কোরআনে আছে—‘তাদের (পূর্ববর্তীদের) ঘটনায় অবশ্যই বুদ্ধিমানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত ১১১) কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিই না। কোরআনে আরেক জায়গায় বলা হচ্ছে—‘আমরা দিনগুলোকে মানুষের মধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দিই।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪০) এর তফসির খুঁজতে গেলে হেগেলের বলা সেই কথাটিই ঘুরে-ফিরে সামনে আসে—
Rulers, statesmen and peoples are primarily referred to the lessons of historical experience. But what experience and history teach is that nations and governments have never learned anything from history and have never acted in accordance with the lessons that could have been drawn from it.
‘শাসক, রাষ্ট্রনায়ক ও জনগণ ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলে থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস আমাদের এ শিক্ষাই দেয়—কোনো জাতি, কোনো সরকারই কখনও ইতিহাস থেকে কিছু শেখে না, এবং ইতিহাস থেকে পাওয়া শিক্ষা অনুযায়ী তারা কখনও কাজ করেনি।’
সিরিয়ার বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও ইতিহাসবেত্তা শাইখ মুহাম্মাদ আল আবদাহর একটি বই আছে— أيعيد التاريخ نفسه? (বাংলা অনুবাদে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে কি?’) এই বইতে তিনি লিখেন মুসলমানদের ইতিহাসে সব সময় দেখা গেছে নিজেদের মধ্যকার মতবাদর্শিক দ্বন্দ্বকে তারা দুশমনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় : জেরুসালেমে যখন ক্রুসেডাররা আক্রমণ করে, মিশরের শিয়া মতবাদের অনুসারী ফাতেমিরা তখন তাদের খ্রিষ্টানদের সমর্থন করে। কারণ প্রতিপক্ষ মুসলিমরা ছিল সুন্নি। তারা ক্রুসেড অভিযানকে খ্রিষ্টান-মুসলিম দ্বন্দ্ব হিসেবে না দেখে খ্রিষ্টান-সুন্নি দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেছিল। এক আল্লাহয় বিশ্বাসী ও এক নবীর উম্মত হওয়ার ধারণার চেয়ে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজনৈতিক মতবাদ।
এই ঘটনার এক হাজার বছর পর আমরা ঠিক বিপরীত এক চিত্র দেখতে পাচ্ছি : তৎকালের ফাতেমিদের জায়গায় আরব শাসকরা বসে আছে, যারা অর্থ ও ভূমি দিয়ে নব্য-ক্রুসেডারদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। শুধু তা-ই নয়, এই বোধবুদ্ধিহীন কাজকে আকিদার নাম দিয়ে ‘জায়েজ’ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের তাবেদার অ্যাক্টিভিস্টরা ইরানের ওপর আমেরিকা ও ইসরায়েলের হামলাকে ‘সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে সাহায্য করার প্রতিশোধ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছে। এমনকি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আরব মুখপাত্রকে পোস্ট করতে দেখা যায়—
نحن نحارب من أجلكم يا سنة المسلمين
আমরা তোমাদের হয়ে লড়াই করছি, হে সুন্নি মুসলিমরা!
ফিলিস্তিনে ৫৬ হাজারের বেশি সুন্নি শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষকে হত্যার পর ইসরায়েল বলছে তারা কিনা সুন্নিদের হয়ে লড়ছে! আর সেই কথা মনেপ্রাণে ধারণ করছে আমাদের দেশের বিশালসংখ্যক মুসলমান। ইতিহাসে একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্নভাবে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে।
হ্যাঁ, এ কথা স্বীকার করতেই হয় আকিদার প্রশ্নে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব থাকবেই। শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ)-এর মতো ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থি আলেমও শিয়াদের ব্যাপারে ‘নমনীয়’ হননি। তিনি ‘ওসিয়তনামা’ কিতাবে বলেন—
অধম রসুলে পাক (স)-এর রুহ মোবারকের কাছে প্রশ্ন করেছিল, ‘শিয়াদের সম্পর্কে হযরত কী বলেন—যারা আহলে বাইতের মহব্বতের দাবি করে, আবার সাহাবায়ে কেরামকে গালিগালাজ করে?’
রসুল (স)-এর রুহানি কালাম থেকে আমার মনে এই কথা নাজিল হয়:
مذہب ایشان باطل است و بطلان مذہب ایشان از لفظ امام معلوم می شود
‘তারা বাতিল (পথভ্রষ্ট)। আর তাদের বাতিল হওয়া নিজেদের সাথে ইমাম শব্দ যোগ করা থেকেই বোঝা যায়।’
আমি যখন (মোরাকাবা থেকে) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি, তখন ‘ইমাম’ শব্দটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবি। আমি বুঝতে পারি শিয়াদের পরিভাষায় ইমাম অর্থ হলো :
مَعْصُوْمٌ مُفْتَرَضَ الطَّاعَةِ مَنْصُوبٌ لِلْخَلْقِ
‘নিষ্পাপ হওয়া, এবং ইমামগণ সৃষ্টিকূলের জন্য নির্ধারিত ও তাদের আনুগত্য করা ফরজ।’
তারা এটাও বিশ্বাস করে যে ইমামের উপর ‘বাতেনি ওহি’ নাজিল হয়। আদতে তারা খতমে নবুওয়তের অস্বীকারকারী, যদিও মুখে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে ‘আখেরি নবী’ বলে। (ওসিয়ত ও নসিহত, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮, বাতায়ন পাবলিকেশন)
এরই সূত্র ধরে দেওবন্দি আলেমগণও বর্তমান ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ক্ষমতাশালী বারো ইমামিয়া শিয়াদের ব্যাপারে একই রকম ধারণা রাখে। তাদের ‘কাফের’ মনে করে না ঠিক, কিন্তু ‘আহলে হক’ থেকে খারিজ করে। (অবশ্য, নির্দিষ্টভাবে যারা স্পষ্ট কুফুরি আকিদা রাখে, তাদের বেলায় তাকফির করে। কিন্তু এই সংখ্যা অনেক কম এবং ব্যাপক নয়।)
তবে বর্তমান পরিস্থিতি আকিদার সাথে যুক্ত নয়, বরং রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এই মুহূর্তে প্রয়োজন তাদের আকিদা-বিশ্বাস একদিকে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেওয়া। ইসলামের ইতিহাসে এই ধরনের মৈত্রীচুক্তি নতুন নয়, খোদ আল্লাহর রসুল (স) এই কাজ করেছেন।
নবুওয়ত লাভের তিন বছর পর রসুল (স) যখন এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনার দাওয়াত দেন, তখন মক্কার সব মুশরিকরা তার বিরোধিতা করতে শুরু করে। ওই সময় পৃথিবীর দুই পরাশক্তি রোমান আর পারসিকরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছিল। মক্কার মুশরিকরা পারসিকদের সমর্থন করত। অন্যদিকে মুসলমানরা সমর্থন করত বাইজেন্টাইন রোমানদের। কারণ রোমানরা ছিল আহলে কিতাব, যারা চিন্তাভাবনায় মুসলমানদের কাছাকাছি। ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমানদের সাথে এক যুদ্ধে পারসিকরা বিজয়ী হয়। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সহায়তায় পারসিকরা তখন খ্রিষ্টানদের ওপর গণহত্যা চালায়। মক্কার মুশরিকরা এতে ভয়াবহ রকমের খুশি হয়, রীতিমতো উল্লাস করতে থাকে। অন্যদিকে খ্রিষ্টানদের সাথে আকিদায় কোনো মিল না থাকলেও মুসলমানরা খুব কষ্ট পায়। না মক্কার মুশরিকরা পারসিকদের সহায়তায় গিয়েছিল, আর না মুসলমানরা রোমান খ্রিষ্টানদের সহায়তায়। তবু পারসিক ও রোমানদের যুদ্ধের প্রভাব তাদের মধ্যে দেখা যায়, কারণ এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল রাজনৈতিক সুবিধা।
আল্লাহ তাআলা তখন সুরা রুম নাজিল করে মুসলমানদের এই আশ্বাস দেন, অচিরেই রোমানরা আবার বিজয়ী হবে। এই আয়াত নাজিলের পর তো শান্তশিষ্ট আবু বকর (রা) উবাই ইবনে খালফের সাথে বাজিও ধরেন—তিন বছরের মধ্যে পারসিকরা পরাজিত না হলে তিনি উবাইকে ১০টি উট দেবেন। অবশ্য সেই সময় বাজি ধরা হারাম ঘোষণা করা হয়নি। তিনি রসুল (স)-কে যখন এই বাজির ব্যাপারে বলেন, রসুল (স) তাকে নয় বছরের জন্য বাজি ধরতে বলেন, আর উটের সংখ্যা ১০০ করেন। যাই হোক, সাত বৎসর পর, বদরের যুদ্ধের সময়, এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়। রোমানরা পারসিকদের উপর বিজয়ী হয়। আবু বকর (রা) উবাই ইবনে খালফের পরিবার থেকে সেই ১০০ উট আদায় করেন, অবশ্য ততদিনে বাজি ধরা হারাম হয়ে যাওয়ায় রসুল (স) উটগুলোকে সদকা করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। (তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৭০৯-৭১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)
আশ্চর্যের বিষয় হলো, রোমানরা বিজয়ী হওয়ার কয়েক বছর পরেই, অষ্টম হিজরিতে মুসলমানরা তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। এমনকি আল্লাহর রসুল (স) ইন্তেকালের কিছুদিন আগে ওসামা বিন যায়েদ (রা)-এর নেতৃত্বে যে বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন, সেটাও ছিল রোমানদের বিরুদ্ধে।
হিজরতের পরপরই রসুল (স) মদিনায় ইহুদিদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হন—যা মদিনা সনদ নামে বিখ্যাত। এই চুক্তির একটি ধারা ছিল এমন—ইহুদিরা জান ও মালের নিরাপত্তা পাবে, তারা আক্রান্ত হলে মুসলমানরা তাদের প্রতিপক্ষকে সহায়তা করবে না, বিপরীতে মুসলমানদের ক্ষেত্রেও ইহুদিরা একই নিয়ম জারি রাখবে। এই চুক্তি মোতাবেক ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে একটি ‘ডায়ালগের’ সম্পর্ক তৈরি হয়, এই সময় ইহুদিদের আপত্তি কিংবা প্রশ্নের মোকাবেলায় অনেক আয়াত নাজিল হয়। এসব আয়াতে ইহুদিদের একগুঁয়েমি ও ওয়াদা না রাখার কথা ছিল। এরপরও তাদের সাথে মুসলমানদের সুসম্পর্ক ছিল, যতক্ষণ না তারা গাদ্দারি করে চুক্তিভঙ্গ করে।
ইতিহাসের এই পাঠ থেকে আমরা এ ধারণাই পাই—আকিদাগত সম্পর্ক ছাড়াও রাজনৈতিক সম্পর্কের একটি জায়গা আছে—যেখানে রাজনীতিটাই মুখ্য, ধর্মীয় অবস্থান নয়। বিশ্বরাজনীতি ও গত শতকের ইতিহাস থেকে আমাদের এই পাঠ নিতে হবে—এই মুহূর্তে কাকে সমর্থন করা ভবিষ্যতে মুসলমানদের জন্য লাভজনক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা যেভাবে সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, এবং নব্বই দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর যেভাবে তারা সাম্রাজ্যবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মূল্যবোধ সবার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, আর ইসরায়েল যখন আরববিশ্বকে নিজের মুঠোয় পুরে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাচ্ছে, তখন আকিদা-বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে তাদের শত্রু ইরানের বিরোধিতা করা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ছাড়া কিছুই নয়।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দাবি করে—আগে মূল শত্রুকে খতম করা, তারপর আস্তেধীরে ছোটখাটো শত্রুদের শায়েস্তা করা। আমাদের প্রধান শত্রু দখলদার ইসরায়েল ও তার মদদদাতা আমেরিকা, যেকোনো মূল্যেই তাদের বিরুদ্ধে থাকতে হবে। যখন দুনিয়ায় শক্তির ভারসাম্য পাল্টাবে, তখন ইরানের সমালোচনারও সুযোগ আসবে। আমরা কোনো জালেমকেই ছাড় দেব না।
লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমান হওয়া জরুরী, সুন্নি-শিয়া হওয়ার আগে
মাশাআল্লাহ ♥️ । অত্যন্ত চমৎকার বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ। আমাদের চিন্তাগত অনগ্রসরপনা দূরিকরণে এই লেখা খুবই সহায়ক হবে বলে আমার ধারণা।।