও জ্ঞানচর্চায় সমন্বয় করেন।
ইবনে খালদুন জীবনের দুইটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ অতিবাহিত করেন। একটা হচ্ছে ভ্রমণকাল—আন্দালুস ছাড়া মাগরিবের বিভিন্ন অঞ্চল। অষ্টম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকে, যখন তিনি কেবল রাজনীতি আর রাজপদ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। আরেকটা হচ্ছে তাঁর মিশরীয় জীবন, যখন তিনি রাজনীতিবিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু এলেম তলব আর সুফিজীবনে অতিবাহিত করেন, আর এভাবে তাঁর প্রয়াণ ৮০৮ হিজরি পর্যন্ত।
রাজনীতি ও জ্ঞানসমৃদ্ধ জীবন :
জেনে রাখুন, ইতিহাসশাস্ত্র হলো তত্ত্বজটিল, উপকারবহুল ও লক্ষ্যসমৃদ্ধ এক শাস্ত্র। কারণ ইতিহাস আমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত করে—আচার-সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জাতিগোত্র, সিরাত-চরিতে আম্বিয়া কেরাম ও রাজ্য-রাজনীতিতে আগেকার রাজাবাদশা, মোটকথা চর্চার সর্বোচ্চ ফায়দাই হাসিল হয়। (ইবনে খালদুন)
ইবনে খালদুন যৌবন পর্যন্ত নিজের পিতা মুহাম্মদের ছায়ায় বেড়ে ওঠেন, এবং পিতার থেকেই তিনি আরবিভাষা পাঠ গ্ৰহণ করেন। ইবনে খালদুনের শিক্ষাজীবন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে সাদ ইবনে বুরাল আনসারির হাতে কুরআনুল কারিমের হিফজ দিয়ে শুরু হয়। তিনি তাঁর থেকে আলাদা আলাদা করে এবং একত্র করে সাত কেরাত আয়ত্ব করেন। এবং ইমাম শাতেবির দুইটি কসিদা—কিরাতবিষয়ক ‘আল-লামিয়া’ ও রসমবিষয়ক ‘আর-রায়িয়া’ তিনি তাঁর কাছে পাঠ করেন। তাছাড়াও ইবনে আবদুল বারের আত-তাকাসসি লি-আহাদিসিল মুয়াত্তা এবং এর সাথে ইবনে মালেকের আত-তাসহিল ও ইবনে হাজেবের মুখতাসার’র পাঠ ইবনে খালদুন তাঁর থেকেই গ্ৰহণ করেন। আর এছাড়া আরও একাধিক উস্তায ও ফকিহের শিষ্যত্ব গ্ৰহণ তিনি—যেমন আবু আবদুল্লাহ ইবনে আল-আরাবি আল-হাসায়িরি এবং মুহাম্মদ ইবনে শাওভাশ আয-যারযালি।
আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, ইবনে খালদুন আন্দালুস ও মাগরিবে থাকাকালে শুধু রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর বন্ধু ইবনুল খতিব কারাগারে নিহত হলে নিজ থেকেই তিনি রাজনীতিবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, এবং চার বছর পশ্চিম আলজেরিয়ার উইলায়াহ ও হাররান প্রদেশে অতিবাহিত করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর বিখ্যাত রচনা আল-মুকাদ্দিমা পাঁচ মাসে শেষ করেন। এই কিতাবে তিনি ইতিহাসশাস্ত্র, এর গুরুত্ব, এর মতবাদসমূহ এবং ঐতিহাসিকদের গুরুতর ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে নিজেই বলেন : তাতে বাক্য আর অর্থের বিন্দুগুলো প্রবলভাবে চিন্তাজগতে বয়ে গেছে। ফলে তার মূল বিষয়গুলো মথিত হয়ে পরিণতিতে রূপ নিয়েছে। আর তখনকার নির্জন সময়ে আমি এভাবেই পরিচালিত হচ্ছিলাম। ইবনে খালদুন শাম ও মিসরেও সফর করেন, এবং মিসরে তিনি মোট পাঁচবার মালেকি কাজি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। যখন তিনি দামেশকে ছিলেন, তখন আচমকা শহর অবরোধের ঘোষণা করা হয়। তবে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন, এবং পরে মিসরে ফিরে গেলে সেখানেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।
প্রভাব ফেলেছেন যে মনীষীগণ
ইবনে খালদুন অসংখ্য উস্তাদ-শায়েখ থেকে এলেম অর্জন করেছেন। তাঁদের সকলের তালিকা পেশ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভবপ্রায়। আমরা কেবল বিশেষ করে তাঁদের উল্লেখ করছি, ইবনে খালদুনের জীবনে যাদের তুলনামূলক বেশি ও সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে, এবং যারা তাঁর সাহিত্যসত্তা নির্মাণে সম্যক অবদান রেখেছেন। তাঁরা হলেন :
১. আপন পিতা মুহাম্মদ আবু বকর
২. আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বাহর
৩. শামসুদ্দিন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে জাবের ইবনে সুলতান আল-কায়সি
৪. আবু মুহাম্মদ ইবনে আবদুল মুহাইমিন ইবনে আবদুল মুহাইমিন আল-হাজরামি
৫. আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মুহাম্মদ যাভাভি
৬. আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে শুয়াইব আত-তাযি
৭. আবু আবদুল্লাহ ইবনে আল-আরাবি আল-হাসায়িরি
৮. আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আল-কাসসার
৯. আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে শাওভাশ আয-যারযালি
১০. আবুল কাসেম আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ ইবনে রিজওয়ান আল-মালাকি
১১. আবুল কাসেম মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহয়া আল-বুরজি।
রিজিকের অন্বেষা কিবা এলেমের তলব :
আবদুর রহমান ইবনে খালদুন নিজের এলেম আর প্রতিভা অনুযায়ী জীবনে বেশকিছু পদ ও দায়িত্ব গ্ৰহণ করেছেন। কখনো লিখনশিল্প, কখনো বিচারপদ, কিংবা কখনো রক্ষী হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। আমরা তাঁর তিউনিসিয়া, মাগরিব, আন্দালুস ও মিসরে থাকাকালীন পেশাসমূহ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু আলোচনা করছি।
তিউনিসিয়ায় পেশাসমূহ :
তিউনিসিয়ায় তিনি শুধুমাত্র একটা পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। তা হচ্ছে তিউনিসিয়ার সুলতান আবু ইসহাকের (৭৫৩ হিজরি) হয়ে ‘আলামত’ লেখার দায়িত্ব। ‘আলামত’ লেখার মানে হচ্ছে বিসমিল্লাহ এবং সুলতানের বিভিন্ন লেখাজোখার মাঝে গাঢ় কলম দিয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহ ওয়াশশুকরু লিল্লাহ’ লেখা।
মাগরিবে পেশাসমূহ :
মাগরিবে তিনি মোট ছয়টি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সেগুলো হলো :
১. সুলতান আবু আনানের হয়ে ‘আলামত লেখা’ (৭৫৫ হিজরি)
২. সুলতান আবু সালেমের কাছে হস্তলিপির দায়িত্ব।
৩. সুলতান আবু সালেমের পক্ষ থেকে বিচারকের দায়িত্ব।
৪. সুলতান বেজাইয়ার (আবদুল্লাহ) কাছে রক্ষীর দায়িত্ব। ‘সুলতান’ বলতে এখানে গভর্নর উদ্দেশ্য।
৫. কনস্ট্যান্টিনেপলের সুলতান আবুল আব্বাসের কাছে রক্ষীর দায়িত্ব।
৬. সুলতান আবদুল আজিজের হয়ে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব। তাছাড়া তিনি সুলতান আবু হামভুর কাছে এই পদেই চাকুরি করেছেন।
আন্দালুসে পেশাসমূহ :
ইবনে খালদুন আন্দালুসে গিয়ে শুধুমাত্র একটা পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। তা হলো সুলতান আবু আবদুল্লাহ ইবনে আল-আহমার হয়ে রাজা পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব, যেহেতু তখন সুলতান আর শত্রুদের মধ্যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল।
মিশরে পেশাসমূহ :
মিশরে তিনি মোট তিনটি পেশায় নিয়োজিত থাকেন। সেগুলো হলো :
১. মালেকি মাজহাবের কাজির পদ। এই পদে তিনি পাঁচবার চাকুরি করেন—৭৮৬, ৮০১, ৮০৩, ৮০৪ ও ৮০৭ হিজরিতে।
২. অধ্যাপনার দায়িত্ব। আল-আজহার, আল-মাদরাসাতুল কমহিয়া, আল-মাদরাসাতুল যাহিরিয়া ও মাদরাসায়ে সারঘাতমিশ।
৩. শরফুদ্দিন আল-আশকারের মৃত্যুর পরে খানকায়ে বাইবার্সের গভর্নর পদ।
ইতিহাসপাঠের আলাদা ও স্বতন্ত্র দৃষ্টি :
ইবনে খালদুনের ইতিহাসপাঠে নতুন দৃষ্টির নেপথ্যে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল, যা তাঁর এই যাত্রাকে প্রস্তুত করে তুলেছে। ইবনে খালদুন ইলমুত তাওহিদকে সবিস্তারে পাঠ করেছেন, তিনি গ্ৰিক অধিবিদ্যা এবং ট্রাডিশনাল আরবি সাহিত্যপাঠে অত্যন্ত আগ্ৰহী ছিলেন, আর তাঁর ছিল দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। এইসব কারণই সমাজজীবনে বাহ্যিক ঘটনাগুলো বিচার-বিশ্লেষণে তাঁকে এই সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়ে যায় যে, এই ঘটনাগুলো সমাজজীবনের প্রকৃত বাস্তবতা নয়, বরং সেখানে দৃশ্যমান এই ঘটনাগুলোর পিছনে অবশ্যই গোপন কোনো চেইন আছে, যা অতীত, বর্তমান আর ভবিষৎকে পরস্পরে সংযুক্ত করে তোলে। আর তাছাড়া ঐতিহাসিক বিবরণী ও ঘটনার বয়ানে পরস্পরবিরোধী বেশ ভুলভ্রান্তি তাঁর কাছে আবিষ্কৃত হয়, যদ্দরুন তিনি ইতিহাসপাঠ ও লিপিবদ্ধকরণের গতানুগতিক ধারায় একটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে বেশ একান্ততা অনুভব করেন।
মুকাদ্দিমাতু ইবনে খালদুনে (পৃষ্ঠা : ৬) তিনি ইতিহাসকে একটা শাস্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন :
নিশ্চয়ই ইতিহাস সেইসব শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত, সমস্ত জাতি ও প্রজন্ম যার সিলসিলা বয়ে চলছে। যা লাভের জন্য উষ্ট্রারোহী ও মুসাফিররা প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমনকি সাধারণ প্রজা থেকে নিয়ে পতিত মানুষেরাও। রাজা-উজিররা যা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে এবং পাঠকের সংখ্যায় যেখানে জ্ঞানী-মূর্খ বরাবর—যেহেতু ইতিহাস বাহ্যিকভাবে কেবল অতীতের কাল, অতীতের রাজ্য-সাম্রাজ্য এবং অতীতের শতাব্দীগুলি সম্পর্কেই অবগতকারী। এই ইতিহাসে মতামতের আধিক্য থাকে এবং থাকে দৃষ্টান্তের সমাহার। যখন সমাজে সমাজে সংখ্যাবহুল হয়ে পড়ে, তখন সমাজগুলোর বৈশিষ্ট্য এই ইতিহাসই হাজির করে। এখান থেকেই আমরা জানতে পারি, তারা কী কঠিন সময় পার করেছে, তখনও কীভাবে তারা রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে গেছে, এবং তারা প্রস্থান বা মরণ তক কীভাবে এই জমিন চষে ফিরেছে। তবে ইতিহাসের অন্তর্নিহিত একটা তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ রয়েছে এবং এতে রয়েছে জগৎ-জীবনের হেতুসমূহ। এর মূলনীতিগুলো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম; ইতিহাস জগতের বাস্তবতা, এবং এর ধরন ও কারণসমূহ ব্য্যখ্যার গভীর শাস্ত্র। এ কারণে ইতিহাস জ্ঞান-প্রজ্ঞার শক্ত মূলভিত্তি, এবং তা প্রজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য ও উপযুক্ত।
ইবনে খালদুনের চিন্তাজগতে দৃষ্টি ফেরাতেই আমরা ধরতে পারি যে, তাঁর চিন্তাগুলো যে কেবল ইতিহাস-সর্বস্ব ছিল তা নয়, বরং তা ইতিহাসকে ছাপিয়ে আরেকটা স্বতন্ত্র শাস্ত্রে গিয়ে পৌঁছেছে, যাকে বলা হয় ‘মানব-বসতি-বিজ্ঞান’, কতক ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকের কাছে যা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ইবনে খালদুনের মতে ইতিহাসপাঠ কেবল ঘটনাসমূহেই সীমাবদ্ধ নয়, তা বরং ভবিষ্যতের পূর্বাভাস। ইবনে খালদুন নিজের চিন্তাজগতে ইতিহাসকে উসুলে ফিকহের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। তাঁর কথামতে উসুলে ফিকহের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ শরয়ি বিধানগুলো কেবল বুঝেই ক্ষান্ত হন না, বরং তারা আরও বিধান আবিষ্কার এবং সেখানে ইজতেহাদের সামর্থ্য রাখেন। তিনি মনে করতেন এই ইতিহাসশাস্ত্র মৌলিক ফুনুনে ইসলামি থেকে উৎসাহপ্রাপ্ত; এবং নুসুসে শরিয়া বা শরিয়তের মূলপাঠের সাথে সম্পর্কনির্মাণে ইতিহাসের ভিত্তিমূল উসুলে ফিকহপাঠের সাথে জড়িত। তাঁর অভিমতে দার্শনিকরা যেমন দর্শনপাঠে মানতেকের ব্যবহার করেন, ফকিহরা যেমন উসুলে ফিকহ মেনে বিধান আবিষ্কার করেন, তেমনি ইতিহাসপাঠের জন্য একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্র দরকার।
মানব-বসতি-বিজ্ঞানের ভিত্তিসমূহ :
ইবনে খালদুন সমাজজীবনের ইতিহাসপাঠে নিজের স্বতন্ত্র ধারা তিনটি ভিত্তিমূল ও কতগুলো মৌলিক রীতির উপর দাঁড় করিয়েছেন। সেগুলো হলো :
- কার্যকারণ-রীতি : একজন জ্ঞানীর ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যাপার হচ্ছে যে, তিনি নির্দিষ্ট ঘটনার সাথে তার নৈপথ্য কারণগুলির যোগাযোগ বিচার করবেন। একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী কিংবা একজন দার্শনিকের আলোচ্য বিষয় এটি, এবং অবশ্যই ইবনে খালদুনের মতে ইতিহাসবিদদেরও এটি আলোচ্য বিষয়। সুতরাং একজন ঐতিহাসিকের জন্য এই কার্যকারণ রীতি জানা এবং মানবসমাজের সাথে সংযুক্ত এর প্রভাবসমূহ পাঠ করা আবশ্যক, এবং সাথে তাঁদের জন্য আবশ্যক হলো যেকোনো সিদ্ধান্ত বা বিবরণী দেবার আগে তা এই রীতির সাথে সমঞ্জস কি না এটা যাচাই করে নেওয়া। ইবনে খালদুন কার্যকারণ রীতিকে ইতিহাসের সাথে এত গভীরভাবে সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন যে, মন্টেস্কুইইউয়ের মতো তিনিও ঐতিহাসিক ক্ষতিপূরণ রীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। মন্টেস্কুইইউ আর ইবনে খালদুনের চিন্তায় একটা সাদৃশ্য এই যে, তাঁরা উভয়েই মানবসমাজের ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট যেকোনো আলোচনা এই রীতির উপর দাঁড় করানোকে আবশ্যক মনে করতেন।
- সাদৃশ্যরীতি : ইবনে খালদুন মনে করতেন, জাতিগতভাবে একই সত্তা হবার কারণে দুনিয়ার সমস্ত মানুষই কিছু কিছু বিষয়ে পরস্পরে সাদৃশ্যপূর্ণ। অর্থাৎ তিনি মানবজাতির মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য কিংবা ভেদাভেদকেই নাকচ করেছেন—কেবল ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মহান ব্যক্তিগণ এর ব্যতিক্রম, নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য আম্বিয়া আউলিয়া যেমন। ইবনে খালদুন এই সাদৃশ্যরীতির একটা ব্যাখ্যা পেশ করেছেন, যেখানে তাকলিদ বা অনুসরণ হলো সাদৃশ্যরীতির অন্যতম বিষয়। তাকলিদের তিনি প্রকার করেছেন তিনি। তা হলো, প্রজাদের জন্য রাজার তাকলিদ, বিজয়ীর জন্য বিজিতের তাকলিদ এবং বিজিতের জন্য বিজয়ীর তাকলিদ। ইবনে খালদুন এই তাকলিদের মাসালায় ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক গ্যাব্রিয়েল তার্দের সাথে একমত হয়েছেন, যিনি ছিলেন তাকলিদতত্ত্ববিদ। তবে তিনি সমাজজীবনের সমস্ত প্রকার সাদৃশ্যকে তাকলিদ বলতেন না—যেমনটি তার্দে করেছেন। তিনি বরং সেটাকে তুলনামূলক জটিল ভাবতেন এবং সেগুলোকে দ্বীন, অধিবিদ্যা-দর্শন ও তাকলিদের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতেন।
- বৈপরীত্য-রীতি : উপরোক্ত সাদৃশ্যরীতির বিপরীত দিক, আর নিশ্চয়ই ইবনে খালদুনের সমাজজীবনের ইতিহাসপাঠ-পদ্ধতির অন্যতম হলো বৈপরীত্য-রীতি। কারণ প্রতিটি সমাজই পরিপূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণ হয় না, বরং সেখানে কিছু ভিন্নতা থাকে, এবং ঐতিহাসিককে যেটা লক্ষ রাখতে হয়। এই বৈপরীত্য-রীতি কেবলমাত্র একটা অভিজ্ঞতামূলক রীতি, দ্বীন বা অধিবিদ্যা-সংশ্লিষ্ট কোনো কার্যকারণ এতে নেই। ইবনে খালদুন এটিকে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রকৃতিতত্ত্ব এবং ভূগোলের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন—এভাবে যে, সমাজসমূহ সত্তাগতভাবে একই আত্মা ও শিকড়ের হলেও তাতে সমষ্টিগতভাবে ভিন্নতা ও বৈপরীত্যের উপাদান রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞান : নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক :
ইবনে খালদুনই এমন প্রথম দার্শনিক, যিনি একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্রের জন্য সমাজজীবন থেকে আলোচ্য বিষয় গ্ৰহণ করেছেন। তাঁর কেতাব আল-মুকাদ্দিমার কেন্দ্রীয় বক্তব্য রাষ্ট্র, যাকে তিনি উম্মত বা সম্প্রদায়ও বলেছেন। রাষ্ট্রের উৎপত্তি, এর বিকাশের বিভিন্ন স্তর, এর অগ্রগতির তরিকা, এমনকি চূড়ান্ত উন্নতি এবং তারপর পতন—এই বিষয়গুলো তিনি সেখানে হাজির করেছেন। তাছাড়া তিনি রাষ্ট্র-সংযুক্ত সমাজজীবনের বাহ্যিক ঘটনাগুলোর সাথে সেসবের পরিণতির পার্থক্যও বিচার করেছেন। আল-মুকাদ্দিমায় তিনি বলেন : মানুষকে সভ্য করে তোলার জন্য অবশ্যই মানবিক সমাজের দরকার আছে। আর এই ভিত্তির উপরেই দাঁড়িয়ে আছে খেলাফত এবং দুনিয়ার ইমারতসমূহ—কারণ বসতি এমন নিয়ন্ত্রক ঠিকানা, যা মানবসমাজের জুলুম ও শত্রুতাকে দমিয়ে রাখে।
কতকের অভিমত : আন্দালুসি দার্শনিকের সমুন্নত মর্যাদা :
লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব তাঁর ব্যাপারে তারিখু গারনাতা গ্ৰন্থে বলেন : একজন গুণী মানুষ, বিস্ময়পূর্ণ ও মর্যাদাসমৃদ্ধ ব্যক্তি। প্রকৃতপক্ষেই সম্মানিত ও প্রশস্ত আত্মার অধিকারী। সুউচ্চ মনোবল ও শক্ত হৃদয়ের মানুষ। তিনি আকলি ও নকলি এলেমে অগ্ৰগামী, অত্যধিক হিফজকারী, সচ্ছ চিন্তাধারী, চমৎকার লিপিকার, দারুণ বন্ধুসুলভ ও পাশ্চাত্যের গর্বের ব্যক্তি।
তহা হুসাইন ফালসাফাতুবনি খালদুন আল-ইজতিমায়িয়া গ্ৰন্থে বলেন : বাস্তবেই এই রাজনৈতিক-দার্শনিক অত্যন্ত বিরল মস্তিষ্কের অধিকারী। তিনি নিজের সমস্ত কর্মে অত্যন্ত সূক্ষ্ম যত্ন নিয়েছেন। মূলত নিজের সুদীর্ঘ পাঠ আর তখন পর্যন্ত আরবদের সমস্ত এলেমে গভীর ব্যুৎপত্তি, এবং অষ্টম হিজরি পর্যন্ত ইসলামি ইতিহাসের সমস্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে অবিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁকে ইবনে খালদুন হিসেবে তৈরি করেছে। নিজের প্রবলভাবে আন্দোলিত কেন্দ্রচিন্তা তাঁকে ভাবতে বাধ্য করত যে, যেসব বলা হচ্ছে আর যেসব কাজ করা হচ্ছে তা অত্যন্ত সতর্কতাপূর্ণ ও ওজনদার হওয়া চাই। এ কারণেই তিনি প্রত্যেকটা বস্তুগত বিষয়ে গভীর দৃষ্টি এবং সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার হিসেবে মেনে নিতে অপারগ ছিলেন।
চৈন্তিক উৎপাদন : স্বতন্ত্র যোগ্যতা ও প্রতিভার পরিচায়ক :
ইমাম ইবনে খালদুন অসামান্য কতক চৈন্তিক উৎপাদনে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে তিনি বিপ্লব সৃষ্টি করে গেছেন, শাস্ত্রগত ধারার সাথে সমাজজীবনের বাহ্যিক ঘটনাগুলোর সমন্বয়ে যা অগ্ৰগামী ছিল। এটা দলিল যে, তিনি সাহিত্য, সমাজ, অর্থনীতি ও ইতিহাস-সহ জ্ঞানের বিভিন্ন অঙ্গনে একাধিক যোগ্যতা ও দারুণ প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। এই চৈন্তিক প্রতিভার আরও সুস্পষ্ট পরিচায়ক হলো তাঁর গ্ৰন্থকর্মগুলো। যেমন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
১. আল-মুকাদ্দিমা
২. আত-তারিফ বিবনি খালদুন ওয়া রিহলাতুহি গারবা ওয়া শারকা
৩. শিফায়ুস সায়েল ফি তাহজিবিল মাসায়েল
৪. শরহু রুজযি লিসানিদ্দিন ইবনিল খতিব
৫. আল-য়িবার ও দিওয়ানুল মুবতাদা ওয়াল খবার ফি তারিখিল আরব ওয়াল বার্বার
৬. মান আসারাহুম মিন যাভিশ শা-নিল আকবার
৭. শরহুল বুরদাহ
৮. আল-হিসাব
৯. আল-মানতিক
১০. বুগয়াতুর রুওয়াদ ফি যিকরিল মুলুক মিন বানিল ওয়াদ
১১. আল-খবার আন-দাওলাতিত তাতার
১২. মুযিলুল মালাম আন হুক্কামিল আনাম
১৩. তালখিসুল মাহসাল লি-ফখরুদ্দিন আর-রাযি
১৪. শরহু কসিদাতিবনি আবদুন
১৫. তবিয়াতুল উমরান
তথ্যপুঞ্জি
- আল-আলাম। আয-যিরিলকি (৩/৩৩০)
- আল-মুকাদ্দিমা। ইবনে খালদুন
- ইবনু খালদুন আদিবা। ইবরাহিম ইউসুফ কিতরিব। (পৃষ্ঠা : ১১)
- শাযারাতুয যাহাব ফি আখবারি মান যাহাব ষ। (৯/১১৪)
- নাইলুল ইবতিহাজ বি তাতরিজিদ দিবাজ। আত-তামবাকতি (পৃষ্ঠা : ২৫০)
- আদ-দওয়ুল লামি লি আহলিল কুরআন আত-তাসি। আস-সাখাভি। (৪/১৪৫)
- আত-তারিফ বিবনি খালদুন ওয়া রিহলাতুহি গারবা ওয়া শারকা (পৃষ্ঠা : ৩)
- ফালসাফাতুবনি খালদুন আল-ইজতিমায়িয়া। তহা হুসাইন। (পৃষ্ঠা : ৩৫)
মাশাআল্লাহ
ভালো লাগল।
Masa-allah