যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের :
পূর্ণ নাম আ. ফ. ম. আবদুল হক ফরিদী (আবুল-ফারাহ মুহাম্মাদ আবদুল-হাক্ক ফারীদী)। তিনি সাধারণত আবদুল হক ফরিদী নামেই পরিচিত। ফরিদপুর জিলার অধিবাসী হিসাবে তাঁর সম্বন্ধবাচক নাম ফরিদপুরী। সেটাকে সংক্ষিপ্ত ও সাযুজ্য করবার উদ্দেশ্যেই তিনি ফরিদী ব্যবহার করতেন। সাবেক ফরিদপুর জিলার মাদারীপুর মহকুমায় পালং থানায় (বর্তমানে শরীয়তপুর জেলা নড়িয়া উপজেলা) এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ২৫ মে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। পিতা মৌলবী আলফাজুদ্দীন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। পিতার ইনতিকালের পর তাঁর এক অনুজ উক্ত ব্যাবসা পরিচালনা করতেন এবং পরিবারের ভরণ পোষণ করতেন। তাঁর অন্য এক কনিষ্ঠ ভ্রাতা বি. এস. সি. বি. এজি. পাশ করে সরকারী কৃষি বিভাগে চাকরি করতেন এবং এডিশনাল ডাইরেক্টর অব এগ্রিকালচাররূপে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।
আবদুল হক ফরিদী অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা যথারীতি মকতব ও স্কুলে শুরু হয়েছিল। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে নিউ স্কীম মাদরাসা শিক্ষা চালু হলে তাঁর ধর্মপরায়ণ অভিভাবক তাঁকে নিউ স্কীম মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। নিউ স্কীম মাদরাসা ও ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজগুলি তখন ঢাকা বোর্ডের অধীনে ছিল। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা মাদ্রাসা হতে ইসলামিক ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে পাশ করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে কৃতকার্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ের অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন এবং সকল বিষয়ের সকল অনার্স পরীক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পান (১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তী বৎসর এম. এ. (ইসলামিক স্টাডিজ) পরীক্ষায় অনুরূপ কৃতিত্বপূর্ণ ফল লাভ করেন। তিনি চাকুরিরত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সীতে এম. এ. পরীক্ষায় বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসাবে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন (১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিপলোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকান সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা প্রশাসন বিষয়ে অধ্যয়ন করবার উদ্দেশে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং অধ্যয়ন শেষে ওই বিষয়ে অ্যাডভান্সড সার্টিফিকেট লাভ করেন (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ)। এই উপলক্ষ্যে সর্বপ্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বহু অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক সফর করেন। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কিন শিক্ষা দফতরের পরামর্শে নিউ ইয়র্ক শহরের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাকোর্সে তিনি যোগ দেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণাকর্মে সারা জীবন নিয়োজিত ছিলেন। বিবিধ বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল। পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে লেখালেখিতেও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। জ্ঞানের কোনো নতুন বিষয় তার নজরে পড়লে তিনি সে সম্বন্ধে জানবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কম্পিউটার বিজ্ঞান আবিষ্কৃত হলে তিনি তা সম্পর্কে জানবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হন। জানা যায়, বৃদ্ধ বয়সে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। সম্যক অবগত না হয়ে তিনি কোন বিষয়ে অভিমত দিতেন না। যে-ই তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছে সে-ই তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়েছে।
বিস্তৃত কর্মমুখর এক জীবন :
শিক্ষাজীবন শেষে তিনি চট্টগ্রাম (সরকারী ডিগ্রী) কলেজে প্রভাষক নিযুক্ত হন (১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ)। প্রায় পৌনে তিন বৎসর পর বেংগল এডুকেশনাল সার্ভিসে উন্নীত হয়ে তিনি বর্ধমান বিভাগের মুসলিম শিক্ষার সহকারী স্কুল পরিদর্শকরূপে চুঁচুড়ায় (হুগলী) বদলি হন। এই পদে তিন বৎসর কর্মরত ছিলেন। অতঃপর তিনি শিক্ষা ছুটি নিয়ে ব্রিটেনের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে যান (১৯৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বরিশাল ও চট্টগ্রাম জিলার জিলা স্কুল পরিদর্শকরূপে তিনি নিয়োগ লাভ করেন। অতঃপর তিনি বেংগল সিনিয়র এডুকেশনাল সার্ভিসে উন্নীত হন। এবং তাকে বর্ধমান বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগে দ্বিতীয় (বিভাগীয়) স্কুল পরিদর্শক নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সী বিভাগের (বিভাগীয়) স্কুল পরিদর্শকরূপে কলকাতায় বদলি হন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এডিশনাল এ.ডি.পি. আই. (প্রাথমিক শিক্ষা) নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সনের আগস্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ঢাকা বিভাগের স্কুল পরিদর্শকরূপে ঢাকায় আগমন করেন। পর বৎসর ১ জানুয়ারী তিনি মুসলিম শিক্ষার সহকারী ডি.পি.আই. নিযুক্ত হন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে শৈক্ষিক প্রশাসনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকা যান এবং ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কয়েক মাস তাঁর পূর্ব পদে (এ.ডি.পি.আই.) কাজ করবার পর ১৯৫৩ সনের জুন মাসে তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন করাচী বোর্ড অব সেকেন্ডারী এডুকেশনের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সনের জুলাই মাসে পূর্ব পাকিস্তান সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৬০ সনের ১৫ মার্চ হতে ১৯৬২ সনের ৮ জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম শিক্ষা উপদেষ্টা পদে করাচীতে এবং ৯ জুলাই হতে ১৯৬৫ সনের ৮ জুলাই পর্যন্ত কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসাবে তিনি কর্মরত থাকেন। অতঃপর ঢাকায় ফিরে এসে জনশিক্ষার পরিচালক (ডি.পি.আই.) পদে ২৮ জুলাই, ১৯৬৫ সনে অধিষ্ঠিত হন এবং ২৫ মে, ১৯৬৬ সনে সরকারী চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
অবসর গ্রহণের অল্প দিন পরেই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনরারী ট্রেজারার পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তিনি এই পদে ছয় বৎসর বহাল ছিলেন। শেষের দিকে কিছু সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তিনি করাচী, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (বর্তমানে সিনেট) নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলেরও তিনি সদস্য ছিলেন।
তিনি ১৬ অক্টোবর, ১৯৭৭ সাল হতে ২৩ জুলাই, ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর মহাপরিচালক ছিলেন। তাঁরই আমলে ফাউন্ডেশনে ইমাম প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়। তাঁর সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলায় ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকাশের পরিকল্পনাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন গ্রহণ করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ নামে একটি পাণ্ডুলিপি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিকট হস্তান্তর করে। জনাব ফরিদী প্রথমে সেটা প্রকাশে আগ্রহী হন এবং তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সম্পাদনার জন্য পাঁচ সদস্য-বিশিষ্ট একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠন করেন। তিনি নিজে ছিলেন উক্ত পরিষদের সভাপতি। বৃহত্তর ইসলামী বিশ্বকোষ প্রণয়নের পরিকল্পনাটি তাঁরই উদ্যোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক গৃহীত হয়। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৮০-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথমে ২০ খণ্ডে বিশ্বকোষটি সমাপ্ত করবার পরিকল্পনা থাকলেও পরে সেটা ২৮ খণ্ডে সমাপ্ত হয়। জনাব ফরিদী বিশ্বকোষের ২০তম খণ্ড পর্যন্ত সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি হিসাবে এই প্রকল্পটির প্রাণপুরুষ ছিলেন (১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ) বললে অত্যুক্তি হয় না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত আল-কুরআনুল করীমের দ্বিতীয় সংস্করণের সম্পাদকমণ্ডলীর তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে সর্বাগ্রে। মৃত্যুর এক দেড় মাস পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিশ্বকোষ সম্পাদনা পরিষদের সভায় যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছেন ।
তিনি বাংলা, ইংরেজী, আরবী, ফার্সী ও উর্দূ ভাষায় সমান দক্ষ ছিলেন । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ হতে সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, মাহে নও ইত্যাদি বহু সাময়িক পত্রিকায় তাঁর মৌলিক এবং আরবী, ফার্সী ও উর্দূ হতে অনূদিত কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোট গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। সেগুলি গ্রন্থিত হয় নাই। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত (১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ) তাজরীদুল বুখারী (হাদীছ গ্রন্থ)-এর একটি অধ্যায় তিনি অনুবাদ করেছেন এবং উক্ত গ্রন্থের সম্পাদনা পরিষদের তিনি একজন সদস্য ছিলেন। তিনি এস. এম. ইকরাম রচিত Cultural Heritage of Pakistan গ্রন্থটির একটি অধ্যায় অনুবাদ করেছেন। তার অনূদিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো :
(১) কবি আল্লামা ইকবালের দার্শনিক ফার্সী কাব্য রুমূয-ই বেখুদী গ্রন্থের বাংলা কাব্যানুবাদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ)
(২) কাজী ইমদাদুল হক প্রণীত মুসলিম সামাজিক উপন্যাসের (আব্দুল্লাহ) উর্দূ অনুবাদ (পাকিস্তান পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ)
(৩) নাসীম হিজাযীর জনপ্রিয় ঐতিহাসিক উপন্যাস মুহাম্মাদ ইবন কাসিম মূল উর্দূ হতে বাংলায় অনুবাদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ)।
তাঁর মৌলিক রচনাও যথেষ্ট। বৃহত্তর ইসলামী বিশ্বকোষে তাঁর বেশ কয়েকটি মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থ মাদ্রাসা শিক্ষা : বাংলাদেশ একটি গবেষণামূলক রচনা। যেটা বাংলা একাডেমী কর্তৃক ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক থাকাকালীন ইসলামিক কনফারেন্স সংস্থার অনুরোধে তিনি বাংলাদেশে সর্বপ্রথম একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। বিশ্বের অনেক দেশ হতে প্রতিনিধিবর্গ এই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন, যার আলোচ্য বিষয় ছিল ‘মুসলিম বিশ্ব : মানবিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ’। এই সম্মেলনে একই সঙ্গে আরবী, ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায় তরজমা করবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমীর প্রথম জীবন সদস্য এবং ১৯৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে তার সরকার নিযুক্ত সভাপতি। তিনি ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ও এক সময়ের অন্যতম সহ-সভাপতি এবং জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির জীবন সদস্য ও তার বোর্ড অব গভর্নর-এর এক সময়ের সদস্য।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার তাঁকে ‘খান সাহেব’ খেতাব দেয় । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি তা বর্জন করেন। পাকিস্তান সরকার তাকে ‘সিতারা-ই খিদমত’ উপাধিতে ভূষিত করে, কিন্তু সেটাও তিনি ব্যবহার করতেন না।
সৃষ্টির সেবা করে যেই জন… :
তিনি অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন । তিনি ১৯৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক রোটারির ৩০৭ নম্বর জিলার ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর পদে নির্বাচিত হন। সমগ্র পাকিস্তান এটার অন্তর্ভুক্ত ছিল। উক্ত জিলার সমুদয় রোটারি ক্লাব পরিদর্শন করা ও তাদের বিভিন্ন মানবসেবা কর্মতৎপরতা উন্নত করতে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া তার কর্তব্যভুক্ত ছিল। ১৯৭০ সনের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশ্বের বিভিন্ন রোটারি ক্লাব জনাব ফরিদী ও তার সহযোগীদের চেষ্টায় সেই সময় বেশ কিছু সাহায্য প্রেরণ করে। যেমন জাপান রোটারিয়ানদের পক্ষ হতে পটুয়াখালী জিলার চারটি স্থানে আশ্রয়স্থল নির্মিত হয়। সেইগুলি পরে স্কুলঘর হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে। পরবর্তী কালে সমগ্র বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক রোটারির ৩২৮ নম্বর জিলা গঠিত হয়। তিনি এই জিলার কাউন্সিল অব গভর্নরস-এর প্রবীণতম গভর্নর ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম নামক সমাজসেবামূলক সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন ট্রাস্টি। বাংলাদেশ বয়স্কাউট আন্দোলনের তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্কাউটের “উড্ ব্যাজধারী।” তিনি পাকিস্তান বয়স্কাউট এসোসিয়েশনের ডেপুটি ন্যাশনাল কমিশনার ছিলেন। তিনি স্কাউটের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান পাকিস্তান স্কাউটের সিলভার উষ্ট্র এবং বাংলাদেশ স্কাউটের সিলভার টাইগার প্রাপ্ত ছিলেন। বাংলাদেশ স্কাউটস-এর জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন।
পৃথিবীর পথে পথে :
তিনি পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন : সউদী আরবে তিনবার, হজ ও যিয়ারতের জন্য দুইবার। আর একবার সউদী আরব সরকারের আমন্ত্রণে হিজরী ১৫শ শতকের আরম্ভানুষ্ঠান উদযাপনের জন্য ।
আমেরিকা তিনবার সফর করেন, প্রথমবার ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে শিক্ষা প্রশাসনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে জাপান, হাওয়াই দ্বীপ, হংকং, ব্যাংকক ও রেংগুন ভ্রমণ করেন। দ্বিতীয়বার পাকিস্তান বয়স্কাউটস্-এর একটি দলের নেতা হিসাবে মার্কিন বয়স্কাউটস্-এর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় জাম্বুরিতে যোগ দিতে ভ্যালিফ্রজ শিবিরে। ইংল্যান্ড হতে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার সময় তিনি এই যাত্রায় সমুদ্র পথে গমন করেন। তৃতীয়বার ১৯৭০ খৃস্টাব্দে রোটারী ইন্টারন্যাশনাল-এর সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত গভর্নর-নমিনি হিসাবে নিউ ইয়র্ক ও জর্জিয়ায় গমন করেন এবং প্রত্যাবর্তনের পথে ফিলিপাইন, জাপান, ব্যাংকক ও হাওয়াই দ্বীপ ইত্যাদি ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেছিলেন।
তিনি যুক্তরাজ্যে অনেকবার গমন করেছেন : প্রথমে ১৯৩৭-৩৮ খৃষ্টাব্দে, লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করবার জন্য; বৃটিশ কাউন্সিল ও এশিয়া ফাউণ্ডেশনের আমন্ত্রণে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ উপলক্ষে কয়েকবার।
পশ্চিম জার্মান সরকারের আমন্ত্রণে এক বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে শিক্ষা সফরে জার্মানীর বিভিন্ন শহর ভ্রমণ করেছিলেন এবং সকল প্রকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছিলেন (১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে)।
তিনি পাকিস্তান বয়স্কাউটস্-এর প্রতিনিধি হিসাবে সিঙ্গাপুর গমন করেছিলেন এবং কুয়ালালামপুর, পেনাং ইত্যাদি সফর করেছিলেন। ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে একাধিকবার ব্যাংককে কয়েকটি সম্মেলনে তিনি যোগদান করেছিলেন। শ্রীলংকা সরকারের আমন্ত্রণে কলম্বোতে একটি ইসলামী শিক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এবং সেখানে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন (১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে)।
বিভিন্ন সময়ে তিনি তুরস্ক, লেবানন, মিসর ও কাবুল (আফগানিস্তান) সফর করেছেন। ভারত উপমহাদেশের প্রায় সকল রাজ্য, গুরুত্বপূর্ণ শহর ও দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন।
রঙিন এক জীবন শেষে :
জনাব ফরিদী সাহেব ছিলেন আদর্শ চরিত্রের অধিকারী একজন খাঁটি মুসলিম। কর্তব্য সম্পাদনে, দায়িত্ব পালনে তার সুদৃঢ় প্রচেষ্টার তুলনা মেলা দুঃসাধ্য। অন্যায় ও অসত্যের সাথে তিনি কখনও আপোস করেন নাই। সরলতায় তিনি শিশুর মত ছিলেন। তার নির্মল হাসিতে আলোকচ্ছটার প্রস্ফুটন ঘটত; যা উপস্থিত সকলকে দিত এক শান্তিময় আনন্দ। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। তার বিজ্ঞোচিত ব্যক্তিত্ব ছিল এতই প্রখর ও প্রভাবশালী যে, তার উপস্থিতিই তার সহকর্মী, সহযোগী ও অধীনস্থ কর্মচারীদের মধ্যে এক স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করত।
হালকা-পাতলা গড়নের এই ব্যক্তিটি ছিলেন অত্যন্ত কর্মঠ। তাকে আলস্য করতে কখনও দেখা যায় নাই। নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি ছিলেন ব্যবহারে অত্যন্ত ভদ্র, আচরণে নম্র, পরোপকারের প্রতি সর্বদা আগ্রহী এবং ইসলামী রীতিনীতি অনুসরণে অতি যত্নবান।
বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার ফলেই হয়তোবা তিনি মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যেতেন, তাকে কয়েকবার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করতে হয়েছে। শেষের কয়েক বৎসর তার কনিষ্ঠ পুত্র জনাব আতাউল হকের গুলশানস্থ বাসভবনে তিনি বাস করতেন। মৃত্যুর দুই মাস পূর্বেও তিনি ইসলামী বিশ্বকোষ সম্পাদনা পরিষদের সভায় যোগদান করবার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন গ্রন্থাগারে নিয়মিত আগমন করেছেন। নভেম্বর ১৯৯৫ সালে তিনি অসুস্থ হন এবং এই অসুস্থতা অব্যাহত থাকে। বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ এক কর্মমুখর জীবন কাটিয়ে জানুয়ারী ১৯৯৬ সালে ৯২ বৎসর বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন।
আমরা তাঁর জন্য সুপ্রশস্ত জান্নাতি জীবন কামনা করি।