আমাকে তুমি ঠিক চিনবে কি না বুঝতে পারছি না। এমনকি কখনো দেখেছ কি না সে ব্যাপারেও আমি সন্দিহান। কোনো দুপুরের মাথাধরা রোদের মধ্যে পিচগলা রাস্তার ধারে, নয়তো সন্ধ্যার ডুবুডুবু সূর্যের আবছা আলোয় তোমার ঠিক পেছনে, নয়তো মধ্যরাতের সবকিছু গিলে ফেলা অন্ধকারে তোমার বাড়ির উলটো পাশের মেহগনি গাছের নিচে যদি কখনো খেয়াল করে থাকো তাহলে হয়তো পলকের জন্য দেখে থাকতে পারো। আমার চেষ্টাই ছিল তুমি যাতে আমায় না দেখতে পাও। তবে সেইসব জায়গায় তোমার জন্য কেবল আমিই ছিলাম। আর তোমার অজান্তেই এই পৃথিবীতে সবখানে, সবকিছুতেই আমার জন্য কেবল এবং কেবলমাত্র তুমিই ছিলে। কিন্তু এইসব থাকাথাকিতে কিছুই যায় আসে না। কারণ তোমার আমার মাঝে ছিল অনেক অনেক দেয়াল—তোমাদের অর্থবিত্ত, বংশমর্যাদা, আভিজাত্য, এই মহাবিশ্বসম অহংকার আর আমার দারিদ্র্য, দুর্ভাগ্য, বংশহীনতা, সীমাহীন অক্ষমতা ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব দেয়াল ছিল চীনের মহাপ্রাচীরের থেকেও দুর্ভেদ্য। তাই আমি যতটা সম্ভব নিজেকে আড়ালেই রাখতাম। আড়ালে থেকে ভালোবাসা খুবই সহজ একটা খেলা। চোখের সামনে এলেই সেই খেলা হয়ে যায় জটিল।
তোমাকে কখনোই চিঠি লেখার ইচ্ছে আমার ছিল না। কাউকেই চিঠি লেখার ইচ্ছে ছিল না আসলে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় নোংরা দুর্গন্ধমাখা ময়লা একটা বেডে শুয়ে থাকতে থাকতে খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম। হাসপাতালের ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। তারপরও দেখি দিব্যি বেঁচে আছি। অবশ্য এই বেঁচে থাকাকে ঠিকঠাক বেঁচে থাকা বলা যাচ্ছে না। প্রায়ই শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়, শরীর বরফঠান্ডা হয়ে যায়। দিনে একবার দুইবার কেউ একজন এসে চেক করে যায়। প্রথম দিকে কীসব জানি লিখত। এখন আর লেখে না। আমার ধারণা মরে গেলাম না বেঁচে আছি তাই চেক করে যায়। এসবের মধ্যেই একদিন দেখলাম ডাকপিয়নের মতো ড্রেস পরা এক লোক হাসপাতালের বারান্দা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। তখন মনে হলো কাউকে একটা চিঠি লিখি। কিছু কথা বলে যাই। কিন্তু কাকে লিখব বুঝতে পারছিলাম না।
তোমার কি মনে আছে একদিন কলেজে যাওয়ার সময় তোমার এক পা রাস্তার ড্রেনের ঢাকনার লোহার ফাঁকে আটকে গিয়েছিল আর তুমি অসহায় হয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলে। সেদিন তোমার পা আরও এক জায়গায় আটকে গিয়েছিল। আর সেই জায়গার মালিক তোমার পা খুব যত্ন করে লোহার ফাঁক থেকে বের করে দিয়েছিল। তুমি তার দিকে তাকানোরও প্রয়োজন মনে না করে গাড়িতে উঠে পড়েছিলে। তাকালে তুমি দেখতে পেতে একজোড়া চোখে তোমার জন্য কি প্রগাঢ় মায়া আর প্রেম চিরজীবনের জন্য গেঁথে গিয়েছিল। বিশ্বাস করো এরপর থেকে সেই চোখজোড়া তোমায় দেখার জন্য যা যা করার সবই করেছে। এইসব করে আমি সুখেই ছিলাম। আসলে এর চেয়ে বেশি সুখ আমার জীবনে প্রয়োজন ছিল না।
দরিদ্রের সুখ নাকি কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আর আমার মতো মানুষদের জন্য তো আরও নয়। একদিন দেখলাম তোমার আর দেখা মিলছে না। তোমাকে না দেখে দেখে আমার অবস্থা হলো না খেয়ে থাকা মানুষদের মতো। কোনোমতে বেঁচে থাকলে যা হয় আরকি। তোমাদের বাড়ির দারোয়ানকে চা-পানি খাইয়ে বশ করে জানতে পারলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলেপক্ষ দেশের নামকরা ধনী। ছেলে থাকে আমেরিকায়। বিয়ের পরে তোমাকেও সেখানে নিয়ে যাবে। আমার চোখের সামনে মুহূর্তেই অনেককিছু ভেসে উঠল। কী কী ভেসে উঠল তা নাহয় নাই বলি। আমার পাগল পাগল অবস্থা হলো। প্রেম যে মানুষকে পাগল বানিয়ে ছাড়তে পারে সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমার মনে হলো আমার এবং শুধুই আমার এমনকিছু একটা আমার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে আর সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। এই ঝাপসা আভাস পাশ কাটিয়ে দারোয়ান বলল আরেক কথা। তুমি নাকি এই বিয়েতে রাজি না। তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। এ কথা শুনে আমার মনের অবস্থা আরও খারাপ হলো। তুমি একজনকে ভালোবাসো অথচ আমি বুঝতেই পারলাম না। মনের অগোচরেই জানতে চাইলাম কাকে ভালোবাসো। দারোয়ান বলল তুমি নাকি কিছুতেই সেটা বলতে চাচ্ছ না।
এদিকে আমি পড়ে গেলাম মহাচিন্তায়। কাকে তুমি ভালোবাসতে পারো। অনেক ভেবেও কাউকে খুঁজে পেলাম না। কেউ থাকলে অন্তত আমার চোখ এড়িয়ে যেত না। হঠাৎ মনে হলো তুমি মনে হয় আমাকেই ভালোবাসো। আমি নিজেকে যতই আড়ালে রাখি না কেন তুমি কোনো এক ফাঁকে আমাকে দেখে নিয়েছ। এমনও হতে পারে তুমি সবসময়ই আমায় দেখেছ আর বুঝতে পেরে গিয়েছ যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এমনটা হতেও তো পারে। আস্তে আস্তে আমার হালকা বিশ্বাস দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হলো যে, তুমি আমাকেই ভালোবাসো। এখন শুধু নিজের মুখে বলা বাকি।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তোমার বাবার সামনে। তার পাশে দাঁড়ানো তোমার মা আমায় দেখছিলেন। তারা তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আর মনে মনে আমায় পিষে ফেলার অঙ্ক কষছিলেন। কে একজন বলল তুমি দরজা বন্ধ করে বসে আছ, কিছুতেই আসবে না। তোমার বাবার মনে হলো আমার কথাই সত্যি। আমিই সেই ছেলে যাকে তুমি ভালোবাসো। আর আমি তো আগেই এসে বলেছি যে, আমিই সেই ছেলে। আমায় দেখে তোমার বাবা হতাশ হলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল উনি সমস্ত রাগ ক্ষোভ গিলে ফেলতে চাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না। আর আমার চিন্তা ছিল অন্য। আমি ভাবছিলাম তুমি কেন এলে না তা নিয়ে। যদি তুমি আসতে আর বলতে যে, আমিই সে যাকে তুমি ভালোবাসো! তোমার বাবা সহজ একটা রাস্তা ধরলেন। আমাকে যেন এক দেখায়ই উনি পড়ে নিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি গরিব, ছোটলোক। বললেন যে, চাইলেই উনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। আমায় পুলিশে দিতে পারেন। সরকারি দলের মোটামুটি প্রভাবশালী নেতা উনি। বুঝতে পারছিলাম যে, কিছু একটা হতে যাচ্ছে আমার সাথে এবং তা অবশ্যই ভালো কিছু না। কিন্তু উনি কিছুই করলেন না। আমায় বললেন চুপচাপ চলে যেতে আর বিনিময়ে অনেক অনেক টাকা দিতে চাইলেন। তখন মনে হলো উনি বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেব। আমিও নায়কের মতো করে বলতে চাইলাম যে, চৌধুরী সাহেব আমি গরিব হতে পারি কিন্তু আমার ভালোবাসা বিক্রির জন্য নয়। কিছুই বললাম না। উলটো অনেক অনেক টাকা নিয়ে শহর ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে গেলাম।
সত্যি বলতে আমার কোনোদিন এত এত টাকা ছিল না। তাই ভেবেছিলাম টাকা পেয়ে হয়তো তোমার কথা আর মনে থাকবে না। কিন্তু কিছুতেই তোমাকে ভুলতে পারলাম না। অনেক মেয়ের সাথে ঘুরলাম, ফিরলাম, বিছানায় গেলাম, কেউই তোমায় ভুলাতে পারল না। লিটার লিটার মদ খেলাম, সবচেয়ে দামি সিডেটিভ নিয়ে ঘুমালাম কিন্তু ঘুমের ভেতর স্বপ্নেও সেই তুমিই। কিন্তু হয় কি, প্রেম ধীরে মুছে যায় যেমন করে নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়। এটা বলেছিলেন জীবনানন্দ। আমিও যেন তোমায় ভুলে গিয়েছিলাম।
একদিন তোমার বাবার দেওয়া টাকা প্রায় শেষ হয়ে এলো। সব টাকা শেষ হয়ে গেলে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আয়-রোজগারেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ভাবলাম তোমার বাবার কাছে গিয়ে আরও কিছু টাকা নিয়ে আসি। ফিরে এলাম আমার পুরোনো শহরে। শহর আর আগের মতো নেই। মানুষ সব আগের মতো নেই। খেয়াল করলাম শহরের কাঠ-পাথরে আর ধুলো-ময়লায় একরকম অস্বস্তি। মানুষদের চোখে-মুখে জামা-কাপড়ে একরকম ক্ষোভ আর ঘৃণার আগুন। শুনলাম এসব অস্বস্তি আর আগুন বেরিয়ে এসেছে। ভাবলাম, ঠিকই তো, মানুষ আর কত বৈষম্য মেনে নেবে! সরকার আর তার লোকজনরাই কেন মানুষ, আমরা বাকিরা কেন ইতর প্রাণীবিশেষ। আমাদের কেন কোনো মতামত নেই, থাকলেও কেন তার মূল্য নেই। রাষ্ট্র কেন আমায় জীবিকার একটা ব্যবস্থা করার সুযোগ দিল না। কেনই-বা আমায় টাকার জন্য এভাবে তোমার বাবার কাছে যাওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। আমি তো আমি নই, আমি হচ্ছি আমরা। আমাদের কোনো চাওয়া বা পাওয়া নেই। যদি থাকে তা তোমার বা তোমাদের শ্রেণির মানুষদের কাছে। রাষ্ট্র আমাদের এমনতর করে রাখল যে, আমাদের ঈশ্বরও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখন সময় এসেছে সেই ঈশ্বরের পাঁজর ভেঙে দেয়ার। আমি মানুষের সাথে রাস্তায় নামি, দাঁড়িয়ে থাকি, স্লোগান দিই, মানুষের সাথে সুর করে দেশের গান গাই।
টাকার কথাও ভুলি না। তোমার বাবার রাজনীতি করে কামানো এত এত অবৈধ টাকা, এসব তো আমাদেরই। আমাদের টাকা থেকেই না হয় আমাকে কিছু দিলো। তুমুল ঝড়ের এসব দিনে একবার সুযোগ বুঝে গেলাম। কিন্তু তোমার বাবা টাকা দেওয়া তো দূরের কথা আমায় চরমতম অপমান করলেন। তিনি বললেন যে, আমি একটা ভুয়া। আমি কখনোই তোমার ভালোবাসার কেউ ছিলাম না। আরও বললেন যে, তোমার বিয়ে তার সাথেই দেওয়া হয়েছে যাকে তুমি ভালোবাসো। উনি নাকি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলেন না এত বড় প্রতারণা করার পর আবার কোন সাহসে উনার সামনে গিয়েছি। তোমার মা-ও আমায় যা ইচ্ছা বললেন। এসব পাত্তা না দিয়ে আমি ঠান্ডা মাথায় বললাম, অল্প কিছু টাকা দিলেই আমি আর সামনে যাব না। রাগে উনাদের চোখ থেকে সমস্ত ঘৃণা বেরিয়ে আসতে চাইলো। আমায় বসিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে কয়েকজন ষণ্ডামার্কা লোক এসে আমায় টানতে টানতে বের করে নিয়ে এলো। বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম তুমি তোমার স্বামীর সাথে গেট দিয়ে ঢুকছ। তোমায় দেখার সাথে সাথে আমার দম আটকে গেল। বরাবরের মতো তুমি কোনো দিকেই না তাকিয়ে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলে। আমি কখনোই তোমার চোখে পড়ব না এই আমি চেয়েছিলাম, একমাত্র এই আমি পেয়েছিলাম। লোকগুলো বাইরে বের করে আমায় প্রচণ্ড মারল। আমি ভেবেছিলাম মেরে ফেলবে। কিন্তু পারল না। আন্দোলনকারীদের একটা মিছিল যাচ্ছিল। তারা আমায় ছিনিয়ে নিল। ষণ্ডা টাইপের লোকগুলো পালটা মার খেয়ে পালাল।
সেদিন তোমায় দেখার পর থেকে আমার আর কিছুই ভালো লাগত না। মনের আর দেহের ভেতর কি যে হতো তা বুঝাতে পারব না। এইসব আন্দোলন, সংগ্রাম, রাষ্ট্র সবকিছু একপাশ হয়ে গেল। নিউমার্কেটের একটা সস্তা হোটেলে সবচেয়ে সস্তা রুমটা নিয়ে তার ভেতর পড়ে থাকলাম। সারাদিন শুধু তোমার কথা ভাবতাম। আমার সেইসব দিনের কথা মনে পড়ত যখন আমি জানতাম যে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে তোমায় ভালোবাসে আর তুমি আমাকে ভালো না বেসে থাকলেও তোমার মনে কেউই ছিল না। এসব কিছু ছাপিয়ে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ত তোমার বাবা-মায়ের কথা। সেদিনের সেই অপমানের কথা। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তাদের এই আচরণের পেছনে ছিল আমার দরিদ্রতা আর অক্ষমতা। আসলে প্রথমবার টাকা নিয়েই আমি এই পরিস্থিতি তৈরি করেছিলাম। উনারা বুঝে নিয়েছিলেন যে, আমার মতো মানুষজন আসলে বিক্রির জন্য। এই সমাজের দুটো দিক সেদিন দেখে নিয়েছিলাম। একদিকে আমি আর অন্যদিকে তোমার বাবা-মা। এই দুইয়ের মাঝখানে থাকা যে দূরত্ব তা অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার সৃষ্টি এক উদ্বায়ী রেখা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি রাস্তায় নামলে আমার মতো অক্ষম হাজার হাজার মানুষকে দেখতাম। সেদিনের আমার প্রতি তোমার বাবা-মায়ের যে ঘৃণা আর অবজ্ঞাভরা দৃষ্টি তা যেন এদের সবার জন্যই। সেই দৃষ্টি আমায় আর ঘুমাতে দিল না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আগেরবারের মতো এই শহর ছেড়ে বহুদূর চলে যাবো।
শহর থেকে আর দূরে যাওয়া হলো না আমার। যেদিন যাব সেদিনই জনতার বুকের ভেতরের সমস্ত আগুন বের হয়ে শহর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। আর রাষ্ট্র চাইছিল রক্তের স্রোতে সেই আগুন নিভিয়ে দিতে। দেখলাম বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা কপালে পতাকা বেঁধে কি অসীম সাহস নিয়ে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই বুকে তপ্ত গরম সীসা ছুড়ে দিচ্ছে পুলিশ আর সরকারের গুন্ডারা। একজন পড়ে যাচ্ছে তো পেছন থেকে হাজারজন গর্জে তেড়ে আসছে। সবাই কেমন যেন এক মায়ার ভেতর, সম্মোহনের ভেতর পড়ে গিয়েছে। আমি একটা ব্যাকপ্যাক কাঁধে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু এই মায়া, এই সম্মোহন আমাকেও টেনে নিল। এদের মাঝে হঠাৎ আমাকে দেখতে পেলাম। আমার হাতে পাথর। পাথর হাতে আমি ছুটছি। আমার সাথে ছুটছে হাজারো মানুষ। আমরা সবাই বৈষম্যের অবসান চাই। আমাদের এই যুদ্ধ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আমার মনে হলো এই যুদ্ধ তোমার বাবা আর তাদের মতো মানুষদের বিরুদ্ধে যারা এই দেশকে খেয়ে খেয়ে ক্ষয় করে দিয়েছে। ক্ষয়ে যাওয়া এই দেশের প্রতি আমার খুব ভালোবাসা জাগে। সেই ভালোবাসা পরিণত হয় স্বৈরাচারী শাসকদের প্রতি ঘৃণায়। সব ঘৃণা হাতের পাথরে গিয়ে জমা হয়। সর্বশক্তি দিয়ে সেই পাথর ছুড়ে দিই। তারপর আরেকটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটতে থাকি। এক সময় দেখি আমার সামনের সবাই একে একে পড়ে যাচ্ছে আর তাদের রক্তে কালো কালো রাস্তা লাল লাল হয়ে যাচ্ছে। সেই লাল হয়ে যাওয়া রাস্তায় আমিও পড়ে যাই। আমার শরীরে কয়েকটা সুঁই ফোটানোর মতো ব্যথা হয়। সেই ব্যথা বাড়তে বাড়তে আমায় ধাক্কা মেরে কেমন একটা অন্ধকার পুকুরে ফেলে দেয়।
যেদিন চোখ মেলে তাকালাম সেদিন কানেও শুনতে পেলাম। দেখলাম হাসপাতালের বারান্দায় একটা নোংরা বেডে শুয়ে আছি আর শুনলাম স্বৈরাচার তার দলবল নিয়ে পালিয়েছে। খুব আনন্দ হলো। ইচ্ছে হলো জোরে একটা চিৎকার দেই। অতিরিক্ত খুশিতে সারা শরীরে টান পড়ল। হাত দিয়ে দেখলাম শরীরের জায়গায় জায়গায় ব্যান্ডেজে প্যাঁচানো। সাদা ড্রেস পরা একজন হইহই করে এলো। ব্যান্ডেজে হাত দিতে মানা করল। ভেতরের দুটা গুলি এখনো বের করা যায়নি। আমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। আত্মীয় স্বজনের ফোন নাম্বার চাইলো। কিছুই বলতে পারলাম না। এর মধ্যে একদিন মনে হলো কাউকে চিঠি লিখি। কেন বা কীভাবে মনে হলো তা তো আগেই বলেছি। কিন্তু কাগজকলম দেওয়ার মতো কাউকে পেলাম না। আন্দোলনে যারা আহত তাদের দেখার জন্য একদিন কারা জানি এলো। আমার দিকে কেউ দৃষ্টি দিলো না। বিকেলের দিকে এক ছোকরা ডাক্তার এসে জানতে চাইল আমার কিছু লাগবে কি না। আমি অনেক কষ্ট করে কাগজ আর কলম চাইলাম। সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।
এক জীবনে তেমন কিছুই করা হয়নি তাই কোনো অনুশোচনাও নেই। তবে তোমার কাছে একটা বিষয় স্বীকার না করলেই নয়। মনে আছে একবার বন্ধুবান্ধব নিয়ে নৌকায় ঘুরতে গিয়েছিলে? আমি সেদিন পাশের আরেকটা নৌকায় ছিলাম। বলাই বাহুল্য যে তোমাকে দেখব বলে গিয়েছিলাম। সবাই মিলে অনেক মজা করছিলে। কিছুদূর যাওয়ার পর তোমাদের নৌকাটা উলটে গেল। আমার চোখ ছিল তোমার দিকে। আমি কোনোকিছুই চিন্তা না করে নদীতে ঝাঁপ দিলাম। পানির মধ্যে অনেক খুঁজে শেষে তোমাকে পেলাম। তুমি জ্ঞান হারিয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছ। তোমায় টেনে ওপরের দিকে তুলছিলাম। এ সময় কি জানি হলো আমার। পানির ওপরে উঠার ঠিক আগ মুহূর্তে পৃথিবীর সব ভালোবাসা এক করে তোমার ঠোঁটে একটা ছোট চুমু খেলাম।
আমি জানি এসব জেনে আমার প্রতি তোমার তীব্র ঘৃণা হচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। আমি তারই যোগ্য। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেদিনের সেই চুমু খাওয়ার সময় তোমার জন্য যেটুকু ভালোবাসা আমার হৃদয়ে ছিল এখনও তাই আছে। এখনও আমি তোমায় ততটুকুই ভালোবাসি। কিছুদিন আগে অবশ্য টের পেয়েছি যে, আমি আমার দেশকেও ভালোবাসি। হাসপাতালের এই বারান্দায় মাথায় বুলেট নিয়ে নোংরা আর দুর্গন্ধমাখা বিছানায় শুয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা একধরনের বোকামি। আবার মনে হয়, দেশের প্রতি যে ভালোবাসা সেটা বোকামি। হতে পারে, দুটোই বোকামি। হতে পারে, ভালোবাসা মাত্রই বোকামি।
ভালো থেকো।
ইতি তোমারই
.. .. ..