আজাদির সন্তান (পঞ্চম কিস্তি)

সাব্বির জাদিদ

আজাদির সন্তান (চতুর্থ কিস্তি)

৪,

মারিয়ামের শোকের মতো এবারের শীতকালটাও দীর্ঘ হলো। উপত্যকার লোকেরা শীতের ঘায়ে ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। জ্বর-সর্দি-ঠান্ডায় আক্রান্তদের সংখ্যাও বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। স্কুল কলেজের অপ্রত্যাশিত ছুটির মেয়াদ বারবার নবায়িত হতে লাগল। আকস্মিক তুষারপাতের কারণে ভেস্তে যেতে লাগল আদনানদের পরিকল্পিত ক্রিকেট ম্যাচের সূচি। ঘরে সময় কাটে না বলে কোনো কোনো রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আদনান বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে। তুষার কেটে কেটে গুরিহাকার সরু রাস্তা ধরে ও চলে যায় পেহেলগাম-অনন্তনাগ প্রধান সড়কে। রাস্তার ধারে সাইকেল থেকে পা নামিয়ে ও বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা রং-বেরংয়ের টুরিস্ট বাস দেখে। কলকাতা, বোম্বে, নয়াদিল্লি থেকে পর্যটকদের বয়ে নিয়ে আসে এসব বাস। কোনো কোনো বাসের জানালায় ও শেতাঙ্গ ইংরেজদের মুগ্ধতায় ভরা মুখ দেখে। কারো কারো গলায় ঝুলতে দেখে ক্যামেরা। একবার স্বল্পবসনা এক ইংরেজ নারী বাস থামিয়ে সাইকেলে বসা ওর ছবি তুলেছিল। যাবার সময় ওর হাতে গুঁজে দিয়েছিল চকলেট আর টিপে দিয়েছিল গাল। ইংরেজ নারীর ওই ক্যামেরার মতো একটি ক্যামেরার বড় শখ আদনানের। কোনোদিন এই শখ পূরণের সাধ্য হবে কি না, জানে না ও। হয়তো সাধ্য এমন সময় হবে, যখন আর শখটাই থাকবে না।

আজ ভেড়ার ঘরে সাইকেলের শব্দ হতেই ছুটে আসে নূরজাহান। সাইকেলের ক্যারিয়ার চেপে ধরে ও আব্দার জুড়ে দেয়—কোথায় যাবে? আমিও যাব তোমার সাথে।

নূরজাহানের এই পিছু লাগা স্বভাব পছন্দ নয় আদনানের। নূরজাহানের কারণে ইতোপূর্বে ওর বহু গোপন অভিযান ভন্ডুল হয়েছে। আজ যখন ও ট্যুরিস্ট বাস এবং ক্যামেরা দেখার বাসনায় সাইকেল বার করছে, তখন নূরজাহানের উপস্থিতি ওকে বিরক্ত করে তোলে। ও কপাল কুঁচকে বলতে যায়, আমার সাইকেলে মেয়েদের চড়া বারণ, ঠিক তখনই নূরজাহানের পেছনে ও ওড়না ঢাকা মারিয়ামের মুখটা দেখতে পায়। গোলাপি পিরহান পরা মারিয়াম দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে আনত নয়নে। অমনি মুখের কথা মুখেই আটকে যায় আদনানের। ও তখন বাক্য বদল করে—তুই গেলে মারিয়ামের কী হবে? বাড়িতে একা একা ওর কি ভালো লাগবে?

কথা গোছানোই থাকে নূরজাহানের—তাহলে ওকেও সঙ্গে নাও।

প্রস্তাব পছন্দ হয় আদনানের। এই অভিযানে মারিয়াম সঙ্গে থাকলে মন্দ হয় না। কিন্তু দুটি মেয়েকে সামনে পেছনে বসিয়ে সাইকেল চালানোর যে অনভ্যস্ত আড়ষ্টতা, তা জাপটে ধরে পরক্ষণে। সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে ও কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। একটু ভেবে সাইকেল রেখে ও বলে, চল যাই।

সাইকেল নেবে না? আমরা সাইকেলে ঘুরব।

আজ না। অন্যদিন।

বাইরে পা রাখতেই শোক সংবাদ বেজে ওঠে মসজিদের মাইকে। দক্ষিণ পাড়ার আবদুল ওয়াহাব দাদা মারা গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে যায়। দুদিন আগে তার অসুস্থতার খবর শুনেছিল আদনান। জ্বর-ঠান্ডা। শীতকালে জ্বর-ঠান্ডা সাধারণ রোগ। কিন্তু এই সামান্য অসুখই যে তাকে কবরে নিয়ে যাবে, ভাবেনি ও। আসলে বয়স হয়ে গিয়েছিল তো! লোকটার সাথে মসজিদে দেখা হতো প্রতিদিন। আদনানকে খুব আদর করতেন তিনি। বলতেন, তোমার বয়সি কাউকে নামাজ পড়তে দেখলে বুক ভরে যায়। প্রায় দিনই তার জোব্বার পকেট থেকে বেরিয়ে আসত লাল টুকটুকে আপেল। আদনানের হাতে গুঁজে দিয়ে বলতেন, খাও। টাটকা। সেই মানুষটা চলে গেলেন আজ। মসজিদে তার বসবার শূন্য জায়গাটায় চোখ পড়লে বুক হুহু করে উঠবে নিশ্চয়।

গন্তব্য বদল করল আদনান। আবদুল ওয়াহাব দাদার বাড়ি দূরে নয়। মসজিদ সংলগ্ন গোরস্তান পার হয়ে পায়ে হাঁটা উঁচুনিচু যে পথটা শিশনাগ খালের কোল দিয়ে চলে গেছে দক্ষিণে, ওই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই একটা মুদি দোকান, মুদি দোকানের পেছনের বাড়িটাই তার। আদনান মৃতবাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। নূরজাহান জানাল—আমরাও যাব। আজ রোদ উঠেছে। ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে জীবন অতিষ্ঠ।

পা তুলতেই সবুর চাচার ভ্যানের সাথে দেখা। অজিতদের কাঠের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অজিতরা কি কোথাও যাচ্ছে? ভ্যানের কাছাকাছি হতেই বাড়ির ভেতর থেকে বাবা-মার সাথে বেরিয়ে এল পরিপাটি অজিত। অজিতের বাবার গায়ে চকচকে ধুতি-পাঞ্জাবি; তার ওপর চাপিয়েছেন কাশ্মীরি উলের শাল। মায়ের পরনে সালোয়ার-কামিজ, কামিজের ওপর খুব নিপুণভাবে জড়ানো চাদর। তার চওড়া সিঁথিতে দৃশ্যমান সিঁদুর, হাতে শাখা। বাবা পেটফোলা দুটো ব্যাগ ভ্যানের ওপর রাখলে আদনানের বুক দুরুদুরু করে ওঠে। ওদের বেড়াতে যাওয়া কি লম্বা সময়ের জন্য? তাই যদি হয় তবে ওদের ক্রিকেট টিম বেশ কিছুদিনের জন্য একজন পেস বোলারের অভাবে ভুগবে। কে না জানে, ওদের দলের সবচেয়ে গতিশীল বোলার অজিত। আর এ কারণেই, দলের অধিনায়ক হিসেবে, আদনানের বুক দুরুদুরু করে ওঠা।

অজিত, কোথায় যাচ্ছিস তোরা? মনের অস্থিরতা একপাশে সরিয়ে জিজ্ঞেস করে আদনান।

তীর্থে যাচ্ছি। এক সপ্তার মধ্যে ফিরে আসব।

আদনানের মনে পড়ে, প্রতি বছর এই সময়টাতে ওরা সপরিবারে জম্মুর কাটরা জেলায় যায় তীর্থে, মাতা বৈষ্ণো দেবীর মুখ দর্শনে। ফিরে আসার পর লাগাতার কয়েক দিন চলে অজিতের জম্মু সফরের গল্প। একই গল্প প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে। তবু, ভিন্ন ধর্মের উৎসব, উপাসনা ও পুরাণের গল্প খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে আদনান, পুনরাবৃত্তির যন্ত্রণা-সহই। কল্পনার চোখে ও দেখে, পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত এক পবিত্র মন্দির, সাপের মতো মোচড় দেয়া পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে যেখানে পৌঁছতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। শুধু মন্দিরই নয়, আদনানের কল্পনাপ্রবণ চোখ দেখতে পায় অনিন্দ্য সুন্দরী এক নারীকে—কালী, লক্ষ্মী ও স্বরসতীর ঐশ্বরিক তেজ প্রবাহের মাধ্যমে যার জন্ম। বাবা-দাদার মুখে অনেক রকম গল্প শুনেছে আদনান। কিন্তু তিন মাতার ঐশ্বরিক তেজস্ক্রিয়ায় এক কন্যার জন্মলাভের গল্প ও কখনো শোনেনি। মাতারা এই কন্যার নাম রাখেন বৈষ্ণো। কন্যাকে তারা সুন্দরী তরুণীর রূপ দিয়ে এক রত্নাকরের বাড়িতে পাঠান। বৈষ্ণো রত্নাকরের বাড়িতে পালিত হতে থাকেন। এক গ্রাম্য মেলায় যুবতী বৈষ্ণোকে দেখে কামনাতাড়িত হয়ে ওঠেন সেই এলাকার বিখ্যাত তান্ত্রিক ভৈরবনাথ। ভৈরবনাথের লালসা থেকে বাঁচতে মাতা বৈষ্ণো ত্রিকুটা পাহাড়ের দিকে চলতে থাকেন। চলার পথে তিনি একটি পাথরের ওপর ক্ষণকালের জন্য দাঁড়ান। পাথর তার পদচিহ্ন ধারণ করে ধন্য হয়। ভক্তরা পাথরের গায়ে আজও খুঁজে পায় মায়ের পবিত্র পায়ের ছাপ। মায়ের পদচিহ্ন ঘিরে সেই জায়গায় আজ গড়ে উঠেছে এক মন্দির। নাম : চরণপাদুকা মন্দির। তীর্থযাত্রীরা এই মন্দিরে মায়ের নামে পূজা না দিলে তাদের তীর্থযাত্রা ব্যর্থ হয়েছে বিবেচিত হয়।

পাথরের গায়ে পদচিহ্ন রেখে এক গুহায় আশ্রয় নেন মাতা বৈষ্ণো। হনুমানকে আদেশ করেন, এই গুহায় আমি নয়মাস তপস্যা করব, যেভাবে মানবশিশু নয়মাস মাতৃগর্ভে আশ্রিত থাকে, তুমি ভৈরবনাথকে প্রতিহত করো।

হনুমান গুহার মুখে ভৈরবনাথকে ঠেকিয়ে রাখেন। এক পর্যায়ে হনুমান তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে মাতা বৈষ্ণো গুহার মুখে বাণ নিক্ষেপ করেন। সেখানে প্রবাহিত হয় এক নদী, আজ যে নদীর নাম বানগঙ্গা। হনুমানজি চলে গেলে মাতা বৈষ্ণো এই নদীতে নিজের চুল ধৌত করেন, বৈষ্ণো দেবীর চুলের স্মরণে এই নদী বালগঙ্গা নামেও পরিচিত ওঠে। এখন বানগঙ্গা বা বালগঙ্গায় স্নান না করলে তীর্থযাত্রীদের গোপন বাসনা পরিপূর্ণ হয় না। আর যে গুহায় বৈষ্ণো দেবী নয়মাস তপস্যায় মগ্ন ছিলেন, কালে কালে সেই গুহার নাম হয়ে যায় অর্ধকুমারী। সেখানেও গড়ে উঠেছে এক মন্দির। সেটাও ভক্তদের তীর্থস্থান।

হনুমানজি চলে যান, কিন্তু তখনো ভৈরবনাথ মাতা বৈষ্ণোকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। বৈষ্ণো দেবী আত্মরক্ষার্থে পাহাড়ের আরো ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে এক গুহার মুখে আপন কৃপাণ দিয়ে ভৈরবনাথকে হত্যা করেন তিনি। জীবিতকালে দেবীকে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা ভৈরবনাথকে অনুশোচিত করেনি, মৃত্যুর পর অনুশোচনা তাকে দগ্ধ করতে থাকে। তিনি মাতার কাছে অশ্রুসজল চোখে ক্ষমা চান। দয়ার্দ্র মাতা ক্ষমা করেন ভৈরবনাথের ভুল। ভৈরবনাথকে বর দিয়ে তিনি বলেন, ভক্তদের তীর্থযাত্রা তখনই সার্থক হবে, যখন আমার পাশাপাশি ভৈরবনাথের জন্যও তাদের আগমন ঘটবে। এরপর মাতা বৈষ্ণো গুহার মধ্যে চিরকালের জন্য অন্তর্লীন হন। আর কালের পরিক্রমায় তার অন্তর্হিত গুহাটিতে গড়ে ওঠে মাতা বৈষ্ণো ভবন ও মন্দির। অজিতরা প্রতি বছর ওই বৈষ্ণো দেবীর মুখ দর্শনের জন্যই তীর্থে গমন করে।

এককালে যে জায়গাটি ছিল জনমানবহীন নির্জন পাহাড়ি প্রান্তর, মায়ের ভক্তিতে আরক্ত পূজারীদের পদচারণায় এখন চব্বিশ ঘণ্টা মুখর থাকে জায়গাটি।

অজিতদের কাছে মায়ের দর্শন এতটাই অনিবার্য যে, ধনীদের অনেকে হেলিকপ্টার যোগে পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত বৈষ্ণো মন্দিরে অবতরণ করে। কেউবা চার বেহারার লোহার পালকিতে চড়ে যায় মায়ের দর্শনে। কেউবা যায় ঘোড়ায় চড়ে। আর যাদের হেলিকপ্টার, ঘোড়া কিংবা পালকি ভাড়া করার সাধ্য নেই, অজিতদের মতো তারা যায় পায়ে হেঁটে। আদনান একবার বলেছিল, আমাকে নিয়ে যাবি, তোদের মাকে দেখার বড় সাধ।

অজিত আঁতকে উঠেছিল—বিধর্মীদের তীর্থে যাওয়া বারণ। তবে হ্যাঁ, তুই দেখার জন্য যেতে পারিস। কত যে সুন্দর আমাদের দেবী! অনেকগুলো মন্দির পেরিয়ে তবে বৈষ্ণো মায়ের আশ্রম। সেখানে বিভিন্ন ঘরে সাজানো আছে অনেক রকম মূর্তি। নতুনরা ভাবে, এগুলোর কোনোটা বোধহয় মা বৈষ্ণো। আসলে এদের কেউই বৈষ্ণো দেবী নয়। তারা দেবীর পাহারাদার। দেবী তো আছেন গুপ্ত গুহার মধ্যে। পাথুরে লম্বা টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে হয় সেই গুপ্ত গুহায়। টানেলের ভেতর লাল গালিচা বিছানো। পাহাড়ি জল চুঁইয়ে পড়ে টানেলের পাথুরে গা বেয়ে। প্রথম যে বার গিয়েছিলাম, আমার গা ছমছম করে উঠেছিল জলের টুপটাপ শব্দে। টানেলের শেষ মাথায় আজও তপস্যায় মগ্ন হয়ে আছেন বৈষ্ণো দেবী। আর তার সাথে আছেন দেবীর তিন মাতা মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাস্বরসতী।

অজিত এমনভাবে বলে ওদের দেবতাদের কথা, শুনলেই দেখা হয়ে যায়। গেল কয়েকবার ও একই গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। এবার নিশ্চয় নতুন কোনো ডানা গজাবে ওর গল্পের। আদনান জিজ্ঞেস করে, কবে ফিরবি?

জবাব দেয় না অজিত। বাবার মুখের দিকে তাকায়। তীর্থে যাচ্ছে অথচ নিজেই জানে না কতদিনের সফর। জ্যাঠা বলেন, এক সপ্তাহর যাত্রা। তোমরা সব ভালো থেকো। তোমার বাবাকে বলো আমার কথা। ব্যস্ততায় ভাইজানের সাথে দেখা করতে পারলাম না।

আমাদের জন্য প্রার্থনা করবেন, জ্যাঠা। একবার আমিও আপনাদের সাথে তীর্থে যাব।

অবশ্যই যাবে বেটা। নূরজাহান-মারিয়াম, আমার দুই মা, তোমরাও ভালো থাকো। ভ্যান ছেড়ে দেয়। অজিত হাত নাড়ে। আদনান চিৎকার করে—জলদি ফিরবি। তুই আমাদের প্রধান পেস বোলার। পথের বাঁকে অজিতদের ভ্যান হারিয়ে যায়। আদনান তখনো তাকিয়ে থাকে ওই বাঁকের মুখে। ও ফিসফিস করে বলে, সহি-সালামতে ফিরে আয়।

অজিতদের মতো কয়েক লক্ষ পণ্ডিতের বসবাস এই কাশ্মীরে। এই উপত্যকার হিন্দু-মুসলমান যুগ যুগ ধরে ঝিনুকের দুটো ঢাকনার মতো একই সঙ্গে বসবাস করে আসছে, কোনোরূপ কোন্দল ছাড়াই। পেশায় কাঠমিস্তিরি অজিতের বাবা। গুরিহাকার অধিকাংশ ঘরের ফার্নিচার তার হাতে তৈরি। আদনানের বাবার সাথে ছোটবেলায় একসঙ্গে পড়েছে। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব দুজনের, যেমন বন্ধুত্ব অজিতের সাথে আদনানের। বাবা প্রায়ই বলেন, অজিতকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে তোমার আনন্দিত হওয়া উচিত, আদনান। অজিতকে তুমি জ্ঞানের নতুন দরজা ভাবতে পারো। বহু অজানারে করতলগত করতে পারো অজিতের মাধ্যমে! আন্তঃধর্মীয় সংস্কৃতির যে সৌন্দর্য তার সঙ্গে তোমার পরিচয় ঘটাতে পারে অজিত। চোখ উপচানো উচ্ছ্বাস নিয়ে অজিত যখন ওর দেবতাদের গল্প বলে, বাবার কথাই সত্য মনে হয় আদনানের। এমন একজন বন্ধু উপহার দেয়ায় ও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে।

দুই টিলার মাঝখানে সমতল ভূমিতে গুরিহাকার একমাত্র মসজিদ। সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে নির্মিত মসজিদটির ছাদ দোচালা ঘরের মতো দুদিকে ঢালু। কাঠের দৃষ্টিনন্দন মিনারটি এত উঁচু যে অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। গুরিহাকার গোরস্তান টিলার ঠিক উল্টো পাশে। মসজিদ অতিক্রম করতে গিয়ে আদনানরা দেখে, উইলো গাছের ছায়ায় ওদের গোরস্তানটি মৃতদেহের মতো শীতল হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘন নিবিড় ছায়ায় গোরস্তানের ওপর তখনো জমে আছে তুষারের আস্তর। গোরখোদক গুলজার চাচা তুষার সরিয়ে কবর খনন করছে। তার গায়ে টাখনু ছোঁয়া লম্বা পিরহান। মাথায় কানঢাকা টুপি। পায়ে শক্ত সোলের জুতা। হাতে প্লাস্টিকের হাত মোজা। দূর থেকেই গুলজার চাচার সাথে সালাম বিনিময় হয়ে গেল আদনানের। পায়ে পায়ে ওরা কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গুলজার চাচা বাঁকানো কোমর সোজা করে বলল, অনেক দিন পর কবর খুঁড়তে এলাম, বুঝছ? অল্পতেই তাই হাঁপিয়ে উঠছি। সাড়ে তেরো মাস পর কেউ মারা গেল।

প্রত্যুত্তরে আদনান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই গমগম করে বেজে উঠল মারিয়ামের কণ্ঠ : শরীর সচল রাখার জন্য আপনি কি অধিক মৃত্যু চান, চাচাজি? মারিয়ামের বলবার ঢঙের মধ্যে এমন তাচ্ছিল্য ছিল, আদনান ও নূরজাহান হতভম্ব হয়ে গেল।

আস্তাগফিরুল্লাহ! আমি তো রসিকতা করছি। আদনান, বেটিটা কে? গুলজার চাচা কোদালের হাতায় ভর দিয়ে জিজ্ঞেস করল।

ও মারিয়াম। আমার খালাতো বোন।

মারিয়াম অস্ফুট স্বরে বলল, লাশের অভাবে আপনি কাজ পান না অথচ এমন অনেক লাশ আছে যারা গোরখোদক পায় না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, লাশের অভাবে আপনাকে যেন বসে থাকতে না হয়।

তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না, বেটি। গুলজার চাচা যুগপৎ বিস্মিত ও বিব্রত।

চাচা, আপনি কাজ করুন, আমরা বাড়ি যাই। বলেই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল আদনান। পেছন ফিরে নূরজাহান ও মারিয়ামকেও আদেশ করল সঙ্গে চলার। আদনান এতদিনে বুঝে গেছে, মৃত্যু, লাশ, কবর—এসবের প্রসঙ্গ এলেই অন্যরকম হয়ে যায় মারিয়াম। ওকে তখন আর ঠিক চেনা মানুষ লাগে না। বাবা-মার আকস্মিক মৃত্যু এখনো ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যতদিন না ও ঠিক হচ্ছে, ততদিন ওকে নিয়ে তাই সতর্ক হয়ে চলতে হবে।

নূরজাহান ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল, মরা বাড়ি যাবে না, ভাইয়াজি?

ভালো লাগছে না।

তাহলে অন্য কোথাও চলো। মারিয়াম, তুমি যাবে তো? নূরজাহান গ্রীবা ঘুরিয়ে মারিয়ামের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা ছুড়ে দিল; কিন্তু মারিয়াম পাশে নেই। ও তখনো রয়ে গেছে গোরস্তানে, তুষারের ভেতর হাটু গেড়ে বসে একটি কবরের এপিটাফ পড়ছে আর গুলজার চাচা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে রহস্যময়ী মেয়েটার দিকে। মারিয়ামের এই আচরণে বিব্রত হয় আদনান। নূরজাহানের সাথে দৃষ্টিবিনিময় করে ও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে মারিয়ামের কাছে। বলক ওঠা ভাতের মতো তখন ফোঁপাচ্ছে মারিয়াম। নূরজাহান দ্রুত ওর কাঁধে হাত রেখে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। মারিয়ামের রুদ্ধ কণ্ঠের দেয়াল এবার ভেঙে যায়। ও ব্যথাতুর কণ্ঠে বলে, আম্মুজি-আব্বুজির কবরেও এমন ফলক থাকতে পারত!

আদনান বাহু ধরে তোলে মারিয়ামকে। বিষণ্ন কণ্ঠে বলে, খালা-খালুর মৃত্যুবার্ষিকীতে তোমাকে খোশরাগপোরা নিয়ে যাব, যেখানটায় তারা হারিয়ে গেছেন।

মারিয়াম ওর বাদামি চোখের জল মুছে বলে, ঝামেলা করার জন্য আমি দুঃখিত। আর কখনো তোমাদের বিব্রত করব না। তারপর ও ধীর পায়ে গুলজার চাচার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, চাচাজি, আপনি অনেক মহৎ কাজ করছেন। আপনি সযত্নে মানুষের শেষ ঠিকানা নির্মাণ করেন। আপনার দীর্ঘ হায়াতের জন্য আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করব।

ফেরার পথে আপেল বাগান, ফসলি মাঠ এবং নূরজাহানদের স্কুল হয়ে ফেরে ওরা। আপেল বাগানে এখন কোনো আপেল নেই। নিজেদের খাওয়ার জন্য একটা গাছ রেখে নভেম্বরে উইলো গাছের পাতলা কাঠের কার্টনে ভরে সমস্ত আপেলই ব্যাপারিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন দাদাজি। তবু এই ফলশূন্য বাগানে দাঁড়িয়ে মারিয়ামের উদ্দেশে আদনান বলে, এটা আমাদের আপেল বাগান। এখন, এই শীতে বাগানে না আছে ফুল, না আছে কুঁড়ি, কিংবা কাঁচাপাকা আপেল। মার্চে আমাদের এই বাগান ভরে উঠবে সাদা সাদা ফুলে। মে মাসে ফুলগুলো পরিণত হবে আপেলের কুঁড়িতে। সবুজ পাতার ভেতর সবুজ কুঁড়িকে তখন খুঁজে পাওয়াই হবে দুষ্কর। সেপ্টেম্বর থেকেই পাকতে শুরু করবে আপেল।

মারিয়াম ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ও হাসতে হাসতে বলে, আমাকে আপেলের জীবনচক্র সম্পর্কে অজ্ঞ বিদেশি পর্যটক ভেবেছ?

নিজেদের বাগান বলেই এমন প্রগল্‌ভ হয়ে উঠেছি। আদনানও যোগ দেয় ওর হাসিতে।

আপেল বাগান ছাড়িয়ে ওরা যখন ওদের ফসলি মাঠের ভেজা আইলে পা রাখে, দেখে, এই শীতে ওদের ধানের মাঠ অনাবাদী জমির মতো পড়ে আছে অযত্নে। চেনা অচেনা লতাগুল্ম আর আগাছায় ভরে আছে প্রান্তর। এক জোড়া বেজি ওদের দেখে ঘাসের ভেতর মুখ লুকায়। শীত যেভাবে কাশ্মীরিদের জীবনকে অচল করে দিয়েছে, অচল করে দিয়েছে ওদের ফসলি মাঠকেও। আজকের এই স্থবিরতা দেখে কে বলবে, কদিন পরই এখানে ধান রোপনের ধুম পড়ে যাবে! ধূসর মাঠের ভেজা আইলে হাঁটতে হাঁটতে আদনান নিজের সাথে নিজে কথা বলে নাকি মারিয়ামকে শোনায়, বোঝা যায় না। আদনান ওদের স্থাবর সম্পত্তিগুলোর সাথে পরিচয় ঘটাচ্ছে মারিয়ামের, কারণ, মারিয়াম এখন আর ওদের খালাতো বোন নয়, যার বাড়ি দূরের বারমুলায়; বরং মারিয়াম এখন ওদের পরিবারেরই একজন। নূরজাহান কিংবা আদনান যেমন ওদের আপেল বাগান, ধানী জমি, ভেড়ার পালকে চেনে, মারিয়ামেরও তা চেনা উচিত।

মাঠ পেরিয়ে আদনান নূরজাহানের যৌথ স্কুল। ইটের দেয়ালের ওপর টিনের চাল নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে হাত-পা ছড়িয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে স্কুলঘর। জনমানবশূন্য থমথমে পরিবেশে প্লাস্টারবিহীন ইটের দেয়ালের লম্বা বিল্ডিংকে মনে হচ্ছে ভূতের বাড়ি। তুষারের অত্যাচারে মাঠের সবুজ ঘাস মারিয়ামের চুলের মতো ঈষৎ লালচে। স্কুল মাঠের দু পাশে দৈত্যের মতো উঁচু উঁচু চিনার গাছের সারি। শীতে পাতা হারিয়ে গাছগুলো কুৎসিত রকমের ন্যাড়া। বসন্ত এলেই এর শাখাপ্রশাখা আবার ভরে উঠবে সবুজ পাতায়। সবুজের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে শরৎকালে যখন সবুজ পাতারা হলুদ হতে শুরু করবে, মনে হবে গাছগুলোর মাথায় আগুন ধরে গেছে। তখন গাছের দিকে চোখ রাখা দায়। শরতের ওই সময়টার স্কুল আদনানের সবচেয়ে প্রিয়। দাদাজি একবার বলেছিলেন, কোনো এক মোগল বাদশাহ নাকি চিনারের এই জ্বলন্ত রূপ দেখে ফারসি ভাষায় চিৎকার করে বলেছিলেন—চিহ নার! মানে, কী আগুন! সেই থেকে এর নামই হয়ে গেল চিনার। চিনারের আগুনে রাজা বাদশাহরা মুগ্ধ হলে আনদান কেন হবে না! এ কারণে অন্য ঋতুতে স্কুল কামাই গেলেও শরতের ও নিয়মিত ছাত্র।

স্কুল খুললে তোমাকে এখানেই ভর্তি হতে হবে। এই আঙিনা ভালো করে চিনে নাও। এখানে তুমি নূরজাহানের মতো অনেক বান্ধবী পেয়ে যাবে।

নূরী আছে, আমার আর নতুন কোনো বান্ধবীর দরকার নেই। নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে মারিয়াম মিষ্টি করে হাসে।

মসজিদের মাইক আবার কথা বলছে। আদনান কান খাড়া করে। আবদুল ওয়াহাব দাদাজির জানাজা হবে বাদ জোহর। আদনান হাতঘড়ি দেখল। জোহরের নামাজের বেশি দেরি নেই। জীবিতকালে যে মানুষটা ওকে ভালোবাসত, সেই মানুষটার জানাজায় শামিল হতে ওর মন বারবার আদেশ করতে লাগল। দুই বোনকে নিয়ে ও হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। জানাজার আগেই ওকে পৌঁছতে হবে লোকালয়ে। জানাজার নামাজের জন্য আজ এত ব্যাকুলতা আদনানের, কিন্তু আদনান জানে না, খুব শিগ্গিরই এমন দিন আসবে, যখন এই উপত্যকার মানুষেরা জানাজা পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু লাশ ফুরাবে না। আদনান, মারিয়াম, নূরজাহানদের যাত্রা সেই রক্তাক্ত সময়ের দিকে।

একই গাঁয়ের মানুষ হিসেবে আবদুল ওয়াহাবের মৃত্যু সংক্রান্ত বিষণ্নতা আক্রান্ত করেছিল আদনানের বাবা ফয়জুল্লাহকেও। জানাজা ও দাফন থেকে ফিরে খাবারের মাদুরে বসে তিনি ছিলেন চুপচাপ। সমবয়সি পড়শিকে হারিয়ে দাদাজি আবদুল লতিফ কোলের পাশে রেডিও রাখতে ভুলে গেছেন আজ। খাবারের থালায় ইতস্তত হাত নেড়ে বাবা ও দাদার বিষণ্ন চেহারার ভাষা পড়বার চেষ্টা করছিল আদনান। একবার ও খেয়াল করল, মারিয়ামের হাতও থমকে আছে দস্তরখানে। শুধু নূরজাহান ও রায়হান নির্বিকার।

বাবা হঠাৎ থমথমে কণ্ঠে বললেন, আবদুল ওয়াহাব চাচাজির স্বপ্ন ছিল স্বাধীন কাশ্মীর দেখে যাওয়ার। অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে তাকে পৃথিবীকে বিদায় জানাতে হলো। হয়তো পরাধীনতার গ্লানি বুকে নিয়ে একদিন আমরাও মারা যাব।

দাদাজি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, গণভোটের নামে বারবার আমাদেরকে প্রবঞ্চিত করা হয়েছে। নয়তো এখন আমরা স্বাধীন ভূখণ্ডের মালিক থাকতাম। কাশ্মীরের পথে পথে বন্দুকের নল উঁচানো ভারতীয় আর্মিদের দেখে ঘৃণায় মুখ ফেরাতে হতো না আমাদের। সেদিন নেহেরুর একটুখানি সদিচ্ছাই পারত আমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দিতে।

আবদুল ওয়াহাব দাদাজির মৃত্যুসৃষ্ট এই বিষণ্ন বাতাস খাবারের দস্তরখান থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিল আদনান, বিশেষত মারিয়ামের জন্য। কারণ, যখনই কারো মৃত্য নিয়ে আলোচনা হয়, মারিয়ামের চেহারায় অমাবশ্যার অন্ধকার নেমে আসে। মারিয়ামের চেহারার ওই ঘনীভূত মেঘ বড় যন্ত্রণা দেয় আদনানকে। আর একারণে, দাদাজির মুখে ইতিহাসের গন্ধ পেতেই ও প্রসঙ্গের মুখ ঘুরিয়ে দিতে চাইল সেদিকে। বলল, দাদাজি, নেহেরু সাহেব কী করেছিলেন?

সেটা তোমার আব্বুজির কাছে শোনো। ফয়জুল্লাহ ভালো বলতে পারবে।

আবার ইতিহাসের গল্প! খাওয়ার সময় এসব চলবে না। চোখ পাকিয়ে তেড়ে এলেন নাজনীন।

আরে বউমা, খেতে খেতে ইতিহাস যতটা জমে, অন্য সময় ততটা জমে না। বললেন আবদুল লতিফ।

রুটি চিবোতে চিবোতে নূরজাহান বলল, আব্বুজি, আগে একদিন কথা দিয়েছিলেন, ডোগরা শাসনের কবল থেকে কীভাবে আমরা ভারতীয়দের কবলে পড়লাম সেই গল্প বলবেন। আপনি এখনো আপনার কথা রাখেননি। কথা দিলে সেই কথা রাখতে হয়।

সবাই যখন ধরেছে, তখন শুনিয়ে দাও ইতিহাসের দু-চারটা লাইন। তবে হ্যাঁ, দীর্ঘ করা যাবে না। তোমাদের খাওয়া হলে আমাকে সব আবার গোছাতে হবে। তাড়া দিলেন নাজনীন।

শুরু করলেন ফয়জুল্লাহ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার খাওয়ার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের লালসার জিহ্বা কিছুটা খাটো হলো। সারা দুনিয়াজুড়ে বিস্তৃত বিশাল কলোনি চালানোর ক্ষমতা তাদের আর থাকল না। তারা অর্থ সাহায্যের জন্য হাত পাতল আমেরিকার কাছে। আমেরিকা শর্ত দিল—কলোনিগুলোকে বিশ্বস্ত লোকদের হাতে তুলে দাও, যারা আমাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলবে। শুরু হলো ভারতবর্ষকে ভারতীয়দের হাতে সোপর্দ করার তোড়জোড়। মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য পৃথক মাতৃভূমির দাবি জানিয়ে আসছিল আগে থেকেই। এবার যখন ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এলো, তখন জোরদার হলো তাদের দাবি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত নামের আলাদা দুটি দেশের জন্ম হলো। দেশভাগের অন্যতম শর্ত ছিল, ব্রিটিশ শাসনের বাইরে যে সমস্ত স্বশাসিত করদরাজ্য আছে, তারা ইচ্ছা মতো ভারত বা পাকিস্তান যে কোনো ডমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে। আবার কেউ যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তাতেও বাধা দেয়া হবে না। কাশ্মীরে তখন সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর শাসক হিন্দু হরি সিং। মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে তিনি ভারতে যোগ দেবেন কিনা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তার দ্বিধার কারণ—সংখ্যাগুরু জনগণ চায় স্বাধীনতা কিংবা পাকিস্তানভুক্তি; কিন্তু কিছুতে নয় ভারতভুক্তি। ওদিকে হরি সিংয়ের প্রথম পছন্দ স্বাধীনতা। তা না হলে ভারতভুক্তি; কিন্তু কিছুতে নয় পাকিস্তানভুক্তি। সবকিছু দেখেশুনে হরি সিং স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ধরেই রেখেছিলেন কাশ্মীর পাকিস্তানের হবে। একে তো এটা মুসলিম প্রধান জনপদ, তার উপর ভৌগলিকভাবে পাকিস্তানের খুব কাছে। কাশ্মীর তারই পাওনা। কিন্তু হরি সিংয়ের স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্তে স্বপ্নভঙ্গ হলো জিন্নাহর।

মাউন্টব্যাটনের উপদেশ অনুযায়ী হরি সিং ভারত পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের সাথে একটি অপরিবর্তনশীল স্থিতাবস্থা সংক্রান্ত চুক্তি করতে সম্মত হলেন। এই চুক্তির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল—ইতোপূর্বে জম্মু-কাশ্মীর সরকার বাণিজ্য, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে ব্রিটিশ ভারতের সাথে যে ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছিল, এখন ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একই ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। কিন্তু পাকিস্তান এই চুক্তিতে আগ্রহ দেখালেও ভারত আগ্রহ দেখাল না। কাশ্মীরি জনগণ ভারতবিযুক্তির কারণে খুশি হলেও তারা হরি সিংয়ের ওপর মোটেও খুশি ছিল না। হরি সিং ছিলেন সাম্প্রদায়িক, অত্যাচারী এবং স্বৈরাচার। ইতোপূর্বে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন করেছে। এখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রেক্ষিতে পুরো উপমহাদেশের মানচিত্র উলোট-পালোট হলেও কাশ্মীরিদের সেই দুঃখের দিনের অবসান ঘটল না। তাদের নেতা শেখ আবদুল্লাহ হরি সিংয়ের কারাগারে তখনো বন্দি। নেতৃত্বে অভাবে হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে তারা কেবল ফুঁসতে লাগল। এই যখন অবস্থা কাশ্মীরের, তখন, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুঞ্চ অঞ্চলের জনগণ হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ডাক দিল। ভৌগোলিকভাবে পুঞ্চ জেলাটি ছুঁয়ে গেছে ভারত পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ রেখা। বর্তমানে এর এক ভাগ আজাদ কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত, অপর ভাগ ভারত অধিকৃত জম্মুর সাথে যুক্ত। পাকিস্তানের অংশ নাম ধারণ করেছে রাওয়ালকোর্ট এবং ভারতের অংশ আগের সেই পুঞ্চ নামেই রয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে এই পুঞ্চ থেকে মহারাজা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে যে গণবিক্ষোভ জেগে উঠেছিল, কালক্রমে এটাই পাক-ভারত যুদ্ধের পরিণতি বরণ করে। পুঞ্চের গণজাগরণের ইতিহাস পুরোপুরি না বললে কাশ্মীরের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পুঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা ছিল মুসলমান। ঐতিহাসিকভাবে এই মুসলমানেরা স্থানীয় ভূ-স্বামীদের হাতে, যারা ছিল হিন্দু এবং মহারাজার নিকটজন, শোষিত হয়ে আসছিল। বাড়তি করের চাপে তাদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। এরকম পটভূমিতেই ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার ঘণ্টা বেজে ওঠে। পুঞ্চের মুসলামনরা ছিল জাতিগতভাবে যোদ্ধা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই অঞ্চলের প্রায় ষাট হাজার সৈন্য ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করেছিল। তাদের হাতে তখনো ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র। তারা দেখছিল, তাদের পার্শ্ববর্তী পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হচ্ছে। এই যুক্ত হওয়া নিয়ে সেখানে জাতিগত দাঙ্গাও শুরু হয়ে গেছে। দাঙ্গা আক্রান্ত অনেক শিখ ও হিন্দু এসে আশ্রয় নিয়েছে জম্মুতে। আবার পুঞ্চে ছিল মুসলিম কনফারেন্সের প্রভাব। মুসলিম কানফারেন্স চাচ্ছিল কাশ্মীর পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হোক। ফলে মুসলিম কনফারেন্স দ্বারা প্রভাবিত পুঞ্চবাসীও চাচ্ছিল পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে। অন্যদিকে শেখ আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স চাচ্ছিল কাশ্মীরের ভাগ্য জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে। তারা স্বাধীন থাকবে নাকি ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে সে তাদের ইচ্ছা। আর মহারাজা হরি সিং এ সময় কালক্ষেপণের উদ্দেশে নীরবতার আশ্রয় নেন। স্থানীয় হিন্দুরা মহারাজাকেই সমর্থন করছিল।

পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের দাঙ্গা মহারাজা হরি সিংকে উদ্বিগ্ন করে তুললে তিনি পুঞ্চে বিপুল পরিমাণে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে থাকেন। নাগরিকদের চলাফেরা এবং মালামাল পরিবহনে কড়াকড়ি আরোপ করেন। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। এতে পুঞ্চবাসীর পূর্বের ধূঁমায়িত ক্ষোভে আগুনের আঁচ লাগতে থাকে। কিন্তু মহারাজা এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপহীন। কোথায় তিনি পুঞ্চবাসীর ক্ষোভ দূরীকরণের চেষ্টা করবেন তা না আগস্ট মাসে তিনি পুঞ্চবাসীকে অস্ত্র জমা দিতে বললেন। ওদিকে সামরিক বাহিনীর ঘেরাওয়ের ভেতর যখন পুঞ্চের বাসিন্দারা বিক্ষুব্ধ, ঠিক তখনই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জঙ্গিরা গণহত্যায় মেতে ওঠে। পুঞ্চবাসীর অপরাধ, তারা জেলার বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেছিল। এই গণহত্যায় পুঞ্চের কত সংখ্যক মুসলিম নিহত হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। তবে ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যগুলো নিহতের সংখ্যা দুই লাখের অধিক বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে। এই গণহত্যা জম্মুর ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার হিসাবই পাল্টে দেয়। এ সময় বর্তমান পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অংশের পুঞ্চ উপজাতিরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দুর্গত মুসলিম স্বজাতিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। শুরু হয় হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে পুঞ্চবাসীর বিদ্রোহ। তারা গঠন করে আজাদ কাশ্মীর সরকার। পাকিস্তান রেডিও নতুন এই সরকার গঠনের সংবাদ প্রচার করে গুরুত্বের সাথে। ঠিক তখন কাকতালীয়ভাবে আরেকটি ঘটনা ঘটে যায়। মহারাজা হরি সিং প্রধানমন্ত্রী রামচন্ত্র কাককে বরখাস্ত করে নতুন প্রধানমন্ত্রী বানান কংগ্রেস সমর্থিত মেহের চাঁদ মহাজনকে। এতে পুঞ্চবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, মহারাজা ভারত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকছে। ফলে মুসলমানদের উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। ক্ষিপ্ত উপজাতিরা পুঞ্চের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজধানী শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তায়, যেসব পাকিস্তানি সৈন্য এই সময় ছুটিতে ছিল, সুযোগ বুঝে তারাও যুক্ত হয় উপজাতিদের সাথে। যদিও দাপ্তরিকভাবে পাকিস্তান শুরুতে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, তবে বিদ্রোহীদের ওপর তাদের সমর্থন ও পরোক্ষ মদদ ছিল পুরোপুরিই।

উপজাতিদের বিদ্রোহে মুজাফফারাবাদ-সহ কাশ্মীরের বিপুল অঞ্চল মহারাজার হাতছাড়া হয়ে যায়। মহারাজার নির্দেশ ছিল—যে কোনো মূল্যে লোকদেরকে মুজাফফারাবাদে আটকে রাখতে হবে। মুজাফফারাবাদের উজির সেই চেষ্টাই করেছিলেন। কিন্তু জনতার পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিপরীতে কার্যত উজিরের কোনো ক্ষমতাই ছিল না তখন। উজির নিজেই সরকারি বাংলোতে আক্রমণকারীদের গুলিতে নিহত হলেন। আক্রমণকারীদের প্রধান টার্গেট ছিল মহারাজার উজির-আমলা-সহ বিভিন্ন রাজকর্মচারী। তারই অংশ হিসেবে নিহত হওয়া উজিরের।

পুঞ্চ অতিক্রম করে উপজাতিরা প্রবেশ করে বারমুলায় এবং ব্যাপক লুটপাট ও ধ্বংসলীলা চালায়। উপজাতিরা ছিল হিংস্র, উশৃঙ্খল এবং গোঁয়ার। তাদের নিয়মতান্ত্রিক কোনো যুদ্ধপ্রশিক্ষণ ছিল না। হরি সিংকে বিতাড়িত করে কাশ্মীর উপত্যকার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মতো দক্ষ নেতৃত্বগুণও ছিল না তাদের। ফলে অত্যাচারী হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেমে তারা ভুলে যায় এই আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। শ্রীনগরে মহারাজার প্রাসাদ দখল করবার পরিবর্তে তারা লুটতরাজে কালক্ষেপণ করে বারমুলায়। এতে প্রস্তুতির জন্য অনেকটা সময় পেয়ে যান মহারাজা হরি সিং। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাক্কালে এই অতর্কিত আক্রমণের মুখে প্রমাদ গুণতে থাকেন তিনি। হিংস্র এই উপজাতিদের তিনি রুখবেন কী করে! এদের রুখবার মতো শক্তি তার নেই। নিরুপায় মহারাজা রাজধানী ছেড়ে পালালেন জম্মুতে। খবর পেয়েই বিদ্রোহীরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। পাক রেডিওতে খবর প্রচারিত হলো—রাজা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছে।

বিপন্ন মহারাজা যখন প্রাণ নিয়ে ফিরছেন নিরাপদে, তখন সবার আগে তার মনে পড়ল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কথা। অমন সুপ্রশিক্ষিত বিশাল সৈন্য ভান্ডার থাকলে আজ কাপুরুষের মতো তাকে পালাতে হতো না। তিনি বুঝতে পারলেন, একাকী টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভারতের সাহায্য তার প্রয়োজন। ২৬ অক্টোবর সাহায্যের আবেদন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মেহের চাঁদ মহাজনকে দিল্লি পাঠালেন হরি সিং। নেহেরু জানালেন—কাশ্মীর এখন স্বাধীন রাষ্ট্র। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সামরিক অভিযান পরিচালনা করবার ন্যায্য কোনো অধিকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেই। আমরা তখনই কাশ্মীরকে সাহায্য করতে পারি, যখন কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে।

মহাজন তখন সাহায্যের জন্য ব্যাকুল। যে কোনো মূল্যেই হোক মহারাজার সিংহাসন টিকিয়ে রাখতে হবে। সেই বৈঠকে ঠিক কী কী ঘটেছিল তার একটি চমকপ্রদ চিত্র মহাজনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়। মহাজন নেহেরুকে বলেছিলেন, এই মুহূর্তে যদি ভারতীয় সৈন্য শ্রীনগরের পথে রওনা না হয়, তবে তিনি সমোঝতার জন্য পাকিস্তানে জিন্নাহর কাছে ছুটে যাবেন।

মহাজনের এই সংলাপে ভয়ংকর রকমের ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন নেহেরু। তিনি মহাজনকে ঘর থেকে বের করে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। শেখ আবদুল্লাহর হস্তক্ষেপের পরই কেবল নির্মূল হয়েছিল নেহেরুর ক্রোধ। ততদিনে হরি সিংয়ের কয়েদখানা থেকে মুক্ত হয়েছেন কাশ্মীরের জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ। এবং জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ঝুঁকে পড়েছেন ভারতীয় শাসকদের প্রতি। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি তাকে বেশি আকর্ষণ করছে তখন। ফলে, প্রথম চাওয়া স্বায়ত্তশাসন হাতছাড়া হলে কাশ্মীরের পাকিস্তানভুক্তির চেয়ে তার কাছে বেশি প্রার্থিত কাশ্মীরের ভারতভুক্তি। আর এ কারণেই নেহেরুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা আবারো উষ্ণ হয়ে উঠেছে।

সেদিন, ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর, দিল্লিতে ভারত সরকার ও জম্মু-কাশ্মীর সরকারের মধ্যে ভারত অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত দলিল সাক্ষরিত হলো। কাশ্মীরি জনতার মতামত না নিয়েই কেবল শাসকের ইচ্ছার বশে কাশ্মীরিদের জীবনকে জুড়ে দেয়া হলো ভারতের সাথে। এই দলিল অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীর সরকার প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ—এই তিনটি বিষয়ে ভারতের কর্তৃত্ব মেনে চলতে স্বীকৃত হলো। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, জম্মু-কাশ্মীরের আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক হলে সেখানকার মানুষের স্বীকৃতি নেয়ার পরেই তাদের ভারত অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। আজাদ কাশ্মীর সরকার ঘোষণা দিল—এই চুক্তি অবৈধ। সিংহাসনচ্যুত হরি সিংয়ের কোনো অধিকার নেই কাশ্মীরের পক্ষে চুক্তি করবার।

চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সাথে সাথে দিল্লি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সৈন্য গিয়ে নামল শ্রীনগরের ছোট্ট রানওয়েতে। আক্রমণকারী উপজাতিরা তখন শ্রীনগর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ভারতীয় সৈন্যরা বিশৃঙ্খল উপজাতিদেরকে তাড়িয়ে দিল শ্রীনগর থেকে। কিন্তু কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্যদের উপস্থিতি বরদাশত করতে পারল না পাকিস্তান। গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ উপজাতিদের জন্য সৈন্যসহায়তা পাঠালেন পাকিস্তান থেকে। স্বাধীনতার প্রথম বছরেই একই মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া দুটি জমজ রাষ্ট্র কাশ্মীর ইস্যুতে জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে। ভারতীয় সৈন্যরা বারমুলা পুনর্দখল করল। মুজাফফারাবাদ রয়ে গেল পাকিস্তানের অধীনে। ভারতবর্ষের মতো ভাগ হয়ে গেল কাশ্মীর। আজও পৃথিবীর এই ভূস্বর্গ পেটের ক্ষত চেপে দু টুকরো হওয়ার বেদনা হয়ে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু আব্বুজি, দাদাজি বলছিলেন গণভোটের কথা। নেহেরু নাকি কথা রাখেননি! এতক্ষণে ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল আদনান। আলোচনার এই পর্যায়ে গণভোট বিষয়ক জিজ্ঞাসা ওর মস্তিষ্কে উছলে ওঠে।

সকলের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তবু কাশ্মীরের বিড়ম্বিত ইতিহাস শ্রোতাদেরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তারা বিস্মৃত হয়েছিল হাত ধোয়ার কথা। প্রত্যেকের হাতে চড়চড় করছিল শুকিয়ে যাওয়া মাংসের ঝোল। ফয়জুল্লাহ শেষবারের মতো আঙুল চেটে বলতে লাগলেন, উপজাতিদের আক্রমণের প্রেক্ষিতে হরি সিংয়ের সাথে যখন নেহেরুর তড়িঘড়ি চুক্তি হয়, নেহেরু সম্ভবত অপরাধবোধে ভুগছিলেন। একারণে আন্তর্জাতিক মহলকে জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন সভায় বারবার বলছিলেন, এই চুক্তি সাময়িক। অচিরেই একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ গণভোট অনুষ্ঠিত হবে কাশ্মীরে। কাশ্মীরিরাই ঠিক করবে তারা কোনদিকে যাবে।

কিন্তু নেহেরু কথা রাখেননি, তাই না খালুজি? এই প্রথম কথা বলে ওঠে মারিয়াম।

শুধু নেহেরু না, নেহেরু জিন্নাহ কেউই কথা রাখেনি। মূলত কাশ্মীর এমন ভাগ্যহত রূপসী নারী, যাকে পাওয়ার জন্য সবাই লালায়িত অথচ তার হৃদয়ের আওয়াজ শুনবার মতো ধৈর্য কারো নেই।

তারপর কী হলো আব্বুজি? এই জিজ্ঞাসা নূরজাহানের।

১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি নেহেরু কাশ্মীর সমস্যাকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে উত্থাপন করেন। জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয়, গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরিরাই নির্ধারাণ করবে কাশ্মীরিদের ভাগ্য। পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধ এবং গণভোটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের পাঁচ সদস্যের কমিশন ভারতবর্ষে আসে। গণভোটের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কমিশন কয়েকটি প্রস্তাব রাখে। প্রথম প্রস্তাব : পাকিস্তান উপজাতি যোদ্ধাদেরকে কাশ্মীর থেকে সরিয়ে নেবে। দ্বিতীয় প্রস্তাব : ভারতও তাদের মোতায়েনকৃত অধিকাংশ সৈন্য কাশ্মীর থেকে সরিয়ে নেবে। তৃতীয় প্রস্তাব : কাশ্মীরে অবাধ গণভোট নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। কিন্তু দুই রাষ্ট্রের কেউই তাদের অংশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হয় না। উভয়েরই শঙ্কা ছিল—সৈন্য প্রত্যাহার করার ফলে যদি দখলকৃত অংশটাও প্রতিপক্ষের হাতে চলে যায়! এরপর বহুবার বহু কমিশন গণভোট আয়োজনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো প্রচেষ্টাই আলোর মুখ দেখেনি। পাকিস্তান শেখ আবদুল্লাহর কারণে গণভোটের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। কারণ, তখন শেখ আবদুল্লাহ ছিলেন কাশ্মীরের তুমুল জনপ্রিয় নেতা। নেহেরুর সঙ্গে সখ্যের কারণে কাশ্মীরকে তিনি ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছিলেন। শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বগুণে হতে পারে কাশ্মীরিরা ভারতের পক্ষে ভোট দেবে—এই ভয় ছিল পাকিস্তানের। অন্যদিকে ভারত বিশ্বাস করতে পারেনি কাশ্মীরিদের। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা পাকিস্তান রেখে ভারতের সাথে যুক্ত হবে—এমন অলীক স্বপ্ন নেহেরু দেখতে পারেননি। ফলে, উভয় দেশই গণভোটের প্রশ্নে বারবার তালবাহানার আশ্রয় নিয়েছে এবং ভেস্তে গেছে কাশ্মীরিদের স্বাধিকারের স্বপ্ন।

১৯৫৩ সালের আগস্টে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে আলোচনায় বসলেন। দুই পক্ষই স্থির করল, গণভোটের স্বার্থে তারা নিজ নিজ সৈন্য প্রত্যাহার করবে। এবং পরের বছর গণভোটের আধিকারিক নিযুক্ত হবে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই ভারত অভিযোগ করল, আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। হতে পারে এই অস্ত্র ব্যবহৃত হবে কাশ্মীরে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে ভারত সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারে না। এরপরও জাতিসংঘ অনেকবার গণভোটের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভারতের মিত্র রাষ্ট্র রাশিয়া জাতিসংঘের প্রতিটি প্রস্তাবেই আমেরিকা ও পাকিস্তানের প্রতি শত্রুতাবশত ভেটো প্রদান করেছে। আর প্রতিবার রাশিয়ার এই ভেটো প্রদানকে অভিনন্দিত করেছে ভারত, গোপনে। যে ভারত শক্তি প্রয়োগ করে স্বউদ্যোগে জুনাগড়ে গণভোটের আয়োজন করল, সেই তারাই কাশ্মীরের গণভোটের প্রশ্নে বারবার পিছু হটল।

জুনাগড়ে কী ঘটেছিল আব্বুজি?

ব্রিটিশ শাসনামলে জুনাগড়ও ছিল কাশ্মীরের মতো দেশীয় করদ রাজ্য। পার্থক্য শুধু এই জায়গায় যে, জুনাগড়ের শাসক ছিলেন মুসলমান আর প্রজাসাধারণ হিন্দু।

কাশ্মীরের ঠিক বিপরীত?

হ্যাঁ। তো মাউন্টব্যাটনের দেশভাগ আইন মতে জুনাগড়ের রাজার সামনে তিনটি পথ খোলা ছিল। স্বাধীন থাকো অথবা ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে যোগ দাও। জুনাগড়ের মুসলিম শাসক স্বাধীন থাকাকেই অগ্রাধিকার দিলেন। অথচ তার হিন্দু প্রজারা চায় ভারতের সাথে যুক্ত হতে। ভারত তখন রাজার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে গণভোটের আয়োজন করল জুনাগড়ে। নেহেরু নিশ্চিত ছিলেন, গণভোটে ভারতের পক্ষেই রায় আসবে। তাই তো জুনাগড়ের বেলায় গণভোটের তার এত আগ্রহ। সেখানে শাসকের ইচ্ছার কোনো মূল্য দেয়া হলো না। অথচ হরি সিং-ও স্বাধীন থাকতে চাইছিলেন। কিন্তু তাকে চাপে ফেলে ভারতভুক্তিতে রাজি করানো হলো। এ সবই সাম্রাজ্যবাদী লালসার ফসল।

দুটি দেশের খামখেয়ালির কারণে সেই যে আমরা পরাধীন হলাম, তা থেকে আর মুক্তি মিলল না। অথচ একটিবার যদি এই উপত্যকায় সুষ্ঠু গণভোট হতো, আমরা নিশ্চিতভাবে স্বাধীকার লাভ করতাম। এই জনপদের মানুষদের আমি চিনি। এরা আজাদির পক্ষেই ভোট দিত। দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ল দাদাজির কণ্ঠে। জানাজার সেই বিষণ্নতা আবার যেন ফিরে এল খাওয়ার মাদুরে। সবাই গম্ভীর চেহারায় হাত ধুয়ে ধীরে ধীরে উঠে পড়ল দস্তরখান থেকে। সবুজ মাদুরের প্রান্তে আতিথেয়তার সৌন্দর্য উৎকীর্ণ উর্দু কবিতার চরণ পড়ে রইল একাকী।

 

[যোগাযোগে প্রকাশিত এটাই আজাদির সন্তানের শেষ পর্ব। ধারাবাহিক এই উপন্যাসটি অমর একুশে বইমেলা-২০২৪ এ ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে বই আকারে বের হয়েছে। আর যা বই আকারে বেরিয়ে যায় পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের তার আর উপযোগিতা থাকে না। পাঠক চাইলে আজাদির সন্তানের বাকি পর্বগুলো বই থেকেই পড়ে ফেলতে পারবেন।–সম্পাদক।]

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷