পর্বতের সামনে পুকুরের মতো এক টুকরো গর্ত। সামনে সবুজের কার্পেটে মোড়া বেশ কয়েকটি টিলা। বসন্তে টিলাগুলো যখন সবুজে চকচক করে, রাখালেরা ভেড়ার পাল নিয়ে আসে চরাতে। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে জেগে থাকে প্রাকৃতিক আসনের মতো পাথরখণ্ড। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাথরগুলোও বুঝি বা ভেড়া। সবুজে মুখর আকাশছোঁয়া পর্বত সামনে নিয়ে পাথরের ওপর বসে ভেড়া পাহারা দেয় রাখাল বালকেরা। সাগরের বিশাল ঢেউয়ের মতো টিলার একেকটি ভাঁজ। কখনো কখনো ভেড়ার আস্ত একটি পাল ওই ভাঁজের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন মনিবের ভেড়ার দুশ্চিন্তায় সচকিত হয়ে ওঠে রাখালের দল। আসন বদল করে তখন তারা ভেড়ার কাছাকাছি কোনো পাথরের ওপর গিয়ে বসে।
সবুজ টিলাগুলোর প্রান্ত বিনীত হতে হতে গিয়ে মিশেছে পুকুরের মতো সেই অবনত ভূমির সাথে, যার উল্টো পাশে বিশাল পর্বতের উদ্ধত দেয়াল। সারা বছর পানিশূন্য থাকলেও গত কয়েক দিনের বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে অবনত ভূমিটি তরুণীর সজল চোখের মতো জলাশয়ের রূপ ধারণ করেছে। সেই জলাশয়ের পাশে দাঁড়ালে সবুজ পর্বতের প্রতিবিম্বে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
সেদিন বৃষ্টিহীন বিকেলে টিলার খাঁজে ক্রিকেট খেলতে এসে আদনানরা দেখে, জানুয়ারির শীতে জলাশয়ের পানি জমাট বেঁধে বরফ। একটু ঝুঁকলে বরফ নামের সেই আয়নায় মুখ দেখা যাবে অবস্থা। খুশিতে ওদের মুখ ডগমগ করে ওঠে। ওরা হইহুল্লোড় করতে করতে ছুটে যায় বরফের ওপর। ওদের প্রত্যেকের পায়ে রেশমি লাইনিং করা রবারের সোলযুক্ত জুতো। পরনে মোটা কাপড়ের ট্রাউজার। গায়ে হাটুছোঁয়া পিরহান। পশমি টুপিতে মুখ-মাথা এমনভাবে ঢাকা, হঠাৎ দেখায় ওদের মায়েরাও হয়তো চিনতে পারবে না। এই দলটির একটিমাত্র ব্যাট। ব্যাটের মালিক আদনান। বাবা পেহেলগাম শহর থেকে কিনে এনে দিয়েছেন ওকে। ব্যাটের মালিকানার সুবাদে পাড়ার ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন বনে গেছে সে। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, ও যা বলে, বেশিরভাগ সময় বন্ধুরা তা পালন করে। আজ ও চিন্তিত মুখে বরফের গায়ে ব্যাট ঠোকে আর ভাবে, জমাটবাঁধা এই বরফে স্ট্যাম্প কীভাবে পুঁতবে! তখন হঠাৎ পাথরের চাঁইয়ের কথা মনে পড়ে ওর। ও ব্যাট কাঁধের ওপর তুলে চিৎকার করে আদেশ করে—এই বেলাল, এই তারিক, এই অজিত পাথরের একটা চাঙড় আন তো!
বন্ধুরা ধরাধরি করে পাথরের একটি চাঙড় বয়ে আনলে সেটিকে খাড়া করে বসিয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে ফেলে আদনান। অজিত মুগ্ধ চোখে বলে, তোর মাথায় এত বুদ্ধি! এটা দারুণ স্ট্যাম্প! পোঁতাপুঁতির ঝামেলা নেই।
দল ভাগ হয়। আনন্দ এবং উত্তেজনা নিয়ে খেলা গড়ায় মাঠে। পর্বতের সবুজ ফুঁড়ে যখন বেরিয়ে আসে একেকজন বোলার, ব্যাটসম্যানের টার্গেট থাকে সজোরে ব্যাট হাঁকিয়ে বলটাকে পর্বতের সেই জায়গায় উড়িয়ে দিতে, যেখানে কান্নার দাগের মতো ঢল নামার দাগ লেগে আছে। কিন্তু কোনো ব্যাটসম্যানই তাদের লক্ষ্য পূরণে সফল হয় না। মহল্লার কয়েকটি বাচ্চা ছেলে বুঝে অথবা না বুঝে দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয় আর জবুথবু হয়ে কাঁপে। কয়েকটা চিল মাথার ওপর বিষণ্ন ডানায় চক্কর কাটে। বসন্তে যে উইলো গাছটি ভেড়ার পালের সাথে হেসে হেসে গল্প করে, এখন, এই শীতে তুষার ঢাকা শূন্য চত্বরে একাকী গাছটি আরো একটি সন্ধ্যাযাপনের প্রস্তুতি নেয়। তখনো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার ঢের বাকি, খেলার মাঝখানে অজিতের সাথে ঠোকাঠুকি লেগে যায় হোরাইরার। অজিত দ্রুতগামী বোলার। অজিতের ওভারের একটি বল হোরাইরার থুতনিতে আঘাত করলে মেজাজ হারায় হোরাইরা। ক্ষিপ্ত হয়ে ও ছুটে আসে অজিতের দিকে আর হিন্দু বলে গালি দেয়। টেনিস বল কতটুকুই বা আহত করতে পারে হোরাইরাকে, তারচেয়ে দ্বিগুণ আহত হয় অজিত, হোরাইরার সাম্প্রদায়িক গালিতে। কতক্ষণ ও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে হোরাইরার দিকে, তারপর নতমস্তকে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করে। এই উপত্যকায় সংখ্যাগুরু মুসলমানের পাশে ওরা সংখ্যালঘু হয়ে জন্ম নিয়েছে। ওরা হিন্দু পণ্ডিত। এই অন্যায্য পাপের কারণে যদি খেলতে এসে গালি খেতে হয়, তবে সেই খেলার প্রয়োজনই নেই। ও মাঠ ত্যাগ করতে চাইলে আদনানসহ ছুটে আসে কয়েকজন। ওরা অজিতকে বোঝায়, হোরাইরা কাজটি মোটেও ঠিক করেনি। রাগের মাথায় বলে ফেলেছে। এর আগে তো কখনো এমন হয়নি।
হয়নি, এখন থেকে হবে। অজিতের গলার স্বরে অভিমান থমথম করে।
আর হবে না। আমি দায়িত্ব নিলাম। আদনান ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে।
হোরাইরাও ততক্ষণে সামলে নিয়েছে ব্যথা। ও নরোম গলায় বলে, যাস না অজিত। আমি দুঃখিত।
সকলের অনুরোধে অজিত খেলায় ফেরে বটে, কিন্তু সেদিন আর বল করে না ও। শুরুতে খেলার যে উচ্ছ্বাস ছিল, সেই উচ্ছ্বাসের সুর কেটে যায়। আদনান তবু সবাইকে ছন্দে ফেরাতে চেষ্টা করে। খেলা যখন প্রথম ইনিংসের শেষ ওভারে গিয়ে দাঁড়ায়, বল হাতে উইকেটের কাছে আসে আদনান। ঝগড়া বিবাদে আজ অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। সময় স্বল্পতায় পেস অ্যাটাক রেখে ও স্পিন বল করে। ধীরে ধীরে কাশ্মীরের অপূর্ব মায়াবী সন্ধ্যা নামে ওদের ক্রিকেট মাঠে। কনকনে শীত জাঁকিয়ে বসে উপত্যকার গায়ে। এমন সময় টিলার ঢালে চিনার গাছের নিচে দুজন পথচারীর ছবি ভেসে ওঠে। শীতের পোশাকের প্রাবাল্যে তাদের চেহারা দেখা না গেলেও একুটু অন্তত আন্দাজ করা যায়, তাদের একজন প্রৌঢ় এবং অপরজন কিশোরী। প্রৌঢ়ের পিঠে ঝুলছে ভারী ব্যাগের মতো পোটলা। ইতস্তত পায়ে আসছে তারা এদিকেই। খেলা রেখে বন্ধুদের কয়েকজনকে সেদিকে মনোযোগী হতে দেখে রেগে যায় আদনান। ঢিলেমি করলে আজ ওর টিম পুরো ওভার ব্যাট করতে পারবে না। ফিল্ডিং খেটে সময়ের অভাবে ব্যাট করতে না পারার মতো বেদনা আর কিছুতে নেই, অন্তত আদনানের কাছে। ও চিৎকার করে সবাইকে খেলায় মনোযোগ দিতে বলে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন এক পরিস্থিতি রচিত হয় এই সন্ধ্যায়, খোদ আদনানকেই মাঠ ছেড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াতে হয়। ও যখন ওভারের দ্বিতীয় বলটা করতে যাবে তখন টিলার ঢেউয়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে শফিক, আদনানদের রাখাল। হন্তদন্ত হয়ে আদনানের কাছে এসে জানায়—ভাইয়াজি, দুজন মেহমান এসেছে বারমুলা জেলা থেকে। তোমাদের বাড়ি যেতে চায়, কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছে না। আমি ওদেরকে তোমার কথা বলেছি। তুমি এখানে খেলছ, তাও বলেছি। ওই তো ওরা আসছে।
শফিকের কথার প্রেক্ষিতে আদনানের ভ্রু ভেঙে যায়। বারমুলা থেকে এই শীতের সন্ধ্যায় কে আসতে পারে, হুট করে মনেও পড়ে না ওর। ও দর্শকদের মাথার ওপর দিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় টিলার ঢালু প্রান্তে, শীতের পাতাঝরা গাছের মতো বিষণ্ন ভঙ্গিতে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুজন আগন্তুক, যারা কিনা ওদের বাড়ির পথ খুঁজছে। অজান্তে আদনানের হাত থেকে পড়ে যায় ক্রিকেট বল। অচেনা মেহমান গন্তব্য হারিয়ে পথের মাঝে ঘুরপাক খাবে আর আদনান কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো খেলা চালিয়ে যাবে এই কুশিক্ষা কাশ্মীর উপত্যকা ওকে দেয়নি। ‘তোরা খেল, আজ আমার খেলা হচ্ছে না রে’ বলে শফিকের সাথে ও হাঁটা ধরে আগন্তুকদ্বয়ের উদ্দেশে। শীতের ধোঁয়া ধোঁয়া সন্ধ্যায় সালাম বিনিময়ের পর ও মেহমানদের উদ্দেশে বলে, আপনারা নাকি আমাদের বাড়িতে যাবেন? তা কোথা থেকে এসেছেন? আপনাদের ঠিক চিনতে পারছি না।
প্রৌঢ় লোকটি সূর্য ডোবার মতো ধীরে কিশোরীর দিকে তাকালে কিশোরীটি নাকের ওপর থেকে নেকাব নামিয়ে ভাইয়াজি বলে কেঁদে ওঠে। আর আদনান তখন অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে মারিয়ামকে। যে মারিয়াম ওর খালাতো বোন, যে খালার বিয়ে হয়েছে বারমুলা জেলায় এবং বহুদিন হয় ওরা বারমুলা যায়নি। এবং মারিয়ামও কি নিকট অতীতে এসেছে ওর বড় খালার বাড়ি পেহেলগামের গুরিহাকায়? আদনান মনে মনে হিসাব কষে—খালা খালুর সাথে মারিয়াম শেষবার যখন এসেছিল এই পেহেলগামে, তারপর চলে গেছে চারটি শীত। আদনান তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আর মারিয়াম প্রাইমারিতে ক্লাশ থ্রিতে পড়ে। সেই শিশু মারিয়াম আজ নূরজাহানের মতো টানা চোখের কিশোরী হয়ে উঠেছে বটে; কিন্তু এরমধ্যে কী এমন ঘটল যে খালা-খালুকে রেখে অচেনা মানুষের সঙ্গে তাকে বেড়াতে আসতে হবে বড় খালার বাড়ি এবং খালাতো ভাইকে দেখে কেঁদে ফেলতে হবে চিৎকার করে? অনেকগুলো প্রশ্ন বুকের মধ্যে বাজপাখির ডানা ঝাপটালেও আদনান সেসবে পাত্তা দেয় না; কারণ, ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা। এক্ষুণি মসজিদের মাইকে মাগরিবের আজান হবে। দাদাজি দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে হাজির হবেন জামাতে। আদনানকে মসজিদে না পেলে তিনি গোস্বা করবেন। পথের মাঝে জেরা না করে মেহমান নিয়ে তাই বাড়ির পথ ধরল আদনান। প্রৌঢ়ের পোটলাটা মাথায় তুলে নিল শফিক। বাড়ি গেলেই খোলাসা হবে সব।
আদনান ভেবেছিল, মেহমানকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই ও জামাতে হাজির হবে; কিন্তু উঠোনে পা রাখতেই এমন অপ্রত্যাশিত এক শোকের ছায়া নেমে এল বাড়িজুড়ে, আদনানের আর মসজিদে যাওয়া হলো না। খালার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মারিয়াম যা বলল, তার সারমর্ম এই : তিনদিন আগে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মারিয়ামের বাবা মা। মারিয়াম এমন এক অভাগা মেয়ে, বারমুলায় বাবা মা ছাড়া ওর আপন কেউ নেই। বাবা ছিলেন একা এক ভাই। নয়তো চাচা-চাচির কাছে ও থাকতে পারত। নিয়তি সেই সুযোগটাও দেয়নি ওকে। আর তাই এই দুর্দিনে প্রতিবেশীদের পরামর্শে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ও আজীবন বসবাস করতে খালার কাছে চলে এসছে।
শেষের কথাটা এমনভাবে ধাক্কা মারল নাজনীনের বুকে, তিনি মারিয়ামের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওরে, তুই তো আমার আরেকটা মেয়ে রে! আমার কাছে আসতে তোর অনুমতি লাগবে নাকি! তোকে আজীবন আমি বুকের ভেতর আগলে রাখব। কে আমার আসল মেয়ে—নূরজাহান নাকি তুই—কেউ বুঝতেই পারবে না কোনদিন। বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এরপর তিনি মারিয়ামকে ঘরে তুলে মৃত বোন ও তার স্বামীর জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে শোক করতে লাগলেন। সেই সন্ধ্যায় আদনানদের বাড়িটা দুঃখের ছবি হয়ে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত জেগে রইল। মাগরিবের পর গোলাপি রঙের লবণ চা খাওয়ার রেওয়াজ এই বাড়িতে। আজ সন্ধ্যায় চায়ের জন্য চুলা জ্বলল না। নূরজাহান অশ্রুভরা চোখে একবার মায়ের পাশে একবার মারিয়ামের পাশে বসতে লাগল। বুদ্ধি হওয়ার পর মাকে সে কোনদিন এমন আহাজারি করে কাঁদতে দেখেনি। তিনদিন আগে বোনের লাশ সামনে নিয়ে যে শোক করবার কথা ছিল নাজনীনের, তিনদিন পর বোনের এতিম মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে সেই শোক করতে লাগলেন তিনি। আট ওভার ফিল্ডিং করে ব্যাট করতে না পারার যে দুঃখ আদনান বয়ে এনেছিল খেলার মাঠ থেকে, মারিয়ামের ব্যথাভরা মুখের সামনে সেই দুঃখ ম্লান হয়ে গেল। ওর খুব ইচ্ছা করছিল মারিয়ামের সামনে গিয়ে সান্ত্বনামূলক দু-একটা বাক্য উচ্চারণ করতে, কিন্তু তিনদিন আগে যে মেয়েটি মা-বাবাকে হারিয়েছে, তাকে কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয়, জানে না আদনান।
সেই রাতে ঘুম হলো না আদনানের। পাশের ঘর থেকে মারিয়ামের ফোঁপানোর আওয়াজ দুঃস্বপ্নের মতো ওকে জাগিয়ে রাখল দীর্ঘক্ষণ। টিনের কৌণিক চালে তুষারপাতের শব্দ হচ্ছিল। একটু পর পর জমা হওয়া তুষার সশব্দে গড়িয়ে পড়ছিল নিচে। বুঝতে শেখার পর থেকে রাতের টিনের চালে তুষারের এই শব্দ বড় প্রার্থিত ছিল আদনানের কাছে। তীর্থযাত্রীদের মতো প্রতিটি শীতে ও অপেক্ষা করত তুষারপাতের। কম্বলের উষ্ণতায় তুষারের শব্দ ওর দু চোখ জুড়ে রূপকথার ঘুম নামাত। কিন্তু আজ তুষারপাতের মায়াবী শব্দকে ওর মনে হলো, পাহাড়ি কোনো দুঃখী মেয়ের কান্নার আওয়াজ। যে আওয়াজ কাঠবাদাম গাছের মাথার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো উপত্যকায়। পাশ ফিরে ও কানে কম্বলচাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল।
শীতকালে পথঘাট তুষারে ঢাকা থাকে বলে বাড়িতেই ফজরের জামাত হয়। ব্যথার রাত্রি পোহালে দাদাজি বাড়ির সবাইকে ডেকে তুললেন নামাজ পড়তে। বসার ঘরে দাদাজির ইমামতিতে নামাজ পড়ল বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। নাজনীন দুই মেয়েকে নিয়ে ভোরের ইবাদত সারলেন নিজের ঘরে। আজ নাজনীনের প্রার্থনা যেন ফুরায় না। খোদার দরবারে দু হাত তুললে পাহাড়ি ঝরনার ঢল নামল তার দু চোখে। প্রার্থনার ভেতর ছোটবোনের শৈশব স্মৃতি তার বুকের ভেতর বারবার ছোবল বসাতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল মারিয়াম। ক্লাশ সেভেনে পড়ুয়া একটি মেয়ে আর কতইবা কাঁদতে পারে। পাকা আপেলের মতো ওর মসৃত কপোলে চড়চড় করছিল কান্নার দাগ। সকাল ছড়িয়ে পড়লে নূরজাহান আদনানের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, মারিয়াম কাল থেকে শুধু কাঁদছে। ভাইয়াজি, এসো স্নোম্যান বানিয়ে ওর দুঃখ ভুলিয়ে দিই।
কিছু একটা করে মারিয়ামের মন ভালো করতে হবে—আদনানও ভাবছিল মনে মনে। অন্তত কোনো একটা কাজে ওকে ব্যস্ত রাখতে পারলে দুঃখ না ভুললেও অন্তত কান্নাটা ওর থামবে। নূরজাহানের প্রস্তাব পছন্দ হলো আদনানের। মারিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে ওরা ভাই-বোন ঘরের পেছনে গেল, যেখানে চাল থেকে গড়িয়ে পড়া তুষার স্তুপ হয়ে ছিল। মারিয়ামকে দাঁড় করিয়ে রেখে ওরা দুজন তুষার দিয়ে একটি মানুষ বানিয়ে ফেলল। শুভ্র তুষারে মানুষের আকৃতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠলেও চোখ যেন ফুটছিল না। নূরজাহান তখন ছুটে গেল রান্নাঘরে। দুই টুকরো কয়লা এনে ও বসিয়ে দিল স্নোম্যানের চোখের জায়গায়। অমনি নিষ্প্রাণ স্নোম্যান যেন দৃষ্টি ফিরে পেল। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল আদনানদের দিকে। নূরজাহান উচ্ছ্বল কণ্ঠে মারিয়ামের উদ্দেশে বলল, সুন্দর না বলো?
মারিয়াম আলতো করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল—হ্যাঁ সুন্দর। এরপর সে নিজেও হাত লাগাল। আদনান ও নূরজাহান পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে নিল গোপনে। হ্যাঁ, ওদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। ওরা চাচ্ছিল মারিয়াম কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক। একটু পর ভুল ভাঙল ওদের। ব্যস্ত রাখতে গিয়ে ওরা মারিয়ামের হাতে এমন অস্ত্র তুলে দিয়েছে, যার মাধ্যমে ওর শোকের ক্ষত আরো দগদগিয়ে উঠল। স্নোম্যান বানিয়ে ও যখন হাত ঝেড়ে ফেলল, আদনানদের চোখে ধরা পড়ল তিনটি তুষার মানব। দুজন নারী পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়ানো। আর একটু দূরে একাকী দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে। মারিয়াম নূরজাহানকে বলল, আরো কয়েকটা কয়লা এনে দাও না! দুটো কয়লা আনবে লাম্বা আকৃতির। আম্মুজির চোখ ছিল টানা টানা। বলে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। আদনান ও নূরজাহান ওদের খালাতো বোনের নির্মাণ শৈলীর সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় দৃশ্যপটে হাজির হলো রায়হান। সে বিস্মিত কণ্ঠে মারিয়ামের উদ্দেশে বলল, কী ব্যাপার, তুমি এই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আদনান আর নূরজাহান নিশ্চয় তোমাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। শিগগির ঘরে চলো। আম্মুজি তোমাকে ডাকছে। আম্মুজি, ও আম্মুজি, মারিয়ামকে ঠান্ডার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছে আদনান।
চুলায় ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি রেখে ঘরের পেছনে ছুটে এলেন নাজনীন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ঠান্ডার মধ্যে তোমরা সবাই বাইরে কেন? আদনান, কী হচ্ছে এখানে?
রায়হানের আচরণে আদনান এতটাই হতভম্ব হয়েছে, ও মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে গেল।
নূরজাহান বলল, আমরা স্নোম্যান বানিয়ে মারিয়ামকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করছি, আম্মুজি।
ঘরে এসো সবাই। চা করেছি। চা খাবে। নাজনীন চলে গেলেন। তার পিছু পিছু গেল রায়হান। মারিয়ামকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল নূরজাহান। সবাই ঘরে ফিরলেও বাইরে তুষারের মধ্যে একাকী দাঁড়িয়ে রইল আদনান। রায়হানের ওপর মনে মনে ও ফুঁসছে। সব কাজে রায়হান কেন ওর বিরোধিতা করে, বুঝতে পারে না ও। ওর পিরহানের পকেটে একটি পাকা আপেল গড়াগড়ি করছিল। এক সুযোগে মারিয়ামের হাতে গুঁজে দেবে বলে ও আপেলটা তুলে এনেছিল মায়ের ঘর থেকে। আপেল দিতে না পারার আক্ষেপে ওর ক্রোধ আরো বেড়ে গেল। ক্রিকেট বলের মতো ও আপেলটা ছুড়ে মারল তুষারের ভেতর।
একনাগাড়ে পড়েই গেলাম। আহা!এত মজা! মনে হচ্ছিল,ভারি মজার চমচম। ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক।