আমাদের ভাষা আন্দোলন ও কবি ফররুখ আহমদ

সালাহউদ্দীন আইয়ূব

যোগাযোগ ডেস্ক

“ও আমার

মাতৃভাষা বাংলাভাষা

খোদার সেরা দান;

বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার

রূপ যে অনির্বাণ।

অনাদৃত একলা যখন

গভীর ব্যথায় ছিলে মগন

নিলে তোমায় বক্ষে তখন লক্ষ মুসলমান।”

—ফররুখ আহমদ

ফররুখ আহমদ মুসলিম রেনেসাঁর কবি। নজরুল-উত্তর বাংলা সাহিত্যের কাব্য- সম্ভার যে কজন শ্রেষ্ঠ কবির স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছে ফররুখ আহমদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ফররুখ আহমদ তাঁর কবিতায় যেমন নির্যাতিত মানুষের মুক্তি চেয়েছেন, তেমনি চেয়েছেন দুনিয়ার বুক থেকে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও অসাম্যের শেষ চিহ্ন মুছে ফেলতে। ফররুখ বিশ্বাস করতেন এক গভীর জীবনাদর্শে। যে জীবনাদর্শ স্বয়ং মহান রাব্বুর আলামীন প্রদত্ত। আর সেই জীবনাদর্শকে কেন্দ্র করেই ফররুখ সারা জীবন কাব্য সাধনা করে গেছেন। এ ব্যাপারে ফররুখ ছিলেন আপসহীন। তাঁর এই আপসহীন ভূমিকা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

ফররুখ আহমদ তাঁর বিশ্বাস ও আদর্শকে শুধু কবিতায়ই সীমাদ্ধ রাখেননি, বাস্তবেও অনুসরণ করে গেছেন। এখানেই চল্লিশ দশকের অন্যান্য কবির সঙ্গে ফররুখের পার্থক্য। এক্ষেত্রে তিনি নজরুলকেও অতিক্রম করে গেছেন। নজরুল-কাব্যে ইসলামী ভাবধারা যত দৃঢ়ভাবে ফুটে উঠেছে সেভাবে ব্যক্তিজীবনে তিনি ইসলামকে অনুসরণ করতে পারেননি অথবা ব্যর্থ হয়েছেন। কবিতায় ও বাস্তবে একই আদর্শের অনুসরণ শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও দুর্লভ। বাংলা সাহিত্যে এক্ষেত্রে ফররুখের সঙ্গে একমাত্র সুকান্তের তুলনা চলে। যদিও আদর্শগতভাবে ফররুখ ও সুকান্তের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। কিন্তু বিশ্বাস ও আদর্শের অনুসরণ ও বাস্তবায়নে দুজনই ছিলেন আপসহীন। বিশ্বসাহিত্যে এ সারিতে রুশ কবি মায়াকোভস্কি ও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কবি বেঞ্জামিন মোলেসের নাম উল্লেখ করা যায়। আপসহীনতার কারণে এদের দুজনকেই নির্মমভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবের পর রাশিয়ায় যখন সমাজতন্ত্রের নামে লাখো লাখো বনি আদমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে তখন আশা ভঙ্গের বেদনায় মায়াকোভস্কি আত্মহত্যা করেন। কারণ তিনি যে সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন বিপ্লবের পর তাঁর সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। তাই আপসহীন মায়াকোভস্কি গড্ডালিকাপ্রবাহে গা না ভাসিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। একইভাবে বিশ্বাস ও বাস্তবে আপসহীন ছিলেন বলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কবি বেঞ্জামিন মোলেসকে শ্বেতাঙ্গ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। কারণ তিনি শুধু কবিতার মাধ্যমেই বর্ণবাদের প্রতিবাদ করেননি—বর্ণবাদের চির অবসানের জন্য রাজপথে মিছিল করেছেন, এমনকি হাতে অস্ত্রও তুলে নিয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার সারা বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বেঞ্জামিন মোলেসকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। একইভাবে সুকান্তকে আপসহীন ভূমিকার কারণে দুঃসহ যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই মৃত্যুর পূর্বে লিখে গেছেন—

“এ দেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম

অবাক পৃথিবী! সেলাম তোমাকে সেলাম।”

এমনিভাবে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে পৃথিবী থেকে এই তিন কবি নির্মমভাবে বিদায় নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ফররুখের কি স্বপ্ন ভেঙেছিল? ফররুখ কি আশাভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত ছিলেন? হ্যাঁ ছিলেন। ছিলেন বলেই সাত সাগরের মাঝি কাব্যগ্রন্থে ফররুখ আহমদের বিশ্বাসে যে বলিষ্ঠতা ও দৃঢ় প্রত্যয় ছিল পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোতে সে বিশ্বাস ও প্রত্যয় অনুপস্থিত। তার একমাত্র কারণ আশাভঙ্গের বেদনা। যে বিশ্বাস ও আদর্শকে সামনে রেখে ফররুখ দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁর সেই আশা ও স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। তিনি দেখলেন, ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী। এমনকি পাকিস্তানের নব্য শাসক গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের নাম গন্ধও নেই। এ সম্পর্কে আল মাহমুদ বলেছেন : “পাকিস্তান সম্বন্ধে ফররুখ আহমদের স্বপ্নভঙ্গ হয় দেশবিভাগের অল্পকাল পরেই। যে পাকিস্তান আন্দোলনকে তিনি ভেবেছিলেন উপমহাদেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রাথমিক উদ্ভবকাল বা বীজ বপনের মুহূর্ত, অতি অল্প সময়ে কবির সে স্বপ্নের মনোভূমিতে আগাছা জন্মাতে থাকে এবং তমদ্দুন মজলিসের ভাষা আন্দোলন যখন পাকিস্তান সরকারের গুলীতে রক্তাক্ত হাহাকারে পরিণত হয়, তখন ফররুখের স্বপ্নের মনোভূমি চোর কাঁটার জঙ্গলে ভরে যায়।”

কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে বলে ফররুখ আহমদ মায়াকোভস্কির মতো আত্মগোপনের পথ বেছে নেননি। সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ ফররুখ যে জীবনাদর্শে বিশ্বাস করতেন সেখানে আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই তিনি আবারো প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। গর্জে উঠলেন পাকিস্তানের নব্য শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীরা প্রথম আঘাত হানল এদেশের ভাষার উপরে। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাস পরই ‘সওগাত’ পত্রিকায় ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন।

এ সম্পর্কে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ১৩৫৪ সালের ভাদ্র মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সে মাসেই তিনি (ফররুখ) সওগাতের জন্য একটি প্রবন্ধ লিখলেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নাম দিয়ে। এ প্রবন্ধটি পরবর্তী সংখ্যা আশ্বিনের সওগাতে ছাপা হয়। উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলন শুরু হয় মূলত ১৯৪৮ সালে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণের পর পরই। আর এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীতে। কিন্তু ফররুখ এ প্রবন্ধ লিখেন ‘৪৭-এর মাঝামাঝি সময়। এদিক থেকে সম্ভবত ফররুখই প্রথম কবি যিনি বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। তাঁর প্রবন্ধটি এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো :

“পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, (তখনো ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি)। জনগণ ও ছাত্র সমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে।

যদি তা-ই হয়, তাহলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। কেন হবে এ নিয়ে পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কিন্তু একটা কারণে আমাকে বাধ্য হয়ে দু’একটি কথা প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে।

পাকিস্তানের অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে একথা সর্ববাদিসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানেই কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপায়িত করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে এই তাঁদের অভিমত।

কি কুৎসিত পরাজয়ী মনোভাব এর পেছনে কাজ করছে একথা আমি ভেবে বিস্মিত হয়েছি। যে মনোবৃত্তির ফলে প্রায় দুশো বছর বাংলা ভাষায় ইসলামের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, সেই অন্ধ মনোবৃত্তি নিয়েই আমরা ইসলামকে গলাটিপে মারার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছি। দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই। কিন্তু আরো দুঃখের কথা এই যে, পূর্ব পাকিস্তানে এমন মানুষ আছেন (সংখ্যায় যত অল্পই হোন না কেন) যারা একমাত্র মানসিক দুর্বলতার জন্যই মাতৃভাষাকে মাতৃভাষার মাধ্যমে অস্বীকার করে ইসলামী ঐতিহ্যের মহান দায়িত্ব অপর একটি প্রাদেশিক ভাষায় কিঞ্চিৎ পরিপুষ্ট ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। কারণ : এক. ঐ প্রাদেশিক ভাষাটি তথাকথিত শরীফদের ভাষা। দুই. ঐ প্রাদেশিক ভাষায় কয়েকখানি ইসলামী তমুদ্দনমূলক গ্রন্থ রচিত ও অনূদিত হয়েছে।

প্রথম কারণটি হাস্যকর। দ্বিতীয় কারণটি অলৌকিক। অবশ্য ঐ দুটো কারণকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে এক কল্পনা করা হয়েছে। আর ঐ কারণটির বিরুদ্ধেই আমার অভিযোগ।

শরাফতি কথাটার প্রকৃত ইসলামী অর্থ যাঁরা জানেন তাঁরা যে এই জাতীয় কথা উচ্চারণ করেন না, অন্ততঃ করতে পারেন না এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। বাংলা ভাষাকে যে ইসলামী ভাবধারার শ্রেষ্ঠ আধারে পরিণত করা যায় এ বিষয়েও আমার কোন সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক দীনতা ঘোচাতে হলে শুধু লেখক সম্প্রদায়কে নয়- রাষ্ট্র ও সমাজের বিত্তবান অংশকেও এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। জনসাধারণের কথা আমি ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছি। কারণ, অধিকাংশ লোকের মত জনগণও লুণ্ঠিত (সম্প্রদায় অবশ্য বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে)।

রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় সাহিত্য গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপে বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনাকে কেউ যদি পুঁজিবাদের সমর্থন মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের বা পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ শত্রু বলে সর্বপ্রথম গণ্য হতে পারে কুফরী ও ক্যাপিটালিজম। আর ঐ দুটোর বিরুদ্ধেই বৈরী মনোভাব নিয়ে আমাদের জাতীয় সাহিত্য গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। সুতরাং পাকিস্তান রাষ্ট্র, রাষ্ট্রভাষা ও আমাদের জাতীয় সাহিত্য গড়ে তুলতে সহযোগিতা (সাহায্য নয়) করতে পারেন কেবলমাত্র তাঁরাই যাদের দৃষ্টিভঙ্গী ইসলামী গণতন্ত্রে আলোকদীপ্ত।

কোন্‌ প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী এর বিরোধিতা করবেন তাও আমাদের অজানা নেই। সেই শ্রেণীর বিরোধিতা ইতিমধ্যেই আমরা যথেষ্ট অনুভব করেছি। নিরক্ষর জনগণকে সকল দিক দিয়ে বঞ্চিত করার চেষ্টা, এদের এ পর্যন্ত সফল হলেও, আর সম্ভব হবে না। সময়ের চাকা তার গতি পরিবর্তন করেছে। জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে চেপে রাখা কারুর সাধ্যেই কুলোবে না। ঐ ন্যায়সঙ্গত দাবির বলেই পাকিস্তানের জনগণ শুধু আহার্যের নয়-সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকার কেড়ে নেবে। গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষাকে পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপায়িত করতে চান তাঁদের উদ্দশ্যে অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

আমি আগেই বলেছি যে, বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে। সেই কথাই আবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমি আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করছি।”

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রধান যুক্তি ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে ইসলামি ঐতিহ্যের সর্বনাশ করা হবে। ফররুখ আহমদ এর তীব্র প্রতিবাদ করে তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন, “বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা না করা হলে বরং দেশের ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।”

১৯৪৮ সালে কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঘোষণা দিলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা—সাথে সাথে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা ও মেহনতি মানুষের সঙ্গে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিলেন। এঁদের সঙ্গে সেদিন কবি ফররুখ আহমদও প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হলেন। এ সম্পর্কে লুৎফর রহমান জুলফিকার লিখেছেন, “যে দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে হুমকি দিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেদিন আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলাম। সেই বিরোধী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের প্রথম কাতারের অন্যতম সৈনিক ছিলেন তৎকালের তরুণ নির্ভীক কবি ফররুখ আহমদ। আমরা একত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছি, পত্রিকায় লিখেছি, ইশতেহার ছেপেছি এবং বহু মিটিং করেছি। ঢাকা থেকে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’ পত্রিকার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে আরো ব্যাপকভাবে শক্তিশালী ও সংগঠিত করার ব্যাপারে তৎকালের ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের সমবায়ে গঠিত ভাষা সংগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে আমরা শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাই। এ প্রসঙ্গে সেকালে নাজিমউদ্দীন রোডে অবস্থিত তৎকালের ঢাকার রেডিও স্টেশনের কথা স্মরণ হচ্ছে। কবি ফররুখ আহমদ, বেতার শিল্পী শেখ লুৎফর রহমান, আবদুল লতিফ ও অন্যান্য শিল্পী- সাহিত্যিকদের নিয়ে আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গড়ে তুলি। আমি তখন রেডিওতে নিয়মিত কথক ছিলাম। বন্ধু ফররুখ আহমদ ও আমরা রেডিও স্টেশনের সামনে আজিজ মিয়ার রেস্তোরাঁয় আড্ডায় বসে রাষ্ট্র ভাষার উপর অনেক কাব্য-কবিতা-গান-গল্প তৈরী করে ভাষা আন্দোলনবিরোধী বন্ধুদের ক্ষেপিয়ে তুলতাম। ফররুখ আহমদ ছোট ছোট স্যাটায়ার (Satire) তৈরী করে স্যুট-টাইওয়ালা সরকার সমর্থক রেডিও বন্ধুদের ক্ষেপিয়ে অনেক রসাত্মক কবিতা রচনা করতেন। আর মাঝে মধ্যে তাঁর বিখ্যাত প্রিয় পার্কার কলমটি উঁচিয়ে ধরে বলতেন, এ কলম দিয়ে গুলী করে বাংলাবিরোধী দালালদের ধ্বংস করবো, আর রাষ্ট্রভাষার জয়গান গাইবো। সে সময় বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অসম্ভব প্রীতির জন্য তাঁকে কম্যুনিস্ট পর্যন্ত বলা হত। বলা বাহুল্য, সে সময় কবি ফররুখ আহমদকে তদানীন্তন সরকার কর্তৃক নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়। কিন্তু নির্ভীক কবি ফররুখ আহমদ কখনো তাদের কাছে তাঁর উন্নত শির নত করেননি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন করলেও আদর্শগত দিক থেকে তিনি ছিলেন ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি।”

‘৪৭ সালের আজাদি লাভের আগেই কবি ফররুখ আহমদ বাংলা ভাষার পক্ষে লেখনী ধারণ করেন। ১৩৫২ সনে ফররুখ আহমদ মাসিক ‘মোহাম্মদী’তে উর্দু- প্রীতিওয়ালাদের ব্যঙ্গ করে ‘উর্দু বনাম বাংলা’ শীর্ষক একটি কবিতা লিখেন। সেখানে তিনি উর্দু-প্রীতিওয়ালাদের তীব্র কটাক্ষ করে লিখেছেন :

“দুই শো পচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন

বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা

বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়েছে আশার চামচিকা

উর্দু নীল আভিজাত্য (জানে তা নিকট বন্ধুগণ)

আতরাফ রক্তের গন্ধে দেখি আজ কে করে বমন?

খাটি শরাফতি নিতে ধরিয়াছি যে অজানা বুলি

তার দাপে চমকাবে এক সাথে বেয়ারা ও কুলী

সঠিক পশ্চিমী ধাঁচে যে মুহূর্তে করিব তর্জন।”

ফররুখ আহমদের আগে মুজীবুর রহমান খাঁ, হাবিবুল্লাহ বাহার, তালেবুর রহমান প্রমুখ ‘পাকিস্তান’ শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ ছাড়া প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ মরহুম আবুল মনসুর আহমদ ১৩৫০ সনে কার্তিক সংখ্যা ‘মোহাম্মদী’তে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি বলেছেন : বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা না করা হলে নবগঠিত পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে। আবুল মনসুর আহমদের এই আশঙ্কা পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ফররুখ আহমদও একই আশঙ্কা বোধ করেছিলেন। তাই তিনি রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কলম ধরেন।

পাকিস্তান-পূর্ব ও পরবর্তী আমাদের সমাজের এক শ্রেণির লোক নিজের আভিজাত্য প্রমাণের জন্য কথায় কথায় ইংরেজি বলার চেষ্টা করতেন (যদিও শুদ্ধ করে বলতে পারতেন না)। ফররুখ আহমদ তাঁর ভাষা কবিতায় এদের তিরস্কার করে লিখেছেন :

“যদিচ সাধারণ মানুষ বলছে যে

আপনার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ

এস্তেমাল করেছেন ছহি বাংলা জবান,

পড়েছেন পুঁথি

পেয়েছেন গাঁথা,

শুনেছেন মারেফতী আর মুর্শীদি,

কিন্তু বুদ্ধিমান আপনি

রাতারাতি বদলে ফেলেছেন

আপনার মুখের ভাষা

(বহুরূপী যেমন সহজে পাল্টে ফেলে গায়ের রংখ

বাংলাটা ঠিক বলতে পারেন না,

ভাব প্রকাশ হয় না যথাযথ

লিখতে গেলে কলম আটকায়

ইত্যাকার কথা নাকি।”

একই কবিতায় তিনি আরো বলেছেন :

“এ বিষয় বিজ্ঞজনের অভিমত এই যে,

বাংলা ভাষাটা আপনি ভুলেছেন ঠিকই

কিন্তু ইংরেজীটাও মোটে আয়ত্ত করতে পারেননি।”

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফররুখ আহমদও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন তিনি রেডিও শিল্পীদের ধর্মঘটে যোগদানের জন্য সংগঠিত করেন। এ সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, “বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পর পর আমরা রেডিওর সামনে রেস্টুরেন্টে যাই বেতার শিল্পীদের ধর্মঘটে যোগদান করানোর জন্যে। গিয়ে দেখি ইতোমধ্যেই ফররুখ ভাই, লতিফ ভাই, আহাদ ভাই ও খোন্দকার আবদুল হামিদ সংগঠন করে ফেলেছেন। ফররুখ ভাই পাকিস্তান ও ইসলামী আদর্শের অনুরাগী ও অনুসারী বরাবর, কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তানী ও পূর্ব পাকিস্তানী শাসকেরা ইসলামের নামে যা করেছিলেন, তাতে তাঁদের ওপরে সবচেয়ে বেশী ক্রুদ্ধ ছিলেন ফররুখ ভাই। তিনি ঐ শাসকদের ব্যঙ্গ করে ‘রাজ-রাজড়া’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন এবং তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনীত হয়েছিল। বেনজীর আহমদ ও আবু জাফর শামসুদ্দীন সম্পাদিত ‘নয়া সড়ক’ সংকলনে নাটকটি প্রকাশিত হয়।”

রফিকুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ফররুখ আহমদ শুধু কবিতা ও প্রবন্ধের মাধ্যমেই রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কথা বলেননি, তিনি ভাষা আন্দোলনের একজন সংগঠকও ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির পর পর তিনি বেতার শিল্পীদের ধর্মঘটের ডাক দেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি নাটকের মাধ্যমেও পাকিস্তানী শাসকদের পৈশাচিক কাজের প্রতিবাদ করেছেন এবং তাঁর সেই নাটক তৎকালীন প্রগতিশীলদের দুর্গ বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনীত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে ফররুখ আহমদের অবদান সম্পর্কে প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জনাব সানাউল্লাহ নূরী লিখেছেন, “বাংলাভাষা আন্দোলনের আদি এবং শেষ পর্বে আমরা তাঁকে (ফররুখ) দেখেছি কেমন দুঃসাহসিকতায় তিনি লেখনী চালনা করেছেন তখনকার চাটুকার আর ক্ষমতাসীনদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। ঘৃণায়, বিদ্রূপে এবং শ্লেষে তাঁর ব্যঙ্গাত্মক কবিতার শব্দমালা এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। আর আমাদের সেকালের ছাত্র এবং তরুণ সমাজ কবিতার সেই হাতিয়ারকে পারঙ্গমতার সঙ্গে ব্যবহার করেছিল হীনমন্যতায় আক্রান্ত বুদ্ধিজীবী সমাজ আর রাজনীতির আঙ্গিনার ক্ষমতা শিকারী স্থাপক শ্রেণীর বিরুদ্ধে।”

বাংলা ভাষার প্রতি ফররুখ আহমদের অপরিসীম মায়া-মমতা ও ভালবাসা ছিল। এই ভালবাসার কারণেই অসংখ্য ঝুঁকি নিয়ে ফররুখ আহমদ ভাষার স্বপক্ষে কথা বলতে পেরেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি ফররুখের কত গভীর মমতা ছিল তা তাঁর ‘ভাষার গান’ থেকেই বোঝা যায়। গানটিতে সুর করেছেন আবদুল হালিম চৌধুরী। পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে গানটি হুবহু তুলে দেয়া হলো :

মধুর চেয়ে মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা

এই ভাষাতে ফোটে আমার দুঃখ দরদ আশা।।

এই ভাষাতে পুঁথি-গাঁথা মারেফতি লিখি,

এই ভাষাতে ভাটিয়ালী ভাওয়াইয়া গান শিখি,

এই ভাষাতে মেটে আমার মনের পিপাসা।।

এই ভাষাতে ফোটে রে ভাই সকল কান্না-হাসি,

এই ভাষাতে দুঃখে-সুখে গাই যে বারমাসী

এই ভাষাতে যায়রে ভাবের আঁধার কুয়াশা।।

(ওরে) হরিণ চেনে বন যে গহীন, নদী চেনে মাছ,

পাখ-পাখালীর বুলি চেনে সকল চারা গাছ,

(আর) আমি চিনি যে ভাষাতে প্রাণের ভালবাসা।।

পাক জমিনের মত আমার পাক বাংলার মান,

না শুনিলে মাতৃভাষা মন করে আনচান,

মায়ের ভাষা শুনলে মনে না থাকে নৈরাশা।।

[গানটি কবিপুত্র আহমদ আখতারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।]

উপরের গানটি থেকে বোঝা যায় ফররুখ আহমদ কত গভীরভাবে ভালবাসতেন বাংলা ভাষাকে, বাংলার মাটি ও মানুষকে। কিন্তু এত ভালবাসার পরও কবি জীবিত অবস্থায় যথাযথ সম্মান পাননি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার পরিকল্পিতভাবে তাঁকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেয় প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী বলে। যার ফলে এই মহান ভাষা সৈনিক ১৯৭৪ সালে দারিদ্র্যের কষাঘাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মাথা নত করেননি। কারণ তিনি জানতেন :

“জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনি জানি

শহিদী রক্তে হেসে উঠে যবে জিন্দেগানী।”

তাঁর মৃত্যুর পর হংকং থেকে প্রকাশিত ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিয়্যুর ৮ নভেম্বর ‘৭৪ সংখ্যায় প্রখ্যাত সাংবাদিক মার্টিন ডেবিডসন লেখেন, “কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি ফররুখ আহমদ ইন্তিকাল করেছেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ অনাহার। কর্তৃপক্ষের অনেকেই তাঁর মৃত্যুতে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন।”

পরিশেষে ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর উক্তি দিয়ে এ প্রবন্ধের শেষ করছি। তিনি বলেছেন, “কবি ফররুখ আহমদ সেই প্রকৃতির কবি যারা কোন দেশের শতবর্ষ পর একবার মাত্র জন্মগ্রহণ করেন। কবি ফররুখকে অনেকে শুধু রেনেসাঁর কবি বলে থাকেন। কিন্তু ইসলামী ঐতিহ্য উজ্জীবন ছাড়াও আবহমান বাংলাদেশের ওপর তিনি বহু কবিতা লিখেছেন যা আলোচনার দাবি রাখে। অমর কবি ফররুখ আহমদের মত আর যেন কারো ট্রাজিক মৃত্যু না হয় এটাই সকল দেশ ও জাতির প্রার্থনা হওয়া উচিত।”

 

তথ্যসূত্র :

১. ফররুখ রচনাবলী-মোহাম্মদ মাহ্ফুজুল্লাহ ও আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত।

২. ন্যায়ের পথে নিঃসঙ্গ কবি-আল মাহমুদ।

৩. অনন্য পুরস্কার-রফিকুল ইসলাম।

৪ . আমার বন্ধু ফররুখ আহমদ-লুতফর রহমান জুলফিকার।

৫. বিদেশী সাংবাদিকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবের শাসনকাল-সম্পাদনায় হাসনাত করিম।

৬. ফররুখ আহমদ : ব্যক্তি ও কবি-সম্পাদনায় শাহাবুদ্দীন আহমদ।

৭ . ঐতিহ্য, ১ বর্ষ ২ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ১১৮৬।

[গুরুত্ব বিবেচনা করে অগ্রপথিক (৪ বর্ষ ১৯-২০ সংখ্যা।। ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৬, ৩ জিলকদ ১৪০৯ ।। ৮ জুন ১৯৮১) এর সৌজন্যে লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।–সম্পাদক]

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷