আলি নদভির সাহিত্যচিন্তা

কাজী একরাম

আলি নদভি এক বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যগত মাত্রা যার অন্যতম। বলা যায়, পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি এই সম্পদ লাভ করেন। তদুপরি তা তার ব্যক্তিগত বিনিয়োগে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অধ্যয়ন ও জ্ঞান-সাধনায় হয়ে ওঠে অনন্য। যেমন একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রাচীন রাজপুরুষ ও উলামাদের রীতি অনুসরণে এবং বিশেষ কিছু কারণে আমাদের বাড়িতে একটি বিশাল পারিবারিক গ্রন্থাগার ছিল। দাদা ও আব্বাজান দুজনেই ছিলেন মহান লেখক। এই গ্রন্থাগারে আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষার হাজার হাজার কিতাব ছিল… এই অধ্যয়ন ও জ্ঞানীয় পারিপার্শ্বিকতার সুবাদে মিশর ও সিরিয়ার লেখক, কবি-সাহিত্যিক এবং পণ্ডিত চিন্তকদের ব্যাপারে এতটাই ওয়াকিবহাল হয়ে উঠি, ভারতের লেখক, সমালোচক এবং চিন্তাবিদদের সাথে যতটা পরিচিত ছিলাম। বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে সেই সময়ে এই বিদেশি লেখক-বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে বরং অধিক অবগত ছিলাম। আমরা অকপটে তাদের সবলতা-দুর্বলতা ও মানসিক অবক্ষয় সম্পর্কে মন্তব্য করতাম এবং লেখক-বুদ্ধিজীবী হিসেবে কার মর্যাদা কতটুকু, কে কোন স্তরের তা নির্ধারণ করতাম। এদের মধ্যে আমার পক্ষে কাউকে তেমন চিত্তাকর্ষক ব্যক্তিত্ব মনে হয়নি, আর না নতুন কোনো বাস্তবতার উন্মোচন হয়েছে আমার সামনে।’ যাই হোক, বর্তমান নিবন্ধে আলি নদভির সাহিত্য অধ্যয়ন, তাঁর সাহিত্যকর্মের গুণাগুণ কিংবা রচনাশৈলীর সৌন্দর্য-বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি নিয়ে নয়, আলোকপাত করতে চেষ্টা করব তাঁর সাহিত্যচিন্তা বিষয়ে; সাহিত্যের ইসলামি পুনর্গঠনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে। 

আলি নদভি সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ করেন বিধায় এর থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও পরিণতি সম্পর্কে, এর অন্তর্নিহিত প্রভাব সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন; তিনি বুঝতে পারেন, তথাকথিত এই প্রগতিশীল লেখক-সাহিত্যিকদের যদি নিশ্চিন্ত ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে তা ইসলামি চিন্তা ও ভাবধারার পক্ষে অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বস্তুত, এই আশঙ্কা বাস্তব হয়ে সামনে হাজিরও হচ্ছিল ইতিমধ্যে। নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম এদের লেখন-শৈলীর অনুরাগী ছিল, ফলে এর সাথে লেখার সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতিও তার মন ও মননে গ্রথিত হচ্ছিল। ইসলামি শিক্ষার প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছিল এবং ফিকরি ইরতিদাদ তথা বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্মত্যাগ দ্রুতই বাস্তবিক ধর্মত্যাগের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সাহিত্যবাহিত এই সংকট নির্ণয়ের পর আলি নদভি একই পথ্য গ্রহণ করেন এবং ভাষা ও সাহিত্যের এই শক্তি দিয়ে তিনি ইসলামি চিন্তার বিষয়ে এমন লিটারেচার প্রণয়নে সচেষ্ট হন, যা তরুণদের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে এবং এর মাধ্যমে তাদের সাহিত্যরুচি এবং দ্বীনি ও ফিকরি খোরাকও সরবরাহ করতে পারে। দ্বীন ও সাহিত্যের সমন্বয়প্রয়াসী এ ধরনের আধুনিক লিটারেচার সম্পর্কে আরব দুনিয়া তখনও অনেকটাই অনবগত, যার মধ্যে হৃদয়কে আকর্ষিত করার এবং মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করার সমান সামর্থ্য রয়েছে। সেখানে হয় নিরেট ইলমুল কালাম বা ফিকহের বিষয়ের উপর প্রাচীন ইলমি ভাষার বইপুস্তক পাওয়া যেত, যেগুলি থেকে নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম অনীহ ও বিরক্ত হয়ে পড়েছিল, নতুবা ছিল মিশরের দ্বীন-বিরূপ আধুনিক প্রগতিশীল সাহিত্য ও সমালোচনা-সাহিত্যের সয়লাব, যার উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছিল নবপ্রজন্মের ইমান-ইসলাম। 

এ প্রসঙ্গে স্বয়ং তাঁর জবানবন্দি শোনা যাক : ‘আমার অধ্যাপনা এবং অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততার কালেও এবং আমার রচনা ও লেখালেখির পরিসরেও, সর্বদাই এই বাস্তবতার উপলব্ধি ছিল যে, সাহিত্য নিজের ভেতর মহান গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক শক্তি ধারণ করে, একদিকে এটিকে সঠিক বিশ্বাসের স্থিতি এবং সুস্থ ও উপকারী ভাব-প্রবণতা গড়ে তুলতে ব্যবহার করা যেতে পারে, অন্যদিকে, নৈতিক মানবিক মূল্যবোধের অবনমন এবং মানসিক ও সামাজিক বিকার ও বিশৃঙ্খলার জন্যও কাজ লাগানো যেতে পারে। প্রতিটি যুগেই রয়েছে এর স্পষ্ট ও অনস্বীকার্য সাক্ষ্য-প্রমাণ। কিন্তু এই যুগে সাহিত্যের (এর ব্যাপক অর্থে) আধুনিক ও শক্তিশালী উপকরণের আবির্ভাবের কারণে বৈশ্বিকতা ও কর্তৃত্বশীলতা অনেক বেড়ে গেছে। বহুকাল ধরে দেখা যাচ্ছে যে, দর্শনের পথ বেয়ে মুসলমানদের জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিতে নাস্তিকতা ও সংশয়বাদের বন্যা অনুপ্রবেশ করত, তার পর তা বিজ্ঞানের (বিশেষত পদার্থবিজ্ঞান) পথ বেয়ে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। কোথাও কোথাও মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির পথ ধরে আসত, এখন তা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৌদ্ধিক কেন্দ্রে সাহিত্যের হাত ধরে আসছে। এ বাস্তবতা বিশেষ করে ইসলামী চিন্তা ও দাওয়াহর ধারকদের জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল যেহেতু, আরবে, বিশেষ করে মিশরে প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল ধরে তরুণদের মানসিক ও সাহিত্যিক খোরাক জোগানোর ক্ষেত্রে সেসব লেখক-সাহিত্যিকদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম হয়ে যায়, যাদের বিশ্বাসে ছিল অস্থিরতা, মন-মানসে বিশৃঙ্খলা এবং লেখনীতে সন্দেহবাদী প্রবণতা, কাজেই একদিকে আরবি সাহিত্যের সমৃদ্ধ সম্ভার থেকে সেসব শক্তিশালী ও চিত্তাকর্ষক সাহিত্যিক নমুনা বের করে সেগুলো তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল, যেগুলো সুবিধার কারণে এবং সাহিত্যের প্রাচীন ঐতিহাসিকদের অনুসরণে না বুঝেই উপেক্ষা করা হয়েছে, অথবা এই দোষে যে, সেগুলো কোনো আলেম, দাঈ বা কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের কলম থেকে এসেছে, সে-সমস্তকে সাহিত্যের রাজপ্রাসাদ থেকে নির্বাসন বা দূরে অপসারণের শাস্তি দেওয়া হয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকচক্ষুর অন্তরাল হয়ে আছে। অন্যদিকে প্রয়োজন ছিল আরবি সাহিত্যের এমন উস্তাদ, লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করা, যারা আরবি সাহিত্য ও রচনা ও সমালোচনা-সাহিত্যের ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন এবং আধুনিক প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ গ্রন্থসম্ভার এবং একটি নতুন চিন্তাধারা (মাকতাবে খেয়াল) তৈরি করা যেতে পারবেন।[1]কারওয়ানে জিন্দেগি, আবুল হাসান আলী নদভী, খণ্ড, ২, পৃ. ৩২৮।

এই চিন্তা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরে, ১৯৫৭ সালে দামেশকের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য একাডেমি ‘মাজমা’উল-লুগাহ আল-আরাবিয়া’র সদস্যপদ প্রাপ্তি উপলক্ষ্যে আলি নদভি একটি নিবন্ধ[2]নিবন্ধটি বর্তমানে ‘মুখতারাত মিন আদাবিল আরব’ এর স্বতন্ত্র ভূমিকা হিসেবে … Continue reading  রচনা করেন, তাতে তিনি পূর্ণ জোর দিয়ে প্রথমবারের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রশস্ত করার আহ্বান জানান। উক্ত প্রবন্ধের শুরুতে, আলি নদভি লেখেন : “আরবি সাহিত্য বর্তমানে এক মহা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি সাহিত্যকে এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই পরীক্ষা কখনো সংক্ষিপ্ত হয়, কখনো দীর্ঘ, এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, নতুন চেতনা এবং সংস্কার আন্দোলনের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। এই পরীক্ষা ঐতিহ্যবাদী এবং প্রগতিশীল লেখকদের সাহিত্যের উপর একচেটিয়াপনার আকারে সম্মুখে হাজির; যারা সাহিত্যকে পেশা হিসেবে নেয় এবং নিজেদের মতলবসিদ্ধির জন্য এবং প্রভাববিস্তারের জন্য ব্যবহার করতে থাকে একপর্যায়ে সাহিত্য তাদের ঘরনায় বন্দি হয়ে যায় এবং তারপর এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, এই বিশেষ শ্রেণির পক্ষ থেকে স্থিরকৃত যে সাহিত্য প্রসবিত হয়, তাকেই কেবল সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে না আত্মা থাকে, না শক্তিমত্তা, না অভিনবত্ব, না রসময়তা। এ যেন কৃত্রিম শব্দবাক্যের সমষ্টি; যাতে কোনো সতেজতা বা স্বাদ নেই। এই প্রগতিশীল সাহিত্যের এমন একটা বেড়াজাল আছে যে, অন্য শ্রেণি থেকে যত শক্তিশালী গদ্য বা কবিতা বের হোক না কেন, সেটাকে সাহিত্য বলে ধরা হয় না।”[3]মুখতারাত মিন আদাবিল আরব, ভূমিকা ১ম খণ্ড।

নিবন্ধটির প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে আলি নদভি তাঁর ‘কারওয়ানে জিন্দেগি’তে উল্লেখ করেন, ‘সাহিত্যের উচ্চস্তরের কতিপয় ব্যক্তিত্ব স্বীকার করেছেন যে, নিবন্ধটি তাদের জন্য চিন্তার উদ্রেককারী প্রমাণিত হয়েছে এবং এটি তাদের মধ্যে ইসলামি সাহিত্যের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।’[4]কারওয়ানে জিন্দেগি, খণ্ড ২, পৃ.৩২৯।  যেমন বিখ্যাত আরব লেখক ও কবি শায়খ আবদুল আজিজ রিফাঈ লিখেন: আমি কা’ব বিন মালিকের আলোচনা বহুবার পড়েছি, আমি তাঁর মহত্ত্বের প্রবক্তা এবং তাঁর মহানুভবতা, তাঁর সততা ও স্পষ্টবাদিতাকে একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে মনে করেছি। তবে তিনি যে একজন সাহিত্যিক ছিলেন অথবা তাঁর গদ্যের একটি সাহিত্যিক স্থান ছিল, এর প্রতি আমার কখনো লক্ষপাত হয়নি। কিন্তু শ্রদ্ধেয় শায়খ আবুল-হাসান আলী নদভি তাঁর নিজের মৌখিক বর্ণনা থেকে তাঁর দীর্ঘ কাহিনি উদ্ধৃত করে আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছেন এবং প্রথমবারের মতো আমি জানতে পেরেছি যে, কাব বিন মালিক রা.-এর কাহিনি একটি মহান সাহিত্যিক ঐতিহ্য।’[5]আফকার ওয়া আসার, ডক্টর সাউদ আলম কাসেমি, পৃ. ৪০৯।

আলি নদভি তার এই সাহিত্যচিন্তাকে ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে তৎপর হন। একে আন্দোলনের রূপ দেওয়ার জন্য এক বৈশ্বিক সেমিনারের প্রয়োজন অনুভব করেন যাতে আরব দেশগুলো এবং সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের শিক্ষকগণ অংশগ্রহণ করবেন এবং প্রবন্ধপাঠ ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবেন। ১৭-১৯ এপ্রিল, ১৯৮১ তারিখে, দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় এই আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজিত হয়, যার বিষয় ছিল ‘আরবি সাহিত্যে বিশেষ করে এবং সাধারণভাবে অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে ইসলামী উপাদানের তত্ত্বতালাশ’। নদভি বলেন, প্রত্যাশা ও ধারণার চেয়েও বেশি, এই আহ্বান ও আন্দোলন আরব দেশগুলি দ্বারা স্বাগত হয়েছিল এবং এতে অংশ নিতে বিভিন্ন আরব দেশের বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং সাহিত্যিকগণ লখনৌতে আগমন করেন, যার মধ্যে বর্তমান সময়ের অনেক শীর্ষস্থানীয় লেখক, কলা অনুষদের ডিন এবং কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ শামিল ছিলেন।[6]কারওয়ানে জিন্দেগি, খণ্ড ২, পৃ. ৩৩০।  এই সেমিনারে আলি নদভি সভাপতির বক্তব্যে অসামান্য অর্থগর্ভ আলোচনা পেশ করেন, যাতে তিনি হিন্দুস্তানি আলিম ও পণ্ডিতদের সাহিত্যজ্ঞানই নয়, ঐতিহাসিক রেফারেন্সের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন সাহিত্যক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বকেও। সেমিনারের সমাপনী বক্তৃতায় অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত আন্দাজে তিনি প্রচলিত সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্যধারণার অসারতার বিপরীতে তাঁর সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বলেন : 

“সাহিত্যের কোনো জাতীয়তা নেই, দেশ নেই, লিঙ্গ নেই এবং এটি বিশেষ পদ-পরিচয় বা বিশেষ বিধিবিধানে আবদ্ধ নয়, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, স্বয়ং সাহিত্যিকরা যারা নিজেদের জীবন সাহিত্যের জন্য উৎসর্গ করেছেন এবং নিজেদের সেরা প্রতিভাকে এর জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছেন, সেই তারাও সাহিত্যের সমুদ্রকে কল্পনা করেন একটি অঞ্জলির জল।… আনুষ্ঠানিকতার প্রতি সবচেয়ে বেপরোয়া হলো সাহিত্য। অমুক ইউনিফর্ম পরে আসতে হবে, তমুক ভাষায় বলতে হবে—সাহিত্যের কাছে এ ধরনের দাবি মঞ্জুর নয়। সে যেখানেই থাকুক, সাহিত্য, ছেঁড়া পুরানো কাপড় পরেও সেটি সাহিত্যই এবং সমাদরযোগ্য। রাজার পোশাক পরেও নিজেকে যথাযথরূপে প্রকাশ করার দক্ষতা যদি না থাকে, তবে তা সাহিত্য নয়। সাহিত্য এজন্য সাহিত্য হয়ে যায় না যে তা এক ইংরেজি-জানা লোক বলেছেন, এক প্রগতিশীল লেখক লিখেছেন! সাহিত্য, যে আকারেই হোক, যে ভাষায়ই হোক এবং যার দ্বারা সম্পাদিত হোক, তা সাহিত্য। … তিনি আরও বলেন, সাহিত্য সাহিত্যই, তা কোনো ধার্মিকজনের মুখ থেকে নির্গত হোক, বা কোনো নবির যবান থেকে নিঃসৃত হোক কিংবা কোনো ঐশ্বরিক কিতাবের মধ্যে থাকুক। এর জন্য শর্ত কেবল এই যে, বলা কথাটি এমনভাবে বলা, যা হৃদয়কে প্রভাবিত করে, কথক এই ভেবে সন্তুষ্ট হন যে আমি উত্তমরূপে বলেছি, আর শ্রোতা-পাঠক তা উপভোগ করে এবং গ্রহণ করে নেয়।… সৌন্দর্যপ্রীতি হলো সৌন্দর্যকে ভালোবাসা, তা যে রূপেই হোক। বুলবুলকে এই ফুলে বসতে, ঐ ফুলে না বসতে বাধ্য করা যায় না। এ কোন ধরনের সৌন্দর্যবোধ এবং কোথাকার সুবিবেচনা যে, পানশালার আঙিনায় যদি গোলাপ ফুটে, তবে তা গোলাপ এবং উপভোগযোগ্য, পক্ষান্তরে কোনো মসজিদের প্রাঙ্গণে ফুটলে এর কোনো সৌন্দর্য নেই। ফুলটি তার রূপ-প্রদর্শনী ও দীপ্তি-বিস্তারের জন্য মসজিদকে অবলম্বন করেছে—এই কি তার অপরাধ?[7]দ্বীন ওয়া আদব, সাইয়িদ মুহাম্মদ রাবে হাসানী নদভি, পৃ. ৩৮-৩৯।

আলি নদভি বৈশ্বিক স্তরে ইসলামি সাহিত্য ধারণার পথিকৃৎ ও অগ্রদূত হয়ে আবির্ভূত হন, শুধুমাত্র তাঁর প্রচেষ্টায়, ‘আলমী রাবেতায়ে আদবে ইসলামী’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যেটি বিশ্বজনীনতাকে তার মূলমন্ত্র বানিয়ে ইসলামী সাহিত্যের সাথে ইসলামি বিশ্বকে পরিচিত করে এবং সকল সাহিত্য অঙ্গনে এর প্রবর্তন করে। এর পর ইসলামপছন্দ লেখকদের একটি দল এগিয়ে এসে রাবেতার এই সর্বজনীন চিন্তাকে গ্রহণ করেন, যার ফলে ভাষা-বয়ান, সাহিত্যরচনা এবং উদ্দেশ্যমুখী লেখালেখির এক বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি হয়। তারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সাহিত্যিক দায়িত্ব পালন করে, ঈমান ও বিশ্বাসের আলোকবাহী রশ্মিপাতে জীবনকে উজ্জীবিত ও আলোকিত করতে শুরু করেন।

আলি নদভির মতে, যেমনটি আগেও বলা হয়েছে, সাহিত্য শক্তির একটি বড় উৎস, এই শক্তি মানুষের হৃদয় ও বুদ্ধিকে শাসন করে, তাই তিনি সাহিত্যকে তাঁর সকল ব্যাবহারিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম করে তোলেন। ইসলামের দাওয়াহ, উদ্দেশ্যমুখী মানবজীবন, বিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব ও সুস্থ চরিত্র নির্মাণে তিনি তাঁর সাহিত্যিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানবিক সৌভাগ্যের সেই সেতু নির্মাণ করেন, যা থেকে আজকের মানুষ বঞ্চিত। এই মহান লক্ষ্য পূরণের পথে, তিনি সাহিত্যের সারসত্যকে পরিমার্জিত করার এবং তা দিয়ে জীবনকে সুশোভিত করার অতুলনীয় অভূতপূর্ব কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। সিরিয়ান বংশোদ্ভূত সুপরিচিত সাহিত্যিক শায়খ আলী তানতাভির স্বীকারোক্তি দেখুন, ‘ভাই আবুল হাসান! আমি সাহিত্যের প্রতি আমার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম কারণ, সাহিত্যিকদের লেখায় সেই স্বর্গীয় সুরলহরী আমি দেখতে পাই না, যা এর প্রাণসত্তা। তবে আমি আপনার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে, আপনি সাহিত্যের প্রতি আমার বিশ্বাসকে পুনর্বহাল করে দিয়েছেন।’ একইভাবে রাবেতায়ে আদবে ইসলামী’র একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও প্রথিতযশা সাহিত্যিক ডক্টর আবদুল বাসিত বদর আপন অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তি তুলে ধরে লিখেছেন :

“১৪০১ হিজরিতে, আমি লখনৌ শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সমিতির প্রথম সভায় যোগদানের সম্মান লাভ করেছি। এই উপলক্ষ্যে আবুল হাসান আলি নদভির বিশেষ মজলিসগুলিতে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই সময় আমি তাঁর সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বে অনেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করি। আরবি সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর চিন্তা আর মতামত শোনার সুযোগ হয়। তাঁর উচ্চ দৃষ্টি এবং সমস্যাবলি সম্পর্কে অবগতি আমাদের অবাক করেছে দারুণভাবে। তাঁর কথোপকথনের বিষয়বস্তু ছিল পাশ্চাত্যগ্রস্ত আরবি সাহিত্য, যেটি বহুকাল ধরেই প্রাচ্যের দেশগুলোতে ছেয়ে আছে। সেদিন আমি ও শ্রোতারা বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই সাহিত্যিক তাঁর লেখালেখি ও কথোপকথনে ইসলামী সাহিত্যের বিশেষ রংটি ছড়িয়ে দেন, এখানে বসেই আরবি ভাষার প্রত্যন্ত মরূদ্যানের আরবি মূলধন রক্ষার কাজ করছেন।”

ডক্টর আবদুল বাসিত আরও লিখেন, ‘এই মহান দায়িত্বগুলি কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই পালন করতে পারেন যিনি কালেমার মূল্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন এবং মানবজীবনে ভাষা ও প্রকাশের মর্যাদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল… নিঃসন্দেহে আবুল হাসান আলী নদভীর মধ্যে একজন বিশ্বমানের ইসলামী সাহিত্যিকের সমূহ গুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তিনি আরবি, উর্দু এবং ফারসি ভাষায় বিশেষজ্ঞ। মহান আল্লাহ তাঁর মধ্যে এই সমুদয় গুণাবলি এজন্য একত্রিত করেছেন যাতে তিনি সেই কাফেলার নেতা হন, যার জন্য বিশ্ব অধীর বাসনায় অপেক্ষা করছে এবং যার ওপর ইসলামি-সাহিত্য গর্ব করতে পারবে। তিনি এমন সময় সাহিত্যের রক্ষক হয়ে কর্মক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছেন, যখন সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের স্লোগান উচ্চকিত করা হচ্ছিল এবং দ্বীনকে চিন্তা, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং জীবনের ব্যাবহারিক ক্ষেত্রগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছিল। তিনি ইমানি ফিরাসাতের আলোকে, জাতি, বর্ণ, ভাষা ও সাহিত্যের বৈষম্য ছাড়াই ইসলামি লেখক সাহিত্যিকদের প্রথম কনভেনশন আয়োজন করেন, যাতে হিন্দি, আরবি, তুর্কি এবং ইন্দোনেশিয়ান সাহিত্যের রথী-মহারথীরা একটি ঐক্যবদ্ধ সাহিত্য প্লাটফর্মে অ্যাকাডেমিক-সাহিত্যিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একত্রিত হন। আমার মতে, এটি ছিল ইসলামী জাতিগুলোর ইতিহাসে এর ধরনের বিচারে একটি অনন্য সম্মেলন। সাহিত্যিক সমিতির প্রতিষ্ঠা যদিও সমগ্র বিশ্বের জন্য নতুন বিষয় ছিল না, কিন্তু ‘রাবেতায়ে আদবে ইসলামী’ প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইসলামী লেখক-সাহিত্যিকদের এমন আন্তর্জাতিক সমিতির কথা জানা যায় না।’[8]দেখুন, আফকার ওয়া আসার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮১-৩৮৩।  

আলি নদভির এই সাহিত্যচিন্তা এবং বৈশ্বিক পরিসরে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন, সর্বোপরি তাঁর রচিত আরবি লিটারেচার ও সিলেবাসের প্রভাবে, আরবি সাহিত্য এবং সাহিত্যধারণা লাভ করে স্বাধীনতা ও প্রসারতা, আরবজগতের বিপুল সংখ্যক সাহিত্যিকবৃন্দের মধ্যে ঘটে শুভবোধের উন্মেষ। সাহিত্যে জমিদারি ফলানো প্রগতিশীল লেখকদের একচেটিয়া আধিপত্য অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং সাহিত্যের দিগন্তে ইসলাম-বিরুদ্ধ চেতনা, নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার যে অপচ্ছায়া জমে বসেছিল, তা ক্রমশ অপসারিত হতে শুরু করে। অনেক প্রগতিশীল লেখকের চিন্তাধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে এবং এমনকি তাদের মন-মনন হয়ে ওঠে ইসলাম-বান্ধব। 

সংক্ষেপে, আলি নদভির এই সাহিত্যচিন্তা ও সাহিত্যের সংস্কার-আন্দোলন দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করে। প্রথমত, নিরেট সাহিত্য রুচিসম্পন্ন লেখকদের মধ্যে ধর্মীয় ভাবধারা তৈরি করে, যাদের ধর্মের সাথে দূরতম সম্পর্কও ছিল না। দ্বীনকে তিনি এমন সাহিত্যিক অবয়বে উপস্থাপন করেন, সাহিত্য রুচিসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তি তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই! বলা বাহুল্য, সাধারণভাবে শিক্ষিত শ্রেণি সাহিত্য দ্বারা প্রাণিত হয় এবং এই মাধ্যমে যা কিছু উপস্থাপন করা হয়, তার প্রভাব থাকেই থাকে, এবং শিক্ষিত শ্রেণির হাতেই থাকে নেতৃত্ব, ফলে তারা যে চিন্তা ও ভাবধারা কবুল করে নেয়, সমাজ এর দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং জনসাধারণ্যে একটা ইতিবাচক ধর্মীয় পরিবর্তন সাধিত হয়। দ্বিতীয়ত, এতে করে নিরেট ধর্মীয় রুচিসম্পন্ন লোকদের মধ্যে সাহিত্যিক অভিরুচির বিকাশ ঘটে, ফলে তারা এর সদ্ব্যবহার করে তাদের দাওয়াহকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারে। কারণ, ‘দ্বীনের যে সকল দাঈ ও আলিমগণ তাদের দেশের ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করার এবং এর অভিরুচি গড়ে তালার সুযোগ পান না, তাদের দ্বীনের কার্যকরী দাওয়াত প্রদানে, দ্বীনি হাকায়েকের ব্যাখ্যা ও শিক্ষাদানে, এভাবে আধুনিক শিক্ষিতমনে দ্বীনি মাকাসিদ ও তাৎপর্য প্রোথিতকরণে অসুবিধা দেখা দেয় এবং তাদের রচনা ও লেখালেখিতে সেই শক্তি ও আবেদন থাকে না, এই যুগে যার প্রয়োজন।’

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 কারওয়ানে জিন্দেগি, আবুল হাসান আলী নদভী, খণ্ড, ২, পৃ. ৩২৮।
2 নিবন্ধটি বর্তমানে ‘মুখতারাত মিন আদাবিল আরব’ এর স্বতন্ত্র ভূমিকা হিসেবে মুদ্রিত।
3 মুখতারাত মিন আদাবিল আরব, ভূমিকা ১ম খণ্ড।
4 কারওয়ানে জিন্দেগি, খণ্ড ২, পৃ.৩২৯।
5 আফকার ওয়া আসার, ডক্টর সাউদ আলম কাসেমি, পৃ. ৪০৯।
6 কারওয়ানে জিন্দেগি, খণ্ড ২, পৃ. ৩৩০।
7 দ্বীন ওয়া আদব, সাইয়িদ মুহাম্মদ রাবে হাসানী নদভি, পৃ. ৩৮-৩৯।
8 দেখুন, আফকার ওয়া আসার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮১-৩৮৩।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷