আজাদির সন্তান (দ্বিতীয় কিস্তি)
গুরিহাকার দোতলা কাঠের বাড়িতে অক্টোবরের রাত নেমেছে। বাড়ির সামনে বেদানার মতো গোলাকৃতির উঠোন। উঠোনের তিনপাশ, বাড়ির দিকটা বাদে, কাঠের বেড়ায় ঘেরা। বাড়িতে প্রবেশের সদর দরজাটি রাজতোরণের মতো শৌখিন। দু পাশ থেকে উঠে গেছে কাঠের দুটো থাম। উপরে দুই থামকে সংযুক্ত করেছে ঢেউ খেলানো খিলান। দূর থেকে গেটটি দেখলে মনে হয় ওখানে বুঝি কোনো নৃপতির বসবাস। উঠোনের ঠিক মাঝখানে হাত-পা ছড়ানো একটা কাঠবাদাম গাছ। ডিসেম্বরের শীতে কাঠবাদামের সবুজ পাতারা সাদা হয়ে থাকে তুষারে। সদর দরজা দিয়ে উঁকি মারলে উঠোনের ডানপাশে পড়ে ভেড়ার খামার, বাঁ পাশে মুরগির খোপ। শফিক নামের যে ছেলেটি ভেড়া দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত, তার থাকার জায়গাটাও ভেড়ার ঘরের সাথেই। গৃহকর্ত্রী নাজনীন বেগম রাতের খাবার সাজাচ্ছিলেন। দরজা জানালা বন্ধ বলে পেতলের বাসনের টুংটাং শব্দ দ্বিগুণ জোরে বাজছিল ঘরটিতে। খাওয়ার ঘরের পুরো মেঝে জুড়ে সবুজ নরোম কার্পেট। কার্পেটের চার প্রান্তে হলুদ হরফে উৎকীর্ণ আতিথেয়তার প্রশংসাসমৃদ্ধ উর্দু কবিতার চরণ। যেন অতিথিদের অবহেলার ভাবনা ঘুণাক্ষরেও মনে না আসে কারো। বিজলি বাতির আলোয় সবাই যখন খেতে বসে, একজনের অনুপস্থিতি সকলের নজরে পড়ে। এই পরিবারের মুরব্বি আবদুল লতিফ, কাঠের তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে, অনুপস্থিত সদস্যের শূন্য আসনের দিকে তাকিয়ে বলেন, আদনান কোথায়? ওকে দেখছি না যে!
মুখরা নূরজাহান চটপট করে বলে, ভাইয়াজি ভেড়ার ঘরে শুয়ে আছে। আজ সে খাবে না।
ঘটনা সত্য। নূরজাহান যখন দাদাজিকে উপর্যুক্ত তথ্য দিচ্ছিল, আদনান তখন শুয়ে আছে শফিকের বিছানায়। পাশ থেকে ভেড়াদের ঢুশোঢুশির শব্দ আসছে। মুরগির কককক ধ্বনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে রাত বাড়ছে, খেতে যাও। কিন্তু আদনান আজ খাবে না। ঘুমোতেও যাবে না নিজের ঘরে। নিজের ঘর মানেই তো রায়হানের সাথে বিছানা ভাগ করে শোয়া। যার কারণে আজ ও অপদস্থ হলো দুটি মেয়ের কাছে, কানমলা খেল মায়ের হাতে, তার সঙ্গে ও ঘুমোতে পারে না।
দরজায় লন্ঠনের ছায়া পড়ল। ভেড়াগুলোকে শেষবারের মতো দেখে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল শফিক। শফিকের ছায়া দরজায় পড়তেই কম্বলের ভেতর পুরো শরীর চালান করে দিল আদনান। আজ শফিককেও ওর অসহ্য লাগছে। সমবয়সী হলেও মনিবের সন্তান হিসেবে আদনানকে শফিক ভাইয়াজি সম্বোধনে ডাকে। লন্ঠনটা কম্বলের ওপর বাড়িয়ে ধরে আদনানকে ডাকতে লাগল শফিক—ভাইয়াজি, ও ভাইয়াজি! দাদাজি তোমাকে খেতে ডাকে।
আদনান এক ঝটকায় কম্বল থেকে মুখ বের করে বলল, দাদাজিকে বলে দাও ভাইয়াজি আজ খাবে না। আজ তার মেজাজ খারাপ। বলেই আবার সে হারিয়ে গেল কম্বলের তলে।
শফিক অসহায় গলায় বলল, না খাও ভালো কথা, কিন্তু নিজের ঘরে ঘুমাতে তো যাও। এখানে ভেড়ার গন্ধে তোমার ঘুম হবে না।
আদনান আগের মতো মুখ বের করে বলল, তুমি চুপ থাকলেই ঘুম হবে। ভেড়ার চেয়ে তুমি বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছ।
ভাইয়াজি কি আমাকে ভেড়ার চেয়েও অধম বলতে চাচ্ছ?
না, শুধু ভেড়া না, তুমি মুরগির চেয়েও অধম। এবার ভাগো। বাইরে গিয়ে কককক করে ডাকো।
কোথায় ভাগব? এটাই তো আমার ঘর, আমার বিছানা।
আমার ঘরে গিয়ে ঘুমাও।
তাই আবার হয় নাকি! রাতে যদি ভেড়া মারামারি করে তুমি কি ঠেকাতে পারবে?
পারব। একশবার পারব।
আদনান, তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। খেতে এসো। হঠাৎ বজ্রপাত। দরজায় বাবার কণ্ঠস্বর।
চাকরের সামনে অমিততেজী আদনান এবার চুপসে গেল মুহূর্তে। বাবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভুলিয়ে দিল ওর অনাহারে থাকার প্রতিজ্ঞা। অনিচ্ছা নিয়ে আদনান বেরিয়ে এল কম্বলের ভেতর থেকে। লন্ঠনের আলোর উল্টো দিকে দীর্ঘ ছায়া ফেলে ও ত্যাগ করল শফিকের ঘর। খাওয়ার পর ওদের দু ভাইকে নিজের ঘরে ডেকে নিলেন বাবা। রেডিও বগলে করে দাদাজি চলে গেলেন নির্ধারিত বিছানায়। বাবার ঘর মানেই জ্ঞানের রাজ্য। দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিনের স্তূপ। তাকে সাজানো সারি সারি বই। বেশিরভাগই ইতিহাস এবং রাজনীতির। আছে সাহিত্যের বইও। গালিব, হাফিজ, ইকবাল, ওমর খৈয়ামের কালেকশন আছে। গ্রামের একজন সাদামাটা দরিদ্র স্কুলমাস্টারের বিদ্যাপ্রীতি অবাক করে আদনানকে। এই বয়সেই আদনান বুঝে গেছে, একটি রাজনীতি সচেতন পরিবারে তার জন্ম হয়েছে। দাদাজি ভারী ভারী ইংরেজি বই পড়তে না পারলেও নিয়মিত তিনি পত্রিকা পড়েন। আর রেডিও তো তার নিত্যসঙ্গী। ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও রেডিও তার শিথানের কাছে থাকবেই। গোলমালটা লাগে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের দিনে। সেদিন রেডিও নিয়ে দাদা-নাতির মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। দাদাজানের ক্রিকেট নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই অথচ আদনান ক্রিকেট বলতে অজ্ঞান। পাড়ার ভেতর এই একটাই মাত্র রেডিও। আদনানের ক্রিকেট খেলার বন্ধুরা এদিন সকাল সকাল হাজির হয়ে যায় আদনানদের বাড়িতে। বিছানার মাঝখানে রেডিও রেখে সবাই চারপাশে গোল হয়ে বসে। মা একদিন কাপ ভর্তি লবণ চা দিতে এসে ওদের এই ধ্যান দেখে হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তোরা তো দেখি কাবাঘরের মতো রেডিওকে তাওয়াফ করছিস।
খেলা শোনার দিন প্রায়ই স্কুল কামাই হয়ে যায়। ওরা সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করে, ক্রিকেট ম্যাচগুলো যেন ছুটির দিনে হয়। বিশেষত ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ বন্ধ কিংবা খোলা যেদিনই হোক, ওরা স্কুলে যায় না। ভারতে বিপক্ষে ওরা সব সময় পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে। আদনান কোনোদিন কোনো কাশ্মীরিকে দেখেনি ক্রিকেটে ভারতকে সাপোর্ট করতে। বরং ভারত যার বিপক্ষে কাশ্মীরিরা তার পক্ষে। হোক সে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা পাকিস্তান। তবে হ্যাঁ, ওদের একটিমাত্র বন্ধু, অজিত, সে ওদের বিপক্ষে সবসময় ভারতকে সমর্থন করে। আর এই একজনের মতের বৈপরীত্য ওদের খেলার আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। যেদিন ভারত জেতে সেদিন অজিতের কথার মুখে টেকা কঠিন হয়ে যায়। আবার পাকিস্তান জিতলে ওরা এতটাই খেপায় বন্ধু অজিতকে, সেদিন ওর ঘর থেকে বেরোনোর অবস্থা থাকে না।
দেশবিদেশের খবরের জন্য দাদাজির এমন ব্যাকুলতা, খেলার দিন বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ পরিক্রমার শুরু হলে দোকান ফেলে তিনি ছুটে আসেন বাড়িতে। আদনান ও তার বন্ধুদের অনুরোধ করে পনেরো মিনিটের জন্য রেডিওটা চেয়ে নেন। তখন আদনানরা মহাবিরক্ত হয় সাংবাদপাঠক এবং দাদাজির ওপর। আদনান খেয়াল করে দেখেছে, সংবাদের এই বিরতির মাঝখানেই ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে যায়। হয় ছক্কা অথবা আউট। অথচ রেডিওর এত কাছে থাকার পরও সেই ঘটনার সরাসরি সাক্ষী ওরা হতে পারে না। তবে দাদাজি ওদের ধৈর্যের পরীক্ষা দীর্ঘ করেন না। সংবাদ শেষ হতেই নাতিদের হাতে রেডিওটা ছেড়ে দিয়ে শোনা খবর আওড়াতে আওড়াতে তিনি ফিরে যান দোকানে। কোনো কোনো দিন যাওয়ার আগে তার কণ্ঠে জিজ্ঞাসা ফুটে ওঠে—রায়হানকে তো দেখছি না। ও নেই?
বন্ধুরা সমস্বরে বলে, খেলাধুলার প্রতি রায়হানের কোনো আগ্রহ নেই। এবার তুমি যাও তো দাদাজি। বিরক্ত করো না।
আদনান মাঝে মাঝে ভাবে, এমন খবর-পাগল পিতার ঔরসেই তো বাবার মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞের জন্ম হবার কথা। কিন্তু আদনান ওর পূর্বপুরুষ থেকে কীসের উত্তরাধিকার বহন করছে? পড়াশোনায় ও বরাবরই ভালো। স্কুলজীবনের প্রথম দিন থেকেই ও শিক্ষকদের স্নেহ পেয়ে আসছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো বিশেষ ঘটনা তো ওকে তাড়িত করে না। এই উপত্যকা, উপত্যকার মানুষ, বরফের মুকুট পরা পর্বত, লিডারের মন উদাস করা ঢেউ, পাইন গাছের শাখায় সবুজের মুখরতা, আপেল বাগানের সৌরভ আর ক্রিকেটের বাইরে ওর জীবনে আর কোনো বৈভব নেই। তাহলে? বাবা প্রায়ই বলেন, সময়ই তোমার লক্ষ্য ঠিক করে দেবে; কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক কোন পথে চালিত করবে, তা ঠিক করবার দায়িত্ব তোমার। আমি তোমাকে যুগসচেতন প্রাজ্ঞ মানুষ হিসেবে দেখতে চাই, কাল যার থেকে কখনো হতাশ হবে না।
প্রথম প্রথম বাবার এসব ভারী কথার মর্ম উপলব্ধি করতে পারত না আদনান। ও কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকত বাবার পরিপাটি করা অভিজাত চেহারার দিকে আর অপেক্ষা করত বিকেলের জন্য, যে বিকেলে ওর বন্ধুরা খেলার জন্য পর্বতের পাদদেশে জড়ো হয়। কিন্তু নাইনে ওঠার পর ইংরেজিটা টুকটাক পড়তে পারার সুবাদে ও যখন স্টিভেনসন, ডিকেন্স, কিপলিং এবং ডেফোর বই পড়া শুরু করল, পড়তে লাগল ওথেলো, হ্যামলেট, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস; উর্দু লেখক প্রেমচাঁদ, মান্টো, গালিব, ইকবালে ও যখন আচ্ছন্ন হলো, ও উপলব্ধি করতে শুরু করল বাবার কথার মানে। সত্যিই, শুধু অর্থোপার্জন, বিয়ে, সন্তান উৎপাদন, পানাহার এবং মলত্যাগের জন্য মানুষের জন্ম নয়। এগুলোর পাশাপাশি অর্জনের ভিন্ন কোনো পালক যদি সে মুকুটে ধারণ করতে পারে, তবেই তার মানবজনম সার্থক।
রাতের আহার শেষে আদনান ও রায়হান বাবার মুখোমুখি গদিআঁটা দুই আসনে বসে। বাবাকে আজ অন্য রকম লাগছে। তার দীপ্ত চোখের দ্যুতি যেন আজ নিস্প্রভ। দৃঢ় চোয়াল খানিকটা ঝোলা। মুখের খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি সজারুর কাঁটার মতো খাড়া। কুঞ্চিত কপালে চিন্তার রেখা। তুচ্ছ কারণে দুই ভাইয়ের মারামারি নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সেইসব ঘটনায় বাবার চোখের দ্যুতি কখনো নিস্প্রভ হতে দেখেনি আদনান। বাবা কি খুব রেগে গেছেন? অথবা বিরক্ত?
এই, আমাদের চা দিও তো। মায়ের উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে বললেন বাবা। বদ্ধ ঘরের ওপাশে বাবার কণ্ঠ পৌঁছল কি না কে জানে। আদনান কি একবার চায়ের কথা বলে আসবে মাকে?
বহুকাল ধরে কাশ্মীরিদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। অত্যাচারীর বিষাক্ত তরবারি বারবার স্পর্শ করেছে আমাদের কণ্ঠনালি। এই সময়, যখন অধিকার আদায়ের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দরকার, তখন তোমরা ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করছ। তোমাদের জন্য আফসোস! বাবার কণ্ঠ মাইকের আজানের মতো বেজে উঠল।
আদনানের ইচ্ছা করল সবকিছু খুলে বলতে—আব্বুজি, দরিদ্র দুটি মেয়ের হাতে আপেল দেয়া কি অন্যায়? কিন্তু বাবার পাথুরে মুখের দিকে চেয়ে কথা বলার সাহস হলো না ওর।
আব্বুজি, এ বছর এখনো আপেল পাড়া হয়নি একটাও। তার আগেই আদনান কেন গাছে হাত লাগাবে। আমি ওর এই অন্যায় সহ্য করতে পারিনি। দাদাজি ওকে যেমন পাহারা দিতে বলেছেন, বলেছেন আমাকেও। আমার সামনে আপনার সম্পদ নষ্ট হোক আমি চাইনি। অচেনা মেয়ে দুটোর সামনে ও আমাকে অপমান করেছে। আমি ওদের চলে যেতে বললে ও রুখে দাঁড়ায়। নয়তো ওকে মারতাম না। শেষের দিকে রায়হানের কণ্ঠ উঁচুগ্রামে উঠে যায়।
তোমাদের দাদাজি বাগান পাহারা দিতে বলেছেন, কিন্তু দরিদ্রকে সাহায্য করতে নিষেধ নিশ্চয় করেননি।
আজ একজনকে দিলে কাল আরো লোক আসবে। আমাদের ফলগুলো অন্যদের ঘরে চলে যাবে।
আল্লাহর ভান্ডারে তো কম নেই। তুমি মানুষকে যত দেবে আল্লাহও তোমাকে তত বাড়িয়ে দেবেন। কোরআনের সেই আয়াতটা কি তুমি ভুলে গেছ, যেখানে আল্লাহ বলেছেন : যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে, সেই ব্যয় একটি শস্যদানার মতো। শস্যদানা থেকে সাতটি শীষ গজায় আর প্রত্যেক শীষে থাকে একশটি দানা। দরিদ্রকে তুমি একটি আপেল দিলে আল্লাহ তোমাকে দেবেন সাতশটি আপেল।
তার মানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় এখন আমিই দোষী সাব্যস্ত হলাম। সরি আব্বুজি। আমার ঘুম পাচ্ছে। বলেই উঠে দাঁড়াল রায়হান। ও যখন দরজার পাল্লায় শব্দ করে বেরিয়ে গেল, মা লবণ চায়ের কেটলি হাতে প্রবেশ করলেন এ-ঘরে। অবাক হয়ে বাবার উদ্দেশে বললেন, কী ব্যাপার, ওকে বকা দিয়েছ? অমন অন্ধকার মুখ করে বেরিয়ে গেল কেন ও?
আদনান বলল, আব্বুজি ওকে বোঝাতে গেছে, উল্টো আব্বুজির ওপর রাগ দেখিয়ে ও চলে গেল।
তুমি পারো শুধু রাগ করতে। কাছে বসিয়ে আদর করে দু দণ্ড গল্প তো করতে পারো না। মা কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে লাগলেন।
আব্বুজি, আপনি অত্যাচারীর তরবারির কথা বলছিলেন। কারা আমাদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছে? কারা অত্যাচারী?
জানতে হলে অনেক পড়তে হবে তোমাকে। এ ঘরে তোমার তৃষ্ণা মেটানোর মতো অনেক বই আছে।
বই পড়া শুরু করেছি আমি। তবু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।
আমাদের এই উপত্যকা কোনদিনই পরাধীনতা সহ্য করেনি, বুঝলে? বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। দ্বিতীয় কাপ তুলে নিয়ে আদনান বাবার মুখের দিকে তাকাল। মা এসে বসলেন ওর পাশে। বাবা বলতে লাগলেন, আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে কলহান নামে একজন জ্ঞানী মানুষ জন্মেছিলেন এই কাশ্মীরে। তিনি রাজতরঙ্গিণী নামে কাশ্মীরের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটি যদি তুমি পড়ো, জানতে পারবে যে, সুপ্রাচীন কাল থেকে স্থানীয় কাশ্মীরিরাই এই উপত্যকা শাসন করত। মাঝেমধ্যে ভারতবর্ষের শক্তিমান শাসকেরা কাশ্মীরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করলেও যখনই তাদের শাসনের রশি ঢিলা হতো, অমনি এখানকার আজন্ম স্বাধীনচেতা মানুষগুলো বিদ্রোহ করে বসত। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এভাবেই এগিয়েছে কাশ্মীরের ইতিহাস।
তাই!
১৫৮৬ সালে সম্রাট আকবর কাশ্মীরকে মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেন। এই প্রথম বহিরাগতদের শাসনের সূত্রপাত হয় কাশ্মীরে। এরপর চারশ বছর ক্রমাগত বিদেশি শাসন চলেছে এই উপত্যকায়। কখনো মোঘল, কখনো পাঠান, কখনো শিখ, কখনো ডোগরা—কিন্তু কখনোই কোনো কাশ্মীরি নয়।
আব্বুজি, তখন তো অনেক কষ্টের দিন ছিল, তাই না?
এখনো তো সুখে নেই তুমি। একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে তোমার জন্মাবার কথা ছিল। অথচ গোলামির জিঞ্জির গলায় পরাধীন দেশে তোমাকে আসতে হলো। চোখ মেলবার আগেই লুঠ হয়ে গেল তোমার মাতৃভূমি। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে তোমাকে সর্বদা লাঞ্ছনার জোয়াল বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
পর্দা সরে গিয়ে হঠাৎ জানলার কাচের ওপাশে ঘন রাত্রি চকচক করে উঠল। সেদিকে চোখ পড়তেই কেমন গা ছমছম করে উঠল নাজনীনের। তিনি উঠে গিয়ে পর্দা টেনে দিলেন।
নূরজাহান কি ঘুমিয়ে পড়েছে? জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
এখনো ঘুমায়নি। ডাকব ওকে?
বাবা কিছু বলার আগেই নূরজাহানকে ডাকতে উঠে গেল আদনান। নূরজাহান দুই বছরের ছোট বোন আদনানের। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট এই বোনটাকে আদনান বড্ড ভালোবাসে। অবশ্য ঠোকাঠুকিও কম লাগে না দুজনের। বিশেষত ছুটির দিনগুলোতে সাইকেল নিয়ে আদনান কোথাও বেরোতে গেলে ঝামেলা পাকাবেই নূরজাহান। দস্যি মেয়ের মতো সেও বাইরে যাওয়ার বায়না ধরবে। আদনান কিছুতেই বোঝাতে পারে না, ছেলেদের সব কাজে মেয়েদের থাকতে নেই। সেই দস্যি মেয়েটা খানিক পর আদনানের পিছু পিছু বাবার ঘরে ঢুকল। গায়ে হাটু ছাড়ানো লম্বা পিরহান। হাত দুটো ডোবানো পিরহানের পকেটে। ঢুলুঢুলু চোখ। ঈষৎ রেশমি চুল লুটানো মুখের ওপর। চেহারায় ঘুমের পেলবতা। নাজনীন এক কাপ চা ধরিয়ে দিলেন কন্যার হাতে। এবার ঘুম ওর চোখ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচবে। ইতিহাসের ক্লাশে বসেছে যখন, তখন ঘুমোনো বারণ।
ঘুমিয়ে গিয়েছিলে? জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
না আব্বুজি। মাত্রই শুয়েছিলাম। তোমরা কী করছ না ঘুমিয়ে?
তোর আব্বুজি ইতিহাসের গল্প বলছে। তাই তোকে ডাকলাম। উৎসাহ নিয়ে বললেন নাজনীন।
নূরজাহান চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, বেশ তো। আমি শুনব। নূরজাহান বাবার পাশে গিয়ে খাটের ওপর বসল। পা ঢুকিয়ে দিল কম্বলের ভেতর। খাটের কোনায় জ্বলতে থাকা কাংড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে ও শীত তাড়াবার চেষ্ট করল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আমলে কাশ্মীরে অত্যাচারী ডোগরা শাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো, সেই গল্প এখন বলব তোমাদের। বাবার চায়ের কাপ ততক্ষণে খালি। নাজনীন স্বামীর কাপে নতুন করে গোলাপি রঙের লবণ চা ঢেলে দিলেন। বাবা বলতে লাগলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পাঞ্জাবে শিখ শক্তির উত্থান ঘটে রণজিৎ সিংয়ের নেতৃত্বে। এই রণজিৎ সিং ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। শেয়ালের মতো চতুর এবং সিংহের মতো সাহসী। ১৮১৯ সালের দিকে কাশ্মীরে পাঠানরা শাসন করত। রণজিৎ সিং পাঠানদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করে নেন। কিন্তু ভারতবর্ষে তখন রণজিৎ সিংয়ের চেয়েও মহাশক্তিধর ইংরেজদের শাসন চলছে। পাঞ্জাবের শাসন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, কৌশলগত কারণেই রণজিৎ সিং ইংরেজদের মনোরঞ্জন করতে থাকেন। তাই, যতদিন রণজিৎ সিং বেঁচে ছিলেন, ততদিন পাঞ্জাব এবং কাশ্মীর তার দখলে ছিল। কিন্তু ১৮৩৯ সালে যেইনা তিনি মারা গেলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিখদের রাজত্ব দখল করবার পাঁয়তারা শুরু করল। শিখদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ হলো দুইবার। শেষমেশ ১৮৪৬ সালে চূড়ান্ত যুদ্ধে পরাজিত হলো শিখরা।
আব্বুজি, তুমি কাশ্মীরের গল্প বলো। শিখদের গল্পে আমার কোনো আগ্রহ নেই। গল্পের মাঝ পথে বাবাকে থামিয়ে দিল নূরজাহান। ও বড্ড তাড়াহুড়োপ্রবণ।
এই তো এখনই কাশ্মীরে ঢুকছি। একটু ধৈর্য ধরো। তো, সন্ধিচুক্তি অনুসারে ব্রিটিশরা শিখদের কাছে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ চাইল পঁচাত্তর লক্ষ রুপি। ওদিকে যুদ্ধ শিখদেরকেও দরিদ্র বানিয়ে ফেলেছে। এত অর্থ তারা কোথায় পাবে! রুপির বদলে তারা ইংরেজদের হাতে তুলে দিল পৃথিবীর বেহেশত কাশ্মীরকে।
সর্বনাশ! এক শাসকের কবল থেকে আরেক শাসকের কবলে। কাশ্মীর যেন দাদাজানের দোকানের সদাই। আদনান আফসোস করে উঠল।
সদাইয়ের দেখেছ কি! এখনই আরেক হাত বদল হবে। মাঝখানে বলে উঠলেন মা। সন্তানদের মতো তিনিও উত্তেজিত।
নূরজাহান বিস্মিত হয়ে বলল, তুমিও এগুলো জানো, আম্মুজি? কীভাবে জানো?
সবই সঙ্গদোষ, বুঝলি! নাজনীনের রক্তিম ঠোঁটে মুচকি হাসি। আড়চোখে তিনি তাকালেন স্বামীর দিকে। কিন্তু ফয়জুল্লাহকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছে কাশ্মীরের বেদনাবিধর ইতিহাস। স্ত্রীর রসিকতা তাকে স্পর্শ করল না। তিনি বলতে থাকলেন, শিখদের হাত থেকে কাশ্মীর চলে এল ব্রিটিশদের হাতে। কিন্তু এই দুর্গম উপজাতি-প্রধান উপত্যকা শাসনের ঝুঁকি চতুর ব্রিটিশরা নিতে চাইল না। তারা এক কোটি রুপির বিনিময়ে কাশ্মীরকে বিক্রি করে দিল জম্মুর ডোগরা রাজ গুলাব সিংয়ের কাছে এবং তাকে করদ রাজ্যের শাসকের স্বীকৃতি দিল। অর্থাৎ বার্ষিক কর দিয়ে ব্রিটিশদের মনোরঞ্জন করে তাকে চলতে হবে।
আবার বিক্রি! এতদিন জানতাম আপেল, নাশপাতি, গরু, ভেড়া বিক্রি হয়। এখন দেখছি দেশও বিক্রি হয়! বাবার কথা কেমন অবিশ্বাস্য লাগে আদনানের। এই উপত্যকার কঠিন পাথুরে মাটি উত্থান পতনের কতই না বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী! ও জোরে শ্বাস নিয়ে বাতাসে বুক ভর্তি করে। ইতিহাসের রোমাঞ্চকর এবং বিদঘুটে চরিত্রগুলোর গন্ধ পায় নাকে। যেন ওই চরিত্রগুলোর অশরীরী আত্মা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে কাশ্মীরের পাহাড়ে পর্বতে। ইতিহাসের সামান্য এই আখ্যানটুকুই ওকে হতভম্ব করে দিয়েছে অথচ গল্পের তখনো অনেক বাকি, যা বলবার প্রস্ততি নিচ্ছেন ফয়জুল্লাহ।
হিন্দু, মুসলমান, শিখ যারাই শাসন করেছে কাশ্মীরকে, প্রত্যেকে নিপীড়ন চালিয়েছে কাশ্মীরিদের ওপর। তবে একশ বছরের ডোগরা শাসন কাশ্মীরিদের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিল। সাম্প্রদায়িক গুলাব সিং কাশ্মীরি কৃষকদের ওপর করের বোঝা এতটাই চাপিয়েছিলেন যে, তার সম্বন্ধে বলা হতো, তিনি করের মাধ্যমে রক্ত চুষে নিচ্ছেন। তার এই অরাজকতার বিরুদ্ধে পুঞ্চ এলাকায় প্রতিবাদ হয়েছিল। গুলাব সিং প্রতিবাদীদের দমন করতে এমন বীভৎস পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, ইতিহাসে তার নজির মেলা ভার। বিক্ষোভকারীদের শরীর থেকে চামড়া আলাদা করে তাদের চামড়াবিহীন দেহ টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল রাস্তায়, অন্যদের শিক্ষার জন্য। গুলাব সিংয়ের পুত্র রণবীর সিং মুসলিম প্রজাদের নদীবক্ষে চুবিয়ে মারতেন, যেন ইংরেজ প্রতিনিধিরা তার রাজ্যের অনাহারী অপুষ্ট মানুষের প্রাচুর্য দেখে বিব্রত এবং নাখোশ না হয়। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে শ্রীনগরের মানবসমাজের এক মর্মন্তুদ ছবি পাওয়া যায় জি এন কাউল নামের এক হিন্দু লেখকের রচনায়। তিনি লিখেছেন—গণিকাবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, রোগব্যাধি, নিরক্ষরতা এবং বেকারত্ব অন্ধকার রাতের মতো ছেয়ে গিয়েছিল উপত্যকতা জুড়ে। মুসলিম প্রজারা অপরিসীম অনটনের মধ্যে কালাতিপাত করত। অন্তত নব্বই শতাংশ মুসলমানদের ঘরবাড়ি হিন্দু মহাজনদের হাতে বন্ধকি পড়েছিল।
জনৈক ব্রিটিশ সামরিক অফিসারের স্ত্রী মাদাম ব্রুস ১৯১১ সালে কাশ্মীরের ওপর একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখেন। সেই ভ্রমণকাহিনিতে বিশ শতকের প্রথম দিকের সমাজজীবনের একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন : শ্রীনগরের প্রকৃত সৌন্দর্য তার বৈচিত্র্যের মধ্যে নিহিত। মন্দির এবং মসজিদের সহাবস্থান শ্রীনগরের আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু কাশ্মীরের শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। সরকার শহরের মানুষদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি বেশি যত্নবান। শহরবাসীর স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের রসদ জোগায় গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র কৃষক।
কাশ্মীরি লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাজাজ লিখেছেন : মুসলমান প্রজারা ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করত। ছিন্ন বস্ত্র এবং নগ্ন পায়ে মুসলিম চাষীদের দেখলে মনে হতো ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক। মুসলিম চাষীদের অধিকাংশই ছিল ভূমিহীন খেতমজুর। তারা জমিদারদের জমিতে ভূমিদাস হিসেবে কাজ করত। আর খেয়ালি শাসকের বিলাসিতার জোগান দিতে হতো মোটা অঙ্কের কর পরিশোধের মাধ্যমে। সরকারের রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে তারা হিন্দু মহাজনদের ঋণের জালে আটকা পড়ত। শত জুলুম-নিপীড়িন, ঋণ আর করের বোঝা মাথায় নিয়েও তারা ডোগরার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি, কারণ, তখন তাদের ভেতর জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষই ঘটেনি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-বিদ্রোহের জন্য যে নেতৃত্বের প্রয়োজন, সেটাও তাদের ভেতর ছিল না।
তিরিশের দশকে দুঃসময়ের অমানিশা কাটতে আরম্ভ করে। এ সময় নিরীহ কাশ্মীরি মুসলমানদের ভেতর জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। ১৯২৭ সালে স্যার অ্যালবিয়ান ব্যানার্জি ডোগরা মহারাজা হরি সিংয়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ডোগরা অপশাসনে হতাশ হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন এবং প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে হরি সিংয়ের দুঃশাসনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জম্মু কাশ্মীরের বিশাল সংখ্যক মুসলমান জনতাকে নিরক্ষর করে রাখা হয়েছে। দারিদ্র্যপীড়িত এই মুসলমান প্রজারা অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলের মানুষ। এরা সরকার কর্তৃক গবাদি পশুর মতো শাসিত হয়।
অল্পকদিন পরেই অ্যালবিয়ন ব্যানার্জির বিবৃতিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক বরাবর চিঠি লিখলেন অপরিচিত অথচ স্বাধীনচেতা এক কাশ্মীরি যুবক। এই যুবকের নাম শেখ আবদুল্লাহ। পরবর্তীতে কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে উচ্চারিত হবে শেখ আবদুল্লাহ নামটি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার কারণে কালক্রমে তিনি শেরে কাশ্মীর বা কাশ্মীরের সিংহ উপাধিতে ভূষিত হয়ে উঠবেন। যখন তিনি সংবাদপত্র বরাবর চিঠিটি লেখেন, তখন তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র। পড়াশোনা শেষ করে তিনি অত্যাচারী ডোগরা শাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মীরি জনতাকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শেখ আবদুল্লাহর উদ্যোগে বিভিন্ন মসজিদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সভাগুলিতে হরি সিংহের অপশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানানো হয়। তিনি জনতাকে বোঝাতে থাকেন—কাশ্মীরে বিদেশি শাসন বলবৎ রয়েছে। হরি সিং কাশ্মীরি নন। তিনি ইংরেজদের দয়ায় কাশ্মীর লাভ করে এর নাগরিকদের ওপর, বিশেষত মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছেন। অল্পদিনের ব্যবধানে কাশ্মীর উপত্যকায় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন শেখ আবদুল্লাহ এবং তার যে কোনো আহ্বানে জনতা স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিতে থাকে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে কাশ্মীরিদের ভেতর প্রথম জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল।
আল্লাহকে শুকরিয়া যে ঠিক ওই সময় তিনি শেখ আবদুল্লাহকে পাঠিয়েছিলেন। নূরজাহান উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ওর চোখ থেকে ততক্ষণে ঘুমের আবির পালিয়ে গেছে।
কাশ্মীরে তখন ডোগরা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, মহারাজা হরি সিংহ বাধ্য হলেন মুসলমান প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসতে। কাশ্মীরি মুসলমানরা মহারাজার কাছে তাদের ক্ষোভের কারণ পেশ করবার জন্যে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গঠন করল। এই সাত সদস্যের ভেতর ছিলেন শেখ আবদুল্লাহও। ১৯৩১ সালের ঘটনা সেটি। যখন সরকারের সাথে প্রতিনিধিদের আলোচনা সভা চলছিল, তখন আবদুল কাদির নামে এক সাহসী যুবক কাশ্মীরের একটি প্রতিবাদ সমাবেশে মহারাজার অপশাসনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা রাখেন। হরি সিংয়ের সরকার তার বক্তৃতায় এতটাই বিব্রত এবং ক্ষিপ্ত হয়, রাজদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার করে এবং তার বিচারের দিন ধার্য করা হয় ৬ জুলাই। আবদুল কাদিরের মুক্তির দাবিতে গণবিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাশ্মীরি জনতা। জনগণের ক্ষোভের মুখে সন্ত্রস্ত জম্মু-কাশ্মীর সরকার আবদুল কাদিরকে শ্রীনগর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তার বিলম্বিত বিচারের দিন ধার্য করা হয় ১৩ জুলাই। জেল এবং বিচারের দিন বদল করেও ঠান্ডা করা যায় না উত্তপ্ত জনগণের ক্রোধকে। বিচারের দিন সমাগত হলে জনতার বিরাট মিছিল সরকারি বাহিনীর প্রতিরোধ উপেক্ষা করে শ্রীনগর জেলের ভেতর ঢোকার প্রচেষ্টা চালায়। আবদুল কাদিরকে ছিনিয়ে আনা তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু হরি সিংয়ের পুলিশ বাহিনী সেই সুযোগ দেয় না জনতাকে। তারা অত্যন্ত নির্দয়ভাবে গুলি চালায় বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীদের ওপর। ঘটনাস্থলে বাইশজন প্রতিবাদী কাশ্মীরি যুবক মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। ১৯৩১ সালে ১৩ জুলাই বাইশটি প্রাণের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরিদের জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম ঝলকানি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে। দিনটি আজও মনে রেখেছে কাশ্মীরিরা। এখনো দিনটিকে তারা গভীর শ্রদ্ধার সাথে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
১৩ জুলাইয়ের রাষ্ট্রীয় হত্যা কাশ্মীরিদের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে স্তব্ধ করতে পারে না। নেতৃত্বের অভাবে এতদিন তারা মুখ বুজে মার খেয়ে এসেছে, কিন্তু একবার যখন তারা নীরবতার ভেতর নিজেদের কন্ঠস্বর খুঁজে পেল, তাদেরকে আর মুক বানিয়ে রাখা গেল না। দলে দলে তারা সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে শামিল হতে থাকল। অনেকে এই অভ্যুত্থানের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পায়। শাসক যখন অত্যাচারী হিন্দু এবং আন্দোলনকারীরা অত্যাচারিত মুসলমান, তখন এই আন্দোলনের গায়ে সাম্প্রদায়িকতার তকমা লাগানো খুবই সহজ। কিন্তু এই অভিযোগ সঠিক নয়। কাশ্মীরিদের এই অভ্যুত্থান ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ছিল অত্যাচারী পুলিশ, হিন্দু মহাজন ও জায়গীরদার; কখনোই সাধারাণ কোনো হিন্দু নয়।
১৯৩২ সালের অক্টোবর মাসে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘নিখিল জম্মু-কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স’ গঠিত হলে কাশ্মীরিদের বিক্ষিপ্ত আন্দোলন একটি সাংগঠনিক ছাউনির নিচে চলে এল। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নিযুক্ত হলেন শেখ আবদুল্লাহ। সভাপতির ভাষণে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, কাশ্মীর আন্দোলন কখনোই কোনো সাম্প্রদায়িক আন্দোলন নয়। মুসলিম, হিন্দু, শিখ সকল ধর্মের মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা দূর করে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করাই এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। তার এই বক্তব্য যে শুধুই মুখের কথা নয়, মনের কথা; তার নমুনা পাওয়া গেল সাত বছর পরেই। ১৯৩৯ সালের ২৭ এপ্রিল মুসলিম কনফারেন্সের কার্যকরী কমিটি নাম-সংক্রান্ত নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সেদিন থেকে জম্মু-কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্সের নাম হয় জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স। ১৯৪০ সাল নাগাদ ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগদান করে হিন্দু ও শিখদের অনেক সংখ্যালঘু সদস্য। শেখ আবদুল্লাহ তার আত্মজীবনী আতিশ-ই-চিনারে স্বীকার করেছেন, সংগঠন থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়ার পেছনে তার ওপর জওহরলাল নেহরু এবং আল্লামা ইকবালের প্রভাব কাজ করেছে। যদিও মুসলিম শব্দ কেটে দেয়াকে অনেক রক্ষণশীল পরিবার ভালো চোখে দেখেনি। শেখ আবদুল্লহর ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে না পেরে মিরওয়াইজ ইউসুফ শাহ তার ঘনিষ্ঠদের নিয়ে সংগঠন থেকে বেরিয়ে যান এবং আজাদ মুসলিম কনফারেন্স নামে নতুন সংগঠনের সূচনা করেন। শেখ আবদুল্লাহ ও ইউসুফ শাহের বিরোধটা ছিল সাম্প্রদায়িক বনাম অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধ।
১৯৪৪ সালে ন্যাশনাল কনফারেন্স কাশ্মীরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত একটি দাবিনামা হরি সিং সরকারের কাছে পেশ করে। এই দাবিনামার ওপর ভিত্তি করে ‘নয়া কাশ্মীর’ নামে একটি ইশতেহারও প্রকাশ করা হয়। কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নয়া কাশ্মীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
১৯৪৫ সালে অত্যাচারী ডোগরা শাসনের বিরুদ্ধে নবউদ্যমে আন্দোলন শুরু করে কাশ্মীরিরা। গণঅভ্যুত্থানের তীব্রতার মুখে মহারাজা হরি সিং রামচন্দ্র কাককে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে আন্দোলন দমানোর যাবতীয় দায়িত্ব তার হাতে ন্যস্ত করতে বাধ্য হন। পরের বছর ন্যাশনাল কনফারেন্স ডোগরা শাসনের অপসারণের দাবিতে ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী ভারতীয় জনগণের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন দ্বারা যে শেখ আবদুল্লাহ প্রভাবিত হয়েছিলেন, সে কথা স্পষ্ট করে না বললেও চলে। সে সময় শেখ আবদুল্লাহ একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, যে মুহূর্তে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন, সে মুহূর্তে কাশ্মীরিরা অবশ্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল মহারাজার শাসনের অবসানের দাবিও যুক্তিসংগতভাবে তুলতে পারেন। কাশ্মীরের সার্বভৌমত্ব তার প্রকৃত অধিকারী কাশ্মীরিদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
কাশ্মীর ছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতা হরি সিং সরকারকে স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত করেছিল। আন্দোলন দমাতে প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাক সামরিক শাসন জারি করলেন। কাশ্মীরি জনতার স্বাধীনতার স্পৃহা দমন করতে সব ধরনের নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করল সামরিক বাহিনী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হলো অনেক মানুষ। অনেকে হলো আহত। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হলো। এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হলো শেখ আবদুল্লাহকে। তাকে তিন বছরের জন্য কারারুদ্ধ করা হলো।
আব্বুজি, আপনি ডোগরা সরকারের জুলুমের কথা বলছেন। কিন্তু এখন তো আমরা ভারতীয় সরকারের জুলুমের শিকার। ভারত কীভাবে আমাদের ওপর কর্তৃত্ব শুরু করল? কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আদনান।
সেটা তো আরেক মর্মান্তিক ইতিহাস। সেই ইতিহাসে ঢুকব বলেই ভূমিকা হিসেবে ডোগরা মহারাজার অপশাসন এবং স্বাধীকার আন্দোলনে ন্যাশনাল কনফারেন্স ও শেখ আবদুল্লাহর অবদানের কথা উল্লেখ করলাম। আমাদের স্বাধীনতার সূর্য ডোগরাদের হাত থেকে কীভাবে ভারতীয়দের হাতে চলে গেল, আজ সেই ইতিহাস বলতে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই আজ এ পর্যন্তই থাকুক। অন্যদিন তোমাদের কৌতূহল নিবারণ করব, কেমন? এখন ঘুমাতে যাও। আর হ্যাঁ, রায়হানের সাথে তুমি আর লাগতে যেও না। জানোই তো, ও একটু অন্য রকম।
পর্বতের মতো ভারী, দুপুরের মতো বিষণ্ন বেদনার বোঝা নিয়ে সেই রাতে ঘুমাতে গেল আদনান ও নূরজাহান।
পরদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হলো আদনানের। স্কুল ছুটি হলে তারিক-অজিতের সাথে ও সোজা চলে গেল আপেল বাগানে। ব্যাগভর্তি আপেল পেড়ে শিশনাগ খাল পার হয়ে বিকেলের আগে আগে আতিকাদের খোঁজে ওরা পৌঁছে গেল পাশের গাঁ বাতেকানে। পাশাপাশি গ্রাম হলেও শিশনাগের বিয়োগ রেখার কারণে বাতেকানে কখনো যাওয়া হয়নি ওদের। গুরিহাকা থেকে আলাদা কিছু নয় বাতেকান, তবু গ্রামটিতে পা রেখে মনে হলো, প্রকৃতির বৈচিত্র্য দেখতে মাঝেমধ্যে এদিক-সেদিক বেরিয়ে পড়লে মন্দ হয় না। একটি টিলার ওপর একাকী দাঁড়িয়ে ছিল একটি ফার গাছ। টিলার সবুজ চত্বরে মুখ লাগিয়ে ঘাস খাচ্ছিল দুটো গরু। যে পর্বতের পাদদেশে আদনানরা ক্রিকেট খেলে, বাতেকানের খালপাড় থেকে সেই পর্বত দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। ঝকঝকে নীল আকাশকে মনে হচ্ছিল একটি চাদর, যা এক মুহূর্তে পর্বতের চূড়ার ওপর নেমে আসবে। আকাশের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ভারতবর্ষের মানচিত্রের মতো এক টুকরো সাদা মেঘ, কল্পনা করলে যার ভেতর বাবা মায়ের মুখও আবিষ্কার করা যায়। আদনানরা ওদের বয়সী কোনো ছেলেকে খুঁজছিল, যার কাছে আতিকাদের কথা জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু আশপাশে কোনো মানুষ তো নেই-ই, বাড়িঘরও নেই। ওরা বুঝল, এটা গ্রামের শেষ প্রান্ত, লোকালয় আরো ভেতরে।
গরু দুটোর গালে আদর দিয়ে, ধানখেতের আইল মাড়িয়ে, পপলার গাছের ছায়া ডিঙিয়ে ওরা পৌঁছে গেল সেখানে, যেখান থেকে লোকালয়ের শুরু। সামনের বাড়িটির ছাদের ওপর দৃষ্টি গড়িয়ে দিলে ওপাশে মসজিদের মিনার দেখা যাচ্ছিল। মিনারটি হয়তো ওদের চোখ এড়িয়ে যেত, কিন্তু আসরের মধুর আজানধ্বনি ওদেরকে মিনারের দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করল। অজিত বলল, তোরা নামাজ পড়বি না?
পড়ব পড়ব। আপেলের ব্যাগ অজিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওরা নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক তখন ওদের চোখ পড়ল ধানখেতের পাশে এক টুকরো সবুজ মাঠে, যেখানে ওদের বয়সী কয়েকটি ছেলে ক্রিকেট খেলছে। খেলার প্রতি এমন তীব্র-তুমুল আকর্ষণ ওদের, ওরা দৌড়ে গেল দর্শক সারিতে এবং খেলা দেখায় এমনভাবে বিভোর হলো, একটু পর নামাজ দূরে থাক, বাতেকানে আসার উদ্দেশ্যই ভুলে গেল। আধা ঘণ্টা পর যখন একটি শবযাত্রীর দল লাশের খাটিয়া নিয়ে উচ্চস্বরে কালেমা পড়তে পড়তে খেলার মাঠ অতিক্রম করল, তখন ঘোর ভাঙল ওদের। ক্রিকেট যতই আকর্ষণীয় হোক, তা নৈমিত্তিকতার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু একটা মানুষের ইহলোক ত্যাগ, সে তো বড়ই চাঞ্চল্যকর এবং বেদনাদায়ক ঘটনা। একজন মানুষের মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে থাকে জীবিত পৃথিবীর অনেকগুলো আয়োজন। মৃত্যু মানেই দুঃখী দুঃখী চেহারার দূরবর্তী স্বজনদের পুনর্মিলন, কাছের মানুষের আছাড়ি-বিছাড়ি কান্না, কবর খনন, চিরবিদায় স্টোরের মালিকের গোপন আনন্দ, হুজুরের ব্যস্ততা, মুসল্লিদের সাজ সাজ রবে জানাজায় উপস্থিত, দাফনের পর মোনাজাতে ফোঁপানোর শব্দ, সিন্নি বিতরণ ইত্যাদি। একমাত্র মৃত্যুই পারে উক্ত আয়োজনের প্রতিটি চরিত্রকে নিপুণভাবে মঞ্চে হাজির করতে। মৃত্যুমঞ্চের চরিত্রদেরকে দেখতে বড় ভালো লাগে আদনানের। যখনই ও কারো মৃত্যু সংবাদ শোনে, ছুটে যায় মৃতবাড়িতে। লাশ দেখে। লাশকে ঘিরে স্বজনদের কান্না দেখে। ভিড়ের মানুষ দেখে। তারপর ছুটে যায় গোরস্তানে। কবরখনন দেখে। গোরখোদকের পেশির ওঠানামা দেখে। কবরের মাটির বিষণ্নতা দেখে। সারাটা দিন মৃত্যু-সংশ্লিষ্ট প্রতিটি চরিত্রকে ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। মৃত্যুর প্রতিটি উপকরণে এত আগ্রহ কেন আদনানের, সে নিজেও জানে না।
আজ শবযাত্রীদের নিমগ্ন কালেমাধ্বনি চমকিত করে আদনানকে। ঘাড় ঘোরাতেই টুপি পরিহিত ওইসব মুখের ওপর আটকে যায় ওর চোখ, মৃত্যুচিন্তার ভীতিকর আবহে সংবেদহীন যাদের চেহারা। ক্রীড়ারত কিশোরেরা মৃতের সম্মানে কতক্ষণ স্থগিত রাখে খেলা আর এই ফাঁকে আদনানরা জুটে যায় শবযাত্রার লেজে। ওরাও দুঃখী দুঃখী মুখ করে নিঃশব্দে চলতে থাকে খাটিয়ার পেছন পেছন। ওদের উদ্দেশ্য—শবযাত্রীদের কারো কাছ থেকে আতিকাদের ঠিকানা জেনে নেয়া। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ঈদগাহ মাঠে গিয়ে শেষ হয় শবযাত্রার মিছিল। গুরিহাকার মতোই ইটের বুননে তৈরি মেহরাব, দুই ঈদে এখানে দাঁড়িয়ে নিশ্চয় ইমাম সাহেব খুতবা দেন। একটি দেবদারু গাছ ছাতার মতো ছায়া দিয়ে আছে মেহরাবের মাথায়। ছাতার মাথার ওপর উড়ছে এক জোড়া উদাসীন চিল। ততক্ষণে আদনানরা জেনে গেছে, ঈদগাহ মাঠে জানাজা পড়ে পাশের গোরস্তানে দাফন করা হবে লাশ। জানাজার কাতারে দাঁড়াতে অজিত ইতস্তত করলে আদনান ফিসফিস করে—আরে দাঁড়িয়ে পড়। শুধু অভিনয় করবি।
জানাজায় ইমাম সাহেবের পাশাপাশি একজন শীর্ণ প্রৌঢ়, যার সমগ্র শরীরে দারিদ্র্যের ছোবল, সম্মিলিত মুসল্লিদের উদ্দেশে কথা বলেন। তিনি তার সদ্য পরলোকগত মায়ের জন্য দোয়া চান সবার কাছে। এই এতক্ষণে আদনানরা জানতে পারে, মৃত ব্যক্তি একজন নারী এবং তিনি এই প্রৌঢ়ের মা। সহসা আতিকার দাদির কথা মনে পড়ে আদনানের। আতিকার দাদিজান মারা গেল না তো! ঈদগাহ মাঠের শেষপ্রান্তে একটি কাঠবাদাম গাছের নিচে বেশ কয়েকজন নারীর ভেতর আলেয়া ও আতিকাকে দেখে বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠে আদনানের। একবার মনে হয়, ছুটে গিয়ে ওদের জিজ্ঞেস করে, যিনি মারা গেছেন তিনি কি তোমাদের দাদিজান, কিন্তু প্রবল হয়ে ওঠা কৈশোরিক আড়ষ্টতায় নারীসমাগমের উদ্দেশে ওর পা ওঠে না। এ সময় এক পিচ্চিকে পাওয়া যায়, মাথার মাপের চেয়ে বড় টুপি পরে সে জানাজায় এসেছে, তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আতিকাকে চেনো?
আতিকা আমার বেহেনজি। সকালে আমার দাদিজান মারা গেছে।
এটাই তোমার দাদিজান? খাটিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে আদনান।
হ্যাঁ। ইতিবাচক জবাব দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে বালক। বোঝাই যায়, এই ছোট্ট জীবনে সে দাদিজানের অনেক আদর খেয়েছে।
মনটা বিষণ্ন হয়ে যায় আদনানের। একজন বৃদ্ধা নারী, মৃত্যুর পূর্বে যিনি আপেল খেতে চেয়েছিলেন, আদনানের ব্যর্থতায় তার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয় আদনানের। ও বন্ধুদের জানায়—যার জন্য ওদের আপেল নিয়ে আসা, তিনি আর ইহলোকে নেই। বন্ধুদের চেহারায়ও নীল বেদনার ছায়া পড়ে। অজিত আফসোস করে—আমরা যদি কালই আসতাম!
সব দোষ রায়হানের। আদনান চিৎকার করে ওঠে।
এই, জানাজায় এসে এত কীসের গল্প তোমাদের! এক মুরব্বি খেঁকিয়ে ওঠেন। ধমক খেয়ে ওরা চুপসে যায়। জানাজা শেষে দাফন হয় লাশ। বিগলিত কান্নাময় মোনাজাতের ভেতর দিয়ে সমাপ্ত হয় মৃতের প্রতি জীবিতদের দায়িত্ব। কিন্তু আদনানদের দায়িত্ব তখনো শেষ হয়নি। ওরা একটু দূরে একটি মৃত গাছের গুঁড়ির ওপর বসে নির্জনতার অপেক্ষায় থাকে। ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসে ভিড়। কয়েকজন স্বজন চল্লিশ কদম পেরিয়ে গেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যখন কবরে ফেরেশতা চলে আসে, তখনো আতিকার বাবা অথবা চাচা, যিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন, তিনি সহ আরো কয়েকজন কবরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। এবং অনেকক্ষণ। নীল আকাশে হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে আসলে সদ্য দাফনকৃত মানুষটাকে আল্লাহর জিম্মায় রেখে অবশিষ্টরা বাড়ির পথ ধরেন। তারিক বলে, মেঘ করছে। বৃষ্টি নামবে। বাড়ি যেতে হবে না?
আদনান গম্ভীর কণ্ঠে বলে, যাব। তবে একটু কাজ বাকি আছে।
গোরস্তান যখন পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায় এবং দূরেও কোনো মানুষের ছায়া দেখা যায় না, তখন ওরা তিন বন্ধু কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আদনান বিভিন্ন গোরস্তানে, বিশেষত দর্গায়, মৃতদের জন্য কবরের ওপর জীবিতদের খাবার ছড়াতে দেখেছে। জীবিতদের উপহার দেয়া খাবার মৃতরা খেতে পারে কি না জানে না আদনান। তবে এ মাটির ধর্মীয় ও লোকজ সংস্কৃতি এবং চাপা অপরাধবোধ এই মুহূর্তে ওকে আপেল ছড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। ও বড় মমতা নিয়ে আতিকার দাদিজানের শিথানের কাছে রেখে দেয় আপেলের ব্যাগটা। ফিসফিস করে বলে, জীবিতকালে খেতে পারলেন না, এখন তো অনন্ত অবসর, সুযোগ করে খেয়ে নিয়েন। বলতে বলতে ওর চোখ ভিজে আসে। নিজের দাদিজানকে কাছে পায়নি আদনান। ওর জন্মের পূর্বেই তিনি ত্যাগ করেছেন ইহধামের মায়া। আতিকার দাদির মাথার পাশে বসে ওর নিজের দাদির কথা স্মরণ হয়। তখন কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। ওর চোখের জল আড়াল করবার জন্যই কিনা কে জানে, বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা বাতেকানের মাটির ওপর সুরের অপূর্ব মূর্চ্ছনা তৈরি করে। ভেজা মাটির অদ্ভুত সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। বৃষ্টিতে অবগাহন করতে করতে ঘরে ফেরে ওরা তিন বন্ধু।
চলবে…
অসাধারণ মা শা আল্লাহ! তিনো কিস্তিই পড়লাম। আমি বিস্মিত, যারপরনাই মুগ্ধ!
উপন্যাসটি ধারাবাহিক চলুক।
তিন পর্ব শেষ হলো। মজার বিষয় হলো পুরোটা পড়া হয়েছে সিএনজিতে বসে আবার সামনের সীটে।
পড়ার সময় মনে হয়েছে – আদনানের সাথে আপেল বাগানে কখনো খেলার মাঠে আবার রাতে গল্পের আসরে।
আতিকার বাড়িতে আপেল পৌছে দিতে দাদিজানের মৃত্যুতে শোকাতুর।