ক.
নিরীহ সবুজ বোতলটা ঝুলছে বেড়ার গায়ে। গতকাল সন্ধ্যায়ই দেখেছে রাবেয়া, আলিমুদ্দিন কীটনাশকের বোতলটা বেড়ার গায়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। হয়তো আজই ধান ক্ষেতে ছিটাবে। সকালবেলায় কীটনাশকের বোতলটা নিয়ে আসে রাবেয়া। চুরিই করে আনে। পাপ হলো বোধহয়! হওয়ারই কথা। তা এর চেয়ে বড় পাপই তো করতে যাচ্ছে সে। তার তুলনায় সামান্য এক বোতল কীটনাশক চুরি, এ আর তেমন কী!
অনেক দিন ভেবেছে রাবেয়া। এমনভাবে আর বেঁচে থাকার মানে হয় না। মৃত্যুতে আর যাই-ই হোক, পেটের চিন্তা তো থাকবে না। না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে, মানুষের উপহাস আর অপমান সইবার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়াই ভালো। সব জ্বালা জুড়ায়। ছেলে মেয়েরাও মুক্ত হয়। গতকাল সন্ধ্যায়, আলিমুদ্দিন বেড়ার গায়ে কীটনাশকের বোতলটা ঝুলিয়ে রেখে বউকে সাবধান করেছে, ছেলে মেয়েরা যেন কোনভাবেই বোতলটা না ধরে। কড়া কীটনাশক আছে বোতলে। কোনোভাবে পেটে গেলে সাক্ষাৎ মরণ। তা তখনই যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে রাবেয়া, এমন নয়। যেদিন জানতে পেরেছিল আউয়াল বাজার থেকে কিনে আনার নাম করে ভিক্ষা করে চাল আনে, সেদিনই আসলে আউয়ালকে নিয়ে স্বেচ্ছায় মরার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। কিন্তু কীভাবে কী করবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। সবুজ বোতলটা তার কাজটা সহজ করে দিল।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাকায় রাবেয়া। বোতলটা এখন তাদের ঘরের ভেতর দিকের বেড়ায় ঝুলছে। লম্বা সবুজ রঙের বোতলটা। ভেতরে কালচে মতন তরল গরল। ধান গাছে ছিটানোর বিষ। একটু পরেই হয়তো বোতলের খোঁজ করবে তার মালিক। … আচ্ছা, ওইটুকু বিষে কি দুইজন মানুষ মারা যাবে? কী জানি, যাবে বোধহয়।
ক্লান্ত পায়ে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে আউয়াল। চুলায় লাকড়ি ঠেলে দিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় রাবেয়া। আউয়ালের হাতে বাজারের ব্যাগ। পরনের পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। বগলের কাছে বড় একটা ছিদ্র পাঞ্জাবিটার। ফর্সা শরীরের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাবেয়া।
এককালে, যখন চাকরি করত—কী শৌখিন ছিল মানুষটা! প্রতি মাসের বেতন পেয়ে নতুন পাঞ্জাবি কিনত। আর রাবেয়ার জন্য নতুন শাড়ি। এত না করত রাবেয়া। প্রতিমাসে কাপড় না কেনার জন্য। শুনত না আউয়াল। বলত, টাকা কামাই করি খরচ করার জন্যই। … মুখে মুখে রাগারাগি করলেও সব শাড়িই পছন্দ হতো রাবেয়ার। লোকটার আর যাই হোক রুচি ছিল। তা অত শাড়ি কি আর পরা হতো। তেমন কোথাও তো বেড়াতে যাওয়াও হতো না। ছেলেমেয়েরা হওয়ার পর বলতে গেলে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধই হয়ে গেল। সেসব শাড়ি সব ট্র্যাংকে জমত। বলতে কী ওইসব জমানো শাড়িতেই গত সাতটা বছর কাটল। শাড়িগুলো না থাকলে বুঝি বে-আবরু থাকতে হতো এখন।
কিন্তু আজকে মানুষটার এত দেরি কেন হলো ফিরতে! সকালে একটু দেরি করে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল ঠিকই। তাই বলে বাজার থেকে কিছু চাল আর একটা দুইটা তরকারি আনতে গিয়ে দুপুর গড়িয়ে যাবে। এমন তো না যে, বাজার দশ মাইল দূরে। মানুষটার দুই পায়ের পাতা ধূলায় সাদা।
বাজারের ব্যাগটা রাবেয়ার হাতে দিয়ে আউয়াল বলে, আজ আর মাছ তরকারি কিছু আনতে পারলাম না গো। কেজি দুয়েক চালই …জিনিসপত্রের যা দাম! … ঘরে শুঁটকি আছে না? বেশি করে ঝাল দিয়ে ভর্তা বানাও। গরম ভাত দিয়া শুঁটকির ভর্তা খাই না বহুত দিন।
তা শুঁটকি কিছু আছে। শুঁটকি বলতে রয়না মাছের মাথা শুকিয়ে রাখা। কিছু গুড়াগাড়া মাছ, আর কিছু কুঁচো চিংড়ি শুকানো। চৈত্র মাসে আউয়াল বাড়ির নামার ডোবা থেকে মাছগুলো ধরেছিল। কিছু খেয়ে কিছু দুর্দিনের জন্য শুকিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল রাবেয়া। অভাবের সংসার কতভাবে যে জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হয়! …কিন্তু রাবেয়া তো মাত্র সাতান্ন টাকা দিয়েছিল বাজারে যাওয়ার আগে। আউয়াল দুই কেজি চাল কিনল কোত্থেকে? তবে কি আজকেও গ্রামে গ্রামে ঘুরেছে? আহারে নিশ্চয়ই অনেক পথ হেঁটেছে মানুষটা!
রাবেয়া বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকলে আউয়াল পরনের পাঞ্জাবিটা খুলে উঠানের কাপড় শুকানোর রশিতে মেলে দেয়। উঠানের এক কোণ থেকে ভাঙ্গা মোড়াটা টেনে নিয়ে রান্নাঘরের চালাটার কাছে বসে। চুলায় কী যেন বসিয়েছে রাবেয়া। পাতিলের ভেতরে টগবগ করে ফুটছে। মৃদু একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চুলার ধারে বসে বসে সে আওয়াজটা একটু শোনে আউয়াল।
রাবেয়া রাজারের ব্যাগ হাতে ঘরের ভেতরে গেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এতক্ষণ কী করছে ভেতরে কে জানে! ক্ষুধায় পেটের ভেতরে চিনচিন করছে। রাবেয়া তো আর জানে না, সকাল থেকে কতক্ষণ হেঁটেছে আউয়াল। … ঘরের চালের দিকে চোখ পড়ায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আউয়াল। কে বলবে, ঘরের চালটা টিনের। পুরনো হয়ে টিনের রং জ্বলে আর রোদ বৃষ্টির ধকল সয়ে সয়ে টিনগুলো শণের মত ভঙ্গুর হয়ে গেছে। কত জায়গায় যে ভেঙ্গে পড়ে গেছে। সেসব জায়গায় পলিথিন দিয়ে চাপা দেওয়া। না, টিনের দোষ নেই। নয় নয় করেও প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে এল ঘরটার। আগিলা দিনের টিন বলেই হয়তো এক বছর টিকেছে। নয়তো এখন যেসব টিন পাওয়া যায় বাজারে, তাতে দশ বছরও টিকত কি না সন্দেহ। কত কত মানুষ বাস করেছে আটচালা ঘরটায়। তাদের বেশিরভাগই এখন কবরে। আর জীবিতদের মধ্যে যারা আছে, ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। এখন বাসিন্দা বলতে রাবেয়া আর আউয়াল। তারা দুইজন মরলে ঘরটায় আর কোনদিন আলো জ্বলবে না।
নাকি মরার পর তিন ছেলে আসবে ঘরের দখল নিতে? বা ভিটার দখল নিতে? কী জানি! আসতেও পারে। আসারই তো কথা। মানুষের হয়তো দাম নেই। কিন্তু মাটির দামতো আছে। যাকগে, নিজেরা মরার পর কী হবে সেসব ভেবে কী লাভ।
চুলার আগুনটা যে নিভে এল! এখনো রাবেয়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না! কী করছে এতক্ষণ! পাতিলের ঢাকনা উঠিয়ে একবার দেখে আউয়াল। আরে, শুধু পানি ফুটছে পাতিলে। রাবেয়া মনে হয় তার বাজার থেকে ফিরে আসার আশায় আশায় আগে থেকেই ভাতের জন্য পানি গরম করে রেখেছে।
আপনি হাত মুখ ধুয়ে নেন। কোন সকালে বাইর হয়েছেন। পা ভর্তি ধূলা। না জানি কত পথ হাঁটেছেন! রাবেয়া কখন বের হয়ে এসেছে ঘর থেকে টের পায়নি আউয়াল।…পাতিলে পানি ফুটতাছে। চাল ধুইয়া দিতে যতক্ষণ। ফুটতে সময় লাগব না। রান্না অইলে গরম গরম খাইবেন।
আউয়াল খালের দিকে পা বাড়ায়। টিউবওয়েল একটা আছে উঠানের কোণে। কিন্তু সেটা বহুদিন ধরে নষ্ট।
খালের পানিতে পা ধুতে ধুতে আউয়াল ভাবে, সে যে অতটা পথ হেঁটেছে রাবেয়া জানল কী করে? পায়ে না হয় একটু ধুলা লেগেছে, তাতে সব বুঝে গেল? নাকি তাকে কেউ কিছু বলেছে? রাবেয়া জানলে বড্ড লজ্জায় পড়তে হবে। আত্মসম্মানটা রাবেয়ার একটু বেশি। না খেয়ে মরতে রাজি আছে, তবু কারো কাছে হাত পাতবে না। পেটের ছেলেদের কাছেই কোনদিন রাবেয়া মুখ ফুটে চায়নি কিছু। …তা আত্মসম্মান কি আউয়ালের কম ছিল? পেটের ক্ষুধার কাছে সব হার মেনেছে। আত্মসম্মান, চক্ষুলজ্জা, বিবেক—সব।
খ.
ছোট চালাটার চারপাশে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। চাল ফুটতে শুরু করেছে। পাতিলের কানা বেয়ে উথলে পড়তে চাইছে আধা সেদ্ধ চাল আর পানি। পাশেই ছোট একটা বাটিতে কিছু ডাঁটা শাক। কুচি কুচি করা। …মানুষটা শুঁটকির ভর্তা খেতে চেয়েছে। কী জানি হয়তো জীবনের শেষ ইচ্ছাই এটা। ভর্তা না হয় করা গেল। কিন্তু খালি ভর্তা দিয়ে জীবনের শেষ ভাতটা খাবে মানুষটা! আর কী করা যায়? অনেক ভেবে, রান্নাঘরের পেছন থেকে কটা ডাঁটা শাক তুলে এনেছে রোকেয়া। তাই সেদ্ধ করে পেয়াজ মরিচ ডলে ভর্তামত করে দিবে। যেমনই হোক আরেকটা পদ বাড়ল।
যখন চাকরি করত আউয়াল, প্রতিদিন ভালো-মন্দ আয়োজন হতো এই সংসারে। জমিজমা বেশি না থাকলেও, বেতনের টাকাতে সংসার খারাপ চলত না। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে দিন খারাপ যায়নি। তবে, লোকটার খরচের হাত খুব খোলা ছিল। একটা টাকাও জমিয়ে রাখত না। কত বলেছে রোকেয়া, বিপদ আপদ বলে কয়ে আসে না। টাকা কিছু জমান।
তার কথা শুনে লোকটা হাসত। বলত, আমার ছেলে মেয়েরাই আমার টাকা পয়সা। সম্পদ। তাগ মানুষ করতে পারলেই হইল। আর কিছু চাই না জীবনে।
তা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে লোকটা বহু ছাত্র-ছাত্রীকে মানুষ করেছে বটে। মানুষ করতে পারেনি শুধু নিজের ছেলেদের।
আকাশের অবস্থা ভালো না। কালো হয়ে আসছে চারপাশ। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। তাড়াতাড়ি ভাতটা নামানো দরকার। শাকটাও সেদ্ধ হয়নি এখনো। অই দিকে আউয়াল হাত-মুখ ধুয়ে এসে খাওয়ার জন্য বসে আছে। রাবেয়া চুলার ভেতর আরো কিছু লাকড়ি ঠেসে জ্বাল বাড়িয়ে দেয়।
আহারে ক্ষুধা! এর জন্য কত অপমান, কত জ্বালা! রাবেয়ার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। না, ধোঁয়ার কারণে না। আবার ইচ্ছে করে যে রাবেয়া কাঁদছে তাও না। আজ কেন জানি তার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। দুইটা ভাতের জন্য এতদিনের মান-সম্মান বির্সজন দেওয়া লোকটার, খাবে বলে কত আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। সে কি আর জানে, জীবনের শেষ খাওয়ার আয়োজন করছে রাবেয়া। তার সাতান্ন বছরের সঙ্গী তাকে মারার জন্য, নিজেও মরার জন্য খাবারে বিষ মেশানোর পরিকল্পনা করেছে?
না, তারা নিঃসন্তান না। তিনটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে তাদের আছে।
তিন ছেলের বড়টা নিজের ভাগের ভিটা বেচে মালয়েশিয়া গিয়েছিল বছর দশেক আগে। বছরখানেক মাসে মাসে কিছু টাকা সে পাঠিয়েছিল। তারপর থেকে কোনো খোঁজ-খবর নেই তার। বউটাও নাতিদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে ছেলে বিদেশে যাওয়ার পর পর। লোকমুখে শোনা যায়, ছেলে শ্বশুরবাড়িতেই এখন সব টাকাপয়সা পাঠায়। আবার কেউ কেউ বলে ছেলে অবৈধভাবে বিদেশে গেছে বলে, তাকে অই দেশের সরকার জেলে ভরে রেখেছে। লোকের কোন কথা যে ঠিক কে জানে! তবে, মাঝে মাঝে রাবেয়া নাতিদের দেখতে বেয়াই বাড়ি যায়। বউ আর নাতিদের দেখে মনে হয় না তারা ঠিক দুঃখে আছে।
বড় ভাইয়ের দেখাদেখি, মেঝোজনও বাপকে বাধ্য করে নিজের ভাগের ভিটা বেচে শুরু করল ব্যবসা, ঢাকা গিয়ে। তার কামাই-রোজগার খারাপ না। তা বিয়ের আগে সে টাকা পয়সা দিত নিয়মিত। বিয়ে করে, বউ নিয়ে ঢাকা যাওয়ার মাস তিনেক পর থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল সে-ও। এখন আর খোঁজ-খবরও নেয় না।
ছোটজন উপজেলা সদরের বাজারে ব্যবসা করে। সেও বড়দের মতো নিজের ভাগের ভিটা বেঁচে মুদি দোকান দিয়েছে। এখন আলাদা থাকে বউকে নিয়ে। মেয়ে দুইটার বিয়ে হয়েছে চলনসই ঘরেই। তারা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপ-মায়ের খবর নেওয়ার সময় পায় না। তাদের আর দোষ কী। পরের ঘরে পরাধীন তারা।
অবসর গ্রহণের পর কিছু টাকা পেয়েছিল আউয়াল। সেসব খাওয়া আর ওষুধে খরচ হয়ে গেছে কবেই। এখন যে কীভাবে চলে সংসার সে জানে রাবেয়া। বাপের কাছ থেকে যেসব গয়না বিয়ের সময় পেয়েছিল তাই বেঁচে বেঁচে চলছে দিন। সেসব গয়নাও শেষ হয়ে গেছে বছর হতে চলল। কথায় বলে খুঁটে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরায়। আর তো সামান্য গয়না।
এখন আর পারছে না বাবেয়া। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আর কত! আউয়াল কদিন দিনমজুরির চেষ্টা করেছিল। বুড়ো মানুষ বলে কেউ কাজেও নিতে চায় না। উপায় না পেয়েই ভিক্ষায় নেমেছে। বুঝে রাবেয়া। …তা তারা দুই বুড়ো বুড়ি বেঁচে থাকলেও সমাজের আর কোন্ কল্যাণে লাগবে? মরলেই-বা কার বুকে লাগবে? আর কেই-বা এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলবে?
ভাতটা নামিয়ে, বেশি করে শুকনা মরিচ দিয়ে যত্ন করে পাটায় বেটে শুঁটকির ভর্তা বানায় রাবেয়া। হাতে কচলে সেদ্ধ শাকের ভর্তা বানায়। শাকেও মরিচটা একটু বেশি দেয়। তারপর ভাত-ভর্তার উপর সবুজ বোতলের সবটুকু তরল ঢেলে ভালোমত মেশায়। মেশায় চোখের পানিও। শেষে পানির জগেও খানিকটা কীটনাশক মেশায়।
খালি বোতলটা টান মেরে ফেলে দেয় দূরের জঙ্গলে।
গ.
ঘরে ঢুকে প্রথমে কিছু দেখতে পায় না রাবেয়া। এতক্ষণ রোদে বসে থাকার কারণে হঠাৎ করে চোখে কেমন অন্ধকার অন্ধকার ঠেকে সব। আস্তে আস্তে অবশ্য ঘরের আঁধার চোখে সয়ে আসে।
কাছে বসিয়ে আউয়ালকে শেষবারের মত যত্ন করে খাওয়ায় রাবেয়া। খেতে খেতে বেশ ক‘বার ঝালের চোটে মুখ হা করে শ্বাস নেয় আউয়াল। ঝালের দরুন মাঝে একটু পানি খায়। পাতের ভাত পুরোটা শেষ করতে পারে না। তার আগেই পেটে হাত দিয়ে ছটফট করে উঠে আউয়াল।
আমার পেটের ভেতর কেমন করছে। ভর্তাতে মরিচটা একটু বেশিই হয়েছে মনে হয়। ঝালের চোটে তিতা তিতা লাগল।…ওরে মারে মারে। কী ব্যথা! … শরীরটাও কেমন যেন খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে। রাবেয়া, কী খাওয়াইলি আমারে?
বিষ! শান্ত স্বরে বলে রাবেয়া। ভাতে, ভর্তায় বিষ মিশাইয়াছি। তাই খাইছেন আপনি। পানির জগেও কীটনাশক দিছিলাম।
বিষ! কীটনাশক! মানে পোকা মারার বিষ! কী বলস আবোলতাবোল। ভর্তাটা কেমন তিতা তিতা লাগাতছিল। ঝালটা মনে হয় খুব বেশি হইছে। সে জন্যই তিতা তিতা লাগছিল ।
ভর্তাতে বেশি ঝাল দিয়েছি ইচ্ছা কইররাঅই। জানি ঝালের চোটে তিয়াসটা বেশি লাগে। পানিডা তিতা তিতা লাগে নাই? শান্তস্বরে বলে রাবেয়া।
এখন মনে হইতাছে একটু জানি অন্যরকমই লাগছিল। বলতে বলতে আউয়াল চিৎকার করে উঠে। অই মাগি, সত্যই কি বিষ দিছছ? মাগো বুকটা জ্বইল্যা যাইতাছে। ও মা, মাগো। বলতে বলতে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি করতে থাকে আউয়াল। হাত-পা-শরীর যেন কাঁপতে থাকে আউয়ালের। মুখের কশ বেয়ে গ্যাঁজলা বের হতে থাকে। রাবেয়া তাকিয়ে থাকে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। কষ্ট পাচ্ছে মানুষটা, বোঝাই যায়। তা মরার সময় তো অমন কষ্ট হয়ই। একটা মুরগি জবাই করলেও কী কম লাফায়! আর এতো জলজ্যান্ত মানুষই।
রাবেয়া বলে, বাঁইচ্যা থাইক্যা আর করবেন কী। আর এর নাম বাঁইচ্যা থাকা! পিছা মারি এমন বাঁচার মুখে। তিন তিনটা পুত আর দুই দুইটা ঝি থাইক্যাও যদি ভিক্ষা কইরা খাওয়া লাগে, এরচেয়ে মরণই ভালো। পেটের জ্বালা একবারে জুড়াইব। মরমু আমিও। এক সাথে তো বাঁচলাম প্রায় ষাইট বছর। কবরেও না হয় এক লগেঅই যামু।
বলতে বলতে থেমে যায় রাবেয়া। আউয়ালের মুখ দিয়ে কেমন একটা শব্দ বের হচ্ছে। এতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল রাবেয়া। আর নিজের জন্যও ভাত বাড়ছিল। আউয়ালের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। মানুষটার শরীর কেমন বাঁকা হয়ে উঠা নামা করছে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে মুখের কাছটায় মাটি ভিজে উঠেছে। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে রাবেয়ার দিকে। সেই চোখে কী অসহায় দৃষ্টি!
চোখের পানিতে রাবেয়ার চারপাশ ঝাপসা ঝাপসা লাগে। তবু নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করে। ভর্তা দিয়ে ভাত মাখায়। মাখা ভাত এক লোকমা মুখে দিতে যাবে, এমন সময় আউয়াল পানি পানি করে কাতরে উঠে। আউয়ালের কাতরানি শুনে ভয়টা বেড়ে যায় রাবেয়ার। মানুষটা সত্যিই মারা যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সময় বেশি নেই।… খাওয়া রেখে রাবেয়া স্বামীর জন্য ঘরের কোণায় রাখা কলসি থেকে গ্লাসে পানি ঢালে। আহা, মরার আগে পানি চেয়েছে মানুষটা। বিষ মেশানো পানি কি দেওয়া যায়! কাছে গিয়ে মাথাটা উঁচু করে পানি খাওয়াতে গেলে ঢলে পড়ে আউয়ালের মাথা। শরীর নিথর হয়ে পড়ে। চোখের দিকে তাকিয়ে রাবেয়া বুঝতে পারে, আউয়ালের শরীরে জান নেই। প্রাণহীন খোলা চোখ দুইটা যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে, ঈষৎ বেঁকে যাওয়া ঠোঁটের দিতে তাকিয়ে প্রবল আতঙ্কে কেঁপে উঠে রাবেয়ার শরীর।
আউয়ালের লাশ মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ভীত রাবেয়া উঠে দাঁড়ায়। পায়ের কাছের খাবারের প্লেট লাথি দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। হাঁড়িতে ভাত কিছু ছিল। সেই ভাত আর ভর্তা একটানে বাড়ির কাছের জঙ্গলে ফেলে দেয়।
রাবেয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আউয়ালের নিথর দেহের দিকে। একবার বাইরে তাকায়। কখন মেঘ সরে গিয়ে রোদ উজ্জ্বল হয়েছে। শেষ বিকালের আলোতে পৃথিবীটা কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে! উঠানের কোণে মাচায় কচি লাউটা গোধূলির আলোতে কেমন মায়াবি লাগছে।
হঠাৎ রাবেয়া চিকার করে উঠে, অ আল্লা, আমার এই কী সর্বনাশ হল! তোমরা কে কই আছোগো, আমার মানুষটাতো আর নেই। অ মমিনের বাপ, তুমি আমারে কার কাছে রাইখ্যা গেলাগো। আমি এখন একা একা বাঁচমু কেমন কইরা। …আল্লাগো তুমি আমারে মাফ করো। মাফ করো আমারে। বলতে বলতে গলা নিচু করে রাবেয়া।
রাবেয়ার আহাজারিতে কেঁপে উঠে চরাচর। একজন দুইজন করে লোক এসে জড়ো হয় উঠানে। তখন পশ্চিম আকাশের সূর্যটা লালিমা ছড়িয়ে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ধীরে ধীরে। আর সন্ধ্যাটা, চারপাশে জুড়ে নামার তোড়জোড় করছে।
চরিত্রের নাম পাল্টে গেছে মনে হলো।
বেডিয়ে মরলো না কেন?
মহিলা বেঁচে থাকলো, কীভাবে সম্ভব!