জানুয়ারির বিকেল বলেই যে তাকে এত দ্রুত ফুরিয়ে যেতে হবে, ভাবতে পারেনি আদনান ফাইয়াজ। খানিক আগে পাহাড়ের বামপাশে এখনো হলুদ না হয়ে ওঠা সূর্যের বিকিরণ দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ভেবেছিল, রাত গভীর হওয়ার আগেই সে ঘরে ফিরতে পারবে। কিন্তু উলের মোটা টুপিটা কান পর্যন্ত নামিয়ে ও যখন আবার চোখ রাখল জানালায়, ততক্ষণে বরফ ঢাকা পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে সূর্যটা। শুভ্র চূড়ার ওপাশের আকাশটা রক্তিম। বারমুলা থেকে ছেড়ে আসা শ্রীনগরগামী এই শেষ বাসের একটি সিটও খালি নেই আর। ড্রাইভারের দু সারি পেছনে বসা আদনান সামনের গ্লাস দিয়ে মাইল ফলকের ওপর চোখ রাখল—শ্রীনগর তিন কিলোমিটার। খুব ভালো হতো, যদি বারমুলা থেকে সরাসরি পেহেলগামের বাস পাওয়া যেত। শ্রীনগর পৌঁছে এই বাস ছেড়ে দিয়ে উঠতে হবে পেহেলগামের বাসে। পেহেলগাম এবং অনন্তনাগের মাঝামাঝি গুরিহাকায় ওদের বাড়ি। পথিমধ্যে তুষার এবং চেকপোস্ট যদি বৈরিতা না করে, পূর্বাভিজ্ঞতা বলছে, শ্রীনগর থেকে পেহেলগামের শেষ বাসটা ধরা অসম্ভব হবে না। জানুয়ারির মাইনাস ডিগ্রি সেলসিয়াসের শীতে কাশ্মীরের বাস জার্নির প্রধান বিড়ম্বনার নাম তুষারপাত। ইদানীং এর সাথে যুক্ত হয়েছে মিলিটারি, প্যারামিলিটারি ও পুলিশের উৎপাত।
আদনানের মতো মারিয়ামের মাথায়ও তখন তুষারপাত এবং চেকপোস্টের দুশ্চিন্তা। লাল হিজাবের ওপর উলের মাফলারে কান পেঁচিয়ে ও বিড়বিড় করে—আল্লাহ, তুমি সর্বশক্তিমান।
প্রতি বছর এই দিনটার সূর্য ওঠে বিষণ্ন তার বার্তা নিয়ে। সাত বছর আগের এই দিনে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মারিয়ামের বাবা–মা। শ্রীনগর হজরতবাল মসজিদে মান্নত দিয়ে তারা বাড়ি ফিরছিলেন। মারিয়ামের বয়স তখন বারো। আগে পরে কোনো ভাইবোন নেই। সেদিন একটি ছেলের আশায় স্বামীর সাথে হজরতবাল মসজিদে মান্নত নিয়ে গিয়েছিলেন আরজুমান্দ। শ্রীনগর থেকে ঘরে ফেরা হয়নি তাদের। খোশরাগপোরার বরফ ঢাকা পিচ্ছিল রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের বাস খাদে পড়ে যায়, দুই হাজার ফুট নিচে। একটি বাস সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে খেয়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে পড়ছে, আর সেই বাসের ভেতর বাঁচার আকুতি নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে বাবা–মা, একটু বড় হয়ে দৃশ্যকল্পটি যখনই ভেবেছে মারিয়াম, বেদনায় নীল হয়ে গেছে মুখ। একটি প্রাণ সৃষ্টির আগেই আল্লাহ তার মৃত্যু নির্ধারণ করে রাখেন। মেয়েকে একলা রেখে বাবা–মার দ্রুত বিদায়ে চাপা কষ্ট আছে, কিন্তু আল্লাহর এই সিদ্ধান্তে আক্ষেপ নেই মারিয়ামের। তার আক্ষেপ ভিন্ন জায়গায়। বাবা–মার দেহ কবরের মাটি পায়নি। লাশ উদ্ধারে বারমুলা পুলিশ প্রশাসনের প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না যদিও। কিন্তু বরফ কেটে রাস্তা থেকে দুই হাজার ফুট নিচে নামতে বড্ড দেরি হয়ে যায় তাদের। ততক্ষণে কাশ্মীরের ভুবনবিখ্যাত তুষারপাত গিলে ফেলেছে আস্ত একটি বাস এবং তার যাত্রীদের। বাবা–মাকে হারানোর পর এই সাত বছরে অসংখ্য পর্যটক দেখেছে মারিয়াম। সারা দুনিয়া থেকে তারা পৃথিবীর স্বর্গ দেখতে ছুটে আসে কাশ্মীরে। কত বিচিত্র সেসব মানুষ! কত বিচিত্র তাদের ভাষা! যারা শীতে আসে, তাদের প্রধান আকর্ষণ থাকে বরফে। পেহেলগামের বরফের রাজ্যে অসংখ্য বৃদ্ধকে সে শিশু হয়ে উঠতে দেখেছে। পর্যটকদের উল্লাস কেবল বেদনাই বাড়িয়েছে মারিয়ামের। গোপনে চোখ মুছে সে ফিসফিস করেছে—কাঠগোলাপের যে শুভ্রতায় তোমরা বিনোদন খুঁজে পাও, আমার কাছে তা প্রিয়জনের কাফন।
আরজুমান্দ বলতেন, সৌভাগ্যবান সেইসব বাবা–মা, মৃত্যুর পর সন্তানেরা যাদের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়; সুরা ফাতেহা, ইয়াসিন পড়ে। শেষের দিকে একটি ছেলের জন্য তিনি যে পাগলপারা হয়ে মসজিদে–মাজারে মানত নিয়ে ছুটছিলেন, কবরে শুয়ে নিয়মিত জিয়ারত পাবার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল তার অন্যতম কারণ। তিনি মারিয়ামকে বলতেন, তুই তো মেয়ে, বিয়ে হয়ে কোথায় না কোথায় থাকবি। একটি ছেলে থাকলে বাবা–মার কবর সে দেখেশুনে রাখতে পারবে। সেই ছেলে পাওয়ার প্রচেষ্টার ভেতরেই মারা গেলেন তিনি। এমন অভাগা মরণ, কাফনের কাপড় জুটল না, কবরের চিহ্ন পর্যন্ত রইল না। এ–ই কি তবে জগতের নিয়ম—অতি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু মানুষের হাত ফস্কে যায়?
মারিয়াম ছেলে নয়। বাবা–মার লাশের সৎকার সে করতে পারেনি। তবু প্রতি বছর এই দিনটা এলে আদনানের সাথে সে ছুটে যায় শ্রীনগর–বারমুলা রোডের সেই জায়গায়, যেখান থেকে বাসটা ছিটকে পড়েছিল। গভীর খাদের দিকে তাকিয়ে সে সুরা ফাতিহা পড়ে। তখন তার বাদামি চোখে টলমল করে কান্না। আর আদনান আলতো করে ওর কাঁধ ছুঁয়ে সান্ত্বনার বাণী আওড়ায়। একটি মেয়ের এতিম হওয়ার দুঃখ আদনানকেও বিমর্ষ করে।
শৈশবে বাবা–মার সাথে দু বার হজরতবাল মসজিদে গিয়েছিল আদনান। মারিয়ামের বাবা–মার মতো সেটাও হয়তো কোনো এক মান্নতের সফর ছিল। কীসের মান্নত, আজ আর তা মনে নেই আদনানের। ডাললেকের পশ্চিম তীরে অবস্থিত কাশ্মীরের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী মসজিদ হজরতবালে কত রকম মান্নত নিয়ে যে যায় লোকেরা! যাবেই বা না কেন, যে মসজিদের সাথে জড়িয়ে আছে স্বয়ং মহানবীর দৈহিক স্মৃতি, নবীপ্রেমিকদের কাছে সেই মসজিদ পুণ্যস্থান হতে দ্বিতীয় কোনো কারণ লাগে না। দাদাজানের মুখে শুনেছে আদনান, প্রায় তিনশ বছর আগে নবী–বংশের এক পুণ্যবান লোক ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে হেজাজ থেকে এসেছিলেন এই ভারতবর্ষে, বসবাস শুরু করেছিলেন দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরে। মদিনা থেকে তিনি একাই আসেননি, সঙ্গে এনেছিলেন মহানবীর দু গাছি পবিত্র চুল। মহানবীর পুণ্যস্মৃতি তিনি আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন নিজের কাছে। এই পুণ্যবান মানুষটার মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সূত্রে মহানবীর পবিত্র চুলের জিম্মাদার হন তার পুত্র সাইয়্যেদ হামিদ। ১৬৯২ সালে সাইয়্যেদ হামিদ দিল্লি গমন করেন এবং নূরুদ্দিন নামক এক কাশ্মীরি ব্যবসায়ীর সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। জীবন সায়াহ্নে সাইয়্যেদ হামিদ মহানবীর পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন বন্ধুকে দিয়ে যান। ততদিনে বন্ধু নূরুদ্দিনেরও ডাক পড়ে কবরের দেশে। ইন্তেকালের আগে এই পবিত্র আমানত তিনি সোপর্দ করে যান লাহোরের বিখ্যাত সুফি–সাধক খাজা মাদানিশের হাতে। পরবর্তীকালে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে খাজা মাদানিশ কাশ্মীর হিজরত করেন এবং ডাললেকের পাশে স্থাপন করেন এক খানকা। এই খানকাতেই তিনি মহানবীর অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করেন। কিছুদিনের মধ্যে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে মহানবীর পবিত্র চুলের খবর। সারা ভারত থেকে হাজার হাজার নবীপ্রেমিক—হোক তারা মুসলমান অথবা হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ অথবা শিখ—ছুটে আসে এই খানকায়, স্বচক্ষে মহানবীর দৈহিক চিহ্ন দেখবার ব্যাকুলতায়। এরপরও জায়গাটি তীর্থস্থানে পরিণত না হলে তা হবে ঘোরতর অন্যায়। সেই অন্যায় ঘোচাতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন মোগল সম্রাট শাহজাহান। জায়গাটির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি তাজমহলের আদলে খানকার পাশে নির্মাণ করেন এক মসজিদ। মহানবীর মূল্যবান চুলের স্মরণে মসজিদটির নাম হয়ে যায় মসজিদে হজরতবাল।
বাবা–মার সাথে দ্বিতীয়বার হজরতবাল মসজিদে যাওয়ার স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে আদনানের। আগরবাতি, লোবানকাঠি ও আতরের মাথা ঝিমঝিম করা গন্ধ এখনো ঘোরাঘুরি করে ওর নাকের আশেপাশে। ও দেখেছিল শ্রদ্ধায় অবনত অসংখ্য নারী–পুরুষকে, যারা মসজিদের ফটকের গায়ে পরম ভক্তিতে চুম্বন করছে, মাথা ছোঁয়াচ্ছে, হাত বোলাচ্ছে। মসজিদের শ্বেতপাথরের সাদা দেয়াল নবীপ্রেমিকদের ঠোঁট ও হাতের স্পর্শে হয়ে গেছে কালো। মিম্বরের সামনে সাদা পাথরের মোজাইক করা চারটি থাম, সেই থামের গায়েও নবীর ভালোবাসার স্মারক রচিত হতে দেখেছিল ও। নারী–পুরুষেরা একে একে যাচ্ছিল ওই থামের কাছে এবং সন্তান যেভাবে জড়িয়ে ধরে মায়ের গলা, সেভাবে তারা জড়িয়ে ধরছিল শীতল থামকে। চুমু খাচ্ছিল, হাত বোলাচ্ছিল, কেউ কেউ থামের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করছিল। মিম্বরের দু পাশে তালাবদ্ধ দুটি লোহার দরজা। দরজার ওপাশেই সংরক্ষিত আছে মহানবীর মহামূল্যবান শারীরিক নিদর্শন। এই স্মৃতিচিহ্ন দেখার সুযোগ সব সময় মেলে না। যারা দেখতে পায়, তারা নিজেদেরকে জগতের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মনে করে। মারিয়ামের বাবা–মা সেদিন মান্নত করতে না গেলে কি আজ তারা বেঁচে থাকতেন? আদনান বিড়বিড় করে—নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিটি সিদ্ধান্তের মাঝেই রয়েছে কল্যাণ। আমাদের উচিত তার দাসত্ব করে যাওয়া।
উপত্যকার বাসগুলো সব সময় চায়ের দোকানের মতো আড্ডামুখর থাকে। চাকরি অথবা ব্যবসার নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে এরা খুব সহজেই একে অন্যের পরিচিত হয়ে ওঠে। আর জানা কথা—পরিচয় মানুষকে সর্বদা গল্পের দিকে আকর্ষণ করে। ফলে কাশ্মীরের একেকটি বাস হয়ে ওঠে একেকটি আড্ডাখানা। কিন্তু আজ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই ও ব্যতিক্রম দৃশ্য দেখছে। শীতের পাতাঝরা গাছের মতো সবকিছু থমথমে। খুব দরকার না পড়লে কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। যেন একান্ত ঠেকায় পড়ে তারা রাস্তায় বেরিয়েছে এবং যতক্ষণ না ঘরে ফিরছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই। ১৯৮৭ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পর থেকেই উত্তাল কাশ্মীর। নির্বাচনকে ঘিরে নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছিল কাশ্মীরিরা। মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের পক্ষে তারা রাতদিন কাজ করেছিল। আদনানের দাদাজান আবদুল লতিফ নির্বাচনী প্রচারণায় পুরো পেহেলগাম একাকার করে ফেলেছিলেন। না কোনো পদের লোভ, না কোনো অর্থের লালসা—কেবল স্বাধীকারের চেতনা থেকেই তিনি অহোরাত্র ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের এই পথ বেছে নিয়েছিলেন। এবং তার মতো আরো অনেকেই। সেই দিনগুলোতে জনতার যে জোয়ার আবদুল লতিফ দেখেছিলেন, ভেবেছিলেন, মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই আত্মবিশ্বাস তার একার নয়, কাশ্মীরের প্রতিটি জনগণের ছিল। কিন্তু পেশিশক্তি আর কূটচালের কাছে হেরে যায় দেশপ্রেমিক কাশ্মীরিরা। মিলিটারি, প্যারামিলিটারি, সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের নির্লজ্জ সহযোগিতায় নজিরবিহীন কারচুপির ঘটনা ঘটে নির্বাচনে। মুসলিম ফ্রন্টের প্রতিনিধিদেরকে গ্রেফতার করা হয়। সমর্থকদের ওপর চালানো হয় সন্ত্রাসী হামলা। বিপুল জনসমর্থন পাওয়ার পরও ইয়াসিন মালিককে মারধর করে সরকার দলীয় পোলিং এজেন্ট। নির্বাচনে জয়ী দেখানো হয় কংগ্রেস–কনফারেন্স জোটকে। নিজেদের মতো করে মাতৃভূমি সাজানোর আরো একটি স্বপ্ন নিমেষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় কাশ্মীরিদের। সেই থেকে ফুঁসছে তারা। ভারতীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলছে তাদের ক্ষোভের আগুন। বিক্ষুব্ধ জনতাকে দমন করতে পৃথিবীর ভূস্বর্গে শকুন নামার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে নেমেছে সামরিক বাহিনী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসেছে চেকপোস্ট। চেকপোস্টে প্রদর্শনের জন্য জামা–জুতোর মতো আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হয় কাশ্মীরিদের। নয়তো শিকার হতে হয় নির্যাতনের।
প্রহসনের নির্বাচন–সৃষ্ট উত্তেজনা মাঝখানে স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কিন্তু কয়েকদিন আগে মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে খ্যাত জগমোহনকে কাশ্মীরের গভর্নর নিযুক্ত করেছে ভারত সরকার। জগমোহন ইস্যুতে উত্তাল সেই দিনগুলো ফিরে এসেছে আবার। জগমোহনের নিযুক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে শ্রীনগরে। পরশু রাতে শ্রীনগরের প্রতিটি বাড়িতে হামলা করেছে প্যারামিলিটারি। বিক্ষোভ ঠেকাতে যুবক ছেলেদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেছে তারা। এতে প্রতিক্রিয়া হয়েছে আরো ভয়াবহ—ফুটন্ত তেলে যেন পানির ছিটা পড়েছে। জনতার ক্ষোভ বেড়েছে বৈ কমেনি। এখন তারা জগমোহনের অপসারণ চায়।
আজ ভোরে মারিয়ামকে নিয়ে আদনান যখন বের হচ্ছিল, বাড়ির সবাই বাধা দিয়েছিল। বিশেষ করে দাদাজান, ফজরের নামাজের পর থেকেই যিনি কানে রেডিও ধরে বসে ছিলেন, ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি ওয়ার্ল্ড প্রচ্ছন্নভাবে তাকে নির্দেশ করছিল—এমন দিনে আপনজনদের ঘরে রাখ। দাদাজানের নিষেধ–বারণের পরোয়া করেনি আদনান। মারিয়ামকে খোশরাগপোরা নিয়ে যাবে বলেই সে কদিন আগে ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি এসেছে। এই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকে মারিয়াম। বাবা–মার মৃত্যুস্মৃতি জিয়ারত করতে না গেলে মেয়েটি ভীষণ দুঃখ পাবে। মারিয়াম কোনো কারণে দুঃখে পুড়ুক, আদনান চায় না। তাছাড়া আদনান কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দাদাজান যে গোলযোগের আশঙ্কা করছেন, অমন গোলযোগ সে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করে। মিছিল–মিটিং–পিকেটিং এই উপত্যকার চিরসখা।
মুরব্বিদের কথা অমান্য করার কারণেই হয়তো দুর্ভোগ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে আদনানকে। বাড়ি থেকে খোশরাগপোরা চার ঘণ্টার পথ, অথচ চেকপোস্টের আধিক্যে সেই পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সাত ঘণ্টায়। মৃত্যুস্মৃতি জিয়ারত করে এতক্ষণ তাদের বাড়িতে থাকবার কথা ছিল, অথচ এখনো তারা পথের মাঝে খাবি খাচ্ছে। আজ বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা তাই নিয়ে রয়েছে ঘোর সংশয়। সন্ধ্যা নামছে, ইদানীং সন্ধ্যার আঁধারের সাথে নেমে আসছে আরো একটি অন্ধকার, তার নাম কারফিউ। শ্রীনগর গিয়ে ওরা যদি কারফিউয়ের মুখে পড়ে, কীভাবে বাড়ি যাবে ভেবে গলা শুকিয়ে যায় আদনানের। একাকী থাকলে এতটা চিন্তিত হতো না ও, এই মুহূর্তে ওর যত দুর্ভাবনা মারিয়ামকে ঘিরে। এই শ্বাপদের দেশে সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে পথে বেরোনোর মতো ঝুঁকি আর কিছুতে নেই। ও মমতা নিয়ে আড়চোখে মারিয়ামের দিকে তাকায়। মারিয়ামের বাদামি চোখে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার ছায়া ওর বিষণ্ন মন আরো খারাপ করে তোলে।
ওর দুর্ভাবনাকে আরো বেশি প্রকট করতেই কিনা কে জানে, উল্টো দিক থেকে ছুটে আসতে দেখা যায় একটি আর্মি ট্রাক। এই সন্ধ্যাতেই ট্রাকের চোখ ঝলসানো আলো দৈত্যের চোখের মতো জ্বলছে। আদনান তিনবার সুরা ইখলাস পড়ে। পাহাড়ের ওপর একাকী দাঁড়িয়ে থাকা চিনার গাছের মতো আর্মির ট্রাকটি পথরোধ করে ওদের। পিচঢালা রাস্তায় কর্কশ শব্দ তুলে থেমে যায় বাস। যাত্রীদের মনে হয়, শব্দের ওই উৎস গাড়ির চাকা নয়, মেশিনগান। ভয়ে তাদের মুখগুলো চুপসানো। মারিয়াম হিজাব ঠিক করে ভয়ার্ত চোখে তাকায় আদনানের দিকে। দূরে বরফের টুপি পরা পর্বত এবং তার গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন গাছের সারি সন্ধ্যার এই ঝাপসা আঁধারেও দৃশ্যমান। শুভ্র পর্বত ও পাইনের বন আজ আর আকৃষ্ট করে না আদনানকে। ও কম্পিত হাতে মারিয়ামের আঙুল স্পর্শ করে ভরসা দেয়—ভয় পেয়ো না।
বাস থামতেই উর্দিপরা দুজন সৈনিক মেশিনগানের নল উঁচিয়ে এসে দাঁড়ায় দরজার মুখে। অমনি ঝুপ করে এমন এক নীরবতা নেমে আসে বাসে, সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা অফিসারের বুটের মচমচ শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। আদনানের সামনের সিটের প্রৌঢ় দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ নেয় বারবার। ওদিকে অফিসারের ভয়ংকর শীতল চোখ ঘুরতে থাকে প্রতিটি যাত্রীর মুখের ওপর। পেছন থেকে কোনো এক বৃদ্ধের ভাঙা ভাঙা আয়াতুল কুরসির ধ্বনি ভেসে এলে বৃদ্ধের ওই আয়াতুল কুরসির ভেতর আদনান খুঁজে পায় দাদাজানের কন্ঠস্বর। অফিসার হঠাৎ গর্জে উঠে কঠিন গলায় বলে, শ্রীনগর শহরে কেউ থামবে না। সবাই যার যার বাড়ি চলে যাবে। মিছিলে যোগ দিলে সবগুলোকে গুলি করব।
ডিউটি শেষ করে নামার জন্য বাসের পা–দানিতে পা রাখে অফিসার। মুখের বদলে তার ইউনিফর্ম ঢাকা পিঠটা ভেসে ওঠে যাত্রীদের চোখে। এতক্ষণ শ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিল সবাই। অফিসারের প্রস্থানে চেপে রাখা নিঃশ্বাস যখন একযোগে ছাড়তে যাবে সবাই, ঠিক তখনই আবার ঘুরে যায় অফিসারের মুখ। কী ভেবে সে আদনানের সিটের কাছে এসে দাঁড়ায়—নাম কী তোমার?
আদনান।
বাবার নাম?
ফয়জুল্লাহ
বাড়ি কোথায়?
গুরিহাকা।
জেলা?
পেহেলগাম।
কী করো?
পড়াশোনা।
কোথায়?
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আইডি কার্ড দেখাও।
অনিচ্ছা নিয়ে আদনান আইডি কার্ড বের করে। ভেতরে ভেতরে ও গজরায় কিন্তু বিরক্তির বিবমিষা প্রকাশ করবার উপায় নেই। মারিয়াম ফিসফিস করে দরুদ পড়ে আর দোয়া করে—হে আল্লাহ, তুমি আমাদের রক্ষাকারী। হে নবী, তুমি আমাদের হেফাজতকারী।
মারিয়ামের দোয়ার প্রভাবেই কিনা কে জানে, অফিসারটি আর কোনো কথা না বলে নেমে যায় বাস থেকে। যখন বাস স্টার্ট করতে যাবে, ঠিক তখনই আবার ফিরে আসে সে। মারিয়াম ঢোক গিলতে গিয়ে অনুভব করে, তার গলার ভেতর তেতো তেতো ভাব। সে অসহায় চোখে জানলার ওপাশের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার ধারে একটি কাঠের বাড়ি, তার সামনে একাকী দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঠবাদাম গাছ। গাছের নিচে জমাট বাঁধা অন্ধকার। মারিয়ামের চোখে সেই অন্ধকারের ছায়া পড়ে। অফিসার মারিয়ামের দিকে ইশারা করে আদনানের উদ্দেশে বলে, এই লাড়কি কী হয় তোমার?
ছোটবোন।
বোনকে নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাবে। মিছিলে যোগ দেয়ার চেষ্টা করলে আমরা সৈন্যরা তোমাকে খুঁজে নিয়ে মারবে।
বাস আবার ছাড়লেও আগের সেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসে না আর। শবযাত্রার মতো নীরবতা বিষণ্ন করে তোলে বাসের বিশ জানুয়ারির সন্ধ্যা। যাত্রীদের চোখেমুখে অনিশ্চিত যাত্রার শঙ্কা। আদনান বুঝে যায়, শ্রীনগরে আবার শুরু হয়েছে বিক্ষোভ।
লালচকের কাছাকাছি আসতেই বাধার মুখে পড়ে বাস। ততক্ষণে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তার দু পাশের দোকানের ঝাপগুলো নেমে গেছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়। ফুটপাতের পাশে খদ্দেরের আশায় আপেলের ঝুড়ি নিয়ে সব সময় বসে থাকে কয়েকটি ভাসমান দোকান। আজ দোকানগুলো নেই। কলার সেই পরিচিত ভ্যানটিও অদৃশ্য। কুয়াশার আধিপত্যে স্ট্রিট লাইটের দুর্বল আলোয় সামনের রাস্তা ক্যামন ভুতুড়ে। সেই ভুতুড়ে রাস্তায় জনতার জোয়ার। আদনানরা ভয় পাচ্ছিল তুষারপাত আর চেকপোস্টের, অথচ তাদের বাস থামিয়ে দিল জনসমুদ্রের মিছিল। জগমোহনের অপসারণ এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবিতে শ্রীনগরের নারী–পুরুষ মশাল হাতে নেমে এসেছে রাজপথে। মশালের আলোয় চকচক করছে তাদের দীপ্ত চোখ। বারুদের মতো বাজছে তাদের কণ্ঠ। আদনানের হাত মারিয়ামকে ডিঙিয়ে সরিয়ে দিল জানলার কাচ। আর অমনি, শীতল হাওয়ার সাথে সাগরের ঢেউয়ের মতো মুখের ওপর আছড়ে পড়ল শ্লোগান :
আমরা কী চাই—আজাদি!
আমাদের দাবি—আজাদি!
লড়কে লেঙ্গে—আজাদি!
ছিনকে লেঙ্গে—আজাদি!
কী বিপুল বিক্রমে বাজাছে ওই দীপ্ত শানিত শব্দ—আজাদি আজাদি। এই উপত্যকার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে খোদিত হয়ে আছে তুমুল প্রার্থিত ওই শব্দ—আজাদি। আদনানের শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে শিহরণ বয়ে গেল। ওর স্পোর্টস জ্যাকেটে ঢাকা লোমকূপ খাড়া হয়ে গেল উত্তেজনায়। এক মুহূর্তের জন্য ও বিস্মৃত হলো গন্তব্য। মারিয়ামকে যে নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে গন্তব্যে, যার দূরত্ব প্রায় ষাট কিলোমিটার, অথচ এখনই রাত নেমে গেছে এবং এই বরফ জমা শীতে বাস বন্ধ হয়ে গেলে এই জার্নি হবে পুলসিরাতের মতো ভয়ঙ্কর—যাত্রাপথের এই সকল অনিশ্চয়তা এবং দুশ্চিন্তা আদনানের মস্তিষ্ক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিল আজাদির ওই শ্লোগান। মিছিলের দিকে তাকিয়ে আদনান চোয়াল শক্ত করল। ছোকরা হেলপার বাসের গায়ে সজোরে থাপ্পড় মেরে বলল, বাস আর যাবে না। মিছিলে রাস্তা ব্লক।
নিচ থেকে কেউ একজন খেঁকিয়ে উঠল—রাস্তা মিছিলে ব্লক করেনি। রাস্তা ব্লক করেছে আর্মি।
আদনান পরিহাসের সাথে বিড়বিড় করল—কাশ্মীর পৃথিবীর এমন ভূস্বর্গ, যেখানে চোখ মেললে প্রকৃতির সাথে অনিবার্যভাবে ধাতব মেশিনগানও দেখা যায়।
আদনানের এই আক্ষেপ মিথ্যা নয়। আটাশ বছর পরে, ততদিনে এই মৃত্যুপুরী আদনানের জীবননদীর স্রোত থামিয়ে না দিলে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যায় থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা জার্নাল পড়বার সুযোগ ঘটবে তার। সেই জার্নাল বিশ্ববাসীকে জানাবে, জম্মু এবং কাশ্মীরের প্রতি বর্গমাইলে নিযুক্ত আছে একশ জন ভারতীয় সৈনিক এবং প্রতি দশজন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে সক্রিয় আছে একজন সামরিক সদস্য। অথচ সমগ্র ভারতজুড়ে সৈনিক নিযুক্তির গড় ৮০০ : ১।
যেসব যাত্রীর গন্তব্য ছিল শ্রীনগর, রাস্তা অবরোধের খবর শুনে তারা ঝুপঝাপ করে নেমে গেল লালচকে। আর আদনানদের মতো অল্প কয়েকজন যাত্রী, যাদের গন্তব্য বাসস্ট্যান্ড, তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল। অসহায়ের মতো তারা চারপাশে তাকাতে লাগল আর ভাবতে লাগল করণীয়। ওদিকে হেল্পারের কণ্ঠে তাড়া—সবাই নামেন। বাস আর যাবে না।
মেশিনগান কাঁধে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ইউনিফর্মধারী দুজন আর্মি। তাদের জলপাই রঙের হেলমেট এই অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছিল। তবে কী এক অদ্ভুত কারণে মেশিনগান দুটো জ্বলজ্বল করছিল মারিয়ামের চোখে। সেদিকে ইশারা করে চুপসানো গলায় মারিয়াম বলল, এখন কী করবে? বাস তো যাবে না। ওদিকে শহরের অবস্থাও থমথমে।
মারিয়ামের দুশ্চিন্তা স্পর্শ করল না আদনানকে। ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আদনান। মিছিল তাকে ডাকছে। তার রক্তের ভেতর চনমন করছে উষ্ণতা। আজ সে বাড়ি ফিরবে না।
মারিয়াম আঁতকে ওঠে—বাড়ি ফিরবে না মানে? সারারাত মিছিল করবে নাকি? আমি কোথায় থাকব?
তুমিও মিছিলে আমার সঙ্গী হবে। বলেই সে মারিয়ামের হাত ধরে টান দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারিয়াম নিজেকে আবিষ্কার করে ঠান্ডা হাওয়ার ফুটপাতে। আদনানের মুঠোর ভেতর তার কব্জি। মারিয়ামের ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা দেখে আদনান ঠোঁট টিপে হাসছে। এই শ্রীনগর শহরটি এমন, এখানে এলে শত দুর্বিপাকেও আদনান উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এখানেই যে ওর ক্যাম্পাস!
মারিয়াম কটমট করে তাকিয়ে বলে, আর্মির চেয়েও তুমি বড় গুণ্ডা। এভাবে কেউ হ্যাঁচকা টান মারে নাকি! আরেকটু হলে হাতটা আমার খুলেই যেত। দ্রুত নামার ধকলে তার গোলাপি মুখ পাকা চেরির মতো রক্তিম হয়ে উঠেছে। মৃদু মৃদু কাঁপছে ঈগল–ডানার মতো বঙ্কিম ভ্রু। কৃত্রিম রাগে সে আদনানের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। একটু থেমে বলে, এমন গুণ্ডামি করলে দাদাজানকে বলে দেব কিন্তু।
রসিকতা ছেড়ে আদনান সিরিয়াস হয়। ওর পরিকল্পনার কথা জানায় মারিয়ামকে। এই রাতে বাড়ি ফেরা হবে দুর্লঙ্ঘ পর্বত ডিঙানোর চেয়েও কঠিন। আদনান চাচ্ছে রাতটা ওর ক্যাম্পাস হোস্টেলে কাটাতে। তবে তার আগে অবশ্যই মিছিলে অংশ নেবে।
মারিয়াম চেঁচিয়ে ওঠে—আমি তোমার সঙ্গে ছেলেদের হলে রাত কাটাব? পাগল নাকি!
শ্রীনগরে আমার এক বান্ধবী আছে, ফাতেমা ওর নাম। ডাললেকের পাশেই ওদের বাড়ি। তুমি ফাতেমার কাছে থাকবে আর আমি হলে। কাল সকালে বাড়ি ফিরব।
শহরের এই দুর্যোগে মারিয়ামের মুখের আলো আগেই নিভে গিয়েছিল। এখন ফাতেমার প্রসঙ্গ উঠতেই ওর চেহারায় রাত্রি নেমে আসে। ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। ফাতেমার বাড়িতে আমি থাকতে পারব না।
মারিয়ামের মনে বয়ে চলা ঈর্ষা–স্রোতের তরঙ্গধ্বনি শুনতে পায় আদনান। ও হাসতে হাসতে বলে, ফাতেমাকে তুমি ঈর্ষা করছ। ও আমার সাথে পড়ে। শুধুই ক্লাসফ্রেন্ড।
তুমি আমার সামনে কখনো ফাতেমার নাম উচ্চারণ করবে না।
আচ্ছা করব না। এবার চলো তো মিছিলে।
মিছিল ততক্ষণে লালচক অতিক্রম করে মাইসুমার দিকে যাচ্ছে। আজাদির স্বপ্নে বিভোর আদনান মারিয়ামের হাত ধরে মিছিলে শামিল হয়। সঙ্গে একটি মেয়ে থাকার কারণে আদনান মিছিলের সম্মুখভাগে যেতে পারে না। বরং মিছিলের যে পাশটায় নারীদের সারি, সেখানে মারিয়ামকে ঢুকিয়ে দিয়ে ও তার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। একটু পর আদনান তার আশপাশের অংশটুকুর নেতৃত্ব দিতে শুরু করে এবং সে নারীদের উদ্দেশে শ্লোগান তোলে—আমাদের বোনদের দাবি কী?
বোনেরা গলা ফাটিয়ে প্রত্যুত্তর করে—আজাদি।
আমাদের মা’দের দাবি কী?
মায়েরা গলা ফাটিয়ে প্রত্যুত্তর করে—আজাদি।
আমাদের কন্যাদের দাবি কী?
কন্যারা গলা ফাটিয়ে প্রত্যুত্তর করে—আজাদি।
আদনান এবার এক মায়ের কোল থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিয়ে মাথায় তুলে শ্লোগান দেয়—আমাদের সন্তানদের দাবি কী?
মায়েরা, বোনেরা এবং কন্যারা সমস্বরে বলে—আজাদি।
শ্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে আদনান মারিয়ামের দিকে তাকায়। লাল হিজাব এবং কালো পিরহানে মারিয়ামকে সত্যিকারের যোদ্ধাদের মতো লাগে। ওর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত যখন শ্লোগানের জন্য উপরে উঠছে, আদনানের হৃদয়ে লিডার নদীর শুভ্রফেনিল ঢেউ উঠছে আবেগের। যে জাতির নারীরা আজাদির জন্য ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, সে জাতি পরাধীন থাকতে পারে না। ও মারিয়ামের দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে শ্লোগান তোলে—আমাদের স্ত্রীদের দাবি কী?
নারীরা প্রত্যুত্তর করে—আজাদি।
ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে। ঘাতকের মতো নিকষ কালো অন্ধকার জেঁকে বসছে উপত্যকায়। সেই নিকষ অন্ধকারে মাইসুমার রাস্তায় জ্বলজ্বল করছে একগুচ্ছ আলোর মশাল। মশালের দীপ্ত আলোয় কাশ্মীরি যুবক–যুবতীদের ফর্সা মুখ দেখাচ্ছে পাথরের মতো শক্ত। আদনান খেয়াল করে, মশালের প্রতিবিম্ব পড়ে মারিয়ামের চোখ জোড়া যেন পরিণত হয়েছে আরেক মশালে, আজাদির স্বপ্নে যে চোখে ছুটছে আলোর ফুলকি। পরিস্থিতি একদিন যে মারিয়ামের সঙ্গে মিছিল করবার সুযোগ এনে দেবে, কোনদিন ভাবেনি আদনান। মারিয়ামের উদ্দীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বুকের ভেতর আনন্দের ঝিলাম নদী বয়ে যায়। ও স্বপ্ন দেখে, মারিয়াম একদিন বধূ হয়ে ওর ঘরে আসবে। হায়েনার হিংস্র থাবাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওরা পেহেলগামের সবুজ গ্রামে পাতবে সুখের সংসার। দুজন মিলে নির্মাণ করবে স্বাধীনতার সৌধ। সন্তানদের ভেতর ওরা ছড়িয়ে দেবে বিপ্লবের চেতনা। স্বাধীন মাতৃভূমির উজ্জ্বল সূর্য ওরা দেখে যেতে না পারলেও সন্তানেরা যেন সেই সূর্য ছিনিয়ে আনতে জীবন বাজি রাখে—এমন এক প্রজন্ম রেখে যেতে চায় আদনান। মারিয়াম হবে তো ওর সঙ্গী?
মোড় ঘুরে মিছিলটি গাউকাদাল সেতুর দিকে এগোয়। সেতু পার হয়ে এক দরবেশের মাজার। উত্তেজনায় দরবেশের নামটি মনে করতে পারে না আদনান। দরবেশের সেই মাজার জিয়ারত করে ওরা আবার ফিরে আসবে শহরে। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে রাজধানী শ্রীনগরের সকল শ্রীই আদনানের নখদর্পণে। মিছিলটি সেতুতে উঠতে গেলে ও সবাইকে সতর্ক করে—তোমরা সাবধানে ওঠো। এটা পুরনো কাঠের সেতু। সবাই একসাথে চাপলে সেতু ভেঙে পড়তে পারে।
মারিয়াম সেতুর নিচে ঝিলামের কুলকুল ধ্বনি শুনতে পায়। জানুয়ারির এই শীতে ঝিলামের পানি জমাট বেঁধে বরফ। শুধু মাঝখানে নালার মতো একটুখানি পানির ধারা বহমান। সেই সরু পথে গলিত পানির চাপ তুলনামূলক বেশি। অন্ধকারেও জলধারার দুর্বিনীত স্রোত কল্পনা করতে পারে মারিয়াম।
সেতুর ওপাশে যমদূতের মতো ঘাপটি মেরে আছে প্যারামিলিটারি ও সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স—জানত না বিক্ষোভকারীরা। কিংবা যারা জানত, তারা ভাবতেও পারেনি এই অন্ধকারে সৈন্যদের মেশিনগান রক্তনেশায় মেতে উঠবে। বিক্ষোভকারীরা যখন ভঙ্গুর সেই কাঠের সেতুতে উঠল, অমনি এক সঙ্গে গর্জে উঠল তাদের মেশিনগান। সূচীত হলো কাশ্মীরের প্রথম গণহত্যার।
গুলির শব্দ কানে আসতেই সবার আগে মনে পড়ল মারিয়ামের কথা। মারিয়াম মারিয়াম বলে চিৎকার করে আদনান ছুটে গেল মেয়েদের সারির দিকে। ততক্ষণে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে বিক্ষোভকারীরা। তাদের হাত থেকে ছিটকে গেছে মশাল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে গাউকাদাল সেতু। আতঙ্কিতদের চিৎচার–চেঁচামেচি আর আহতদের আর্তনাদে যেন সময়ের আগেই নেমে এসেছে কেয়ামত, এই সেতুর ওপর। অন্ধকারে একটি মেয়েকে মনে হলো মারিয়াম। আদনান তার কাছে ছুটতে যাবে, ঠিক তখনই ছলকে ওঠা উষ্ণ রক্ত এসে পড়ল ওর চোখে। কোন হতভাগার শোনিতধারা—বুঝে উঠতে পারল না ও। ততক্ষণে অনেক মানুষের লাশ পড়ে গেছে সেতুর ওপর। মিছিলের সম্মুখভাগ এখন অনেকটাই ফাঁকা। উলের টুপি খুলে ও মুখের রক্ত মুছতে যাবে, ঠিক তখনই শিসকাটা একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হলো ওর ডান বাহুতে। এমন অসহনীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আগে কখনো জারিত হয়নি ওর জীবন। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে লাগলে ও সেতুর রেলিং ধরতে গেল। কিন্তু আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটিতে তখন এমনভাবে কাঁপছিল কাঠের সেতুটি, আদনান রেলিং ধরতে ব্যর্থ হলো। শরীর অবশ হওয়া তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে ও রেলিংয়ের ওপাশে নদীতে পড়ে গেল। পতনের আগে ও শুধু অনুভব করল, উর্দিপরা কয়েকজন সৈন্য সেতুর ওপর উঠে এসেছে, তখনো যারা বেঁচে আছে, তাদেরকে গ্রেফতার করতে।
আজাদির সন্তান (দ্বিতীয় কিস্তি)
এটা সর্বপ্রথম পড়লাম। সাব্বির জাদিদ যেন নিয়মিত হয়।
সাব্বির জাদিদে মুগ্ধ হচ্ছি…
এটা কি গল্প আকারে পড়েছিলাম কোথাও?🤔
ডাক্তার বাড়ি যাচ্ছি, গাড়িতে পড়া শুরু করলাম আজাদির সন্তান যেন আদনান আর মরিয়ামের সাথেই সফর, ফোনে চার্জ কমে আসল, পড়া বন্ধ করলাম মিলিটারির আঘাত গায়ে লাগল। বাড়িতে এসে চার্জ দিয়ে পুরো পড়লাম।
মুগ্ধ হলাম। বাকি পর্ব পড়া শুরু করব।
হারিয়ে গিয়েছিলাম ভূস্বর্গ কাশ্মীরে। পরের কিস্তি দ্রুত আসুক।
চমৎকার
এতো দারুণ!
একটানা পড়ে গেলাম। কেবল মুগ্ধতাই…